(১৯১৫-২০১১)
মৃণাল ঘোষ
এক
সংবৃতি
হুসেনের ছবিতে তাঁর আঙ্গিকের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য – রূপাবয়বের সংক্ষিপ্ততা, ইংরেজিতে যাকে ‘মিনিমাল’ (minimal) বলে। তাঁর পরিণত পর্বের ছবিতে এই সংক্ষিপ্ততার দৃষ্টামত্ম হিসেবে উলেস্নখ করা যায় মহাভারত চিত্রমালার একটি ছবি, যার বিষয় ভীষ্মের শরশয্যা। নগ্নদেহ, অনুভূমিকভাবে শায়িত এক বৃদ্ধ, তলপেটের নিচে একটি মাত্র সাদা কাপড়ে ঢাকা তার যৌনাঙ্গ, আর কতগুলি আলম্ব রৈখিক তীরচিহ্ন তার পা থেকে মাথা পর্যমত্ম বিসত্মৃত। শরের ওপর শায়িত ভীষ্ম বোঝাতে এর চেয়ে বেশি কিছু বিশদের প্রয়োজন বোধ করেননি শিল্পী। অথবা ১৯৭৩-এ সেরিগ্রাফে করা বেনারস চিত্রমালার ছবিগুলি। ঘন-কৃষ্ণ প্রেক্ষাপট। গহন অন্ধকারের পরিপূর্ণ শূন্যতা। তার ওপর ছড়ানো সূর্যকণা-সদৃশ বিস্রসত্ম শ্বেতশুভ্র কিছু রেখা। সেই রেখার ছন্দে গড়ে উঠেছে অবয়ব। যেটুকু না হলে নয়, সেটুকুই। একটি ছবিতে গঙ্গায় সণান করছে এক সন্ন্যাসী। অনুভূমিকভাবে বিসত্মৃত রেখায় জলের গভীরতা ও স্পন্দনকে বুঝিয়েছেন শিল্পী। জলের ওপর নৌকার আভাস। কয়েকটি রেখার সমাহারে গড়া একটি সরলরেখা। তার ওপর একটি অর্ধবৃত্ত। সূর্য উঠছে। কিছুদূরে চিত্রক্ষেত্রের দক্ষিণ প্রামত্ম ঘেঁষে নগ্নদেহ এক সন্ন্যাসী। কোমরজলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতদুটি মাথার ওপরে তোলা। একটি মাটির কলসি তার হাতের ওপরে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে সন্ন্যাসী। তার অবয়বের সবটাই সংক্ষিপ্ততম রেখার বিন্যাসে আঁকা। এটুকুমাত্র আয়োজনে শিল্পী পরিস্ফুট করেছেন হিন্দু ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সারাৎসারটিকে।
এখানে পৌঁছাতে শিল্পীর অবশ্য অনেকটাই সময় লেগেছে। সেই যাত্রাপথটি আমরা অনুধাবনের চেষ্টা করব চারটি ছবির উলেস্নখে। ১৯৭৩-এর জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি মাসে হুসেনের একটি পূর্বাপর প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। সেখানে প্রদর্শিত ছবির মধ্যে তিনটি ছবি আমরা একটু নিবিষ্টভাবে দেখব। ১৯৪৮-এ তেলরঙে আঁকা একটি ছবির শিরোনাম ছিল ‘অ্যাট দ্য ওয়েল’ (কুয়োর পারে)। এটিই ছিল ওই প্রদর্শনীর প্রথম ছবি। কুয়োর পারে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই গ্রামীণ রমণী। জমাট বর্ণে গড়ে উঠেছে তাদের অবয়ব। সমসত্মটাই আভাসে। শরীরের কোনো বিশদ বর্ণনা নেই। একজনের হাতে ধরা একটি দড়ি। সেটা কুয়ার গভীরে চলে গেছে। দুটি কলসি দেখা যাচ্ছে ওপরে ও নিচে। প্রেক্ষাপটের সবটাই কিছু রঙের প্রলেপ। এছাড়া দৃশ্যের কোনো বর্ণনা নেই।
বিষয়ের দিক থেকে এ ছবিতে রয়েছে উত্তর ভারতের বা রাজস্থানের গ্রামের দৃশ্য। আঙ্গিক কিন্তু সম্পূর্ণভাবে গ্রামীণ বা লৌকিক নয়। আঙ্গিকে স্বাভাবিকতাবাদী বিশদকে শিল্পী সম্পূর্ণ পরিহার করেছেন। দ্বিমাত্রিক সরল যে উপস্থাপনা এনেছেন, তার উৎস পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিজম। পাশ্চাত্যে ইম্প্রেশনিজম স্বাভাবিকতাবাদকে পরিহার করে রূপায়ণে দৃশ্যের অনুপুঙ্খ বিশদ বর্জন করে সারল্যময় দ্বিমাত্রিকতাকে গুরম্নত্ব দিচ্ছিল। এই উদ্ভাবনের পিছনে প্রাচ্যচেতনার যথেষ্ট প্রভাব আছে। শিল্পীর আত্ম-অনুভবের এই প্রকাশ, এটা আরো ঘনীভূত হয়েছিল পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকে। আমাদের দেশে ইম্প্রেশনিজমের আঙ্গিক প্রথম ব্যবহার করেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পোস্ট-ইম্প্রেশনিজমের ব্যবহারে অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ অমৃতা শেরগিল। গগনেন্দ্রনাথ ১৯২১ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে প্রথমে ইম্প্রেশনিস্ট, পরে কিউবিস্ট আঙ্গিক নিয়ে প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। অমৃতা শেরগিল ১৯৩০-এর দশকে ভারতীয় গ্রামীণ জীবনের বিষয় নিয়ে পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকে অজস্র ছবি আঁকেন। ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে যামিনী রায়ও পরিপূর্ণ লৌকিক আঙ্গিকে পৌঁছানোর আগে পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকে অনেক নিসর্গদৃশ্য আঁকেন। হুসেনের ১৯৪৮-এর ‘অ্যাট দ্য ওয়েল’ ছবিটিতে ভারতীয় গ্রামীণ বিষয়কে ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকে রূপায়িত করার প্রবণতা দেখা যায়। এখানে অমৃতা শেরগিলের ছবির ধরনের সঙ্গে কিছুটা মিল লক্ষ করা যায়।
হুসেন ১৯৪০-এর দশকের শুরম্ন থেকে যখন নিজস্ব আঙ্গিক বা রূপরীতি গড়ে তোলার প্রয়াস করছেন, তখন ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় দুটি রূপরীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। একটি ব্রিটিশ-প্রভাবিত অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদ। আর একটি নব্য-ভারতীয় ঘরানার ঐতিহ্য-অন্বিত স্বদেশচেতনা-আশ্রিত আঙ্গিক, যার একটা অংশ ছিল অতীতচারী, পুনরম্নজ্জীবনবাদী। যদিও নব্য-ভারতীয় ঘরানার একটি বড় অংশ এই পুনরম্নজ্জীবনবাদিতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। সন্ধান করেছে দেশীয় ঐতিহ্যগত রূপরীতির বা প্রাচ্যচেতনার অনেক নতুন দিগমত্ম। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল থেকে বিনোদবিহারী পর্যমত্ম এই সন্ধানের অনেক দৃষ্টামত্ম রয়েছে। অমৃতা শেরগিল বা যামিনী রায়ের মতো শিল্পী আধুনিকতার এই দুটি প্রচলিত পথকেই পরিহার করে রূপের নতুন অভিজ্ঞানের সন্ধান করেছেন। শামিত্মনিকেতনে রামকিঙ্করও প্রচলিত এই দুটি আঙ্গিককে পরিহার করে নতুন পথে আধুনিকতাবাদের সন্ধান করেছেন। তাঁদের দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ১৯৪০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীরা। হুসেন ১৯৪০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত ভারতের একজন প্রধান শিল্পী। ওই দুটি প্রচলিত রূপরীতিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন তিনিও। এই প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপের একটি দৃষ্টামত্ম আমরা দেখলাম ‘অ্যাট দ্য ওয়েল’ ছবিটিতে।
হুসেন ইম্প্রেশনিজম পোস্ট-ইম্প্রেশনিজমের পাশ্চাত্যনির্ভর অভিঘাতকে ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় লৌকিককে আত্তীকৃত করার চেষ্টা করেছেন। তার সঙ্গে মিলিয়েছেন পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অন্য নানাবিধ আবিশ্ব উত্তরাধিকার।
ভারতীয় আধুনিকতাবাদে দেশীয় লৌকিকের এই যে আত্তীকরণ, এটা খুব ধীরগতিতে ঘটেছে ১৯৩০-এর দশক থেকে। এর পিছনে রাজনীতি তথা সমাজচেতনার বিবর্তনের কিছু অভিঘাত আছে।
