logo

ভেনিস বিয়েনালে এবং বাংলাদেশ

তৈ য় বা  বে গ ম  লি পি

ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশের প্রথম পদার্পণের যে-অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা বর্ণনার প্রাক্কালে এর শিকড় কীভাবে প্রোথিত হয়েছিল তা বর্ণনার দাবি রাখে। ২০০৯ সালের ৫ মার্চ আমার কাছে একটি ই-মেইল এলো, যা পাঠিয়েছেন মেরি অ্যাঞ্জেলা স্রথ নামে ইতালি প্রবাসী এক আমেরিকান মহিলা, যিনি রোমে ‘সালা উনো (ঝধষধ ১)’ নামে রোমের প্রথম অলাভজনক একটি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। মেরি অ্যাঞ্জেলা আমাকে ‘বৃত্ত’র পক্ষ থেকে একটি ভিডিও শিল্পের কিউরেটিংয়ের অনুরোধ জানান, যা তিনি ইতোমধ্যেই বিশ্বের বহু দেশের সঙ্গে করেছেন, যার নামকরণ হবে – ‘ভিডিওজুম বাংলাদেশ (ঠরফবড়ুড়ড়স ইধহমষধফবংয)’। আমাদের প্রতিষ্ঠান বৃত্ত আর্টস ট্রাস্ট তার বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে আসছে, তা তিনি জানতে পারেন ইতালীয় অপর একজন কিউরেটরের হাতে বৃত্তের কিছু ক্যাটালগ এবং বই থেকে। দীর্ঘদিন এই বিষয়ে মতামত আদান-প্রদানের পর অবশেষে ২০১০ সালের মে মাসে প্রথমবারের মতো ‘সালা উনো’তে প্রদর্শিত হয় মাহ্বুবুর রহমান, মোল্লা সাগর, ইমরান হোসেন পিপলু, প্রমথেশ দাস পুলক, রিয়াজ হোসেন এবং আমারসহ মোট এগারোটি ভিডিও শিল্পকর্ম। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন্ মোমেন এর উদ্বোধন করেন। মাহ্বুব বৃত্তের তথা শিল্পীদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকেন। মরিশাসে অবস্থানের কারণে আমার আর রোমে যাওয়া হয়ে ওঠে না।

‘ভিডিওজুম বাংলাদেশ’ প্রদর্শনীটি অনেক শিল্পী এবং শিল্পবোদ্ধাকে বাংলাদেশের শিল্পী এবং শিল্প সম্পর্কে আগ্রহান্বিত করে তোলে। এমনই একজন শিল্পী পাওলো ডব্লিউ টামবুরেল্লা, যিনি সে-সময়ে এক আড্ডায় মাহ্বুবকে ভেনিস বিয়েনালে অংশগ্রহণের সম্ভাবনার কথাটি জানান। সেই রাতেই মাহ্বুবের পরিচয় হয় ফিয়োনা বিজ্জিয়েরোর সঙ্গে, যিনি ‘জেরভাসুতি ফাউন্ডেশন’ নামে ভেনিসের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। মাহ্বুব রোমে অবস্থানকালীন এই সম্ভাবনাটি চূড়ান্ত একটি আলোচনার দিকে যায়, যার সঙ্গে পাওলো, ফিয়োনা, মেরি অ্যাঞ্জেলা এবং রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন্ মোমেন একটি লক্ষ্য নিয়ে আমাদের ভাবনার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ফিয়োনা ও আমি যৌথভাবে কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ করি। মাসুদ বিন্ মোমেন হন অনারারি কমিশনার। পাওলো ও মেরি অ্যাঞ্জেলাকে ‘বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে’র কিউরেটর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মেরি অ্যাঞ্জেলা প্রথম বাংলাদেশে আসেন অক্টোবর ২০১০-এ, যে-সময়ে ঢাকায় ‘এশিয়ান বিয়েনাল’ চলছিল। ‘ভেনিস বিয়েনালে’র কমিটিকে আমরা ‘বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে’র প্রস্তাবনাটি আমাদের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তারও অনেক আগে পাঠিয়ে দিই লিখিতভাবে। মেরি অ্যাঞ্জেলা বাংলাদেশে আসার আগেই মাহ্বুব ভেনিসে আমাদের প্রদর্শনস্থলটি দেখতে যায়। কোপেনহেগেনে তাঁর নিজের একটি প্রদর্শনীর সুবাদে এই ভ্রমণটি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়, যা প্রদর্শনস্থল সম্পর্কে আমাদের একটি আগাম ধারণা জোগায়। ২০ অক্টোবর একশ ষোলো বছরের এই পুরনো বিয়েনালের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি চূড়ান্তভাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস আমাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী। তাঁর সাহস এবং ইচ্ছাশক্তি আবারো কাজে লাগল এই বিশাল অচেনা উদ্যোগের ক্ষেত্রেও। তাঁর হস্তক্ষেপের ভরসাতেই আমরা মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলাম।

