logo

ভারতের এক মেয়েকে নিয়ে ছবি, কি বুঝব আমরা এটা বলে?

সুরভি শর্মা

ভূমিকা ও ভাষান্তর : ফৌজিয়া খান

২০১২ সাল, ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকায় তখন বিজয় দিবসের প্রাণময় আনুষ্ঠানিকতা শেষের পথে। ভারতের রাজধানী দিল্লি। ইভনিং শোতে ফিল্ম দেখে বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল ফিজিওথেরাপির ইন্টার্ন জ্যোতি। গণপরিবহন ভেবেই একটি বাসে ওঠে ওরা। বাসে লোকজনের তেমন ভিড় নেই – চালকসহ সাকল্যে চারজন। অকারণ ছুতোয় বাসের যুবকেরা জ্যোতির সঙ্গে ঝগড়া বাধায়। এই ঝগড়ার উসিলায় রাস্তায় চলন্ত বাসে ওরা চার বখাটে জ্যোতিকে নারকীয় নির্যাতন শেষে কাপড় খুলে নিয়ে বন্ধুসহ বাস থেকে ছুড়ে ফেলে। এক পথচারী তাদের দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ তাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরদিন খবরটি প্রকাশিত হলে ভারতসহ বিশ্বময় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের তাপে প্রশাসন ত্বরিত অপরাধী আটক করে। জ্যোতির চিকিৎসার দায়িত্ব নেয় ভারত সরকার। নির্মম অত্যাচারে আহত জ্যোতিকে অবশ্য বাঁচানো যায়নি।

এই ঘটনা নিয়ে লন্ডনভিত্তিক চলচ্চিত্রনির্মাতা লেসলি আডউইন ইন্ডিয়া’স ডটার নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। সহ-প্রযোজনায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন বিবিসি ওয়ার্ল্ড। ২০১৫ সালে বিশ্ব নারী দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ৯ মার্চ ছবিটি প্রচারের দিনক্ষণ ঠিক করে বিবিসি। পুরো ছবিটি প্রচারের আগে বিবিসি এর একটি প্রমোশনাল প্রচার করে। প্রমোশনালে অভিযুক্ত চার আসামির একজন মুকেশ শর্মার সাক্ষাৎকার ছিল। এই সাক্ষাৎকারে মুকেশ শর্মা নিজের অপরাধ নিয়ে অনুতাপ নয় – উল্টো ধর্ষণের জন্য নারীদেরকেই দায়ী করে বক্তব্য দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় হাইকোর্ট এই ছবির প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিবিসি তখন নির্ধারিত সময়সূচির একদিন আগে ৮ মার্চ, ২০১৫ তারিখে ভারত ছাড়া আর সব দেশে ছবিটি প্রচার করে। সেদিনই ইউটিউবেও ছবিটি আপলোড করে বিবিসি। ভারত সরকার ইউটিউবের ব্যবহারও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রামাণ্যচিত্রকারের নীতিবোধ, প্রামাণ্যচিত্রের সামাজিক দায়বদ্ধতা, নিষেধাজ্ঞা জারি, প্রামাণ্যচিত্রের পরিবেশনা, পশ্চিমের ঔপনিবেশিক মানসিকতা ইত্যাদি বিষয়ে নানা বিতর্ক চলতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প ও শিল্পীর পক্ষ থেকে ভারতের স্বাধীন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সুরভি শর্মাকে ইন্ডিয়া’স ডটার নিয়ে লেখার অনুরোধ করা হয়। তিনি ইংরেজি একটি লেখা পাঠান। তাঁর লেখাটি সামান্য সংক্ষেপ করে বাংলায় অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ফৌজিয়া খান।

 

 

