আন্দালিব রাশদী অনূদিত
এক
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরে ভারতবর্ষের
শ্রেষ্ঠ শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের জন্ম। ৯ জুন ২০১১
নির্বাসিত জীবনে লন্ডনের ব্রম্পটন হসপিটালে
মৃত্যুবরণ করেন। জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা
জানাতে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার
অনূদিত হলো।
সাক্ষাৎকারটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক শেখর গুপ্ত এনডিটিভির জন্য রেকর্ড করেছিলেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৬ এবং ৩১ ডিসেম্বর ২০০৬ দুটি পর্বে সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচার করা হয়।
প্রশ্ন : এম এফ হুসেন, আপনি দুবাইতে কী করছেন? এটা নিউইয়র্ক বা প্যারিস নয় কিংবা শিল্পকলাবান্ধব কোনো স্থানও নয়।
মকবুল ফিদা হুসেন : আসলে আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় হাঁটতে ভালোবাসি। পঞ্চাশ বছর ধরে আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার কোথাও কোনো স্টুডিও নেই। আমি সঙ্গে
রং-তুলি নিয়ে নিই, হোটেলরম্নম ভাড়া করি, কোনো বন্ধুর বাড়ি যাই কিংবা যে-কোনো জায়গায় গিয়ে ছবি আঁকতে শুরম্ন করি। আমার মনে হয় আমার কাজের এ ধারাটি শিল্পীসুলভ… তিন-চার বছর ধরে এখানে আসছি, আর সত্যিই দ্রম্নত গড়ে উঠছে এমন একটি শহর হচ্ছে দুবাই। এখানে আমার প্রায়ই আসার কারণ হচ্ছে, পঁচিশ বছর ধরে আমার ভাই এ শহরে বসবাস করছে। আগে এটি ছিল মরম্নভূমি… আমি শহরটি গড়ে উঠতে দেখেছি।
…তারা আমাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। আইনকানুন না ভেঙে যা ইচ্ছে তাই এখানে করা যায়। কাজেই এখানে ফিরে এসে কাজ করার সিদ্ধামত্ম নিই। আমি এখানে কাজ করছি, তিন বছর আগে আমার ছবির একটি প্রদর্শনী করেছি, মানুষ আমার ছবি পছন্দ করেছে। আমি এখন আরব সভ্যতা-আল আরহাব নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু তা নাসিত্মবাদ নিয়ে নয় – আরব সভ্যতা কেমন করে জ্যোতির্বিদ্যা, ভ্রমণ, বিজ্ঞান এবং এমন অনেক বিষয়ে অবদান রেখে মানব জাতিকে সহায়তা করেছে, তা নিয়ে আমি এর মধ্যেই বেশকিছু স্কেচ করেছি, সব মিলিয়ে নিরানববইটার মতো পেইন্টিং হবে।
আমি একজন বিশ্বনাগরিক আর একজন চিত্রশিল্পীর তা-ই হবার কথা, কারণ তাঁর বিষয় তো দৃশ্যমান জগৎ। ষাট-সত্তর বছর ধরে আমার মূল প্রবণতা পাঁচশো বছরের পুরনো ভারতীয় সভ্যতাকে ধারণ করা, আমি ভারতেই কাজ করেছি, রামায়ণ ও মহাভারত নিয়ে সিরিজ ছবি এঁকেছি, দেশের প্রতিটি প্রামেত্ম ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার ঘুরে বেড়ানোর এই যে বাসনা তার একটি কারণ আমি দেড় বছর বয়সে মা হারিয়েছি – মায়ের কোল যে হারিয়েছে পৃথিবীতে তার আর কোনো জায়গা নেই – সে কারণেই পৃথিবীর যে প্রামেত্মই যাই না কেন আমার দেখা প্রতিটি নারীর মধ্যে আমার মাকে খুঁজে বেড়াই। আমি তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি – ভারতীয় সংস্কৃতির সারবত্তা হচ্ছে শক্তি – শক্তি হচ্ছে নারী।
প্রশ্ন : যখন মানুষ আপনাকে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত পরবাসী বলে বর্ণনা করে তখন কেমন লাগে?
হুসেন : আমি তখন ‘পরবাস’ শব্দটিকে উপহাস করি। কারণ আমি পঞ্চাশ বছর সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি তো সারাক্ষণই কাজ করি, আমার কাছে পরবাস বলে কিছু নেই। তিন বছর আগে আমি এখানে এসে স্টুডিও স্থাপন করেছি, কারণ জায়গাটা ভারতের খুব কাছে। আরব বিশ্ব ও ভারত বছরের পর বছর বহু কিছু ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এমনকি আমি যখন লন্ডন যাই, ওটাও অর্ধ-ভারত – সবকিছু এত পরিচিত। কিন্তু যখন নিউইয়র্ক যাই তখনই মনে হয় আমি বহিরাগত।
প্রশ্ন : আমেরিকাতে কেন নিজেকে বহিরাগত মনে করেন?
হুসেন : প্রথমত আমি যে দেশের, সে দেশ পাঁচ হাজার বছর বয়সী আর আমেরিকার বয়স মাত্র দুশো বছর। আর দুশো বছর কিছুই নয়। বুঝতে হলে তাদের আরো এক হাজার বছর টিকে থাকতে হবে…।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি যদি প্যারিস, নিউইয়র্ক যেতেন কিংবা লন্ডনে, ভারতে আপনাকে যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে, সেখানে তা করতে হতো না?
হুসেন : আমি কিসের মোকাবিলা করছি? কিছুই নয়! মামলা আর বাকি সব তো তুচ্ছ বিষয়। যেভাবেই হোক মোটের ওপর ভারত তো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাছাড়া আমি যা এঁকেছি তা রিয়েলিস্টিক কিছু নয়; আধুনিক চিত্রকলার রীতি অনুসরণ করে, সমকালীন পন্থায় আমি ছবি এঁকে থাকি। আর এটা বোঝা বেশ কষ্টকর। আমি যেখানে নারীর ছবি আঁকি, সে নারী যদি নগ্ন হয় তাহলে তা রিয়েলিস্টিক নয়। আমি শরীরের সবগুলো অংশ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আঁকি না। আমাদের মন্দিরেও কিন্তু নগ্ন নারীর ছবি থাকে। নগ্নতা বিশুদ্ধতা ও শক্তির রূপালঙ্কার।
প্রশ্ন : তার মানে আপনি মনে করছেন তাঁরা আপনার ছবি বোঝেননি? নাকি ইচ্ছে করেই না বোঝার সিদ্ধামত্ম নিয়েছেন?
হুসেন : কারণটা যে কী আমি জানি না, এটা বুঝতে সময় লাগবে। রেনেসাঁর পর ইউরোপে যখন ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলা এলো, তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তারা এসব ছবিকে বলল ‘ননসেন্স’। কিন্তু এখন তা ধ্রম্নপদ সম্পদে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে বড় ধরনের চিত্রকলা আন্দোলন ঘটে গেছে – সমকালীন চিত্রশিল্পীদের হাতে তা ঘটেছে। শত শত শিল্পী এখন কাজ করছে এবং তাদের সবার ভিত্তি এই এ-কালের চিত্রকলা।
প্রশ্ন : হতে পারে, সৃজনশীলতার ধারণাটি সময় থেকে খানিকটা এগিয়ে ছিল।
হুসেন : সবসময় তা-ই হয়েছে। ভিজ্যুয়াল আর্ট সবসময়ই সময় থেকে এগিয়ে, কারণ শিল্পীরা জীবন ও ল্যান্ডস্কেপের কাঠামোর কোনো কোনো পরিবর্তন আগাম দেখতে পান। মানুষ যেভাবে বস্ত্তকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ সে রকম প্রপঞ্চের অংশ – এভাবেই মানুষ তার জন্য পৃথিবী সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন : এটা কি আপনাকে উদ্বিগ্ন করেছে কিংবা বিপর্যসত্ম করে দিয়েছে? আপনি সারাজীবনই বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন – কিন্তু এটা তো বিশেষ ধরনের – এর বেলায়?
হুসেন : মোটেও না। মামলা-মোকদ্দমা চলছে, কিন্তু কেউ আমাকে দমাতে পারবে না। আর আমি যা বিশ কিংবা ত্রিশ বছর আগে করেছি, এখন তো আর তা করি না – এমন তো নয় যে, আমি আজো একই ধরনের কাজ করে বেড়াচ্ছি।
প্রশ্ন : কিন্তু এবার তো ব্যাপারটা সহিংস হয়ে উঠেছে। আক্রমণ হয়েছে, ভাঙচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ধ্বংসোন্মাদনা চলেছে।
হুসেন : না, ধ্বংসোন্মাদনার কিছু ঘটেনি। কে বলেছে এমন কিছু হয়েছে? সব ঠিক আছে। কিছু প্রতিবাদ হয়েছে – এই তো। তারা আমার কোনো ক্ষয়ক্ষতি করেনি এবং এমনকি আমার ইচ্ছেমতো কাজ করা থেকে আমাকে বিরতও রাখেনি।
প্রশ্ন : তার মানে আপনি বলতে চান আপনার ভারত থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে এসব বিতর্কের কোনো সম্পর্ক নেই!
হুসেন : না, কিছুই নেই।
প্রশ্ন : কিন্তু সে ঘটনার পর অনেকদিন তো হয়ে গেল। আপনার ভক্তরা এখন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
হুসেন : আমি এসব জানি না। সত্যি কথা হলো, ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় আমার চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন হচ্ছে, আমি সেখানে থাকছি (প্রকৃত সত্য হচ্ছে শিল্পী এম এফ হুসেনের আর ভারতে ফেরা হয়নি)।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনার ছবি নিয়ে যাঁরা বিচলিত হয়ে পড়েছেন, মামলা-মোকদ্দমা পর্যমত্ম করেছেন, তাঁদের জন্য আপনার কোনো বার্তা আছে কি?
