স ত্য জি ৎ চৌ ধু রী
কলা-সংস্কৃতি নিয়ে রচিত সাহিত্যের বড় অংশ শিল্পের নানা ধারার ইতিহাস, দার্শনিকের শিল্পতত্ত্ব, শিল্পের সমালোচনা। বিপুল এই সাহিত্যের আর দু-একটি, তুলনায় খুবই ছোট অংশ, শিল্পীদের নিজেদের লেখা, তাঁদের চিঠিপত্র, নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে প্রকাশিত ইশতেহার। পরিমাপে কম হলেও শিল্পীদের এসব বয়ানেরও ধারাবাহিকতা আছে এবং এ-সাহিত্যের ঐতিহ্যও বেশ পুরনো।
সাহিত্যের এই মহলে বাংলার শিল্পীদের রচনার পরিমাণ খুব কম নয়। পত্রপত্রিকায় চাপা পড়ে আছে অনেক লেখা, যা সংকলন ও সম্পাদনা করে সাজালে আমাদের আধুনিক শিল্পবিকাশের পেছনের শিল্পচৈতন্য ও মননের পরম্পরা অন্য মাত্রায় ধরা সম্ভব। যেমন পাই বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলীতে (অবনীন্দ্রনাথ) বা নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, চিন্তামণি কর, প্রদোষ দাশগুপ্তদের লেখায়। এঁদের রচনার বেশ অনেকটাই বইয়ে সংকলিত হওয়ায় সহজে পাওয়া যায়, কিন্তু এঁদেরও এবং আরো অনেকের কত যে রচনা খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকার পাতায় জরাজীর্ণ হতে হতে অবলোপের মুখে – তার হিসাব করে ওঠাও হয়নি কখনো। যেমন বীরভূমের অনেক প্রত্যন্ত গ্রামের তুচ্ছ কাগজে দেখেছি রামকিঙ্করের ছোট ছোট অনেক লেখা – যার কোনো শৈলীগত বাঁধুনি নেই, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মোক্ষম একেকটি বাক্যের এ দুর্ধর্ষ শিল্পীর উপলব্ধি একেকটি অব্যর্থ ঋকের মতো উচ্চারিত। এসব রত্নসম্ভারের আলো আড়ালে রেখে কী-ই বা আমাদের নন্দনচর্চার তাৎপর্য! আর শুদ্ধ বোধের উন্মেষই বা কী! ইউরো-আমেরিকার মনস্বীদের সুভাষিতর প্রতিধ্বনির পেছনে ধাওয়া করে কোথায়ই-বা পৌঁছব।
এইসব আক্ষেপময় ভাবনায় নতুন করে অভিঘাত এলো শ্রীমতী মীরা মুখোপাধ্যায়ের (১৯২৩-৮৯) কিছু বিক্ষিপ্ত লেখা আর তাঁর অসামান্য বিশ্বকর্মার সন্ধানে বইটির মধ্যে কিছুদিন ধরে নিবিষ্ট থাকার সুযোগে। মীরা মুখোপাধ্যায়ের গদ্যে আছে ঘনিষ্ঠ স্বর ফোটাবার অনায়াস শৈলী। তাঁর বাক্যে শব্দগুলি উঠে আসে শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়েপিটে নেওয়ার অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত উপলব্ধি থেকে। সরাসরি উঠে আসে। আত্মগরিমার ছটা থাকে না তাঁর বয়ানে, বরং থাকে এক বিনত-ব্যথিত অনুনয়। এই গদ্যশৈলী আমাদের তাঁর নিজস্ব ভুবনের অভিমুখে টেনে নেয়, তাঁর নিজস্ব শিল্পের ভুবনে। সে-ভুবনের অনেক বিফলতার, বিঘ্নের, ঠিক ঠিক নান্দনিক মাত্রা ছুঁতে না পারার নজিরগুলির কথা ফিরে ফিরে বলেন। কোথাও-বা উচ্চারণে কোনো কাজে সফলতা এসেছে যে ক্লেশ, যন্ত্রণা এবং শ্রমের তিতিক্ষায় – সেসব কথা বলেন। লেখায় যে-স্বরে, যে-শৈলীতে এসব উপলব্ধি তিনি মেলে রেখে গিয়েছেন, মনে পড়ে, তাঁর কাজ দেখতে গেলেও এমনি উচ্চারণে নিজের সারা জীবনের বিফলতা-সফলতার কথা অবিরল বলে যেতেন। এমন মানুষের লেখায় বা সান্নিধ্যে ঘনিষ্ঠ হওয়া খুব অনায়াস।
কোনো আড়াল না রাখা একান্ত কাছের মানুষ হয়ে ওঠে এই যা কিছু তিনি বলতেন বা লিখতেন তার মধ্যে জাগিয়ে তুলতেন অনেক জিজ্ঞাসা। তার মধ্যে ফুটত একজন প্রখর আত্মসচেতন শিল্পীর মন – যাঁর ‘আত্মা’ বা ‘আত্মতা’ আদৌ নিজের মধ্যে গোটানো নয়। নিরন্তর তিনি বুঝতে চাইছেন কলা-সংস্কৃতির পরিমন্ডলের কোন আলো, কোন দীক্ষা তাঁর পক্ষে উন্মীলনের সহায় হবে। খুব অল্প বয়স থেকেই মীরা মুখোপাধ্যায় নিজের মধ্যে শিল্পরুচির অস্ফুট রণন অনুভব করতেন। এই রুচি-প্রবণতাই কোনো শিল্পী-ব্যক্তিকে নিজের সংকল্প গড়ে নিতে সাহায্য করে। তাঁকেও করত। সংগীতে তাঁর স্বাভাবিক নৈপুণ্য শিক্ষার পরিমার্জনায় অনেকদূর এগিয়েছিল। কণ্ঠসংগীতে এবং সেতারে। অভিনিবেশ ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতে। কৈশোর থেকে গহরজানকে, কেশরবাঈকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা, গান শোনা – সে-সৌভাগ্য তাঁর মনের গড়ন নান্দনিক ছাঁচে বসে যেতে পেরেছিল, ‘আলো পড়েছে আমার মনে’ সংগীত তাঁকে চিরদিন টেনেছে। বিদেশে যাওয়ার সুযোগে পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর অভিনিবেশ অনেক গভীরে যায়, ‘মিউনিখে স্টিব কোয়াট্রেট গোষ্ঠীর মেম্বার ছিলাম, যাতে ওঁদের কোনো প্রোগ্রাম না বাদ পড়ে। এছাড়া অপেরা, ব্যালে, সিম্ফনি, অর্কেস্ট্রা সবেতে আমার উৎসাহ ছিল।’ সংগীতে, দেশি বা বিদেশি, এমনভাবে ‘ডুবে-যাওয়া’ সত্ত্বেও সুরকে প্রেরণা হিসেবে নিয়েছেন, আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আত্মকথায় মীরা মুখোপাধ্যায় বারবার বলেন – সংগীত তাঁকে নান্দনিক মুহূর্ত, নান্দনিক সফলতার চূড়ান্তে পৌঁছবার অভিজ্ঞতায় নিয়ে গেছে। বুঝতে শিখেছেন, সংগীত বা শিল্পের অন্য শাখায় তূরীয় দশায় পৌঁছনো সর্বদা ঘটে ওঠে না। সে-উত্তরণের জন্য সেধে যেতে হয়, কাজ করে যেতে হয়।
সংগীতের পথে নয়, চিত্রকলার পথে এগিয়ে অবশেষে চূড়ান্ত নির্বাচনে ভাস্কর্যে সিদ্ধির জমি পেয়েছিলেন মীরা মুখোপাধ্যায়। কোনো বাধ্যতায় নয়, নিজেকে খুঁজে পাবার অদম্য গরজে ত্রিমাত্রিক মাধ্যমটিকে আশ্রয় করেছিলেন। আর এখন আমরা জানি, এই শিল্পীর আত্ম-অনুসন্ধান তাঁকে নিয়ে গিয়েছে প্রায় অসাধ্য এক ব্যাপ্ত সন্ধানের ধারাবাহিকতায়। শিল্পী হিসেবে তাঁর পরিণতির ধাপগুলি এগিয়েছে শিকড়ের সন্ধানে – শিল্পের স্বদেশের খোঁজে। সারা ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে। তাঁর অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে, তাঁর সৃজিত শিল্পের ভুবন থেকে জেগে-ওঠা প্রশ্নগুলি ভারতীয় আধুনিকতার মূল সংকটের সামনে আমাদের সরাসরি দাঁড় করিয়ে দেয়।
দুই
ভারতীয় আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে কলাকৃতির পর্বটি শুরু হয়েছিল বেশ দেরিতে। যেমন আমাদের বাংলায় সাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা নিয়ে নিবিষ্ট ভাবনা মধুসূদন দত্তে প্রতিষ্ঠা পায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। মেঘনাদ বধ বাক্য আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম একই সালে, ১৮৬১-তে। আর নানান বাঁক ফিরে এই আধুনিক বাংলার সাহিত্য রবীন্দ্রনাথেরই হাতে ওই শতকের মধ্যেই দৃঢ় প্রতিষ্ঠাভূমি পেয়ে গিয়েছিল। বাংলা থিয়েটার বা গানের আধুনিক রূপ – সেও ততদিনে স্থির আশ্রয়ভূমি পেয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই প্রথম সচেতন আধুনিক শিল্পী ধরতে হয়। তাঁর এবং তাঁকে ঘিরে নতুন শিল্পী সংঘের আয়াস ও প্রতিষ্ঠায় ঊনবিংশ শতক প্রায় পেরিয়ে গেল। প্রায় চল্লিশ বছর পিছিয়ে আমাদের কলা-সংস্কৃতির বিলম্বিত সূচনা।
এ যেমন ইতিহাসের কথা, তেমনি এর স্মরণীয় তথ্য যে আমাদের কলা-সংস্কৃতির, শুধু বাংলারই নয় – পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতেরও, বিকাশ ও বাঁক-ফেরা ঘটেছে খুব দ্রুত। সতর্কভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, দুই দশকের মধ্যে এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে উত্তরণ ঘটেছে। সারা ভারতের পরিপ্রেক্ষিত ধারণায় রাখলে বুঝতে পারি, শিল্পে ভারতীয় আধুনিকতার বিকাশ শতমুখে বাহিত এবং আধুনিক শিল্পীমনের এই বিকাশে শতবিধ বিঘ্ন, অনতিক্রম্য জটিলতার বাধা – যা শিল্পীর সামনে এসে দাঁড়ায় ভারতীয় ইতিহাসের, ভারতীয় বাস্তবের অস্বাভাবিকতা থেকে। মীরাদেবীর ভাষায় – আমাদের ঘাড়ের ওপর ভিন্ন একটা সভ্যতা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো সচেতন শিল্পী এই ইতিহাসের সংকট, শাসকের সংস্কৃতির চাপ পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন না। সচেতনভাবে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়। বরং এটাই, এই সচেতনতার মাত্রাই ভারতীয় আধুনিক শিল্পীর প্রতিভার মূল্যগৌরব নির্ণয়ের এক মাপক। বিক্ষত, ধস্ত স্বদেশ। অসাড় কিংবা বিকারগ্রস্ত মনের জমি। তার মধ্যে কোথায় পাব গৌরব করার মতো কোনো শিল্পের স্বদেশ!
