logo

ভাস্কর পিকাসো

হাসান ফেরদৌস

নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে ‘পিকাসো স্কাল্পচার’ দেখতে এসে প্রথম যে অনুভূতি হয় তা হলো, এই লোকটা আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছে না তো?

তাঁর দ্বিমাত্রিক ছবিতে কমিক উপাদান যে নেই তা নয়, কিন্তু সেখানে তিনি মুখ্যত এমন একজন চিত্রকর, যিনি নিজেকে অনবরত আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার করছেন, ফলে তাঁর প্রতি কৌতূহল ও বিস্ময় আমাদের অনুসরণ করে। ক্রিশ্চিয়ান জেরভোস যাকে বলেছেন ‘কম্পালসিভ ইনভেন্টর’, যার কেন্দ্রে মানুষ ও তার অন্তর্গত ব্যক্তিজীবন, চিত্রকর পিকাসো সেই রকম অনবরত পরিবর্তনশীল অথচ অমত্মর্গতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ একজন শিল্পী। দ্বিমাত্রিক ছবিতে পিকাসোর উদ্ভাবনী ক্ষমতা আমাদের সত্মম্ভিত করে, কিন্তু তা কখনো ঠাট্টা বলে প্রতীয়মান হয়, সেকথা বলা যাবে না।

একথার অর্থ এই নয় যে, পিকাসোর ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যসমূহ চিমত্মার উদ্রেক করে না, তবে তাতে চিমত্মার চেয়ে কৌতুকের উপাদানটাই প্রধান। মোমার ‘স্কাল্পচার’ প্রদর্শনীতে পিকাসোকে দেখে আমার সেকথাই মনে হয়েছে। আমি যেদিন প্রদর্শনীটি দেখতে যাই, সেদিন একদল শিশুকে দেখেছিলাম, অভিভাবকদের সঙ্গে তারা সহাস্যে ও মহা আগ্রহে এক শিল্পবস্ত্ত থেকে অন্য শিল্পবস্ত্ত দেখতে ছুটোছুটি করছে। সেসব শিল্পবস্ত্তর কোনোটি বন্য ষাঁড়, শস্নথগতির ছাগল, বোকা চোখে তাকিয়ে থাকা পেঁচা অথবা ফুল গোঁজা জলপাত্র। এসব ছবি থেকে আনন্দ পাওয়ার উপকরণ আমাদের চেয়ে তারা খুব যে কম কিছু পেল, তাদের খিলখিল হাসি শুনে আমার তা মোটেই মনে হয়নি।

পাশাপাশি সংযুক্ত ছয়টি প্রশস্ত কক্ষে প্রদর্শনীটি বিসত্মৃত, দেড়শোর মতো ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম তাতে অমত্মর্ভুক্ত হয়েছে। নামে ভাস্কর্য হলেও তার অনেকগুলো ঠিক আমাদের চেনাজানা ভাস্কর্য নয়। কাঠ, কাগজ, শিট মেটাল ও পস্নাস্টার তো রয়েছেই। নিত্যব্যবহার্য নানা জিনিস, যা ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়েছে, পিকাসো তাও কুড়িয়ে নিয়েছেন তাঁর চিত্রকর্মের উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। যেন মজার এক খেলা, এইভাবে সেইসব উপকরণ ভেঙে, ভাঁজ করে, একটার সঙ্গে আরেকটার মিশ্রণ ঘটিয়ে বিচিত্র সব সামগ্রী তিনি তৈরি করেছেন। সামগ্রী বলছি, কারণ কখনো কখনো তাদের এছাড়া অন্য আর কী নামে ডাকব, সে সংবিৎ আমাদের থাকে না। এর কোনো কোনোটা অপূর্ব, কোনো কোনোটা প্রথম দর্শনে হয়তো সাদামাটা, কিন্তু অভিনিবেশ নিয়ে দেখলে বুঝতে বাকি থাকে না যে শুধু খেলা নয়, পরিকল্পিত বিবেচনা কাজ করেছে প্রতিটি শিল্পকর্ম নির্মাণের পেছনে। তাদের সময়গত পরিচয় জানা থাকলে ও দ্বিমাত্রিক চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে বোঝা যায়, আসলে এর প্রতিটিই পিকাসোর তাবৎ শিল্পকর্মের অবিভাজ্য প্রকাশ, তাঁর শিল্পভাবনার অণু-পরমাণুর সঙ্গে জৈবিকভাবে অন্বিত। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক চিত্রের যে আঙ্গিকটি তিনি অনুসন্ধান করছিলেন, তার প্রথম প্রকাশ ঘটেছে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মে, নিরীক্ষা হিসেবে, অথবা নিজের কাছে ছুড়ে দেওয়া কোনো নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। জেরভোজের মমত্মব্য, ‘পিকাসোর জন্য কী চিত্রকর্ম নির্মিত হলো, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরম্নত্বপূর্ণ কীভাবে সে চিত্রকর্মের নির্মাণ শেষ হলো,’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তাঁর সেকথার অর্থ আমাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ হয়।

