আন্দালিব রাশদী
‘লোকশিল্পীর মতো এগিয়ে যাই’
‘সৃজনশীলতার কোনো সীমামত্ম নেই। আমার কাজ আমাকে যেখানে নিয়ে যায়, আমি সেখানেই যাই।’ ভারতের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন তাঁর নির্বাসিত জীবনকে মেনে নিতে যে-কটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন, এটি তার অন্যতম। কিন্তু তাঁর অমত্মরের কথা ছিল ভিন্ন – তিনি বাড়ি ফিরতে চান। তাই বলে হাপিত্যেশ করে সময় নষ্ট করেননি। পঁচানববই বছর বয়সেও পঁচিশের তারম্নণ্য, পারঙ্গমতা ও শক্তি নিয়ে ক্যানভাসে ব্রাশ চালিয়েছেন। উগ্র মৌলবাদী দাপটে দেশ ছাড়লেও, দেশকে এতটুকু খাটো করেননি – ‘নির্বাসনের প্রশ্নই আসে না, আমি যে-কোনো সময় বাড়ি ফিরে যেতে পারি। আমি তো বছরের পর বছর বিদেশে থেকেছি, আমি যে-কোনো জায়গায় আঁকতে পারি।’ আবার বলেছেন, ‘আমি লোকশিল্পীদের মতো, আঁকতে আঁকতে সামনে এগিয়ে যাই।’
বিদেশি চিত্র-সমালোচকরা হুসেনকে কখনো বলেছেন ‘ভারতীয় শিল্পকলার জার’, কখনো ‘ভারতের পিকাসো’।
বয়স যখন তাঁর নববই, হাতে নেন একশ ছবির মেগা প্রজেক্ট ‘ভিশন : টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’। পাশাপাশি যশ চোপড়ার স্টুডিওতে চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে ম্যুরাল তৈরিতে হাত দিয়েছেন। এই প্রকল্পের নাম ‘সিলভার সাইলেন্স অব দাদা ফালকে টু দ্য গোল্ডেন ড্যাজল অব মাধুরী দীক্ষিত’। নিজের কাজ নিয়েই আরো একটি প্রকল্প ‘হুসেন ডিকোডেড’।
মাধুরীকে নিয়ে গজগামিনী, টাবুকে নিয়ে মীনাক্ষী : এ টেল অব থ্রি সিটিজ-এর পর একটি কমেডিচিত্র বানাবার স্বপ্নটি তো বারবার ফিরে আসছিল। নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র থ্রু দ্য আইজ অব অ্যা পেইন্টার বানিয়ে ১৯৬৭ সালে যিনি বার্লিন উৎসব থেকে গোল্ডেন বিয়ার এনেছেন – সেলুলয়েড-স্বপ্ন তো তাঁর নিত্যসঙ্গীই হওয়ার কথা।
দেবীদের নির্বসন করেছেন, ভারতের মানচিত্রে স্থাপন করেছেন নগ্ন নারী – এসব অভিযোগে যখন তাঁর ছবি ভাঙচুর হচ্ছে, গ্যালারি থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, জীবন দিয়ে হুসেন ঠেকাও আন্দোলন হচ্ছে, মৃত্যুর হুমকি আসছে, আদালত থেকে জারি হচ্ছে গ্রেফতারি পরোয়ানা, মাথার মূল্য ধার্য হচ্ছে কোটি রম্নপি, তিনি বললেন, সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে এসব সামান্য হেঁচকি মাত্র, তিনি আদৌ বিচলিত নন।
নগ্নপদ এম এফ হুসেনের হাত থেকে ব্রাশ কখনো পড়েনি। উপমহাদেশের আধুনিক চিত্রকলার প্রধান পুরোধা হুসেনের জন্ম ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৫, মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুর গ্রামে, মৃত্যু ৯ জুন ২০১১ লন্ডনের একটি হাসপাতালে। ইলা পালের ‘বিয়ন্ড দ্য ক্যানভাস : অ্যান আনফিনিশড পোর্ট্রেট অব এম এফ হুসেন’, হুসেনের আত্মজৈবনিক রচনাসহ বিভিন্ন প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার, সমালোচনা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ‘মকবুল ফিদা হুসেন’ লিখিত। শিল্পীকে জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা জানাতেই এই আয়োজন।
মায়ের জন্য হাহাকার
আমার বয়স যখন দুবছর, আমার মা জয়নব মৃত্যুবরণ করেন। আমি তখন ভয়ানক অসুস্থ, মরিয়া হয়ে আমার মা প্রার্থনা করছেন – আমি যেন বেঁচে থাকি, এর বদলে যদি তাঁর জীবন যায় যাক। শেষ পর্যমত্ম ঠিক তা-ই ঘটল। বেঁচে থাকলেও আমার মনে হলো আমিই ভয়ংকর দুর্ভাগা। মায়ের যদি মৃত্যু হয়, কেউ কি আর তার ক্ষতি পূরণ করতে পারে? আমার কাছে মায়ের কোনো ছবিও নেই। তিনি তাঁর ছবি তুলতে দিতেন না। সে-কালের মানুষ ক্যামেরাকে ভয় পেত। তারা মনে করত, এতে নজর লাগে এবং আয়ু কমে যায়। দুঃখজনক, আমার কাছে এমন কিছু নেই যাতে কিছুটা হলেও মায়ের প্রতিবিম্ব রয়েছে কিংবা যা মাকে মনে করিয়ে দেয়। আমার মা আমার কাছে কেবল একটি নাম – সামান্য স্মৃতিও নয়।
আমার মায়ের মৃত্যুর পরপরই আমাদের পরিবার পান্ধারপুর থেকে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে বসতি স্থাপন করে। চার বছর পর আমার বাবা আবার বিয়ে করেন। বাবার বিয়ের কথা আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। আমার নতুন মা আমাদের সঙ্গে বসবাস করতে চলে এলেন। বাবার বিয়েতে আমি ক্ষুব্ধ হইনি। কিন্তু একজন অপরিচিত মহিলা আমাদের সঙ্গে থাকবেন – আমি তো এমন পরিস্থিতিতে অভ্যসত্ম হয়ে উঠিনি – আমার কাছে এটা মনে হলো অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ। তিনি আসলে ভালোমানুষ ছিলেন – এটা যদি না বলি তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। আমার বাবা যখন আমার ওপর ক্ষুব্ধ এবং আমাকে পেটাতেন, তিনি আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। তারপরও আমি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি।
সব মিলিয়ে আমার ছেলেবেলাটা সুখেরই ছিল। আমার চার বোন চার ভাই – ফলে খেলার সঙ্গীর কখনো অভাব হয়নি। তবে ছবি আঁকাতে তাদের কারোই কোনো আগ্রহ ছিল না। সত্যি কথাটি হচ্ছে, আমার পরিবারের কেউই শিল্পী হতে চায়নি – তারা অন্য কিছু করেছে। আমার সৎবোন দিলবার বহুবার আমার পোর্ট্রেটের মডেল হয়েছে। বয়স তিরিশ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। আমাদের দুজনের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ – আমি তাকে খুব মিস করি।
স্কুল ড্রপ-আউট হুসেন
আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, আমি বুঝতে পারি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মানে হিন্দু ও মুসলমানের ঐক্যও। এ-ধরনের আদর্শ নিয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি। সেজন্যই দেশভাগ হয়ে যখন স্বাধীন পাকিসত্মান ও ভারত হয়ে গেল, আমাদের পরিবার কখনো পাকিসত্মানে অভিবাসী হওয়ার কথা ভাবেনি। আমাদের মনে হয়েছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমরা যেখানে জীবনধারণ করেছি আমরা সে স্থানেরই মানুষ।
আমার বেলায় পছন্দটা খুবই স্পষ্ট। আমি কখনই পাকিসত্মানবাসী হব না, সেখানে আমার আঁকা ছবি নিষিদ্ধ হবে। ইন্দোরে যে গোঁড়া মুসলমান সম্প্রদায়ে আমি বেড়ে উঠি, আমার ছবি নিয়ে তারাও কম হইচই করেনি। সেখানকার ওসত্মাদ ও মোলস্নারা বলে যেতেন, ‘এটা ঠিক নয়। তুমি যা করছ তা আমাদের ধর্মের বিরম্নদ্ধে যাচ্ছে।’
কিন্তু তাঁর বাবা ফিদা হুসেন যত কঠোর মানুষই হোন না কেন মকবুলকে কখনো ছবি আঁকা থেকে নিরসত্ম করেননি, বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। ছেলেকে অবাক করে দিয়ে দামি রং-তুলি কিনে এনেছেন।
‘আমার ছবি দেখারও কেউ ছিল না, ভালোই বলুক কি মন্দই বলুক, আমার ছবি নিয়ে মমত্মব্য করারও কেউ ছিল না। আমার বাবা ছিলেন একজন সাধারণ প্রশ্রয়দাতা। তিনি মোটেও শিল্পের সমঝদার ছিলেন না। আমি ছবি এঁকেই চলি। রং কেনার জন্য এমনকি আমার স্কুলের বইপত্রও বিক্রি করে দিই।’
স্কুলে সাহিত্য ছাড়া আর কোনো বিষয় তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ভাষা শেখায় তাঁর ছিল বিপুল আগ্রহ – গুজরাটি, হিন্দি, মারাঠি, সংস্কৃত, পার্সি, উর্দু – সেসব ভাষার সাহিত্যের টানে শিখে ফেলেছেন। ডিগ্রি-ডিপেস্নামা এসবে তাঁর এতটুকুও আস্থা ছিল না। পড়াশোনা যখন হবেই না বাবা তখন তাঁকে বোম্বের আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে বললেন। তিনি গেলেনও, গিয়ে দেখলেন শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা যা আঁকছে, কোনো ক্লাস না করেই তিনি তার চেয়ে ভালো আঁকতে পারবেন। তিনি সেই তারম্নণ্যে হিন্দিতে কবিতা লিখেছেন, ইংরেজিতেও। স্কুল ড্রপ-আউট হুসেনের ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ বেরোয় সুইজারল্যান্ড থেকে।
সিনেমার হোর্ডিং আঁকতে আঁকতে…
১৯৩৬ সালে বোম্বে রেলওয়ে স্টেশনে নেমে হুসেন চলে এলেন সিনেমার হোর্ডিং আঁকিয়ে শাবাবের কাছে। তাঁর কাছে হুসেনের সৃজনশীল ছবির কোনো গুরম্নত্বই নেই; কটা দাগ আর কিছু রং – একেই কি পেইন্টিং বলা যায়? রিয়েলিস্টিক পোর্ট্রেট না হলে কিসের পেইন্টিং? তিনি বললেন, ‘আমার কথা শোনো, ইন্দোরে ফিরে যাও।’
হুসেন কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘দয়া করম্নন, আমাকে সাহায্য করম্নন। তাহলে আমি আর কার কাছে যাব?’