আপাতদৃষ্টিতে এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডটির খরচ অনেক বেশি মনে হলেও পরবর্তীকালে আমরা পর্যবেক্ষণ করে জেনেছি, আমাদের প্যাভিলিয়নটিই সবচেয়ে কম খরচের প্যাভিলিয়নগুলোর একটি। আমরা জানতাম, শিল্পকলার সর্বাপেক্ষা বৃহৎ এই আয়োজনটির সার্থকতার জন্য আমাদের সঙ্গে আরো অনেকের একজোট হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। মিজারুল কায়েস এবং খুশী কবীরের পরপরই আমরা বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আবুল খায়ের লিটুর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসি। লিটুভাই তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণেই আমাদেরকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার ব্যাপারে অঙ্গীকার করেন। লিটুভাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হন লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং যে-কোনো শিল্পবিষয়ক কাজে সর্বদা উৎসাহী সুবীর চৌধুরী।

২০১০-এর নভেম্বরে আমরা পাওলো টামবুরেল্লাকে ‘বৃত্ত ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্টস ওয়ার্কশপে’ অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাই। ইতালীয় নতুন রাষ্ট্রদূত, যিনি শিল্পকলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তিনি ৩ ডিসেম্বর সোনারগাঁওয়ে আসেন আমাদের কর্মশালাটি দেখার জন্য। তাঁর একান্ত আগ্রহে এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে আয়োজিত হয় প্রায় ৯০ জন শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনী, যার বিক্রয়লব্ধ অর্থের অর্ধেকাংশ দিয়ে দেওয়া হয় ‘ভেনিস বিয়েনালে’র খরচের জন্য। নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠান ‘আর্টস কোলাবোরেটরি’ এবং ‘প্রিন্স ক্লাউস ফান্ড’ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যায়। ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ এবং ‘বেক্সিমকো’ তাদের হাত আরো বাড়িয়ে দিয়ে আমাদেরকে চিন্তামুক্ত করে।

দেশীয় শিল্পবোদ্ধা, শিল্পী ও সাংবাদিকদের জন্য বেঙ্গল গ্যালারিতে ১১ মার্চ আয়োজিত হয় একটি সংবাদ সম্মেলন এবং বিয়েনালের জন্য নির্বাচিত শিল্পকর্মের প্রাথমিক প্রদর্শনী। এরপরের কঠিন কাজটি হলো শিল্পকর্ম পাঠানো। ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ এবং আমাদের পক্ষ থেকে যৌথ প্রচেষ্টা চলল নানা ধরনের অনুমতি সংগ্রহ করার। আমরা প্রথম থেকে জাহাজে কাজ পাঠাতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত বাধ্য হই এমিরেটসের একটি কার্গোতে পাঠাতে। কায়েসভাই তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় আমাদের কাজগুলো বাক্সবন্দি অবস্থায় রওনা হয় ভেনিসের উদ্দেশে।

১১ মে পাঁচজন শিল্পী – মাহ্বুবুর রহমান, প্রমথেশ দাস পুলক, ইমরান হোসেন পিপলু, কবির আহমেদ মাসুম চিশ্তী এবং আমি টার্কিশ এয়ারওয়েজে চেপে রওনা হই ভেনিসের উদ্দেশে। ভেনিস এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য ১২ মে অপেক্ষা করছিল ফিয়োনা বিজ্জিয়েরো এবং নিমল চৌধুরী। ‘বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন’ থেকে সাত-আট মিনিট হাঁটাপথের দূরত্বে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের ভাড়া করা বাসায় নিমল আমাদের থাকার জায়গা করে। আমাদের অনুজ শিল্পী নাসিরের ভাই নিমল অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলের বন্ধু হয়ে ওঠে। বিশাল লটবহর নিয়ে নিমল ও ফিয়োনার সঙ্গে আমরা একটি নৌকায় রওনা দিই ভেনিসে ঘরের উদ্দেশে। যেদিনটিতে আমরা ভেনিসে পৌঁছাই, সেদিনই আমাদের কাজের বাক্সগুলো নিমল উদ্ধার করে এয়ারপোর্ট থেকে। প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়েও মাসুম নিমলের সঙ্গে আবারো এয়ারপোর্টে যায়। সেদিন থেকেই আমাদের প্রতি পদক্ষেপে নিমল হয়ে উঠল সমস্ত বিপদের সঙ্গী।