পিকাসোর তালিকাভুক্ত চিত্রকর্মের সংখ্যা মোটামুটি সাড়ে চার হাজার, কিন্তু ত্রিমাত্রিক চিত্রকর্মের সংখ্যা সঠিক এখনো নির্ণীত হয়নি। যে শদেড়েক কাজ মোমার প্রদর্শনীতে রয়েছে, মোমার কিউরেটর বলছেন, তাতে পিকাসোর সব উলেস্নখযোগ্য ত্রিমাত্রিক কাজই অমত্মর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

১৯৭৩ সালে পিকাসোর মৃত্যুর পর এটিই সম্ভবত তাঁর ত্রিমাত্রিক কাজের সবচেয়ে বৃহৎ ও গুরম্নত্বপূর্ণ প্রদর্শনী। মোমার নিজস্ব সংগ্রহ তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সারাবিশ্ব থেকে চষে আনা পিকাসোর সেরা কাজগুলো। এতে প্যারিসের পিকাসো মিউজিয়াম সহযোগী হিসেবে হাত লাগিয়েছে, সে মিউজিয়ামের খ্যাতনামা কিউরেটর ভার্জিনি পারদ্রিসোত প্রদর্শনীটি বিষয়ভিত্তিক ও সময়ানুক্রমিক করতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেয়ালে ঝোলানোর বদলে প্রদর্শনী কক্ষের মেঝেতে পরিমিত ব্যবধানে শিল্পকর্মগুলো স্থাপিত হওয়ায় দর্শকদের পক্ষ প্রতিটি কাজ মুখোমুখি অথবা চারপাশ থেকে দেখা সম্ভব হয়। এতে ছবির কারিগরি জটিলতা যেমন সহজে চোখে পড়ে, তেমনি ত্রিমাত্রিকতার ঘনত্ব পরিমাপ করা অনভিজ্ঞ দর্শকের জন্যও পরম বিস্ময়ের এক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। সময় ক্রমানুসারে সজ্জিত হওয়ায় অমত্মর্ভুক্ত শিল্পকর্ম থেকে পিকাসোর বিবর্তন – তাঁর ভাঙা-গড়া-ভাঙার নানা পর্যায়ক্রমিকতা অনুসরণও সহজ হয়ে ওঠে।

প্রথম ঘরটিতে, যেখানে ভাস্কর পিকাসোর প্রথম পর্যায়ের কাজগুলো সাজানো হয়েছে, তাতে প্রথমেই নজরে পড়ে ‘রমণীর মাথা’ নামের ভাস্কর্যটি। ১৯০৯ সালের এই ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যটি তাঁর কিউবিস্ট পিরিয়ডের কথা মনে করিয়ে দেয়। পিকাসোর সেই সময়ের প্রেমিকা ফেরনান্দে অলিভিয়ে এই ভাস্কর্যের মডেল হয়েছিলেন, কাজটি শুরম্ন করার আগে তাঁর অসংখ্য স্কেচ এঁকে শেষ করেছিলেন পিকাসো। এ এমন একসময়ের কথা, যখন পিকাসো আফ্রিকান কাঠ খোদাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন এবং নিজের ছবিতে তার বিভিন্ন উপাদান অমত্মর্ভুক্ত করা শুরম্ন করেছেন। যে জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য কিউবিজম পরিচিত, তার সকল লক্ষণই এই শিল্পকর্মে বর্তমান। মসত্মক ও মুখাবয়বটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত, অলিভিয়ের আয়ত চোখ ও চোখা চিবুক অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে তৈরি। এমনকি চুলের বিনুনি পর্যমত্ম সেই ভাগে ভাগে, জ্যামিতির হিসাব মেনে তৈরি। কাজটি স্পষ্টতই পরীক্ষামূলক, খুব যে দৃষ্টিনন্দন তাও নয়। বলাই বাহুল্য, প্রকৃত অলিভিয়ের সঙ্গে এই শিল্পকর্মের মিল খুব সামান্যই। বাসত্মবে অলিভিয়ে ছিলেন অতীব সুন্দরী, গুরুবক্ষা ও কামনাময়ী। সেই অলিভিয়েকে অবিকল নয়, তার একটি স্টাইলাইজড বিনির্মাণেই প্রধান আগ্রহ ছিল পিকাসোর, কোনো কোনো সমালোচক সে মমত্মব্যই করেছেন।