শাবাবই দৈনিক ছ’আনা বেতনে হুসেনকে চাকরি দিলেন। হুসাইনি খিচদিওয়ালার খাবার দোকান থেকে দুবেলার যেনতেন খাবার ছ’আনায় হয়ে যায়। খিচদিওয়ালা তাঁর অনাগ্রহী মায়ের পোর্ট্রেট করাতে চাইলেন, তা হতে হবে মায়ের অজামেত্ম। দূর থেকে দেখে কয়েকটি স্কেচ করে একটি ধারণা নিলেন। তারপর একটি গোটা দিনের কামাই দিয়ে একটি অয়েল পেপার কিনে এক বসাতেই পোর্ট্রেটটি শেষ করলেন। রিয়েলিস্টিক এই পোর্ট্রেটে এই নারীর কেবল চেহারাই নয়, ব্যক্তিত্বও ধরা পড়ল। খিচদিওয়ালা মায়ের ছবি আঁকিয়ে যুবকটিকে যথেষ্ট সম্মান করে বললেন, ‘এক মাস তোমার কাছ থেকে খাবারের দামই নেব না।’
শাবাবের অধীনে চাকরির তৃতীয় মাসে হুসেন ছুতারের কাজ শিখলেন। মাচা বানিয়ে ফ্রেমে চট ঢুকিয়ে টানটান করে তাতে বিলবোর্ড বানানোর কাজটাও শিখলেন। হোর্ডিং আঁকার কাজই তাঁকে বৃহৎ ফ্রেমে কাজ করার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। হুসেন বলছেন : ‘শরীর আর মনের জোর সবসময় একসঙ্গে যায় না। প্রতিদিন এবেলা-ওবেলা অপুষ্টিকর খাবার তো শরীরের ওপর শোধ নেবেই। দু-একবার উঁচু মাচায় মাথা ঘুরিয়েছে, ওপর থেকে পড়ে গিয়ে খুলি ভাঙার উপক্রম হয়েছে। আমাশয় আরো খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। গ্যালন গ্যালন তিসির তেল, কেরোসিন, দসত্মার রং আরো অন্যসব রঙের ঘ্রাণ টানতে টানতে আমার দুরারোগ্য কাশি বেঁধে যায়।’
হুসেন এমন শুভানুধ্যায়ীও পেলেন যিনি পরামর্শ দিলেন, ‘তোমার ব্রাশের আঁচড়ের কাঠামোটিই সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ, রেমব্রান্টের কথা ভাবো, তাঁর ছবিগুলো দেখো। কেমন করে ব্রাশের দশ টানের বদলে পাঁচ টানেই একই সাফল্য অর্জন করা যায় তাই শেখো।’ বিলবোর্ড আঁকিয়ের জন্য বড় শিল্পীদের নাম জানা জরম্নরি নয়। কিন্তু হুসেন পরামর্শগুলো ক্যানভাসে প্রয়োগ করতে শুরম্ন করলেন। মুসলমান বিধবা মেহমুদাবিবি তাঁর বাড়িতে একটি মেস চালাতেন। হুসেন যোগ দিলেন। একবার দুমাসের বকেয়া পড়ে গেল। মেহমুদাবিবির মাতৃসুলভ ভালোবাসা ও উদ্বেগ থাকলেও তাঁর ব্যবসা-বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্র হুমকি দিলো, ‘আগামীকালের মধ্যে সব বকেয়া শোধ করবি, নতুবা তোকে পিটিয়ে বের করব।’ পরদিন বাসত্মবিকই তাঁর বিছানা-বালিশ রাসত্মায় ছুড়ে ফেলল।
হুসেন যখন ঠিকানাহীন জিন্দেগি ছবির প্রচারণায় হোর্ডিং তৈরির কাজ একাই পেলেন। ‘আমার কাজ করার বিশাল ক্ষমতা এবং তা পুঁজি করেই প্রযোজকদের কাছ থেকে আরো কাজ নিলাম। পরদিন ভোরের আগে মারাঠি সিনেমার জন্য নায়িকা দুর্গা খোটের ৪০ ফুট কাট-আউট তৈরি করতে হবে। প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর চারটা পর্যমত্ম ট্রাম চলাচল বন্ধ থাকত। শেষ ট্রেন থিয়েটার পেরিয়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাসত্মার একপ্রামত্ম থেকে অন্যপ্রামত্ম পর্যমত্ম ক্যানভাস বিছিয়ে দিলাম এবং আঁকতে শুরম্ন করলাম। চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, আমার কাট-আউট বানানোর কাজ শেষ – সে রাতের কথা আমার এখনো মনে পড়ে – কাজটা শেষ হওয়াতে যে উত্তেজনা অনুভব করেছি সে কথা।’
জিন্দেগি তাঁর হাতে বেশ কটা টাকা এনে দিলো। হুসেন সব পাওনাদারের টাকা শোধ করে মেহমুদাবিবির হাতেও তুলে দিলেন দুমাসের বকেয়াসহ আগাম দুমাসের টাকা। তার ছেলে যত অপদস্থই করে থাকুক মেহমুদাবিবির সেণহাচল ছাড়াও সে বাড়িতে বাড়তি আকর্ষণ ফজিলা, তারই কন্যা। হুসেন তাকে দশ পাতার গুরম্নগম্ভীর চালের একটি প্রেমপত্রও লিখেছিলেন। সবাই বিরোধিতা করেছে, এমন চালচুলোহীন ভবঘুরের সঙ্গে মেয়ে বিয়ের প্রশ্নই আসে না, কিন্তু মেহমুদাবিবির মৌন সমর্থনেই ১১ মার্চ ১৯৪১ সালে কেবল কিছু খেজুর বিতরণ করে তাদের নিকাহ সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের দিনও বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যমত্ম তিনি সিনেমার হোর্ডিং এঁকেছেন। সিনেমার হোর্ডিং আঁকতে আঁকতে তিনি হয়েছেন – আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম প্রধান আইকন।
হুসেন! হু ইজ হি ?
‘মানুষের মুখাবয়বের মতো চিত্তাকর্ষক কোনোকিছু পৃথিবীতে আছে কিনা আমার জানা নেই। কোটি কোটি মানুষ – যারা পৃথিবীতে বসবাস করে গেছে তাদের অমত্মত দুটি মুখাবয়ব কখনো একরকম নয়। বিস্মিত হওয়ার কথা, আমার সবচেয়ে পুরনো যে স্মৃতি তা মুখাবয়বের। যেসব মানুষকে আমি চিনি তাদের চেহারা এবং চিনি না কিন্তু অবয়ব আমার মনে আঁকা হয়ে গেছে। এর কিছু জীবমত্ম এবং শ্বাসপ্রশ্বাস আছে, কিছু আমার ড্রইংয়ের সরলরেখার মতো। এখনো মজার কোনো কিছু যদি আমার চোখে পড়ে আমি খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন থেকে তা কেটে রাখি।
আমার স্মৃতিতে প্রথম মানুষের মুখ – আমার দিকে ঝুঁকে আছে, তখন আমার বয়স এক কি দুবছর। চার বছর বয়সেই আমি এসব অবয়ব আঁকতে শুরম্ন করি – যাদের দেখেছি ঘরে, রাসত্মায় এবং বাজারে। বয়স পাঁচে পৌঁছতেই আমি সারাক্ষণই স্কেচ করতে থাকি – যেখানে সুযোগ পাচ্ছি আঁকছি; কাগজে, বইতে, দেয়ালে, মেঝেতে। সেসব মুখ আমার কাছে মডেল হয়ে ওঠে – যাদের মুখের বাইরেও বিশেষ কিছু আছে, যেমন চশমা, গোঁফ এবং দাড়ি। মুখ আঁকার আমার এই যে বাতিক তা অবয়ব বৈচিত্র্যের কারণে নয় – বরং প্রকাশভঙ্গির যে বৈচিত্র্য তা-ই আমাকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। দেখুন, একই মুখ কিন্তু সবসময় একরকম দেখায় না। বহু অনুভব তাতে উদ্ভাসিত হয় আবার মিলিয়ে যায়, একটি অনুভূতি অন্যটিকে তাড়া করে নিরমত্মর বদলাতে থাকে।’
সেজন্যই হুসেন এক মুখ বারবার এঁকেছেন – একটি থেকে অন্যটি প্রকাশভঙ্গিতে খানিকটা ভিন্ন।
‘ছবি আঁকার তাড়না আমাকে এমনভাবে ছেয়ে ফেলে যে, আমি আর সবকিছুতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আমার হাত কাগজের ওপর ঘুরেই চলছে, আকার-আকৃতি, ডিজাইন আঁকা হয়ে যাচ্ছে। বাসন-কোসনের ভাঙা চিনেমাটির ওপর, মেঝের ওপর গুজরাটি ও রাজস্থানি ঐতিহ্যের অনুকরণে এঁকে চলেছি। আমার সৎমা শিরিন এসেছেন গুজরাট থেকে। ছুটির দিনে আমি গুজরাট চলে যাই – বিভিন্ন দৃশ্য, রীতিনীতি ও মানুষের মুখোমুখি হই। আমি সবসময়ই স্কেচপ্যাড সঙ্গে বহন করতাম। যখনই কোনো কিছু আমার আগ্রহকে উস্কে দিত, আমি তা ধরে রাখার জন্য বাতিকগ্রসেত্মর মতো এঁকে ফেলতাম। আমি দিবাস্বপ্ন নিয়ে রাসত্মায় বসে থাকতাম, যাতে মুখের মধ্যে হঠাৎ দেখা একটি মুখ আমাকে বিদ্যুতায়িত করে ফেলত – শুরম্ন হতো আমার আঁকাআঁকির কাজ, আমি সব ধরনের মানুষ এঁকেছি। কখনো কখনো আমি নিজের বিষয় ঠিক করে নিতাম – আমার চাচাত ভাইকে ভিক্ষুক সাজতে অনুরোধ করতাম, তাকে ওই অবস্থায় রং দিয়ে আঁকতাম। বড় রাসত্মা, সরম্ন গলিপথ ধরে হেঁটে আমি বাস, ট্রেন, টোঙ্গা, গরম্নর গাড়ি এবং বিভিন্ন পেশায় কর্মরত মানুষের ছবি আঁকতাম। ল্যান্ডস্কেপ আঁকার জন্য সাইকেল নিয়ে এদিক-ওদিক চষে বেড়ালেও আমার বাগান কিংবা পার্কের দরকার হয়নি।’
‘যদিও পাঠ্যবিষয়ের দিকে আমার কোনো মনোযোগই ছিল না, স্কুলে আমি বেশ জনপ্রিয় ছিলাম। শিশুরা আমার পেইন্টিংগুলো খুব পছন্দ করত। স্কুলের শিক্ষকদের চেহারা বিকৃত করে যেসব ক্যারিকেচার আঁকতাম দেখে খুব মজা পেত। এগারো বছর বয়সে আমার হাত পোর্ট্রেটে পাকা হয়ে যায়। স্কুলের ফাংশনে বস্ন্যাকবোর্ডে আমি বড় ছবি আঁকতাম। মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে তাঁর অতিকায় মাথা এঁকেছি।’
‘আমার বয়স যখন বাড়তে থাকে আমি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানের চিত্রশিল্পীদের সম্পর্কে জানতে থাকি। মাতিসে, রেনোয়া, পিকাসো ও পল ক্লির কথা পড়ি। রেমব্রান্টের প্রতি আমার ভক্তি এখনো অব্যাহত আছে। কারণটা কী? আমি তাঁর মধ্যে মানুষের জন্য প্রচ- মানবিক অনুভূতি খুঁজে পাই, তাঁর ছবির আত্মা এত তীক্ষ্ণ যে তা কেবল চেহারাকে তুলে ধরে না, অমত্মরের জ্বালাকেও তাতে মূর্ত করে। আমস্টারডামের রিক মিউজিয়ামে টাঙানো তাঁর ‘দ্য ওয়াচম্যান’ ছবিটির কথা ধরা যাক – এই ছবি হাজার হাজার মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টি টেনে এনেছে, আমি যখন প্রথম ছবিটির সামনে দাঁড়াই, আমার অমত্মর কেঁপে ওঠে। এটিই পৃথিবীতে একমাত্র পেইন্টিং – এর সামনে যতবার দাঁড়িয়েছি আমার একই অনুভূতি জেগে উঠেছে।’
এই ছবিটির বিষয় কী? বিশেষ কিছু নয় – সংবেদনশীল কিংবা বিষণ্ণ কিছু নয়। এতে মৃত্যু কিংবা ক্রুশবিদ্ধকরণের মতো কিছু দেখানো হয়নি। কিন্তু যখন কেউ এই ছবির সামনে দাঁড়াবে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি তার ভেতর সক্রিয় হয়ে উঠবে – যা কোনো প্রার্থনালয়ে গেলে কখনো নাও ঘটতে পারে।
হুসেন বললেন, ‘পেইন্টিংয়ের এমনই শক্তি।’
ইন্দোরের মতো একটি ছোট্ট শহরে টানাটানির সংসারে হুসেনের মতো এক কিশোর পৃথিবীর শিল্পীদের সম্পর্কে এতকিছু কেমন করে জানল তা অবাক করা ব্যাপার। টাউন লাইব্রেরিতে অনেক বইয়ের সঙ্গে পেইন্টিংয়ের ওপর চমৎকার একটি সংগ্রহ ছিল, তাতে বহু ইলাস্ট্রেশন। ‘আমি সেখান থেকেই ইমপ্রেশনিস্ট এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্টদের সম্পর্কে জানতে পারি। কিউবিজম এবং স্যুররিয়েলিজম সম্পর্কে ধারণা পাই। কলেজে পড়া এক বন্ধু আমাকে কলেজ লাইব্রেরিতে নিয়ে যায়। সেখানে প্রথম শিল্পকলার ইতিহাস পড়ি, জন রাস্কিনের বইতে। এটা খুব গুরম্নগম্ভীর বই নয়। আমি আগ্রহ ও প্রত্যাশা নিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকি।’
