logo

‘ভ্যান গগ টু কানডিনস্কি’ ইউরোপে সিম্বলিস্ট ল্যান্ডস্কেপ

রা জী ব  ভৌ মি ক

 

১৯৮৬ সালে ফরাসি কবি জ্যঁ মরেয়া বলেছিলেন, Symbolism is art as the attempt to clothe the idea in sensuous form (ধারণাকে ইন্দ্রিয়ের চাদরে মুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা)। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘idea’ বা ধারণা। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকের কয়েক দশকে, স্বভাববাদের বিরুদ্ধ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবর্তন ঘটে সিম্বলিজমের। সমান্তরালভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে সংগীত, মঞ্চনাটক ও কবিতায়। ইম্প্রেশনিস্ট ছবির সঙ্গে সিম্বলিস্ট ছবির পার্থক্যটা এই রফবধ বা ধারণার ক্ষেত্রেই। একটা ইম্প্রেশনিস্ট ছবিতে রঙের দুর্দান্ত ব্যবহার দেখে আপনার মনে হতে পারে – বাপ রে! লোকটা আঁকতে পারে বটে! কিন্তু সেই ছবিতে আপনি পাবেন কেবল বাহ্যিক তথ্য। সেখান থেকে কোনো অস্পৃর্শ্য ধারণার আভাস পাওয়াটা কঠিন। ইম্প্রেশনিজমের উদ্যাপন কেবল দৃশ্যমান দুনিয়াকে ঘিরেই – বহমান মুহূর্তে, এখানে এবং এখন। যেমন ধরা যাক, ক্লড মনের ছবিতে সেইন নদীর ওপর রেলসেতু দেখেই আপনি জানতে পারেন অনেক কিছু – ঊনবিংশ শতকে প্যারিসে শিল্পায়ন কিংবা রেললাইনের কারণে নগরায়ণের গতিবৃদ্ধি। কিন্তু সেই ছবিতে মানুষের সূক্ষ্মতম অনুভূতি যেমন ভালোবাসা, বিষাদ, কল্পনা বা ক্ষমাসৌন্দর্যের দেখা মেলাটা কঠিন।

এদুয়ার মানে বা এদগার দেগা বারবণিতাদের ছবি এঁকেছেন, কিন্তু আনুষঙ্গিক অবশ্যম্ভাবী কামনার অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। হুইসলার রাতের টেমস নদীর ছবি এঁকেছেন, কিন্তু এর মধ্যে যে বিষণ্নতা লুকিয়ে আছে তার খোঁজ সে ছবিতে মিলবে না। গুস্তাভ মোরোঁ, জ্যঁ তুরপ কিংবা জি এফ ওয়াটস – পৌরাণিক রূপক নিয়ে কাজ করা এই শিল্পীরা নতুন এক জগতের খোঁজ দিয়েছেন – মানুষের মনের একেবারে ভেতরকার কোণ যেখানে রয়েছে নিজস্ব অনুভূতি, হাহাকার ও আকাক্সক্ষা।

এমনটা বলা বোধহয় ভুল হবে না যে, সিম্বলিজম আসলে রোমান্টিকদের আদর্শবাদেরই পুনরুত্থান। এবারের গ্রীষ্মে স্কটিশ ন্যাশনাল গ্যালারিতে চলছে সিম্বলিস্ট ছবির একটি বিশেষায়িত প্রদর্শনী – ‘ভ্যান গগ টু কানডিনস্কি’। সেই প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে এতদিন খুব একটা পাদপ্রদীপের আলো না পাওয়া কিছু ছবি – ১৮৮০ থেকে ১৯১০ – এই তিন দশক সময়ে সিম্বলিস্ট স্টাইলে আঁকা ইউরোপের নিসর্গের ছবি। এখানে তোলা হয়েছে এমন আরো কজন আঁকিয়ের ছবি, যাঁদের কথা এমনকি শিল্প-ইতিহাসবিদরাও তেমন একটা জানেন না। ন্যাশনাল গ্যালারিস অব স্কটল্যান্ড, আমস্টারডামের দ্য ভ্যান গগ মিউজিয়াম এবং হেলসিংকির দ্য অ্যাটেনিয়াম মিউজিয়ামের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে ‘ভ্যান গগ টু কানডিনস্কি’। চলবে ১৪ জুলাই থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত।