হুসেন : মামলা তো আদালতে। এ মানুষগুলো আমার ছবি নিয়ে বিরক্ত হয়েছিল, জনে জনে এই জনতার কাছে কেমন করে বার্তা দেব? এটা কঠিন কাজ।
প্রশ্ন : কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আপনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, আপনি কাউকে কাউকে আঘাত করেছেন?
হুসেন : আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আমি যা করেছি আমার বিশ্বাস ও ভালোবাসা থেকে করেছি। কিন্তু আমার এই প্রক্রিয়ায় কারো অনুভূতিতে যদি আঘাত লেগে থাকে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
প্রশ্ন : অতীতে আপনি যেমন বলেছেন আপনি এক ঈশ্বর বিবেচনা করেন, আমি যদি মানুষের সব নির্মম সমালোচনা ও প্রশ্ন আপনার সামনে তুলে ধরি…।
হুসেন : এই সুন্দর ল্যান্ডস্কেপটি দেখুন, চলুন আমরা সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলি… পৃথিবীর ইতিবাচক বিষয় নিয়ে – এসব তো খুব তুচ্ছ বিষয়, আর আমরা এত বড় একটি মহান দেশ। আমাদের মধ্যে অনুপম এক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে – এটা হচ্ছে কম্পোজিট কালচার – বাইরের শক্তিসমূহ এখানে এসে বিকশিত হয়েছে।
প্রশ্ন : এ-রকম সময়ে যখন কার্টুন নিয়ে বিতর্ক চলছে তখন এ বিষয়গুলো (এম এফ হুসেনের সঙ্গে বিরোধ) আরো জটিল হয়ে উঠবে।
হুসেন : এসব নিয়ে আমি মোটেই উদ্বিগ্ন নই। আমার উদ্বেগ সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে। ব্যস। অন্যকিছু আমাকে বিচলিত করে না।
প্রশ্ন : আপনি গভীর অনুরক্তি নিয়ে হিন্দু দেবতা ও দেবীদের ছবি এঁকেছেন। যেমন গণেশ। বহু বছর ধরে গণেশ আপনার হাতে রূপকালঙ্কার হয়ে আছে।
হুসেন : ভারতে আপনি বাড়ি বাড়ি যান, সেখানে একটি নয়, বহু গণেশের দেখা পাবেন।
প্রশ্ন : আপনি কি ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ?
হুসেন : আমি বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী নই।
প্রশ্ন : আপনি কি প্রার্থনা করেন – মন্দির কিংবা মসজিদে যান?
হুসেন : আমার জন্ম পান্ধারপুরে, আমার মা মহারাষ্ট্রের, খুদাই কসমের বদলে তিনি বলতেন ‘দেবাশিস শপথ’… আমি এ-রকম একটি পরিবেশে বেড়ে উঠি।
প্রশ্ন : সন্দেহ নেই আপনি ধর্মীয় সম্মিলনের একটি কম্পোজিট কালচারের প্রতীক হিসেবে বড় হয়েছেন। কাজেই যে প্রশ্নটি আপনার দিকে ছুড়ে দিতে চাই তা হচ্ছে, আপনি যদি এভাবে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি আঁকতে পারেন তাহলে নবীজীর ছবি কেন আঁকেন না?
হুসেন : আমি কিছু বলতে চাই না।
প্রশ্ন : এটা আপনার সৃজনশীলতাকে প্রভাবিত করছে না?
হুসেন : আমি ভালোভাবেই আমার কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : লন্ডনে আপনার ডান হাত যখন ভাঙল, আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।
হুসেন : হ্যাঁ, দুমাস আমার ডান হাত পস্নাস্টার করা ছিল। তাহলে কী করা? আমি বাম হাতে কাজ করতে শুরম্ন করলাম। তখন আমার রঙের গঠনের অভিজ্ঞতা হলো। ষাট-সত্তর বছর ছবি আঁকার পর ছবির কারিগরি দিক নিয়ে লড়াই করার কারণ নেই, যা কিছু আছে তা ছবির ভিশন নিয়ে।
প্রশ্ন : অভিব্যক্তির দিক থেকে বিচার করলে এখন কোন দিকে আপনার ছবির অভ্যুদয় ঘটবে?
হুসেন : আমার দৃষ্টি এখন ইতিহাসেই বেশি নিবদ্ধ… এখন যাই করা হোক তাই ইতিহাস! তিন বছর আগে আমি একটি সিরিজ করেছিলাম ‘অ্যা পেইন্টার্স ভিশন অব টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’, কারণ মানবজাতির ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীই হচ্ছে সবচেয়ে গতিশীল সময়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, কবিতা – যা কিছু এ সময়ে ঘটেছে আমি তা-ই এঁকেছি। এতকিছু ঘটেছে – ১৯১১-তে উড়োজাহাজ আকাশে উড়ল। ১৯৫০-এর দশকে তা চাঁদে পৌঁছে গেল। আমার পঁচিশটি ছবি দুবাইতে প্রদর্শন করা হবে, তারপর সিঙ্গাপুর এবং বিভিন্ন জায়গায়। এখন আমি বাকি পঁচাত্তরটি ছবির ওপর কাজ করছি। অপর কাজটি হবে আরব সভ্যতা নিয়ে। তারপরও শিল্পী হওয়ার পরিবর্তে আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চেয়েছিলাম, কারণ আমি মনে করি সিনেমা হচ্ছে সবচেয়ে গতিশীল মাধ্যম, কারণ এ মাধ্যমটি শিল্পকলার সবকিছু ধারণ করতে পারে – সাহিত্য, সংগীত, কবিতা – সবই এখানে আছে। আমি বাণিজ্যিক দিক নিয়ে মোটেও ভাবি না, আমার ভাবনা সৃজনশীলতা নিয়ে। চলিস্নশ-পঞ্চাশ বছর পর সুযোগ পেয়ে মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে গজগামিনী তৈরি করি। পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে আমার পেইন্টিংয়ে যে নারীর সন্ধান করছিলাম গজগামিনী মাধুরীতে তা পূর্ণাঙ্গ হয়ে ধরা দেয় – মাধুরীর শরীরী ভাষা, প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালন পুরোপুরি ভারতীয়। দশ-এগারো বছর পর আমি ভারতীয় সিনেমায় আরো একটি নারী-কাঠামো খুঁজে পাই, তাঁর নাম অমৃতা রাও। তিনি এসেছেন ব্যাঙ্গালোর থেকে, কেবল দু-একটি ছবি করেছেন। সুরম্নজ ভারতীয়ার বিবাহ ছবিতে অমৃতা একটি ছোট শহরের বালিকা ও তার মূল্যবোধ ফুটিয়ে তুলেছেন। আমি মনে করি, এ এক অসাধারণ ছবি। এটা সুপারহিট ছবি হবে। এখন আমি এ নিয়ে কাজ করছি – আমি দশবার সিনেমাটি দেখেছি।
প্রশ্ন : আপনার পঁচাত্তরবার দেখা সিনেমা হাম আপকে হ্যায় কৌনের কাছাকাছি পৌঁছতে অনেক বাকি?
হুসেন : না, আমি মনে করি সিনেমাটি আমি অমত্মত একশবার দেখব। কারণ এটি অনেক বেশি বাসত্মবানুগ, কল্পপ্রবণতা কম – বিশাল বাড়ি, সশব্দ নৃত্য ও সংগীত নয়; এটি মাটির কাছাকাছি। ছোট শহরের প্রেক্ষাপটে একটি মধ্যবিত্ত পরিবার এতে চিত্রায়িত হয়েছে।
প্রশ্ন : ভারতে ছবি নির্মাণ আগের চেয়ে আরো উন্নততর হয়েছে।
হুসেন : আমি দুটো ছবি বানিয়েছি – গজগামিনী এবং অ্যা টেইল অব টু সিটিজ – কারণ শহরের প্রতি আমার ভালোলাগা। একটি শহর হায়দারাবাদ অন্যটি রাজস্থানের জয়সালমের। তৃতীয় একটি শহর প্রাগ আমার বিবেচনায় ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর শহর।
প্রশ্ন : অমৃতা রাওয়ের কী এমন বিশেষত্ব? আমি জানি বোম্বে সিনেমার অনেক অভিনেত্রী এতে সত্যিই হতাশ হবেন।
হুসেন : অনেক ভালো অভিনেত্রী রয়েছেন, কিন্তু আমার আগ্রহ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে। ফ্রান্স কিংবা নিউইয়র্কে কিংবা অন্য যে-কোনো স্থানে আপনি বড়মাপের পেইন্টিং করতে পারেন; কিন্তু এর কোনো ভারতীয় সারবত্তা থাকলে আমি আকৃষ্ট হই। আমার সারাজীবন এই আগ্রহ ধরে রেখেছি। অন্য দেশে কী হচ্ছে আমি তা উড়িয়ে দিচ্ছি না। পরীক্ষামূলক অগ্রগামী সব শিল্প আন্দোলনের প্রতি আমার সমর্থন রয়েছে, যেমন মার্কিন চিত্রশিল্পী অ্যান্ডি ওয়াইল কিন্তু জাঙ্ক কালচারের প্রতিনিধিত্ব করেন। আমেরিকার জন্য তা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু আমি তা অনুকরণ করতে যাব কেন?
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, বিবাহ সিনেমাটি হাম আপকে হ্যায় কৌনের একধাপ ওপরে। অমৃতা রাও-ও কি মাধুরীর একধাপ ওপরে?