১৬ ডিসেম্বর, ২০১২। দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাসে গণধর্ষণে ভয়াবহভাবে নির্যাতিত হয় এক তরুণী। খবরটি ভারতের সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পায়। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে মানুষ। শুধু ভারত নয়, বিশ্বময় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঘটনাটি ঘিরে লেসলি আডউইন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন, নাম দেন ইন্ডিয়া’স ডটার। ২০১৫ সালে প্রচারের পর থেকেই ইন্ডিয়া’স ডটার নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়।

‘বিপক্ষ’ এবং ‘প্রতিপক্ষ’ শব্দ দুটির মধ্যেই বিতর্কের ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে। আমরা যখন চটজলদি কোনো বিষয়ের এ-পক্ষ অথবা ও-পক্ষে কথা বলতে শুরু করি তখন পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিতে মূল বিষয়টা হারিয়ে যেতে থাকে। এই ঘটনা কোনো চলচ্চিত্রের বেলায় ঘটলে তো আর কথাই নেই; ছবিটির বিষয় ঘূর্ণি-আবর্তের তলায় তলিয়ে যায় – পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্কে উঠে আসে কীভাবে ছবিটি বানানো হয়েছে, কে বানিয়েছেন এবং এর মধ্য দিয়ে নির্মাতা আসলে কী করতে চেয়েছেন – ছবির আলোচনায় কিছুটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো।

লেসলি আডউইন পরিচালিত ইন্ডিয়া’স ডটারের ভাগ্যেও তা-ই ঘটেছে। ভারত সরকার ছবিটি প্রচার নিষিদ্ধ করেছে। সরকারের যুক্তি, এই ছবিতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে; এমন ঘটনা ঘটে সমাজে, তবে অস্বস্তিকর এসব বিষয় নিয়ে কথা কম বলাই ভালো। তবে আমার কাছে অবাক করা অস্বস্তিকর লেগেছে আমাদের শীর্ষ নারীবাদী এবং আইনজীবীদের অবস্থান। তাঁদের অনেকে মামলার রায় ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এই ছবির প্রচার স্থগিত করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

বিচারাধীন মামলা আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এর বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না – বিপজ্জনক এই যুক্তি কিন্তু আমাকে
অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এই যুক্তি মেনে নিলে গণহত্যা, দাঙ্গা কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা নিয়ে তো আমরা কথা বলতে পারব না। নানা জায়গায় নিয়মিতভাবে শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে – আদালতে বিচারাধীন এই যুক্তিতে তো সেসব বিষয়ে প্রতিবাদ না জানিয়ে নিশ্চুপ থাকার সুযোগ আমাদের আছে বলে মনে করি না।

ইন্ডিয়া’স ডটার প্রামাণ্যচিত্রে আসামিদের সাক্ষাৎকার আছে। এরা গণধর্ষণ এবং হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত। এই ছবি নিষিদ্ধ করতে নারীবাদী ও আইনজীবীদের দাবির মূল কারণ অভিযুক্ত আসামিদের সাক্ষাৎকার। তাদের যুক্তি, ‘ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ড’ – রাজপথে প্রতিবাদের এই দাবি আরো জোরালো হবে; ফলে ‘মুক্ত’ ও ‘স্বাধীন’ রায় দিতে বিচারকরা প্রভাবিত হবেন। তবে ছবিটি তৈরি বা প্রচার হওয়ার আগেই কিন্তু ‘ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদন্ডে’র দাবির পক্ষে জোর আওয়াজ উঠেছে। এই ধরনের অপরাধ বিচারের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই বিচারব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল। প্রামাণ্যচিত্র শক্তিশালী একটি মাধ্যম। নির্মাতা হিসেবে বিশ্বাস করি জনমত গঠনে বা প্রভাবিত করতে প্রামাণ্যচিত্র খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ইন্ডিয়া’স ডটার দেখে কখনোই মনে হয়নি যে এখানে চিত্রায়িত অভিযুক্ত আসামির সাক্ষাৎকার বিচারকদের প্রভাবিত করে রায় অন্যদিকে চালিত করবে।