‘রাস্কিন এবং পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলন নিয়ে অন্যান্য বইপত্র পড়ে আমি এই সমগ্র স্রোতধারার অংশ হতে সচেতন পদক্ষেপ নিই। আমার ছবি কখনো বিমূর্ত নয়, আবার তা রিয়েলিস্টিকও নয়। আমি সত্যিকার মানুষের মুখ ও পোর্ট্রেট এঁকে চলেছি, ছবিগুলোতে অনুপুঙ্খ বিবরণ নেই এবং তা হুবহু প্রতিরূপও নয়। আমার ব্রাশের আঁচড় পুরম্ন ও দৃঢ়। বহিরাবরণের দিকে না তাকিয়ে আমি বস্ত্তর সারবত্তাকে আমার ছবিতে উঠিয়ে আনতে চেয়েছি – হোক তা মুখাবয়ব, হোক দৃশ্য। আমি ন্যাচারালিস্টিক পেইন্টিং কখনো পছন্দ করিনি – এটা আমার কাছে নকল করার মতো মনে হয়েছে।’
‘বয়স সতেরোতে না পড়া পর্যমত্ম এভাবেই সময় কেটে গেল। তখন আমি বোম্বে এলাম। ভাবলাম, এতবড় শহরে পেইন্টার হিসেবে ছবি এঁকে আমি নিশ্চয়ই জীবনধারণ করতে পারব। ইন্দোর প্রদর্শনীতে আমি একটি সোনার পদক পেলাম, তা আমাকে আশান্বিত করল। আমি বোম্বেতে পৌঁছার পরপরই একটি ল্যান্ডস্কেপ বিক্রি করলাম। কেউ একজন আমাকে রাসত্মায় এটি আঁকতে দেখেছেন। তিনি তা পছন্দ করলেন এবং তখনই এটা কিনে নিলেন। দশ টাকা দিলেন। এটা কোনো ছোট অঙ্কের অর্থ নয়। সে আমলে কুড়ি টাকায় একটি সংসারের মাস কেটে যেত। আমি পোর্ট্রেট আঁকার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকলাম। কেউ কেউ আমাকে দিয়ে পোর্ট্রেট আঁকিয়ে নিলেন এবং প্রতিটির জন্য পনেরো থেকে কুড়ি টাকা মূল্যও দিলেন। কিন্তু এভাবে এগোতে পারলাম না। আমি যেভাবে আঁকতে চাই তাঁরা ছবিটা সেভাবে দেখতে চান না – না, না, না এভাবে নয়, আমাকে আরো ফর্সা ও সুন্দর করে আঁকুন। আমার চামড়া হবে উজ্জ্বল এবং নাকটা গ্রিক ধাঁচের।
আমি তাই সিনেমার হোর্ডিং আঁকাতে নেমে গেলাম। এটা অবশ্যই ফাইন আর্ট নয় – দেখতে যে রকম সেভাবেই আঁকা। ‘টকিস’ সবসময়ই আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। এখান থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্নটি বাসত্মবায়নের পথে নামলাম।
মাসের পর মাস আমি সিনেমার হোর্ডিং এঁকেছি, রং মিলিয়েছি, ছবির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছি, রং দিয়ে মুখ ভরেছি। গ্র্যান্ড রোডের পাশে পতিতালয়ের খুবই কাছে আমার কাজ করার জায়গা। আমার কোনো ঘরবাড়ি নেই। সতেরো বছর বয়সে আমি রাসত্মার ধারে ঘুমাতাম। আমি দৈনিক ছ’আনা মজুরি পেতাম। ছ’আনায় ভাতের দাম হয়ে যেত – তরকারি কিংবা ডাল ফ্রি।
বোম্বের সেই দিনগুলোতে আমি কোনো শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি, কোনো শিল্পীর সঙ্গে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠেনি। আমি (সৈয়দ হায়দার) রাজা ও (ফ্রান্সিস নিউটন) সুজাকে দেখেছি। নিজের প্রদর্শনীতে অমৃতা শেরগিলকে দেখেছি – কিন্তু তাঁকে মনে হচ্ছে অগম্য এক রাজকন্যা। আমি অন্য শিল্পীদের আঁকা ছবির সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি।
১৯৪৭ সালে আমার প্রদর্শনী দেখে ‘প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্টস অব বোম্বে’ প্রথমবারের মতো আমার কথা জানল। ‘হুসেন! হু ইজ হি?’ এবার তাঁরা আমাকে তাঁদের দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালেন।’
বিয়ন্ড দ্য ক্যানভাস : প্যারিসে জাগরণ
বোম্বেতে যখন দ্বিতীয় একক প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন হুসেন তাঁর জীবনের প্রথম ভারতীয় প্যাট্রন ও চিত্রসংগ্রাহক হায়দরাবাদের ধনাঢ্য মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বদ্রিবিশাল পিট্টি। তাঁর দেওয়া চৌদ্দ হাজার টাকা দিয়ে ১৯৫৩ সালে হুসেন তাঁর পেইন্টিংগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশ করলেন। হুসেনের ছবির বদলে দিলেন আরো তিন হাজার টাকা, তাতে ইউরোপ ভ্রমণের টাকা হয়ে গেল।
‘শিল্পকলা-বিশ্বের রাজধানী প্যারিস, ল্যুভ ও অন্যান্য মিউজিয়াম দেখে উত্তেজনা, সচকিত মনোভাব এবং আবেগ পর্যায়ক্রমে আমার ভেতর উথলে উঠতে শুরম্ন করল। দানবের দেশে নিজেকে আমার পিগমি বলে মনে হলো – কোনটা আমার ভালো লাগছে আর কোনটা লাগছে না আমি তার তফাত করতে পারছি না। … কেবল মিউজিয়াম আর গ্যালারিতে নয়, যখন আমি প্যারিসের রাসত্মায় হাঁটছিলাম, আমি দেখলাম সেখানকার মতামত সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর।’
কেবল প্যারিসেই পঞ্চাশ হাজার চিত্রশিল্পী বসবাস করছেন, ছবি আঁকছেন। সেখানে সার্ত্রে, ক্যামু কিংবা মালরোও লিখছেন, তর্ক করছেন, পরস্পরকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলছেন। আসলে প্যারিস নয়, গোটা ইউরোপই তখন মহাযুদ্ধের ভস্ম থেকে উঠে এসে নিজেদের পুনর্গঠন গঠন করছে – দর্শন, সাহিত্য, শিল্প ও সিনেমায় গৌরবের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। ফ্রান্সে যদি রেনোয়া, বুনোলা ও রেসানির মতো সিনেমার মানুষ থেকে থাকেন ইতালি গর্ব করতে পারে আরো উজ্জ্বল ও প্রাণবমত্ম চিত্রনির্মাতা – নিউরিয়েলিস্ট ডি সিকা, আমেত্মানিওনি, প্যাসোলিনি ও রোসেলিনিকে নিয়ে।
প্যারিসের প্রাথমিক হতভম্বদশা এবং উদ্বেগ কাটিয়ে ওঠার পর হুসেন যখন তাঁর শিল্পীবন্ধুদের কাছ থেকে সরে এলেন, নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগলেন – কী পছন্দ করেছেন আর কী পছন্দ করেননি এবং কোনটিতে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি তা শনাক্ত করতে লাগলেন। সেখানকার শৈল্পিক ঘূর্ণিপাক থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আবিষ্কার করলেন প্রাক-রেনেসাঁ যুগের পেইন্টিংয়ের প্রতি তিনি সবচেয়ে বেশি সাড়া দিয়েছেন – শিল্পী গিয়োত্তো, মাসাক্কিও, ওচেলো এবং এমনকি স্বল্পপরিচিত কজন শিল্পীর কাজে। মাইকেলেঞ্জেলোর কাজ বিশেষ করে তাঁর ভাস্কর্য হুসেনকে স্পর্শ করেনি। ইমপ্রেশনিস্ট ও এ-কালের যাঁরা গুরম্ন তাঁরাও হুসেনকে তেমন নাড়া দিতে পারেননি। ‘এমনকি পিকাসোও আমার মন ভরাতে পারেননি – অথচ তিনি পুরো আধুনিক চিত্রকলাকে প্রভাবান্বিত করেছেন এবং সারাজীবনই আমার প্রণোদনার উৎস হিসেবে বিরাজ করেছেন। এ-কালের বড় শিল্পীদের মধ্যে কেবল পল ক্লি আমার ওপর একটি ছাপ রাখতে পেরেছেন। আমি যখন সুইজারল্যান্ডের বার্নস শহরের কুন্টস মিউজিয়ামে তাঁর অনেকগুলো কাজ দেখার সুযোগ পাই – তাঁর রসবোধ, করম্নণ রস এবং শিশুসুলভ ফ্যান্টাসি আমাকে অভিভূত করে। ক্লি মমত্মব্য করেছেন, ‘সবকিছুর ওপর আমি চাই অনুভব এবং সঞ্চলন’ – আমার অমত্মর্মূলকে তা স্পর্শ করেছে।’
প্রথম একক প্রদর্শনী
হুসেনের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ১৯৫০ সালে বোম্বেতে (এখন মুম্বাই)। দ্বিতীয়টি কলকাতা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। ‘গরম্নর গাড়ি, গ্রামের মানুষ, গ্রামীণ উৎসব – মৌলিক রঙে আঁকা, অমসৃণ ও নিষ্কলুষ রেখা – এভাবেই আমি আমার প্রদর্শনীটির বর্ণনা দেব। সে-সময়কার বাংলার সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্প-সমালোচক ও সি গাঙ্গুলি আমার কাজের ওপর সিল মেরে দিলেন ‘বিট্রেয়াল অব যামিনী রায়’ – যামিনী রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা … আমার একটি ছবিও বিক্রি হয়নি আর আমি কলকাতায় পড়ে রইলাম – ফিরতি টিকিট কিনে বোম্বেতে ফিরে যাওয়ার মতো পয়সাও আমার হাতে নেই।’ সে-বছরই কলকাতায় একটি গ্যালারির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে অনেক খ্যাতিমান শিল্পীর সঙ্গে হুসেনও অংশ নিলেন – যামিনী রায়ও প্রথমবারের মতো তাঁর স্টুডিও ছেড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এলেন।
প্রথম জাতীয় পুরস্কার
১৯৫৪ সালে হুসেন ‘প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সদস্য’ হিসেবে ললিতকলা একাডেমির সদস্য মনোনীত হলেন। পরের বছরই একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম ভারতীয় জাতীয় প্রদর্শনী। এম এফ হুসেনের ক্যানভাস ‘জমিন’ পেয়ে গেল প্রথম জাতীয় পুরস্কার। একাডেমির তিন প্রধান নিয়ন্ত্রক ভবেশ সান্যাল, ভি পি রায় চৌধুরী এবং ভেঙ্কাটাচালাম হুসেনকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচনের বিরোধিতা করলেন। তাঁদের বিশ্বাস, কেবল নিউ বেঙ্গল স্কুলের ধারাটিই সত্যিকারের ভারতীয়, সেখানে দেশীয় প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যের এক্সপ্রেশনিজম কিংবা ইমপ্রেশনিজমের বৈধতা নেই। রম্নডি ফন লেইডেন তিনজনের বিরম্নদ্ধে লড়ে ‘জমিন’-এর জন্য পুরস্কার নিশ্চিত করেন। শুধু তা-ই নয়, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম ছয় হাজার রম্নপি দিয়ে ছবিটি কিনে নেয়। সে সময় একটি ছবির জন্য শিল্পী পেতেন বড়জোর পাঁচশো রম্নপি। ‘জমিন’-এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট ও শনাক্তেয় হয়ে ওঠেন পরবর্তী সময়ের নগ্নপদ এই চিত্রশিল্পী।
হুসেনের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে শিল্পীমহলে অনেকেই অসন্তুষ্ট হলেন। ন্যাশনাল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষও ছবিটি দেয়াল থেকে নামিয়ে গুদামে পাঠিয়ে দিলো। যাঁরা হুসেনের ছবির কথা জিজ্ঞেস করলেন তাঁদের বলা হলো – এম এফ হুসেন শিল্পী হিসেবে ফুরিয়ে গেছেন, তাঁর আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
হুসেনের ফুরিয়ে যাওয়ার কথা তোতাকথন হয়ে উঠল। সঙ্গে যোগ হলো – হুসেনের ছবিতে কোনো মৌলিকত্ব নেই, বিদেশি ম্যাগাজিন থেকে নকল করে ছবিটা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে।
