logo

ব্রিটিশ ভাস্কর ডেইম বারবারা হেপওয়ার্থ

সৈয়দ আবদুল ওয়াজেদ

 

ইংরেজ নারী শিল্পী ডেইম বারবারা হেপওয়ার্থ (১৯০৩-৭৫)। তাঁকে বিগত শতাব্দীতে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে ভাস্কর উপাধিতে সম্বোধন করা হয়েছে। এ বিষয়টি খুবই অবাক লাগে বিগত শতাব্দীতে হেপওয়ার্থ শিল্পতত্ত্ব আর শিল্পালোচনায় ব্যাপকভাবে অধিত-আলোচিত হয়েছেন। তথাপি একুশ শতকেও তাঁর প্রভাব-প্রসঙ্গ এতটুকুও মস্নান হয়নি।
অথচ একবিংশ শতাব্দীর প্রায় সিকি শতাব্দীকাল এখন অতিক্রান্ত হতে চলেছে। বরং হেপওয়ার্থের প্রভাব পাশ্চাত্যে তো বটেই, প্রাচ্যেও অবিশ্বাস্যভাবে প্রসারিত হয়ে চলেছে। বাংলাদেশেরও অনেক ভাস্কর হেপওয়ার্থের রীতির দ্বারা প্রাণিত-প্রভাবিত হয়ে নানা বিষয়ের ভাস্কর্য গড়েছেন। তাঁর রীতিটিকে মানদ- হিসেবে ধরে একুশ শতকেও বাংলাদেশের অনেক তরুণ ভাস্কর্য শিল্পীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলকভাবে কাজ করে যেতে দেখা যাচ্ছে। তিনি ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য অবয়বে ‘হোল’ বা শূন্য স্পেসের যে জাদু সৃষ্টি করেছিলেন তা ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরি মুরও অনুকরণ করেছিলেন।

হেপওয়ার্থ ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ বা ‘শিল্পসার’ ধারার শিল্পী বা ভাস্কর ছিলেন। এটা বলে রাখা ভালো যে, তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের ওয়েফিল্ড থেকে আসা মেয়ে, অর্থাৎ সেটা তাঁর জন্মস্থান। আবার এটাও দেখা যাচ্ছে, তার জীবদ্দশায় গত শতকে পৃথিবীর বুকে মানবজাতির মধ্যে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো তখন হেপওয়ার্থ মাত্র এগারো বছরের শিশু। সে বছর নির্মিত হয় বিশ্বখ্যাত চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রগুলো। তারও তিন বছর পর ১৯১৭ সালে সংঘটিত হয় রুশ বিপস্নব, এ সময় হেপওয়ার্থের বয়স মাত্র চৌদ্দ। ১৯০৩ সালে তাঁর জন্মের বছর, উইলবার রাইট এবং অরভিল রাইট ভ্রাতৃদ্বয় পৃথিবীতে প্রথম শক্তিচালিত ইঞ্জিন দিয়ে আকাশে বিমান ওড়ালেন।

মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় হেপওয়ার্থের চারুশিল্পবিষয়ক অধ্যয়নকাল শুরু ১৯২০ সালে, সতেরো বছর বয়স থেকে। শৈশব, কৈশোর, শিল্পশিক্ষাসহ নানামাত্রিক প্রস্ত্ততিতে তাঁর জীবনের প্রায় ত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়। তাঁর বাহাত্তর বছরের আয়ুষ্কালে সৃজনশীল শিল্পীজীবন ধরে নেওয়া যায় প্রায় বিয়ালিস্নশ বছর। তাঁর জীবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশকিছু অভিঘাত সম্পর্কে জানা যায়। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তাঁর বেশকিছু মূল্যবান ভাস্কর্য বিনষ্ট হয়, কিংবা চিরতরে হারিয়ে যায়। প্রচ- ঘটনাবহুল বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে।