নিজেকে চেনার জন্যই, নিজের দাঁড়াবার জমি তৈরির জন্যই
স্রষ্টা-শিল্পীকে শিল্পের স্বদেশ অন্বেষণ করতে হয়। এই বোঝাপড়ায় কে কতটা শ্রম স্বীকার করেছেন, সে-অভিজ্ঞতার স্তরে স্তরে নিজেকে কে কেমন করে ভেঙেচুরে গড়েপিটে তুলেছেন – এই বিবেচনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অন্তত মীরা মুখোপাধ্যায়ের কাজকর্মের, ভাবনাচিন্তার কথায় এড়ানো সম্ভবই নয়।
তিন
মীরা মুখোপাধ্যায়ের মনের আধুনিকতা, আধুনিক সচেতনতা তাঁকে দুদিকে টানে, দুইমুখী ভাবায় থমকে দেয়।
একদিকে আছে হাত দুরস্ত করার আয়াস। একটা রেখা – যা শিল্পকাজের ভিতের মতো, সে-রেখা ঠিক আমারই রেখা হয়ে উঠবে কী করে – অসহ তিতিক্ষায় সেই প্রাতিস্বিক রূপ-অয়ন-শৈলীর সন্ধান করেন। কতবার যে বলেন – কিছুই হচ্ছে না বুঝতে পারি, কী করে যে হয় বুঝতে পারি না। বলেন, জ্ঞান লাগে, উপলব্ধির অব্যর্থতা লাগে, বৈরাগ্য লাগে – নিস্পৃহ হয়ে যেতে হয়। বড় গভীর সত্য আছে তাঁর এই সরল, সাদাসিধে উচ্চারণে। শিল্পের আধুনিক নন্দনে এ সত্য মান্য – শিল্পের কাজে এক জটিল বহুস্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, তার জন্য প্রয়োজন বৈরাগ্য নৈরাত্মতা – ডি-পারসোনালাইজেশন। ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া বা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সৃজন সিদ্ধির অভিমুখ পায় না। এই নন্দন প্রতিষ্ঠায় মীরা মুখোপাধ্যায় মাঝে মাঝে চমকে দেওয়ার মতো সুভাষিত উচ্চারণ করেন। ‘এখন আমি জানি আমাদের সভ্যতার জ্ঞান দিয়ে গড়ন বার করেছে।’ জ্ঞান অর্থ নিশ্চয়ই ‘রূপজ্ঞান’। গড়ন অর্থ নিশ্চয়ই ‘ফর্ম’। বস্ত্তকে প্রাকৃত থেকে শিল্পীর অভিপ্রায় মতো, ধ্যানের অনুপাত মতো কোনো শিল্পিত গড়নে নিয়ে যেতে হয় একটি পদ্ধতির ভেতর দিয়ে। সে-পদ্ধতির কোনো ছক থাকতে পারে না। শিল্পীতে শিল্পীতে পদ্ধতি স্বতন্ত্র হবেই। এক সৃজন-উদ্দীপনায় শিল্পী তাঁর শিক্ষাদীক্ষা, অভ্যাস, স্নায়বিক উদ্যম অনুযায়ী কাজের দিকে অভিনিবেশ চালনা করেন। তাঁর শারীরিক ব্যক্তিত্বের সীমা তো হাতের আঙুলগুলির উপান্ত অবধি। সেই উপান্তে তাঁর আমিত্বর, আত্মতার সীমা। কাজের জন্য হাতে তুলে নেন কলম বা তুলি বা ছেনি-হাতুড়ি, হাতে তুলে নেন নমনীয় মোম বা মাটি। গড়নের আয়োজন, রূপের ‘অয়ন’ সূচিত হয় সেই মুহূর্ত থেকে। নিয়ন্ত্রণ থাকে টানটান চৈতন্যে, মান-পরিমাণের বিচার-বিবেচনায়, অতন্দ্র-নন্দন-জ্ঞান। মীরা মুখোপাধ্যায়ের নন্দন-ভাবনায় একটি অনন্য সূত্র : ‘জ্ঞান দিয়ে গড়ন সৃষ্টি করেন শিল্পী।’
এই প্রজ্ঞার অনুষঙ্গে আরো কিছু কথা বলেন। সেসব কথার ভেতরে তন্তুর মতো জড়িয়ে আছে নিজের কাজের অভিজ্ঞতা এবং দেশময় হাতের কাজে লিপ্ত শতসহস্র ‘কর্মী’র – কখনই এঁদের মীরা মুখোপাধ্যায় ‘কর্মী’ বলেন না, বলেন স্রষ্টা, বলেন বিশ্বকর্মা – সেই স্রষ্টা-বিশ্বকর্মাদের কাজ দেখার অভিজ্ঞতাসার। সৃষ্টির পদ্ধতির দিক থেকে এই আনুষঙ্গিক কথাগুলি গূঢ় নান্দনিক তাৎপর্যের। এ তাৎপর্য বিবেচ্য প্রশ্নের আকারে এভাবে সাজানো যায় –
শিল্পী ব্যক্তির ‘আত্মতা’ যেমন সত্য, যে-বস্ত্ত তিনি ব্যবহার করছেন তারও আছে ‘আত্মতা’। সব মাটি সমান নয়, প্রাকৃতিক উপাদানে পাথরে পাথরে ভেদ আছে, অনন্ত ভেদ ধাতুর চরিত্রে, এমনকি কাগজ বা ক্যানভাসের কাপড় বা কাঠ – সব বস্ত্তরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তাই প্রশ্ন উঠবেই – শিল্পীর ‘আত্মতা’ আর ‘বস্ত্ত’র আত্মতায় সম্পর্ক কী? কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করে? মুগনি পাথর আর মাক্ড়া পাথর কি একই মাত্রায় আঘাত সইতে পারে, বেলে পাথর আর শ্বেত পাথর? ব্রোঞ্জ আর পিতল চরিত্রে এক নয়, বর্ণে এক নয়। মাটি রং ও স্বভাব-ধর্মে কত ভিন্ন