দ্বিতীয় কক্ষটি সম্পূর্ণ নিবেদিত পিকাসোর কিউবিস্ট পিরিয়ডের প্রতি। ‘রমণীর মাথা’ যদি কারো কাছে পুরোপুরি সন্তুষ্টিদায়ক না মনে হয়, তো এই কক্ষের ‘গিটার’ শিল্পকর্মটি তাঁর মন জোগাতে বাধ্য। এটি এমন একসময়ের কথা, যখন পিকাসো তাঁর কিউবিস্ট পিরিয়ডের চূড়ায় বসে, তিনি ও সতীর্থ কিউবিস্ট শিল্পীরা এক সম্পূর্ণ নতুন ধারার চিত্রকলা সূচনা করেছেন, যা আমাদের শিল্পের সম্ভাবনা বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। পিকাসো একটি নয়, এই সময়ে বেশ কয়েকটি গিটার নির্মাণ করেছিলেন, প্রস্ত্ততি হিসেবে অসংখ্য স্কেচও এঁকেছিলেন। সবচেয়ে পুরনো গিটারটি বানিয়েছিলেন কাগজ, পেপারবোর্ড ও তার দিয়ে। পরে ধাতুর পাত (শিট মেটাল) ও তার দিয়ে টেকসই যে গিটারটি তিনি বানান, প্রদর্শনীতে সেটিই স্থান পেয়েছে। এই গিটারের ভেতর দিয়েই পিকাসো ত্রিমাত্রিক শিল্পবস্ত্তর সম্ভাবনা আরো গভীরভাবে নিরীক্ষা শুরম্ন করেন।

কেউ কেউ এই ধাতব গিটারকে পিকাসোর সেরা কিউবিস্ট চিত্রকর্ম, দেমোজাএল দ’আভিনোর ন্যায় গুরম্নত্বপূর্ণ বলেছেন। প্রথম যখন পিকাসো তাঁর বন্ধুদের কাজটি দেখান, অনেকেই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, এটা আবার কী? দেয়ালে এটা ঝোলাবে কী করে? পিকাসোর জবাব ছিল, ‘এটা কিছুই না, এটা একটা el guiter!’ চিত্রসমালোচক ফ্রেড ক্লাইনার আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন যে, এই গিটারে পিকাসো তাঁর দর্শকদের শিল্পকর্মের পৃষ্ঠভাগ (সারফেস) এবং তার অভ্যমত্মর (ইন্টেরিয়র স্পেস), এই দুইয়ের কী পারস্পরিক সম্পর্ক তা খোলাসা করে দেখাতে গিয়ে সংযুক্ত বস্ত্তর ভর ও তার অভ্যমত্মরীণ শূন্যতার নৈকট্য প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিউবিস্ট দর্শন ও কলার সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ ছিল বস্ত্তর ভর ও অভ্যমত্মরীণ শূন্যতার এই ব্যবহার। ক্লাইনার আরো একটি উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আফ্রিকার মুখোশ কলার সঙ্গে পিকাসো আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন এবং তার নানাবিধ ব্যবহারে অভ্যসত্ম ছিলেন। এই গিটারে যে নলাকার ফাঁপা অংশটি রয়েছে, পিকাসো তা আহরণ করেছিলেন আইভরি কোস্টের মুখোশে চোখের স্থানে যেভাবে ফাঁকা রাখা হতো, সেখান থেকে। গঠনগতভাবে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও লোকজ মুখোশের গঠনরীতি নির্দ্বিধায় তিনি স্থানামত্মর করেছেন গিটারের মতো একটি আধুনিক বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে। পিকাসোর আগে এই রকম দুঃসাহসী নিরীক্ষা আর কেউ করেনি।