১৯২০-এর দশকে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। ওই আন্দোলনকে তিনি গ্রামের সঙ্গে যুক্ত করেন। গ্রামের অধিকাংশ জনগণ এই আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন। শহরে শিক্ষাত মানুষের মধ্যে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। শিল্পকলার ওপরেও গ্রামীণ শিল্পের প্রভাব পড়ে। লৌকিক শিল্পের প্রথম নিবিষ্ট চর্চা দেখা যায় সুনয়নী দেবীর ছবিতে। ১৯২০-এর দশকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অমত্মঃপুরে বসে এই শিল্পী যে ছবি আঁকছিলেন তার মধ্যে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বাংলার লোকাচারের প্রভাব এসে যাচ্ছিল। যামিনী রায় সুনয়নী দেবীর ছবি দেখেই প্রথম উদ্বুদ্ধ হন। লৌকিক সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা জাগে। ১৯৩০-এর দশকের শুরম্ন থেকেই তিনি ধীরে ধীরে তাঁর সুদক্ষ স্বাভাবিকতাবাদী চিত্রের পথ পরিহার করে লৌকিকের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৯৩৫-এর মধ্যে তাঁর এই অভিযাত্রা সম্পূর্ণ হয়। তাঁর শিশুপুত্রের সারল্যময় ছবিও অবশ্য তাঁকে এ পথে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৩৭-এ গান্ধীজিরই আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায় নন্দলাল বসু আঁকেন হরিপুরা ম-পসজ্জার ছবি। ১৯৩৮-এ অবনীন্দ্রনাথ আঁকেন লৌকিকের প্রাধান্যে ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ ও ‘কবিকঙ্কণ চ-ী’ চিত্রমালা।
লৌকিকের এই বিসত্মার ১৯৪০-এর দশকের শিল্পীদেরও উদ্বুদ্ধ করে। তাঁরা খুঁজছিলেন তথাকথিত ভারতীয়তা অতিক্রামত্ম এক আমত্মর্জাতিক চিত্রভাষা, কিন্তু তাতে থাকবে এক ভারতীয় আত্মপরিচয়। হুসেনের ছবিও এই সমন্বয়ের পথেই অগ্রসর হয়েছে। এর পরে আমরা কলকাতার পূর্বোক্ত প্রদর্শনী থেকে তিনটি ছবির উলেস্নখ করব এই সমন্বয় প্রয়াসের দৃষ্টামত্ম হিসেবে।
১৯৫৫ সালে তেলরঙে আঁকা একটি ছবির শিরোনাম ‘বেগম’। ছবিটি রেখার প্রাধান্যে আঁকা। শায়িতা এক মানবী, এইটুকু মাত্র ছবিটির বিষয়। নারী শুয়ে আছে, তার মাথাটি বালিশে ওপরের দিকে তোলা। পা-দুটি হাঁটুর কাছ থেকে ভাঁজ করে লম্বভাবে অবস্থিত। ডানহাতে ধরা একটি তালপাতার পাখা। সে নিজেকে বিজন করছে। বিষয়টি লৌকিক। আঙ্গিকেও লৌকিক সারল্য রয়েছে। কয়েকটি সরল ও বক্ররেখা সূচিত করছে মানবীর অবয়ব-বিন্যাস, তার চোখ, মুখ,
হাত-পা। রেখার মধ্যবর্তী অংশ সমতল বর্ণে ভরাট করা। প্রেক্ষাপটে আঁধারময় সমতল বর্ণপ্রলেপ। আর কিছু নেই। দেশীয় লৌকিকের সঙ্গে এখানে শিল্পী ইম্প্রেশনিস্ট রূপবিন্যাসকে মিলিয়েছেন। কিন্তু ছুঁয়ে গেছেন ভারতীয় গ্রামীণ জীবনের সরল সৌন্দর্যকে। এই ছবিটির রূপায়ণে অতিকথন বা অতিরিক্ত বাচন একেবারেই নেই। মিত-বাচন বা মিনিমালিজম এর বৈশিষ্ট্য বলা যায়।
এর পরে আমরা দেখব ১৯৬৯-এ আঁকা ‘বড়ে গুলাম আলি’ শীর্ষক রূপায়ণটি। এটিও তেলরঙের রচনা। সুরম-ল বাজিয়ে গান গাইছে প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পী। এই হলো ছবিটির বিষয়। এখানে দেশীয় লৌকিক আঙ্গিক একেবারেই নেই। পোস্ট-ইম্প্রেশনিজমের সঙ্গে ঈষৎ এক্সপ্রেশনিজমের মিশ্রণ রয়েছে। রেখা বা বর্ণের পরিমিত ব্যবহার এ ছবিটিরও বৈশিষ্ট্য। দেশীয় বিষয়কে পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের ভিতর দিয়ে রূপায়ণের প্রয়াস এখানে। কিন্তু এখানে হুসেনের নিজস্ব আঙ্গিক বা স্বকীয়তা তেমন কিছু নেই।
চতুর্থ যে ছবিটির কথা বলা হবে, সেটিকে বলা যেতে পারে হুসেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। ১৯৭৩-এর আগে তেলরঙের বেশ বড়মাপের (৯১.৫ x ৯১.৫ সেমি) এই ক্যানভাসটির শিরোনাম ‘বার্ড সেলার’। পাখি-বিক্রেতা কয়েকজন গ্রামীণ মানবীর উপস্থাপনা, এই হলো ছবিটির বিষয়। এই ছবির আঙ্গিক কিন্তু একেবারেই দেশীয় লৌকিক নয়। নারীদের অবয়ব-সংস্থান অবশ্য দ্বিমাত্রিক। কিন্তু মুখের গঠনে ত্রিমাত্রিক কৌণিকতা আছে, যাতে কিউবিজমের উপস্থিতি খুবই স্পষ্ট। পিকাসো এখানে খুব বেশি মাত্রায় উপস্থিত। যে পাখিটিকে ওপরে তুলে ধরেছে একজন পসারিণী, সেই পাখিটির গঠনেও কিউবিজম রয়েছে। পশ্চাৎপটে নীল আর সাদার বুনোটের বিসত্মারে আকাশের আভাস। আকাশের তলায় বর্ণের ঝংকারে রূপায়িত হয়েছে চারজন গ্রামীণ পসারিণী মানবী। তারা ভারতের গ্রামে সুস্মিত সুরকে স্পন্দিত করছে পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী চিত্রভাষায়। এই ছবির বর্ণপরিকল্পনায় পাহাড়ি অনুচিত্রের বর্ণপ্রয়োগপদ্ধতির প্রভাব আছে। এখানে যে সিত্মমিত আনন্দ ও বিস্ময়ের অভিব্যক্তি, তাতে ভারতীয় ধ্রম্নপদী স্থৈর্যের প্রকাশ আছে। হুসেন গ্রামীণ ভারতের প্রাণকেন্দ্রটিকে ধরেছেন এই ছবিতে। কিন্তু সবটাই দেশীয় লৌকিক ভাষায় নয়। স্বদেশ ও বিশ্বের এই সমন্বয়-প্রয়াস ১৯৪০-এর দশকের আধুনিকতাবাদী সন্ধানের একটি বৈশিষ্ট্য। হুসেনের এই ছবিটি এই সন্ধানেরই শ্রেষ্ঠ এক প্রকাশ। এই ঝংকৃত প্রকাশ থেকে হুসেন ধীরে ধীরে সংবৃতির দিকে গেছেন। রূপকে আরো সংক্ষিপ্ত করে তুলতে চেয়েছেন, যার প্রকাশ আমরা দেখেছি ‘ভীষ্মের শরশয্যা’ বা বেনারস চিত্রমালায় সন্ন্যাসীর সণানের দৃশ্যে।
দুই
আত্মসন্ধান
১৯৪০-এর দশকের শিল্পকলায় আধুনিকতাবাদী চেতনার বিসত্মারে সবচেয়ে বহুপ্রজ, সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত এবং সবচেয়ে বিতর্কিত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের জন্ম মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে ১৯১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবা একটি কাপড়ের মিলে চাকরি করতেন। মাত্র ছমাস বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর বাবা সে বছরই চাকরিটি হারিয়ে শোলাপুর ছেড়ে ইন্দোরে চলে যান। সেখানেই কেটেছে হুসেনের শৈশব। মাতৃসেণহের অভাব, সৎমায়ের অবহেলা শৈশব থেকেই তাঁকে অনিকেত, স্বাধীনচেতা করে তোলে। ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল শৈশব থেকেই। ছিল জন্মগত প্রতিভা। স্কুলে কিছুদিন সাধারণ লেখাপড়ার পর ইন্দোরের আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে ডি দেওলালিকরের অধীনে তাঁর চিত্রকলা শিক্ষার সূচনা। পরবর্তীকালের প্রখ্যাত শিল্পী এন এস বেন্দ্রে তখন ইন্দোরে ছিলেন। হুসেনের শিল্পী-প্রতিভাকে তিনিই প্রথম চিনতে পেরেছিলেন। তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, হুসেন অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন। সে যেন ছবিতেই তার সমসত্ম মনোযোগ সংহত করে। তাঁর বাবা ইন্দোরে যে চাকরি করতেন, সেই চাকরিও তিনি হারালেন। জীবিকার সন্ধানে হুসেনকে চলে আসতে হলো বম্বেতে ১৯৩৭ সালে। নানা ধরনের কাজ করেছেন সেখানে। তাঁর বাবার ছিল ঘির ব্যবসা। সেই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয়েছে তাঁকেও। এছাড়া পোস্টার ও সিনেমার হোর্ডিং এঁকেছেন। কাঠের আসবাব তৈরি, পুতুলের নকশা তৈরি – এসবও তাঁকে করতে হয়েছে জীবিকার জন্য।