১৯২০ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত হেপওয়ার্থের শিল্পশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সময়কাল কাটে ইংল্যান্ড এবং ইতালির রোম ও ফ্লোরেন্সে। ১৯২০ সালে তাঁর শিল্পশিক্ষার সূচনা হয় ইংল্যান্ডের লিডস স্কুল অব আর্টে। সেখান থেকে পা–ত্যভাতা (স্কলারশিপ) পেয়ে তিনি ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত শিল্পশিক্ষা নেন ইল্যাংন্ডের রয়েল কলেজ অব আর্টে। এরপর ওয়েস্ট রাইডিং স্কলারশিপ নামের পা–ত্যভাতা পেয়ে সেখান থেকে শিল্প অধ্যয়নে যান ইতালি। ইতালির ফ্লোরেন্স এবং রোম দুই জায়গাতেই চলে তাঁর অধ্যয়ন।

ফ্লোরেন্সে অবস্থানকালে সহপাঠী ভাস্কর জন স্কিপিংকে বিয়ে করেন। ১৯২৭ সালে ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এই শিল্পীযুগল সেন্ট জনস উড নামক স্থানে স্থাপিত তাঁদের ভাস্কর্য বা শিল্পসৃজনশালায় (স্টুডিও) আয়োজন করেন যৌথ প্রদর্শনী। এখানেই এ সময় ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যক্ষ রিচার্ড বেডফোর্ড তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন শিল্পসংগ্রাহক জর্জ ইয়োমোরফোপোলাসের সঙ্গে। রিচার্ড নিজেও ছিলেন একজন ভাস্কর। একই সময় হেপওয়ার্থের তক্ষণকৃত চারটি ভাস্কর্য বিক্রি হয়। এগুলোর অন্যতম একটির নাম ‘ডোভস’, এই ভাস্কর্যটিসহ সব ম্যানচেস্টার সিটি আর্ট গ্যালারিতে সংরক্ষণ করা হয়। পরের বছর এই শিল্পীদম্পতি যৌথ প্রদর্শনী করেন বিউক্স আর্টস গ্যালারিতে। তাঁরা নিজেরা উঠে আসেন হ্যাম্পস্টিড এলাকার পার্কহিল সড়কের আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণশালায়। সম্ভবত ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই শিল্পীদম্পতির দাম্পত্যজীবন টেকে।

১৯৩১ সালে হেপওয়ার্থ মিলিত হন চিত্রকর বেন নিকলসনের সঙ্গে। নিকলসন এ সময় হেপওয়ার্থের দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে তাঁর জীবনে আসেন। একই বছর হেপওয়ার্থ যোগ দেন ‘সেভেন অ্যান্ড ফাইভ সোসাইটি’ নামের একটি শিল্পীসংঘে। এই শিল্পীসংঘটিতে জড়িত শিল্পীরা, চিত্রকর বেন নিকলসন এবং ভাস্কর হেনরি মুরের প্রভাবে ক্রমোদ্দীপ্তভাবে ‘শিল্পসারাংশতা’য় (অ্যাবস্ট্রাকশন) উপনীত হচ্ছিলেন।

পার্কহিল সড়কের হ্যাম্পস্টিডে ভাস্কর্য বা শিল্পসৃজনশালায় হেপওয়ার্থের সঙ্গে ১৯৩০ সালে শিল্পী বেন নিকলসন এবং ভাস্কর হেনরি মুর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। এই তিনজন শিল্পীই ছিলেন সমসাময়িক। তাঁরা একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ অব আর্টে। এই সময়টায় অর্থাৎ ১৯৩০ সালে হেপওয়ার্থ এঁদের দুজনকে নিয়ে একটি স্বাধীন শিল্পধারার (এনক্লেইভ) সূচনা করেন, যা ক্রমেই সবার কাছে ইংল্যান্ডে শিল্পসারাংশ আন্দোলনের (অ্যাবস্ট্রাক্ট মুভমেন্ট) মূল কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এই শিল্পসারাংশতা রীতির কারণে এই তিনজনই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তাঁরা তিনজন একসঙ্গে স্বতন্ত্রধারার শিল্পী বিবেচিত হতে থাকেন তাঁদের সমসাময়িক অন্যান্য ব্রিটিশ শিল্পীসহ সবার কাছে। এটাকে হয়তো বলা যায় তিন শিল্পীর যূথবদ্ধ নিঃসঙ্গতা। কিন্তু তাঁরা শেষ অবধি কিছুতেই সরে আসেননি তাঁদের শিল্পের অ্যাবস্ট্রাকশন বা শিল্পসারাংশতার রীতি-বিশ্বাস থেকে।