হুসেন : অমৃতা অভিনয়ে নতুন। কিন্তু বিকশিত হওয়ার মতো তার অসাধারণ শক্তি রয়েছে। সেজন্যই আমি তার ওপর কাজ করতে চেয়েছি। আমার পছন্দে খুব কমই ভুল হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : তার মানে মোহনীয়, আকর্ষণীয় ও সুন্দরের বাছাইতে আপনার কোনো ভুল নেই।
হুসেন : তা সত্যি। জীবনের উচ্ছ্বাসের প্রতি আগ্রহ ধরে রাখার এক গোপন রহস্য। তা যদি থাকে তাহলে সবসময়ই ভালোবাসায় মগ্ন থাকা যায়। কেবল নারীর প্রেমে মত্ত হওয়া নয়, প্রেমের সত্যিকার আবেগে মগ্ন থাকা।
প্রশ্ন : তাহলে অমৃতা রাও কেমন করে অন্যদের চেয়ে ভিন্ন কিংবা স্পেশাল?
হুসেন : আমি শরীরী ভাষা এবং আর যা কিছু সংস্কৃতির সঙ্গে সে নিরিখে দেখছি। আপনি যা কিছু সৃষ্টি করেন তা যদি নিজ মৃত্তিকা থেকে উত্থিত হয়, তখনই তা যথার্থ।
প্রশ্ন : আমাদের সিনেমাতে ক্রমবর্ধমান মার্কিন এবং পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ করছেন কি?
হুসেন : মার্কিন ঐতিহ্য মাত্র দুশো বছরের। তাদের আছে কেবল মাত্র জাজ সংগীত আর সেটা কালোদের কারণে, জাজ তাদেরই অবদান।
প্রশ্ন : বুশ ইরাক ও অন্যান্য স্থানে যা করেছেন তা কি আমেরিকার সাম্প্রতিক রাজনীতি সম্পর্কে সন্দিগ্ধ করে তোলে?
হুসেন : তাহলে আমাদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করতে হবে। রাজনীতির প্রতি আমার তেমন নজর নেই, ভাসা ভাসা যেটুকু জানা যায় আমি তা-ই জানি, তবে আমেরিকা কী করছে তা গোটা পৃথিবীই জানে। এটা আমেরিকার ইতিহাসে একটি দুর্ভাগ্যজনক অংশ। এ-রকম কিছু মানুষ আসবে আবার চলেও যাবে…।
প্রশ্ন : আমেরিকা অনেক স্মরণীয় সিনেমা তৈরি করেছে।
হুসেন : না, তা করেছে ইতালি।
প্রশ্ন : আপনার পরের সিনেমা কোনটি? এটি কী নিয়ে?
হুসেন : আমি ধ্রম্নপদ ছবি গজগামিনী তৈরি করেছি, সমকালীন দ্য টেইল অব টু সিটিজ বানিয়েছি। তৃতীয়টি হবে একটি কমেডি। কমেডিতে রসজ্ঞান সৃষ্টি হয় আর এই রস পুরোপুরি ভারতীয়, তা রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক কৌতুক নয়। খুব কম শব্দ ব্যবহার করে আগামী গ্রীষ্মে ছবির শুটিং শুরম্ন করব। দেখা যাক সে সময় অমৃতাকে পাওয়া যায় কি না। আমি এর মধ্যে তার একটি পোর্ট্রেট করে ফেলেছি; ছোট শহরের একটি ভারতীয় মেয়ে হিসেবে অমৃতার ইমেজ নিয়ে কাজ করছি।
প্রশ্ন : বেশ তো, অমৃতা রাও রয়েছেন। আপনি আর কাকে চাচ্ছেন?
হুসেন : ছবিতে দুটি মেয়ে আছে। আমি এখনো সিদ্ধামত্ম নিইনি, দেখা যাক। আমি আংশিক স্ক্রিপ্টও লিখেছি।
প্রশ্ন : ছবির কাহিনি সম্পর্কে কিছু বলুন।
হুসেন : না, অনেক চিত্রনির্মাতা কাহিনির জন্য বসে আছেন…।
প্রশ্ন : আপনি যেভাবে শুরম্ন করেছিলেন সিনেমার হোর্ডিং আঁকা – সেখান থেকেই কি সিনেমা তৈরির আগ্রহ সৃষ্টি হয়?
হুসেন : তারও আগে আমি যখন বোম্বে আসি, আমি দশ-পনেরো বছর পেইন্টিং করেছি। পোর্ট্রেট এঁকে আমি ততদিনে সোনার মেডেল পেয়েছি। তারপর আবার বোম্বে আমি। কেউ তখন আমাকে চিনত না, আর বেঁচে থাকার জন্য আমাকে কিছু আয় করতে হবে – আমি তখন সিনেমার হোর্ডিং আঁকতে শুরম্ন করি। আমি সবসময়ই ছবি বানাতে চেয়েছি। কিন্তু এ মাধ্যমটি খুবই ব্যয়বহুল। ১৯৫৫ সালে প্রথম জাতীয় চিত্রপ্রদর্শনীতে আমার ১৫ ফুট দীর্ঘ একটি পেইন্টিং প্রদর্শিত হয়েছিল। এর নাম জমিন-মৃত্তিকা। এটা কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রায় সিনেমার মতোই। এতে আমি ভারতীয় গ্রামীণ জীবনের প্রকৃতি তুলে ধরেছি।
প্রশ্ন : বোম্বেতে আপনার সেই দিনগুলো নিয়ে মনোমুগ্ধকর কাহিনি পড়েছি – আপনি কেমন করে বোম্বের রাসত্মায় পূর্ণদেহী নারীর চিত্র আঁকতেন। নায়িকা দুর্গা খোটের ৪০ ফুট লম্বা ছবি।
হুসেন : আমার কাজ করার কোনো জায়গা ছিল না। আমরা খুব দরিদ্র ছিলাম। সে আমলে বোম্বেতে ট্রাম চলত। দুপুর ২টা থেকে শুরম্ন করে রাত ১২টা পর্যমত্ম। রাত ১১টা থেকে ভোর ৪টা পর্যমত্ম আমি রাসত্মার ওপর বিশাল কাট-আউট পেইন্টিং করতাম এবং তা রাতারাতি শেষ করতাম।
প্রশ্ন : আপনি ধাবাতে (রাসত্মার পাশের সসত্মা রেসেত্মারাঁ) কাজ করেছেন?
হুসেন : হ্যাঁ, আমি যখন প্রথম বোম্বেতে এলাম আমার বাবারও কোনো চাকরি ছিল না – তিনি আমাকে সহায়তা করতে পারতেন না। আমি বললাম, আমার ব্যবস্থা আমি করব। আমি তখন পাকা রাসত্মার ওপর ঘুমাতাম। তারপর আমি সিনেমার হোর্ডিং আঁকতে শুরম্ন করলাম। দিনে ছয়আনা করে পেতাম।
প্রশ্ন : ছয় আনা থেকে পেইন্টিংয়ের জন্য এখন মিলিয়ন ডলার, আপনার কেমন লাগে?
হুসেন : তখন আমি যা পেতাম তা আমাকে অনেক সম্মান ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। এখন নিলামকারী আছে, তাদের প্রতিষ্ঠান আছে, ডিলাররা আছে – এ কাজটা তারা করছে। না আয়ে কি খুশি, না জায়ে কা গাম, কামায়ে দুনিয়া খায়ে হাম! মঞ্চ জীবনের জন্য অত্যমত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। সে সময় আমি কঠোর পরিশ্রম করতাম আর এখন লোকজন কঠোর পরিশ্রম করে চড়া দামে আমার ছবি কেনে।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি যখন কোটির অঙ্কে কিংবা মিলিয়ন ডলারের অঙ্কে দাম চেয়ে বসেন তখন আপনার হাসি পায় না?
হুসেন : সত্যিই তখন হাসি। কথায় বলে না, হাসতে হাসতে টাকা কামায়। একটা সময় ছিল যখন শিল্পকর্মের স্থান ছিল কেবল ধর্মশালায়। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে লেখক ও শিল্প-সমালোচকরা ছবির ব্যাপারে সিদ্ধামত্ম নিতেন। সে সিদ্ধামেত্মর দায়িত্ব এখন বাজারের হাতে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এটা চলে আসবে শিল্পীর হাতে – তখন কেবল ছবির অমত্মর্নিহিত মূল্যই কথা বলবে।
প্রশ্ন : এত টাকা দিয়ে আপনি কী করেন?
হুসেন : সবার আগে – ছয় কোটি টাকা খরচ করে আমি একটি সিনেমা বানিয়েছি। পুরো টাকাটাই আমার। তারপর আমি দিলিস্ন, আহমেদাবাদ, হায়দারাবাদ ও ব্যাঙ্গালোরে মিউজিয়াম বানিয়েছি। তারপর এগুলো শহরকে দিয়ে দিয়েছি – এটি একটি অলাভজনক কাজ। আমি লাইব্রেরি, থিয়েটার গড়েছি। আরো যা করেছি তা সরকারের করার কথা। কিন্তু আমি ভালোবাসি বলেই অর্থ ব্যয় করেছি। আমার ছটি সমত্মান – এটি একটি বড় পরিবার, এটাকে স্থিতিশীল অবস্থায় দাঁড় করাতে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। এই হচ্ছে আমার অর্থ, শ্রমসাধ্য পথে এসেছে, একইভাবে খরচ হচ্ছে।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি তো টাকার কাছে বন্দি হয়ে পড়েননি?
