logo

মনিরের চিত্রশিল্প রং ও রেখায় চিত্রিত মরমি কবিতা

এ স  এ ম  সা ই ফু ল  ই স লা

শিল্পকলার মহত্তম মাধ্যম চিত্রকলা মানুষের বোধ ও অন্তর্জগৎকে যতটা প্রভাবান্বিত করে, তা বহুমাত্রিক ও অতুলনীয়। জীবন ও সময়কে চিত্রকলা যতটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অনুভূতিময় ও স্পর্শযোগ্য করতে পারে, তা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিরল। শিল্পকলার মধ্যে চিত্রের মাধ্যম আন্তর্জাতিক এবং তার আবেদন ভূগোলের সীমা মানে না। মাধ্যমের এই আন্তর্জাতিকতা চিত্রশিল্পে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, তা রূপান্তরিত হয় ইতিহাসে। শিল্পীরা সময়ের অন্তর্গত, তাঁরা ইতিহাসের বাসিন্দা। এ সম্পর্ক তাঁদের কাজ নিরূপণ করে। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে বিশ্বের আধুনিক চেতনা প্রমূর্ত হয়েছে বিভিন্ন ও বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। বরেণ্য শিল্পী মনিরুল ইসলামের ক্ষেত্রে এ সত্য।

মনিরের দীর্ঘ সাধনালব্ধ চিত্রকলা বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের সমৃদ্ধি ও বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে। আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও স্বীকৃতি আমাদের জন্য গৌরবের। স্পেনের মাদ্রিদ শহরে জীবন ও শিল্পের অন্বেষণে কেটে গেছে তাঁর কয়েকটি যুগ। অবশ্য বেশ কয়েক বছর যাবৎ মাদ্রিদ ও ঢাকায় যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে তাঁর কাজ, শিল্পসাধনা ও চিত্রপ্রদর্শী লক্ষণীয়। কিছুদিন আগে (২৭ মে-১৫ জুন ২০১১) ধানমণ্ডির গ্যালারি চিত্রক ‘মনির ২০১১’ শীর্ষক শিল্পী মনিরুল ইসলামের একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। মনিরের শিল্পের অভিঘাত তৈরি হয়েছে মূলত নিসর্গ ও তার অনাবিল রূপের বিশ্লেষণ থেকে, শিল্পের তত্ত্ব থেকে নয়। ষাটের দশকে আঁকা তাঁর অসংখ্য জলরং চিত্রে এর দেখা মেলে। উল্লেখ্য, তিনি ১৯৬৬-৬৯ সাল পর্যন্ত গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসেস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯-এ স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৃত্তিলাভের পর তিনি দেশত্যাগ করেন। বস্তুত প্রবাসজীবনেই তাঁর চিত্রকলায় এক অভাবিত অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৬৯-৭৩ সাল পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রম, মেধা ও সৃজনশক্তির সমন্বয়ে তিনি ছাপচিত্রের বিভিন্ন মাধ্যমে বিশেষত এচিংয়ে অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেন। শিল্প ও শিল্পীর শহর মাদ্রিদে সেই সময়ের তরুণ শিল্পী মনিরের জীবনসংগ্রাম ও নিরবচ্ছিন্ন শিল্পসাধনা সিনেমার নায়কের চেয়েও কম কিছু নয়। তিনি ১৯৭৩-৭৬ পর্যন্ত মাদ্রিদের একটি স্টুডিওতে ছাপচিত্রীদের কারিগরি সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। শিল্পীদের রং তৈরি ও মিশ্রণ; এচিং, ড্রাইপয়েন্ট, মেজোটিন্ট ইত্যাদি মাধ্যমের উপযোগী বিভিন্ন ধাতব পাতে রং প্রয়োগ এবং ছাপাই মেশিনের মাধ্যমে ধাতব পাত থেকে কাগজে চূড়ান্ত চিত্র প্রস্তুত পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। শিল্পীদের কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থকড়ি দিয়েই চলত তাঁর জীবন ও জীবিকা। সততা, নিষ্ঠা ও ধৈর্য নিয়ে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন নিজের সৃষ্টির জন্য, শিল্পের জন্য। প্রায়শ রাতে ছোট্ট ডেরায় ফিরে নিজের শিল্পের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতেন নিঃসঙ্গ এই শিল্পী। শিল্পের জন্য তাঁর প্রবল আবেগ, ধ্যান ও শ্রম বিফলে যায়নি।