ভিন্ন। জলরং, ট্যামপেরা, তেলরঙের চরিত্রেও ফারাক অনেক। শিল্পে প্রাকৃত বস্ত্তর রূপান্তরণ ঘটে ঠিকই; কিন্তু বস্ত্তকে কোনোভাবেই তার স্বভাবচ্যুত করা যায় না। শিল্পীর অনলস চেষ্টা বস্ত্তকে বাগে আনা, বস্ত্তত শিল্পীকে বশীভূত হতে বাধ্য করতে পারে। কোথাও একটা সমঝোতায় আসতেই হয়, রফা করতে হয়। এ এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা – যার ভেতর দিয়ে সব শিল্পীকেই যেতে হয়। এই দ্বন্দ্বে বস্ত্তর আদি গড়ন যেমন ভাঙে তেমনি শিল্পীর মূল প্রকল্পও বদলে যেতে পারে। যায়ও।
এ দ্বৈতাদ্বৈতকে কেমন সংকল্পে বাঁধবেন, কীভাবে উত্তরণের উপায় করবেন শিল্পী – বাইরে থেকে কেউ বলে দিতে পারে না, কোনো শাস্ত্র, বিধিবিধান বা কোনো গুরুর নির্দেশ এখানে খাটে না। বিশেষ শিল্পী তাঁর বিশিষ্ট উপলব্ধির কথা সৎভাবে জানাতে পারেন শুধু। যেমন মীরা মুখোপাধ্যায়ের উপলব্ধি : ‘আমার মনে হচ্ছে ধাতুর ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে চলতে হবে। আমি বোধ করি, তার আমার মতো প্রাণ আছে। সে-কথা বলে, সাহায্য করতে চায়, সে ভালোবাসা চায়। যে-ভালোবাসা এক মুহূর্তের জন্যেও নড়চড় হবে না।’
‘ধাতু কোনোরকম গাফিলতি আর অন্যমনস্কতাকে ক্ষমা করেনি। আগুনের মতো শক্তি নিয়ে সে আমার সমস্ত সত্তাকে পাকড়ে রেখেছে। আর আমিও আমার শক্তি আছে কী নেই এ নিয়ে প্রশ্ন করিনি।
ভালোবেসে কাজ করে গেছি।’ (‘স্পন্দন’, দেশ, সাহিত্যসংখ্যা ১৩৯৯, পৃষ্ঠা ৪৯-৫০)।
খুব জোর দিয়ে, প্রত্যয়সিদ্ধভাবে নিজের নান্দনিক অবস্থানের কথা বলছেন মীরা মুখোপাধ্যায়। তাঁর উচ্চারণের ঝোঁক বুঝে একটু তলিয়ে গেলে অনুভব করা যায়, বস্ত্তত নিজস্ব ধর্ম তাঁকে বশ করে নেয়। নিজেকে তিনি পরিপূর্ণ নিবেদন করে দেন বস্ত্তর কাছে। একটা নিয়ন্ত্রণের কথা তবু থাকে – ভালোবাসার নিয়ন্ত্রণ। ‘ভালোবেসে কাজ করে গেছি।’ শিল্পে তাঁর
মুক্তি এলো ধাতুর কাজে। গানের কথা, ছবি অাঁকার সফলতা-বিফলতার কথা ছাপিয়ে ধাতুর কথাই বড় হয়ে ওঠে তাঁর আলাপচারিতায়, লেখায়। ধাতুর, বিশেষত ব্রোঞ্জের স্বভাবধর্ম নিয়ে এমনভাবে বলেন, যেন ধাতু কোনো জড়বস্ত্তই নয়, ধাতুর যেন মান-অভিমান আছে। শিল্পীর কাছে দাবি আছে। ধাতুও হয়ে উঠেছে মানবিক গুণে অন্বিত।
‘ওরা আসে কিন্তু আর ছেড়ে যায় না। সুখে-দুঃখে ওরা আমার আঙুলে নাচানাচি করে। আসে প্রাণের গভীর থেকে।’
‘আমি নানা দিক দিয়ে এই ধাতুকে পরখ করেছি – সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও। তরল হলে সে ছুটতে পারে। আবার একেবারে নারাজ হলে বসে ত যাবেই – কত রকম যে হবে তার ঠিক নেই। আবার ভালো হলে জালি জাতীয় সকল রকম সূক্ষ্ম আকৃতির নক্সা হতে পারে। ধাতুর কাজ করতে একমাত্র নির্মাণের বিধি অনুসারে না পড়লে আমি অন্য কোনো মাধ্যমের চরিত্র আনিনি। যেমন পাথরের মধ্যে যে ভারি চরিত্র থাকে তার ঠিক উল্টো বরণ করেছি।’ (আগের সূত্র : পৃষ্ঠা ৪৭, ৫০)
মীরা মুখোপাধ্যায় একে বলেন, ‘সত্যনিষ্ঠা’। মাধ্যমের সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা জন্মায় এই সত্যনিষ্ঠায়। শিল্পীর অহমিকা ভেঙে যায়, নিজেকে মাধ্যমের দাবির কাছে সঁপে দিতে কোথাও বাধা পান না। একজন শিল্পীর এই ব্যক্তিগত শিল্পদর্শনের মধ্যে নন্দনতত্ত্বের সাধারণ সূত্র অবশ্যই প্রচ্ছন্ন আছে। শিল্পীর ধ্যান-কল্পনা আর তাঁর মাধ্যম শেষ অবধি এক সুরে বাঁধা না হলে সৃজনের কাজ কখনো ফলবান হতে পারে না। এই শিল্পী বলছেন, প্রাণ থেকে স্ফুরিত ভালোবাসার টানে তিনি কেবলই তাঁর উপকরণের দিকে চলেছেন। মিলনের জন্য। উপকরণ বস্ত্তটির নিজস্বতা আদৌ আচ্ছন্ন না করে, তার শিল্পগত সম্ভাবনা পুরো ষোলো আনা কাজে লাগানোয় নিজেকে ‘উৎসর্গ’ করেছেন। অহংকে ভেঙে এমন করে নিজেকে বস্ত্তর সঙ্গে মেলানো – এই এক মহামূল্য সূত্র মীরা মুখোপাধ্যায় নিজের জীবনব্যাপ্ত শ্রমে অর্জিত সফলতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