১৯৩২ সাল। হেপওয়ার্থ এবং বেন নিকলসন দুজনেই ফ্রান্সে গেলেন। সেখানে তাঁরা মিলিত হলেন ব্র্যাক, ব্রাঙ্কুইজি, পিকাসো, মন্দ্রিয়ানসহ ইয়োরোপীয় শীর্ষস্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে। যাঁদের শিল্পের ফরাসি পরিভাষায় ডাকা হয়ে থাকে ‘আভাঁ গার্দ’। অর্থাৎ সৃজন-সৌকর্যে সমসাময়িক এবং প্রচলিত শিল্পধারার অনুসারীদের চেয়ে যারা মৌলিক ও অগ্রসর, তাঁরাই হলেন আভাঁ গার্দ। এ বছরই হেপওয়ার্থ যৌথ প্রদর্শনী করলেন বেন নিকলসনের সঙ্গে। টুথস গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীটি গভীরভাবে আকৃষ্ট করল বিখ্যাত শিল্পসমালোচক হার্বার্ট রিড এবং আর এইচ উইলেনস্কিকে। অগ্রসর শিল্পীদের নিয়ে শিল্পী পল ন্যাশ গঠিত শিল্পীসংঘ ‘ইউনিট ওয়ান’-এ দুজনই যোগ দিলেন ১৯৩৩ সালে।

১৯৩৪ সালের প্রায় শুরু থেকে ভাস্কর হেপওয়ার্থ নির্মাণবাদী শিল্পের রীতিকে (কনস্ট্রাক্টিভিস্ট প্রিন্সিপালস) ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করে অজৈবিক-জ্যামিতিক আকৃতির সারাংশ ভাস্কর্য (নন-অর্গানিক জিওমেট্রিক্যাল অ্যাবস্ট্রাক্ট কার্ভিংস) গড়লেন। এ রীতির উল্লেযোগ্য ভাস্কর্যগুলো হলো : ‘ডিসক্স ইন ইশেলন’ (দ্য মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, নিউইয়র্ক, ১৯৩৫), ‘টু সেগমেন্টস অ্যান্ড স্ফেয়ার’, এই ভাস্কর্যটি ১৯৩৬ সালে রেইড অ্যান্ড লেফেভরে গ্যালারিতে নিকোলেত্তি গ্রে আয়োজিত ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যান্ড কংক্রিট’ (সারাংশশিল্প ও নির্যাসশিল্প বা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের সমার্থক শব্দ বা পরিভাষা হিসেবে পাশ্চাত্যের শিল্পালোচনায় কখনো কখনো ‘কংক্রিট আর্ট’ এই শিল্প অভিধাটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলায় যাকে দীর্ঘকাল আভিধানিক সমর্থন ছাড়াই ভুলভাবে ‘বিমূর্ত শিল্প’ বলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ ব্যাপারে মাসিক শব্দঘর ভ্রমণসংখ্যা ২০১৭-তে প্রকাশিত শিল্পী আমিনুল ইসলামের ওপর লেখা আমার প্রবন্ধটিতে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আধুনিক শিল্প সাদৃশ্যাত্মক নাকি অসাদৃশ্যাত্মক, বাস্তববাদী নাকি ভাবপ্রসূত বা অধিচৈতন্যপ্রসূত, নাকি অভিনব রং, রেখা, তল, দাগ-ছোপ-ফোঁটা আকৃতির দ্বারা রচিত এটাই মুখ্য। পাশ্চাত্যে বিশ শতকজুড়ে তাই আঙ্গিকেরই নানা পরিবর্তন, আবির্ভাব ও যুগসন্ধিক্ষণ আমরা দেখি।
চিত্র-ভাস্কর্যে ‘রচনা’ শব্দটির ইংরেজি শিল্পপরিভাষা হচ্ছে ‘কম্পোজিশন’। এই কম্পোজিশনের আওতায় চিত্র-ভাস্কর্যে তাই চেনা-অচেনা বস্ত্ত বা অবয়ব থাকছেই নানা অভিব্যক্তিতে। প্রশ্ন হচ্ছে সেগুলো সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বা সুরচিত কিনা, দৃশ্যমান শিল্পের ফরম বা আকার-আকৃতিগুলো চেনাজগতের নাকি অচেনা অভিনব ভাবজগতের
শিরোনামের প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়; ‘পিয়ার্সড হেমিস্ফেয়ার’ ১ (ওয়েকফিল্ড সিটি আর্ট গ্যালারি, ১৯৩৭), ‘সিঙ্গল ফরম’ (ড্যাগ হ্যামারসকজোল্ড মিউজিয়াম, ব্যাকাকরা, সুইডেন, ১৯৩৭-৩৮)।