সত্তরের দশকের শুরুতে এচিং মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেন ‘টেরর অ্যান্ড অ্যাগোনি’ শীর্ষক দশটি সিরিজ চিত্র। বাংলার ১৯৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের এক দুর্বিষহ কালো অধ্যায় ওই চিত্রগুলোর মূল উপজীব্য, যা শিল্পীর দেশপ্রেম ও দরদিমনের প্রকাশবহ। মহান শিল্পী রেমব্রান্ট ও ফ্রান্সিসকো গয়ার আদর্শে মনির তখন উদ্বেলিত। ১৯৭১-এ প্রিয় স্বদেশের স্মরণে মাদ্রিদে ‘হোমেজ টু বাংলাদেশ’ শীর্ষক মনিরের একটি চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই চিত্রসমূহে প্রতিভাত হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, রক্তাক্ত সময়, বর্বর পাকিস্তানিদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নমুনা এবং প্রিয় মাতৃভূমির জন্য শিল্পীর প্রগাঢ় ভালোবাসা। মনিরের শিল্পের পথ ওই জায়গা থেকে বিকশিত হয় ক্রমে ক্রমে। এচিং মাধ্যমের পাশাপাশি তিনি তেলরং, জলরং ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং নিজস্ব চিত্রভাষা তৈরিতে সচেষ্ট হন। তাঁর কাজে অন্তর্গত বাইরের পৃথিবী, প্রাত্যহিকতা, দৃশ্যমানতা ও অনুভূতি মনোলোকের জটিলতা নয়। তাঁর অভিজ্ঞতা ও কল্পনায় ধরা পড়ে জীবন ও নিসর্গের নিঃসঙ্গতা, ঋতুরঙের ঘূর্ণমানতা, আকাশ ও ভূমির মধ্যবর্তী শূন্যতা, নগর ও গ্রামের বৈপরীত্য এবং ইন্দ্রিয়জাত প্রাত্যহিক অনুভূতিসমূহ। তাঁর কাজের প্রথম পর্যায়ে দেখা মেলে বাস্তবতায় দৃশ্যমান বর্ণিল আবহাওয়া। প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, কোনো কিছুই বাদ দেননি, সেই দেখাতে তিনি অনুবাদ করেছেন জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক ও এচিং মাধ্যমে, মুগ্ধ বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে অনেকটা প্রেমিকের মতো। তাঁর আঙ্গিকে প্রতিভাত হয়েছে অরণ্যের বৃক্ষরাজির অপার্থিব নৃত্য, বেলাভূমির রোদমাখা ধূসর বাদামি, প্রিয় লালের মনোমুগ্ধকর তীব্রতা, সময়ের গোপন সুড়ঙ্গ, স্মৃতিময় মেঘনার জলজ ধূসর নীল ও জীবনের দুঃখময় ছায়াসমূহ। বিমূর্ত প্রকাশবাদ রীতি তাঁর কর্তৃত্বের অধীন, রীতি দিয়ে তিনি ভেঙেছেন এবং গড়েছেন দৃশ্যমান বাস্তব ও মুহূর্ত, এ যেন খণ্ডকে ধরে রাখার গভীর আরাধনা। সব বস্তু ও অভিজ্ঞতার মধ্যে ফর্ম আছে, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য। শিল্পীর কাজ ওই ফর্ম আবিষ্কার করা; উন্মীলিত করা। বিষয়, বাস্তব, অভিজ্ঞতা, কল্পনা, অনুভূতি সবই শিথিল ও বহমান; ওই শিথিলতা ও বহমানতা ফর্মে সংহত হয়, অন্যপক্ষে ওই অন্বেষা ফর্মের অন্তঃসার সম্বন্ধে সজাগ করে তোলে। অন্তঃশীল ফর্ম হচ্ছে বস্তু কিংবা অভিজ্ঞতার অন্তঃসার। মনিরের কাজে বস্তু, অচেনা অবয়ব ও অভিজ্ঞতানির্ভর যে অন্তঃশীল ফর্ম এবং রং ও রেখার বিস্তার, তা অনূদিত হয় গভীর অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও দৃশ্যমান বাস্তবের প্রতিনিধি হিসেবে – এক প্রকার বিমূর্ত মরমি কবিতার মতো। বিশ্বখ্যাত শিল্পী জোয়ান মিরো ও এন্তোনিও তাপিসের মতো তাঁর কাজে অন্য একটি ঝোঁক লক্ষণীয়, বস্তুকে বা কোনো গড়নকে জ্যামিতিক নীতির ভিত্তিতে নির্মাণ করা। ফলে তাঁর কাজে জীবন্ত বা বাস্তবানুগ কোনো ফর্মের তেমন উল্লেখ নেই। তিনি নির্ভর করেছেন পরিসরগত ছন্দের নির্বস্তুক জ্যামিতিক কৌশলের ওপর এবং রং ও রেখার ইন্দ্রিয়জাত-আবেগময় দ্যোতনায়। বিমূর্ত প্রকাশবাদের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য মনিরের কাজে প্রায় ঘুরেফিরে আসে। ওই বৈপরীত্যে অন্তর্গত বস্তু ও গড়নের বিরোধ বনাম নির্বস্তুকতা, চিত্রগত পরিসরের বিবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং নির্বস্তুকতার অ্যাকশন পেইন্টিং-সুলভ কাঠামোহীনতা।

