logo

ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশ

জা হি দ  মু স্তা ফা

সে দিন নদী মেখলা ভেনিসের আকাশ ভারী। সকাল থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে প্রাণবন্ত এই পর্যটননগর। বৃষ্টিতে বাতাসের বেগ নেই। বাহারি রঙের ছোট ছোট ছাতা মাথায় ছুটে চলেছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ।

দিনটি ছিল ৩০ মে, ২০১৩ বৃহস্পতিবার। বিকেল থেকেই ভিড় বাড়ছিল ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের গ্যালারি অফিসিনা দেলা যাত্রেয়। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে, ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিল্পপ্রেমী মানুষ ও ইতালিতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের পদভারে মুখর ছিল আমাদের গ্যালারি প্রাঙ্গণ। স্থানীয় এক শিল্পী আগ্রহী দর্শকদের হাতে-মুখে এঁকে দিচ্ছেন বাংলাদেশের পতাকা।

গ্যালারি ভবনের পেছনেই যাত্রের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তন। বিকেল পাঁচটায় আমরা সমবেত হলাম সেখানে। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন ও প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো সেখানে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি সচিব সুলেখক রণজিৎ বিশ্বাস প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন রোমে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পরাগ, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের কিউরেটর প্রফেসর ফ্রান্সিসকো এলিসেই ও ফাবিও আনসেলমো। হল থেকে বেরিয়ে সবাই ফিরে এলাম আমাদের কাজ দিয়ে সাজানো-গোছানো প্যাভিলিয়নে। আমাদের সহশিল্পী ইয়াসমিন জাহান নূপুর পারফর্ম করলেন। উপস্থিত দর্শকদের সকলকে এক সুতোয় গেঁথে নিজের অবয়বকে সুতোর বাঁধনে ঢেকে দিয়েছেন।

পঞ্চান্নতম ভেনিস বিয়েনালের এ আসরে বাংলাদেশ থেকে আমরা অংশগ্রহণ করেছি আটজন শিল্পী। তাঁরা হলেন যথাক্রমে শিল্পী ঢালী আল মামুন, মোখলেসুর রহমান, মাহবুব জামাল শামিম, অশোক কর্মকার, লালা রুখ সেলিম, উত্তম কুমার কর্মকার, ইয়াসমিন জাহান নূপুর ও আমি। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আমন্ত্রিত দুজন বিদেশি শিল্পী ছিলেন, তাঁরা হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্পী গেভিন বেইন ও ভেনিসের শিল্পী জিয়ানফ্রাংকো মেগিয়াতো। এছাড়া ছিল যশোর চারুপীঠের শিশুশিল্পীদের কাজ।

এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয়বারের মতো অংশগ্রহণ। দুবছর আগে ৫৪তম ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশ নেয়। বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের পাঁচজন শিল্পী মাহবুবুর রহমান, তৈয়বা বেগম লিপি, ইমরান হোসেন পিপলু, মাসুম চিশতী ও প্রমথেশ দাস পুলক।

এবার ভেনিস বিয়েনালের থিম ছিল – এনসাইক্লোপিডিয়া। পৃথিবীর আদ্যোপান্ত নিয়ে চারুশিল্পীদের কাজ করার অপার স্বাধীনতার সম্ভাবনা নিহিত ছিল এই থিমে। শিল্পীর আপন সত্তা আর তার প্রতিভার উদ্ভাসের সঙ্গে মাধ্যমগত প্রকাশের তুমুল সাহস মিলিয়ে সৃজনের এক মহোৎসব যেন ভেনিস বিয়েনাল। এবারের আয়োজনে সব দেশের প্যাভিলিয়নে ভিডিও আর্ট ও স্থাপনার জয়জয়কার। তারপর আছে ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফিক কনসেপ্ট ও চিত্রকলা। দেয়ালে টানানো দ্বিমাত্রিক চিত্রকলার জায়গা প্রায় অপসৃত। সে স্থানে ভিডিও ও স্থাপনার ভিড়।