তারপরও ১৯৬০ সালে টোকিওর দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে তিনি পুরস্কৃত হলেন। হুসেনের ফুরিয়ে যাওয়ার প্রচারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ‘মুলকরাজ আনন্দ আমার করা কিছু ঘোড়ার পেইন্টিং দেখলেন। তিনি আমাকে লিখলেন, যেহেতু আমি ষাঁড়ের চেয়ে বেশি ঘোড়া আঁকছি, আমি একজন বুর্জোয়া চিত্রশিল্পীতে পরিণত হয়েছি। তিনি দাবি করলেন, ষাঁড় প্রগতিশীল শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে আর ষাঁড়ের জায়গায় ঘোড়া হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক।’
মকবুল ফিদা হুসেন বহু ঘোড়া এঁকেছেন, আর ঘোড়ার সঙ্গে নারী।
সাও পাওলোর আমন্ত্রণ
‘সাও পাওলোর দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে বিশেষ আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে পিকাসোর সঙ্গে আমার আঁকা ছবি প্রদর্শনের আমন্ত্রণ পেলাম, আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মনে পড়ছে, সন্ধ্যার শেষভাগে আমি আমন্ত্রণটি পাই, সারারাত আমি দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। তখন চলিস্নশ বছর আগের আরেকটি রাতের কথা মনে হয় – আমার বাবা আমাকে এক বাক্স উইন্ডসর অ্যান্ড নিউটন রং কিনে দিয়েছিলেন… এগুলো আমার হাতেই, তবুও বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি রংগুলো পেয়েছি।’
‘আমি বিছানায় জেগে থেকে ভাবছিলাম সাও পাওলোতে কোন ছবি প্রদর্শন করব। রামায়ণ সিরিজ আঁকার পর আমি মহাভারত সিরিজ করার কথা ভেবেছিলাম। এই মহাকাব্যিক জৌলুস ও বিশালত্ব আমার শৈলী ও মেজাজের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যায়। মহাভারতের চিত্রায়ণের যে মাত্রা তাতে আমাকে যা মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে
নিয়তি-নির্দিষ্ট চরিত্রগুলোর মনসত্মাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের নাটক, তখনই আমার মন ঠিক করে ফেলি।’
‘আমার আমন্ত্রিত হওয়ার সংবাদটি আমাদের শিল্পী সম্প্রদায়ের ওপর বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়। আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ সত্যিই উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। এয়ারপোর্টে শিল্পী রাজকুমারের চোখের চাহনির কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, মিনতি করে বলছে, ‘হুসেন এটাকে সিরিয়াসলি নেবে। ফাঁকি দিয়ে বেড়াবে না (বলতে বলতে আমার সঙ্গে থাকা নম্রতাকে একবার দেখে নিল)। ইউরোপে পা রাখা মাত্রই ছবি আঁকতে বসে যাবে।’
‘আমরা দু’সপ্তাহ ইউরোপ ঘুরে বেড়ালাম যেন আমার মহাভারত সিরিজ ছবি আঁকার কাজ শেষ হয়েছে, আর ওগুলো বাক্সবন্দি করে সাও পাওলো পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে এটা ঠিক, প্রতিরাতেই আমি রাজাগোপালাচারিয়ার মহাভারত থেকে একটি কি দুটি অধ্যায় পড়ে শেষ করেছি। যদিও মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে আমি পরিচিত, রাজাজির মহাভারত আমাকে প্রধান চরিত্রগুলোর শক্তি ও দুর্বলতার বিভিন্ন মাত্রা অনুধাবন করতে সাহায্য করে। আমি পড়ছি আর ক্যানভাসে চারকোল দিয়ে স্কেচ করছি।’
‘আর এই স্কেচগুলোও আমস্টারডাম যাওয়ার পথে চুরি হয়ে গেল। আমার স্বপ্নপ্রয়াণ থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালাম। দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীর মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি, আমি একটি পেইন্টিংও করিনি। নম্রতাকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে প্যারিসে এলাম – সোজা আমার বন্ধু রিবোর বাড়িতে, গিয়েই কাজ শুরম্ন (নম্রতা শিরোদকার মিস ইন্ডিয়া নির্বাচিত হন, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান দখল করেন)।’
জ্যাঁ রিবো ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় বহুজাতিক কোম্পানির চেয়ারম্যান। তিনি শিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপ ঘুরেছেন। তাঁর বাড়িতে এম এফ হুসেন দেখা পেয়েছেন ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের।
ফরাসি দূতাবাসের একজন সাধারণ কর্মকর্তা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসায় তিনি ক্ষিপ্ত হলেন এবং দূতাবাসের পার্টি এড়িয়ে গেলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হলো, হুসেন সাহেব এতটাই মাতাল হয়ে পড়েছিলেন যে, পার্টিতে হাজির হতে পারেননি। অথচ তিনি মোটেও মদ্যসেবী নন। সবচেয়ে মন্দ যে ব্যাপারটি ঘটল তা হচ্ছে পিকাসোর অনুপস্থিতি। তিনি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেননি।
মহাভারত সিরিজের ছবিগুলো কিনে নিল চেস্টার হার্ভিজ,
১৯৭৩-এ। এ ছবিগুলো প্যারিসে প্রদর্শিত হলো। কবছর পর হার্ভিজ এক শর্তে ছবিগুলো ভারতকে দান করতে চাইল : ছবিগুলো বোম্বের কোনো জাদুঘরে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু সে দায়িত্ব নিয়ে কেউ এগিয়ে এলো না।
হুসেনের কাবুল প্রদর্শনী
ছবিকে ছাপিয়ে নারী। কাবুলে প্রদর্শনী শেষ করে তিনি বাগদাদ এলেন। ‘প্রদর্শনীতে বিস্ময়কর মোগল সৌন্দর্যের অধীশ্বরী আয়েশার সঙ্গে দেখা। সে আমার নামের প্রথম অংশ মকবুল অত্যমত্ম সুন্দরভাবে উচ্চারণ করল – এত মিষ্টি করে আগে আর কেউ উচ্চারণ করেনি – এটাই আমাকে প্রথম আকৃষ্ট করল। আমাদের সম্পর্ক যতটা নিবিড় হতে পারত, নিয়তির ফেরে তা হয়নি। কাবুল পৌঁছার আগেই টাইম ম্যাগাজিন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর একটি পোর্ট্রেট করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল। সে বছরের শেষভাগে তাঁর যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা। কিন্তু উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাঁর সফর বাতিল হয়ে যায়। টাইম আমার আঁকা প্রচ্ছদ ব্যবহার করতে না পারলেও কাবুলে আমার কাছে দশ হাজার ডলার পাঠিয়ে দেয়। টাকা পেয়ে সবার আগে একটা গাড়ি কিনলাম। আগে কখনো একসঙ্গে এত টাকার স্বাদ পাইনি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কাবুলে গাড়িতে আমার পাশে আয়েশাকে বসিয়ে যখন শহরে ঘুরে বেড়াই, নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী।’
তখন কবি অক্তাভিয় পাজ কাবুলে এসেছেন। হুসেন কবিতার টানে চাইলেন তাঁর সঙ্গে পাজের দেখা হোক। ‘স্বামীনাথনের বাড়িতে যেখানে কবিতা পাঠের আসর বসত, সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি কবিতার ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছে যাই – অক্তাভিয় পাজের মতো বড় কবির সঙ্গে দেখা হবে, শোনা যাবে তাঁর কণ্ঠস্বর।’
কবি ও শিল্পীর বন্ধন বেশ দৃঢ়ই হয়েছিল। পাজ যখন ‘হনুমান দ্য গ্রামারিয়ান’ লিখলেন, হুসেনকে ডাকলেন বিশ্ব কবি সম্মেলনে তাঁর কবিতার অলংকরণ করতে; তিনি হুসেনের কবিতারও প্রশংসা করলেন। বছর গড়াতেই হুসেন পেয়ে গেলেন অষ্টাদশী উচ্ছল তরম্নণী নম্রতা শিরোদকারকে।
সুরাইয়া উপাখ্যান
হুসেন ষোলো, প্রিয় বন্ধু হামিদের বোন সুরাইয়া চৌদ্দ কিংবা পনেরো। খোলা মাঠে বসে হুসেন সুন্দর ও লাজুক এই মেয়েটিকে কবিতা ও দর্শন ভারাক্রামত্ম একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। ‘আমি তার ঘরের আয়নাতে ছবি এঁকেছি, আলমারিতে এঁকেছি ময়ূর, পুকুর এবং তোতাপাখি এমনকি জানালার শার্সিও রাঙিয়ে দিয়েছি, কিন্তু আমার চিঠিটি তার হাতে তুলে দেওয়ার মতো সাহস পাইনি…। আমার মতো একটি ভবঘুরের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়ার ঘোর বিরোধী তার বাবা। ছবি এঁকে আমি একজন স্ত্রী এবং একটি পরিবার পুষতে পারব – তিনি তা বিশ্বাসই করেননি। তার স্বামীকে হতে হবে সচ্ছল ব্যবসায়ী – সে রকম একজন পাত্রই তিনি সুরাইয়ার জন্য খুঁজে পেয়েছিলেন।
সুরাইয়া – শব্দটির মানে জানো তো? আকাশের সাতটি তারার সমাহার – সপ্তর্ষিম-ল। পার্সি একটি বয়াতে বলা হয়েছে : ‘যদি রাজমিস্ত্রির প্রথম ইটে কোনো গলদ থাকে, তাহলে সৌধের চূড়া যদি সুরাইয়াতেও পৌঁছে, সৌধে গলদই থেকে যাবে – আমারও ভিত্তির ইটে নিশ্চয়ই গলদ ছিল।’
বহু বছর পর হুসেন সাহেব পাকিসত্মানে। বেনজির ভুট্টো তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন, মাত্র তিন মাস আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন। খুব ভালো সময় কাটল তাঁর সঙ্গে। তারপর তিনি সুরাইয়ার বাড়ি খুঁজে বের করলেন।
‘আমার এক পুরনো বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এক অপরাহ্ণে আমি তার বাড়িতে হাজির হলাম। সুরাইয়া আর নেই, তার স্বামীও মৃত। শুরম্নতে তার দুই ছেলে আমার সঙ্গে বৈরী আচরণ করল। বড় ছেলে আমাকে এমনকি বেরিয়ে যেতে বলল। কিন্তু ক’মিনিট পর তারা শামত্ম হয়। একজন ভেতর থেকে অ্যালবাম নিয়ে এলো, পারিবারিক ছবি দেখাবে। তারা যখন অ্যালবামের পাতা উল্টাচ্ছে আমি প্রার্থনা করছিলাম আমাকে যেন বদলে যাওয়া বার্ধক্যপীড়িত সুরাইয়াকে দেখতে না হয় – আমার সৌভাগ্য এ ধরনের কোনো ছবি ছিল না। সত্তরের দশকের শেষদিকে তোলা একটি গ্রম্নপ ছবিতে সে ছিল, কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায়নি।’
‘আসলে সুরাইয়ার সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি। আমার স্মৃতিতে কেবল তার চেহারা, কেবল তার আকৃতি – এটাই আমার কাছে গুরম্নত্বপূর্ণ। তার সেই ছবি আমার স্মৃতিতে পরিপূর্ণ সংরক্ষণ করে রেখেছি – আমি চাইনি এই ছবি সামান্য মলিন হোক – এমনকি ছয় দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও।’
আমরা যখন উঠতে যাচ্ছি তার বড় ছেলে জানতে চাইল আমি তার একটি ফটোগ্রাফ নিতে চাই কি না – আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তারপর বলল, ‘আম্মুর কবর দেখতে যাবেন?’