ধরা যাক সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর ‘জীবনের ছায়াসমূহ’ শীর্ষক তেলরং চিত্রের ভাবনা ও বিষয়। ক্ষয়িষ্ণু জীবনের মতো ধূসর চিত্রতলের ওপর কম্পমান কিছু উল্লম্ব কালো রেখা। জীবনের দুঃখময় ছায়ার ভারে সেসব রেখা প্রায় ভেঙে পড়ছে এক প্রকার শোকাবহ নৃত্যের মতো। বিমূর্ততার ভেতর অনুষঙ্গ বলতে ওইটুকু, কিন্তু কী অসামান্য মায়াবী মেলানকোলিয়া ধরে রেখেছে ওই বিষাদময় রেখাগুলো। সামান্যের মধ্য দিয়ে অসামান্যকে প্রকাশ করার শক্তি মনিরের কাজে গোড়া থেকেই লক্ষণীয়। এরকম অনুভূতির আরো একটি চিত্র ‘বননৃত্য’। এচিং ও জলরং মাধ্যমের ওই চিত্রটি রং ও রেখার বিন্যাসে ভীষণ কাব্যিক ও মনোমুগ্ধকর। ‘কৃষ্ণকায় হৃদয়’ শীর্ষক চিত্রে আবেগ ও বুদ্ধির চমৎকার রসায়ন ও একটি বেদনাবিধুর হৃদয়ের গল্প প্রোথিত আছে। অনেক হৃদয়ের পাশে একটি নিঃসঙ্গ হৃদয় কোনো এক ব্যাখ্যাতীত আঘাতে কৃষ্ণকায় হয়ে ধসে পড়ছে, ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু ভস্মের মতো। আজন্ম নিঃসঙ্গ মানুষের মন পৃথিবীর বিচিত্র দুঃখকষ্ট সঞ্চয় করে একদিন অবধারিতভাবে ফুরিয়ে যায়, হারিয়ে যায় চিরতরে মহাশূন্যে। এ ধাঁচের অন্য একটি চিত্র ‘রক্তাক্ত হৃদয়’। মনিরের চিত্রে রং, রেখা ও পরিসরের মনোহারী বিন্যাস শক্তিমান, যা যুগপৎ নান্দনিক ও গীতল। তাঁর চিত্রে প্রতিটি বিন্দু, মোটিভ, সাংকেতিক চিহ্ন, রেখা এবং রেখার ছোট্ট ভগ্নাংশকেও অপরিহার্য মনে হয়।

এই অপরিহার্যতার শক্তি ও পরিমিতিবোধের শুদ্ধ প্রয়োগ তাঁর চিত্রকলার প্রধান নিয়ামক, বোধ করি। চিত্রের আখ্যাসমূহে শিল্পীর কবিত্বশক্তির প্রমাণ মেলে। যেমন – ‘বৃষ্টি ও অশ্র“র ভূমি’, ‘অজানা গ্রহে ভ্রমণ’, ‘বেলাভূমির দুর্গ’, ‘উল্লম্ব জীবন’, ‘ধরিত্রী ও গগন’, ‘লালমাটিয়ার দুটি পাখি’, ‘একটি গ্রামের হারানো গল্পগুলো’, ‘আমার অন্ধকার প্রেমের বাড়ি’, ‘বননৃত্য’, ‘রক্তাক্ত হৃদয়’, ‘লালটুপি পরিহিত মানুষটির স্বপ্ন’, ‘জীবনের সুড়ঙ্গ’, ‘জীবনের ছায়াসমূহ’ ইত্যাদি।

মনিরের মধ্যে আছে শান্ত মনোহরণের ক্ষমতা। ওই মনোহরণতা লুকিয়ে রাখার কোনো ইচ্ছেও তাঁর নেই। তিনি প্রকাশ করতে ভালোবাসেন নিজের সত্তার গভীরতর বাঁক কিংবা কোণ, তাঁর স্বপ্নের মধুরতা, দুঃখ কিংবা হৃদয়াবেগ ও উন্মাদনা। তিনি রং ও রেখার উপাসক। রং ও রেখার রসায়নে তিনি সৃষ্টি করেন প্রবল অনুভূতিপ্রবণ মনের শান্তিময় পরিসর, যা যুগপৎ আনন্দ ও দুঃখের বার্তাবহ।

মহান কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতায় যে রকম মর্মন্তুদ নৈঃসঙ্গ্য ও অনন্ত নীরবতার জগৎ আছে, শিল্পী মনিরুল ইসলামের চিত্রকলা অনেকটা তেমন অনুভূতিময়। তাঁর কাজে নান্দনিক গুণের সঙ্গে চিন্তাশীল পরিসরের ব্যাপ্তি আছে, যা নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা ও দর্শনের বিশুদ্ধ নিয়ামক এবং একই সঙ্গে শিল্পীর মেধা ও স্বাতন্ত্র্যের উজ্জ্বল পরিচায়ক।

Leave a Reply