এবারে হেপওয়ার্থের ভাস্কর্যকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করা যাক। সেটি হলো ১৯৩১ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে হেপওয়ার্থের গড়া ‘পিয়ার্সড ফরম’ই হচ্ছে সেই ভাস্কর্য, যাতে ভাস্কর্যের ইতিহাসে প্রথম ‘হোল’ বা গর্ত ভাস্কর্যের শরীরে সৃষ্টি করা হয়। এটি হচ্ছে ত্রিমাত্রিক একটি অবয়বের ভেতর এক বা একাধিক ছন্দায়িত রেখায় সীমায়িত পরিলেখের ভেতর দিয়ে সংবৃত্তে কিংবা এফোঁড়-ওফোঁড় একটি বা একাধিক বস্নাংক স্পেস বা শূন্য-পরিসর সৃষ্টি করা। এই কাজটি তিনি করেন ইংল্যান্ডের মাটিতে। ভাস্কর্যটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই ভাস্কর্যে করা হেপওয়ার্থের এই ‘হোল’, যাকে অনেকে শূন্যপরিসরও বলেন, সেটাকে গ্রহণ-অনুসরণ করলেন সমসাময়িক ভাস্কর হেনরি মুর। ভাস্কর্যে এই নতুন প্রয়োগ কৌশলকে হেপওয়ার্থ এবং মুর তাঁদের স্ব-স্ব ভাস্কর্যের নতুন নতুন ভাস্কর্যায়িত আকৃতি আবিষ্কারের জন্য গুরুত্ব দিলেন। তাঁদের অভিনিবেশ থেকে বের হতে শুরু করল নব-উদ্ভাবিত ‘হোল’ বা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ‘গর্ত’ সমৃদ্ধ ভাস্কর্যময় আকৃতি (স্কালপচারাল ফরম)। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে হেপওয়ার্থ এবং মুর দুজনই কোনো ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে মডেলিংয়ের অর্থাৎ কাদামাটি, গলিত ধাতু দিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের রীতি অনুসরণ না করে সরাসরি তক্ষণ-খোদাই রীতিতে ভাস্কর্য গড়তে শুরু করেন। এই দশকে ডাইরেক্ট কার্ভিং বা সরাসরি তক্ষণ-খোদাইয়ে সৃজিত হেপওয়ার্থের উল্লেযোগ্যসংখ্যক ভাস্কর্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছোবলে ধ্বংস হয়েছে অথবা হারিয়ে গেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হেপওয়ার্থ এবং নিকলসন লন্ডন থেকে চলে আসেন ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালের সেন্ট ইভসে। সেখানে তাঁরা শিল্পীনিবাসী কেন্দ্র হিসেবে একটি শিল্পীপলস্নী গড়ে তোলেন।