ভাগ্য-বিপর্যয়ে কোনো শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখার সুযোগ হয়নি তাঁর। হয়তো সেটাই তাঁর ক্ষেত্রে আশীর্বাদের মতো কাজ করেছিল। ২২ বছর বয়স থেকে বম্বেতে সিনেমার হোর্ডিং এঁকে তাঁর শিল্পীজীবনের শুরম্ন। তুলির দ্রম্নত টানে অতি অল্প সময়ে ওই যে বড় বড় ছবি এঁকে যাওয়া – এটা প্রথম থেকেই তাঁর প্রকরণ ও আঙ্গিকের নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে উঠেছে। তাঁর রূপায়ণে এনেছে জঙ্গমতা। এই জঙ্গমতা তাঁর রূপাবয়বের সংক্ষিপ্ততারও অন্যতম উৎস। ১৯৩৭ সালের পর থেকে বম্বেতে যখন তিনি থেকেছেন প্রথম কয়েক বছর খুবই কষ্টের মধ্যে কেটেছে তাঁর জীবন। বম্বের ফোরাস রোডের এক মোটর গ্যারেজে প্রায় ছয় মাস তাঁকে রাত কাটাতে হয়েছে। গ্র্যান্ট রোডের ফুটপাথই ছিল তাঁর স্টুডিও। রাতের যানবাহন ও লোক চলাচল শেষ হলে ফুটপাথের ওপর চিত্রপট বিছিয়ে আঁকতে হতো সিনেমার হোর্ডিং। ভোরে যানবাহন চলাচল শুরম্ন হওয়ার আগে শেষ করতে হতো। শেখার অদম্য ইচ্ছা ছিল তাঁর। মানুষের শরীর-অভ্যমত্মরের অঙ্গসংস্থান জানার জন্য মেডিক্যাল কলেজে শবব্যবচ্ছেদ দেখেছেন। স্বাভাবিকতার চিত্ররীতিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য রেনেসাঁর প্রখ্যাত শিল্পীদের ছবি নকল করে অনুশীলন করেছেন। এভাবে প্রচ- কষ্টের মধ্যে অদম্য উৎসাহ ও আগ্রহে তিনি অনুশীলন করে গেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যমত্ম। সেই অনুশীলন তাঁর শিল্পসৃষ্টির ভিত তৈরি করেছিল।
১৯৪৭-এ বম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি প্রথম প্রদর্শিত হয়। হুসেনের আরেকটি শখ বা ‘হবি’ ছিল সিনেমা দেখা। ইন্দোরে থাকতে তিনি সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখতেন। বম্বেতে এসে বিশ্ব চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। চলচ্চিত্রে তাঁর জ্ঞান তাঁর চিত্রসাধনায় যেমন সহায়ক হয়েছে, তেমনি একটা পর্যায়ে চলচ্চিত্র নির্মাণেও তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই প্রজ্ঞার বলেই তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন থ্রু দ্য আইজ অব আ পেইন্টার নামে তথ্যচিত্র, ১৯৬৭ সালে যা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। প্রথাগত স্কুল ও কলেজের শিক্ষার সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্তু নিজের উদ্যোগে পড়াশোনা করে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেন, তা তাঁর শিল্পসৃষ্টির উৎস হিসেবে যেমন কাজ করেছে, তেমনি গড়ে তুলেছে তাঁর নিজস্ব বিশ্বদৃষ্টি। ইংরেজি ভাষায় অসামান্য ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন তিনি, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখা ইংরেজি কবিতায়। কবি হিসেবেও তাঁর সফলতা কম নয়।
বম্বেতে যে আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী শিল্প-আন্দোলন চলছিল, ১৯৪৭-এর মধ্যে হুসেন সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। ১৯৪৮-এ তিনি বম্বে ‘প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রম্নপে’ যোগ দেন। সে বছরই দিলিস্নতে সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত হয়েছিল ভারতীয় শিল্পকলার একটি প্রদর্শনী। শিল্পী সুজার সঙ্গে তিনি গিয়েছিলেন সেই প্রদর্শনী দেখতে। এই প্রদর্শনীতে ছিল গুপ্ত ভাস্কর্য থেকে শুরম্ন করে বাশোলি ও পাহাড়ি চিত্রকলা, লোকশিল্পের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে ভারতীয় ধ্রম্নপদী ও লৌকিক শিল্পের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহ। তাঁর নিজের কথায় : ‘The exhibition left me both humbled and exhilerated. It was like scaling a mountain and then discovering a whole new range of mountains.’ এই দেখা শিল্পীর আত্ম-আবিষ্কারে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ভারতীয় পরম্পরাগত শিল্প ও লৌকিক জীবনের বর্ণিল ব্যাপ্তি হুসেনের সৃজনের ভিত্তি। এই ভিত্তির ওপর তিনি পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী অন্বেষণকে মিলিয়েছেন। সময় ও সামাজিক পরিস্থিতির অভিঘাতে নিজের প্রকাশভঙ্গি স্থিরীকৃত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সুফি ধর্মমত, ভারতীয় পুরাণের ঐতিহ্য, চৈনিক কালি-তুলির ছবি, ইতালীয় রেনেসাঁস, ব্রিটিশ জলরং, পিকাসো থেকে বাউহাউস, চলচ্চিত্র, ভারতীয় লৌকিক জীবন, রাজনীতি ইত্যাদি অনেক কিছু থেকে তিনি গ্রহণ করেছেন। এবং আত্মস্থ করে নিজস্ব রূপ নির্মাণ করেছেন। সেই রূপের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আধুনিকতাবাদের বলিষ্ঠ এক পাদপীঠ তৈরি করেছেন।
তিন
দায়
হুসেনের শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছে মুম্বাইয়ের ১৯৪০-এর দশকের শিল্প-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। বাংলার শিল্প-আন্দোলনের সঙ্গে এর অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। হুসেনের ছবি বুঝতে হলে সেই প্রেক্ষাপটটিকে বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। পূর্বাঞ্চলে বা বাংলায় চলিস্নশের দশকের বা তার পূর্ববর্তী সময়ে ছিল মুখ্যত দুটি চিত্রধারার সহাবস্থান ও পারস্পরিক আদান-প্রদান। একটি নব্য-ভারতীয় রীতি, অন্যটি ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাবাদী ধারা। পশ্চিমাঞ্চলে বা মুম্বাইতে সে রকম ছিল না। সেখানে কোনো নব্য-ভারতীয় ধারা অথবা সমতুল্য স্বদেশচেতনা-আশ্রিত কোনো আঙ্গিক গড়ে ওঠেনি।
১৮৫৬ সালে মুম্বাইতে স্যার জে জে স্কুল অব আর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার ধারার চর্চাই প্রবল হয় সেখানে। এই ধারায় সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মধ্যে অত্যমত্ম প্রভাবশালী ছিলেন মহাদেব বিশ্বনাথ ধুরন্ধর (১৮৭১-১৯৪৪), এস এল হলদানকর
(১৮৮২-১৯৬৮), জে এ লালকাকা (১৮৮৪-১৯৬২), এম ভি শিখাওয়ালা (১৮৭২-১৯৩৭), এ এক্স ত্রিনিদাদে (১৮৭০-১৯৩৫) প্রমুখ। পাশাপাশি আর এক ধারার শিল্পীও অবশ্য ছিলেন, যাঁরা স্বাভাবিকতার ভিত্তি থেকে শুরম্ন করলেও ভারতীয় প্রথাগত শিল্পের দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য আবালাল রহিমান (?-১৯৩১), জে এম অহিবাসি, এন এল যোশি, রবিশঙ্কর রাভাল (১৮৯২-১৯৭৭) প্রমুখ। তখন বম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনী ছিল ওখানকার শিল্পীদের প্রকাশের প্রধান পাদপীঠ। এই সোসাইটি ছিল একমাত্র স্বাভাবিকতার রীতিরই পৃষ্ঠপোষক। সেই স্বাভাবিকতা থেকে কোনো রকম বিচ্যুতি সেখানে স্বীকৃতি পেত না।