নারীবাদী, আইনজীবীদের মতো চলচ্চিত্রকাররাও এই ছবির বিরোধিতা করেছেন। তবে রাজপথে নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সক্রিয় ছিলেন তাঁরা। লেসলি আডউইন জেলের ভেতরে অভিযুক্ত আসামির সাক্ষাৎকার ধারণ করেছেন। এই ছবিতে দর্শক টানার মতো সম্ভবত একমাত্র ‘মসলা’ অভিযুক্ত আসামির সাক্ষাৎকার। ভারতের চলচ্চিত্রকারদের অনেকেরই বিক্ষুব্ধ প্রশ্ন, লেসলি এই অনুমতি পেলেন কী করে। অভিযুক্ত আসামিরা কেন, কীভাবে এমন নৃশংস অপরাধে যুক্ত হয় – সে কথা জানবার প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের চলচ্চিত্রকাররা বলেননি। আলোচনার মূল বিষয় এটা হলেই ভালো। কিন্তু সবার কথাবার্তা পড়ে মনে হবে বিবিসির হয়ে লেসলি আডউইন ভারতের জেলে ঢুকে আসামির সাক্ষাৎকার ধারণ করেছেন, বিদেশি বলেই তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে আর আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা ক্ষুব্ধ শুধু এই কারণেই।

লেসলি আডউইনের সঙ্গে কাজ করেছেন যে ভারতীয় নির্মাতা – তাঁকে ধোঁকা দেবার বিষয়টাও ইন্ডিয়া’স ডটারের সমালোচনাকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের আলোচনায় উঠে এসেছে। এই ছবির পরিচয়লিপিতে (ক্রেডিট লাইনে) লেসলি ভারতীয় নির্মাতার অংশগ্রহণের বিষয়টি গায়েব করে দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় এই নির্মাতা প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি, তবে তাঁর নাম না-প্রকাশ করে তাঁর হয়ে আমাদের নির্মাতাদের অনেকে কথা বলেছেন।

যাদের কথা এতক্ষণ বলা হলো – তারা সবাই ছবিটির ‘বিপক্ষে’ বলেছেন।

তবে ছবিটির ‘পক্ষে’ও অনেকে কথা বলেছেন। পক্ষে বলিয়েদের যুক্তি মূলত ছবি নিয়ে। তাঁদের মতে, ছবিটি বস্ত্তনিষ্ঠ, তথ্যবহুল, সংবেদনশীলতার সঙ্গে নির্মিত। এই ছবিতে অভিযুক্ত আসামি বা ভিলেনকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি – আমার বিবেচনায়, পর্দায় অনেকটা সময়জুড়ে দেখিয়ে তাদের আসলে বোকাই বানানো হয়েছে। নায়কদের নিয়ে এই ছবিতে আতিশয্য নেই।

নির্মাতা বিদেশি – এটা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে চলচ্চিত্রের মানদন্ডে আমি ছবিটি বিবেচনা করার চেষ্টা করেছি। নির্মাতা দেশি বা বিদেশি তা কোনো ছবি সমালোচনার মূল বিষয় হতে পারে না। আমি ইন্ডিয়া’স ডটারকে বিবিসির অর্থায়নে নির্মিত একটি ছবি হিসেবেই দেখেছি। বিবিসি কী ধরনের ছবি প্রযোজনা করে সেটা তো এতদিনে আমাদের সবারই জানা হয়ে গেছে। নির্মাতা পশ্চিমের হোন কিংবা দক্ষিণ এশীয়, তাতে খুব কিছু হেরফের হয় না – ছবির চিত্রায়ণ এবং চলচ্চিত্রিক ভাষা ব্যবহারে বিশেষ একটা ধরন আছে তাদের। বিবিসি প্রযোজিত ছবিকে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির ভার বইতেই হবে। তবে এটাও বলা যাবে না সে ছবি জোরালো হবে না – হবে বর্ণবাদী, যার শিকড় প্রোথিত থাকবে ঔপনিবেশিক মানসিকতায়। চলচ্চিত্রিক ভাষার ব্যবহারে ইন্ডিয়া’স ডটার আপাত সরল হলেও বহুস্তরিক জটিল পঠনের সুযোগও করে দেয়। আর এ-কারণেই গড়পড়তা এই ছবিটি নিয়ে লিখতে আগ্রহী হই।