চারদিকের অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত ভেনিসে নৌযান ছাড়া চলাফেরা করা, বিশেষ করে ভারী জিনিস বহন করা একেবারেই অসম্ভব। যে-কোনো জিনিস বহন করা যতটা দুরূহ, ততটাই আবার ব্যয়সাপেক্ষ। স্বল্প অর্থের বাজেটের কারণে যে-কোনো পদক্ষেপেই আমাদের টাকার অঙ্ক মাথায় রাখতে হতো। নিমল তাই এয়ারপোর্ট থেকে শিল্পকর্মের বাক্সগুলো সোজা পাশের শহর ‘মেস্ত্রে’তে নিয়ে গেল, যে-শহরে সে নিজেই বসবাস করে। তার বাড়ি ও পিৎজার দোকান একই দালানে। পৃথিবীর সেরা পিৎজা খেয়েছি আমরা নিমল এবং তার দুই ভাই হাসান ও তপনের হাতে। আমরা যাওয়ার দুদিন পর নিমলের ইতালীয় বন্ধুর বিরাট স্টোর থেকে তাদেরই সহযোগিতায় অত্যন্ত কম খরচে বাক্সগুলো খুলে কাজগুলোকে প্রথমে ভ্যানে করে এবং পরে নৌকায় করে আমরা নিয়ে এলাম ‘জেরভাসুতি ফাউন্ডেশনে’। নিমল, পিপলু, মাসুম ও পুলক শিল্পকর্মের সঙ্গে নৌকায় চলে গেল। আমি আর মাহ্বুব চললাম হেঁটে।

সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী এবং লন্ডনে বসবাসকারী ‘বিসে কুরিগার’কে নির্বাচিত করা হয়েছে এবারের ৫৪তম এই বিয়েনালের ‘আর্টিস্টিক ডিরেক্টর’ হিসেবে। ঊননব্বইটি দেশের জাতীয় প্যাভিলিয়ন এই বিয়েনালে অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া যুক্ত হয়েছে বিসে কুরিগার দ্বারা নির্বাচিত বিশ্বের তিরাশিজন শিল্পীর শিল্পকর্ম এবং সাঁইত্রিশটি বিভিন্ন

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ‘কোল্যাটারাল’ প্রজেক্ট। সমগ্র আয়োজনের বিশালত্ব এবং বৈচিত্র্য দেখে মনে হবে, এটি শুধু ইতালীয়দের আয়োজন নয়, এটি সারা বিশ্বের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় আয়োজিত। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলো স্থাপন করা শুরু করে দেন। আর তাই আনুষ্ঠানিকতার বহু আগে থেকেই ভেনিস শহর এবং তার আশপাশের দ্বীপগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে শিল্পী এবং শিল্প-সংশ্লিষ্ট মানুষে। পুরনো এই অদ্ভুতসুন্দর জলবেষ্টিত শহরটির অলিগলিতে বিবিধ কাঠামোর এবং ঢংয়ের দালানগুলো বেছে নেওয়া হয় বিশ্বশিল্পের সর্ববৃহৎ প্রদর্শনীর স্থান হিসেবে। এ যেন এক মিলনমেলা। বিয়েনালের মূল প্রদর্শনস্থল, যেখানে উপস্থাপিত হয়েছে বিসে কুরিগার কর্তৃক বাছাই করা শিল্পীদের শিল্পকর্ম, তা হলো ‘আর্সেনালে’। এটি একসময়ে জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর খানিকটা অংশ আবার ভাড়া নেওয়া যায় জাতীয় প্যাভিলিয়ন ও কোল্যাটারাল প্রজেক্টের জন্যও। বিশাল বিস্তৃত এর দালানগুলো অনেক উঁচু ছাদ আর অনেক বিচিত্র কাঠামোয় নির্মিত।

