logo

‘মাটি ও মানুষ’ চিত্রকর্মের প্রদর্শনী

এম  সা ই দু জ্জা মা ন

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর বাংলাদেশে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সারির শিল্পী ছিলেন, যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, নিঃসন্দেহে তাঁরা হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ ও মো. কিবরিয়া।
এরপর, নতুন দেশে, প্রথম প্রজন্মে যাঁরা শিল্পী হিসেবে এবং পরবর্তীকালে উঁচুদরের শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তাঁরা হলেন প্রয়াত আমিনুল ইসলাম, প্রয়াত দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, রশিদ চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু এবং কিছুদিন পর কালিদাস কর্মকার।
এঁদের সবার সঙ্গেই আমার বন্ধুত্বের সুযোগ হয়েছিল সেই পঞ্চাশের দশকের প্রথম থেকেই। প্রথম তিনজন – আমিনুল, দেবদাস, মুর্তজা বশীর এবং পরবর্তী সৈয়দ জাহাঙ্গীর – সবার সঙ্গেই পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু সাদেক খানের মাধ্যমে। তখনকার দিনে বামপন্থী সাদেক খানের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও সাংবাদিকতার জগতে ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি।
কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বন্ধু বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে। প্রায় একই সময়ে পরিচয় ঘটে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে, তাও সাদেক খানের মাধ্যমেই। কালিদাসের সঙ্গে পরিচয় আরো কিছু পরে।
আমাদের আনন্দের উৎস ছিল আমাদের আড্ডা, যার ভেতর দিয়ে বন্ধুত্ব হয় সাঈদ আহম্মদ (পরবর্তী সময়ে সহকর্মী) ও তাঁর অগ্রজ হামিদুর রাহমানের সঙ্গে। আর অতিরিক্ত পাওয়া হয়  শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান ও সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে বন্ধুত্ব। বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মূলত দেবদাসের পুত্র গৌতম চক্রবর্তীর গ্যালারি কায়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৮ সাল থেকে হলেও অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলতে গেলে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। বাঙালি হিসেবে একরকম প্রবাসে। ইসলামাবাদে আমার কার্যরত থাকা অবস্থায় বাংলা-উর্দু কালচারের একটা বলিষ্ঠ সমন্বয়ের নজির দেখেছিলাম, রাওয়ালপিন্ডিতে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের বাড়িকে ঘিরে। তাতে শামিল হতেন ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির কর্মরত বাঙালি সমাজ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ, আগত শিল্পী-সাহিত্যিক অনেকে, আর বাংলা গান, বাংলা সাহিত্য শিল্পোৎসুক, বেশ কিছু পাঞ্জাবি/পাঠান মোহাজির কওমি সুশীল ব্যক্তি। একই সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত আর গালিবের গজলের আসর বসত। দোলচে ভিটা বা সুন্দর জীবনের স্বাদ তখন তার ঘরোয়া সান্নিধ্যে যেমন মিলেছে, তেমনি ঘরের বাইরেও, যেমন মারীর পার্বত্য চড়াই রাস্তার দুপাশে, পাহাড়ি জুঁই বা জেসমিনের সুবাস, সুন্দর স্মৃতির দাগ রেখে গেছে, আমাদের মনে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীর তখন তুখোড় একজন বাঙালি চিত্রশিল্পী – দারুণ আড্ডাবাজ ও বন্ধুবৎসল। তাঁর স্ত্রী আনিস জাহাঙ্গীর, এক অনন্য মহিলা – ওই সময়ে সরকারি চাকরি করতেন – ছিলেন একজন হস্তশিল্প বিশেষজ্ঞ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ হস্তশিল্প প্রদর্শন ও বিক্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্না আনিস, ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে পাকিস্তানে আসেন, পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি – তাঁর পিতার সঙ্গে যোগ দিতে। এরপর চাকরি, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয়বন্ধন। এঁরা দুজনে মিলে জাহাঙ্গীরের জন্য একটা ক্রমবর্ধমান চাহিদার শিল্প মার্কেট তৈরি করে ফেলেন কিছুদিনের মধ্যেই।