১৯৪০ সাল থেকে হেপওয়ার্থের ভাস্কর্যে হোল বা খোদিত গর্ত শুধু এফোঁড়-ওফোঁড় হচ্ছে না, বরং একটি স্থানু আয়তনিক ভাস্কর্যের গর্তের ভেতর দিয়ে অন্যপাশের দৃশ্যমানতাকে দৃষ্টিগোচর করাচ্ছে। এই রীতিটি তাঁর হাতে ক্রমেই আরো জটিল ও সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের মাধ্যমে গভীর বোধসঞ্চারী হয়ে উঠতে থাকে। যখন তাঁর ভাস্কর্যের শরীরের এইসব হোল বা গর্ত তুলনামূলক বড় হতে শুরু করে, ঠিক তখন থেকেই তাঁর ভাস্কর্যে মসৃণবক্রতা এবং শঙ্খের ভেতরের পরিসরের মতো ঘূর্ণাবর্তগুলো প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এই রীতিটিই তাঁর ভাস্কর্যের ভেতরগত আকৃতিকে আরো সপ্রকাশিত করে তোলে। কখনো ভাস্কর্যকে হেপওয়ার্থ একটি বড় ছিদ্র করা পেলব গর্তসংবলিত নতুন ভঙ্গিতে গড়েছেন; কখনো বা কোনো ভাস্কর্যে একাধিক গর্ত বা হোল সৃষ্টি করে তাতে একাধিক কেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করেছেন; এই বিষয়টির দৃষ্টান্ত হচ্ছে তাঁর ভাস্কর্য ‘বাইসেন্ট্রিক ফরম ’ (টেইট গ্যালারি, ১৯৪৯)।

হেপওয়ার্থ ১৯৩৮ সালে তাঁর ভাস্কর্যের হোল বা গর্তের মুখে আড়াআড়িভাবে সমান্তরাল সমদূরত্ব রেখায় তন্ত্রীগুচ্ছ (স্ট্রিংস) বা ধাতব তারের ব্যবহার শুরু করেন। তবে সেটা ভাস্কর গ্যাবোর মতো করে নয়। গ্যাবো (১৮৯০-১৯৭৭) ইংল্যান্ডে অবস্থান করেন ১৯৩০ সালে। ‘নব গ্যাবো’ একই ধরনের তন্ত্রীগুচ্ছ বা সুবিন্যস্ত তার ভাস্কর্যে ব্যবহার করেছেন, খোলা স্থান বা ওপেন স্পেস এবং ট্রান্সপারেন্ট স্কালপচার বা ভাস্কর্যে স্বচ্ছতা বোঝানোর জন্য। অন্যদিকে হেপওয়ার্থ ভাস্কর্যের হোল বা গর্তের মুখে সুবিন্যস্ত তার বা তন্ত্রীগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন ভাস্কর্যের ঘন-বিসত্মৃত আয়তনের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি, কখনো বা ফরমের নানামাত্রিক তুঙ্গ পার্থক্যকে বোঝাতে, কখনো বা ভাস্কর্যের আয়তনের নানা ধরনের কনট্রাস্ট বা সংঘাতকে বোঝানোর জন্য। চিত্রকলায়, পাশাপাশি আলো ও ছায়ার প্রবল অবস্থানের কারণে যে দৃশ্যমান নাটকীয়তার সৃষ্টি হয় তাকেও আমরা শিল্পের পরিভাষায় বলি সংঘাত বা কনট্রাস্ট।