হুসেন : আমার কোনো ব্যাংক ব্যালান্স নেই। আমার বাসনা নিবৃত্তির কোনো প্রচেষ্টাও নেই। কাল যদি আমার কিছু না থাকে, আমি রাসত্মায় বসে পড়তে পারব।
প্রশ্ন : আপনি তো নিজের ছবি বাজারজাতকরণেও পাকা হয়ে উঠেছেন।
হুসেন : বাজারজাতকরণও শিল্পের একটি ধরন। কেমন করে বাজারে নিজের শিল্পপণ্য বিক্রি করতে হয় আমি তার নতুন ধারা সৃষ্টি করেছি। এ ব্যাপারে আমি রক্ষণশীল নই। আমার নিজের কাজ নিজেই বাজারজাত করি। তা ছাড়া সব বড় বড় ডিলার এখন নিষ্প্রাণ।
প্রশ্ন : মানুষ বলে, হোসেন মার্কেটিং করে বেড়ান। তাঁর ঘোড়া আঁকা, খালি পায়ে হাঁটা – সবই মার্কেটিং, তাই নয় কি?
হুসেন : এতে সমস্যা কোথায়? কিন্তু আমি যা আঁকছি, তাতে যদি কিছু না থাকে, দশ বছরও তা টিকবে না।
প্রশ্ন : আপনার নগ্নপদ চলাফেরার ইতিহাসটি শোনান। কবে এটা শুরম্ন করলেন এবং কেন?
হুসেন : আপনি যখন কোথাও যান, সবার আগে মনোযোগ আকর্ষণ করে আপনার জুতো। জুতো আপনার মর্যাদা নির্ধারণ করে। ননসেন্স! আমি রাসত্মার পাশের ধাবায় যেতে খুব পছন্দ করি, আমার শুরম্নটা এ-রকমই। আমি পাঁচতারা-সাততারা হোটেলে থাকতে পারি কিংবা মহারাজার অতিথি হতে পারি; কিন্তু সকালে আমার ধাবাতে যাওয়া চাই-ই।
প্রশ্ন : এটা কখন প্রথম শুরম্ন করলেন?
হুসেন : প্রায় চলিস্নশ বছর আগে। আমি খুব কবিতাভক্ত। কবি মুক্ত বোধ তখন অনেকদিন ধরে দিলিস্নতে অজ্ঞান অবস্থায়। তিনি মে মাসে মৃত্যুবরণ করলেন। আমি তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিলাম আর আমার হঠাৎ মনে হলো তিনি একটি ছোট বইও প্রকাশ করে যেতে পারেননি। এতই উপেক্ষিত ছিলেন তিনি! আমি তাঁকে বড়মাপের হিন্দি কবিদের একজন মনে করি। তখন মনে হলো আমাকেও ভুগতে হবে। আমি জুতো খুলে ফেললাম, মে মাসের পিচতপ্ত রাসত্মায় আমি হাঁটতে শুরম্ন করলাম।
প্রশ্ন : মুক্ত বোধের কোনো লেখা আপনার মনে আছে?
হুসেন : কোনো পঙ্ক্তিই আমার মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, আপনি কবিতা লিখতেন। আপনার কোনো কবিতা আমাদের শোনাবেন?
হুসেন : আমার শৈশবে আমি উর্দুতে লিখতাম; কিন্তু যখন বোম্বে এলাম আমি ইংরেজিতে লিখতে শুরম্ন করলাম। জেনেভা থেকে আমার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলো, বইটির নাম পোয়েট্রি টু বি সিন। প্রায় ল্যান্ডস্কেপের মতো একটি পঙ্ক্তি আমার মনে পড়ছে, ‘তোমার মধ্যে জন্ম নেওয়া আমার শব্দগুলো এখনো বলা হয়নি…।’ চেকোসেস্নাভাকিয়াতে আমার গার্লফ্রেন্ডকে এই পঙ্ক্তিগুলো লিখেছিলাম। ১৯৫৬ সালে তার সঙ্গে আমার দেখা এবং আমি তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম, আমি প্রতিদিন তাকে চিঠি লিখতাম, তাতে থাকত আমার কবিতা – তোমার মধ্যে জন্ম নেওয়া আমার শব্দগুলো এখনো বলা হয়নি।
প্রশ্ন : তাহলে পেইন্টিং, সিনেমা বানানো, কবিতা – কোনটি আপনাকে তরম্নণ, শক্তিমান ও প্রাণবমত্ম রাখছে, আমাদের সেই ফর্মুলাটি দিন।
হুসেন : কম খাবেন এবং সবসময় প্রেমে মগ্ন থাকবেন, এমনকি যখন আপনার বয়স নববই বছর তখনো। বলা হয়, ‘সকল সফল পুরম্নষের পেছনে একজন নারী রয়েছে’ আর আমি বলি, ‘আপনারা কী বলছেন – প্রতিটি সফল পেইন্টিংয়ের পেছনে রয়েছে একজন নারী।’
প্রশ্ন : আপনি বলছেন প্রতিটি বড়মাপের পেইন্টিংয়ের পেছনে রয়েছে একজন নারী। আমি শুনেছি আপনার দুবাই স্টুডিওতে আপনার জীবনের নতুন প্রেরণাদাত্রী অমৃতা রাওয়ের একটি বিখ্যাত পেইন্টিং রয়েছে। এ সম্পর্কে বলুন।
হুসেন : আমি যখন অমৃতাকে আঁকছিলাম তিনি অনুরোধ করলেন আমাকেও ছবিতে থাকতে হবে। সুতরাং এখানে আমি অমৃতাকে আঁকছি।
খুব চমৎকার বলেছেন হুসেন সাহেব। এ পর্যায়ে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে সময় কাটানোর এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি অত্যমত্ম কৃতজ্ঞ।
দুই
‘নিজের ইমেজ ভাঙার সাহস থাকতে
হবে’ : এম এফ হুসেন
ভারতীয় এবং বিশ্বখ্যাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন পেইন্টারদের মিলিয়নেয়ার্স ক্লাবের সদস্য ছিলেন। আমত্মর্জাতিক চিত্রশিল্পের বাজারে উপমহাদেশের প্রবেশদ্বার তিনি খুলে দিয়েছেন। ২০০৪ সালে তিনি উপার্জন করেছেন ২১ মিলিয়ন ডলারের বেশি। ক্রিস্টির নিলামে তাঁর গঙ্গা ও যমুনা বিক্রি হয়েছে ১.৬ মিলিয়ন ডলারে।
ভারতীয় পাসপোর্ট সমর্পণ করে তিনি তখন কাতারের নাগরিক। ৮ মার্চ ২০১০ Arabic Knowledge@wharton পোর্টালে দোহা থেকে তিনি নিচের সাক্ষাৎকারটি প্রদান করেন। তখন শিল্পীর বয়স ৯৪ বছর।
Arabic Knowledge@wharton : আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা আপনার শৈশবের কথা দিয়ে শুরম্ন করতে পারি। আপনার জন্ম তো ১৯১৫ সালে পান্ধারপুরে আর আপনি সিনেমার পোস্টার আঁকতে আঁকতে চিত্রশিল্পীর পেশাজীবন শুরম্ন করেন।
মকবুল ফিদা হুসেন : এই গল্পটি সঠিক নয়। আমি মধ্যপ্রদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চল ইন্দোরে ছিলাম। পান্ধারপুর থেকে আমার পরিবার এখানে চলে আসে। ছয় বছর বয়স থেকেই ড্রইং এবং পেইন্টিংয়ে আমি আগ্রহ দেখাতে শুরম্ন করি। আমার বয়স এগারো বছর হতেই আমি পোর্ট্রেট করতে শুরম্ন করি। বাবাই পরামর্শ দিলেন আমার আর্ট স্কুলে পড়া উচিত। তিনি আমাকে সেখানে নিয়েও গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম চূড়ামত্ম ক্লাসের শিক্ষার্থীরা যা আঁকছে তা আমি প্রথম বর্ষে বসেই আঁকতে পারব। তখন আমি সিদ্ধামত্ম নিলাম আমি স্কুলে পাঁচটি বছর নষ্ট করতে চাই না, আমার ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ চাকরির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি হাতে ব্রাশ নিয়ে কেবল রং করতে চেয়েছি; যদি তেমন কাজ না পাই তাহলে দেয়াল হোয়াইটওয়াশ করতেও আমার কোনো আপত্তি নেই – এটাই আমার নিষ্ঠা। আমি তাই করতে চাইলাম। কল্পনা করম্নন তখন আমাদের কোনো আর্ট গ্যালারি ছিল না। আমি ১৯২৫, ২৬, ২৭-এর কথা বলছি। আমি রং-তুলির কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম।
প্রশ্ন : কোন কোন শিল্পী আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
হুসেন : প্রধান এবং প্রথম আমার কল্পলোকের ঘোড়া টিপে দেয় ডাচ মাস্টার রেমব্রান্টকে নিয়ে তৈরি একটি চলচ্চিত্র, ১৯৩০ সালের প্রথমদিকে আমি তা দেখার সুযোগ পাই। হলিউডের এই ছবিটিতে চার্লস লাউটন নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। রেমব্রান্ট সাধারণত তাঁর দেখা মানুষের মুখ আঁকতেন আর সেই মুখগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। প্রথিতযশা কোনো ব্যক্তি হতে হবে এমন নয়, যে কারো মুখের ছবি। নারী হোক কি পুরম্নষ হোক আমি খবরের কাগজ থেকে যে-কোনো মানুষের মুখ কেটে রাখতাম এবং এগুলো সংগ্রহে রাখতাম। পোর্ট্রেট পেইন্ট করা আমার প্রিয় একটি কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন : তাহলে রেমব্রান্ট স্পষ্টতই আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। পিকাসোর ব্যাপারে?
