logo

ব্রাজিলের শতায়ু অসকার নাইমেয়ের

র বি উ ল  হু সা ই ন

তিনি বলেছেন, ‘যখন একটি রূপবন্ধ বা গঠন দ্বারা সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তখন তা হয়ে ওঠে উপযোগী ও ব্যবহারযোগ্য, সুতরাং সেটাই হচ্ছে স্থাপত্যশিল্পের মৌল বিষয়।’

‘সরল রেখা, যা কঠিন, অভঙ্গুর, মানুষের সৃষ্টি তা কখনো আমাকে আকর্ষণ করে না। যেটা আমাকে আকর্ষণ করে তা হলো স্বাধীন ও অনুভূতিশীল বাঁকা রেখা। যে বক্র রেখাকে আমি আমার দেশের পর্বতমালায় দেখি, নদীর বাঁকে দেখি, আকাশের মেঘমালায় দেখি – দেখি সমুদ্রের ঢেউয়ের ভেতর এবং আমার প্রিয়তমা নারীদের শারীরিক সুষমায়। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড বাঁকা গঠন ও রেখায় সৃষ্ট, আইনস্টাইনের বক্র গঠন এবং আকারের মাধ্যমে সব পরিস্ফুট।’

‘একজন স্থপতির কর্তব্য এমন একটি উপযোগী পৃথিবীর সৃষ্টি করা, যার মাধ্যমে তিনি স্থাপত্যশিল্পের ভেতর দিয়ে সবাইকে সেবা করতে উদ্যোগী হতে পারেন, শুধু একটি অভিজাত ও সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর বিশেষভাবে সাহায্য করার জন্যে নয়।’

২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বরে ব্রাজিলবাসী পর্তুগিজ, আরব ও জার্মান বংশের কিংবদন্তিসম শতবর্ষ বয়স পেরোনো সাম্প্রতিক স্থাপত্যজগতের এক মহান সৃষ্টিশীল ও ব্যতিক্রমধর্মী স্থপতি অসকার রাইবিরো দ্য আলমিদা নাইমেয়ের সোয়ারিস ফিলহো সংক্ষেপে অসকার নাইমেয়ের রিও ডি জেনিরোর এক হাসপাতালে মাসব্যাপী শ্বাসকষ্টে ভুগে এই পৃথিবী ছেড়ে চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর একশ পাঁচতম জন্মদিনের দশদিন আগে মহাপ্রয়াণ ঘটে। ১৯০৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর রিও ডি জেনিরো নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৮ সালে সান্তো আন্তনিও মারিয়া জাক্কারিয়া প্রাইওরি স্কুলের পড়া শেষ করেন। সে সময়ে চিরপ্রচলিত উদাসী ও উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেও  শহরের এসকোলা নাসিনিওল দে বেলাস আর্টস অর্থাৎ জাতীয় চারুকলা বিদ্যালয়ে স্থাপত্যশিল্প বিভাগে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯৩৪ সালে আঠাশ বছর বয়সে স্নাতকপ্রাপ্ত স্থপতি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেন। এর মধ্যে ১৯২৮ সালে অন্নিতা বালদো নামে এক ইতালীয় অভিবাসীর মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়। অসকার তখন ছয় সন্তানের জনক গ্রাফিক শিল্পী তাঁর বাবার ছাপাখানায় মুদ্রণশিল্পে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো আগ্রহ না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাঁর স্থপতি জীবনের পথিকৃৎ ও গুরু স্থপতি লুসিও কস্তার কার্যালয়ে একজন ড্রাফটসম্যান বা নকশাকার হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর সঙ্গে লুসিওর সহকারী স্থপতি গ্রেগরি ওয়ারচাভচিক ও কার্লোস লিয়াও ছিলেন; যদিও তিনি কোনো মাসোহারা সে-সময়ে লাভ করতেন না।

অসকার নাইমেয়েরের স্থাপত্যপেশা জীবনে স্থপতি লুসিও কস্তার অবদান ও সাহচর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে একজন সৃষ্টিশীল এবং পরিপূর্ণ স্থপতি হিসেবে বেড়ে বা হয়ে ওঠার জন্যে প্রভূত সাহায্য করে। ব্রাজিলীয় স্থাপত্যে নব্য ঔপনিবেশিক রীতির সঙ্গে ইউরোপীয় আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধনের ভেতর দিয়ে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া নিশ্চিত হবে – এই প্রত্যয় লুসিও কস্তা প্রথমবারের মতো বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন। এটিই সাম্প্রতিক ও আধুনিক স্থাপত্যে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।

১৯২২ সালে সাও পাওলোতে আয়োজিত আধুনিক শিল্প সপ্তাহ অনুষ্ঠান, ১৯২৬ সালে রেসিফে শহরে আঞ্চলিক আন্দোলন এবং ১৯৩০ সালে বিদ্রোহের পর লুসিও কস্তা ব্রাজিলে আভাঁ-গার্দ বা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, বিশেষ করে শিল্প ও স্থাপত্যে। তাঁর সঙ্গে স্থপতি গ্রেগরি ওয়ারচাভচিক যোগ দেন, যিনি ইউরোপের ঘনকবাদ বা কিউবিস্ট ধ্যান-ধারণার সূত্রপাত ঘটান সেখানে। এই সম্পর্কে তাঁর মতাদর্শ বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধে প্রকাশিত হয়, যেখানে প্রায়োগিক বা প্রযুক্তিগত সততা-সরলতা নিয়ে ঐতিহ্যিক ঔপনিবেশীয় স্থাপত্যরীতির সমন্বয় সাধনই আধুনিকতার মূল বিষয় – সেই বাস্তবিক এবং তাৎপর্যময় উপলব্ধি দ্বারা অসকার নাইমেয়ের ও সমসাময়িক স্থপতিবৃন্দ যেমন এফ্ফোনসো এদোয়ার্দো রিডি প্রমুখ গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ব্রাজিলের ওলিন্দা অঞ্চলে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যধারা বহুলভাবে দেখা যায়। যার সঙ্গে আধুনিক পদ্ধতির সংশ্লিষ্টতা সচেতনভাবে চলে আসে ও প্রতিষ্ঠা পায়। লুসিও কস্তার স্থাপত্যভাবনা অসকারের স্থাপত্যপেশা চর্চায় পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আসতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ছোটবেলা থেকেই অসকারের অাঁকাঅাঁকিতে খুব আগ্রহ দেখা যায়। তাঁর মা দেখতেন, ছোট্ট অসকার খালি হাতে আঙুল দিয়ে বাতাসের গায়ে শূন্যতার মধ্যে অাঁকিবুঁকি দিচ্ছে। পরে বড় হলে সেই হাতে পেনসিল তুলে দিলে তা বাস্তবে পরিপূর্ণতা পায়। লে কর্বুসিয়েরের সঙ্গে যখন কাজ করতেন লুসিও কস্তার কার্যালয়ে, তখন অসকারের অাঁকা বিভিন্ন ভবনের পরিপ্রেক্ষিত ছবি দেখে তিনি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন এবং এই শিল্পকুশলতা সারাজীবন লক্ষ করা গিয়েছিল।

এই সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যঘটনা ব্রাজিলে ঘটে। সেটা ১৯৩৬ সাল, ঊনত্রিশ বছর বয়সী লুসিও কস্তা তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী গুস্তাভো কাপানেমা কর্তৃক রিও ডি জেনিরো শহরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান কার্যালয়ের নকশা করার দায়িত্ব পান। কস্তা ভবনটিকে আধুনিক স্থাপত্যের সার্বিক মূল্যায়নে অনুপম নিদর্শন করে তুলতে একদল তরুণ স্থপতির সমন্বয় সাধন করেন। এই দলে স্থপতিবৃন্দ কার্লোস লিয়াও, এফ্ফোনসো এদোয়ার্দো রিডি, জর্জি মরিরা ও এর্নানি ভাসকোনসেল্লোস ছিলেন; কিন্তু অসকারকে বাদ দেওয়া হয়। পরে অসকারের বারবার পীড়াপীড়িতে কস্তা তাঁকে দলভুক্ত করেন। তখন কস্তা আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, সেটা হচ্ছে চিরকালের স্থাপত্য-প্রতিভা লে কর্বুসিয়েরকে ওই ভবনের পরামর্শক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান এবং অসকারকে তাঁর সঙ্গে রিওতে থাকার সময়ে সাহায্যকারী হিসেবে ও একই সঙ্গে নকশায় সহায়তা দেওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব প্রদান করেন। স্বাভাবিকভাবে তাই সুইজারল্যান্ডের স্থপতিগুরু কর্বুর সঙ্গে অসকারের ব্যক্তিক, আত্মিক ও শৈল্পিক সম্পর্কীয় নতুন উদ্দীপনা ও উৎসাহব্যঞ্জক স্থাপত্য সৃষ্টিশীল এক প্রভাববিস্তারী কর্মপ্রচেষ্টা গড়ে ওঠে, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে পরিষ্কাররূপে দেখা যায়। কিছুদিন বাদে কর্বু ব্রাজিল ছেড়ে চলে গেলে তাঁর নকশায় অসকার ভবনটির যে রূপ দিয়েছিলেন, তা অবলোকন করে কস্তা চমৎকৃত হন এবং সে কারণে তাঁকে ওই প্রকল্পের সার্বিক উন্নয়নের যাবতীয় কর্ম সম্পাদনসহ স্থাপত্য-নকশা করার প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান ভবনটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে আছে। ভবনটি যেমন ব্রাজিলের আধুনিক বহুতল কার্যালয় ভবনের প্রথম নিদর্শন, তেমনি লে কর্বুসিয়েরের স্থাপত্য-সৃষ্টিশীলতার বিচারেও অনন্য হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