তৃতীয় ও চতুর্থ কক্ষ দুটি সম্পূর্ণ নিবেদিত পিকাসোর বন্ধু, কবি গিয়ম এপোলিনিয়রের প্রতি। এই ফরাসি কবিকে ‘কিউবিজম’ এবং ‘সুররিয়ালিজম’ – এই শব্দ দুটির উদ্ভাবক হিসেবে ধরা হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণের সময় তিনি আহত হন এবং ১৯১৮ সালে রোগভোগের পর মারা যান। পিকাসো আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তাঁর কবি বন্ধুর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করে একটি স্মারকসত্মম্ভের নকশা বানাতে। একটি সমতল পাটাতনের ওপর শুধু সরম্ন তার দ্বারা নির্মিত এই ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মটি প্রথম দর্শনে কিছুটা ধাঁধার সৃষ্টি করে। আসলে পিকাসো এখানে কী বলছেন? একটু দূরত্বে অবস্থান নিয়ে কাজটি দেখুন। বুঝতে বাকি থাকে না এখানে এক রমণী দোলনায় দুলছে। অথবা ঠিক দুলছে না, দোদুল্যমান সে রমণী স্থির, তার সঙ্গে স্থির সময় ও স্থান, তার কোনো ভর নেই, নেই কোনো পরিসর। নকশাটি গৃহীত হয়নি, কারণ এর গূঢ়ার্থ সত্মম্ভ নির্মাণ কমিটির সদস্যদের পক্ষে উদ্ধার সম্ভব হয়নি। ইঙ্গো ওয়ালথার আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন, এপোলিনিয়র তাঁর ‘মৃত কবি’ নামক কবিতায় নিজেই একটি স্মৃতিসত্মম্ভের বিবরণ দিয়ে গেছেন। সেখানে কবি ক্রনিয়ামামত্মালকে একজন ভাস্কর জিজ্ঞেস করেন, কবির জন্য কেমন স্মৃতিসত্মম্ভ তাঁর মনঃপূত হবে। জবাবে কবি বললেন, এমন এক সত্মম্ভ চাই যা হবে শূন্য থেকে প্রস্ত্তত, যেমন শূন্য কবিতা ও খ্যাতি। পিকাসো এপোলিনিয়রের সেই ইচ্ছা পূরণের জন্য নির্মাণ করেছিলেন একদম শূন্যে ‘সচল স্থগিত’ এই ভাস্কর্যটি।

পরবর্তী দুটি কক্ষ আমার কাছে ছিল এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে প্রিয়, এখানেই রাখা হয়েছে বোয়াসেলুতে ১৯৩০-৩২ এই প্রায় তিন বছর পিকাসো যে পাগলের মতো ভাস্কর্যে মেতেছিলেন, তার প্রমাণচিহ্ন। এটি এমন একসময় যখন প্রথম স্ত্রী ওলগার সঙ্গে তাঁর বিবাদ স্ক্যান্ডালে পরিণত হয়েছে এবং একই সঙ্গে মারি-তেরেস নামে এক কিশোরীর প্রেমে তিনি আমু-ু মগ্ন। প্যারিসের প্রায় ৪০ মাইল বাইরে বোয়াসেলুতে পিকাসো একটি অবসর নিবাস কিনেছিলেন ওলগা থেকে রেহাই পেতে এবং মারি-তেরেসের সঙ্গে নির্বিঘ্ন সময় কাটাতে। অনেকেই এ সময়কালকে পিকাসোর সবচেয়ে উর্বর ভাস্কর-সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সংখ্যার হিসাবে সেটি সঠিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্যের জন্য তার গুরম্নত্ব কোনো কোনো বোদ্ধা খাটো করে দেখেছেন। মারি-তেরেসকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে এখানে যে ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মগুলো সম্পন্ন করেন পিকাসো, তাদেরকে অনায়াসে আমাদের পরিচিত পস্নাস্টারভিত্তিক ভাস্কর্যের কথা মনে করায়। সম্ভবত সে কারণে আমাদের কাছে তার আবেদন অধিক। অন্য কারণ অবশ্যই মারি-তেরেস। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, যেভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে পিকাসো মারি-তেরেসের মুখাবয়বের বিকৃতি ঘটান, তাতে এই তরম্নণীর প্রতি ভালোবাসা নয়, বরং বিরক্তি ও অবসাদের প্রকাশ ঘটেছে। এইসব শিল্পকর্মে পিকাসো মারি-তেরেসের মুখ, তাঁর চোখ, নাক, চুল, গুরম্নবক্ষ ইত্যাদি নিয়ে এক বিচিত্র পরিহাসময়, কখনো কখনো ক্রূর ক্রীড়াময়তায় মেতে ওঠেন। এই সময়ের প্রধান দুটি কাজ ‘হেড অব এ ওম্যান’ ও ‘বাস্ট অব এ ওম্যান’ একই সঙ্গে তাঁর প্রেম ও ক্রূরতার প্রমাণবহ। মারি-তেরেস সুন্দরী ছিলেন, নবযৌবনা সে তরম্নণীকে পিকাসো প্যারিসের রাসত্মা থেকে প্রায় ছোঁ-মেরে তুলে এনেছিলেন গভীর কামজ আগ্রহে। অথচ তাঁকে মডেল করে যখন একের পর এক ভাস্কর্য নির্মাণ করলেন, তাতে মারি-তেরেস না সুন্দরী, না আছে তাঁর যৌবনের মাদকতা। ‘হেড অব এ ওম্যান’ ও ‘বাস্ট অব এ ওম্যান’ – এই দুই শিল্পকর্মেই মারি-তেরেসের বেঢপ নাক, পিকাসোর জীবনীকার জন রিচার্ডসনের তথ্যানুসারে, মারি-তেরেস নিজে ভীষণ অপছন্দ করতেন, পিকাসো তার মাত্রাতিরিক্ত গুরম্নত্ব দিয়েছেন। এই অভিযোগ হয়তো একদম অযৌক্তিক নয় যে, ‘হেড অব এ ওম্যানে’ পিকাসো সে নাককে মারি-তেরেসের সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে নয়, তাঁর নিজের শিশ্নের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে ‘বাস্ট অব এ ওম্যানে’ মারি-তেরেসের মুখটি আগের মতোই অসুন্দর, নাকটি অতি বেঢপ এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈসাদৃশ্য ও অতি লম্বা একটি ঘাড়, রিচার্ডসন যাকে পিকাসোর উপস্থ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