চল্লিশের দশকের উদীয়মান তরম্নণ শিল্পীরা উপরোক্ত দুটি ধারার কোনোটির সঙ্গেই নিজেদের মেলাতে পারছিলেন না। দেশীয় ও আমত্মর্জাতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি প্রতিবাদী ভাবনায়
উদ্বুদ্ধ করছিল তরম্নণ শিল্পীদের। মুম্বাইতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জে জে স্কুল অব আর্টের ছাত্রদের মধ্যেই একটা প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, যাকে বলা হয় ‘ইয়ং টার্ক মুভমেন্ট’ বা তরম্নণ
তুর্কি-আন্দোলন। এই দলের নেতা ছিলেন পি টি রেড্ডি (১৯১৫-৯৭)। এই দলে তাঁর সঙ্গে অন্য যে শিল্পীরা ছিলেন, তাঁরা হলেন ক্লেমেন্ট বাপতিসত্মা, মজীদ, ভোজলে, এম কে কুলকার্নি ও মোঘুল। এই ইয়ং টার্ক মুভমেন্টের ভাবধারার অনুসরণেই কিছু পরে বম্বে প্রগ্রেসিভ গ্রম্নপের উদ্ভব হয়েছিল।
মুম্বাইতে ‘ক্যালকাটা গ্রম্নপে’র প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ সালে। এই প্রদর্শনী সেখানকার তরম্নণ শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৭ সালে বম্বে আর্ট সোসাইটির প্রদর্শনীতে কে এইচ আরার (১৯১৩-৮৫) ‘ইনডিপেনডেন্স ডে প্রসেশন’ শিরোনামে একটি ছবি বাতিল হয়েছিল। ফ্রাঁসিস নিউটন সুজার (১৯২৪-২০০২) ছবি সম্পর্কে বলা হয়েছিল, বড় বেশি ‘প্রোলেটারিয়ান’। এর প্রতিবাদে এই দুজন শিল্পী অর্থাৎ আরা ও সুজা এবং আরো দুজন সমমনোভাবাপন্ন শিল্পী ভাস্কর এস কে বাক্রে (১৯২০-) ও সৈয়দ হায়দর রাজা (১৯২২) একসঙ্গে মিলে দল তৈরি করলেন। এই দলে পরে অমত্মর্ভুক্ত করা হলো এম এফ হুসেন ও এইচ এ গাডে-কে (১৯১৭-২০০১)। এই কজন শিল্পীর সম্মিলনে ১৯৪৭-এ গড়ে উঠল ‘বম্বে প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রম্নপ’। এই দলের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল মুম্বাইতে ১৯৪৯-এর জুলাই মাসে। এই কজন শিল্পী ছাড়াও তাঁদের পাশে ছিলেন সমমনোভাবাপন্ন ও সমসাময়িক আরো কয়েকজন শিল্পী, কে কে হেববার (১৯১১-৯৬), শিবক্স চাবদা (১৯১৪-৯০), কৃষেণ খান্না (১৯২৫) প্রমুখ। এঁদের কাজের মধ্য দিয়েই চলিস্নশের শিল্পকলা বিশেষ এক চরিত্র অর্জন করেছিল।
প্রগতিশীল আদর্শ নিয়ে কলকাতায় যেমন শিল্পীদের মধ্যে মতানৈক্য ও বিরোধ ছিল, মুম্বাইতেও তা ছিল। সুজার একসময় মার্কসবাদের প্রতি সহানুভূতি ছিল। সেজন্য দলের নামকরণে ‘প্রগ্রেসিভ’ কথাটি তিনি রেখেছিলেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। তিনি বা অন্যান্য শিল্পীও ফর্মালিজম বা আঙ্গিকের অভিনবত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকতাকে যেমন তাঁরা পরিহার করেছিলেন, তেমনি শামিত্মনিকেতন বা যামিনী রায়ের আদর্শকে তাঁদের গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। শামিত্মনিকেতনকে মনে হয়েছিল বেশি ভাবপ্রবণ এবং যামিনী রায়কে অত্যমত্ম অপরিশীলিত। তাঁদের কাছে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন অমৃতা শেরগিল। তাঁরা পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। আঙ্গিকের আধুনিকতাকে গুরম্নত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল তাঁদের। আঙ্গিকের মধ্য দিয়েই তাঁরা সময়ের নির্যাসকে ধরতে চাইছিলেন।
‘প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রম্নপে’র সঙ্গে থেকেও হুসেন ছিলেন অন্য সবার থেকে আলাদা। আঙ্গিকের নিজস্বতা ও অভিনবত্বের সন্ধান তাঁর ছিল। কিন্তু নিছক আঙ্গিকবাদী তিনি ছিলেন না। জীবনের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল নিবিড়। তৃণমূল সত্মরের বাসত্মবতাকে তিনি উপলব্ধি করেছেন দারিদ্রে্যর বিরম্নদ্ধে তাঁর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এই জন্য শিল্পের ভিতর দিয়ে তিনি জীবনের ঐশ্বর্য ও আলোকময়তাকেই ধরতে চেয়েছিলেন। এর আগে ‘বার্ড সেলার’ ও ‘বড়ে গুলাম আলি’ ছবি দুটিতে আমরা সেই সদর্থক জীবনবোধের দৃষ্টামত্ম দেখেছি। গ্রামীণ ভারতের প্রতি যেমন তাঁর গভীর দায়বোধ ছিল, তেমনি ভারতের অধ্যাত্মসাধনা, পুরাণ ও ইতিহাসের বৈচিত্র্যকেও অত্যমত্ম সম্ভ্রমের চোখে দেখেছেন। তাঁর ছবিতে বিষয় হিসেবে এ সমসত্মই বিশেষ গুরম্নত্ব পেয়েছে। এর আগে মহাভারত চিত্রমালায় ‘ভীষ্মের শরশয্যা’ ও বেনারস চিত্রমালার ছবিতে এর নিদর্শন আমরা দেখেছি।
বাংলার শিল্পীদের মতো ১৯৪০-এর দশকের মুম্বাইয়ের শিল্পীরা ১৯৪৩-এর মন্বমত্মর দেখেননি। ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দেখেননি। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর উদ্বাস্ত্তর মিছিল দেখতে হয়নি তাঁদের। তাই সেখানে রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, চিত্তপ্রসাদ বা সোমনাথ হোরের মতো শিল্পী হয়নি। হুসেনেরও ছিল না এ সমসত্ম বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু দারিদ্র্য তিনি দেখেছেন, জীবনধারণের সংকট দেখেছেন। এজন্য গ্রামীণ ভারতের রিক্ততার প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল। রিক্ততার ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আধ্যাত্মিকতার ফল্গুস্রোত – তার প্রতিও নিবিড় শ্রদ্ধা ছিল। এই সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা থেকেই গড়ে উঠেছে তাঁর ছবির আঙ্গিক। এখানেই তাঁর ছবির সঙ্গে মুম্বাইয়ের সমসাময়িক ও অন্যান্য শিল্পীর পার্থক্য।
সুজা তাঁর আঙ্গিক গড়ে তুলেছিলেন আদিমতার আয়তনিক সংক্ষুব্ধ অভিব্যক্তির প্রখরতা থেকে। রাজা বিমূর্ততার ভিতর দিয়ে আধ্যাত্মিকতার নানা দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাঁর ছবিতে প্রায় সারাজীবন। হেববার নৃত্যের ছন্দের ভিতর দিয়ে জীবনের ছন্দকে অনুধাবন করতে চেয়েছেন। চাবদা লৌকিক উপস্থাপনার সারল্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর ছবি। গাইতোন্ডে তাঁর বিমূর্ততায় মুহূর্তের অনুভবের আলোকে জ্যামিতিক গাঠনিকতায় রূপায়িত করেছেন। তায়েব মেহতা অবয়বকে ভেঙে নিজস্ব কল্পরূপ তৈরি করেছেন। আকবর পদমসির ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে অধ্যাত্মচেতনা। কখনো নিসর্গের বিমূর্তায়নে, কখনো ‘মেটাস্কেপ’ চিত্রমালায়। পশ্চিম ভারতে চলিস্নশের দশকে শিল্পীদের এরকম বহুমুখী বিসত্মারের মধ্যে হুসেন একটু স্বতন্ত্র থেকেছেন তাঁর সামাজিক দায়বোধ ও ঐতিহ্যচেতনায়।