আর্সেনালে থেকে জার্দিনিতে যাওয়ার ঠিক মাঝপথে আমাদের প্যাভিলিয়ন। ওই এলাকার সবচেয়ে বড় পথ ‘ভিয়া গ্যারিবল্ডি’র শেষ মাথায় ‘জেরভাসুতি ফাউন্ডেশন’, যেখানে রয়েছে ইরাক ও বাংলাদেশের জাতীয় প্যাভিলিয়ন। এখানে একজন ব্রিটিশ কিউরেটরের চারজন শিল্পীকে নিয়ে একটি ‘স্বতন্ত্র’ প্রদর্শনী এবং জাপানি একজন শিল্পীর প্রদর্শনী, যা লন্ডনের একটি গ্যালারি আয়োজন করেছে। আরো রয়েছে ‘আর্ট হাব এশিয়া’-আয়োজিত ইন্দোনেশিয়ান শিল্পী জম্পেটের ‘স্বতন্ত্র’ আয়োজন। এগুলোকে ‘ওহফরারফঁধষ’ বা ‘স্বতন্ত্র’ প্রজেক্ট এজন্য বলা হয় যে, এগুলোর কোনোটাই বিয়েনালের সঙ্গে কাগজে-কলমে সংযুক্ত নয়, যদিও বিয়েনালকে কেন্দ্র করেই এরকম আরো অসংখ্য প্রদর্শনী প্রদর্শিত হচ্ছে ভেনিসের আনাচে-কানাচে। আমাদের প্যাভিলিয়নের সামনেই প্রবহমান জলধারার ওপর রয়েছে একটি আর্চের মতো ছোট সেতু আর সেতুর ঠিক ওপারে ব্রিটিশ জাতীয় প্যাভিলিয়নের আরেকটি অংশ, যাতে রয়েছে ওয়েলসের শিল্পী টিম ডেভিসের অনেকগুলো কাজ। আর্সেনালে ও জার্দিনি দুটোই আমাদের থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। ইতালীয় ভাষায় ‘জার্দিনি’র অর্থ ‘বাগান’। এটি একটি অনেক পুরনো বড় বাগান, যার মাঝে স্থায়ীভাবে জমি কিনে নিয়ে প্যাভিলিয়ন নির্মাণ করেছে ঊনত্রিশটি দেশ। প্যাভিলিয়নগুলো নানান আয়তনের এবং আকারের। অনেকটা প্রতিবেশীর মতো একটির পাশে আরেকটি অবস্থান করছে। এই প্যাভিলিয়নগুলো মূলত ধনী দেশগুলোর সম্পত্তি। এশিয়ার শুধুমাত্র কোরিয়া ও জাপানকে এখানে পাওয়া যাবে তাদের নিজস্ব দালানে। ভারত ও চায়না আর্সেনালেতে স্থান করে নিলেও তাদের বড় অঙ্কের ভাড়া দিতে হয়েছে বিয়েনালকে। বিসে কুরিগার নির্বাচিত তিরাশিজন শিল্পীর শিল্পকর্মের একটি অংশ জার্দিনিতেও আয়োজন করা হয়েছে। শিল্পকর্ম স্থাপনার প্রয়োজন অনুযায়ী জার্দিনিতে অবস্থিত অনেক দেশই তাদের প্যাভিলিয়নের ভেতরের কাঠামো সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। বিষয়টি না জানা থাকলে দেখে মনে হবে, এগুলো বোধহয় এভাবেই নির্মিত। একেকটি প্যাভিলিয়নের পেছনে অসংখ্য মানুষের শ্রম ও মেধার পরিস্ফুটন লক্ষণীয়। শুধুমাত্র শিল্পী, কিউরেটর বা কমিশনার নন, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নানান বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিবর্গ এবং স্থপতিগণ। কোনো কোনো প্যাভিলিয়ন দেখে মনে হলো, তাদের কাজ আনা-নেওয়াতেই যে-খরচ হয়েছে, তা হলো আমাদের প্যাভিলিয়নের সমগ্র বাজেটের চেয়েও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পীরা তাঁদের সহকারীদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন নিজেদের দেশ থেকে, এমনকি অনেক প্যাভিলিয়নই শিল্পকলা বিষয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসেছে প্রদর্শনী চলাকালীন ছয় মাস গাইড হিসেবে বা কাস্টোডিয়ান হিসেবে কাজ করার জন্য। নিজেদের সমস্ত খরচ প্রতিটি দেশকেই বহন করতে হয়। আমার জানামতে, তাদের দেশের সরকারেরই একটি বড় বাজেট থাকে ‘ভেনিস বিয়েনালে’ অংশগ্রহণ করার জন্য। যাদের নিজস্ব প্যাভিলিয়ন রয়েছে, তারা আবার স্থাপত্য, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি সব বিয়েনালেই অংশগ্রহণ করে, যদিও শিল্পকর্মের বিয়েনাল হয় সর্বাপেক্ষা বৃহৎ আকারে।