প্রদর্শনীর অবশিষ্ট কক্ষসমূহে পিকাসোর শেষ ২০ বছরের ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মের সংগ্রহ স্থান পেয়েছে। এই সময়ে নির্মিত অনেক শিল্পকর্মেই পিকাসোর ক্রীড়াপ্রিয় দিকটি প্রচ্ছন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য : ব্রোঞ্জের ‘মেয়ে-ছাগল’, খোদাই করা নুড়ি দিয়ে বানানো ‘খুদে পেঁচা’, বা রং করা কাঠ, কাঁটা-চামচ, পেরেক, স্ক্রু দিয়ে বানানো ‘পাখি’ ও পস্নাইউড এবং খেজুরগাছের ভাঙা ডাল, পেরেক ও স্ক্রু দিয়ে বানানো ‘ষাঁড়’। একটি বাগানে জল দেওয়ার পাত্র নিয়ে, তাতে টুকরো ধাতব উপকরণ, পেরেক ও কাঠ জোড়া দিয়ে এমন চমৎকার একটি ‘পুষ্পিত জলপাত্র’ বানিয়েছেন, তা দেখে তাক লেগে যায়। ১৯৬১ সালে, তখন পিকাসোর বয়স ৭০, শুধু এক টুকরো শিট মেটাল, তাকে পিটিয়ে তিনি এমন চমৎকার একখানা চেয়ার বানিয়েছেন, যা দেখে অনায়াসে নৃত্যরতা রমণীর কথা মনে পড়ে যায়। এই শিল্পকর্মগুলো দেখে পিকাসোকে একজন সমালোচক ‘শিশুদের জন্মদিনের উৎসবে এক বাজিকরে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঠিক ভাস্কর্য হিসেবে নয়, নিজের পুত্র-কন্যার খেলনা হিসেবে এর কোনো কোনোটা বানানো। এখন সেই শিশুতোষ খেলনা দেখে এই ভেবে অবাক মানতে হয় জীবনের শেষ দিন পর্যমত্ম কাতালনের এই অবাক-বাজিকর কীভাবে নিজেকে অনবরত ভেঙে ভেঙে গড়ে গেছেন।

তাঁর শেষ বয়সের এই শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য, প্রদর্শনীটির কিউরেটরদের ভাষায়, খুব সহজ, খুব সাধারণ। এত সাধারণ যে আমাদের মধ্যে কারো কারো মনে হতে পারে, এ আর এমন কী, আমিও পারি। n

৩ নভেম্বর ২০১৫, নিউইয়র্ক

 

[পিকাসো স্কাল্পচার, প্রদর্শনী, মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, নিউইয়র্ক, অক্টোবর ২০১৫-৭ ফেব্রম্নয়ারি ২০১৬]

Leave a Reply