তাঁর শিল্পের বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিসত্মীর্ণ গ্রামীণ ভারতকে। তারপর এসেছে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পৌরাণিক বিষয়। স্বাধীনতাসংগ্রাম এসেছে। এসেছে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের নানা দিক, সত্যজিৎ রায়, পথের পাঁচালী ইত্যাদি। মাদার টেরেসাকে নিয়ে চিত্রমালা করেছেন। ঘোড়া অনেক সময়ই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রিয় বিষয়। ছাতার আত্মকথা নিয়ে ছবি করেছেন, যার ভিতর দিয়ে ধরেছেন গ্রামীণ ভারতের সংবিতকে। এছাড়াও এসেছে অজস্র বিষয় – পোস্টার, ট্যাপেস্ট্রি ইত্যাদি। বেনারস বারবার ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে। ১৯৪০-এর দশকের ভারতীয় আধুনিকতাবাদের যে মূল বৈশিষ্ট্য – পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিককে আত্তীকৃত করে ভারতীয় সংবিতের গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে তাকে সমন্বিত করে তুলে আত্মপরিচয়ের এক স্বতন্ত্র নিরিখ নির্মাণ করা, যাতে আমত্মর্জাতিকতার ভিতর প্রতিফলিত হয় প্রবহমান পরম্পরার অনিবার্য প্রতিবিম্ব – হুসেন সেটা অত্যমত্ম সফলতার সঙ্গে করে গেছেন। ভারতের জীবন ও সংস্কৃতিকে – এর অতীত ও বর্তমানকে – তিনি আলোকিত বিভায় উপস্থিত করেছেন তাঁর বিভিন্ন চিত্রমালার মধ্য দিয়ে। অত্যমত্ম পরিমিত বাচনে সংক্ষিপ্ততার মধ্য দিয়ে সাংকেতিক চিত্রভাষা তিনি তৈরি করেছেন তাঁর বিষয়ের প্রয়োজন অনুসারে। এই সংক্ষিপ্ততা ও সাংকেতিকতার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে তাঁর প্রকাশের স্বাতন্ত্র্য। হুসেনের ছবি সবসময়ই অবয়বী। বিমূর্ততার দিকে তিনি প্রায় কখনোই যেতে চাননি। বলেছেন ভারতে যে শতাধিক কোটি মানুষের জীবন, এর সবটাই প্রখর বাসত্মব। এখানে বিমূর্ত কিছু নেই।
তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে পৌঁছানোর দৃষ্টামত্ম হিসেবে ১৯৫৫-র ‘বেগম’ শিরোনামে একটি ছবির উলেস্নখ করেছি আমরা আগে। ১৯৫৬-তে আঁকা তাঁর আরেকটি ছবি তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক-পদ্ধতির আদর্শ-স্বরূপ বিবেচিত হয় এখন। বোর্ডের ওপর তেলরঙে আঁকা ছবিটির শিরোনাম ‘বিটুইন দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য ল্যাম্প’। সাংকেতিক হলেও খুবই সহজ উপস্থাপনা। একটি ঘরের অভ্যমত্মরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজন মানুষ। দুজন পুরম্নষ, বাকি তিনজন নারী। গ্রামীণ একটি মুসলিম পরিবারের সদস্য বলে মনে হয় তাদের। তিনজন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। দুজন রয়েছে কথা বলার ভঙ্গিতে। তাদের শরীরের গঠনে রেখাভিত্তিক লৌকিক সারল্য রয়েছে। সেই সারল্যের মধ্যেই মুখের রৈখিক গঠনে যে দৃঢ়বদ্ধ কৌণিকতা, তাতে রয়েছে কিউবিজমের পরোক্ষ প্রতিফলন। পিকাসোর সঙ্গে গ্রামীণ ভারতীয়তার সফল মেলবন্ধন রয়েছে ছবিটিতে। মেঝের ওপর একটি মাকড়সা দেখা যাচ্ছে। সুতোর সাহায্যে সেই মাকড়সাটিকে ধরে আছে মধ্যবর্তী অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রধান পুরম্নষ। ওপরের দিকে বাঁ-পাশে ঝুলছে লণ্ঠন-সদৃশ একটি বাতি। মাকড়সা ও বাতির অবস্থান নির্দেশ করেই ছবিটির শিরোনাম রাখা হয়েছে ‘বিটুইন দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য ল্যাম্প’। মাকড়সা ও আলোর মাঝখানে সত্মব্ধ হয়ে অবস্থান করছে গ্রামীণ একটি পরিবার। এই হলো ছবিটির বিষয়; যতটা আমরা অনুধাবন করতে পারি।
১৯৭৭-৭৮-এর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে দিলিস্নতে ললিতকলা অ্যাকাডেমির রবীন্দ্রভবন গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত ‘পিকটোরিয়াল স্পেস’ শীর্ষক একটি সম্মেলক প্রদর্শনীতে ছবিটি দেখানো হয়েছিল। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছিলেন গীতা কাপুর। ছবিটির আঙ্গিক সম্পর্কে তাঁর মমত্মব্য প্রণিধানযোগ্য। খানিকটা উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
‘As early as the beginning of the 1950’s M. F. Husain had devised a style for the figural delineation of the Indian villager with reference to Indian sculpture and was using, with unique effect, the pictorial format of the birdie scrolls and miniature schools of western India and Mewar, where the picture space is divided into square reetangulor sections to accomodate different parts, aspects or phasis of a narrative.
চার
বিবর্তন
১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে হুসেন তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক-পদ্ধতিতে পৌঁছে গেছেন। সেই আঙ্গিকের ভিতর দিয়ে পরিস্ফুট করতে পেরেছেন তাঁর নিজস্ব জীবন-ভাবনা ও বিশ্বদৃষ্টি। এই ভিত্তির ওপরই তাঁর পরবর্তীকালের শিল্পসৃষ্টি বিবর্তিত হয়েছে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যমত্ম তাঁর মুম্বাইতে অবস্থানকালে এক জটিল সময়ের মধ্য দিয়ে তিনি গেছেন। জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়েই আয়ত্ত করেছেন শিল্পের প্রকরণ। অদম্য ছিল তাঁর জীবনীশক্তি। অদম্য ছিল আবেগ ও আবিষ্কারের প্রবণতা। এরই জোরে তিনি শিল্পের ও জীবনের একটির পর একটি শিখর জয় করেছেন। ১৯৪৭-এ মুম্বাইতে একটি সম্মেলকে তাঁর ছবি প্রথম প্রদর্শিত হয়। ১৯৪৮-এ ‘বম্বে প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রম্নপ’ দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫০-এ বম্বেতে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। ১৯৫১-তে প্যারিসের Salon de Mai-তে প্রদর্শিত হয় তাঁর ছবি। ওই বছরই চীনে যান। চীনের শিল্পকলা ও নান্দনিকতা তাঁর নিজের
শিল্প-ভাবনাকে অনেক সমৃদ্ধ করে। ১৯৫৩-তে প্রথম ইউরোপ যান। জুরিখের গ্যালারি প্যালেটে একক প্রদর্শনী হয় এবং ভেনিস বিয়েনালে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৫-তে ললিতকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬৬-তে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৩-এ তিনি পান পদ্মভূষণ, ১৯৯১-তে পদ্মবিভূষণ। ১৯৭১-এ সাও পাওলো বিয়েনালে যোগদান করেন বিশেষ আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে পাবলো পিকাসোর সঙ্গে। একজন ভারতীয় শিল্পীর পক্ষে এটা একটা বিরল সম্মান। ১৯৬৭-তে তিনি তৈরি করেন ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র থ্রু দ্য আইজ অব আ পেইন্টার ভারত সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের প্রযোজনায়। সেই ফিল্ম ওই বছরই বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ সম্মান পায়। পরবর্তীকালে আরো দুটি ফিল্ম তিনি তৈরি করেন। ২০০০ সালে গজগামিনী, ২০০৪-এ মীনাক্ষী : আ টেল অব থ্রি সিটিজ।