মূলত আনিসই উচ্চ পর্যায়ের রুচিশীল কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় থাকা ও হস্তশিল্প প্রদর্শনী ও সম্প্রসারণ কেন্দ্রের প্রধান হওয়ার সুবাদে, জাহাঙ্গীরের জন্য পেশাগত দিক দিয়ে পরিচিতি সম্প্রসারণ করা সহজ হয়, একথা বললে ভুল হবে না। এর পেছনে আর একটি জিনিস ছিল – আনিস ও জাহাঙ্গীরের বন্ধুবৎসলতা-আপ্যায়নে আনন্দ এবং সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে উৎসাহ ও উদ্যোগ।
আজ আনিসের অনুপস্থিতি (জাহাঙ্গীরের ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে) আমার মতো অনেকেই অনুভব করছেন সন্দেহ নেই।
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের আবির্ভাব একজন শক্তিশালী জলরং শিল্পী হিসেবে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছে সরাসরি তাঁর হাতেখড়ি ঘটেছিল জলরং চিত্রকলার। জয়নুল আবেদিনের সুযোগ্য শিষ্যের সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায় তাঁর তখনকার অনেক নিসর্গ চিত্রকর্মে। বাংলাদেশের নদী, মাটি, নৌকা, কুঁড়েঘর, চাষি, মাঝি, গৃহকর্মী, মেঠো পথঘাট – এসব পরিচিত দৃশ্য প্রথম জীবনে অনেক এঁকেছেন তিনি। ব্যতিক্রম ঘটল যখন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে পাহাড়ি জীবনের কিছু ছবি আঁকলেন। শুধু রঙের ও মুখচ্ছবির ব্যতিক্রম নয়, ইংলিশ স্টাইল জলরং ব্যবহারেও আলোর জন্য ফাঁকা জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কায়দা দিয়ে, কোনো কোনো ছবিতে পাহাড়ি বৈচিত্র্যের একটা ব্যতিক্রমধর্মী চিত্ররূপ ফুটে উঠল। একই বৈশিষ্ট্য জাহাঙ্গীর বজায় রেখেছিলেন তাঁর মারীর দৃশ্যাবলিতে। জলরং চিত্রে ব্যতিক্রমধর্মী নিরীক্ষার ওই উৎসাহ জাহাঙ্গীরের মনে দানা বেঁধেছিল শুধু ভিন্নতর নৈসর্গিক পরিবেশের কারণে নয়। ফুলব্রাইট শিক্ষার্থী হিসেবে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে জাহাঙ্গীর মার্কিন মুল্লুকে যান। আর সেখানে যেসব অগ্রসর শিল্পীর সান্নিধ্যে তিনি আসেন জলরং, তেলরং ও অন্যান্য মাধ্যমে – চিত্রকর্মের আঙ্গিকের নিজস্ব নান্দনিক আবেদন সম্বন্ধে তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনারও প্রভাব, সম্ভবত এসেছিল জাহাঙ্গীরের ব্যতিক্রমধর্মী জলরংগুলোতে। আমার সঙ্গে যখন পরিচয়, মার্কিন জীবন লহরির জাদু তখন তাঁর চিন্তাচেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তবে একই সঙ্গে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত প্রবল, সেটা হলো আমাদের প্রথাগত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলোর প্রতি তাঁর অতুলনীয় ও অসাধারণ শ্রদ্ধা, আর ভিন্নাদর্শের অনুভূতিতে আঘাত না দেওয়ার সতর্কতা। সেটি শিল্পী জাহাঙ্গীর নয়, মানুষ জাহাঙ্গীর। শিল্পচর্চার একাগ্রতায়, স্বভাবতই সৈয়দ জাহাঙ্গীর বৈষয়িকতায় তেমন মনোযোগী হতে পারেননি। কিন্তু শিল্পকর্মে উৎসর্গীকৃত ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও, সময় ও অর্থের সংকুলান করে, তিনি ও তাঁর সহধর্মিণী, তাঁর পরিবারের প্রতি যে নিঃস্বার্থ দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা অতুলনীয় এবং বাংলাদেশের চারুশিল্প প্রয়াসের বিকাশ সাধনায়, তাঁর নিজস্ব অবদানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে বলে আমি মনে করি।
স্বাধীনতাউত্তরকালে তাঁর সৃষ্টিধর্মী প্রেরণার এক নতুন প্রকাশ ঘটে। ঢাকার অনেক সুধীজন বৈঠকের তিনি মধ্যমণি। বিশেষ করে তাঁর বড় ভাই প্রয়াত বিশিষ্ট কবি সিকানদার আবু জাফরের বাড়ির বৈঠকখানায় [আমাদের জাফর ভাই] তখন ফরাসি সেলনের কায়দায় যে গুণীজন সমাগম ঘটল, সেখানে তাঁরই সপ্রতিভ সান্নিধ্যের আকর্ষণ সকলকে টানত আর আসর ধরে রাখত।