দ্য ফিল্ম ইজ স্যালো – খুব ওপরভাসা এই ছবি। কেন বলছি এই কথা? কারণ দিল্লিতে ঘটা ওই নৃশংস গণধর্ষণ এবং হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ভারতে পাশবিক সহিংসতার নমুনা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ঘৃণ্য ওই অপরাধের নৃশংস নির্মমতা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দর্শকের কাছে বর্ণনা করা হয়। আর সবকিছু বাদ দিয়ে বিষয় হিসেবে গণধর্ষণের এই ঘটনাটি বেছে নেওয়া হয়েছে; এর ফলে নারীর বিরুদ্ধে ক্রমশ বেড়ে চলা সহিংসতার চরিত্র এবং প্রতিবাদে অসংখ্য নারীবাদীর বিক্ষোভের রাজনীতি বুঝবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা এই ছবিতে পাওয়া যায় না।

অপরাধীরা এই ছবির মূল চরিত্র। এরা রাগী, গন্তব্যহীন গরিব ঘরের সন্তান – নিজের গোত্র বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অপরাধের শিকার মেয়েটি সম্ভাবনাময় – ফিজিওথেরাপিতে ইন্টার্ন করছে; আর্থিক দীনতা পেরিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। ছবিতে তার বন্ধু আর পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পাই – সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সহমর্মী, উদ্যোগী। তার স্বাবলম্বন অর্জনের এই যাত্রায় বাবা-মায়ের ছিল পূর্ণ সমর্থন। এই চলচ্চিত্রে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি চিত্রিত হয়েছে বাবা-মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রবল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান বাবা-মায়ের অপূরণীয় ক্ষতির কথা শুনি আমরা। অন্যদিকে অপরাধীদের বিধবা মা ও স্ত্রীর কথায় জানা যায়, একেবারে নিঃস্ব
প্রান্তিক মানুষ তারা। ছবিতে ওরা অপরাধপ্রবণ বর্বর, পশ্চাৎপদ মানসিকতার বাহক। বিবাদী আইনজীবীর কথার ভেতর দিয়ে পরিচালক ওদেরকে আরো স্পষ্ট করে চেনান আমাদের।

ছবিতে নিজেদের বৃত্তে আবদ্ধ দুই জগতের বাসিন্দা তারা – এপক্ষে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি ও তার পরিবার, ওপক্ষে ধর্ষক ও তাদের আইনজীবী। উদারমনা বনাম রক্ষণশীলদের প্রতিনিধি ওরা।

দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্রনির্মাতা আমি। লেসলির ছবিতে পরস্পরের মুখোমুখি দুই পক্ষের ভেতরে আমার বসবাস। দিনযাপনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ইন্ডিয়া’স ডটারের মুখোমুখি দুই পক্ষ বিচ্ছিন্ন নয় – বরং পরস্পর প্রতিনিয়ত একে অপরের সংস্পর্শে এমন ঘোঁট পাকিয়ে থাকে যে পুরোটার জট না খুলে সুতোর একটি মাথা যেমন খুঁজে পাওয়া কঠিন তেমনি কঠিন তাদের এভাবে পৃথক দুই গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের একরকম প্রকাশ আমার নির্মিত চলচ্চিত্র এবং নারীবাদ চর্চা। নিজের এই রাজনৈতিক দর্শন ইন্ডিয়া’স ডটারের মতো এমন সরল একরৈখিক বর্ণনার কোনো ছবি আমাকে বানাতে দেবে না, যেখানে ধর্ষক এবং ধর্ষিতর জগৎ এতটা বিচ্ছিন্ন।