এবারের বিয়েনালে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের কনসেপ্ট – সুপারন্যাচারাল বা অতিপ্রাকৃতিক। এ সম্পর্কে কিউরেটরের ব্যাখ্যা হচ্ছে – এটি নন্দনতাত্ত্বিক একটি অভিধা। উনিশ শতকের শেষদিকে সুপারন্যাচারালিজমের আবির্ভাব। দার্শনিক উইলার ভন ওরমান কুইনি এর উদ্গাতা। মানুষ যেন তার লক্ষ্য খুঁজে পায়, জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করে এই চিন্তাকে উস্কে দেয় অতিপ্রাকৃতবাদ। আমরা কে, কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি – এসব প্রশ্ন ও চিন্তনপ্রক্রিয়াই হচ্ছে সুপারন্যাচারালিজমের ভিত্তি। আমাদের কাজে কিউরেটরের থিমের আংশিক প্রতিফলনই ঘটেছে বলা যায়।

অফিসিনা দেলা যাত্রের তিনটি কক্ষ আর একটি প্যাসেজে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন। প্রথম কক্ষে শিল্পী ঢালী আল মামুন ও উত্তম কুমার কর্মকারের কাজ জায়গা পেয়েছে। কক্ষের ঠিক মাঝখানে মামুনের স্থাপনা – ‘অপনয়ন’। আমাদের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বর্বরতা, গণহত্যা ও নির্যাতনের স্বাক্ষর এটি। সেই বাহাত্তরেই এক ছবিতে দেখেছিলাম বাঙালি এক বীরাঙ্গনা বোনের দীর্ঘ চুল আর দুহাতে মুখ ঢাকা এক ছবি। নির্যাতিত মা-বোনের লজ্জা আর ঘৃণার প্রতীক হয়ে ওঠা সেই ছবিটিকে নিয়ে শিল্পীর এই রচনা। কাজটি সম্পাদন করেছেন শিল্পী যেসব উপকরণ দিয়ে সেগুলো হচ্ছে পাটের সুতা, কৃত্রিম চুল ও ফাইবার গ্লাস।

আজানুলম্বিত চুলে ঢাকা অনেকগুলো নারী যেন জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণায়-লজ্জায় তারা যেন পরস্পরকে সমবেদনায় জড়িয়ে আছে। এই জড়িয়ে থাকার মধ্যে একতার একটি শক্তিময়তা ফুটে উঠেছে। সে প্রতিবাদ জানাচ্ছে মানবতা-বিরোধিতার, অন্যায় ও সব নির্যাতনের বিরুদ্ধে। দেখলাম – নানা দেশের দর্শকরা আগ্রহভরে অবলোকন করছে ঢালী আল মামুনের ‘অপনয়ন’।

ওই কক্ষের দুটি দেয়ালে ঝুলেছে শিল্পী উত্তম কুমার কর্মকারের পেইন্টিং। শিল্প ও প্রকৃতির মেলবন্ধন নিয়ে তাঁর কাজ। নদী মেখলা নিসর্গ, মানুষ ও প্রাণিকুল নিয়ে যে বাংলাদেশ তাকে নিয়ে শিল্পীর কল্পনার মিশেলে একেকটি চিত্রকর্ম তৈরি হয়েছে। ক্যানভাসের পাশাপাশি পাটসুতোর তৈরি চিত্রপট, লিনেন কাপড়ের পটও ব্যবহার করেছেন শিল্পী তাঁর চিত্রকর্ম রচনার মাধ্যম হিসেবে।

আমাদের সহপাঠী শিল্পী উত্তম কুমার কর্মকার দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ইতালির রোমে বসবাস করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে চিত্রকলায় স্নাতক করে গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে দেশ ছেড়ে ইতালির সঙ্গে মিতালী করেছেন। ওখানে খানিকটা থিতু হয়ে ভর্তি হয়েছেন রোমের খ্যাতনামা চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন চারুশিল্পে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অসংখ্য চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন উত্তম। বাংলাদেশে গত বছর মে মাসে বেঙ্গল শিল্পালয়ে তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে। প্রায় একই সময়ে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত ছক্কা শিল্পী পরিষদের ‘পরিবেশের প্রতিবেশ’ শীর্ষক যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। ওই প্রদর্শনীর কিউরেটর ছিলেন ইতালির ফ্রান্সেসকো এলিসেই। ভেনিস বিয়েনালের কমিশনার ও কিউরেটর নিয়োগ পেয়ে তিনিই আমাদের ভেনিসের পথ দেখিয়েছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শিল্পী উত্তমের বিয়েনালে অংশগ্রহণের স্বপ্ন।