এই আপিস বা কার্যালয় বহুতলাবিশিষ্ট, যা পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে নির্মিত প্রথম ভবন, যেখানে ব্রাজিলের সে-সময়ের মূল মতাদর্শ, নীতিবাণী এবং তারুণ্যের চালিকাশক্তি – নভো হোমেম, ব্রাসিলিরো এ মডার্নো অর্থাৎ নতুন মানব যারা ব্রাজিলবাসী এবং আধুনিক – এই অভিধায় বিশিষ্ট। ছয় বছর পর ১৯৪৩ সালে ভবনটির নির্মাণ শেষ হয়, তখন কর্বুর বয়স ছত্রিশ বছর এবং এটি তাঁর জীবনের বৃহৎ ও বহুতলাবিশিষ্ট আপিস ভবনের প্রথম নিদর্শন। ভবনটির ভেতর দিয়ে ব্রাজিলের বহমান ও বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন এবং সংশ্লেষণ ঘটে, যে বিষয়টি পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলের স্থাপত্যে সাম্প্রতিকী আধুনিকায়নের দিকনির্দেশনা দিতে থাকে। ভবনটিতে দেশীয় নির্মাণশৈলী ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহৃত হয়, যেমন পর্তুগিজরীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আজুলেযচ বা কাচের চকচকে বা মাটির উজ্জ্বল টালির উপকরণ এবং সেইসঙ্গে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার মুরীয় ঔপনিবেশিকতা-প্রচলিত পরিবর্তনযোগ্য ছায়া প্রদানকারী জালি পদ্ধতি। এটি ব্রাজিলের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ায় ব্যবহারোপযোগী, যেটি কর্বুর সুবিখ্যাত বিশেষ করণকৌশল ব্রিজেস-সলিল ও পাইলটিস বা থামের ওপর ভর দেওয়া রীতির সঙ্গে বিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায় – সেসব অনুসরিত হয়েছে। এখানে উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় বিভিন্ন বর্ণ, ব্রাজিলের বিখ্যাত নিসর্গ-রচনা প্রণেতা রবার্তো বার্লি মার্ক্সের পরিকল্পনায় মৌসুমি উদ্যান নির্মাণ, ব্রাজিলের প্রাকৃতিক বিন্যাসে সারিবদ্ধ রাজকীয় পামবৃক্ষ রোপণ, ব্রাজিলের স্বনামধন্য ভাস্কর ও শিল্পীদের শিল্পকর্ম – এরকম বহু প্রকার সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে এবং তা দেখা যায় ভবনটিতে। সেই কারণে অনেকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী আপিস ভবন হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করেন এবং অনুচ্চ ও বহুতলাবিশিষ্ট ভবনের মধ্যবর্তী এক সংযোগ-সাঁকো নির্মাণের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এখানে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়, সেটা হলো, একটি ভবন নির্মাণে যাঁদের সংশ্লিষ্টতা থাকে তাঁদের প্রত্যেককে নিয়েই সম্মুখযাত্রা, যেমন স্থপতি, নগর-পরিকল্পক, নিসর্গ-নকশাকারী, উদ্যানবিশারদ, শিল্পী ও ভাস্কর, ইতিহাসবিদ, ঐতিহ্য সংরক্ষক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, পৌরকর্মী – এঁদের সবার সহযোগিতায় স্থপতির নেতৃত্বে ও বিশেষ বিবেচনায় আরাধ্য নির্মিতিটির বাস্তব রূপ অর্জিত হয়। এরকম সম্মিলিত কর্ম-উদ্যোগের ফলশ্রুতি এই ভবনে সফলভাবে পরিদৃশ্যমান।

১৯২৯ সালে নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক শিল্পমেলা হয়। সেখানে অসকার নাইমেয়ের এবং লুসিও কস্তার নকশায় ব্রাজিল প্যাভিলিয়ন বা বৃহৎ প্রদর্শশালা নির্মিত হয়। সহযোগিতায় ছিলেন স্থপতি পল লেস্টার উইনার। এটার পাশেই ফরাসি প্যাভিলিয়ন বেশ বড় আর ভারী নির্মাণসামগ্রী দিয়ে তৈরি, সেই তুলনায় ব্রাজিল প্যাভিলিয়ন ছিল সরলীকৃত হালকা এবং সহজ নির্মাণ পদ্ধতির ছিমছাম গঠনের। কস্তা বলেছেন, এটিকে সুষমা ও সৌন্দর্যময় করে তোলার জন্যে খোলা পরিসরের স্বাভাবিক প্রবহমানতার সঙ্গে বাঁকা এবং অর্ধবৃত্তাকার দেয়াল ব্যবহারসহ আকর্ষণীয় ও উজ্জ্বল গঠনে উপস্থাপন করা হয়। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে তিনি আরো বলেন, তাঁদের স্থাপত্য-নিদর্শন গ্রিক স্থাপত্যরীতি আইওনিকের মতো সহজ-সরল, যেখানে ফরাসি প্যাভিলিয়নের বহমান আধুনিক কৌশল ডোরিক পদ্ধতির জটিলতায় বেশ আকীর্ণ। নাইমেয়েরের সেই অনুপম স্থাপত্য-নিদর্শনে নিউইয়র্কের তদানীন্তন মেয়র বা নগরপিতা ফিওরেল্লো লা গার্দিয়া খুব বিমোহিত হন। তাই তিনি তাঁকে নিউইয়র্ক শহরের চাবি ও নাগরিকত্ব উপহার দিয়ে সম্মানিত করেন।