যেমন ধরা যাক, উনিশ শতকের পুভিস দ্যঁ শ্যাভেজ এবং সতেরো শতকের ক্লদ লর্যাঁর কথা। পুভিসের ন্যাড়া ল্যান্ডস্কেপকে বলা হয় সিম্বলিস্ট, কিন্তু লর্যাঁর একই উপাদানের ছবিকে নয়। কেন? উত্তরটা হলো : বাস্তবের পৃথিবীর প্রতিকৃতি আঁকার কোনো চেষ্টাই করেননি পুভিস। যে আদর্শবাদের ছবি শ্যাভেজ এঁকেছেন, তার সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের ওপর শিল্প-দূষণের যে প্রভাব, তার কোনো সম্পর্ক নেই। শ্যাভেজ বরং প্রতিবাদ করেছেন শিল্পায়ন এবং অতি-বৈষয়িকতার কারণে ফ্রান্সের মানুষের নৈতিক স্খলনকে, যার কারণে বদলে যাচ্ছিল দেশটির গোটা সামাজিক ব্যবস্থার বুনন। পুভিসের রঙের ব্যবহার আগ্রহজাগানিয়া – বর্ণহীন প্রেক্ষাপটে হালকা নীল, গোলাপি ও সবুজে আঁকা মানব অবয়ব – এ যেন কোনো গভীর কিন্তু শান্ত এক সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে নেই কোনো সংঘাত। ছবিতে নারী-পুরুষ আলাদা করা কঠিন – এ বিষয়টিও প্রতীক বা symbol হিসেবে গুরুত্ববহ। শ্যাভেজ এমন এক সমাজের ছবি এঁকেছেন, যেখানে রয়েছে গণতান্ত্রিক সাম্যাবস্থা। একঘেয়ে রঙের ব্যবহারে শ্যাভেজ বোঝাতে চেয়েছেন, আদর্শ সমাজ শান্তিপূর্ণ হলেও আদতে একঘেয়েই। মানুষ-সমাজ-প্রকৃতি – এই তিনের সাম্যাবস্থার ছবি এঁকেছেন আরো বেশ কজন। সেই তালিকায় পাওয়া যাবে অঁরি এডমন্ড ক্রস ও পল সিনিয়াককে।

তবে সাবধান। এখনই সমাপ্তি টেনে বসবেন না যেন। আলফনসে অসবেয়ারের নাম হয়তো খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু তাঁর সিম্বলিজম একেবারেই অন্য রকম। ১৮৯৭-এর ‘ইভনিং পোয়েমে’ দেখা মিলবে সাদা আলখাল্লা পরা এক নারীকে। এটি একটি আনুভূমিক বিন্দুচিত্র। সন্ধের কবিতা যেমন নাম তেমনি স্বপ্নময় এর দৃশ্যকল্প। রাজনৈতিক কোনো ব্যাপারই এতে নেই।

‘ভ্যান গগ টু কানডিনস্কি’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে, উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিককার ইউরোপীয় চিত্রকর্ম সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে সিম্বলিস্ট ছবির প্রদর্শনীতে হুইসলার, মনে, লেইটন, গগিন এবং ভ্যান গগের ছবির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। সময়ের হিসাবে সিম্বলিজমের আয়ু একেবারেই কম – অর্থাৎ মাত্র তিন দশক। কিন্তু উনিশ শতকের ইম্প্রেশনিজম ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম এবং বিশ শতকের কিউবিজম এবং বিমূর্তবাদ – এর মাঝে পালাবদলের সময়টার ঝড়ের ভেতরেই অস্তিত্ব সিম্বলিজমের।

বাস্তববাদের অতি-অনুভূতিবিমুখতা এবং কিউবিজম-বিমূর্ততাবাদের অতি নিরীক্ষাধর্মিতা – এই দুই চরম অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান সিম্বলিজমের। তৎকালীন পৃথিবীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবং প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক আগের বিস্ফোরণোন্মুখ বিশ্বপ্রবাহে, সিম্বলিজমের মতো অনুভূতিনির্ভর শিল্পচর্চা যে তিন দশক টিকে ছিল সেটাই যথেষ্ট আশ্চর্য।

দ্য টেলিগ্রাফ অবলম্বনে

 

Leave a Reply