তার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি যখন প্রার্থনা করছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল তার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করছি – অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আমার মনে হয়েছে, আমি সুরাইয়ার আত্মাকে অবমুক্ত করে দিয়েছি।
আমার রম্নমে ফিরে এসে খুব অস্থিরতায়, জাগরণে সময় কাটল। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে – মনে হলো আমার বুকের ভেতর ছুরির ফলার আঘাত পড়তে শুরম্ন করেছে। আমি উঠে বসি, আমার নিঃশ্বাস ফিরিয়ে আনি – আমি কাঁদতে শুরম্ন করি। আমার সারাজীবনেও এত কাঁদিনি। যখন কান্না থামল, আমি শামত্ম হয়ে এলাম। পৃথিবীতে আমার পরিভ্রমণবৃত্ত সম্পন্ন করেছি … আমি এখন চলে যেতে প্রস্ত্তত – আমার আর কোনো বাসনা কিংবা খেদ নেই।
ষোলো বছর বয়সী সুরাইয়ার একটি ছবি লকেটে পুরে গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন তাঁর সেই প্রেমমুগ্ধ তারম্নণ্যে, মধ্যরাতে বিছানা ছেড়ে জায়নামাজে বসে পড়তেন – বাকি রাত প্রার্থনায় কেটে যাবে। তার মোনাজাতের তীব্রতা সুরাইয়াকে তাঁর কাছে টেনে আনবে – ইহজগতে সে মিলনের সম্ভাবনা চিরদিনের মতো মিলিয়ে গেল।
মারিয়া পর্ব
শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের গোটাজীবন একটি খোলা বই – কেবল একটি অধ্যায় ছাড়া। চেকোসেস্নাভাকিয়ান দোভাষী মারিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অধ্যায়টি অনালোকিত রয়ে গেছে। কিশোর সিংয়ের এম এফ হুসেন : দ্য জার্নি অব দ্য লেজেন্ড গ্রন্থের একাংশের অনুবাদ :
হুসেনের জীবনে প্রাগ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। চেকোসেস্নাভাকিয়ার রাজধানী, দুটো পবিত্র রোমান রাজত্বের কেন্দ্রভূমি, একই সঙ্গে সেন্ট্রাল ইউরোপের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী – ভাল্টাভা নদীর তীরে অদ্ভুত রমণীয় আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে এই শহর। এখানকার গ্যালারি মানেসে ১৯৫৬ সালে হুসেনের আঁকা ছবির একটি প্রদর্শনী হয়। গ্যালারিতে সাজানোর তিন সপ্তাহ আগে তাঁকে ছবিগুলো দেখাতে হয়। সে সময় হুসেন ইংরেজিতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারতেন না, তাই তাঁকে একজন দোভাষী সরবরাহ করা হয়।
মারিয়া জারোসস্নাভ জুরকোভার অনুসন্ধিৎসা তৃপ্ত হওয়ার মতো নয়। মারিয়া হুসেনের মধ্যে এমন একজন মানুষকে পেয়ে গেলেন যার সঙ্গে তিনি বেদ ও উপনিষদ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিক্ষা নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন, পাশ্চাত্য দর্শন ও সংগীত নিয়ে আলাপে মজে থাকতে পারেন। তাদের মধ্যে প্রেমের সৃষ্টি তাৎক্ষণিকই হয়ে গেল।
যখন প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো সবাইকে অবাক করে দিয়ে হুসেন ঘোষণা করলেন তাঁর কোনো ছবিই বিক্রির জন্য নয়। তিনি ততক্ষণে সিদ্ধামত্ম নিয়ে ফেলেছেন সবগুলো ছবিই মারিয়াকে উপহার দেবেন।
১৯৫৭ সালে এয়ার-ইন্ডিয়া তার প্রাগ অফিসে ম্যুরাল করার জন্য এম এফ হুসেনকে নিয়োগ করল। তিনি প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রাগ এলেন এবং মারিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নবায়ন করলেন। এরপর হুসেন বারবার প্রাগ আসতে থাকলেন। তিনি তাকে বিয়ে করার প্রসত্মাব দিলেন, মারিয়া বিয়ের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করল। শুরম্ন হলো তাদের মধ্যে বহু দূরবর্তী – লং ডিসট্যান্স প্রেম – পূর্ণ কামনা ও বাসনা দিয়ে লেখা আবেগময় চিঠিপত্রের লেনদেন। ‘তোমার হাতে আকাশটাকে ধরে রেখো, আমার ক্যানভাসের টান কোনদিকে আমার জানা নেই।’
মারিয়াকে দেওয়া তাঁর ঘোষণা-দলিল ও সাধ্যের সবটুকু উদ্ধৃত করাই বরং ভালো হবে :
‘আমার কাছে তুষার ঢাকা আকাশের ফালি পাঠিয়ে দাও
কোনো ক্ষত নেই যার
আমি সাদা শব্দে কেমন করে রাঙাবো
তোমার অসীম শোক ঘিরে থাকা
দেহরেখা?
আমি যখন রঙ লাগাতে শুরম্ন করি
আকাশটা তোমার হাতে ধরে রেখো
আমার ক্যানভাসের টান কোনদিকে
আমার জানা নেই।’
আট বছর পর ১৯৬৪ সালে মারিয়া আইসল্যান্ডের এক যুবককে বিয়ে করলেন। এরই মধ্যে হুসেন মারিয়াকে আরো অনেক পেইন্টিং উপহার দিয়ে অভিভূত করে রাখলেন – কিছু আঁকা প্রাগে, বাকিগুলো শিল্পীর নিজ দেশ ভারতে। হুসেন পুরোপুরি আচ্ছন্ন। মারিয়া নিজেকে ধরে রেখেছেন – অত তাড়াহুড়োর কী আছে! শিল্পী তো এমনিতে বিবাহিত এবং কজন সমত্মানের জনক। বয়সের ব্যবধানও কম নয়। তাছাড়া চেকোসেস্নাভাকিয়ায় যে জীবন তা ফেলে রেখে তিনি ভারতে যেতে আগ্রহী কেন হবেন? সেই বছরগুলো তো ঝঞ্ঝামুখরই হওয়ার কথা – আবেগ ও হৃদয় ভাঙার বেদনা – আর নিয়তির বিড়ম্বনা। শেষ পর্যমত্ম মারিয়াই সম্পর্কটির অবসান ঘটালেন। হুসেন মারিয়ার বিয়েতেও হাজির হলেন – তাঁদের মধ্যকার যোগাযোগ কিন্তু বিচ্ছিন্ন হলো না।
মারিয়া দম্পতি যখন অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসনের সিদ্ধামত্ম নিলেন উদারচেতা হুসেন এগিয়ে এলেন – মারিয়াকে দেওয়া তাঁর সব পেইন্টিং ‘মারিয়া কালেকশন’ প্রাগের শুল্ক বিভাগ পার করে দিলেন। ২০০৫ সালে তিনি মারিয়া ও তাঁর পরিবারকে দেখতে অস্ট্রেলিয়া এলেন। কিন্তু এক বছর পর মারিয়া যখন আবার প্রাগে ফিরে আসার সিদ্ধামত্ম নিলেন তিনি ছবিগুলো ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। যদিও ছবিগুলোর মূল্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার – মারিয়া অনুভব করলেন এসব ছবি নিজের কাছে রাখার কোনো অধিকার তাঁর নেই।
হুসেনের দুবাইয়ের বাড়িতে এক কন্টেইনারভর্তি পেইন্টিং এসে পৌঁছল। তাতে একটি ছোট্ট চিরকুটও ছিল – ‘একসময় তুমি আমাকে যে উপহার দিয়েছিলে তা তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চাই। এগুলো আসলে আমার নয়, ভারতের।’ ভারতীয় সিভিল সার্ভেন্ট ও চিত্রনির্মাতা বিক্রম সিং লিখেছেন, ‘২০০৭ সালে হুসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যখন দুবাই গেলাম, দেখলাম তাঁর ঘরের একাংশে প্রায় ষাটটি ছবি টাঙানো – মারিয়া কালেকশনের ছবি। এটি একটি প্রেমের গল্প; কিন্তু অন্য সবার গল্পের মতো নয়। মারিয়া আশিটি পেইন্টিং ফেরত পাঠিয়েছেন – কিন্তু তার কাছে কি এই আশিটিই ছিল? সম্ভবত নয়, হুসেনই লেখক ও চিত্রনির্মাতা খালিদ মোহাম্মদকে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘আমি মারিয়ার যে ছটি পোর্ট্রেট করেছিলাম সেগুলো ফেরত দেয়নি।’
তিনি একথা তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি এ বয়সে বিশ্বাসও করেন, ‘মারিয়া আমার শিল্পকর্ম ফিরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ভালোবাসা তো ফিরিয়ে দেয়নি।’
হুসেন তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বহু নারীসঙ্গ উপভোগ করেছেন, ‘কিন্তু তিনি কেবল মারিয়ার প্রেমেই পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি।’ খালিদ মোহাম্মদ লিখেছেন, আর সবকিছুর চেয়ে মারিয়ার জন্য তাঁর ভালোবাসার যে অভিজ্ঞতা, নারীকে দেখার হুসেনের দৃষ্টি বদলে দিয়েছে এবং তাঁর শিল্পীজীবনের সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ থিম ‘নারী’কে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে।
হিন্দি ঔপন্যাসিক শ্রীকামত্ম ভার্মা যখন লেখেন, ‘সৌন্দর্য, বিশেষ করে নারীর সৌন্দর্য হুসেনের পেইন্টিংয়ের বিষয়’, তিনি তেমন ভুল বলেন না। তাঁর বিষয় ও রং নির্বাচন প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালে তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখে ঔপন্যাসিক মুলকরাজ আনন্দও একই ধরনের একটি উপসংহারে পৌঁছেছেন : ‘ছবিগুলো সব আনন্দোজ্জ্বল রঙের – সবুজ, নীল, হলুদ, বাদামি ও লালই মুখ্য। নারী আকৃতি সর্বত্র – বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে, বড় শ্রমনিষ্ঠ হাত, বড় নিতম্ব, সমতল পায়ের পাতা এবং বড় আঁকারের কেশবিন্যাস – পাখি, ফুল বা কলসির সঙ্গে সংগতি রেখে এসব নারীদের অঙ্কন করা হয়েছে।’
ইলা পালের ‘বিয়ন্ড দ্য ক্যানভাস’ থেকে মারিয়াকে নিয়ে আরো কিছু কথা : মারিয়া ভাষাতাত্ত্বিক এবং ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি। স্কুল থেকে ঝরেপড়া সামান্য ইংরেজি জানা লাজুক স্বভাবের হুসেন কেমন করে তাঁর সঙ্গে কথোপকথন চালাবেন? প্রেমের ভাষা সর্বজনীন বলেই হয়তো হুসেনের ভাষাজ্ঞান বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মারিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে তাঁর সময় লাগেনি। হুসেন বললেন : তার মাধ্যমে আমি পাশ্চাত্যের সংগীত অনুধাবন করতে শুরম্ন করলাম, সবচেয়ে বড় কথা পাশ্চাত্যের মানব মন মারিয়াই আমাকে বুঝিয়ে দিলো।’
এয়ার-ইন্ডিয়া অফিসে যখন ম্যুরাল আঁকতে এলেন তাঁর মনে হলো : যেন তাকে আমি সবসময়ই চিনতাম। প্রাগ ছেড়ে আসার আগে আমি বুঝতে পেরেছি, আমি মারিয়াতে অমত্মত গভীরভাবে মোহমুগ্ধ হয়ে আছি। মকবুল ফিদা হুসেন এবার সত্যিই কবি হয়ে উঠলেন। তিনি মারিয়াকে লিখলেন :
‘তোমার নিঃশ্বাসের আশেপাশে
আমি নিকটে গিয়েছি আবার দূরে
সেই ছায়াতলে
আমাদের নগ্ন শব্দগুলো কেমন সিক্ত।’
তিনি আবার লিখলেন :
‘আমাদের গল্পগুলো সংক্ষিপ্ত
যখন শেষ হয়ে আসে, আমরা সবসময়ই
শুরম্ন করি – ওখানে দূরের কোনো গ্রামে
দলবেঁধে নারীরা বসে থাকে
সুদূর-প্রসারিত টিনের চালের মতো
অজানা গল্প তারা নিজেদের শুনিয়ে যায়।’
এই কাব্যপত্র পেয়ে মারিয়া লিখলেন, ‘আমি তোমার পেইন্টিং পছন্দ করি। কিন্তু তোমার কবিতা ভালোবাসি তার চেয়েও বেশি। তোমার কবিতা আমার সামনে ভারতকে এঁকে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাউকে বিবেচনা করেই তোমাকে শুরম্ন করতে হয়, তার ওপর তুমি অদৃশ্য সুতো দিয়ে আপাত অসংযোজিত চিত্রকল্পগুলো সেলাই করে কবিতার সত্মর হিসেবে বিছিয়ে দাও।’
আরো একটি কবিতা পেয়ে মারিয়া লিখলেন, ‘আমরা যে
সময়-স্রোতে বয়ে চলি সে সম্পর্কে তোমার কবিতার সে কী তীক্ষ্ণ সচেতনতা। আমি যখন তোমার কবিতা পড়ি আমি নিজের মনকে তখনই বহু যুগ, বহু সভ্যতা ও বহু সংস্কৃতিতে স্থাপন করতে পারি। আমি অনুভব করি আমি যেন এই গ্রহের ঠিক কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছি।’
দেশে ফেরার কমাস পর দিলিস্ন যাবেন বলে হুসেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, কিন্তু চলে এলেন এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল উইংয়ে। রোমে অবতরণ করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে কিনে নিলেন একটি ভক্সওয়াগন কার। যত দূরত্বই হোক, গাড়ি চালনায় যত অনভিজ্ঞই হোন, স্টিয়ারিং ধরে চলে এলেন মিলান, সেখান থেকে জুরিখ, তারপর জার্মানি হয়ে প্রাগ। কারণ তো একটিই – মারিয়া।