১৯৩৭ সালে যদিও অসকার নাইমেয়ের একটি জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানের নার্সারি ভবনের নকশা প্রথমবারের মতো স্বাধীনভাবে করার সুযোগ পেয়েছিলেন, যেটা ছিল নবীনা মায়েদের জন্যে, ওবরা দো বার্কো নামে। তবে প্রকৃতপক্ষে তাঁর মূল স্থাপত্যপেশা চর্চা শুরু হয় পামপুলহা শহরের বিভিন্ন ভবনের মাধ্যমে, যা মিনাস গিরেস প্রদেশের রাজধানী বেলো হরাইজন্ট নগরের উত্তরে অবস্থিত। সেটা ছিল ১৯৪০ সাল, অসকারের বয়স যখন তেত্রিশ বছর। সে-সময়ে বেলো হরাইজন্টের নগরপিতা জাসেলিনো কুবিটসচেক, যিনি ১৯৫৬ সালে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে রাজ্যপাল বেনেদিতো ভালাদারেস – এঁদের সাক্ষাতে অসকারকে পামপুলহা শহরের সার্বিক পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন প্রকার ভবনের নকশা প্রণয়ন করার দায়িত্ব প্রদান করেন। এসবের মধ্যে ক্যাসিনো, রেস্তোরাঁ, নৃত্যশালা, ইয়ট ক্লাব, গলফ ক্লাব এবং গির্জা ভবন ছিল। এগুলো একটি মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদকে ঘিরে অবস্থিত, অদূরে নগরপিতার একটি সপ্তাহ শেষের অবসর আবাস – সব মিলে এটি পামপুলহা স্থাপত্য প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৩ সালে প্রকল্পটি শেষ হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্কের আধুনিক শিল্পশালা মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট-মোমাতে ব্রাজিল নির্মিতি বা ব্রাজিল বিল্ডস শীর্ষক একটি স্থাপত্য প্রদর্শনীতে ভবনগুলো প্রদর্শিত হয়। সেখানে দেখা যায় – ভবনসমূহের নকশা কর্বুসিয়ের দ্বারা প্রভাবান্বিত, কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে অসকারের নিজের মতো সৃষ্টি করার সচেতন প্রচেষ্টা বেশ স্পষ্ট। ক্যাসিনোতে যেমন মূল শক্ত কাঠামোর বাধ্যতা থেকে বাঁকানো পরিসর নির্মাণরীতি এবং খেলোয়াড়দের জন্যে ভাসমান পায়ে চলা পথের মতো ঢালু অবতল সৃষ্টির ফসল দেখা যায়, যা কর্বুর স্থাপত্য বিনোদনি শোভাযাত্রার ভাবনাকে প্রসারিত করা হয়েছে বলা যায়। কাসাদো বাইলে নামের ছোট রেস্তোরাঁ কৃত্রিম মৃত্তিকা দ্বীপে প্রবহমান ভূমিরেখা অনুসরণে একটি তাঁবুসদৃশ কাঠামোয় সৃষ্ট। এই মুক্ত গঠন-পদ্ধতি কর্বু বা মিজ ভান্ডার রো ব্যবহার করলেও অসকারের নকশাধারা ভবনের ভেতর ও বাইরের পরিসরকে একীভূতকরণের পাশাপাশি প্রজাপতির উড্ডীন পাখাসদৃশ ছাদ, যা ইয়ট ক্লাব ও কুবিটসচেক ভবনে দেখা গিয়েছে, তা সেই সময় খুব জনপ্রিয় ও এক আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তবে এই প্রকল্পে নির্মিত ভবনগুলোর মধ্যে অনবদ্যভাবে সৃষ্টি হয়েছিল অ্যাসিসির সেন্ট গির্জাটি। নানাবিধ কারণে ভবনটি অসকারের স্থপতিজীবনে বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এই স্থাপনা দ্বারা তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেন ও দেশ-বিদেশের স্থাপত্য-বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি কেড়ে তাঁদের আলোচনার মধ্যে জায়গা করে নেন। সাধারণত জমানো সিমেন্ট বা রিইনফোর্সড কংক্রিট চিরাচরিতভাবে থাম বা খুঁটি, বিম বা কড়িকাঠ আর স্ল্যাব বা সমতলি পুরু ফলক – এইসব একটি ভবনে দেখা যায়। কিন্তু অসকার নাইমেয়ের সেসব দিকে না গিয়ে অগাস্ট পেরেট বা রবার্ট মাইলার্ট দ্বারা নিরীক্ষামূলক যে কংক্রিটের প্যারাবলিক আর্চ বা অধিবৃত্তিক খিলানের জ্যামিতিক গঠনে থিন শেল বা খুব পাতলা-পলকা খোলস তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর মতো স্বল্পব্যয়ী স্থাপনাকৌশল অনুসরণ করেছিলেন। এটা ছিল পরিবর্তনযোগ্য সহজাতধর্মী নান্দনিক এক পরিসর সৃষ্টির অভিজ্ঞতালব্ধ বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম। একটি উপাদানের ভেতর দেয়াল ও ছাদকে একীভূত করে উল্লম্বের বিপরীতে সৌধ স্থাপনার কাজ এটি। সঙ্গে সব শিল্প যথা চারু ও কারুর সঙ্গে স্থাপত্যের সংযোগ দেখা যায়, যেখানে শিল্পী পর্টিনারির আজুলেযচ ও পাউলো ওরনেকের দেয়ালচিত্র প্রদর্শিত অনেকটা মধ্যযুগের বারোকরীতির অলংকরণে স্পষ্ট। এখানে সাম্প্রতিক ও আধুনিক স্থাপত্যধারা অনুসরিত হয়েছে তবে অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে – এই রীতি সমালোচকগণ স্ববিরোধী বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু সেই ধারা ছিল বেশ প্রচলিত সে-সময়ে। এই গির্জার আধুনিক স্থাপত্য-নিদর্শন বিশ্ব বা আন্তর্জাতিক স্থাপত্যে স্থান করে নিয়ে বিশেষভাবে পরিচিত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিলের স্থাপত্য-ইতিহাসেও; যদিও মিনাস গিরেসের কট্টর গির্জা-অভিভাবকগণ দীর্ঘ ষোলো বছর পর্যন্ত এটি ব্যবহারের অনুমোদন দেননি। তাঁদের আপত্তি ছিল গির্জার গড়ন অপরিচিত ও ব্যতিক্রমী এবং পর্টিনারির শিল্পসৃষ্টি বা পেইন্টিংয়ে অ্যাসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসকে রোগপীড়িত দরিদ্র জনগণ আর পাপীদের রক্ষাকারী হিসেবে দেখানোর বিষয় দুটিতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৯ সালে এসব সত্ত্বেও সবার জন্যে গির্জার দরজা খুলে দেওয়া হয়। প্রচলিত ও প্রবহমান ব্যবহারিকতা এবং প্রযুক্তি অনুসরণের বিপরীতে অসকার তাঁর ভবনের নকশায় আয়ত, বর্গ বা খাড়া স্থাপনা বাদ দিয়ে মুক্ত স্বাধীন পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, জলের ঢেউ, নারীদেহের পেলবতা, নম্রতা ইত্যাদির মতো বাঁকানো উপাদান ও স্থাপত্য-কৌশলে আকর্ষণীয় এবং অভিনব সৃষ্টিধারায় নিমগ্ন হন। এই সঙ্গে নিসর্গ-স্থপতি রবার্তো বার্লি মার্ক্সের সঙ্গে আধুনিক নিসর্গ-পরিকল্পনায় আগ্রহান্বিত হন এবং বহু বছর যাবৎ বিভিন্ন প্রকল্পে তাঁরা উভয়ে সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডে নিয়োজিত হয়ে ছিলেন। এটি খুব উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে আছে ব্রাজিলের আধুনিক স্থাপত্য-ইতিহাসে।

রিও ডি জেনিরোর পামপুলহা প্রকল্পের বিভিন্ন ভবনের নকশা অসকারের স্থাপত্য-সৃজনশীলতায় এমন প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি এনে দেয় যে, এগুলো পৃথক এক ব্রাজিল-রীতির স্থাপত্য-নিদর্শন হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাত। চিরপরিচিত আধুনিক ধারা সেই আকার বা গঠন ব্যবহারবিধি ও বিধান দ্বারা গড়ে ওঠে, এটাকে তিনি এবং তাঁর সঙ্গে অনেক স্থপতি পরিহার না করে পাশাপাশি পরিমিতি, সাযুজ্যতা, পরিমাপ, নান্দনিক বিন্যাস, জায়গার বৈশিষ্ট্য, নৈসর্গিক সম্পর্ক ইত্যাকার গুণাবলি যোগ করে ভবনগুলোকে আরো বৈশিষ্ট্যময় করে তুলতে সচেষ্ট হন এবং এতে সফলতা লাভ করেন। সহজ, সরল ও বুদ্ধিদীপ্ত স্থাপত্যরীতি-কৌশল প্রয়োগ করে তিনি জটিলতামুক্ত সমাধানে পৌঁছেন। এগুলোই তাঁর স্থাপত্যে প্রধান হয়ে দেখা দেয়।

১৯৪৮ সালে নির্মিত বেলো হরাইজন্টের ব্যাঙ্কো বোয়াভিস্তা প্রধান কার্যালয়, ১৯৫১-৫৪-তে এডিফিসো মন্ট্রিয়াল, ১৯৫৫-তে এডিফিসিও ট্রায়াঙ্গুলো, ব্যাঙ্কো মিনিরো দা প্রডসাও প্রধান কার্যালয় ইত্যাদি বহুতলাবিশিষ্ট ভবনে সেই সময়ের কঠিন-দৃঢ় গঠনরীতির বিপরীতে হালকা, স্বচ্ছ ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যে অসাধারণ সব স্থাপত্যকৃতি সংযোজন করেন। আরো উল্লেখ্য, স্থান বা পরিসরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নির্মিত ভবনকে বিশেষায়িত করার প্রচেষ্টা যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী ক্যান্ডেলারিয়া গির্জা স্থাপত্যের সঙ্গে অসকারের সেই নগর ভবনগুলোর নির্মিতি ও স্থাপনা-প্রক্রিয়া।