ভেনিসে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে উত্তম কুমার কর্মকারের চিত্রকর্মগুলো পরিবেশ সচেতনতামূলক। ঢাকার আকাশ ঢেকে আছে কংক্রিটের জঙ্গলে – এ নিয়ে শিল্পীর মনোবেদনার অন্ত নেই। সারি সারি ভবনের ইঙ্গিতময় ছবি এঁকেছেন গনগনে আগুনলাল রং, হলুদ আর ঘন নীলে। শিরোনাম দিয়েছেন ‘শ্বাসহীন নগর’। প্রকৃতিকে রুদ্ধ করে, প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বকে ব্যাহত করে যে নগরায়ণের সংস্কৃতি চলছে, শিল্পী তাঁর কাজের মাধ্যমে ওই প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর আরো একটি বড় পেইন্টিংয়ের শিরোনাম – ‘নিসর্গ বাঁচাও’-এ শিল্পী গণসচেতনতা তৈরির বিষয় তুলে ধরেছেন। পরিবেশবান্ধব ঐতিহ্যবাহী একটি দেশে বসবাস করেও উত্তম বাংলাদেশকে নিয়ে ভেবেছেন, বাংলার প্রকৃতিকে রক্ষার উপায় খুঁজেছেন। ওই কক্ষেরই পশ্চিমের দেয়ালে যশোর চারুপীঠের শিশুশিল্পীদের অাঁকা মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি ছবি ঝুলছে। বাঙালির উৎসবের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করছে চার ভাগে বিভক্ত হয়েও একটিমাত্র চিত্র। প্যাভিলিয়নের দ্বিতীয় কক্ষে ঠাঁই হয়েছে বাংলাদেশের তিনজন শিল্পীর। তাঁরা হলেন মাহবুব জামাল শামিম, লালা রুখ সেলিম ও ইয়াসমিন জাহান নূপুর। প্রথমোক্ত দুজনের ভাস্কর্য ও শেষোক্তজনের ভিডিও ইনস্টলেশন ছিল এই কক্ষে।

মাহবুব জামাল শামিমের ভাস্কর্যের থিম বা বিষয় হচ্ছে – জনারণ্য বা মানব অরণ্য। ষোলো কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি কর্মিষ্ঠ হাতকে শিল্পী বিশাল এক শক্তিরূপে অনুভব করেন। আবার এই সংশয়ও তাঁর মনে, যদি এই হাতগুলো প্রকৃতি ধ্বংসে মেতে ওঠে? এই ভাস্কর মনে করেন – আমাদের সমাজে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস – বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা মায়ের দশ হাত মানব শক্তির ঐক্যের প্রতীক। এই দেবী দুর্গতিনাশিনী, শিষ্টের পালক, দুষ্টের দমনকারী। শামিম দুর্গার মতো মাতৃরূপ গড়েছেন – যাকে আমরা প্রাচীন শিল্পের মাতৃকা মূর্তি বলতে পারি। তিনি আরো গড়েছেন প্রেমের প্রতীক দেবদেবী রাধা-কৃষ্ণের ভাস্কর্য। মানব-মানবীর সম্পর্কের মানবিকতা তুলে এনেছেন ভাস্কর।

তাঁর উপস্থাপিত ভাস্কর্য চরিত্রগুলো চওড়ায় প্রকান্ড, কিন্তু উচ্চতায় খর্বকায়। চরিত্রগুলোর বিশালতাকে তিনি বিশাল করে দেখাননি। দেখেছেন সহজ করে। এই সহজের ভেতরে এগুলোর বিশালতা আমরা দেখতে পাই – চরিত্রগুলোর বিশাল সামর্থ্যবান কাঁধ দেখে। পৃথিবীর বিশালত্বের তুলনায় মানুষ অতিশয় ক্ষুদ্র। তাই শামিমের দিগরগুলো খর্বাকৃতির। তবে মানুষের কাজ বা অবদানের বিরাটত্ব তিনি দেখিয়েছেন মানুষের চওড়া শরীর গড়ে। মাধ্যম ছিল মাটি। শামিম বিশ্বাস করেন, একটি জাতির প্রগতির পেছনে থাকতে হবে তার নন্দনজ্ঞান। শিশুকাল থেকেই এই জ্ঞানের চর্চা শুরু করতে হবে। এই তাগিদ থেকে তিনি যশোরে প্রতিষ্ঠা করলেন চারুপীঠ আর্ট স্কুল। নববর্ষে যে মঙ্গল-শোভাযাত্রা হয় – এটির প্রথম উদ্গাতা তিনি।