আমরা প্রায় তিন সপ্তাহ আগে প্যাভিলিয়নে আমাদের কাজ শুরু করি। ভেনিসের অন্যান্য দালানের মতোই এটি একটি পুরনো দালান। ‘জেরভাসুতি ফাউন্ডেশন’ মূলত ওই এলাকার কমিউনিটির জায়গা। কয়েকটি খণ্ডে এটি বিস্তৃত। আমরা যে-খণ্ডটিতে আছি সেটি একটি বয়স্ক মহিলাদের থাকার জায়গা ছিল। ছোট দোতলা দালান, যা অনেকগুলো নানান আকারের ঘর নিয়ে নির্মিত। একদম ওপরে একটি এটিক (attic)-ও রয়েছে। দেয়ালগুলো নোনা ধরা এবং এর অনেক ঘরই ব্যবহারিক কাজে সম্ভবত নিয়োজিত ছিল, যে-কারণে এতে পুরনো ফায়ারপ্লেস, চিমনি, সিংক ইত্যাদি চোখে পড়বে। আমরা প্রথম দিকে অনভ্যস্ততার কারণে খানিকটা দমে গেলেও বিপুল উদ্যমে কাজ শুরু করে দিই পৌঁছানোর তিন-চার দিন পর থেকেই। দোতলার পেছন দিকটায় একটা চমৎকার খোলা ছাদ রয়েছে, যা হয়ে যায় আমাদের খাওয়া আর বিশ্রামের স্থল। ভেনিসে প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি জিনিস পাওয়ার তেমন কোনো সহজ উপায় নেই। অনেক দোকানের সমারোহ, কিন্তু তার সবই বলা যায় ট্যুরিস্টদের জন্য সাজানো। আমাদের প্যাভিলিয়নের ঠিক পাশেই ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিসের একটি অনেক বড় স্টোর থাকায় আমরা অনেকখানি ঝামেলামুক্ত ছিলাম, যদিও সেখানে প্রতিটি জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। বড় কোনো প্রয়োজনে আমরা ছুটে যেতাম ‘মেস্ত্রে’তে। সেখানে নিমল এবং তার ভাইয়েরা হতো আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। এই ছুটোছুটির দায়িত্বটা নিতে হলো আমাকেই। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাজগুলো স্থাপনার এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের দুই কিউরেটরেরই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে আমরা সবাই মাহ্বুবের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠলাম। তাঁকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করল পুলক ও পিপলু। মাসুমের কাজ ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও জটিল। আর তাই সে তার নিজের কাজ নিয়ে তখন ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হলো।

প্যাভিলিয়নের একেবারে বাইরের অংশটিতে মাসুমের অসংখ্য ছাতা দিয়ে নির্মিত ‘রেইনবো’ শীর্ষক কাজটি স্থাপন করা হলো। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে ঢোকার আগেই সবার আগে এ-কাজটি চোখে পড়বে। এরপর আমরা দালানের ভেতরে ঢুকে যাব। তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহৃত ছোট জায়গাটি ফেলে আরো একটি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেই কানে আসবে মাহ্বুবের করা শূকরের আর্তনাদের শব্দ। ‘আই ওয়াজ টোল্ড টু সে ওয়ার্ড’ শীর্ষক এই কাজটির একটি অংশ ঠিক বাঁদিকে সিঁড়ির নিচের ছোট্ট কুঠুরিতে দেখা যাবে। খাঁচায় রাখা গরু ও ছাগলের চামড়ায় আবৃত শূকরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ‘মা’ শব্দটি, নিয়নের আলোতে। আলোছায়ার একটা স্বপ্নময় পরিবেশ সেখানে। সামনে আরো এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে খাঁচার বাইরে নিয়ন-সংযুক্ত আরেকটি শূকর। তার ঠিক সঙ্গের ঘরটিতে কাঁটাতারে নির্মিত বড় বড় খাঁচায় বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত কয়েক সারি শূকর। পুরনো ইটের দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে এই ঘরগুলো যেন সত্যিকারের শূকরেরই আস্তাবল। নয়টি ছোট স্পিকারে এখান থেকেই নির্মগন হচ্ছে শূকরকে নিধন করার সময়ের আর্তনাদ।

মাসুম ও মাহ্বুবকে ফেলে সরু কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময়ই ডানদিকের ঘরটি চোখে পড়বে। প্রথম ঘরটিতে আমাদের দুই চ্যানেলে প্রদর্শিত ‘আই ওয়েড মাইসেলফ’ ভিডিওটি। ঘরটির একদিকে একটি জিনিসপত্র ধোয়ার সিংকও রয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবেই এই অবাঞ্ছিত অংশগুলোকে আমরা লুকাতে চাইনি। এই সিংক, চিমনি, ফায়ারপ্লেস সবই এই দালানটির বহু পুরনো বাস্তবতা, ভেনিসের ইতিহাসের সত্যতা, যা সঙ্গে করে নিয়েই আমরা আমাদের কাজগুলোকে উপস্থাপন করতে আগ্রহী ছিলাম। তাই শুধুমাত্র শিল্পকর্মের খাতিরে যতটুকু প্রয়োজন, দালানের চরিত্রের সঙ্গে ততটুকু সমঝোতাই আমরা করেছি।