১৯৪৭ সালে অসকার নাইমেয়েরের স্থাপত্যপেশা-জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সূত্রপাত হয়। একটি আন্তর্জাতিক স্থপতি সংঘের সদস্য হিসেবে নিউইয়র্কে আসেন জাতিসংঘ প্রধান কার্যালয় ভবনের নকশা সম্পাদনের উদ্দেশ্যে এবং লে কর্বুসিয়েরের সঙ্গে যৌথভাবে বোর্ড অব ডিজাইনে তাঁদের ‘প্রকল্প-২৩/৩২’ জমা দেন। এঁদের সঙ্গে স্থপতি বদিয়ানস্কি ও ওয়েজমানও ছিলেন এবং পরে তাঁদের নকশা গৃহীত হয়। তখন অসকার ও কর্বুসিয়েরের মনোনীত জাতিসংঘ প্রধান কার্যালয় ভবনের নকশাটি প্রকল্প পরিচালক স্থপতি ওয়ালেস হ্যারিসন ও তাঁর অংশীদার স্থপতি ম্যাক্স আবরামোভিজ দ্বারা আরো উন্নত আর পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান রূপে স্থাপিত হয়। অসকারের বয়স তখন চল্লিশ বছর। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে বার্টন জি ত্রিসেন বাসভবন নিসর্গ-স্থপতি বার্লি মার্ক্সের সঙ্গে মিলে নকশা করেন, যা খুব ব্যতিক্রমী ছিল। সে-সময়ে মার্কিনিদের জন্যে কৌতুককর এক সহজাত বৈষম্যধর্মী ঘটনা ঘটে। সেটা ১৯৪৬ সালে, যখন তাঁকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকতা করার জন্যে সম্মানজনকভাবে একজন সৃষ্টিশীল স্থপতি হিসেবে আমন্ত্রণ জানায় এবং যেহেতু তিনি ব্রাজিল কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন তাই তাঁকে আশ্চর্যজনকভাবে ভিসা প্রদানে মার্কিন সরকার অস্বীকৃতি জানায়। এরপরে আবার ১৯৫৩ সালে তাঁর যখন ছেচল্লিশ বছর বয়স, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ অর্থাৎ হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইনে ডিন হিসেবে শিক্ষকতা করার জন্যে ডাকা হয়, তখনো কম্যুনিস্ট আদর্শের অনুসারী যা তিনি আজীবন ছিলেন, সে কারণে ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এইসব অধ্যায় দ্বারা বোঝা যায়, আমেরিকা বাইরের দিক দিয়ে যতটুকু উদার ও মুক্ত ততটুকু ভেতরে ভেতরে আড়ষ্ট এবং আবদ্ধ। তারা রাজনৈতিক মৌলবাদের অনুসারী এবং এখনাবধি সেই অপরিবর্তনীয় মতাদর্শে বিশ্বাস করে আসছে, যা শিল্পজগতে সৃষ্টিশীলতার বিচার ও মূল্যবোধে সবসময় পরিত্যাজ্য, অগ্রহণযোগ্য তো বটেই।

১৯৪৮ সাল থেকেই অসকারের স্থাপত্যে নিজস্ব মৌলিক ভাবনা প্রয়োগের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। পামপুলহা প্রকল্পে ব্যবহৃত প্যারাবোলিক আর্চ বা অধিবৃত্তিক খিলানরীতি ছাড়িয়ে তিনি আরো উদ্ভাবিত বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলী সৃষ্টিতে পারদর্শী হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করেন এবং সে কারণে তিনি স্থাপত্যকর্মের নিজ শিল্পগুণে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করতে সমর্থ হন। তাঁর স্থাপত্য-নিদর্শনের দ্বারা তাঁকে ভাস্করদের সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়। এ সময় অর্থাৎ ১৯৫০ সাল থেকে তিনি বহু প্রকল্পের স্থাপত্যকর্মে নিয়োজিত হন। ব্রাজিলে তখন ভবন নির্মাণ ও উন্নয়নের বহুমুখী জোয়ার। তিনি সে-সময়ে সাও পাওলো শহরের চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ইবিরাপুয়েরা বিনোদন উদ্যান প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। বিশাল তাঁবুসদৃশ স্থাপনাগুলো এঁকেবেঁকে মুক্ত হয়ে চলছে এবং ভবনের নিচে ইংরেজি ওয়াই-Y ও ডব্লিউ-W আকারের খাড়া স্তম্ভের ব্যবহার। তখন এই বিশেষ শৈলীটি ব্যাপকভাবে অনেক স্থপতি অনুসরণ করেন ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে; যদিও এগুলোতে কর্বুর ইউনাইট ডি হ্যাবিটেশন ভবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তাই সেগুলোকে নাইমেয়ের-সংস্করণ প্রক্রিয়াজাত বলে অভিহিত করা যেতে পারে। ১৯৫১ সালের তদানীন্তন সরকারের এক হাজার অ্যাপার্টমেন্ট বা বসবাস প্রকল্প, ১৯৫৩-৬৬-এর সাও পাওলো শহরের কেন্দ্রে কোপান বসবাস প্রকল্প, বেলো হরাইজন্টের মিজ ভান্ডারের ১৯২২-এর ভবন মতো নাইমেয়ের বসবাস প্রকল্প, পাঠাগার ভবন – এসব উল্লেখযোগ্য। কোপান প্রকল্প এগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ সচেতনভাবে আনুভূমিক স্থাপনারীতি, শহরের কেন্দ্রে বাণিজ্য এলাকায় বসতি নির্মাণ, ভবনে ব্রিজ-সলিল বা রোদের তাপ ও আলো নিরোধক জালি ব্যবহার ও প্রচলিত উল্লম্ব বলিষ্ঠ গঠন বা নির্মিতির পরিবর্তে নাইমেয়েরের কোমল বা পেলব ও লীলায়িত নকশা-কৌশলে বাস্তবায়ন – এইসব নিয়ে ছিল এর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যাবলি। অনেক বসবাসগৃহ তিনি নকশা করেন, যেমন তাঁর বাবার জন্যে নির্মিত মেন্দেজ অঞ্চলের ভবন রিওর মোরে নেটো ভবন, লিওনেল মিরান্দা ভবন, কাভানেলাস ভবন, কানোয়াস ভবন ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে মিরান্দা ও নেটো ভবনে ব্যবহৃত দুটি পেঁচানো বা শঙ্কুবৃত্ত গড়নে ঢালুভাবে ওঠা-নামার সিঁড়ি নিয়ে প্রজাপতির দুটি মেলানো ডানাসদৃশ অসমকোণী থামের ওপর আচ্ছাদন এবং পাহাড়ি জায়গার সঙ্গে মিল রেখে তাঁবুর মতো ধাতুনির্মিত ছাদ নিয়ে বিখ্যাত কাভানেলাস ভবন উল্লেখ্য। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে করা হয় ১৯৫৩ সালে তৈরি অসকার নাইমেয়েরের নিজের জন্যে বাসগৃহ কানোয়াস ভবনটি, যা অদূরবর্তী সমুদ্রপাড়ের ঢালুতে দুটো তলা নিয়ে নির্মিত। প্রথম তলার ছাদটি স্বচ্ছ এবং লোহার খুঁটিনির্ভর মুক্ত অব্যাহত গঠন নিয়ে অসমতল পার্বত্য পরিবেশে সুবিন্যস্ত ও মনোমুগ্ধকর। তবুও সমালোচিত হয়েছেন ভবনটি নিয়ে যেমন স্থপতি ওয়ালটার গ্রোপিয়াস যখন সাও পাওলোতে দ্বিতীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীর একজন বিচারক হিসেবে আসেন, তিনি তখন বলেছিলেন, একই বাসগৃহ বহুল পরিমাণে বারবার নির্মাণ করা সমীচীন নয়। তার উত্তরে অসকার বলেছিলেন, বাড়িটি সবার জন্যে নয়, মনেপ্রাণে নিজের জন্যেই নকশা করা। আসলে সব ব্যবহারিক প্রথা ও রীতি ছাড়িয়ে তাঁর এই ভবনের স্থাপত্য-নকশা ছন্দায়িত মুক্তরীতির সুষমায় এক লাবণ্যময় গীতলতা এনে চূড়ান্ত রূপে উপস্থাপিত এবং এই বিশেষ সৃষ্টিশীলতার প্রাকৃতিক প্রবহমানতা তাকে আধুনিক স্থাপত্যজগতে অনন্য ও অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।