আবার দুজনের দেখা দুজনের জন্যই যন্ত্রণার এবং পরীক্ষার। হুসেন ধীরে ধীরে মারিয়ার জীবন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে চাইছেন, আর মারিয়ার মরিয়া হয়ে চাওয়া তার গর্ভে হুসেনের একটি সমত্মান।
নববিবাহিত মারিয়া এবং আইসল্যান্ডিক যুবক যখন চেকোসেস্নাভাকিয়া ছেড়ে যাচ্ছেন হুসেন নিজে এসে তাঁর ছবিগুলো প্যাক করলেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নিজের ছবি সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাওয়ার নাম করে সীমামত্ম পার করে মারিয়াকে দিয়ে দিলেন সেই ‘মারিয়া কালেকশনস’।
প্রাগ থেকে ফিরে এসে এক বন্ধুকে নিয়ে চলে এলেন জুহু সমুদ্রসৈকতে – মারিয়ার লেখা চিঠিগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন। তারপর শুরম্ন হলো তাঁর এক অস্থির জীবন। মারিয়াকে বিয়ে করার জন্য হুসেন একসময় তাঁর সরল-সাদামাটা স্ত্রী মেহমুদাবিবির কন্যা ফজিলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির কথাও ভেবেছিলেন।
মারিয়া হুসেনকে সবসময়ই তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর হাতে নির্মিত চলচ্চিত্র মীনাক্ষী : এ টেল অব থ্রি সিটিজেও ফিরে এসেছেন মারিয়া জুরকোভা।
হুসেনের জীবনে নারী পিকাসোর জীবনের নারীর মতোই অবিশ্বাস্য রকম একটি পরিসর দখল করে আছে – তাঁর জীবনে এসেছে মিস ইন্ডিয়া নম্রতা শিরোদকার, মাধুরী দীক্ষিত, টাবু, অমৃতা রাও, আনুশকা … এ তালিকা ফুরোবার নয়। সব নাম ছাপিয়ে মারিয়া। প্রাগের গ্যালারিতে পেইন্টিং প্রদর্শনীর পর সবগুলোই মারিয়াকে দিয়ে হুসেন যখন ভারতে ফিরলেন, তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রতিদিন মারিয়াকে একটি করে চিঠি লিখতাম।’
নম্রতা পর্ব : প্রেম ও প্রত্যাখ্যান
১৯৬৬ সালে হুসেনের দুটি বৃহৎ প্রাপ্তি। নয়াদিলিস্নর ইন্দ্রপ্রস্থ ভবনের সামনের দিকটাতে সিরামিক টাইলসের ম্যুরাল অঙ্কনের জন্য ভারত সরকার তাঁকে অনুরোধ জানাল। ‘আমি আগেও ম্যুরাল করেছি, পরেও করেছি; কিন্তু এমন বিরোধিতা ও ঈর্ষার শিকার কখনো হইনি। ম্যুরাল করার প্রতিটি সত্মরে আমার ‘বন্ধুরা’ বাধার সৃষ্টি করেছে; প্রতিটি বাধা আমাকে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছে…।’
৮০ ফুট x ৫০ ফুট মাচা তৈরি হয়ে গেলে রংভরা বালতি আর ব্রাশ নিয়ে তিনি যখন মাচায় উঠলেন বিরোধিতা ও ঈর্ষার বাইরেও শিল্পের চ্যালেঞ্জ – বিশাল পরিসরে ফ্রিহ্যান্ড ব্রাশ চালনা। রঙের বালতি পায়ে ঝুলিয়ে বাঁশের এক খুঁটি থেকে অন্য খুঁটিতে পা বাড়াচ্ছেন, মোজাইক টাইলস বসাচ্ছেন, রঙের পোচ দিচ্ছেন – দেখতে হাজার মানুষ প্রতিদিন জমায়েত হচ্ছে – মানুষের উচ্ছ্বাস শিল্পীকে আরো প্রণোদিত করছে। মাচা তৈরি, টাইলস কেনাসহ সব মিলিয়ে তাঁকে পঞ্চাশ হাজার রম্নপি দেওয়া হলেও হুসেনের জন্য তা ছিল আকাশছোঁয়ার কাজ – এতবড় কাজে হাত দেওয়ার দুঃসাহস তখনো কেউ দেখাননি।
প্রধান প্রাপ্তি হচ্ছে নম্রতা – আঠারো বছর বয়সী প্রাণচঞ্চল এক সুন্দরীশ্রেষ্ঠা – দুজনের বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছর। শুরম্নতে তাঁর কাজ ছিল হুসেনকে চিঠিপত্র লেখায় সাহায্য করা – ক্রমেই নম্রতা হয়ে উঠলেন তাঁর প্রেমিকা ও প্রেরণাদাত্রী – সম্পর্কটি রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় জমজমাট হয়ে ওঠে।
সে সময়ের আরেকটি প্রাপ্তি নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণে ভারত সরকারের আমন্ত্রণ। সিনেমার জন্য তাঁর যে অনুরাগ তা অকৃত্রিম – শৈশবে সিনেমা দেখার যে রেশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তা অবলম্বন করেই একটার পর একটা নিজের আঁকা ছবি সেঁটে দিয়ে জীবমত্ম একটি চলমান সিরিজের মায়াজাল সৃষ্টি করার শৈলী রপ্ত করে নিয়েছিলেন। ‘এটিই একমাত্র মাধ্যম, যা আমার মনে হয়েছে সম্পূর্ণ। একেই ইমেজ এবং ধ্বনির সমন্বয় করা হয়েছে – কখনো এমন দৃশ্য ফুটে উঠতে পারে, যা প্রকৃত দৃশ্যের চেয়েও বেশি কার্যকর … আমি ভাবতাম ছবি আঁকা তেমন কঠিন কাজ নয়। আমি যে-কোনো সময়ই আঁকতে পারি – আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমাকে সৃজনশীল চলচ্চিত্র তৈরি করতে হবে।’
মকবুল ফিদা হুসেনের সে ছবি থ্রু দ্য আইজ অব অ্যা পেইন্টার বার্লিন উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার গোল্ডেন গেস্নাব পেয়ে যায়। সম্ভবত এই বিশাল প্রাপ্তির কারণেই চিত্রনির্মাতা হিসেবে তাঁকে আর উপেক্ষা করা গেল না – পরের বছর হুসেন পেলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ছবি দেখে শিল্পী তাইয়েব মেহতা (১৯২৫-২০০৯) হুসেনকে বললেন, ‘আপনার চলচ্চিত্র আপনাকে জীবনের দ্বিতীয় ইজারা প্রদান করল।’
তখন হুসেন-নম্রতা প্রণয় তুঙ্গে। তিনি নম্রতাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেরালার পথে-প্রামত্মরে। নম্রতা তাঁর কল্পলোকের অনাবিষ্কৃত আরো অনেক জগতের দরজা উন্মোচন করে দিলেন। দুজনের মধ্যে চলতে থাকে উষ্ণ শব্দাবলির পত্র-বিনিময়। হুসেনের ‘জীর্ণ দেহকাঠামো ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে আমার হৃদযন্ত্রের বাড়তি কিছু স্পন্দন’, ছবির পাশাপাশি কবিতারও জন্ম হতে থাকে। ‘আমার প্রেম স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তোমাকে সত্য করে তোলে।’
হুসেনের কেরালা সিরিজের ছবি শক্তিমমত্ম প্রাণবমত্ম নারী নম্রতা তাঁর সৃজনশীল কল্পনার দিগমত্ম বহুদূর বিসত্মৃত করে দিলো। দুজনের মধ্যে ঘটল কিছু স্মরণীয় পত্র-বিনিময়। হুসেনের চিঠিতে কবিতা নগ্নতা ও যন্ত্রণা। কিছু কিছু ড্রইংকে কেউ যদি অশস্নীল বলতে চায় বলুক। তিনি নম্রতাকে লিখছেন :
‘নৈঃশব্দ্য! আঁধার! আমি একটি শব্দও শুনতে পাচ্ছি না। আমার দিগমেত্ম তিনটি কালো দাগ ভেসে উঠেছে – আমি দেখতে পাই না, আমি অনুভব করতে পারি না এবং সম্ভবত আমি আর বেঁচেও নেই। এই সদয় নৈঃশব্দ্যের জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি বিকেল পাঁচটা থেকে টেলিফোন অফিসে বসে আছি। তিন মিনিট আমার নির্বোধ বচন সময় নষ্ট করার বদলে (যা তুমি গত তিন বছর ধরে শুনে আসছ) নিশ্চয়ই ভালো কোনো কাজে তুমি যোগ দিয়েছ।’
‘আমি কারণ জানি না, কিন্তু তুমি দূরে সরে যাচ্ছ বলে মনে হয়। আমি যখন তোমার সামনে তখন অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু একবার দৃষ্টির আড়াল হলেই আমি তোমার মনের আড়ালে চলে যাই মনে হয়, তোমার এতটা দৃষ্টি আমার প্রত্যাশা করা ঠিক নয়, কারণ আমি তা পাব না – তুমি সত্যটি শুনতে ভালোবাস এমন মনে হয় না – তোমার ভেতরের মানুষটির জন্য আমার করম্নণা হয়… আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারি না, আমি তোমাকে ভালোবাসতেও পারি না। যখন তুমি আমাকে অবিশ্বাসী হিসেবে কল্পনা করো – তখন নয়।’
সেই হুসেনই বয়ঃসন্ধির কিশোরের ভাষায় নম্রতাকে লিখেছেন :
‘আমার ডায়েরিতে তোমার কেবল একটি ফটোগ্রাফ। আমার হৃদয়কোটরের সবচেয়ে কাছে রাখা। দয়া করে আমাকে সবগুলো ছবি পাঠাও। আমি তোমার প্রতিটি ইঞ্চি ভালোবাসি। এ আমার গভীর প্রেরণা।’
নম্রতা সাফ জানিয়ে দিলেন, হয় বিয়ে করে সংসার করো, নতুবা এ সম্পর্কের কোনো প্রয়োজন নেই। কাজেই ভাঙনই তখন একমাত্র খোলাপথ। হুসেন বললেন, ‘যা-ই ঘটুক দুজনের মঙ্গলের জন্যই ঘটেছে। এমন একটি সম্পর্ক আমি বিয়ের কাছে বলি দিতে চাইনি। এটাই পরিণতি টেনে এনেছে। স্রষ্টাকে ধন্যবাদ এ সময় আমার বন্ধু শিল্পী বাল চাববাডা এসে হসত্মক্ষেপ করে, নতুবা এমন প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমাকে হয়তো ঝাঁপই দিতে হতো।’
আর সব গোলস্নায় যাক …
ভারতে জাদুঘর আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পুরোধা হারমান গোয়েৎজ (১৮৯৮-১৯৭৬) বরোদা জাদুঘরে প্রগতিশীল শিল্পীসংঘের শিল্পীদের প্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। ১৯৪৭-এ গঠিত এই সংঘ রয়াল অ্যাকাডেমি অব লন্ডন এবং নিউ বেঙ্গল স্কুলের কর্তৃত্ব ও প্রভাবের বাইরে আধুনিক ভারতীয় শৈল্পিক রম্নচি তৈরিতে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। হুসেন তাঁদের নতুন সদস্য। বরোদার প্রদর্শনীতে যোগ দিয়ে দিলিস্নতে রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হচ্ছে – অন্যরা তেমন আগ্রহী না হলেও হুসেন ও সুজা দিলিস্নর পথে পা বাড়ালেন। ‘আমাদের হাতে অর্থকড়ি নেই যে হোটেলে থাকব, সেখানে আমাদের কোনো বন্ধু-স্বজনও নেই। সুতরাং আমরা জামে মসজিদের সিঁড়িতে ঘুমিয়ে রাত পার করলাম।’ এই প্রদর্শনীতে এসে তাঁর মনে হলো পর্বতের শিখরে সারি সারি পর্বতমালা আবিষ্কার করেছেন – গুপ্তযুগের ভাস্কর্য থেকে শুরম্ন করে নিষ্কলুষ লোকশিল্প।
হুসেন রাস্কিন, উইলিয়াম ওরপেন ও অন্যান্য ব্রিটিশ চিত্রকলা ঐতিহাসিকের লেখা পড়লেন – তখনো আঁদ্রে মালরোর নাম শোনেননি। বোম্বে ফিরে নিজের অধিকারে নিলেন মালরোর ‘ভয়েস অব সাইলেন্স’, ফরাসি শিল্প-সমালোচক ইলিয়াস ফো’র প্রবন্ধ, জেনসেনের আধুনিক শিল্পকলা আর ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে কুমারস্বামীর গ্রন্থ।
১৯৪৮-এ বোম্বে আর্ট সোসাইটির বার্ষিক প্রদর্শনীতে হুসেন তাঁর পাঁচটি পেইন্টিং গ্যালারির দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। ছবি দেখে তখনকার খ্যাতিমান শিল্পী নারায়ণ শ্রীধর বেন্দ্রে (১৯১০-৯২) মমত্মব্য করলেন, ‘তুমি তো নতুন ফর্ম আবিষ্কার করেই ফেলেছ। ফিগারেটিভ আর্টের ইতিহাসে এ এক গুরম্নত্বপূর্ণ সম্মুখ পদক্ষেপ।’ তিনি হুসেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছো… তবে হাঁটার জন্য তোমার জুতো দরকার।’ ফ্রান্সিস নিউটন সুজা বুঝে গেলেন কদিন আগের হুসেন আর এই হুসেনের আঁকার মধ্যে বিসত্মর তফাত, তিনি তাঁর ছবির নতুন উপাদানের কথা বললেন এবং কৌতূহলী হয়ে এসব উপাদানের উৎসমূল কোথায় জানতে চাইলেন।
বোম্বে আর্ট সোসাইটির সেলুনে ১৯৫০ সালে হুসেন আয়োজন করলেন নিজের একক প্রদর্শনী। হুসেনের ছবি দেখে শিল্পবোদ্ধারা এবার সমীহ করে বলতে শুরম্ন করলেন – হুসেন অন্য জাতের শিল্পী। হুসেন বিশেষ একজন। ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদ ও ভারতীয় শিল্পধারা মিশে গেল এই শিল্পীর অনায়াসসাধ্য কাজে।
বিরোধিতাও কম হয়নি। হুসেনের ফুরিয়ে যাওয়ার রটনা হুসেন কানে তোলেননি। আর সব গোলস্নায় যাক, ‘আমি যা করতে চাই তা-ই করব।’ হুসেন তা-ই করে চললেন।
ছবির দাম মিলিয়ন ডলার