চার
বলছিলাম, তাঁর আধুনিক আত্মসচেতন মন নিরন্তর দুদিকে টানে। এক তো সৃজনের বিধি – সে-কথা এতক্ষণ বলা গেল। অন্য কথা – সৃজনের বিধিকে দাঁড় করাবেন কোন জমিতে – এই তাঁর আরেক অন্বেষা। একে বলা চলে – শিল্পের স্বদেশ খুঁজে ফেরা। তাঁর শিল্পশিক্ষার সূত্রপাত সমকালের আরো অনেকের মতো অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের পোষকতায়। বাংলায় একটি রীতিপদ্ধতি বাঁধা হয়েছিল ততদিনে। অবনীন্দ্রনাথ চান বা না-চান তাঁর ছাত্ররা গুরুর একটা বিশেষ পর্বের কাজের ধারা অনুসরণ করে ভারতীয় আধুনিক শিল্পের বাতাবরণ তৈরিতে নিয়োজিত ছিলেন। এঁরা ভারতীয় শিল্প জাগিয়ে তুলতে ব্রতী কিন্তু অনেকেই শিল্পের ভারতীয়ত্ব দেশের বাস্তবে খোঁজার শ্রম স্বীকার করেননি। এক চূড়ান্ত ব্যতিক্রম নন্দলাল বসু। এই মানুষটি তত্ত্বের ঘোরের মধ্যে বুঁদ না হয়ে দেশময় ঘুরে ঘুরে নজির খুঁজে ফিরেছেন। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ভিত্তিচিত্র, পটপাটা, ঘরবাড়ির গড়ন, মাটির-ধাতুর-তৈজসের গড়ন, গহনা, পরিচ্ছদ – দেশের মানুষের এই বিচিত্র সৃজন নন্দলালের মতো প্রত্যক্ষজ্ঞানে আর কেউ জানতেন না। এই অন্বেষণ, শিল্পের স্বদেশকে জানার এমন তাড়না পরের প্রজন্মে এক মীরা মুখোপাধ্যায়ের জীবনে দেখতে পাই।
ধাতুর কাজে মন বসল। ইউরোপ ঘুরে আসা ভারতীয় শিল্পী। আধুনিকতম ধাতুশিল্পের যাবতীয় পদ্ধতি তাঁর গোচরে ছিল। কিন্তু
সে-শিক্ষার পথে যে স্বদেশের মর্মে পৌঁছনো যাবে না এই স্থির প্রত্যয় তাঁর সংকল্পের মেরু হয়ে ওঠে। নির্মলকুমার বসুর প্রভাব পড়েছিল তাঁর ওপর, নিজে খুব কৃতজ্ঞমনে সেই প্রভাবের কথা বলেওছেন। তাঁকে অনেকটাই স্বদেশের মুখে চালনা করেছিলেন নির্মলকুমার বসু। বলছেন, ‘নৃতত্ত্ব বিভাগে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ আমাকে দেওয়া হয়, তার জন্য আমার কোনো অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা ছিল না, কিন্তু ততদিনে বিভিন্ন ব্যবহারিক পরীক্ষা করে করে সে-যোগ্যতা আমি অর্জন করেছিলাম। আমার কাজের ওপর প্রফেসর নির্মলকুমার বসুর বিশ্বাস জন্মাল।
‘নির্মলবাবুর প্রভাব আমাকে সারাজীবন সমস্ত জিনিসের প্রতি ঔৎসুক্য সৃষ্টি করে গিয়েছে।’
গান্ধীজির সচিব নির্মলকুমার বসুর স্মৃতি ধূসর হয়ে গিয়েছে। তাঁকে স্মরণ করতে পারবেন আজকের দিনে তেমন মানুষ খুব বেশি আর নেই। অধ্যাপক বসু নৃতত্ত্ববিদ্যায় পারঙ্গম ছিলেন বললে কিছুই বলা হয় না। তাঁর কাজের পদ্ধতিই ছিল বাঁধাধরা অ্যাকাডেমিক পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। পশ্চিমের আমদানি-গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বিতৃষ্ণ ছিলেন। তাঁর প্রত্যয় ছিল কোনো তত্ত্বের ছকের মধ্যে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার সত্য পরিচয় ধরা সম্ভব নয়। ডিগ্রিধারী ‘বিদ্বান’দের ওপরে তাঁর বিশেষ ভরসা ছিল না। দেশকে জানার জন্য, চেনার জন্য, জনজীবনের স্রোতের মধ্যে নেমে যেতে উৎসাহ দিতেন। দুস্থ এই দেশে খেটে-খাওয়া মানুষের কাজের নিষ্ঠা, উৎপাদনের বৈচিত্র্য, হাতের কাজের শিল্প-নৈপুণ্য – একেবারে তাদের জীবনে মিশে না গেলে জানার উপায় নেই। অধ্যাপক বসু তাই দেশের কলা-সংস্কৃতির বহতা ধারার মধ্যে নেমে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন, শ্রমে অকুণ্ঠ তরুণ-তরুণীদের এই বাস্তবে যাওয়ার উপায় করে দিতেন। তাঁরই এক অভ্রান্ত নির্বাচন মীরা মুখোপাধ্যায় – যাঁর সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলা যায় – নন্দলাল বসুর পরে আমাদের শিল্পীদের মধ্যে স্বদেশের শিল্পের বাস্তব সম্পর্কে এত প্রত্যক্ষ জ্ঞান আর কারো ছিল না, আজো নেই।