যৌন সহিংসতাকে যেভাবে এই ছবিতে দেখা হয়েছে তাতে আবারো একে ‘ওপরভাসা’ না বলে পারছি না। দিল্লির বাসে ঘটা ওই ঘটনাটি ভীতিজনক, কারণ এটা ঘটেছে আমাদের ভাবনার সীমা ছাড়িয়ে। সিনেমা দেখে বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে গণপরিবহন ভেবে মেয়েটি বাসে উঠেছিল। কথাকাটাকাটির অজুহাতে ছেলেগুলো মেয়েটিকে ধর্ষণ, জখম করে। ওদের আক্রমণ থেকে বন্ধুটিও রক্ষা পায় না। বিবস্ত্র করে আহত দুজনকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাস নিয়ে চলে যায় ওরা। পাশবিক এই সহিংসতা ছিল আকস্মিক, ঝোঁকের বশে করা। নারীবাদীরা বলেন, ভারতে ঘটা বেশিরভাগ যৌন অপরাধ ঝোঁকের বশে করা নয়। আমাদের শীর্ষ নারীবাদীদের একজন ফ্লাবিয়া অ্যাগনেস সবসময় বলে আসছেন যে বেশিরভাগ যৌন অপরাধ ঘটে বাড়িতে, আত্মীয়-পরিজনরাই ঘটান সেসব অপকর্ম। পরিসংখ্যানের হিসাবে অপরিচিতদের হাতে ধর্ষণের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। গোত্র, ধর্ম, রাজনীতির নাম করে পরিকল্পিত যৌন সন্ত্রাস ঘটায় কিন্তু রাষ্ট্র এবং নারীর নিজ সম্প্রদায়ের ক্ষমতাসীন মানুষরাই।

বিশেষ একটি নাটকীয় ঘটনার শিকার মেয়েকে ‘ভারতকন্যা’ নাম দিয়ে বিষয়টি অনুধাবনে নিজেদের আগ্রহের ঘাটতিই প্রকাশ করেছে বিবিসি; বিবিসি আসলে ভারতকে ‘জানেন’ না যে দর্শক তিনিও যাতে একাত্ম হতে পারেন এমন নাটকীয় একটি ‘স্টোরি’র ব্যাপারেই আগ্রহী ছিল। এই ছবির নির্মাতা পক্ষ হয়তো বলবেন, ভারতে নারীবাদী আন্দোলনের অংশ হবার অনুমতি তাদের ছিল না। আর সম্ভবত এ কারণেই কবিতা কৃষ্ণার মতো গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টের কেবলমাত্র কথা বা ‘সাউন্ড বাইট’ ব্যবহার করেন নির্মাতা। ফলে নারকীয় সেই ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদের অাঁচ এই ছবিতে দর্শক পান খুবই কম। ওই দুর্ঘটনার পর পথে পথে প্রতিবাদের বন্যা বয়ে গেছে, মেয়েটির বিচার পাবার দাবি উঠেছে লাখো কণ্ঠে, ধর্ষণকারীর ফাঁসির দাবি রাজপথে জোরালো থেকে আরো তীব্র হয়েছে। সেইসব তীব্র জোরালো লাখো কণ্ঠের ভিড়ে কবিতা কৃষ্ণা অন্যরকম দাবি উচ্চারণ করেন – সব কথা পাশে রেখে প্রতিবাদমুখর অগণিত তরুণ-তরুণীর কণ্ঠে অনন্য হয়ে উঠতে শুরু করে কবিতার দাবি। কবিতা ‘আজাদি’ মানে স্বাধীনতার ডাক দেন। অবশ্য আক্ষরিকভাবে তাঁর ‘আজাদি’র ডাক ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না। ইউটিউবে আপলোড করা এক ভাষণে কবিতা কৃষ্ণা নারীর ‘আজাদি’ চান। ইউটিউবের ভাষণে বাড়ির বাইরে কাজে-অকাজে, যখন তখন পথে হেঁটে বেড়াতে, সিনেমা দেখতে, যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাক পরে যার সঙ্গে ইচ্ছে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে, যখন যেখানে যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের মতো জীবনযাপনে নারীর স্বাধীনতার দাবি জানান কবিতা। তাঁর এই দাবি প্রতিবাদমুখর তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যেন-বা জীবাণুর মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর দশ-পনেরো মিনিটের এই বক্তব্য দিল্লির ওই দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে নগরে, গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা কিংবা নারীর চলাফেরা নিয়ে চলতে থাকা বিতর্ক একেবারে পালটে দেয়। নিপীড়িত আহত মেয়েটির ন্যায়বিচার পাওয়া এবং ধর্ষকের ফাঁসির দাবি সমান গুরুত্বের সঙ্গেই রাজপথে জারি থাকলেও কবিতা কৃষ্ণার দাবি এই আন্দোলনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি সংযোজন। নারী স্বাধীনতা নিয়ে চলমান বিতর্ক তখন অন্য মাত্রা পায়।