আমার ধাতুনির্মিত অন্তর্বাসের কাজ ‘বিজার অ্যান্ড দ্য বিউটিফুল’ ঠিক পাশের ছোট একটি ঘরে স্থাপন করা হলো। এই কাজটি উপস্থাপনার বাহ্যিক দিকটির প্রয়োজনেই এই ঘরটিকে খানিকটা পরিচ্ছন্ন সাদা রঙে রঞ্জিত করার চেষ্টা আমরা করেছি, যদিও পুরনো পলেস্তারায় রং দীর্ঘদিন টিকে থাকার তেমন কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আমার অংশটুকু থেকে বেরিয়ে হাতের ঠিক বাঁদিকে একটি ছোট ঘরে রাখা হয়েছে পুলকের আটটি ডিজিটাল কাজ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কিছু বিখ্যাত পুরনো আলোকচিত্রের প্রত্যেকটি চরিত্রে ফটোশপে কাজ করে পুলক নিজেকে উপস্থাপন করছে তার ‘ইকোড মোমেন্টস্ ইন টাইম’ কাজটিতে। পুলকের ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলেই মাসুমের আর একটি শিল্পকর্ম চোখে পড়বে। একশটি মূল ড্রইংয়ের সঙ্গে তার এক মিনিটের অ্যানিমেশন চলছে এই ঘরে। দেয়ালজুড়ে তার ছোট ড্রইংগুলো ঝোলানো। ঘরের বড় একটি চিমনি থেকে ঝুলছে প্রজেক্টর, যা থেকে ঘরের এক কোনায় অনেক ড্রইংয়ের মাঝে ছোট আকারে মেডুসার ভাবনা নিয়ে নির্মিত তার অ্যানিমেশন ‘কোয়ান্ডারি’ প্রদর্শিত হচ্ছে। মাসুমের পাশাপাশি একটি বড় এবং একটি ছোট ঘর নিয়ে পিপলুর ‘ইউটোপিয়ান মিউজিয়াম’ কাজটি স্থাপন করা হয়েছে। দেয়ালজুড়ে ফসিল-সদৃশ হাড় দিয়ে নির্মিত যুদ্ধাস্ত্রের ডিজিটাল উপস্থাপন দুই ঘরেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চারটি ত্রিমাত্রিক ফসিল, যা গ্লাস ফাইবার ও সিমেন্ট দিয়ে নির্মিত। দুটো ঘরকেই পিপলু নৃতাত্ত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। একটা ছোট্ট গল্প এখানে করে নেওয়া যায়। আমরা যখন ভেনিসে অবস্থান করছি, শুরুর দিকেই দর্শকের ঢলে যখন প্যাভিলিয়নটি পরিপূর্ণ, মাসুমের ঘরের মেঝে অনেকখানি নিচের দিকে দেবে যায়, একটি ফোকরও তৈরি হয়। যার ফলে প্রায় সাতদিন দর্শকের প্রবেশ নিষেধ ছিল বিশেষ করে ওই নির্দিষ্ট ঘরটিতে। দর্শকের দূর থেকে দেখার অনুমতি ছিল শুধু। ‘জেরভাসুতি ফাউন্ডেশন’ নতুন করে ওই অংশটি ঠিক করার আগ পর্যন্ত এই নিয়ম কার্যকর ছিল।

দেশ থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই ক্যাটালগের ডিজাইন শেষ করে ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’কে আমরা তুলে দিই মুদ্রণের জন্য। লেখার সমস্ত সম্পাদনা শেষে সেগুলো পুনঃস্থাপনের দায়িত্ব দিয়ে এবং পুরো ক্যাটালগটি মুদ্রণ উপযোগী চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়া পর্যন্ত রুশো কাজ করে গেল। মুদ্রণের সময়ে সার্বক্ষণিকভাবে উপস্থিত ছিল রিপন। অনেকদিনের পরিশ্রমে এবং মাহ্বুব, পিপলু ও রুশোর সম্মিলিত সমন্বয়ে করা ক্যাটালগটি ছাপা হওয়া পর্যন্ত আমরা ভেনিসে গিয়েও অনেক সংশয়ে থাকলাম, যদিও জানি ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ শেষ অবধি এর পূর্ণ তত্ত্বাবধান করবে।

ভেনিসে রওনা হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে থেকে ভূতেরগলিতে আমাদের বাসা বৃত্তের একটি শাখা অফিসে পরিণত হয়েছিল। কয়েকটি কম্পিউটারে রাত-দিন জেগে সর্বক্ষণ কাজ চলেছে ক্যাটালগ, পোস্টার, ব্যানার, ব্যাগ, টি-শার্ট, টোটেম, কার্ড, খাম ইত্যাদির। মাহ্বুব, শাওন, রুশো এবং আমি প্রায় নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম কয়েকটি রাত। আমাদের সঙ্গে অফিসের ফাঁকে ফাঁকে সময় ও সুযোগ পেলেই চলে আসত পিপলু।