হুসেন : শুরম্নর দিকে আমি পিকাসোকে তেমন পছন্দ করতাম না, এখনো আমার তেমন পছন্দের নয়। কোনো সন্দেহ নেই তিনি বিংশ শতকের প্রধান শিল্পীদের একজন। কিন্তু তাঁর শিল্প পুরোপুরি পাশ্চাত্যের, অবশ্য এ নিয়ে আমার কিছু করার নেই। কোনটা যে ভারতীয় তা নিয়ে আমি শুরম্ন থেকেই সচেতন ছিলাম। এমনকি শিক্ষাতেও আমি ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। পাশ্চাত্যভিত্তিক যে শিক্ষা আজ তা প্রাসঙ্গিক; আমরা সবটা বদলে দিইনি। আমি সংস্কৃত, আরবি, পার্সি – এসব শিখেছি। হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠিও শিখেছি। শুরম্নতে আমার ইংরেজির ভিত্তি ভালো ছিল না, কিন্তু যখন বোম্বে এলাম আমি ইংরেজি শিখলাম। এখন তো ইংরেজিতে বেশ ভালোই।
প্রশ্ন : আমি আপনার জীবনের শৈল্পিক ও উদ্যোক্তার দিক – এ নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই। সব শিল্পীর সৃজনশীল একটি দিক এবং উদ্যোক্তাসুলভ একটি দিক রয়েছে। আপনি দুটো দিক কেমন করে সামলে নেন?
হুসেন : অধিকাংশ শিল্পীই উদ্যোক্তা নন। আমি বলতে চাচ্ছি, তাঁরা ছবি সৃষ্টি করা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন। ভ্যান গঘের উদাহরণ দেওয়া যায়। তিনি কেবল ছবি আঁকতেন আর তাঁর ভাই থিও বাকি কাজটা – বাজারজাতকরণ থেকে যা যা করা দরকার করতেন। আবার এদিকে পিকাসোর উদাহরণ দেওয়া যাক। পিকাসো নিজেই একজন বড় উদ্যোক্তা। নিজের কাজকে কেমন করে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে হয় তিনি তা জানতেন। আবার চলচ্চিত্রে স্ট্যানলে কুবরিক একজন মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা। একটি ছবি বানাতে তিনি হয়তো দশ বছর সময় নিতেন, কিন্তু তারপর ছবি মুক্তি পাবার তারিখ, জায়গা ঠিক করা থেকে শুরম্ন করে যা কিছু আছে তিনি নিজেই তা করতেন। সেভাবে আমি নিজেও আমার কাজের সঙ্গে খুব সম্পৃক্ত থাকি এবং আমার ছবি বাজারজাত করার নতুন কর্মকৌশল আবিষ্কার করি – এটা খুব গুরম্নত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
প্রশ্ন : আপনি কি শিল্প বাজারজাত করার কর্মকৌশলের বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন?
হুসেন : ভারতে আর্ট ডিলারের উপস্থিতি ও ঐতিহ্য না থাকায় আমাকেই সম্পৃক্ত হতে হয়। এখানে শিল্পকর্মকে সবসময়ই পবিত্র মনে করা হতো, সুতরাং তা বেচাকেনা করা যাবে না। শিল্পকর্ম বাজারজাত করা ধর্মদ্রোহিতার শামিল। আমার মনে পড়ে, দিলিস্নতে প্রথম বাণিজ্যিক গ্যালারি খোলা হয় ১৯৫২ সালে। প্রথম প্রদর্শনীটিই আমার। এমনকি দিলিস্নতেও আমার ছবি দিয়ে প্রথম গ্যালারির সূচনা করা হয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর হোমি ভাবা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। সেই দিনগুলোতে আমার বন্ধুরা বলতেন এভাবে শিল্পকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা উচিত নয়। এতে শিল্পের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হয়। আমি বললাম, একদিন আপনাদেরও তাই করতে হবে। এ যুগে আপনি যখন সবকিছু সৃষ্টি করছেন, এসব তুলে ধরার দায়িত্বও আপনাকে নিতে হবে। আপনার বাড়িতে এসে আপনার শিল্পকর্ম দেখার সময় মানুষের নেই। কাজেই এটাই সূচনা। ‘বাণিজ্যিক চিত্রশিল্পী’ বলে আমাকে অভিযুক্ত করা হলো। যে যাই বলুন…
প্রশ্ন : আপনি এসবের কী জবাব দিয়েছেন?
হুসেন : শুরম্ন থেকেই আমি একজন গোঁয়াড় প্রকৃতির মানুষ। সবসময়ই যা কিছু স্বাভাবিক মনে হয় আমি ধ্বংস করে চলেছি। সেটা একটা কারণ আর আমার বয়স যখন দেড় বছর আমি আমার মাকে হারিয়েছি। একটি শিশুর যে ভালোবাসা ও সোহাগ প্রয়োজন আমি তা পাইনি। কাজেই আমি বিদ্রোহী। কাজেই এভাবেই আমি আমার পথ নির্মাণ করেছি – সব আইনকানুন ভেঙেচুরে… অবশ্য সেজন্য আমাকে মূল্যও দিতে হয়েছে।
প্রশ্ন : এ বিষয়ে আমরা ফিরে আসব। শিল্পকর্ম বাজারজাত করার প্রশ্নে আবার ফিরে যেতে চাই। তখনকার বাজারজাতকরণ আর এখনকার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
হুসেন : ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে পাশ্চাত্যের আর্ট ডিলাররা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠল। তাদের উদ্দেশ্য টাকা বানানো। কখনো কখনো তারা শিল্পীর কাছ থেকে বিক্রীত মূল্যের ৭০%, ৮০% কেটে রাখত। ভারতে আর্ট ডিলারের সহযোগিতা ছাড়া একজন শিল্পীর টিকে থাকা সম্ভব হলেও পাশ্চাত্যে তাদের বাদ দিয়ে ছবির প্রদর্শনী করাও সম্ভব নয়। আর্ট ডিলারের সঙ্গে শিল্পীদের ১০ বছর বা ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি করতে হতো – শিল্পীরা পেতেন কেবল টিকে থাকার মতো অর্থ – চিত্রশিল্পীরা এভাবেই তাদের শোষণের শিকার হতেন। ভারতে যদিও গ্যালারিগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যার কিছু অর্থ খরচের সামর্থ্য রয়েছে তিনি একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারেন, পাশ্চাত্যে তা করা একেবারেই অসম্ভব। শুরম্নতে ভারতে আমাদের আর্ট ডিলার ছিল না। আমরা সানডে বিয়ার পার্টির আয়োজন করতাম, কিংবা কোনো একটা কিছু উপলক্ষে আমাদের আঁকা ছবি দেখার জন্য লোকজনকে নিমন্ত্রণ জানাতাম। সে সময় আমাদের ছবির ক্রেতা ছিল বিদেশিরা। একজন ভারতীয় ক্রেতাও ছিল না। ভারতীয় ক্রেতা পেতে আরো ২০ থেকে ৩০ বছর লেগে যায়।
প্রশ্ন : আবুধাবিতে ‘ফেস্টিভাল অব থিঙ্কার্স’-এ আপনি দর্শকের সামনে ছবি এঁকেছেন। সঙ্গে ছিল আপনার ছেলের যন্ত্রবাদন। আপনি কেমন করে এরকম একটি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন?
হুসেন : ১৯৬৮ সালে ভারতে আমি এটা প্রথমবারের মতো আয়োজন করি। আমি একটি গ্যালারি ভাড়া নিই। আমি ছদিন দর্শকদের সামনে প্রতিদিন চলিস্নশ মিনিট করে ছবি আঁকি। আমি মনে করেছি, ছবি আঁকার ব্যাপারটি যখন এমন উদ্দীপনাময়, দর্শকদের সঙ্গে এটা ভাগাভাগি করে নিলে কেমন হয়? সেকালে লোকজন বলত, ‘না, শিল্পকর্ম এমনই একটি ব্যক্তিগত বিষয় যে নিঃসঙ্গ নিরম্নপদ্রব থেকে কাজটি করতে হয়।’ আমি তখন বলেছি, ‘অন্য শিল্পমাধ্যমের বেলায় কী? যেমন – সংগীত। সংগীতশিল্পী যদি শ্রোতাদের সঙ্গে নিয়ে গান গাইতে পারেন তাহলে চিত্রশিল্পী কেন পারবেন না। না পারলে বুঝতে হবে আপনার অভিনিবেশ ক্ষমতা দুর্বল।’
এই না পারার মিথ ভাঙতে ১৯৬৮ সালেই আমি প্রথম দিলিস্নতে ছদিনের চিত্রশালায় যোগ দিই। চলিস্নশ মিনিট আমি পিনপতন নীরবতায় কাজ করতাম। আমি মেঝেতে ছটি বিভিন্ন আকারের ক্যানভাস বিছিয়ে দিই। একেকটির ভিন্ন ভিন্ন ধরন। কোনোটি চড়া রঙের, কোনোটি গীতিময় – আমি তখন দেখাতে চেয়েছি মানুষের মন একই সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ‘মুড’-এ সাড়া দিতে পারে। সেকেন্ডেরও কম সময়ে একধরনের মানসিক অবস্থা থেকে অন্যটিতে যাওয়া যায়। এভাবেই আমি ছটি ছবি আঁকি। কিন্তু তারপর কী হলো? শেষে দেখা গেল দুটি ছবি ফ্লপ করল। এটাই সৃষ্টির রহস্য, এমনকি চলিস্নশ-পঞ্চাশ বছর ছবি আঁকার পরও কখনো কখনো কিছু ছবি নাও হয়ে উঠতে পারে।
এই রহস্যই শিল্পীদের মুগ্ধ করে রাখে। নিজের সক্ষমতার ঘাটতি নিয়ে লজ্জা না পেলে দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। একজন শিল্পীর সবসময়ই কেন নিজের শ্রেষ্ঠ কাজটি করতে চেষ্টা করতে হবে আর যা শ্রেষ্ঠ নয় তা লুকিয়ে ফেলতে হবে? মানুষের মধ্যে কারোরই সম্পূর্ণ ‘পারফেকশন’ নেই, দুর্বলতা রয়েছে। যদি আমরা তা স্বীকার করে নিই, আমরা তখন স্বচ্ছ মানুষ। আমি সেই মিথই ভাঙতে চেয়েছি। আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে শুরম্ন করি। আমি সেখানে সবার উপস্থিতিতে পঁয়তালিস্নশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ছবি আঁকব – এ খুব মনোমুগ্ধকর কাজ। ফেস্টিভাল অব থিঙ্কার্সে আমার কাজ এই উদ্যোগেরই একটি অংশ। এটা হাতে-কলমে কাজ দেখানো কোনো অনুশীলন নয়, এটা সিরিয়াস পেইন্টিং।
প্রশ্ন : সনাতন বাজারিরা আপনার বাজারজাতকরণ কৌশলের কাছে কী শিখবে?