১৯৫৩ সাল থেকে ব্রাজিল নির্মাণে ব্যস্ত এই প্রতিপাদ্যে গৌরবান্বিত এবং সেই থেকে দেশটি আধুনিক স্থাপত্যে এগিয়ে যাচ্ছে – এর বিপরীতে ও বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে তখন এক যুক্তিবাদী সমালোচনা শুরু হয়। অসকারের মুক্ত স্থাপত্যরীতি সম্পূর্ণ অলংকরণ প্রকৃতির, ব্যবহারিক গুণবর্জিত, দেয়ালে চিত্রলেপন-কৌশল ব্যক্তিগত ধরনের এবং ভবনের নিচের তলায় ইংরেজি অক্ষর ভি-V বা ওয়াই-Y আকারের থাম সংযোজন শুধু সৌন্দর্যবৃদ্ধির কারণে নির্মিত – এসবে উপযোগিতা নেই। ম্যাক্স বিলের এই উক্তিতে অসকার তত প্রতিক্রিয়া দেখাননি, তবে লুসিও কস্তা বলেছিলেন, তাঁর স্থাপত্যনির্মাণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক দ্বারা সমাধা হয়নি – এটা বলা যায় ব্রাজিলবাসী গির্জা শ্রমিকদের ঐতিহ্যবাহী কংক্রিট কাজের মুখে সুইজারল্যান্ডবাসী ঘড়ি নির্মাতাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মনৈপুণ্যের মতো। তখন দেখা যায়, অসকারের স্থাপত্যধারা অনুসরণ করে অনেক দ্বিতীয় সারির স্থপতি শুধু অলংকারপূর্ণ বিভিন্ন শৈলী অনুযায়ী ভবন নকশায় নিমগ্ন হতে থাকেন। অসকার এসব সমালোচনা অস্বীকার না করে তখন বলেন, কথাটা ঠিক বটে, যেহেতু সে-সময়ে বহু প্রকল্পের বহু ভবন তাড়াতাড়ি করে চাহিদা মোতাবেক নির্মিত হয়েছিল বলে সব ভবনের জন্যে সমানভাবে দৃষ্টি দেওয়া যায়নি যেমন, সাও পাওলোর এগারো তলাবিশিষ্ট এডিফিসিও ক্যালিফোর্নিয়া কার্যালয় ভবন ইত্যাদি। ইংরেজি ভি-V অক্ষরের মতো নিচে থাম ব্যবহার করা প্রচলিত প্রথার মতো এবং কাঠামোগত যুক্তি নেই এখানে। এরকম কর্বুর মার্সাই নগরের ভবনে পাইলটিস পদ্ধতি দেখা যায়।

পরবর্তী সময়ে ১৯৫৭ সালের বার্লিনে ইন্টারবাও প্রদর্শনী আয়োজিত হয়, যার মধ্য দিয়ে অসকার নাইমেয়ের জার্মানিতে তাঁর স্থাপত্যকৃতি দেখাতে সমর্থ হন। এর আগে ১৯৫৪ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোপ ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন গ্রিক ও রোমান আমলের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও চিরায়ত প্রকৃতির বিভিন্ন নগরীর বিভিন্ন স্থাপত্যগুণবিশিষ্ট ভবন দেখে চমৎকৃত এবং মনে মনে বেশ আলোড়িত হন। পরে এই প্রতিক্রিয়ার ফসল তাঁর নকশায় দেখা দিতে থাকে, যেখানে স্থাপত্যে সৌন্দর্য সৃষ্টি-ধারা মুখ্য ও প্রধান বলে বিবেচিত, তবে কখনো উপযোগিতার মূল্যে বা বিনিময়ে নয়। তিনি তখন আরো বুঝতে পারেন, ব্রাজিলের স্থাপত্যচর্চা প্রতিভাদীপ্ত না হয়ে মধ্যমানের সাধারণ পর্যায়ভুক্ত স্থপতিনির্ভর হয়ে পড়ছে দিন দিন এবং সে-কারণে আন্তর্জাতিক বিচারে সমালোচিত হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই ইউরোপ-ভ্রমণ স্থাপত্যচর্চার ক্ষেত্রটিকে পুনর্বিবেচনায় একটি ইতিবাচক শিক্ষার মাধ্যমে রূপ নেয়। তাই পরবর্তী স্থাপত্য-নকশার চিন্তাভাবনায় এমন স্বীকারোক্তিমূলক আত্মসমালোচনায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন এবং সেসব তাঁর সম্পাদনায় মডুইলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আগের সেই কর্বুয়ী স্থাপত্যচিন্তার ব্রিজ সলিল, পাইলটিস, তাঁবুসদৃশ নির্মিতি, ভারী ধরনের ভাস্কর্যসুলভ আয়তন-আকারের পরিবর্তে দৃষ্টিনন্দন স্বচ্ছ ও সাবলীল প্রকৃতিজাত গঠনশৈলীর দিকে গুরুত্ব দিতে থাকেন। এই আত্মোপলব্ধিত ধারণাকে দিপোইমেন্তো বলে আখ্যায়িত করা হয়। ঘন গড়নের প্রতিনিধিত্বকারী কাঠামোর সহজাত প্রকাশে রূপায়িত এবং বিস্তৃত সেই রীতি-কৌশল স্থাপত্য নির্মাণে নিয়ে এসে নতুন এক মৌলিক সৃষ্টি অধ্যায় তৈরিতে সচেষ্ট হতে হবে। এটা বুঝেছিলেন আটান্ন বছর বয়সে। ১৯৫৫ সালে কারাকাসে আধুনিক চারুকলা শিল্পের এক জাদুঘরের স্থাপত্য-নকশা করেন, যার ভেতর দিয়ে অসকারের প্রাগুক্ত চিন্তাচেতনার প্রতিফলন দেখা যায়। কারাকাস শহরের কেন্দ্র থেকে চারদিকের পাহাড়-পর্বতের ঘেরাটোপে উলটো-পিরামিড গঠনে বিদ্যমান নিসর্গের মধ্যে এটি স্থাপিত। অস্বচ্ছ ঘনকে ভবনের দেয়াল শক্তভাবে প্রোথিত এবং বাইরের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ছাদ থেকে আলো আসার ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিনির্ভর তার সঞ্চালন। কৌশল ও ঢালু সিঁড়ি বা র‌্যাম্প দিয়ে বিভিন্ন উচ্চতায় যাওয়ার ব্যবস্থাসহ স্বাধীনভাবে বাধাহীন প্রবহমানতা নিয়ে এর মনোরম পরিসরের সৃষ্টি। এই রকম সহজাত সরল জটিলামুক্ত গঠনশৈলীর মধ্য দিয়ে স্থাপত্যে এক বিশুদ্ধ লালিত্য ও সুষম পরিশীলতা নিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে ব্রাসিলিয়া প্রকল্পের বিভিন্ন ভবনে এর প্রতিফলিত রূপ পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে।

তখন ১৯৫৬ সাল। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাসেলিনো কুবিটসচেকের সঙ্গে সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে অসকার নাইমেয়ের এক মোটরযানে করে শহরে ফিরছিলেন। তখন তাঁকে রাষ্ট্রপতি খুব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ‘আমি এই দেশের জন্যে এক নতুন রাজধানী গড়ে তুলব, তোমার সাহায্য চাই…। শোনো অসকার, এবার আমরা ব্রাজিলের রাজধানী তৈরি করতে যাচ্ছি।’ সেই দায়িত্ব অসকারকে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে নাইমেয়ের ব্রাসিলিয়া নগর পরিকল্পনার শ্রেষ্ঠ নকশা বাছাই করার জন্যে একটি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁর বন্ধু ও গুরু-স্থপতি লুসিও কস্তা এতে জয়ী হন। তখন সাব্যস্ত হলো, নাইমেয়ের বিভিন্ন প্রস্তাবিত নতুন ভবনের নকশা ও লুসিও শহর পরিকল্পনা করবেন। কয়েক মাসের মধ্যেই নকশাগুলো সম্পন্ন হয়। লুসিওর ব্রাসিলিয়া দ্বিমাত্রিক মহাপরিকল্পনায় উদ্যত তীর-ধনুসদৃশ এবং রেনেসাঁস বা নবজাগৃতি চেতনায় সুসংহতভাবে শহর পরিকল্পনাটি অনুসরিত ও জ্যামিতিক সরলতায় বিন্যস্ত। তাঁর অবিমিশ্র স্বচ্ছ পরিকল্পনা-কাঠামোর মধ্যে নির্মিত অসকারের বিভিন্ন ভবন খুব যথার্থ এবং একে অপরের সম্পূরক হিসেবে দেখা দেয়। এই সময়ে নির্মিত হয় রাষ্ট্রপতি ভবন প্যালাসিও দা আলভোরাদা, ব্রাজিলের জাতীয় কংগ্রেস, চেম্বার অব ডেপুটিজ, হাইপারবলয়িড বা পরাবৃত্তিক কাঠামোর ব্রাসিলিয়া ক্যাথাড্রাল, রিপাবলিকের সাংস্কৃতিক স্থাপনাসমূহ – জাতীয় পাঠাগার, জাতীয় জাদুঘর নিয়ে দি কালচারাল কমপ্লেক্স, দি সুপ্রিম ফেডারেল কোর্টসহ অনেক সরকারি ও বাণিজ্যিক ভবন এবং আবাসিক প্রকল্প। ১৯৬০ সালের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল রিও ডি জেনিরো থেকে ছয়শো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে জনবিরল এলাকা, সমুদ্রপৃষ্ঠের তিন হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ব্রাসিলিয়াতে এইসব স্থাপনা।