এই সময়টায় হেপওয়ার্থ ভাস্কর্যে রং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাঁর রং ব্যবহারের উদ্দেশ্যটার পেছনে ভাস্কর্য নির্মাণ-উপাদানের প্রাকৃতিক স্বাভাবিক রূপকে লুকানোর কোনো অভিপ্রায় ছিল না। আবার দুর্বোধ্যতা সৃষ্টির জন্যও তিনি রঙের প্রলেপ দেননি ভাস্কর্যের অবয়বে। তাঁর ভাস্কর্যের বহিরঙ্গের আকর্ষণকারী যে অভিব্যক্তি, সেটিকে জোরালো করার জন্যই তিনি ভাস্কর্যে রং প্রলেপন করেছেন। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত আদ্রিয়ান স্টোকেসের গ্রন্থ কালার অ্যান্ড ফরমের রং প্রলেপনের নির্দেশনাকে এক্ষেত্রে তিনি অনুসরণ করেছেন। ওই সময় হেপওয়ার্থের এসব নব-উদ্ভাবিত রীতিতে গড়া ভাস্কর্যের কয়েকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে : ‘টু ফিগারস’, (মিনেসোটা ইউনিভার্সিটি, মিনেপোলিস, ১৯৪৭-৪৮), ‘পেলাগোস’, (টেইট গ্যালারি, ১৯৪৬)।

নিজেকে এবং ভাস্কর্যকে নিয়ে হেপওয়ার্থ কিছু উল্লেযোগ্য কথাবার্তা বলেছেন। তার একটি হচ্ছে : ‘কোনোকিছুর ভেতরে বাঁকানো অবতলের রং আমাকে এমনভাবে ভেতরে টানে, যা কিনা কোনো কিছুকে পানির গভীরে ডোবানোর মতো, ছায়ার মধ্যে টেনে নেওয়ার মতো কিংবা অন্ধকার গুহায় প্রবিষ্ট করানোর মতো। এই নিমজ্জিত হওয়ার বিষয়টি তক্ষণ করা কোনো অবতলের ভেতরে টানার ক্ষমতার চেয়েও গভীরতর। (এ এম হ্যাম্যা শার)।

প্রকৃতিকে গভীর আবেগে শনাক্ত করার প্রচ- একটি ক্ষমতা হেপওয়ার্থ স্বভাবগতভাবেই পেয়েছিলেন। তাঁর এই সহজাত ক্ষমতা থেকে তিনি যে রূপ-রস আহরণ করেছেন তার প্রতিফলন তাঁর সৃজিত ভাস্কর্যে দেখা যায়। এ বিষয়টির কারণে বহু শিল্পসমালোচক বলতে পেরেছেন যে, হেপওয়ার্থের ভাস্কর্য হচ্ছে ইংল্যান্ডের রোমান্টিক নিসর্গচিত্রের ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত ভাস্কর্য-স্থাপনা গড়ার ক্ষেত্রে হেপওয়ার্থের প্রবল ক্ষমতা, প্রাকৃতিক নুড়িপাথর কিংবা বড় পাথরে তক্ষণ করা তার ভাস্কর্য ইত্যাদি গড়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রেরণার বিষয়টি কতটা দূর থেকে এসেছে, তা সহজে বলা যাবে না। প্রেরণা বলতে আরো গভীর কোনো উৎস কিংবা সাধারণ কোনো বিষয় তাঁকে আলোড়িত করে থাকতেই পারে। কিন্তু দৃশ্যমান সত্যটা হলো এই যে, গভীর অনুভূতির সঞ্চার ঘটাতে পারে এমন ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যময় আকার সৃজনের ক্ষমতা তাঁর ছিল। আর তার বিপরীতে প্রকৃতিকে আবেগমথিতভাবে, প্রকৃতির সর্বব্যাপী সারাংশসৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে কাঙিক্ষতকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা তাঁর নিশ্চয়ই ছিল। ভাস্কর্যে, প্রকৃতির সৌন্দর্যের সামগ্রিক অবলোকন হেপওয়ার্থের বৈশিষ্ট্য। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যকে তুলনা করতে গিয়ে শিল্পালোচকরা সর্বেশ্বরবাদ বা প্যানথেয়িজমের উপমার আশ্রয় নিয়েছেন। এটা খুবই জানা কথা, হেপওয়ার্থ প্রকৃতির সবকিছুকে ছুঁয়ে দেখতেন। একজন শিল্পীর জন্য দর্শনেন্দ্রিয়ের দূরত্ব গোছাতে কোনো কিছুকে স্পর্শ করা যে কত জরুরি, হেপওয়ার্থ তা দেখিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে শিল্পীকে ভুল বুঝবার কোনো কারণ নেই।