হুসেন : ডিলারদের অধিকাংশই মূলত দোকানদার। তারা সমকালীন ভারতীয় শিল্পকলার আন্দোলন সম্বন্ধে অবহিত নয়, কীভাবে জনগণকে তা জানাতে হবে এ সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই। তারা কেবল কেনে আর বেচে। শিল্পের এই আবেগ কখনো তাদের মধ্যে আসার কথা নয়। আমি মনে করেছি, তাদের এড়িয়ে যাওয়া দরকার। ২০০৫-এ ভারত থেকে বেরিয়ে এসে আমি এ কাজটা করি। আমি বলি, ভারতে এভাবে কিছু করা যাবে না। আমি এটাকে বড়মাপে আমত্মর্জাতিক মানের করতে চাই। এসব নিয়ে ঈর্ষাপরায়ণতাও ছিল।… নিজ দেশে আপনি কখনো প্রাপ্য সম্মান পাবেন না।
২০০৫ সালে ভারত থেকে বেরিয়ে এসে আমি এই প্রকল্পটি হাতে নিতে চাই। পাশ্চাত্যের তুলনায় ভারতে পেইন্টিংয়ের বিক্রয়মূল্য হাস্যকরভাবে কম। শিল্পী যখন তার ছবির দাম বাড়াতে চাইবেন তখনই ভারতীয় ডিলাররা তাকে থামিয়ে দেবে, বলবে এটা করতে যাবেন না, ছবি বিক্রি হবে না। আমি দেখলাম ভারতে গড়পড়তা একটা ভালো ছবির জন্য আমার দাম ষাট হাজার থেকে আশি হাজার রম্নপি (এক হাজার পাঁচশো থেকে দুই হাজার ডলার)। আমি ঠিক করলাম, আমার ছবির দাম হবে এক কোটি টাকা (দুই লাখ ডলার)। আমি পঁচিশটি পেইন্টিংসের একটি সিরিজ পরিকল্পনা করলাম, আলাদাভাবে একটা বিক্রি হবে না, কিনলে পুরো সেটই কিনতে হবে। ভারতে এ ধরনের কাজ আমারই প্রথম। আমি কেরালায় কাজ করার সময় বিশটি ছবি করলাম এবং জানিয়ে দিলাম কেউ কিনতে চাইলে তাকে সবগুলোই নির্দিষ্ট দামে কিনতে হবে। আমার দেড় বছর লেগে গেল, কিন্তু ছবিগুলো বিক্রি হলো।
প্রশ্ন : ছবিগুলো কে কিনেছেন?
হুসেন : বোম্বের একজন পার্সি ভদ্রলোক। আমি কেমন করে ছবি বেচেছি, ডিলাররা বলল, তাদের জানা নেই। পরে তারা ভাবল, এমন বিক্রি একবারই সম্ভব, এর পুনরাবৃত্তি হবার নয়। যে ডিলার চলিস্নশ বছর ধরে আমার ছবি বেচাকেনা করছে, আমাকে জানাল প্রতিটি ছবি এক কোটি টাকা করে পঁচিশটি ছবি একসঙ্গে বিক্রি করা কখনো সম্ভব নয়। আমি চেষ্টা করতে চাইলাম, ডিলারের সমর্থন পেলাম না। আমি মধ্যপ্রাচ্যে চলে এসে দুবাইকে বেছে নিলাম, এখানে তেমন শিল্পিত দৃশ্যপট নেই, এখন অবশ্য অনেক হয়েছে। প্রথম প্রদর্শনীর একজন স্পনসরের কথা ভাবলাম। ব্যাংকগুলো একটি সাংস্কৃতিক ইমেজ চায়। সিটি ব্যাংক এগিয়ে এলো।
আমি খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিই প্রদর্শনী হবে মাত্র তিন ঘণ্টা। দশ মিলিয়ন বা ততোধিক মূল্যের গোল্ড কার্ডধারীরাই এখানে আসার আমন্ত্রণ পাবেন, অন্য কেউ নয়। এটি পুরো ব্যবসায়ী বুদ্ধি। আমন্ত্রিতরা আমার ছবি দেখেছেন। বেশি সময় ধরে দেখতে চাইলে ইন্টারনেটে দেখতে পারেন।
প্রথম প্রদর্শনী দুবাইতে, দ্বিতীয়টি সিঙ্গাপুরে এবং শেষটি লন্ডনে। দুবাইতে বললাম, কোনো ছবি বিক্রি হবে না, এমনকি মূল্যও জানানো যাবে না। যে কজন মহিলা অতিথি অভ্যর্থনা জানিয়েছে তাদের বললাম, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে প্রতিটি পেইন্টিং এক কোটি রম্নপি, কিন্তু কোনো ছবি বিক্রি হবে না। ধনী মানুষদের অনেকেই ছবি দেখল, কিনতে চাইল কিন্তু পারল না। উত্তেজিত হয়ে বলল, যত টাকা লাগে দেবে। আমি লোভ সংবরণ করলাম এবং ছবি বিক্রি করা থেকে বিরত রইলাম।
পরের প্রদর্শনী সিঙ্গাপুরে। একজন ক্রেতা পেয়ে গেলাম, যিনি পঁচিশ কোটি রম্নপি দিয়ে পঁচিশটি নিয়ে নিলেন। এটা তখন বড় আমত্মর্জাতিক সংবাদ হলো। এ রকম আগে কখনো ঘটেনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল সমকালীন ভারতীয় চিত্রকর্মের দাম বাড়ানো। আমি টাকাটা দেশের বাইরেও নিতে পারতাম, জানি। কিন্তু তা করিনি। আমি টাকা ভারতে নিয়েছি এবং ওই পেইন্টিংগুলোর জন্য সরকারকে তেরো কোটি রম্নপি আয়কর দিয়েছি।
প্রশ্ন : ভারতীয় চিত্রকর্মের বাজার কেমন মনে হচ্ছে?
হুসেন : আমি মনে করি, ক্রেতারা অনিবাসী ভারতীয়, তারা দেশের বাইরে থাকেন। তাঁরাই সমকালীন শিল্পের সত্যিকার সমর্থক। এখনো শিল্পের বাজার অনিবাসীদের মধ্যেই বাড়ছে। ঠিক পথেই এগোচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনি যখন ডিলারদের নেটওয়ার্কের কথা বলেন – যা শিল্পী ও ক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ বাধাগ্রসত্ম করছে – অনেক শিল্প-কারখানায় ইন্টারনেট এখন ডিলারের ভূমিকা অপসারণ করেছে, সে রকম কিছু কি চিত্রশিল্পের বেলায় ঘটছে না? মধ্যস্বত্বভোগী বিলোপ করতে আপনি কি ইন্টারনেট ব্যবহার করে দেখেছেন?
হুসেন : না, আমি এখনো এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছি, এ বিষয়ে আমি অনেকটা নিরক্ষর। আজ পর্যমত্ম আমার একজন ম্যানেজার নেই, আমার হিসাব-নিকাশের কোনো ডেস্ক নেই। আমি একাই চারটি মিউজিয়াম, ছটি সমত্মানের ব্যবস্থাপক – এ পর্যমত্ম ভালোই চালিয়েছি। এটা বড় কাজ।
প্রশ্ন : এবার আপনার শৈশবের বিপস্নবী সত্তার দিকটা নিয়ে কথা বলা যাক। শিল্পের সৃজনশীল দিক ও বাজারের দিকের মধ্যে টেনশন ছাড়াও শিল্পী ও ব্যবসায়ীর মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। কিন্তু আপনার ছবিগুলোতে আপনি ব্যবসায়ীদের মতোই ঝুঁকি নিয়েছেন। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা আপনার কাছে কী শিখতে পারে?
হুসেন : এগুলো কীভাবে কাজ করে তার কোনো ফর্মুলা দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : আপনার চিত্রকর্মে ঝুঁকির বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
হুসেন : সৃষ্টির প্রশ্নে যে মুহূর্তে আপনি আপনার কাজ দিয়ে স্বীকৃত, আপনি যত ভালো কাজই করে থাকুন না কেন, নিজের ইমেজ ভাঙার সাহস আপনার থাকতে হবে। প্রতিটি সত্মরেই আপনাকে এভাবে ভাঙতে হবে। এটাই চাবিকাঠি।
প্রশ্ন : আপনি কি বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?
হুসেন : আমার ছবি আঁকার শৈলীর দিকে লক্ষ করম্নন। ধরম্নন, আপনি একজন ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার। আপনি সারাদিন ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে পড়ে থাকবেন না। যামিনী রায়ের কথা ধরম্নন। তিনি চিত্রকলার লোকঐতিহ্য – কালীঘাট শৈলী গ্রহণ করেছিলেন, তাই তিনি ক্যানভাসে এঁকেছেন। কিন্তু তিনি সেখানেই আটকে থাকেন। প্রায় ত্রিশ, চলিস্নশ, পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি একই শৈলী অনুসরণ করে এঁকে গেছেন। তিনি তাঁর ইমেজ ভাঙতে পারতেন। আর এটাই সৃজনশীলতার চাবিকাঠি, অসিত্মত্বের এটাই একক উদ্দেশ্য। প্রকৃতি তা-ই চায়।
প্রশ্ন : আপনার শিল্পী জীবন ও ব্যবসায়িক জীবনের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলুন আপনি সবচেয়ে বড় কোন ভুলটি করেছেন? সেই ভুল থেকে কী শিখেছেন?