তাঁর জীবনপঞ্জি থেকে এই কয়েকটি তথ্য আমরা উলেস্নখ করলাম শিল্পী হিসেবে তাঁর অবস্থান ও সাফল্যের দিকচিহ্ন বোঝাতে। অসাধারণ সমৃদ্ধ তাঁর জীবনপঞ্জি। এর বিসত্মৃত উলেস্নখ বাহুল্য মাত্র। আমরা এখন তাঁর ছবির ক্রমবিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটু যাওয়ার চেষ্টা করব তাঁর বিষয়ভাবনা ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য অনুধাবন করতে। ‘টাটা স্টিল’ থেকে হুসেনের ওপর একটি বড় চিত্রসম্ভার বা অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে ‘হুসেন’ শিরোনামে। সেই গ্রন্থে উদ্ধৃত একটি ছোট লেখায় শিল্পী বলেছিলেন, ‘In ‘Art’ there is no such thing as evolution. Aesthetic experience at the age of 11 is as vital and valid as at 70.’ হুসেন সময়ের সাযুজ্যে ও বিষয়ের প্রয়োজনে তাঁর প্রকাশভঙ্গি নির্ধারণ করেছেন। সেই বিষয় ও প্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র্যের কয়েকটি দিক আমরা অনুধাবনের চেষ্টা করব এই গ্রন্থটির অনুসরণে।
তাঁর বেনারস চিত্রমালার কয়েকটি নিদর্শন দিয়ে শুরম্ন ও শেষ হয়েছে এই চিত্রসম্ভার। এর একটি ছবির উলেস্নখ করেছি আমরা শুরম্নতে তাঁর প্রকাশভঙ্গির সংবৃতি বোঝাতে। এর পরে আমরা দুটি ছবি দেখব – ‘গান্ধী’ ও ‘গান্ধী অ্যাসাসিনেশন’। দুটি ছবিই জলরঙে আঁকা। জলরং তাঁর একটি প্রিয় মাধ্যম। নিজস্ব রীতির জলরং উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি, যা ব্রিটিশ জলরং পদ্ধতি থেকে আলাদা, যার সঙ্গে ভারতীয় সজলতা ও জলপ্রবাহের নিবিড় সম্পর্ক আছে। ড. ডানিয়েল হারউইটজ (Dr. Daniel Hurwitz) যিনি উক্ত গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন, তিনি হুসেনের জলরং পদ্ধতির সঙ্গে পল ক্লির পদ্ধতির সাযুজ্য সন্ধান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে পল ক্লির মিতবাচন ও সংক্ষিপ্ততা এবং প্রচ্ছন্ন কৌতুকের দীপ্তি হুসেনের প্রকাশভঙ্গিরও একটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু গান্ধীবিষয়ক ছবি দুটিতে কোনো কৌতুক নেই। আছে বিপন্ন এক ট্র্যাজিক-চেতনা। গান্ধী-হত্যার ছবিটিতে বিশেষ করে, যে অন্ধকার পরিবৃত হয়ে আছে তা যেন আমাদের সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার মুখে কালো কালি লেপে দেয়।
প্রচ্ছন্ন কৌতুক বরং রয়েছে এর পরের ছবিটিতে, যার শিরোনাম ‘বস্নু টাইগার’। পূর্বোক্ত গান্ধীবিষয়ক ছবির সঙ্গে এই নীল বাঘের যেন এক দূরতর সম্পর্ক রয়েছে। যে সন্ত্রাস গান্ধীকে হত্যা করেছে সেই সন্ত্রাসই যেন নীল বাঘের রূপ নিয়ে বিচরণ করছে। সৈনিকের মুখোশটি কি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতীক। এক কল্পরূপের পরিম-ল সৃষ্টি হয়েছে এখানে, যার সঙ্গে স্যুররিয়ালিজমের যেন কিছু সাযুজ্য আছে। তাঁর ছবির গোড়ার দিকের এই অমত্মর্দীপ্ত প্রতিবাদী চেতনা তাঁর অসামান্য শিল্পসিদ্ধির দৃষ্টামত্ম!
আমরা এরপরে চলে আসি ফৈয়জ, গালিব ও ইকবালকে নিয়ে করা চিত্রমালায়। এগুলিও জলরঙের কাজ, ১৯৮০-র দশকের। এই তিন কবির উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে ভারতের আধ্যাত্মিকতার মর্মবাণীটিকে তুলে ধরেছেন শিল্পী। মহাভারত চিত্রমালার উলেস্নখ করা হয়েছে আগে। ‘দ্রৌপদী অন ডাইস’ শীর্ষক ছবিটিতে ভূপাতিতা দ্রৌপদীর যে যন্ত্রণাকে উন্মীলিত করেছেন শিল্পী, তা চিরমত্মন নারীর সংকটের প্রতীক হয়ে ওঠে। ঘোড়া হুসেনের একটি প্রিয় বিষয়। বলেছেন তিনি : ‘my horses like lightening, cut across many horizons.’ ছেলেবেলায় তিনি বিস্মিত হয়ে দেখতেন কেমন করে কালস্নু টাঙ্গাওয়ালা তার অস্থিচর্মসার একটা ঘোড়া দিয়ে টাঙ্গা চালায়। অশ্বমেধের ঘোড়া, কারবালা-যুদ্ধের ঘোড়া, ছেলেবেলায় ইন্দোরের মেলায় দেখা মাটির ঘোড়া আর মেরি-গো-রাউন্ড খেলার কাঠের ঘোড়া – এই সমসত্ম অভিজ্ঞতা একাকার হয়ে গড়ে ওঠে তাঁর ছবির ঘোড়া। ‘নকটারনাল হর্সে’ ঘোড়ার প্রতীকে তমসাবৃত পরিমন্ডলে তিনি যেন এক ধ্বংসের প্রতীকী রূপ-ই আঁকেন।
রামায়ণের হনুমানের চিত্ররূপ অতিক্রম করে আমরা আসি ‘মাদার টেরেসা’ চিত্রমালায়। মাথায় নীল-পাড়ের সাদা শাড়ির অবগুণ্ঠন হয়ে ওঠে মাদার টেরেসার প্রতীক। এই বিপর্যসত্ম দেশে যেখানে অবহেলিত, পরিত্যক্ত শিশু সামগ্রিক অন্ধকারের স্মারক, সেখানে মাদার টেরেসা হয়ে ওঠেন নবজীবনের উদ্গাতা। ‘পোর্ট্রেট অব অ্যান আমব্রেলা’ তাঁর একটি উলেস্নখযোগ্য চিত্রমালা। ছাতার সংজ্ঞা তিনি নির্ধারণ করেন এভাবে – ‘A tottered piece of black cloth clings to its wiry existence called Umbrella’ এ যেন আমাদের দেশের দরিদ্রের অসিত্মত্বেরই প্রতীক। দরিদ্র দেহাতী মানুষটি মাটির ওপর বসে আছে। পাশে দাঁড় করানো ছেঁড়া ছাতাটি। এই হলো আজকের ভারতবর্ষের একটি পরিচয়। একটি দড়ির খাটিয়ার ওপর পড়ে আছে দুটি ভাঙা ছাতা। এও তো দারিদ্রে্যর এক অভ্যমত্মর।
তাঁর আলোকচিত্র দেখি এর পরে ‘কালচার অব দ্য স্ট্রিট’ শিরোনামে। ছাতায় থাকে দারিদ্র্য। তারপরেই সিনেমার হোর্ডিংয়ের আলোকচিত্রে উদ্ভিন্ন যৌবনের কামনালোলুপতায় ধরা থাকে ঐশ্বর্যের অহংকারের সর্বগ্রাসী রূপ। ‘সার্কাস ড্রয়িং’ পেরিয়ে আমরা আসি ‘চাইনিজ ইম্প্রেশনসে’, যেখানে তিনি প্রণতি জানিয়েছেন চীনের শৈল্পিক প্রজ্ঞাকে। হুসেনের নিসর্গচিত্র একটু ভিন্ন ধরনের। স্বাভাবিকতা অতিক্রামত্ম, কিন্তু একটু যেন উচ্চকিত অতিকথন রয়েছে তাতে, অমত্মত এই গ্রন্থে যে কয়েকটি দৃষ্টামত্ম আমরা দেখি। এ রকম নিসর্গরচনাও তাঁর আছে, যেখানে মিত-ভাষণে তিনি প্রায় বিমূর্ততার কাছাকাছি চলে যান। মুখাবয়বচিত্রে তিনি বাংলার এবং সারা ভারতের বিভিন্ন মনীষীকে ধরেছেন। আত্মপ্রতিকৃতিও রয়েছে কয়েকটি।
হুসেন চিরদিনই ছিলেন সিনেমার একজন নিবিষ্ট দর্শক। বিভিন্ন চলচ্চিত্রকারকে নিয়ে তিনি ছবি এঁকেছেন। বলেছেন তিনি : ‘Most of my thematic series of paintings are inspired by the works of great filmmaker.’ কুরোসওয়া, বুনুয়েল, পাসোলিনি ও সত্যজিৎ রায় – তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে অন্যতম। একেকজন পরিচালককে তিনি একেক রকম চিত্রপ্রতীকে ভাবতে চান। পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরম্নণকে নিয়ে করা ছবিটি অসামান্য। একটি কলাপাতা, বসে থাকা এক বৃদ্ধা, তার দীর্ঘ প্রসারিত একটি হাত, হাতের তলায় বাটিতে একটি প্রস্ফুটিত ফুল।
এই ফুলটিই নিখিল-নাসিত্মর ভিতর এক টুকরো আশার আলোর মতো উদ্ভাসিত থাকে। এরপর অপু-দুর্গার ট্রেন দেখার দৃশ্য। ট্রেন যাচ্ছে দূরে। ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে আকাশে ছড়াচ্ছে। কিন্তু
অপু-দুর্গার অভিব্যক্তিতে বিস্ময় তো বোঝা যাচ্ছে না। কাশফুল নেই কেন? একটি ছাগল রয়েছে শুধু। সংবৃত হতে গিয়ে হুসেন কি মাঝে মাঝে অতিসংবৃত হয়ে যান?