মহাভারত সিরিজের ছবিগুলোর বিপুল সাড়া হুসেনের জীবনের ক্যানভাসে বহুবিচিত্র বিষয়ের উদ্ভাসন ঘটাতে লাগল। আগের দুদশক তিনি ছবির প্রদর্শনী করেছেন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যক্তিমালিকানাধীন গ্যালারিতে। এবার তাঁর জন্য খুলে গেল বিখ্যাত সব আর্ট সেন্টার ও মিউজিয়াম। লন্ডনের কমনওয়েলথ আর্ট মিউজিয়াম, মস্কোর মিউজিয়াম অব ওরিয়েন্টাল আর্ট, বস্টনের মিউজিয়াম অব কনটেম্পোরারি আর্ট, মন্ট্রিয়েলের গ্যালারি জর্ডান হুসেনকে নিয়ে প্রদর্শনী করতে এগিয়ে এলো। হুসেনের আমত্মর্জাতিক খ্যাতি এবং নতুন নতুন ছবির সৃষ্টি পালস্না দিয়ে এগোতে থাকে – এম এফ হুসেনের ছবির অর্থমূল্যও নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে হু হু করে বেড়ে যায়।
১৯৩৪-এ হুসেন নিজের আঁকা ছবি বেচে পেতেন দশ রম্নপি, ১৯৩৭-এ যখন বোম্বে এলেন বিশ রম্নপিতে পোর্ট্রেট করতেন।
১৯৫০-এ যখন প্রথম একক প্রদর্শনী করলেন তাঁর ছবির দাম পঞ্চাশ থেকে দুশো রম্নপির মধ্যে নির্ধারিত হয়। ১৯৫৫-তে একটি ছবির জন্য সর্বোচ্চ আটশো রম্নপি পেলেন। ১৯৫৯-এ টোকিও দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁর ছবির দাম আরো একধাপ বাড়িয়ে দিলো – দাম উঠল এক হাজার দুইশো রম্নপি। ১৯৭১-এ সাও পাওলো দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রদর্শনের জন্য পিকাসোর সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে আমন্ত্রিত হওয়াতে হুসেনের ছবির দাম উঠল ত্রিশ হাজার রম্নপি। ৬০ ইঞ্চি x ৪৮ ইঞ্চি একটি ক্যানভাসে আঁকা ছবির জন্য এই অর্থ দেয় হিন্দুসত্মান লিভার। উনিশশো সত্তরের দশকে হুসেন শিল্পকলার ও সমাজের স্বীকৃতির সর্বোচ্চ ধাপে চলে যান।
হুসেন ঘোষণা দিয়ে জানালেন, তাঁর ছবির দাম প্রতিটি এক কোটি টাকা। অনেকেই অবাক হলেন হুসেনের পাগলামির শেষ কোথায়? এক কোটি টাকায় কেউ ছবি কিনবে?
তিনি বললেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় একটি মাস্টারপিস পেইন্টিংয়ের দামের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন – এক কোটি এমন কোনো অবিশ্বাস্য দাম নয়।
আমত্মর্জাতিক নিলামকারী ক্রিস্টি প্রথমবার ভারতে এসে নিলাম ডাকের আয়োজন করলে হুসেনের ছবি বিক্রি হলো পাঁচ লাখ রম্নপিতে – এটিই তখনকার সর্বভারতীয় রেকর্ড। তাঁর ছবি বিক্রি হলো ১.৬ মিলিয়ন ডলার, ২.০ মিলিয়ন ডলার। ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবিও যে মিলিয়ন ডলার দামে বিক্রি হতে পারে সে সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন এম এফ হুসেন।
এম এফ হুসেন-রবার্তো রোসেলিনি
প্রখ্যাত ইতালীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রবার্তো রোসেলিনি প্রধানমন্ত্রী নেহরম্নর আমন্ত্রণে ভারতের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে ১৯৫৭ সালে ভারতে আসেন। বলস্নভভাই দেশাই ইনস্টিটিউট দেখতে এলে রোসেলিনিকে মকবুল ফিদা হুসেনের স্টুডিওতে আনা হয়। ইতালি ফিরে গিয়ে রোসেলিনি লেখেন, ‘ভারতে আমার সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ দুটি আবিষ্কার হচ্ছে হুসেন এবং সোনালি দাসগুপ্তা (সোনালি রোসেলিনিকে বিয়ে করেন)।’ টেলিগ্রাফে প্রকাশিত (৮ জুলাই ২০০৭) একটি নিবন্ধে হুসেন লিখেছেন :
‘তিনি আমার কাজ পছন্দ করতেন, আমি করতাম তাঁর কাজ – আমরা ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। মহিশুরের গ্রামাঞ্চল থেকে পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটি টেলিফোন বুথে এসে কলকাতায় (বাঙালি নারী সোনালিকে) ফোন করতেন। রোসেলিনি ও তার একটি যৌথ ফটোগ্রাফের বদলে আমেরিকার একটি পত্রিকা আমাকে দশ হাজার ডলার সেধেছিল। কিন্তু আমি যে আমার বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভাবতেই পারিনি।’
রবার্তো রোসেলিনি ও সোনালি দাসগুপ্তার মিলনে হুসেন গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এক রাতে তিনি ফ্রন্টিয়ার মেইলে প্রথম শ্রেণির কুপে ভাড়া করে সোনালিকে মিসেস হুসেন সাজিয়ে বোম্বে থেকে দিলিস্ন নিয়ে আসেন। সাংবাদিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে তাকে রোসেলিনির কাছে পৌঁছে দেন। সোনালি দাসগুপ্তা ছবছর বয়সী একটি পুত্রসমত্মানকে ভারতে ফেলে রেখে এক বছর বয়সী পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে প্যারিসে পাড়ি দেন। তারপর রোমে – বিশ্বখ্যাত নায়িকা ইঙ্গরিড বার্গম্যানের স্বামী রোসেলিনি সোনালিকে বিয়ে করেন।
হুসেন এ প্রসঙ্গে আরো যোগ করেন : ‘রোসেলিনি ভারতীয় নারী সোনালির প্রেমে পড়েন আর আমি পড়ি ইউরোপীয় নারী মারিয়ার প্রেমে। আমার জন্যও রোসেলিনির পক্ষে যা সম্ভব তাই করবে। এটা সত্যি, আমরা দুজনই বিবাহিত – তার সমত্মান চারটি, আমার পাঁচটি। কিন্তু আমরা দুজনই পাগলের মতো ভালোবেসেছি।’
শশী থারম্নরের কলামে
মৌলবাদী অত্যুৎসাহী একটি হিন্দু গোষ্ঠী যখন মকবুল ফিদা হুসেনকে ভারতছাড়া করেছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ছোট শহর পিবডিতে বসেছে এম এফ হুসেনের মহাভারত চিত্রমেলা। শশী থারম্নর আমন্ত্রিত হয়েও শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে প্রদর্শনীতে হাজির হতে পারেননি। সেই খেদ ব্যক্ত করে তিনি তাঁর কলামে লিখেছেন :
প্রধানতম ভারতীয় আধুনিক চিত্রশিল্পী এবং দেশের সর্বাধিক পরিচিত মুসলমান এম এফ হুসেন যে প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্য থেকে প্রেরণা আহরণ করবেন, এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। হুসেন বরাবরই উন্মুক্তচিত্তে ভারতের সাংস্কৃতিক অসমসত্তা থেকে, মহাভারত থেকে, মহাভারতের যমজ মহাকাব্য রামায়ণ থেকে তাঁর প্রয়োজনীয় চিত্রকল্প ও প্রতীক গ্রহণ করেছেন। মহাভারত রামায়ণ থেকে ভিন্ন – একটি ধর্মনিরপেক্ষ মহাকাব্য। মহাভারত হুসেনকে দিয়েছে চরিত্র এবং চিত্রকল্প, যা মহাকাব্যিক অনুনাদে সমৃদ্ধ। আরো দিয়েছে একে বদলে, পুনর্গঠন করে সমকালীন ক্যানভাসে তুলে আনার প্রেরণা – এটাই শৈল্পিক পুনরাবিষ্কার।… মহাভারত সিরিজের প্রথম ছবিটি আঁকা হয় ১৯৭১-এ – ভারতের তখন এক উথালপাথাল সময় – বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী সংকট, বছর শেষে পাকিসত্মানের সঙ্গে যুদ্ধ। হুসেনের ১৯৭১ ও পরবর্তী সময়ের পেইন্টিংগুলোর কথা স্মরণ করা যেতে পারে – তিনি মহাভারত-সচেতন দেশবাসীর কাছে দ্বন্দ্ব ও লড়াইয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন, হ্রেষারত অশ্ব এবং চিৎকাররত হসিত্ম কুরম্নক্ষেত্রের দ্বন্দ্বে অসহায়, তাঁর তুলির প্রতিটি আঁচড়ে রক্তপাত ও মরণাতঙ্ক – সেই সঙ্গে গণপতির কালোত্তীর্ণ প্রতিকৃতি হুসেনের কল্পনা ও বেদব্যাসের লেখনীতে একাকার হয়ে গেছে। মহাকাব্যের প্রজ্ঞান হুসেনের তুলিতে তাঁর যুগের ভারতীয়দের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।
হুসেনের অনেক কাজে হিন্দু পুরাণ এবং মহাকাব্যিক গল্প জাতীয় বিবেককে সমৃদ্ধ ও প্রতিফলিত করেছে। অতিউৎসাহী ধার্মিকরা হিন্দু চিত্রকল্প ব্যবহারে হুসেনের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে, ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁর বিরম্নদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। অন্যদিকে শিল্পপ্রেমিক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই হুসেনের সৃষ্টির পক্ষে মিছিলে নেমেছেন। হুসেনকে সর্বোচ্চ জাতীয় পদক ভারতরত্ন প্রদান করতে রাষ্ট্রপতির কাছে যে আবেদন করা হয়েছে, তাতে স্বাক্ষরদাতাদের আমিও একজন। সত্যজিৎ রায়, এম এস সুববুলক্ষ্মী, রবিশঙ্কর, বিসমিলস্নাহ খান, লতা মুঙ্গেশকরের মতো সৃজনশীল শিল্পীরা ভারতরত্ন খেতাব পেয়েছেন। হুসেনের নামও এই কীর্তিমানদের সঙ্গেই উচ্চারিত। তাঁর দৃষ্টির মহাভারতকে ভারত ও পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করে তিনি ভারতের সভ্যতাকে নিবেদন করেছেন শ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য – তাঁর তুলিতে অতীতের পুনরাবিষ্কার এবং বর্তমানের নবকল্পনা ভারতীয় সভ্যতায় বিপুল সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে। ভারতরত্ন তাঁর প্রাপ্য। (সংক্ষেপিত)
হুসেনের বিরম্নদ্ধে যত অভিযোগ
কেরালা সরকার এম এফ হুসেনকে রাজা রবি ভার্মা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেয়। মহারাষ্ট্রের আদালত শিল্পীর বিরম্নদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরদিনই কেরালা হাইকোর্ট সরকারের সিদ্ধামত্ম বাসত্মবায়ন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। মহারাষ্ট্রের কোর্ট কেরালা সরকারকে হুকুম দেয় হুসেন পুরস্কার নিতে এলে তাঁকে যেন গ্রেফতার করা হয়। মহারাষ্ট্র কোর্টে হুসেনের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভারতমাতার নগ্ন ছবি এঁকে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশের কোর্টে অনুরূপ মামলায় হুসেনের আইনজীবী সেখানে শিল্পীর মৃত্যুঝুঁকি থাকায় মামলা দিলিস্নতে স্থানামত্মরের আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। কেরালা ক্ষেত্র সংরক্ষণ সমিতি হুসেনকে শারীরিকভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। বিজেপি হুসেনের বিরম্নদ্ধে দাঁড়ায়, বাজরাং দল তাঁর ছবি ভাঙচুর করে, হত্যার হুমকি দেয়। হুসেন পুরস্কারের জন্য এলে ‘জনতা কারফিউ’ জারি করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
শিল্পীর বিরম্নদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে : তিনি সিংহের সঙ্গে সহবাসরত দেবী দুর্গা এঁকেছেন, দেবী লক্ষ্মীকে নগ্ন অবস্থায় শ্রী গণেশের মাথার ওপর স্থাপন করেছেন, নগ্ন সরস্বতী, নগ্ন পার্বতী এঁকেছেন। ভগবান হনুমানের কাপড় সরিয়ে ফেলেছেন, ভগবতী সীতাকে রাবণের ঊরম্নর ওপর বসিয়ে দিয়েছেন, নগ্ন হনুমানকে দিয়ে ভগবান রাম ও ভগবতী সীতার রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করিয়েছেন। সব মিলিয়ে হুসেন যা এঁকেছেন তা হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। হুসেনের বিরম্নদ্ধে ভারতের বিভিন্ন থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এক হাজার দুইশো পঞ্চাশটি আর আদালতে মামলা হয়েছে সাতটি – ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি হিন্দু দেব-দেবীদের অপদস্থ করেছেন, সব মিলিয়ে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে মহাপাতকের কাজ করেছেন। উস্কানিমূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে – এম এফ হুসেন শিল্পী না কসাই?