বিয়েনাল সংক্রান্ত যে-কোনো কিছুই মুদ্রণের আগে বিয়েনাল অফিস থেকে অনুমোদন নিতে হয়। ব্যানার বা টোটেম আমরা কীভাবে স্থাপন করব তার নক্শা এবং ব্যবহৃত উপাদান অনেক আগেই পাঠাতে হয়েছিল অনুমোদনের জন্য। পোস্টার যত্রতত্র লাগানোর কোনো অনুমতি সেখানে নেই। সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে দিন হিসাবে ভাড়া করে পোস্টার লাগানো যায়। নিজেদের ঐতিহ্যকে আগলে রেখেছে সেখানকার মানুষজন। প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়ে রয়েছে আইনানুগ ব্যবস্থা। বিয়েনালের জন্য ব্যবহৃত যে-কোনো দালানকোঠা পরীক্ষা করে ব্যবহারযোগ্য কি না তা অনুমোদনের জন্য রয়েছে আরেকটি বিভাগ। তারা প্যাভিলিয়নের নাম-ঠিকানা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পর্যবেক্ষণ করে দেখে যায়, সেগুলো প্রদর্শনীর জন্য কতখানি ব্যবহার উপযোগী।

একটানা কাজ করে আমরা একটা পর্যায়ে চলে এসে ছোট জটিল কাজগুলোর দিকে হাত বাড়ালাম মে মাসের শেষ দিকে। ৩ জুন সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের প্যাভিলিয়নের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। কিন্তু ২৯ মে থেকেই শুরু হলো মানুষের আনাগোনা। দর্শকের ভিড়ে হিমশিম অবস্থায় আমরা। কাজ কিছুতেই এগোনো যায় না। এরা সবাই বিয়েনালের আমন্ত্রিত অতিথি। সারা বিশ্বের শিল্পরসিকদের মহাসম্মেলন চলে এ-সময়টাতে। ৩০ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সব প্যাভিলিয়ন উন্মুক্ত ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য, বিশেষ করে মূল দুই প্রদর্শনস্থলের বাইরের স্থানগুলো। মূলত ১ থেকে ৩ জুন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা রইল সাংবাদিক, সংগ্রাহক, কমিশনার, কিউরেটর, শিল্পী ও মিউজিয়ামের লোকজনের জন্য। আমাদের ছোট প্যাভিলিয়ন হয়ে উঠল লোকের ভিড়ে ব্যস্ত ও মুখরিত। এই তিন-চারদিন নানান প্যাভিলিয়ন এবং প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাল। সে এক উৎসবমুখর পরিবেশ চারদিকে। শিল্পরসিকদের বিশাল ঢল অবলোকন করলাম আমরা। আগ্রহীদের বহুজনই এসেছেন সংবাদমাধ্যম থেকে। বিশ্বের নামকরা বহু সংবাদ সংস্থা সাক্ষাৎকার নিল আমাদের। দূরালাপনীতেও অনেক সাক্ষাৎকারপর্বে অংশ নিতে হলো। প্রথমবারের মতো এই ধরনের সমুদ্রসম বিশাল অভিজ্ঞতায় আমরা হয়ে উঠলাম শিহরিত, আনন্দিত ও চমৎকৃত। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত ও বাংলাদেশের এই প্রথম জাতীয়ভাবে পদার্পণ বিশ্বশিল্পের ইতিহাসের একটি বড় অংশ হয়ে দাঁড়াল। ৪ জুন থেকে সাধারণ দর্শকের জন্য খুলে দেওয়া হলো বিয়েনালের দ্বার।