শামিত্মনিকেতনকে দেখি। দুপাশে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে ছাতিমগাছ। তার শরীরে লিপ্ত হয়ে আছে একটি তানপুরা। দুপাশে ছেলেমেয়েরা বসে পাঠ নিচ্ছে। কয়েকটি সংকেতের মধ্য দিয়ে একটি আদর্শকে ধরা – এই হলো হুসেনের শিল্পপ্রজ্ঞার মূলমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘ছবি’ কবিতাটিকে যখন চিত্রায়িত করেন তখন ছবির ফ্রেম থেকে মানবী বেরিয়ে আসে চলমান জীবনে। মানবীর মুখের ওপর লেখা থাকে ‘কবির অমত্মরে তুমি কবি/নও ছবি, নও ছবি, নও তুমি ছবি।’ ব্রিটিশ রাজ নিয়ে ছবি করেছেন এর পর – ‘দ্য ইমেজেজ অব রাজ’। ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ ভয়েস’ ক্যানভাসের ওপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা। চোঙওয়ালা একটি বড় গ্রামোফোন চলছে। পাশে নীল কুকুরটি তাকিয়ে আছে সুরের দিকে। ব্রিটিশদের শৌর্য আর দম্ভের ছবি এঁকেছেন নানা আঙ্গিকে। হাতে বোনা ট্যাপেস্ট্রির ছবি করেছিলেন একটা পর্যায়ে। তাতে তসর সিল্ক কাপড়ের ওপর সুতোয় বোনা একটি ট্যাপেস্ট্রির শিরোনাম ‘চাইনিজ হর্স’। ঊর্ধ্বমুখে পিছন দিকে তাকিয়ে ছুটছে একটি ঘোড়া। আর ওপরে এক রাশ ঘোড়ার জটলা।
মিথুন ড্রয়িংগুলো পেরিয়ে এরপর আমরা আসি তাঁর ভাস্কর্য ও স্থাপত্যে। কাঠের কাট-আউটে মানুষের মূর্তি গড়ে তাতে কালো বা লাল রং করেছেন। সেগুলি ছড়িয়ে দিয়ে তৈরি করেছেন ইনস্টলেশনধর্মী রচনা। নাম দিয়েছেন ‘থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ড’। ‘ফ্রম বাউহাউস টু মাই হাউস’ শীর্ষক ভাবনায় জার্মানির বাউহাউসের প্রত্যয়কে দেশীয় স্থাপত্যের সঙ্গে মিলিয়েছেন। ‘ফার্স্ট স্কেচ ফর দ্য আর্কিটেকচারাল কনসেপ্ট অব আ রেসিডেন্সিয়াল হাউস’ রচনায় ধরেছেন স্থাপত্য ও চিত্রের সমন্বয়-ভাবনা।
এরকম বিসত্মীর্ণ পরিক্রমার অমেত্ম আমরা এসে পৌঁছাই তাঁর সেই সরস্বতীতে, যার তথাকথিত নগ্নতা নিয়ে অশালীন বিতর্ক হয়েছিল একসময়। পরে যার জেরে হুসেনকে দেশছাড়া হতে হয়। যে লজ্জার হাত থেকে আমাদের দেশের কোনো নিসত্মার নেই। অথচ ছন্দিত রেখার টানে গড়া এই সরস্বতী আমাদের আধুনিক চিত্রকলায় এক অবিনশ্বর সৃষ্টি।
পাঁচ
আঁধার-মথিত গরল
পূর্ববর্তী পরিক্রমায় আমরা দেখলাম হুসেন তাঁর শিল্পীজীবনের সূচনা পরিণতিতে পৌঁছনো পর্যমত্ম অর্থাৎ ১৯৩৭ থেকে ১৯৮৭ পর্যমত্ম এই প্রায় অর্ধশতকে কীভাবে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছেন। কেমন করে তিনি ডুব দিয়েছেন ঐতিহ্য ও ইতিহাসের গভীরে, সেখান থেকে তুলে এনেছেন বিষয়, আর সেই বিষয়ের ভিত্তিতে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব আঙ্গিক-পদ্ধতি। দেখলাম – কেমন করে সংবৃতিই হয়ে উঠেছে তাঁর আঙ্গিকের প্রধান অবলম্বন, আমত্মর্জাতিকতাকে কেমন করে তিনি মিলিয়েছেন দেশীয় সংবিতের সঙ্গে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এর পরেও শিল্পী নিজেকে নবীকৃত করেছেন। বাসত্মবের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। বিপর্যসত্ম ভ্রষ্টতার বিরম্নদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। আধুনিকতাবাদী শিল্পী উত্তর-আধুনিকতাকে আত্মস্থ করে তাঁর আঙ্গিক রূপামত্মরিত করেছেন পরিপূর্ণভাবে।
এরই দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা ২০০২ সালের মে মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত তাঁর একটি প্রদর্শনীর পরিপূর্ণ প্রতিবেদন পেশ করব, যা থেকে দেখা যাবে কীভাবে এই শিল্পী প্রতিনিয়ত সময়ের ডাকে সাড়া দিয়েছেন, প্রকাশের ভাষাকেও পালটে নিয়েছেন। প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিমা গ্যালারিতে ২৬ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যমত্ম।
সংবাদের বাহন যে সংবাদপত্র সেটাকেই হাতিয়ার করে সেই প্রদর্শনীতে ৮৭ বছর বয়সেও দীপ্ত যৌবনে উজ্জ্বল শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন গড়ে তুলেছিলেন অভিনব এক শিল্প। গড়েছেন অন্ধকারের ভাষায়। অন্ধকারকে মথিত করে অমৃত তুলে আনতে চাননি। গরলই পৌঁছে দিতে চেয়েছেন দেশবাসী মানুষের বিবেকের কাছে। যাতে অনুভব করতে পারেন তাঁরা কী এক ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি!