এরপরে সরকার থেকে তাঁর ডাক পড়েছিল, শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা প্রসঙ্গকে গড়ে তোলার কাজে। দীর্ঘ পনেরো বছর সৈয়দ জাহাঙ্গীর তাঁর কর্মতৎপরতার পুরোটাই নিবেদিত করেছেন শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগ পরিচালনায়। এতে শিল্পী হিসেবে তাঁর নিজস্ব সৃজনশীলতা ও কর্মতৎপরতা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু গড়ে উঠেছে একটা গর্ব করার মতো প্রতিষ্ঠান। সৈয়দ জাহাঙ্গীরের উদ্যোগেই বাংলাদেশে এশীয় চারুকলার নিয়মিত দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন অনেক দেশের বড় বড় শিল্পী। বাংলাদেশের শিল্পীদেরও সুযোগ ঘটেছে দেশে-বিদেশে যোগাযোগের, বহুল বিস্তার ঘটেছে এদেশের শিল্পকর্মের পরিচিতির।
অবসরগ্রহণ করে শিল্পী জাহাঙ্গীর আবারো সৃজনশীলতা ও মুক্তচিন্তায় ব্রতী হন। অনেক কাজ করেছেন। আর তাতে সংযোজিত করেছেন নতুন নতুন ভাবনা, নতুন নতুন আঙ্গিক। আমি তার বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। জীবনের বহু আঙ্গিকে, বহুর্জাতিক আগন্তুকদের সঙ্গে যে নিয়মিত ভাববিনিময় ও সামাজিক সখ্যের সুযোগ তাঁর সর্বদাই ঘটেছে, পরোক্ষ প্রভাবে তাঁর মুক্তমনে একটা আন্তর্জাতিকতার প্রভাব বর্তেছে, আর থেকে থেকে বিশেষ করে তেলরঙে, নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাকে প্রলুব্ধ করেছে। সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে অনেক কিছু বিষয়নির্ভর, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক। আবার অনেক কিছু একেবারেই ঐকান্তিক, আত্মনির্ভর। তবে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ছবির যে দিকটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে, সেটি হলো তাঁর রঙের ঢং আর তার রূপ বিন্যাসে একটা সহজাত ছন্দোবদ্ধতা। বিশেষ করে তাঁর নব্বইয়ের দশকের কাজে রৌদ্রোজ্জ্বল রঙের যে সোনালি সমাবেশ ঘটেছে, আমি তাতে মোহাবিষ্ট হয়েছি।
আমার বক্তব্য একটু লম্বা হচ্ছে। তবে জাহাঙ্গীরের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনীতে তাঁর অতিক্রান্ত জীবনের কিছু তথ্য, যা অনেকেই হয়তো জানেন না – আমি মনে করেছি জানানো প্রয়োজন আছে। আর জাহাঙ্গীরের শিল্পকর্মের চাহিদা সৃষ্টি করতে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশেও আমি কিছু প্রচেষ্টা চালিয়েছি। একইভাবে মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী ও আরো অনেক শিল্পী, যাঁরা আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন ও আছেন, তাঁদের শিল্পকর্মের জন্য একই ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছি নিজের মনের তাগিদে, উঁচুমানের শিল্পকর্মের প্রসারে। তাঁরাও আমাকে তাঁদের বন্ধুত্ব দিয়ে ধন্য করেছেন। [বেশকিছু শিল্পকর্ম তাঁরা আমার সংগ্রহের ভাণ্ডারে দিয়েছেন, বিশেষ করে তাঁদের প্রথম জীবনের পঞ্চাশ-ষাটের দশকের এবং সর্বশেষ সৃষ্টিরও কিছু কিছু]। এতে আমি গর্ববোধ করি। আমার ছেলে এখন এগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে।
শিল্পকলা একাডেমী থেকে অবসর নেওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরেই সৈয়দ জাহাঙ্গীর নিয়মিত ছবি এঁকে চলেছেন এবং প্রদর্শনী করে আসছেন, এটা খুবই আনন্দের ও তৃপ্তির বিষয়।
আজকের প্রদর্শনী ‘মাটি ও মানুষ’ জাহাঙ্গীরের প্রায় এক দশক ধরে আঁকা কাজের ধারাবাহিকতা বহন করছে। বাস্তবধর্মী কাজ হলেও অনেকটা বিমূর্ত প্রকাশভঙ্গি ও বিষয়বস্তুকে একটি নতুন ধারায় প্রকাশে, এই সময়টাতেই তিনি সফল হয়েছেন বলে আমি মনে করি।
সবশেষে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের ৮০ বছর পূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত আশিটি ছবি দিয়ে সাজানো প্রদর্শনীর আনন্দের সঙ্গে উদ্বোধন ঘোষণা করছি এবং এর সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।

Leave a Reply