শিল্পী ও ভাস্কর লালা রুখ সেলিম ওই কক্ষে স্থাপন করেছেন তাঁর ভাস্কর্য-স্থাপনা ‘ব-দ্বীপের জীবন’। কাঠ, বালিশ, বঁটি-দা, শুকনো লাল মরিচ, ছন ও কৃত্রিম চুল দিয়ে। কাঠের একটা টুলের ওপর আরেকটি কাঠের বেইজ, তার ওপরে খর্বাকৃতির এক নারী-শরীর, স্কন্ধহীন। তার কাঁধ বেয়ে দীর্ঘ চুল ছড়িয়ে পড়েছে প্রদর্শনী কক্ষের মেঝেয়। সামনে লাল মরিচ আর বঁটি-দা, চারপাশে ছনের তৈরি ঝাড়ু। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীর জীবন-যন্ত্রণার প্রতিফলন ঘটেছে এই ভাস্কর্য স্থাপনায়। আমাদের দেশে সংসারের মূল ভূমিকা পালন করতে হয় সংসারকর্ত্রী নারীকে। রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালন, স্বামীসেবা, হাঁস-মুরগি পালন, অতিথি আপ্যায়ন, এমনকি বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ পর্যন্ত বিস্তৃত নারীর কর্তব্য। এত করেও আবার সইতে হয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, কখনো কখনো সংসারকর্তার শারীরিক নির্যাতনও। সর্বংসহা এই বঙ্গনারীরূপকে লালা রুখ তুলে ধরেছেন বিশ্বসভায়। লোকায়ত বাংলার জীবনকে আমাদের প্রচলিত উপকরণ দিয়েই সাজিয়েছেন শিল্পী।

শিল্পী ইয়াসমিন জাহান নূপুরের ভিডিও স্থাপনা ‘একত্রে সীমান্ত অতিক্রম’ স্থান পেয়েছে কক্ষটির উত্তর দিকের দেয়ালের সামনে। পৃথিবীর বড় একটি মানচিত্র নানা বর্ণের সুতোয় সেলাই করা। জামদানি কাপড়ে সেলাই করা এই পর্দা-মানচিত্রের পেছনে আসা-যাওয়া করছে একটি প্রজেক্টর। পর্দায় প্রজেক্ট হচ্ছে টার্গেট প্রতীক। প্রতিটি দেশ সীমান্তরেখা দিয়ে বিভক্ত। আমরা সেই বিভাজনরেখা অতিক্রম করতে পারি না। এই বিভাজন কখনো কখনো দেশের ভেতরেও জায়গা নেয়, এমনকি একটি সংসার কিংবা ঘরেও এই বিভাজকের উপস্থিতি দেখা যায়। শিল্পী নূপুর এই বিভক্তির অবসান চেয়েছেন – মানুষের মানবিকতার উত্থান চেয়েছেন তাঁর এই স্থাপনার মাধ্যমে। পারফরম্যান্সের মাধ্যমেও নিজের বক্তব্যের সপক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন শিল্পী।

প্রায় আট ফুট বাই কুড়ি ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের প্যাসেজটিতে আমাদের দুজন শিল্পীর কাজ জায়গা পেয়েছে। শিল্পী অশোক কর্মকারের শিল্পকর্মের শিরোনাম – ‘দ্য কোডস অব রাপচারড কম্যুনিকেশন’। এর উপকরণগুলো হচ্ছে – কাঠের গুঁড়ো, গোবর ও কাদামাটির ঘুঁটের তৈরি হাতের নানারকম ছাপ, ভিডিও অ্যানিমেশন ও শব্দ। অফিসিনা দেলা যাত্রের প্রবেশপথ থেকে এই স্থাপনাকাজ শুরু করেছেন শিল্পী। এর আরেকটি অংশ ভিডিও ইনস্টলেশন প্যাসেজের উত্তর পাশে। ওপর থেকে প্রজেক্ট হচ্ছে নিচের গোলাকার সাদা জায়গায়। সেটি ঘিরে আছে ঘুঁটের তৈরি হাতের নানারকম মুদ্রায়। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে – একটি হাত ভেজা মাটিতে হাত বুলিয়ে কিছু সৃজনের চেষ্টা করছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের জন্য, অনুভূতি প্রকাশের জন্য হাতের মুদ্রা বিশেষ একটি মাধ্যম। এটিকেই শিল্পী তুলে ধরেছেন দেশীয় উপকরণ প্রয়োগ করে। কাজটির অভিনবত্বে দর্শকরা চমৎকৃত হয়েছেন।