গোধরার সেই ট্রেন জ্বালানো মর্মন্তুদ হত্যাকা-, তারপর সারা গুজরাট জুড়ে জ্বলছে আগুন। কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দীর্ঘ সংবাদ-শৃঙ্খলেরই একেকটি অংশ এই ঘটনাপ্রবাহ। সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসবিরোধী পালটাসন্ত্রাসে সারা পৃথিবী তোলপাড় হচ্ছে। মানবতার এই দুর্মর পরাজয়ের মুহূর্তে একজন শিল্পীর যা করণীয় হুসেন তা-ই করেছেন। মুখের ওপর ছুড়ে দিয়েছেন খবর আর খবর। সংবাদকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। সংবাদের ওপর এঁকেছেন হত্যা, ঘৃণা, অন্ধকার।
সেই অন্ধকারকে নিংড়ে তীব্র স্বরে বাজছিল ‘হবাগনার’। এই সুর, এই অন্ধকার, সমসত্ম গ্যালারির মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা রাশি রাশি সংবাদপত্র আর দেয়ালজুড়ে সংবাদ নিংড়ানো শিল্পের সমারোহ এই প্রদর্শনীকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল, এতদিনের পরিচিত শিল্পী হুসেনের থেকে অনেকটাই আলাদা। ‘হবাগনার’ কি হুসেনের প্রিয় সুর? নাকি আজকের এই তমিস্রাতে হবাগনারের আলোড়িত আর্তনাদই হতে পারে প্রকৃষ্ট এক আবহ? মনে পড়ে, হবাগনারের সুর প্রিয় ছিল আমাদের আরেক প্রধান শিল্পীর। তিনি রামকিঙ্কর। উতরোল আবেগে মানুষকে তার মানবতা ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্নের সেই সুর মহৎ শিল্পীদের নাড়া না দিয়ে পারে না। এই প্রদর্শনীতে, এই অন্ধকারে, এই সুরে সেই স্বপ্নের প্রতিধ্বনি স্পর্শ করতে চেয়েছিল দর্শককে।
প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘দ্য নাইট ওয়াচ’। উপশিরোনাম : ‘রিফ্লেকশন অন টাইম প্রেজেন্ট’। শিরোনামে শিল্পীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট। হুসেনের প্রিয়তম শিল্পী রেমব্রান্ট। রেমব্রান্টের ১৬৪২-এ আঁকা একটি ছবি ‘দ্য নাইট ওয়াচ’, যা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলে আজ স্বীকৃত। এই ছবির নামেই হুসেন নামকরণ করেছেন এই প্রদর্শনীর। অবশ্য ‘নাইট’কে তিনি রাত্রি অর্থে ব্যবহার করেননি। এর বানানকে পালটে করেছেন ‘Knight’. এক মধ্যযুগীয় আবহ তো তৈরি হলোই এই শব্দের মধ্য দিয়ে, তাছাড়া আরেকটা উদ্দেশ্যও হয়তো সাধিত হলো। জানা আজ প্রায় সকলেরই ‘দ্য নাইট ওয়াচে’র যে রাত্রি তা রেমব্রান্টের অভীষ্ট রাত্রি নয়। পরবর্তীকালে ধুলোর আসত্মরণ ছবিটির ওপর অন্ধকারের প্রলেপ এনেছিল। তা থেকেই এই নামকরণ। হুসেন হয়তো এই আরোপিত অন্ধকারকে সরিয়ে প্রকটতর এক মধ্যযুগীয় অন্ধকারেরই দ্যোতনা আনতে চেয়েছেন।
হুসেনের ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ মূলত একটিই শিল্পকর্ম, একটিই নির্মাণ, যদিও অজস্র ছোট-বড় কাজের সমন্বয়ে গড়া। গ্যালারির মেঝেতে ছড়ানো অজস্র খবরের কাগজ মাড়িয়ে মাড়িয়েই দর্শককে এই প্রদর্শনী পরিক্রমা করতে হয়। কালো কাপড় টাঙানো রয়েছে পর পর এ-দেয়াল থেকে ও-দেয়াল পর্যমত্ম। বৈদ্যুতিক আলোর কারসাজি ছাড়াও এভাবে নির্মিত হয় আরেক আরোপিত অন্ধকার। এই অন্ধকার ভেদ করে চলতে চলতে আমরা দেখি দেয়ালে একের পর এক ছবি। সংবাদ শিরোনাম থেকেই গড়ে উঠছে তা। যেমন টাইমস অব ইন্ডিয়ার ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ২০০২ তারিখের শিরোনাম ‘মব টর্চেস ট্রেন, সেটস নেশন অন ফায়ার’ – এই শিরোনামকে ঘিরে জ্বলমত্ম টেনের ছবিকে পুনর্নির্মাণ করেছেন শিল্পী। আবার ১৪ ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে আনন্দবাজারের খবর : ‘সংসদও আর নিরাপদ নয়’। সঙ্গের ছবিটিকে রূপামত্মরিত করেছেন, রাইফেল হাতে সৈন্য আর কালো রেখায় ঘেরা সংসদ ভবনের প্রতিমাকল্পে। সন্ত্রাসের পাশাপাশি ছিল ভিন্নতর মননের সংবাদবিনির্মিত ছবিও। যেমন আনন্দবাজারের খবর : ‘অবশেষে বিসর্জন। দশমীর গঙ্গাবক্ষে সান্ধ্য আলোয় উৎসবের সমাপন’। এ থেকে গড়ে উঠেছে সারল্যময় জল আর জলে বিসর্জিত প্রতিমার ছবি।
সারা গ্যালারিজুড়ে ছড়ানো রয়েছে পস্নাইবোর্ডের বহু বড় কাট-আউটে আর্তনাদময় তীব্র কালো নরনারীর প্রতিমাকল্প। এক প্রামেত্ম একটি বড় ইনস্টলেশন। বড় ক্যানভাসে যুদ্ধরত সৈন্যের সমারোহ। কালো কাট-আউটে ভীতত্রসত্ম নারীরা। সামনে মেঝের ওপর পড়ে আছে খাটিয়া। তার ওপর একটি দোনলা বন্দুক। খাটিয়ার ওপর একটি বড় পুতুলের আর্ত আবেদন। আজকের ভারতবর্ষের এই এক রূপকল্প।
বিনির্মাণ করেছেন অন্য শিল্পীর কাজকেও। গোইয়ার ‘দ্য থার্ড অব মে (এক্সিকিউশন)’ ১৮১৪-১৫-র স্মরণে এঁকেছেন একটি ছবি। উজ্জ্বল সাদা চিত্রপট। তার ওপর লালে আঁকা দুহাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নরনারী। তাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে সারিবদ্ধ কালো সৈনিকেরা। ওপরে সারি সারি বুটের পদচারণা। ভূগোল ও ইতিহাসের নানা বিসত্মারে এভাবে মানুষ মানুষকে মারছে।
এতটা বিসত্মারে উলেস্নখ করা হলো যে এই প্রদর্শনী, তা শুধু হুসেনের শিল্পচেতনার বিসত্মারকে বোঝাতে। কখনোই কোনো নির্দিষ্ট ছকে আটকে যাননি তিনি।
ছয়
সমাপ্তি
সন্ত্রাসের বিরম্নদ্ধে, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরম্নদ্ধে তাঁর এই যে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ – এর মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। ১৯৭০-এ তিনি এঁকেছিলেন অসামান্য সেই সরস্বতীর ছবি, যার কথা আমরা বলেছি আগে। লক্ষ্মী ও দুর্গাও এঁকেছিলেন তিনি। সেই ছবিকে উপলক্ষ করে হিন্দু দেবীকে কেন নগ্ন করে এঁকেছেন – এই অভিযোগ তুলল হিন্দু মৌলবাদীরা ১৯৯০-এর দশকে। আদালতে তাঁর বিরম্নদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলো। ১৯৯৮-তে তাঁর বাড়িতে লুণ্ঠন চালানো হলো বজরংদল আর শিবসেনার নেতৃত্বে। ২০০৪ সালে দিলিস্ন হাইকোর্ট তাঁর বিরম্নদ্ধে অভিযোগ খারিজ করে দিলেন। ২০০৬-এর ফেব্রম্নয়ারিতে তাঁর বিরম্নদ্ধে আবার মামলা দায়ের করা হলো যে তিনি জনসাধারণের ভাবাবেগে আঘাত করেছেন। এরকম কয়েকশ মামলার প্রতিক্রিয়ায় তাঁকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যখন তিনি হাজির হলেন না তাঁর বিরম্নদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো। হুসেন দেশ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন। ২০০৬ থেকে তিনি দেশছাড়া। থাকতেন দোহায়, আর গ্রীষ্মকালে লন্ডনে। ২০১০ সালে তিনি কাতারের নাগরিকত্ব নিলেন। ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল করলেন।
কাতারে তিনি দুটি প্রকল্পে কাজ শুরম্ন করেছিলেন। একটি আরব সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে চিত্ররচনা, দ্বিতীয়টি ভারতীয় সভ্যতার ওপর। এই ছবিগুলি দোহার মিউজিয়মে থাকার কথা ছিল।
তাঁর শেষজীবন এরকম দুঃসহ কষ্টের মধ্যে কেটেছে। ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ জেগেছে। কিন্তু সারাদেশে এমন কিছু জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেনি কেউ, যাতে হুসেনকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়। সরকারও নীরব দর্শক থেকেছে। সমগ্র জাতির পক্ষে এই লজ্জার আজ আর কোনো প্রতিকার নেই।
২০১১ সালের ৯ জুন লন্ডনে হৃদরোগে আক্রামত্ম হয়ে হুসেন পরলোকগমন করেন ৯৬ বছর বয়সে। তাঁর আগে ও তাঁর সমসাময়িককালে বহু শিল্পী আমাদের দেশের শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। শিল্পপ্রতিভায় কে বড় কে ছোট সে বিচার চলে না। তবু সৃজনশীলতার প্রাচুর্যে ও জঙ্গম জীবনযাপনে হুসেনের মতো শিল্পী যে খুব বেশি আসেননি – একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।