ভারতের বিভিন্ন রাস্তায় প্রতিবাদমুখর তরুণীদের খুব শক্তিশালী দৃশ্য ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এই দৃশ্যগুলোর বর্ণনায় পরিচালক কবিতা কৃষ্ণার কণ্ঠ ব্যবহার করেছেন। না, নিজের কথা ব্যাখ্যা করার জন্য কবিতাকে ছবির পর্দায় জায়গা দেওয়া হয় না। ছবিতে অনস্ক্রিন কবিতাকে দর্শক দেখতে পান না। পরিবর্তে পান একজন ভারত ‘বিশেষজ্ঞকে’ – যিনি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে ভারত এবং এই আন্দোলন ব্যাখ্যা করেন লম্বা সময়। ছবি বানাতে গিয়ে অবজেকটিভ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতারা এমনটা করেন সচরাচর। ছবিতে বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন এমন বিশেষজ্ঞকে পর্দায় নিয়ে আসেন তারা। বিশেষজ্ঞের মুখে প্রকাশিত হয় ফিল্মে চিত্রায়িত মানুষের বিশ্বাস, যা কি না সেই মানুষ নিজেই বলতে পারত।

ইন্ডিয়া’স ডটার ছবিতে আমরা যে মানুষকে পাই তারা ধর্ষক। তবে এরাও নিজেদের পুরোপুরি প্রকাশের সুযোগ পায় না – বরং এমনভাবে তাদের কথা সম্পাদনা করা হয় যাতে জীবন সম্পর্কে এদের নির্মম নিস্পৃহতা ও নারী বিষয়ে এদের রক্ষণশীল পশ্চাৎপদ ধারণাই কেবল দর্শক জানতে পারেন। এমনকি আগে করা আরো নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে যাওয়ার কথা দর্শককে শোনাবার সুযোগও পরিচালক তাদের দিয়েছেন। সম্ভবত এ কারণেই নারীবাদী আইনজীবীরা ছবিটি নিষিদ্ধের দাবি করেছেন।

এই ছবিতে আরো যারা নিজেদের অশালীন ভাবনা পর্দায় উগরে দেবার সুযোগ পেয়েছেন তারা হলেন বিবাদীপক্ষের আইনজীবী। উনারা জানেন, ক্ষণিকের জন্য ক্যামেরায় কথা বলে খ্যাতির সুযোগ পেয়েছেন এবং তাদের কথায় আসলে বিচারের রায় হেরফের হবে না। আচমকা পাওয়া এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এরা এমন কথা বলেন যা শুনে আসলে আমাদের পেট গুলোবে। এরা যা বলেন তা মিথ্যে নয়। রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা কিংবা পরিচিত অনেকের মুখে এসব কথা ফতোয়া আকারে সবসময়ই আমাদের শুনতে হয় বৈকি!