প্যাসেজের অন্যপাশে একটি বড় টিভি পর্দায় আমার ভিডিও ইনস্টলেশন টানা চলছে। ইমোশন অব আর্থ। পৃথিবীর আবেগের সঙ্গে মানুষের হাসি-কান্না-দুঃখ-বেদনা-ভয়-রাগকে সম্পর্কিত মনে করে আমার এই ভিডিও। শান্ত-স্নিগ্ধ এক প্রকৃতির ভেতর স্নিগ্ধ এক কিশোরীর অবয়ব ভেসে ওঠে, সে যখন কাঁদে প্রকৃতিজুড়ে নামে ঝুম বৃষ্টি, তার চুলগুলো যখন বাতাসে দুলে ওঠে প্রকৃতিতে তখন ঝড় উঠেছে। এভাবে এগিয়ে অগ্ন্যুৎপাতের ভয় আর শঙ্কার ভেতর দিয়ে শেষ হয় ভিডিওটি।

পরের কক্ষে শিল্পী মোখলেসুর রহমানের ছাপচিত্র ‘বাংলার প্রকৃতি ও মায়ের অাঁচল’। তিনটি টাঙ্গাইল শাড়ির ওপর প্রিন্ট নিয়ে পাশেই মূল ছাপাই প্লেট। এটি তাঁর নিজস্ব একটি উপস্থাপনরীতি। ২০০১ সালে দশম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে এ ধরনের উপস্থাপনরীতির জন্য গ্র্যান্ড পুরস্কার জিতেছিলেন। সেই ধারা নিয়ে তিনি এখনো কাজ করছেন। শিল্পী মোখলেসুর রহমানের চিত্রপটজুড়ে তাঁর দেশের নিসর্গবন্দনা। ‘ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ – ডি এল রায়ের এই অমূল্য গানের সুর যেন পেয়ে যাই আমরা তাঁর এই কাজগুলোয়। একটি চিত্রে শিল্পী তুলে ধরেছেন শিল্পী এস এম সুলতানের প্রথম বৃক্ষরোপণের অনুকৃতি। দেশের শিল্প-ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার নিদর্শন ফুটে উঠেছে এতে। তাঁর কাজের প্রতিও দর্শকদের বিশেষ আগ্রহ দেখা গেছে।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে অংশগ্রহণকারী বিদেশি দুই শিল্পী গেভিন রেইন ও জিয়ানফ্রাংকো মেগিয়াতোর শিল্পকর্ম এই কক্ষেই শোভা পেয়েছে। গেভিন করেছেন পেইন্টিং, শিরোনাম ‘লীনা’। পয়েন্টিলিজমের চূড়ান্ত এক উদাহরণ এই চিত্রকর্ম। বিশাল ক্যানভাসে বৃত্তাকার থিক রং দিয়ে অনেকের মতো হিসাব মিলিয়ে নানা টোন প্রয়োগ করে এগিয়েছেন শিল্পী। যত না শিল্প তার চেয়ে বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশ বেশি যেন। চমক আছে এ কাজে, যা দর্শককে সম্মোহিত করে। জিয়ানফ্রাংকো করেছেন ভাস্কর্য, শিরোনাম ‘দ্য ব্ল্যাক কিউব’। ব্রোঞ্জ দিয়ে চমৎকার তিনটি ফর্মের ভাস্কর্য করেছেন তিনি।

সব মিলিয়ে সুন্দর সেজেছে আমাদের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন। বাংলার রূপ-রস-গন্ধ অনুভব করেছে দর্শকরা অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি শিল্পীদের কাজ দেখে।

ভেনিস বিয়েনাল চলবে আগামী ২৪ নভেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত। সে অব্দি চলবে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন।n

Leave a Reply