আমাদের রাষ্ট্রদূত মাসুদভাই রোম থেকে ছোটখাটো একটি দল নিয়ে চলে এলেন ভেনিসে। কায়েসভাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরো দুজন পরিচালকসহ ঢাকা থেকে এলেন। এদের সবার আগে এসে পৌঁছালেন সুবীরদা। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন ডেইলি স্টারের সাংবাদিক তাকির হোসেনকে। আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি আমরা ইচ্ছে করেই করলাম দরজার ঠিক সামনে পানির ওপরে অবস্থিত ছোট সেতুটির ওপর। মাসুম তার বেঁচে যাওয়া ছাতার অনেকগুলো ছড়িয়ে দিলো সেতুটির ওপরেও। রিকশায় ব্যবহৃত ছোট প্লাস্টিকের ফুল ও ঝালরে সজ্জিত হলো আমাদের পুরনো কাঠের সদর দরজাটি। এভাবে হয়ে উঠল সবকিছু উৎসবমুখর। দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মাইনুল ভাইয়ের প্রচেষ্টায় ভেনিসের বাঙালি ভাবিরা তৈরি করলেন বাংলাদেশের সব মজার খাবার। স্পার্কল ওয়াইন আর বাংলা খাবার খেয়ে দর্শকরা তৃপ্ত হলেন। অসংখ্য দর্শকের পদচারণায় মুখরিত হলো আমাদের প্যাভিলিয়নটি। ‘জেরভাসুতি ফাউন্ডেশন’ আমাদের জন্য আয়োজন করল ‘বাংলা রাতে’র। এতে প্রায় তিনটি দল গান গেয়ে শোনাল, চল্লিশ বছর আগে যুদ্ধের সময় সহযোগিতার জন্য জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলন প্রমুখ যে-গান গেয়েছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক আয়োজনটিতে। আমরা সকলে বিশেষ করে পিপলু গেয়ে শোনাল আজম খানের ‘বাংলাদেশ’  গানটি। পরদিনই খবর জানলাম আজম খানের জীবনাবসানের।

৩ জুন পর্যন্ত যেহেতু প্যাভিলিয়নগুলো আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত, আমরা চেষ্টা করেছিলাম সেসব জায়গা দেখে শেষ করতে, যেগুলোতে টিকেটের প্রয়োজন রয়েছে। ৪ জুন থেকে জার্দিনি ও আর্সেনালের জন্য টিকেট লাগবে, যদিও বেশিরভাগ প্যাভিলিয়নে ঢোকার জন্য কোনো টিকেটের দরকার হয় না। এক সপ্তাহ ঘুরে ঘুরে আমরা সব মিলিয়ে বিয়েনালের প্রায় সত্তর ভাগ দেখে ফেললাম। বাকি তিরিশ ভাগ আর দেখা হয়ে উঠল না। নানাভাবে উপস্থাপিত কত বিচিত্র আয়োজন চোখে পড়ল। আমাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলল। মনে হলো আয়োজনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে এবং তা নানাভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের ধারণাগুলোও খুব একটা পিছিয়ে নেই। লোকবল ও অর্থবল পর্যাপ্ত হলে আমরা আমাদের চিন্তাগুলোকে আরো পরিস্ফুটিত করতে হয়তোবা সমর্থ হতাম।

ভেনিসের কেন্দ্রস্থলে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ অবস্থান করা, নানা বর্ণের, গোত্রের মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করা, আয়োজনের ব্যাপকতাকে নিয়ত অনুভব করা আর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলোকে দেখার এই অভিজ্ঞতা আমাদের বাকি জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। সারাদিন প্যাভিলিয়নের ব্যস্ততার পর আমরা সমুদ্রপারে চলে যেতাম, যা আমাদের আবাসস্থল থেকে মাত্র দুই মিনিটের পথ ছিল। গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিদিন সমুদ্রপারে আমাদের পাঁচজনের অফুরন্ত আনন্দ-উৎসব চলত, মাঝে মাঝে যোগ দিত অন্যান্য প্যাভিলিয়নের শিল্পী বন্ধুরা। আমি, পিপলু ও পুলক কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে উঠলেও মাসুম আর মাহ্বুব ছিল এ ব্যাপারে পুরোপুরি আগুয়ান। সারারাত সমুদ্রপারে রাতের ভেনিস উপভোগ করে কখনো কখনো ভোরবেলাতেও তারা দুজন ঘরে ফিরেছে। তাদেরকে কখনই আমরা ক্লান্ত হতে দেখিনি।

বিয়েনালের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি বর্ণনা করতে হলে প্রয়োজন আরো বড় পরিসরের। নানা ধরনের কাজের যে-অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি তার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা স্বল্পপরিসরে একেবারেই অসম্ভব।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন নিয়ে এখনো মানুষের আগ্রহের প্রতিফলন আমরা পেয়ে চলেছি। ফিয়োনা বিজ্জিয়েরো প্রতিনিয়ত জানিয়ে চলেছেন কত লোকের আগমন ঘটছে সেখানে এবং কত রকমের শিল্পবোদ্ধা তাঁদের মতামত জ্ঞাপন করছেন। দুজন তরুণ ইতালীয় কাস্টোডিয়ান এখন প্যাভিলিয়ন দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করছেন। ২৭ নভেম্বর শেষ হয়ে যাবে শিল্পের এই সর্ববৃহৎ মিলনমেলা। শেষ সময়ের অভিজ্ঞতাটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অন্যরকম হবে।

Leave a Reply