জাতীয় পর্যায়ে দেশকে শিল্পোন্নত করার লক্ষ্যে দূরবর্তী অঞ্চলকে নিকটে এনে জনগণের জন্যে ব্যবহার উপযোগী ও এভাবে সমৃদ্ধতর করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়েই মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়। ভবনগুলো দৃশ্যত ভাসমান হয়ে স্থাপিত, নিচের তলা ফাঁকা পরিসরের এবং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে একই সূত্রে গাঁথা। উল্লেখ্য যে, প্রকল্পটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে গড়া। পদস্থ থেকে সাধারণ শ্রমিক সবাই একই ভবনে বসবাস করবে এবং এর ফলে কোনো অঞ্চল অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিতি পাবে না।

অসকার এই ব্রাসিলিয়া প্রকল্পে পূর্ণ সফলতা পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং দেশে-বিদেশে খুব সুনাম অর্জন করেন। তখন ব্রাসিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান এবং তা গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে আমেরিকার ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের একজন অবৈতনিক সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। একই বছরে তিনি লেনিন শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে। ১৯৬৪ সালে ব্রাসিলিয়া নগরীর বিভিন্ন ভবন নির্মাণ এবং অসকারের অবদান নিয়ে দি ম্যান ফ্রম রিও শীর্ষক একটি ফরাসি চলচ্চিত্র তৈরি হয়, যেখানে জাঁ-পল বেলমন্ডো মূল অভিনয়ে ছিলেন। পরে ১৯৬৪ সালে অসকারের বয়স সাতান্ন বছর যখন, ইসরায়েলের হাইফা শহরের মেয়র আববা হুশির আহবানে হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য-নকশা করার দায়িত্ব পান।

অসকার ব্রাজিলিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য এবং আজীবন একজন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি ছিলেন। সেই সময়ে ১৯৬৪ সালে সেনাশাসক জেনারেল কাস্তেলো ব্রাঙ্কো ব্রাজিলে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং দীর্ঘ একুশ বছর ক্ষমতায় থাকেন। এর ফলে অসকার তখন দেশত্যাগে বাধ্য হন এবং ফরাসি দেশে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে পৃথিবীর শিল্পনগরী খ্যাত প্যারিসে একটি স্থাপত্য কার্যালয় স্থাপন করে স্থাপত্যপেশায় নিয়োজিত হন। নিজে একজন বামপন্থী ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নাগরিক ছিলেন বলে অনেক বাধা-বিপত্তি আসে তাঁর জীবনে। সামরিক স্বৈরাচারী সরকার তাঁর ১৯৭২ সালে নির্মিত রিও ডি জেনিরোর স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন এবং সবকিছু ধ্বংস সাধন করে। তাঁর মডুইলো পত্রিকার কার্যালয়টিও বাদ যায় না। রহস্যজনকভাবে কেউ তাঁকে কোনো স্থাপত্যকর্মের জন্যে দায়িত্ব দেয় না বরং এড়িয়ে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়-বিরুদ্ধ সরকারি নীতির প্রতিবাদে অসকারসহ দুশোজন শিক্ষক ব্রাসিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন। সেই বিশেষ সময়ে এসবের আগে তিনি ফরাসি দেশে গিয়ে প্যারিসের লুভ জাদুঘরে একটি প্রদর্শনীর আয়োজনে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

তখন ১৯৬৬ সাল, অসকারের বয়স ঊনষাট বছর, লেবাননের ত্রিপলিতে তিনি একটি আন্তর্জাতিক স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্রের নকশা করেন এবং নকশানুযায়ী নির্মাণকার্য শেষ হলেও লেবাননের গৃহযুদ্ধের জন্যে তা পরিপূর্ণতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। প্যারিসে সাঁজে লিজের স্থাপত্য কার্যালয় থেকে একজন নির্বাসিত স্থপতি হিসেবে অনেক প্রকল্পের নকশা করেন। এসবের মধ্যে ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয় স্থপতি জাঁ দে বোচে ও শেমেটের সঙ্গে প্লেস দু কর্নেল, আলজিরিয়ার হুরি বুমেদিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির মন্দাদরি প্রকাশনা সংস্থার ভবন, ফুঞ্চাল অঞ্চলের মাদিরাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর পুরনো হোটেলের জায়গায় এক ক্যাসিনো প্রকল্প – এসব উল্লেখ্য।

এ-সময়ে অসকার অনেক আসবাবপত্রের নকশা করেন, যেমন মবিলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার জন্যে ইজিচেয়ার ও লম্বা হেলানবিহীন গদি-অাঁটা আসন – সব সীমিতসংখ্যক গ্রাহকদের জন্যে। ১৯৭৮ সালে ওইসব আসবাব, চেয়ার, রিও চেজ-লংসহ ব্রাজিলের এক জাপানি কোম্পানি তেন্দো ব্রাসিলিরা তৈরি করতে থাকে। বাঁকা কাঠের প্রযুক্তি নিয়ে চেয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান কার্যালয়ে ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অসকারের নকশা করা বিভিন্ন ধরনের চেয়ার ও আসবাবপত্রের মধ্য দিয়ে ব্রাজিলের সুগার লোফ বা শর্করামন্ডিত পর্বতের গঠন-স্থাপনা এবং সাবলীল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। এই সঙ্গে বৈচিত্র্যময় রিও ডি জেনিরো শহরের নারীকুল এবং তাদের দেহসৌষ্ঠবের প্রকাশ ও বিকাশ আরো অর্থপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়।

এরপর ১৯৮৫ সালে সামরিক একনায়কত্ব শাসনের অবসানে ব্রাজিলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, তখন অসকার নাইমেয়ের দেশে ফিরে আসেন। এ-সময় অনেকগুলো স্মৃতিস্তম্ভ নকশা করেন, যেগুলো স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও উপাদানে নির্মিত হয়। দৃষ্টিনন্দন উচ্চ কাঠামোয় এগুলো স্থাপত্য-নান্দনিকতায় নতুনভাবে উপস্থাপিত এবং ভাস্কর্যশিল্প-নির্ভর স্থাপত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। এসবের মধ্যে আগে ১৯৮০ সালের জাসেলিনো কুবিটসচেক মেমোরিয়াল, ১৯৮৫ সালে স্বদেশ ও স্বাধীনতার প্যানথিয়ন বা স্মরণস্তম্ভ, ১৯৮৭ সালে ল্যাটিন আমেরিকার ভাস্কর্যগুণমন্ডিত স্মৃতিস্তম্ভ যেখানে একটি আঘাতপ্রাপ্ত হাত থেকে রক্তধারা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্র-আদলে পতিত হচ্ছে। এটা খুব সমালোচিত হয় এবং লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা অযাচিতভাবে অবান্তর ও অশ্লীল বলে মন্তব্য করে।

১৯৮৮ সালে অসকার একাশি বছর বয়সে সেই সময় স্থাপত্য শিল্প জগতের সবচেয়ে সম্মানজনক অর্জন আমেরিকার স্থপতি গর্ডন বনশাফটের সঙ্গে প্রতজকার স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের ফলে ব্রাজিলের সমস্যাসংকুল সমাজতন্ত্রকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে দলের হাল ধরেন। আজীবন সমাজতান্ত্রিক মতবাদের অনুসারী, সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও অসকার ব্রাজিলিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চার বছর এই দায়িত্ব খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এ-সময়ের মধ্যে ব্রাসিলিয়াতে স্বদেশিদের জন্যে স্মৃতিভবন বা মেমোরিয়াল ফর দি ইন্ডিজিনাস পিপল এবং মিলিটার ক্যাথাড্রালের নকশা শেষ করেন।