শিল্প বিষয়ে ‘ইউনিট ওয়ান’ শিল্পীসংঘের মুখপত্রে ১৯৩৪ সালে মুদ্রিত হেপওয়ার্থের কথাগুলো তাঁর শিল্পীসত্তা ও ভাস্কর্যকে বোঝার ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়তা হয়তো করবে। তিনি লিখেছেন : ‘In the contemplation of nature we are perpetually renewed, our sense of mystery and our imagination is kept alive, and rightly understood, it gives us power to project in to a plastic medium some universal or abstract vision of beauty.’ তাঁর ভাষ্যে যে সেন্টিমেন্ট বা শিল্পানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে, তা তাঁর সারাজীবনের কাজের ক্রম-অগ্রগতি ও ক্রম-বিকশিত উৎকর্ষের পরিচায়ক। তাঁর সমগ্রকে বুঝতে এই কয়টি কথাই যথেষ্ট।

১৯৫০ সালে ভেনিস দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের আমন্ত্রণে হেপওয়ার্থ সেখানে যান। ১৯৫১ সালে বেন নিকলসনের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যজীবনের ইতি ঘটে।

১৯৫৪ সালে তিনি গ্রিসে যান। জীবনের একটি টালমাটাল অধ্যায়ে তাঁর গ্রিসে অবস্থান লক্ষ করা যায়। কখনো কখনো কিছু কাজের নামকরণে গ্রিক ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন তিনি। যেমন : ‘করিন্থস’ (টেইট গ্যালারি,
১৯৪৪-৪৫), ‘কার্ভড ফরম (ডেলফি)’ (আলস্টার মিউজিয়াম, বেলফাস্ট, ১৯৫৫)। তাঁর কাজ এ সময় কখনো কখনো মনুমেন্টাল বা স্মারকাতিকৃতিক মাত্রা অর্জন করে। এগুলো তিনি হয় খোলা আকাশের নিচে নিসর্গে স্থাপনের জন্য অথবা কোনো স্থাপত্যিক সংলগ্নতায় বসানোর জন্য পরিকল্পনা করেন। পঞ্চাশের দশকে করা তাঁর এসব কাজ এবং এগুলোর অবস্থানের মধ্যে ছিল : ‘ফিগার (রিকুইয়েম)’ (আবেরডিন আর্ট গ্যালারি, ১৯৫৭), ‘ফিগার (আরকেয়ান)’ (রিজকসমাস, ক্রলার-ম্যুলার, অট্রেরলো, নেদারল্যান্ডস; স্টার্লিং ইউনিভার্সিটি; ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি; সেন্ট ক্যাথেরিন কলেজ, অক্সফোর্ড); ‘মেরিডিয়ান’ স্টেট হাউস, লন্ডন (১৯৫৮-৫৯); ‘সি ফরম (পোর্থমিয়র)’ (টেইট গ্যালারি); ইয়েল ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম, ব্রিটিশ কাউন্সিল; গেমিনটিমাস, দ্য হেগ  (১৯৫৮); ‘সিঙ্গল ফরম’, ড্যাগ হ্যামারসকজোল্ড মেমোরিয়াল, নিউইয়র্ক (১৯৬২-৬৩)। শেষের এই চারটি কাজই হেপওয়ার্থ ব্রোঞ্জ মাধ্যমে করেন, যদিও ১৯৩০ সাল থেকে তিনি ভাস্কর্য নির্মাণে সরাসরি তক্ষণ বা ডাইরেক্ট কার্ভিং রীতির পক্ষে বলিষ্ঠভাবে কথা বলে গেছেন। বলা যায়, বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে তিনি ব্রোঞ্জ মাধ্যমের দিকেই ঝুঁকেছেন। তবে তিনি মূল ভাস্কর্যের পস্নাস্টার কাস্টিংয়ের ওপর হাতে নানারকম সারফেস তৈরি করে তারপর সেটি ব্রোঞ্জ কাস্টিংয়ের মাধ্যমে ব্রে্র্র্র্র্র্র্র্রাঞ্জ-ভাস্কর্যে রূপান্তর করেছেন। তাঁর কিছু ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের মধ্যে, তাঁর পাথরে ও কাঠে সরাসরি তক্ষণের মাধ্যমে করা ‘হোল’ বা গর্ত তৈরির বিষয়টি এসে গেছে। এরকম দুটি ভাস্কর্য হচ্ছে : ‘এলেজি-৩’ (রিজকসমাস, ক্রলার-ম্যুলার, ১৯৬৬); ‘স্প্রিং’ (আর্টস কাউন্সিল, ১৯৬৬)।