ধাতুর কাজে অভিনিবেশ গাঢ় হলো ক্রমে এবং শৌখিন চর্চার স্টুডিওতে নিজেকে আটকে না রেখে মীরা এই দেশময় ছড়ানো ধাতু-কারিগরদের সঙ্গে কাজে যুক্ত হবার আকুলতা বোধ করলেন। তখনকার শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর তাঁকে গেজেটেড অফিসার করে দিতে চেয়েছিলেন। সরকারি শিক্ষাকেন্দ্রে কর্ত্রী হয়ে বসতে পারতেন। সেসব সুযোগ উপেক্ষা করে গেলেন বাস্তারে। কখনো সরকারি বৃত্তি নিয়ে, কখনোবা নিজেরই সামান্য সামর্থ্যে ভর করে দেশময় ঘুরেছেন। ধাতুশিল্পীদের সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন – এমনকি তাদের হুকুমমাফিক কাজে হাত লাগিয়েছেন। অতিবিচিত্র সে-অভিজ্ঞতার আশ্চর্য বিবরণ নিজেই লিখে গিয়েছেন তাঁর এক অসামান্য রচনা বিশ্বকর্মার সন্ধানে (১৯৯৩) বইয়ে। দেশজ শিল্পের কথা নিয়ে এত মূল্যবান বই ইদানীং আর হয়নি। মীরা মুখোপাধ্যায় না জানালে কী করে জানা যেত ধর্মাচরণে ভেদ সত্ত্বেও সারা ভারতে ধাতু-কারিগররা সকলেই নিজেদের বলেন বিশ্বকর্মা। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধভেদ নেই – সকলেরই এক আত্মপরিচয়।
কত প্রাচীন ভারতের এই ধাতুশিল্পের ঐতিহ্য? মীরা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা এবং সমীক্ষার বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয়, ‘অতি গভীর তার মূল, প্রায় আমাদের জানিত সভ্যতার শুরু থেকেই এর সূচনা।’ তাঁর পর্যবেক্ষণ শুধু প্রসিদ্ধ স্থাপত্য-ভাস্কর্যের দৃষ্টান্তে নিবদ্ধ থাকেনি। দেশের দুর্গমতম অঞ্চলেও গিয়েছেন, সেসব অঞ্চলের কারিগরদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন। এই বাস্তবের জমি যত স্পষ্টভাবে চিনেছেন ততই শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কে প্রসিদ্ধ পৌরাণিক আখ্যানগুলি তাঁর কাছে নতুন তাৎপর্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ক্রমে তিনি নিজের অর্জিত সাক্ষাৎ জ্ঞানে স্বদেশের আবহমান সৃজনপ্রতিভার ব্যাখ্যাসূত্র সংগঠিত করেন। এসব সূত্র এবং প্রখর শিল্পবোধের আলোয় আমাদের পূজা-পার্বণের, দেবদানব বিরোধ নিয়ে আমাদের পুরাণের মর্মে প্রবেশ করেন। জাতীয় পুরাণ ইতিহাস নয়, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসের বহু অবলেশ পুরাণের আলৌকিক আখ্যানে মিশে থাকে। সে চূর্ণকগুলি নিজের বোধের মধ্যে একটা যুক্তিযুক্ত কাঠামোয় সাজিয়ে তোলা – সেও এক গুরুত্বময় নান্দনিক
মনন-প্রক্রিয়া। মীরা মুখোপাধ্যায়ের এই মনন-প্রক্রিয়ার তাৎপর্য আলাদা করে বিবেচনাযোগ্য। অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে তাঁর মনন, তাঁর শিল্পীমনের স্বাদেশিকতা, তাঁর নিজস্ব সৃজনপ্রতিভার বিকাশ ও উত্তরণ উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়, তাৎপর্যময় আলো মেলে এই শিল্পীর বয়ান থেকে।
পাঁচ
সমকালীন অপর অনেক খ্যাতিমান শিল্পীর মতো মীরা মুখোপাধ্যায় আধুনিক শিল্পের বড় রাস্তার অভিজ্ঞতার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইউরোপের নামি শিল্পকেন্দ্রে কাজও করেছেন। আবিম্ব শিল্পপ্রগতির ধারাগুলির পরিচয় জেনেবুঝেই শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মবিকাশে গ্রহণ-বর্জন-নির্বাচন নীতি নির্ণয় করেছিলেন। তাঁর নির্বাচনে অপরিসীম সাহস বিস্মিতই করে। চূড়ান্ত নির্মাণে তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত করেন – উপেক্ষা-লাঞ্ছনায় পর্যুদস্ত করেন – উপেক্ষা-লাঞ্ছনায় পর্যুদস্ত হওয়া সত্ত্বেও যে শিল্পী-কারিগরেরা আজো দেশজুড়ে নিজেদের সৃজনকলা, নিজেদের পদ্ধতি অাঁকড়ে আছেন – তাঁদেরই কাছে কাজ শিখবেন। তাঁদের পদ্ধতিতেও যে আধুনিক রুচি ও