১৯৯৬ সালে যখন তাঁর বয়স ঊননববই বছর তখন রিও ডি জেনিরোর কাছে অবস্থিত নিতেরোই আর্ট মিউজিয়াম ভবনের নকশা বাস্তবায়িত হয়। চমকপ্রদ ও খুব আকর্ষণীয় নির্মিতিটি শহরের অদূরে গুয়ানাবারা সমুদ্রসৈকতের সামনে পাহাড়ের চূড়া থেকে বেরিয়ে আসা আলম্ব ভরহীন এককেন্দ্রিক নির্মাণশৈলী এবং নান্দনিক সৌন্দর্যে প্রতিস্থাপিত। স্থাপত্য-নিদর্শনটি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের ফলিং ওয়াটার, লে কর্বুসিয়েরের রনশ্যাম্প চ্যাপেল, মিজ ভান্ডার রোয়ের ফার্নওয়ার্থ হাউস, ফ্রাঙ্ক গেহরির বিলবাওয়ে গগেনহেইম মিউজিয়ামের সঙ্গে একই কাতারে স্থান দেওয়া হয়।

২০০৩ সালে ছিয়ানববই বছর বয়স যখন, অসকার লন্ডনের হাইড পার্কের কেনসিংটন গার্ডেনে সার্পেন্টাইন গ্যালারির সামার প্যাভিলিয়ন নকশা করার আমন্ত্রণ পান। যাঁদের কোনোদিন আগে যুক্তরাজ্যে কোনো স্থাপনা নকশা করার সুযোগ হয়নি সেইসব স্থপতিই শুধু এমন আহবানে অংশ নিতে পারতেন। অসকারের বেলায়ও তাই ঘটে। এর আগে ২০০২ সালে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত অসকার নাইমেয়ের মিউজিয়াম কমপ্লেক্স ভবন পারানা অঞ্চলের কিউরিটিবা শহরে উদ্বোধন করা হয়।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে তিনি এইভাবে তাঁর স্থাপত্য-স্টুডিওতে স্থাপত্য-সৃজনীর স্বাক্ষর ও কর্মতৎপরতা বহমান রেখে সবাইকে বিমোহিত করে রাখেন। একশ বছর বয়সেও তিনি আশ্চর্যজনকভাবে কর্মক্ষম ছিলেন, বিশেষ করে ভাস্কর্য-স্থাপত্য সৃষ্টিকর্মে আর পুরনো প্রকল্পের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ বিষয়ে। সেই সময়ে অসকারের একশতম জন্মদিন উপলক্ষে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ পুরস্কার অর্পণ করে সম্মান জানান। ১৯৮৯ সালে পাওয়া প্রিন্স অব আস্টুরিয়াস অ্যাওয়ার্ড অব আর্টস পুরস্কারটি এর পঁচিশতম বার্ষিকীতে আস্টুরিয়াস সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দান করেন। পরে ২০১১ সালে এভিলসে অসকার নাইমেয়ের আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বা সেন্ট্রো নাইমেয়ের ভবনের উদ্বোধন হয়। এখানে উল্লেখ্য, ইতালির সমাজতাত্ত্বিক, তাঁর বন্ধু ডোমেনিকো দে মাসির তত্ত্বাবধানে ২০০০ সালে অসকারের নকশা করা একটি মিলনায়তন অডিটরিয়াম অসকার নাইমেয়ের রাভেল্লোর আমালফি সমুদ্রতীরের রাভেল্লো শহরে দ্বারোদ্ঘাটিত হয়। কিন্তু স্থানীয় স্থাপত্য-ঐতিহ্য ও স্থাপনা নিয়মানুসারে নির্মিত হয়নি বলে নানাবিধ সমস্যা ও স্থপতিদের আপত্তির জন্যে এক বছর চালু থাকার পরে বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে এখন খোলা হবে। বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ ও প্রণিধানযোগ্য।

শতবর্ষ অতিক্রমী অসকার মানুষটি দীর্ঘ জীবনের অধিকারী তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে দীর্ঘদেহী, ভদ্র, নম্র, স্বল্পবাক, ধীরস্থির, নিজের আদর্শে বিশ্বাসী, ভীষণভাবে সৃজনশীল, রসিক, আমোদপ্রিয়, স্বাপ্নিক, প্রকৃতি ও দেশপ্রেমী এবং সর্বোপরি রমণীমোহন এক সুদর্শন ও অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন। একশ বছর বয়সে, বয়সের কারণে বিভিন্ন রোগে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তাঁকে একাকী সময় কাটাতে হয়। তখন বলেছিলেন, ‘হাসপাতালের দিনগুলো খুব নিঃসঙ্গতায় যাপন করতে হয়, আমি সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকতে চাই, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশতে চাই, জীবনের ছন্দ বজায় রেখে চলতে চাই।’

তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তান আন্না মারিয়া বিরাশি বছর বয়সে মারা যান অসকারের মৃত্যুর দশ মাস আগে। তাঁর সহধর্মিণী অন্নিতা বালদো তাঁদের দীর্ঘ ছিয়াত্তর বছর বিবাহিত ও যৌথ জীবন কাটানোর পর তিরানববই বছর বয়সে অসকারের যখন বয়স সাতানববই বছর তখন দেহত্যাগ করেন। এরপর ২০০৬ সালে অসকার তাঁর নিরানববইতম জন্মদিনের কিছু আগে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ভেরা লুসিয়া ক্যাবরিরার সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন এবং সেটা পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙার এক মাস পর।

ব্যক্তিজীবনে খুব ধূমপানে, বিশেষ করে চুরুট ও সিগারে আসক্ত ছিলেন এবং তাঁর স্টুডিওটি ধূমপান এলাকা হিসেবে ঘোষিত ছিল। দীর্ঘ আটাত্তর বছরের স্থাপত্যপেশার জীবনে সব মিলে প্রায় ছয়শোটি প্রকল্পে তাঁর অসামান্য লালিত্যময় প্রতিভাদীপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক কাব্যিক সৃজনশীলতা দিয়ে ব্রাজিলের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বস্থাপত্যকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

উল্লেখ্য, পাঁচটি কর্বুসীয় নকশারীতি – জানালার সম্পূর্ণ বিস্তৃতি, সূর্যের আলো নিরোধক পদ্ধতি, ছাদে উদ্যান, ভূমির ওপর স্তম্ভ দিয়ে ভবন স্থাপন ও মুক্ত রূপ গঠনে সারিবদ্ধ স্তম্ভ ব্যবহার – এসবের সঙ্গে নির্মাণরীতির সমন্বয় সাধনে বলা হয় এভাবে স্বর্গে ভবন গড়তে হয়। অসকার এটিকে সম্প্রসারিত করে স্বাধীন ও অবাধে স্বাভাবিক ছন্দোবদ্ধ, লীলায়িত এবং কাব্যিক পথে ভবনে নদী-স্রোতের প্রবহমানতা যোগ দিয়ে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলভার আলতো বলেছেন, একটি ভবনের মূল্যায়নে কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর সময়ের প্রয়োজন পড়ে। তাঁর বেলায় তা এখনই চিরায়ত গুণে স্পষ্ট। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীস্পর্শী শতবর্ষ পেরোনো আধুনিক স্থাপত্যের চিরকালীন পথিকৃৎ তাঁর ভবনের নকশায় চিত্র ও ভাস্কর্যশিল্প, প্রকৌশল কুশলতা, কারু ও চারুশিল্প, নিসর্গ রচনা এবং স্থাপত্যশিল্প – সবগুলোকে একীভূত করার বিস্ময়কর সৃজনশীলতাসহ অপূর্ব পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, বিশেষ করে প্রকৌশল নির্মাণ নকশার ক্ষেত্রে পূর্ত প্রকৌশলীদের অনেক অবদান স্বীকার করতে হয়। এই সঙ্গে তাঁর জীবনে যে সুযোগ এসেছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। তার জন্যে শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী কিছু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ক্ষমতাবান বন্ধু-নেতার অকুণ্ঠ সমর্থন, নিঃস্বার্থ সহযোগিতা ও পূর্ণ আনুকূল্য লাভ খুব মূল্যবান। এছাড়া তিনি এভাবে কখনো পূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারতেন না। এ কারণে স্থাপত্যকে আজকাল এবং সর্বদা অনেকে রাজনৈতিক শিল্প বলে পরিচিহ্নিত করে থাকেন। তিনি তাই বলেছেন, ‘আমি সাহস আর আদর্শের সঙ্গে সব সৃষ্টি করি সচেতনভাবে, জীবন ও বন্ধুত্বের আলোকে যা গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্রতীপ পৃথিবীকে, যেখানে আমরা বাস করি সেটাকে আরো উন্নত ও বাসযোগ্য করে তোলাই আমার লক্ষ্য ও স্বপ্ন।’ সেই স্বপ্নটি তাঁর বিশাল-বিস্তৃত জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে পূরণ করেছেন – এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