আরো কিছু ভাস্কর্য জ্যামিতিক আকৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে গড়েন তিনি, বিশেষত সেগুলো করা হয় ওপেন স্পেস বা খোলাচত্বরে স্থাপনের জন্য। যেমন : ‘স্কয়ার ফরমস উইথ সার্কেলস’ (ইসরায়েল মিউজিয়াম, জেরুজালেম, ১৯৬৩); রিটভেল্ড প্যাভেলিয়ন ফিগার (রিজকসমাস, ক্রলার-ম্যুলার, ১৯৬১); ‘ফোর স্কয়ার’ (ওয়াক থ্রো) (চার্চিল কলেজ, কেমব্রিজ, ১৯৬৬)। ষাটের দশকে তিনি মার্বেল ও পাথরে জ্যামিতিক চরিত্রের কিছু ভাস্কর্য গড়েছেন যাতে বেন নিকলসনের রিলিফ বা অবমুক্ত-ভাস্কর্য ও কনস্ট্রাক্টিভিস্ট বা নির্মাণবাদী শিল্পরীতির প্রতি তাঁর স্মৃতিকাতরতা মূর্ত হয়ে উঠেছে। যেমন : ‘মার্বেল উইথ কালার’ (ক্রিট) (বয়ম্যানস-ভ্যান বিউনিনজেন মিউজিয়াম, রটারডেম, ১৯৬৪)।

তাঁর জীবনে আসা অনেক সম্মানের মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম ও ১৯৬১ সালে তাঁর জীবনের প্রথম বিদ্যাপীঠ লিডস থেকে তাঁকে সম্মানজনক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি প্রদান।n

 

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থাবলি :

১.   ব্রিটিশ আর্ট/সিন্স নাইনটিন হান্ড্রেড, ফ্রান্সেস স্প্যালডিং, থেমস অ্যান্ড হাডসন লিমিটেড, ১৯৮৬, লন্ডন

২.   দ্য ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপেডিয়া অব আর্ট (রিভাইজড এডিশন), এডিটরস : বার্নার্ড এল মিয়ারস অ্যান্ড ট্রেউইন কোপলস্টোন, ১৯৭৯, লন্ডন

৩.  দ্য অক্সফোর্ড কম্পেনিয়ন টু টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি আর্ট, এডিটর : হ্যারল্ড অস্বর্ন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউইয়র্ক, ইউএসএ, ১৯৮১

৪. দ্য অক্সফোর্ড কম্পেনিয়ন টু আর্ট, এডিটর : হ্যারল্ড অস্বর্ন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭১, গ্রেট ব্রিটেন

৫.   দ্য পকেট অক্সফোর্ড ডিকশনারি, জুলাই ১৯২৪

৬.  চারুকলা পরিভাষা, বুলবন ওসমান, বাংলা একাডেমি ঢাকা, প্রথম সংস্করণ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬

৭.         শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য, সৈয়দ আলী আহসান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০০৪, আষাঢ় ১৪১১, ঢাকা

 

Leave a Reply