মনন প্রকাশ করা যায় – এই দৃঢ় প্রত্যয় আশ্রয় করে তিনি এক নিজস্ব শিল্পনীতি অনুসরণ করলেন এবং একালের রুচির সঙ্গে আবহমান লৌকিক ঐতিহ্যের, দেশের শিল্পের শিকড়ের সংযোগ ঘটালেন। খুব তৃপ্ত স্বরে বলেন, ‘সেদিক থেকে যখন দেশে আমি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কারিগরদের কাজ দেখি, যেন আমার প্রাণের মধ্যে একটা মুক্তি পেয়েছিলাম। দেশকে চেনা – দেশের ধমনির মধ্যে প্রাণের যে-শক্তি বয়ে চলেছে তার আন্দাজ করা, প্রাণে আমার বিশেষ আনন্দ দিয়েছিল। কারিগরদের জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম প্রতিদিনের দুঃখকে যেন তারা হাতুড়ির ঘা দিয়ে দিয়ে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিত।’ (আগের সূত্র, পৃষ্ঠা ৪৭)। কোথায় মিউনিখ আর কোথায় বীরভূমের দুস্থ ধোকরা কামার বা বাস্তারের নানা সম্প্রদায়ের ধাতু-কারিগর কিংবা এখনকার পাকিস্তানের বুমবুরেট ও গেমবুর অঞ্চলের কলস সম্প্রদায় – যেন দুই আলাদা বিশ্ব, পৃথক ভুবন। মিউনিখ আর্ট অ্যাকাডেমির সতীর্থ বন্ধুরা নয়, মীরাদেবীকে গোলবিবি, হারানের মা, নূরবানু, অসিত, প্রশান্ত নস্কর প্রাণের টানে টানে। টানে হাজারো দুঃখের ভর তুচ্ছ করে কাজে ডুবে-যাওয়া কারিগরেরা। এঁদের সঙ্গে একাত্মতায় তিনি সমগ্র সত্তায় একটি গভীর সত্য পেয়ে যান – শিল্পীর পক্ষে শ্রমের চেয়ে, সৃজনের মধ্যে মগ্নতার চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। সেই হলো শিল্পীর ধ্যান, ধর্ম। নিজেকে তো সব শিল্পীকেই খুঁজে পেতে হয়, কিন্তু পেতে হয় নিজের স্বভাবে। এই স্বভাবের অব্যর্থতা মীরাদেবী তাঁর শিক্ষকতুল্য ইন্দোনেশীয় শিল্পী আফান্দির মধ্যে দেখে প্রেরণা পেতেন।
বিরাট আকারের ছবি করতেন আফান্দি। তাঁর কাজে প্রকাশ পেত রং ও গড়নের প্রচন্ড শক্তি। তিনি কাজের মধ্যে এমনভাবে ডুবে যেতেন যে-মনে হতো কাগজ-রং-তুলি তাঁর দেহেরই অংশ। সেই শক্তির অভিব্যক্তি ভয় পাইয়ে দিত। কান্না পেত তাঁর। কারিগরদের কঠোর মেহনতের মতোই এই শিল্পীর কঠোর মেহনত মীরাদেবীকে শিল্পকর্মে শ্রমের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছিল। ধাতু ঢালাই-পেটাই – সে প্রচন্ড শ্রমের কাজ। সে-শ্রম তাঁকে পরম মুক্তির, পরম চরিতার্থতায় ভরপুর করে তুলত। ধাতু কোনো রকম গাফিলতি বরদাশত করে না। ধাতু নিয়ে কাজে তিনি ধাতুর বশ্যতা মেনে, শিল্পীর ‘আত্মতা’ অভিমান বিলীন করে দিয়ে কাজ করেছেন। সারা জীবনের সৃষ্টিময় শ্রমের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি এক আশ্চর্য উপলব্ধির কথা বলেন, আমার মনে হয়, সবচেয়ে ভাগ্যবান তারা, যারা রাস্তায় ঘর্মপাত করে, শারীরিক পরিশ্রম করে উপার্জন করে, এটা আমার মনে হয়।…তারা সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান, মানসিক ও শারীরিকভাবে, যারা কায়িক পরিশ্রম করে। আমার অনেক কাজে আমি কায়িক পরিশ্রমকে বড় করেছি।…।’
দেশময় কায়িক শ্রমে যারা নানা তৈজস নানা প্রয়োজনের সামগ্রী উৎপাদন করে তাদের হাতের কাজ মানুষের ব্যবহারে লাগে। উৎপাদনগুলি ব্যবহারের জিনিস হয়ে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। শিল্পের কাজও তেমন জীবনে জড়িয়ে গিয়ে সার্থকতা পাবে – এ তাঁর ভাবনা জুড়ে থাকত। সে তো হওয়ার নয়। একালে শিল্প হয়ে গেল প্রদর্শনীতে সাজিয়ে রাখার জিনিস। এই আক্ষেপেও মীরা মুখোপাধ্যায়ের সেই একই টান প্রকাশ পায় – দেশের জীবনে জড়িয়ে দেশের শিল্প কাজের যথার্থ চরিতার্থতা। শিল্প কোনো বিলাস নয়, শ্রমে-ঘর্মে,
জয়ে-পরাজয়ে মিলিয়ে যে জীবন তারই মধ্যে শিল্পের বসবাস।