১৯০৭ সালে স্থপতি হারমান মুথেসিয়ামের ওয়ার্কবান্ড থেকে ১৯১৯-৩২ সাল পর্যন্ত বাউহাউস শিল্প-স্থাপত্য স্কুল যা জার্মানির ওয়েইমার-দেসাউয়ে ওয়াল্টার গ্রোপিয়াস, ক্লি, মিজ ভান্ডার রো, ক্যান্ডিনসকি প্রমুখ দ্বারা যন্ত্র-নান্দনিকতার সূত্র ধরে সর্বশিল্পের সমন্বিত রূপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে ও পরবর্তী সময়ে প্রবর্তিত হয়। এটিই আন্তর্জাতিক রীতির শিল্প আন্দোলন হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পায়। অসকার এই বাঁধা-ধরা শৈলী কখনো অনুসরণ করেননি বরং এসব ছাড়িয়ে স্বাধীনভাবে তাঁর মতো করে স্থাপত্যচর্চা করে গেছেন। এখানেই তাঁর অভিন্ন-অনুপম শিল্প-বৈশিষ্ট্যের বিশিষ্ট পরিচয় নিহিত।

অসকার বলতেন, ‘আমার কাজ গঠন বা আকৃতি ব্যবহারিকতা বা উপযোগিতা অনুযায়ী সম্পূর্ণ হয় না, আমার কাজ সৌন্দর্যকে ঘিরে, ভালো করে বললে আমার কাজ গঠিত হয় নারীর কমনীয়তা, নম্রতা ও পেলবতাকে কেন্দ্র করে।’

অসকারের বিখ্যাত উক্তি, ‘আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে, এছাড়া কখনো কোনোকিছু বাস্তবে রূপ নেবে না।’ ১৯৬০ সালে ঘোষিত ব্রাজিলের নতুন রাজধানী ব্রাসিলিয়া ১৯৮৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পায়। অসকার-বিয়োগে তারা বলে, বাঁকানো রেখার অপূর্ণ-অপরিপক্ব গড়ন ও অসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রীর সঙ্গে আনুভূমিক এবং খাড়া বা উল্লম্ব আয়তাকার পরিসর নিয়ে সেটিকে একীভূত ছন্দে গাঁথতে পারতেন তিনি।

তাঁর বহু কাজ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও ভাস্করদের অনুপ্রাণিত করে আসছে, করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো করবে। রিও ডি জেনিরোর সাম্বা ড্রোমের নকশা তিনিই করেছিলেন, যেখান থেকে প্রতিবছর নিয়মিতভাবে সাম্বা নৃত্যের আয়োজন ও মিছিল শুরু হয়। তিনি সুন্দর নকশা করে সুন্দর পৃথিবী গড়ার ব্রত নিয়ে এসেছিলেন এবং বলতেন, ‘জীবন হচ্ছে বাতাসের নিঃশ্বাস।’ ফিদেল কাস্ত্রোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কাস্ত্রো বলতেন, ‘নাইমেয়ের আর আমি এই গ্রহের সর্বশেষ কম্যুনিস্ট।’

নাইমেয়ের যুক্তরাজ্য ও আমেরিকার স্থপতি ইনস্টিটিউট – দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই স্বর্ণপদক লাভ করেন। সেই ১৯৪০ সালে হার্ভার্ড বিশ্বাবিদ্যালয়ে ওয়ালটার গ্রোপিয়াস ছাত্রদের সঙ্গে অসকারের স্থাপত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করার সময় তাঁকে প্যারাডিজভোগেল বা স্বর্গের পাখি বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তাঁর কাজ সবসময় আলোচিত হয়ে রইবে – এমন মন্তব্য করেছিলেন। কর্বুসিয়ের অসকারের ব্রাসিলিয়াতে কংগ্রেস ভবনের ঢালু সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এখানে কল্পনার উদ্ভাবনশক্তি অনুভব করা যায়। জাতীয় কংগ্রেস ভবনে সুউচ্চ সচিবালয়ের বহুতল জোড়া ভবনের পাশে সিনেটের ওলটানো বাটি বা পাত্রসদৃশ গম্বুজ আর মেলে ধরা বাটিসদৃশ লোয়ার হাউস সন্নিবেশিত এবং দৃষ্টিনন্দিতভাবে বিন্যস্ত। বলা হয়, প্রতীকীভাবে সব ভালো জিনিস পাত্রে গ্রহণ করে সেই পাত্র উলটো করে ঢেলে অর্পণ করে সেসবের সাহায্যে জোড়া ভবনের মতো দেশকে গড়ে তুলতে হবে – এটাই জনগণের অঙ্গীকার। সেটাকেই অসকার ব্রাসিলিয়ার স্থাপত্যে প্রতীকীভাবে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন সফলভাবে।

তাঁর শেষকৃত্য হয়েছিল তাঁর পঞ্চাশ বছর আগের করা নকশার রাষ্ট্রপতি ভবনে, ব্রাসিলিয়াতে। তাঁর স্মরণে ম্যুরাল শিল্পী এদোয়ার্দো কোবরা সাও পাওলোর বাণিজ্যিক এলাকার এক সুউচ্চ ভবনের দেয়ালে দীর্ঘ একশ তেষট্টি ফুটের এক বর্ণিল দেয়ালচিত্র সৃষ্টি করেছিলেন।

অসকারকে বক্র রেখার রাজা বা বক্রতার নৃপতি বলে সম্বোধন করা হতো। তিনি বলতেন, ‘তোমাকে বিশাল পরিসরকে আয়ত্তে আনতে সহজাত ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বক্র রেখার সাহায্যেই সমাধান করতে হবে। যা পুরনো তা-ই নতুন।’ তিনি এমনও বলতেন, ‘আমাকে সেটাকেই নকশা করতে হবে, আমাকে আমার উৎসের সঙ্গে এবং তার মধ্য দিয়ে যা উৎসারিত করবে, যেখানে আছে আমার আদি শিকড় আর আমার প্রিয় স্বদেশ। এবং সেখানেই আমার আনন্দ।’

২০০০ সালে তাঁর মেমোয়ের্স-কার্ভস অব টাইম বা সময়ের বক্রতা শীর্ষক একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল। এই মুক্ত স্বাধীন রীতিবিরুদ্ধ বহুমাত্রিক শিল্পী-ভাস্কর-স্থপতি গানও লিখেছিলেন, এক গায়ক এদু ক্রিয়েগার সেটিকে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন, ট্রাংকুইলো কম আ ভিদা – শান্তি আসুক এই জীবনে। তাঁর গানের সঙ্গে আমাদের সবার প্রার্থনা – শান্তি, চিরশান্তি বিরাজ করুক, চির বহমান, চিরটা কাল, মহান স্থপতি অসকারের পরজীবনজুড়ে। n

 

ঋণ স্বীকার

l   লারুসে এনসাইক্লোপিডিয়া অব মডার্ন আর্ট (১৮০০-বর্তমানকাল), সম্পাদক – রেনে হুইঘে।

l   এ হিস্টোরি অব মডার্ন আর্ট, সম্পাদক – এম এইচ আরনাসন।

l   এ হিস্টোরি অব আর্ট, সম্পাদক – স্যার লরেন্স গোয়িং।

l   কনটেম্পোরারি আর্কিটেক্টস, সম্পাদক – মুরিয়েল এমানুয়েল।

l   স্যার বেনিস্টার ফ্লেচার্স এ হিস্টোরি অব আর্কিটেকচার, সম্পাদক – জন মাসগ্রোভ।

l   দি ফনটানা ডিকশনারি অব মডার্ন থট, সম্পাদক – অ্যালান বুলক, অলিভার স্ট্যালিব্রাস এবং স্টিফেন ট্রম্বলি।

l   ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের বিভিন্ন তথ্যাবলি।

Leave a Reply