টেক্সট বুক থেকে আউট
হিমাচল প্রদেশ শিক্ষা বোর্ডের নবম শ্রেণির বইয়ে একটি অধ্যায় মকবুল ফিদা হুসেনকে নিয়ে। মৌলবাদী চাপের কাছে নতিস্বীকার করে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান জানিয়ে দিলেন – লেখাটিতে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার মতো কিছু নেই। সুতরাং শিক্ষা বোর্ড রিভিউ কমিটির সুপারিশে হুসেনকে পাঠ্যবই থেকে বহিষ্কার করা হলো। সব স্কুলে নির্দেশ পাঠানো হলো যেন হুসেনকে সিলেবাসভুক্ত করা না হয়। তাঁর জায়গায় অমত্মর্ভুক্ত হবেন শিল্পী শোভা সিং। হিমাচলে বসতি স্থাপনকারী রম্নশ শিল্পী নিকোলাস রোরিচও অমত্মর্ভুক্ত হতে পারেন। ঘটনাটি
২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের।
যত মামলা-মোকদ্দমাই হোক না কেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে হুসেনের পক্ষেই। খারিজ করে দিয়েছে অশস্নীলতা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ।
বুটপরা সৈনিকের মতো মৃত্যুবরণ করতে চাই
(২১ নভেম্বর ১৯৯৭ সালে মকবুল ফিদা হুসেন একটি অনলাইন আলাপে অংশগ্রহণ করেন)
প্রশ্ন : চিত্রশিল্পী মহলে একটি কথা চালু আছে যে, আপনি নিজের ছবির জন্য অত্যমত্ম বেশি দাম চেয়ে বসেন – আপনি কোন মানদ– আপনার পেইন্টিংয়ের দাম নির্ধারণ করে থাকেন?
উত্তর : সাধারণত আর্ট ডিলাররাই পেইন্টিংয়ের দাম নির্ধারণ করে থাকে। পশ্চিমের সঙ্গে তুলনা করলে প্রমিত আমত্মর্জাতিক দামের চেয়ে অনেক কম মূল্যে ভারতীয় পেইন্টিংয়ের মূল্য ঠিক করা হয়ে থাকে। কদিন আগে পিকাসোর আঁকা একটি বিড়ালের নিলামমূল্য ছিল ১৪০ মিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন : আপনি কি মূলত ধার্মিক না সংশয়বাদী নাকি নাসিত্মক?
উত্তর : এখানে আমি ই এম ফস্টারকে উদ্ধৃত করতে চাই, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, হে ঈশ্বর আপনি আমার এই অবিশ্বাসে সহায়তা করম্নন।’
প্রশ্ন : আপনার আঁকা সরস্বতী নিয়ে কথা বলতে চাই। এ ছবি যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে সে সম্পর্কে আপনার কী বলার আছে?
উত্তর : আমার পেইন্টিং সরস্বতী নিয়ে যেহেতু অনেক প্রশ্ন উঠেছে, আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে : সরস্বতী হচ্ছে শিল্প ও সাহিত্যের দেবী। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ভারতীয় মিনিয়েচার আর্টে সরস্বতীকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি যে সরস্বতী এঁকেছি, তা করেছি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সঙ্গে – আধুনিক চিত্রকলার ভাষায় সরস্বতীর প্রতিকৃতি আঁকা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য আমার ছিল না। কিন্তু এর শৈল্পিক আবেদনের যে দ্যোতনা তা কেউ কেউ বুঝতে পারেনি। এটা রং-তুলির পেইন্টিং ছিল না, এটা ছিল ২০ বছর আগে আঁকা ড্রইং, যা প্রদর্শনী বা প্রকাশনার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়নি।
প্রশ্ন : মকবুল সাহেব, আপনার অশ্ব পর্বের পেছনের তাড়না নিয়ে বলুন – এমন কিছু বলবেন না যেন আমাদের মনে হয় যে আপনার কাছ থেকে উত্তর পাইনি।
উত্তর : আমার অশ্ব পর্ব তো এখনো চলছে। এমন নয় যে, আমি আগে ঘোড়া আঁকতাম, এখন আর আঁকছি না। কিন্তু তা নয়, এখনো আঁকছি। ঘোড়া হচ্ছে পুরম্নষ ও নারীর একটি সমন্বয়। সামনের অংশটি পুরম্নষের এবং তা খুবই আক্রমণাত্মক, পেছনের অংশ নারীর। অর্ধ-নারীশ্বর ঘোড়া হচ্ছে নারী ও পুরম্নষের সমন্বিত রূপকালঙ্কার, এঁকে প্রাণী হিসেবে আঁকা হয় না। ঘোড়া ছাড়াও আমি মহাভারত, রামায়ণ এবং মাদার তেরেসা সিরিজের ছবিগুলো এঁকেছি। কয়েক বছর আগে আমি পৃথিবীর প্রধান নয়টি ধর্মের ওপর সিরিজ ছবি এঁকেছি। দশ বছর আগে ব্রিটিশরাজ নিয়ে সিরিজ করেছি, প্রধান শহরগুলো নিয়ে ছবি এঁকেছি, কলকাতা, বেনারস, রোম। যখন চীন সফরে যাই বেইজিং শহর নিয়ে ছবি আঁকি। তারপর ৪০ ফুট উঁচু ম্যুরাল ‘পোর্ট্রেট অব টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’ নির্মাণ করেছি – এতে শতাব্দীর প্রধান শিল্পকলা, বিজ্ঞান, নৃত্য, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদি চিত্রিত হয়েছে।
প্রশ্ন : হুসেন সাহেব, গুজব রটেছিল আপনি মিস (মাধুরী) দীক্ষিতের জন্য একটি স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। কিন্তু এখন তাঁর কোনো ছবিই হিট করছে না বলে স্ক্রিপ্টটা কি শেলফে তুলে রেখেছেন?
উত্তর : আমি স্ক্রিপ্ট শেষ করেছি। এর নাম গজগামিনী। আর্ট অ্যান্ড সিনেমা এ নিয়ে লিখেছে। একটি-দুটি ছবি ফ্লপ করলে কিছুই এসে যায় না, কারণ ভারতীয় পর্দায় এ পর্যমত্ম যাঁরা এসেছেন তিনি তাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ আর স্ক্রিপ্ট শেলফে তুলে রাখার প্রশ্নই আসে না, কারণ তাঁর চলতি সিনেমা দিল তো পাগল হ্যায় বক্স অফিসে বিশাল সাফল্য নিয়ে এসেছে – এ ছবি তাঁকে ভারতীয় সিনেমায় খবরদারি করার মতো জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনি নিজে দিল তো পাগল হ্যায় দেখেছেন কি?
উত্তর : হ্যাঁ, আমি পাঁচবার দেখেছি – এ তো সংগীত ও নৃত্যের এক কাব্য – তিনি অত্যমত্ম রোমান্টিক ফর্মে এখানে আবির্ভূত হয়েছেন – এ রকমটা দেখা যায় ইম্প্রেশনিস্টিক পেইন্টিংয়ে। এখানে তিনি রেনেসাঁ যুগের মোনালিসা নন, তিনি পিকাসোর মাদমোয়াজেল দ্য অ্যাভিনো।
প্রশ্ন : আপনি সর্বশেষ কী নিয়ে কাজ করছেন?
উত্তর : সর্বশেষ আমি আমার থ্রি ‘এম’ সিরিজের ওপর কাজ করছি : মাদার তেরেসা, মাধুরী দীক্ষিত এবং ম্যাডোনা (যখন তিনি এভিটার ভূমিকায় অভিনয় করেন)।
প্রশ্ন : আপনি কি আপনার তুলি হাতে নিয়ে মৃত্যুবরণ করবেন? মৃত্যু কি আপনাকে আতঙ্কিত করে? গণমাধ্যম আপনাকে এমনভাবে চিত্রিত করছে যেন আপনার মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টির চুলকানি রয়েছে। এটা কি সত্য? আপনি কী বলেন?
উত্তর : পায়ে বুটপরা সৈনিকের মতো আমি মৃত্যুবরণ করতে চাই। বিতর্ক সৃষ্টির জন্য কাজ করি না; কিন্তু যারা কাজটি বুঝতে পারেন না তাঁরা বলেন এটা বিতর্ক সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে। আমি সারাজীবন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি, আমি অনেক বেশি মাধ্যমে বহু ধরনের কল্পনা নিয়ে কাজ করেছি – কারণ আমাদের দিগমত্ম অত্যমত্ম বিসত্মৃত এবং ভারতীয় সংস্কৃতি এত সমৃদ্ধ যে, আমাদের আজ সাংস্কৃতিকভাবে যে অনবদ্য অবস্থান – তা ধারণ করার জন্য একটি জীবনই যথেষ্ট নয় বলে আমার ধারণা।
মকবুল ফিদা হুসেন পায়ে বুটপরা সৈনিকের মতোই মৃত্যুবরণ করেছেন।