হুসেন : কিছু মারাত্মক ভুলসহ ছোট-বড় অনেক ভুল করেছি। গান্ধীজি বলেছেন, তোমার যদি বিশাল ভুল হিমালয়ন বস্নান্ডার করার সাহস না থাকে তাহলে তুমি সারাজীবনে কিছু করতে পারবে না। আমার ভুলগুলো হিমালয়-প্রমাণ নয় – তার চেয়ে ছোট।
প্রশ্ন : একটি শেষ জিজ্ঞাসা। আপনি সাফল্যকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেন?
হুসেন : আপনি যদি সাফল্যের লক্ষক্ষ্য কাজ করে যান সাফল্য কখনো আসবে না। সাফল্যকে আপনার অস্বীকার করতে হবে। সেজন্য যখনই আপনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন, বারবার আপনাকে আপনার ইমেজ ভাঙতে হবে।
তিন
‘শিল্পকলা সময়ের চেয়ে এগিয়ে
থাকে’ : এম এফ হুসেন
এনডিটিভির রিপোর্টার বার্খা দত্ত নির্বাসিত চিত্রশিল্পী
মকবুল ফিদা হুসেনের সাক্ষাৎকার নেন। ১০ মার্চ
২০১০ এটি সম্প্রচারিত হয়। স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে
সাক্ষাৎকারটি অনূদিত হলো।
প্রশ্ন : আপনি ভারতীয় পাসপোর্ট সমর্পণ করে কাতারের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন কেন? বহু বছর ধরে আপনি এমনিই তো ভারতের বাইরে বসবাস করছেন, কোন পরিস্থিতিতে আপনাকে ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগের সিদ্ধামত্ম নিতে হয়েছে?
হুসেন : আমার এ সিদ্ধামেত্মর একটি যুক্তি রয়েছে। ২০০৬ সালে আমি তিনটি বড় প্রকল্পে কাজ করার সিদ্ধামত্ম নিই :
মহেঞ্জোদারো থেকে মনমোহন সিং পর্যমত্ম ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস।
ব্যাবিলন থেকে এ-কাল পর্যমত্ম অন্যান্য সভ্যতার ইতিহাস।
চলচ্চিত্র আমার অমত্মরের কাজের বিষয় – চলচ্চিত্র আমার ভালোবাসা। আসছে বছর (২০১১) ভারতীয় চলচ্চিত্রের শতবর্ষপূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষে আমার কাজ : ১০০ বছরের ভারতীয় সিনেমা।
আমি এসব প্রকল্প ভারতেই বাসত্মবায়ন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনারাই জানেন অনেক বাধা আছে আর এটা খুব সহজ কাজ নয়। প্রথমত, একজন স্পনসর খুঁজে পাবার ব্যাপার রয়েছে। আমি অপেক্ষা করছিলাম। ২০০৪-এ যখন দুবাই আসি স্পনসরের খোঁজে, সিদ্ধামত্মটি তখনই নেওয়া। লন্ডনে আমি ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসের স্পনসর পেয়েছি, কাতারে শেখ মোজাহ অন্যান্য সভ্যতার ওপর কাজ করার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আর আমার ভারতীয় সিনেমা প্রকল্প স্পনসর করবেন, যার সাহায্যে আমি মনে করি আগামী বছর ভালোভাবেই কাজটা শুরম্ন করতে পারব। কাজেই এসব কাজ ভালো করে করার জন্য আমি অনিবাসী ভারতীয় হয়ে গেছি, কারণ সেখানকার কর কাঠামোতে সুবিধা বেশি (যে-কোনো কর্পোরেটকে জিজ্ঞেস করলেই তা জানতে পারবে)। এটা কেবল ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীর সমস্যা। রোমান পোলানস্কিকে নিয়ে কী ঘটেছে, সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যান – আয়কর বিভাগের লোকদের তাড়ায় তাঁদের দেশ ছাড়তে হয়েছে।
আমার বয়স যদি ৪০ বছর হতো তাহলে আদাজল খেয়ে লড়াই করতাম। এখানে আমি কেবল কাজের ওপর মনোনিবেশ করতে চাই, আমি কোনো বাধা ও বিরক্তি চাই না। আমি চাই পুরোপুরি স্বসিত্ম ও কাজ করার জন্য সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা।
তারপরও হিন্দিতে যেমন বলে, হিন্দুসত্মান হাম ওয়াতান হ্যায়, সারা জাঁহা হামারা। এগুলো কেবল রাজনৈতিক সীমামত্ম, বিশেষ করে ভিজ্যুয়াল আর্টের ভাষা হচ্ছে বৈশ্বিক ভাষা, তুমি পৃথিবীর যে-কোনো স্থানে থাকতে পারো, কিন্তু তুমি যে কাজ করবে তার সঙ্গে রয়েছে মহান ভারতীয় সংস্কৃতির পাঁচ হাজার বছরের সংযোগ।
প্রশ্ন : হুসেন সাহেব আপনি যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে এটা অত্যমত্ম বাসত্মবধর্মী একটা সিদ্ধামত্ম হয়েছে, ভারতে যেসব সুযোগ আপনি পাবেন না, কাতারে তা পাচ্ছেন। কিন্তু আপনাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে – ভারত আপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণই কি আপনাকে কাতারের নাগরিকতব গ্রহণে প্রভাবিত করেছে?
হুসেন : আমি কখনো বলিনি ভারত আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যা-ই করে থাকুন আমার পূর্ণ দৃষ্টি সেখানেই। আমি বলেছি, এখানে সুযোগ আছে তাই চলে এসেছি। নাগরিকত্ব কী? এ তো কেবল একটুকরো কাগজ। যখন কেউ আমাকে এত ভালোবাসা ও আদর-সোহাগ দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে আমার কি উচিত হবে না সেখানে যাওয়া এবং তাদের সঙ্গে ডিনার করা। আমি কি তখন বলব, আমি মাংস চাই না, আমি কেবল শাকসবজি চাই। এসব নিয়ে আমার মধ্যে কোনো গোঁড়ামি নেই। যেমন কথায় বলে না, ‘জাহা ভি পার মিলা, ম্যায় উস্কে সাথ হো গয়া’ – যেখানে ভালোবাসা আমি তার সাথেই আছি। আমি একজন উঁচু দরের প্রেমিক। যেখানে উষ্ণতা পাই, সেখানকার মানুষকে ভালোবাসি। ভারতে নিশ্চয়ই শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষই আমাকে ভালোবাসে, এখনো ভালোবাসে। কিন্তু সৃষ্টিশীলতার ওপর রাজনীতির ক্ষতিকর প্রভাব সবসময়ই ছিল।
সেই গ্যালিলিও থেকে কালিদাস – সব মহান শিল্পীকেই হেনসত্মা করা হয়েছে। এমনকি নেরম্নদা, চার্লি চ্যাপলিন – এমন আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যমত্ম এ ধরনের বিষয় রাজনীতিতে গিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এটা যদি আইনি বা সামাজিক কোনো সমস্যা হতো, তাহলে সমাধান করা যেত। আদালত (আমার পক্ষে) একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। কিন্তু এই রাজনীতি এবং অল্প কিছু লোক সবকিছু ভ-ুল করে দিতে পারে।
প্রশ্ন : আপনি কি দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করেন না?
হুসেন : আমি তো আত্মিকভাবে এবং সবকিছুতে দেশেই আছি। শারীরিক উপস্থিতিতে কী এসে যায়? আজকের পৃথিবীতে এত প্রযুক্তি এবং যোগাযোগের এত মাধ্যম থাকায় যে কেউ সর্বত্রই অবস্থান করতে পারে, ভৌগোলিক সীমামত্ম কখনো সৃষ্টিশীল মানুষকে বেঁধে রাখতে পারে না। কোথায় অবস্থান তাতে কিছুই এসে যায় না। আমি আদি ভারতীয় চিত্রশিল্পী এবং আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যমত্ম তাই থেকে যাব।
প্রশ্ন : কিন্তু বাসত্মবতা হচ্ছে, ভারতে অনেকেই বিশ্বাস করে ভারত সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো আপনার ভারতে ফিরে যাবার প্রশ্নে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারত।
হুসেন : এসব আলোচনায় আমি কোনো মনোযোগ দিই না। তারা যা ভাবার ভাবছে, যা করার করছে – এটা তাদের ব্যাপার। এতে আমি বিরক্ত বোধ করছি না, আমার কাজও বন্ধ রাখছি না।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি কি বিশ্বাস করেন সরকারের আরো করার ছিল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আপনার ফিরে যাওয়া উচিত।
হুসেন : এ নিয়ে আমি বিসত্মারিত আলোচনায় যেতে চাই না। আমি আমার কাজ করছি, তাদের কাজ তারা করম্নন – এটাই ভালো। আমি তাদের ইচ্ছেকে অস্বীকার করিনি, আবার কোনো প্রশ্নও করিনি। আমার তিনটি প্রকল্প শেষ করতে হবে। ভারতে আমি কাজ করতে পারছি না – সেখানে কাজ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। বহু কারণ রয়েছে, সবাই সেসব জানেন। তারা যদি তাদের নিজেদের ভেতরের দিকে তাকান তাহলে তাদের বিবেকই এসব প্রশ্নের জবাব দেবে।
প্রশ্ন : আপনার সমালোচকরা আপনার পরবর্তী গমত্মব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন – আপনি এখন একটি অগণতান্ত্রিক দেশকে বেছে নিয়েছেন – কাতার কেন?