কাজের মধ্যে নিরলস লিপ্ততা, দেশি রীতিপদ্ধতি পরিপূর্ণ আয়ত্ত করে, সেই লোকশিল্পীদের নিয়েই তিনি কাজ করলেন অথচ তাঁর কাজে উঠে এলো আধুনিক কাল, সমকালের জীবন পরিবেশ। এই সন্নিহিত, মাটিঘেঁষা বিষয়বস্ত্তর প্রকাশ নিয়ে নিরন্তর শৈলীগত পরীক্ষা করেছেন। তাঁর হাতের ব্রোঞ্জ অবয়ব-আশ্রিত, চরিত্রের পর চরিত্র আসে তাঁর কাজের ধারায়। বিমূর্ততা তাঁকে বিশেষ টানেনি। চলতি জীবনপ্রবাহে, শ্রম-নিরত সচল সজীব অবয়বে গতিভঙ্গির অন্তর বৈচিত্র্য তাঁকে যেন অভিভূত করত। সেই সচলতা প্রকাশের জন্য তিনি অবয়বকে বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক মাপজোখ ভেঙে অতিকৃত করেছেন, কিন্তু সাদৃশ্যের বিলোপ ঘটিয়ে নিছক রেখার বিমূর্ততা আশ্রয় করেননি। এই কারণেই বোধহয় তাঁর কাজের মধ্যে জীবনের প্রতিচ্ছবিই দেখি – কিন্তু দেখি মান-পরিমাণের হেরফের ঘটানো অভিব্যক্তির তীব্রতায়। যেমন ‘নিত্যযাত্রী’ কাজটির দীর্ঘ উত্তোলিত হাতের সারি বা নাচ-গানের মূর্তিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসম মান-পরিমাণ। ‘নৃত্যের তালে তালে’ কাজটিতে তিনি জোড়া মূর্তিতে এক ছন্দে যুগলে সাজানোর বিন্যাসে-দেহভঙ্গির সচলতা একটি তালে একসূত্রে বাঁধা। একক এবং সমবেত মূর্তি – সর্বত্রই দেখা যাবে অবয়বকে অভিব্যক্তিময় করে তোলার বিশিষ্ট শৈলী – যা তাঁর আধুনিক শিল্পজ্ঞানের স্মারক, আবার জীবনে জীবন যোগ করার ব্যাকুলতারও নজির। গড়নের বিশিষ্টতার জন্যই এক একটি কাজে মূর্ত চরিত্রের ব্যক্তিত্ব দর্শকের উপলব্ধিতে চিরত্ব পেয়ে যায়। দেখামাত্র চেনা যায়, এ তাঁরই হাতের কাজ। চোখ বুজলে এখুনি দেখতে পাব ধুলোয় বসে গান গাইছে ‘কালাচাঁদ’ – মসৃণ তার মুখে আলোছায়ার খেলা। সুর বুনে তোলার তন্ময়তায় আকাশমুখী এক চরিতার্থ শিল্পী। এমন কত যে মুখ, কত বিচিত্র আবেগে আন্দোলিত দেহভঙ্গি – মন ছেয়ে আসে : অবিস্মরণ, প্রাণিত এক মানবিক ভুবন – যার স্রষ্টা শ্রীমতী মীরা মুখোপাধ্যায়।
সমকালের সংকট, বিপন্নতা, কোথাও-বা অব্যর্থ অবয়ব পায় – যেমন ‘অশোক’ মূর্তিটিতে। এগারো ফুটের এই বিরাট মূর্তিটির পায়ের গোছ, হাত বা কাঁধের পেশি এক শক্তিময় ব্যক্তিত্ব ফোটায়। হাতে অস্বাভাবিকভাবে ধরা বিরাট আকার অস্ত্র। এ কি রণোন্মাদ অশোক? তা নয়, হিংস্রতার, রক্তপাতের বীভৎস অভিজ্ঞতায় বিহবল অশোক – যার মুখে রয়েছে বিপন্নতার অভিব্যক্তি। যার হাতের অস্ত্র উদ্যত নয়, মাটি ছোঁয়া। অবিরল রক্ত-ঝরানো বাংলার সত্তরের দশক মূর্তিটিতে সেই সময়ের বিহবলতার ছাপ রেখে গিয়েছে।
অখন্ড ভারতজুড়ে ভাস্কর্যের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। শুধু যে শাস্ত্রের বিধিবিধান মেনে দেবদেবী গড়া হয়ে এসেছে তা নয়, পাশাপাশি চলে এসেছে শিল্পীদের স্বাধীন ইচ্ছাসুখের কাজ। দেশের প্রান্তে প্রান্তে স্থাপত্যের অলংকরণে খোদাই কাজে জ্বলজ্বল করছে মানবিক জীবন প্রবাহের ছবি, পাথরে, পোড়ামাটিতে, ধাতুশিল্পে। উপমহাদেশ জোড়া এই যে শিল্পকাজের সমারোহ, সামাজিক পরিপোষণ হারিয়ে ক্রমে নিস্তেজ, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। ইতিহাসের মার খেল এই ঐশ্বর্যময় শিল্পের স্বদেশ। ঔপনিবেশিক শাসনের আদিপর্বে সাহেব-পন্ডিতরা এমন কুৎসাও করেছেন, ভারতের প্রসিদ্ধ স্থাপত্য-ভাস্কর্য সব গ্রিসরা করে রেখে গেছেন। দেশীয় ঐতিহ্যের আধুনিকতায় উত্তরণ স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি। ভাস্কর্যে আধুনিক পর্বের সূত্রপাত ততো বেশ বিলম্বিত। রামকিঙ্কর বেইজের কাজে, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায়। এই আধুনিক পর্বের বিকাশ অবশ্য বেশ দ্রুত, শক্তিমান ভাস্করদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এঁদের মধ্যে আর কেউ হারিয়ে যাওয়া শিল্পের স্বদেশ নতুন করে আবিষ্কারে, ঐতিহ্যের ছিন্নসূত্র আধুনিক চৈতন্যে গেঁথে নেওয়ায় মীরা মুখোপাধ্যায়ের মতো এত মেহনত করেননি।