ইন্ডিয়া’স ডটার অপ্রত্যাশিতভাবে মেয়েটির মা-বাবাকে পর্দায় যথেষ্ট জায়গা দিয়েছে। এই জায়গা দিয়ে নির্মাতারা অবশ্য ছবিটির বাণিজ্য যে বাড়াতে পারবেন তা নয়। ছবিতে দেখি, মৃত্যুর পর মেয়ের বাবা-মা সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলছেন। মেয়ের আসল নাম বলেছেন, নিজেদের পরিচয়ও গোপন করেননি তাঁরা। মেয়ের কথা জানাতে গিয়ে নিজেদের উদার আত্মমর্যাদার প্রকাশ করেন। আমরা জানতে পাই তাঁদের মেয়ে জ্যোতিকে – সে বড় হয়েছে নম্র, প্রগতিশীল মূলবোধসম্পন্ন পরিবেশে। নারীবাদীরা বহু বছর ধরে যা বলে আসছেন তা-ই অবলীলায় বলেন জ্যোতির আপাত সাধারণ মা-বাবা, ‘মেয়ের জন্য আমাদের কোনো লজ্জা নেই – লজ্জা তো তারা পাবে যারা অপরাধ করেছে।’ এমন জোরালো কথা তাঁরা অবলীলায় বলেন সচরাচর ধর্ষিতকেই যেখানে দোষী বলে সাব্যস্ত করা হয়।

একধরনের ছবি আছে যার গল্প শুরু এবং শেষ হয় ক্যামেরা অন করবার সঙ্গে সঙ্গে আগে থেকেই যার শেষটাও ঠিক করা থাকে। লেসলি আডউইনের ইন্ডিয়াস’ ডটার আসলে তেমনই একটি ছবি। আমরা বড়জোর একে টেলিভিশন প্রতিবেদন বলতে পারি; কারণ বিশেষ একটি লোকেশন এবং সেখানে উপস্থিত কয়েকজন মানুষের বহিরঙ্গের কথাই কেবল দর্শকের কাছে তুলে ধরেছে এই ছবি। আমরা যারা রাজনীতিসচেতন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা – আমরা এর উল্টো কাজটাই করার চেষ্টা করি। পর্দার ওপিঠে ছড়িয়ে থাকা বাস্তবতার নানা সূত্রকে যুক্ত, বিযুক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং একই সঙ্গে সংযুক্ত করে নানাভাবে তাকে বোঝার চেষ্টা করি; নির্মাণকালে অাঁকিবুকির এই কাজটা চলতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না গভীর জটিল অস্বচ্ছ বাস্তবতাকে আমরা জানতে, বুঝতে, অনুধাবন করতে সমর্থ হই।

আবার সেই ‘বিতর্ক’ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক – ইন্ডিয়া’স ডটরের প্রচার নিষিদ্ধ করা কি ঠিক হয়েছে? আমি বলব –  না, ঠিক হয়নি! এই নিষেধাজ্ঞা আসলে ছবিটিকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। অনেকেই ইন্টারনেট থেকে বিনে পয়সায় এটি ডাউনলোড করেছেন, সংগ্রহে রেখেছেন। ছবি সংগ্রহে রাখার পক্ষে আমি সবসময়; কিন্তু আরজি আমার একটাই – লেসলি আডউইন নির্মিত ইন্ডিয়া’স ডটার আমদের যে একরৈখিক ন্যারেটিভ দেয় এর বিপরীতে দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আমরা কী করতে চাই সেই প্রশ্ন করা যেন জারি রাখি সকলে। n

[ভাষান্তরে মূল লেখার বাক্যগঠন রীতি সবসময় অনুসরণ করা হয়নি।]

 

Leave a Reply