হুসেন : বলেছিই তো, এখানে স্পনসর পেয়েছি, কাজ করার সুযোগ-সুবিধে পেয়েছি। আমি ষাট বছর ধরে এসব কাজই করছি। পৃথিবীর কোথাও আমার একটি স্টুডিও-ও নেই। আমি হোটেলে যাই, বন্ধুর বাসায় যাই, ক্যানভাস ছড়িয়ে আঁকতে বসি। আমি লোকশিল্পীদের মতো, যেখানে-সেখানে কাজ করতে পারি। এভাবেই আমি আমার আঁকার পথটি গড়ে তুলেছি। অনেক বড় বড় চিত্রশিল্পী আছেন, চিমত্মাবিদ আছেন, আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। তারা তাদের পদ্ধতিতে কাজ করেন, আর এটাই আমার পথ।
প্রশ্ন : আপনাকে যে ভারতীয় পাসপোর্ট সমর্পণ করতে হলো, এটা কি একটা কষ্টকর সিদ্ধামত্ম ছিল না?
হুসেন : ঠিকই আছে, যত কষ্ট আর যন্ত্রণা গণমাধ্যমগুলো সবই পাচ্ছে, আমি পাচ্ছি না। আমি চলিস্নশ বছর ধরে মহানন্দে আছি, সিনেমা বানাচ্ছি, দু-এক কলম লিখছি, স্বপ্ন সৃষ্টি করছি। আমার যা কিছু প্রকাশ করার মাত্র দশ ভাগ প্রকাশ করতে পেরেছি, নববই ভাগ এখনো ভেতরে রয়ে গেছে। আমার মনে হয় না তা প্রকাশ করে যেতে পারব। আমার মনে হয়, অসমাপ্ত সবকিছু নিয়েই আমাকে সমাহিত হতে হবে।
প্রশ্ন : আপনার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সমত্মান-সমত্মতি সবার কাছে আপনি এর কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন?
হুসেন : তারা তো আমার মতো একটি বৃক্ষের নিচেই বড় হয়েছে, কাজেই তারা আমাকে বোঝে। তবে কোনো একজন নায়িকাকে নিয়ে কাজ করার সময় তারা ভেবেছিল আমি পাগল হয়ে গেছি। এমন তো হতেই পারে।
প্রশ্ন : আপনার বয়স এখন পঁচানববই বছর – আলোছায়ার সময়ের ভেতরে আপনার অবস্থান। এ সময় মানুষ সাধারণত বাড়ি ফিরতে চায়। জীবনের অন্য যে-কোনো সময়ের চেয়ে এ সময়ই বাড়ির প্রয়োজন বেশি অনুভব করে।
হুসেন : অসিত্মত্বের একটি শারীরিক অবস্থানের ওপর এত কেন জোর দিচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমার বয়স তো এখন কুড়ি বছর নয় যে, আমার একটা বাড়ি দরকার। আমি সে পর্যায়টি অতিক্রম করে এসেছি। মানুষ তারম্নণ্যে শিকার ধরার মতো সবকিছুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি থাকে। সে সময়ের চেষ্টা যতটা ধরে রাখা যায়, যা পাও ভোগ করো। আর আমার এখন যে বয়স, বলতে হয় – এটা নয়, ওটা নয়। এটি হচ্ছে সেই সময়, যখন সবকিছু বর্জন করে শূন্যে এসে পৌঁছাতে হয়। আমি তো তাই চেষ্টা করছি। কিন্তু সে পর্যায়ে পৌঁছিনি। কেবল সাধু-সমত্মরা সেখানে পৌঁছাতে পারেন।
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন আপনার বয়স চলিস্নশ বছর হলে ভালো করে লড়তেন। এখন কেন লড়ছেন না? আপনি কি লড়াই থামিয়ে দিয়েছেন?
হুসেন : হ্যাঁ, আমার জীবনের এ পর্যায়ে এটাই সত্য। চল্লিশ বছর বয়সে আমি যদি কোনো রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চাইতাম কিন্তু তা সম্ভব না হতো, আমি হাল ছেড়ে দিতাম না। আমি তাকে কিডন্যাপ করতাম। কিন্তু এখন সে পর্যায় পার হয়ে এসেছি।
প্রশ্ন : মানুষ এখনো জানতে চাচেছ আপনি কেন আদালতের মোকাবিলা করছেন না? আর মাত্র তিনটা মামলা বাকি। মানুষ চায় আপনি ফিরে আসুন এবং যা-ই ঘটুক মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করম্নন।
হুসেন : আমি তো সেখানেই আছি। আমি ভারতে ফিরেছি কি না আমার গায়ে হাত দিয়ে মানুষ তা পরীক্ষা করতে চায় বলে আমি মনে করি না। আমি আশা করি, আমি যে শিল্প সৃষ্টি করে গেলাম তা চিরদিন টিকে থাকবে। আমার জীবনের সাত-আট বছর খুব সামান্য সময়। সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে মহাবৈশ্বিক হিসেবে এটা কিছুই নয়।
প্রশ্ন : আমি সে কথা বুঝেছি। কিন্তু আপনি কি অনুভব করেন না যে, ভারতের জনগণ ও ভারতের সরকার আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? আপনি কি মনে করেন না যে, ব্যাপারটা এ পর্যমত্ম আসা মোটেও উচিত হয়নি?
হুসেন : না, মোটেও না। আমি কখনো বলব না যে, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি। কিছুসংখ্যক মানুষ আধুনিক চিত্রকলার ভাষা বোঝে না, তারা মাত্র কজন। শিল্পকলা বরাবরই সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকে। আগামীতে তারা বুঝতে পারবে।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন আপনাকে নিরাপদ একটি পরিবেশ দিতে হলে আরো অনেক কিছু করার ছিল?
হুসেন : আমি তো বলেছিই ভারত সরকার তার কাজ করেছে, আমি আমার কাজ করছি। কোনো কিছুই আমাকে থামিয়ে রাখছে না। আমি কালই সেখানে ফিরতে পারি। জেনে রাখুন, প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কাতার – যেখানেই আমি ছবি আঁকি না কেন, আমি একজন ভারতীয় শিল্পীই থেকে যাব। আমি একজন মুক্ত নাগরিক। আমি কাউকে খুন করিনি, কারো কাছ থেকে একটি পয়সাও নিইনি।
প্রশ্ন : আপনার নিজের বাড়ি কোথায় বলে অনুভব করেন – এখনো কি ভারত?
হুসেন : আপনি আবারো শারীরিক উপস্থিতির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছেন। আমি শরীরী অসিত্মত্বের ঊর্ধ্বে। যাঁরা আমাকে বুঝতে পারেন তাঁরা আমাকে মিস করেন না।
প্রশ্ন : প্রকাশের স্বাধীনতা কতদূর বিসত্মৃত হতে পারে বলে আপনার ধারণা? অসহিষ্ণুতার রাজনীতি ভারতের জ্ঞানচর্চার ওপর প্রভাব বিসত্মার করছে বলে কি আপনি মনে করেন?
হুসেন : সৌভাগ্যবশত সৃজনশীল চিত্রকলার ওপর ভারতে বড় ধরনের কোনো আঘাত আসেনি। বরোদাতে একটি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে – আমাকে নিয়ে যা হয়েছে তা ছোট ঘটনা। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিকই আছি।
প্রশ্ন : প্রকাশের স্বাধীনতা কি চূড়ামত্ম অধিকার হতে হবে বলে আপনি মনে করেন? আমি আবারো বলছি, আপনি কি ভিন্ন কিছু করতে পারতেন না?
হুসেন : আমি আবারো বলছি, আমি যা কিছু সৃষ্টি করেছি আমি মনে করি তা চিরকাল থেকে যাবে। আশা করি আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।
প্রশ্ন : হুসেন সাহেব, বিগত বছরগুলো আপনার জন্য কতটা কঠিন ছিল?
হুসেন : আপনি কঠিন শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমার জন্য কঠিন বা সমস্যাবহুল ছিল না। অবশ্য মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে, আমার আইনজীবীরা সেগুলোর ফয়সালা করবেন। আমি পালিয়ে আসিনি। সারা ভারতে আমার ত্রিশ হাজার থেকে চলিস্নশ হাজারেরও বেশি কাজ রয়েছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন? এটা বাসত্মব। আমার প্রিয় দেশকে আমি তা-ই দিয়েছি, অন্য কোনো দেশকে তো দিইনি।
প্রশ্ন : ৯৫ বছর বয়সে কোনো অসম্পূর্ণ স্বপ্ন রয়েছে কি?
হুসেন : যত দিন বেঁচে আছি দেশের মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কেবল দেশের ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকেও যেন কাজ করে যেতে পারি – সে স্বপ্নই দেখে চলছি। ভারত আমাকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে, এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি আমি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি। কেউ কেউ আমার ছবি বোঝে না, সময় হলে বুঝবে। আমি তাদেরও ভালোবাসি। মতামত জানানোর স্বাধীনতা সবারই আছে, যে যাই বলুক, আমরা তো একটি গণতান্ত্রিক দেশ।
প্রশ্ন : যাঁরা আপনাকে এই অনুষ্ঠানে দেখছেন সেই দর্শকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
হুসেন : কেবল ছবিগুলোর নাম বলা হয়েছে; কিন্তু সত্যিকার গল্প শোনাতে এক জীবন কেটে যাবে। আমি নিউইয়র্ক কিংবা কাতার যেখানেই ছবি আঁকি না কেন কেবল ছবির শিরোনাম বদলেছে, আর কিছু নয়। আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে আমি আমার নিজের গল্প বলে গেছি, যা আশা করি আমার দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের অমত্মরে রয়ে যাবে।