মা হ মু দ আ ল জা মা ন
শিল্পসাধক সফিউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে একটি মনোগ্রাহী গ্রন্থ বেরোল ইতালির বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে। ৭ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যায় বেঙ্গল শিল্পালয়ে এ-গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তারা আন্তর্জাতিক মানের এ-গ্রন্থটিকে এ-দেশের চিত্রকলা চর্চার ইতিহাসে সবদিক থেকে একটি তাৎপর্যময় সাংস্কৃতিক ঘটনা ও প্রকাশনা বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটি পৃথিবীর যেকোনো সম্ভ্রান্ত বইয়ের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে। মুদ্রণ পারিপাট্যে, বিষয়গুণে, অঙ্গ-সৌষ্ঠবের নান্দনিকতায় চিত্রকলা বিষয়ক গ্রন্থটি অনন্য একটি প্রকাশনা বলে বিবেচিত হয়েছে। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ও সঞ্চালন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এ-গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁরা শিল্পী সফিউদ্দীনের সৃজন, শিল্প-মনীষা ও ব্যক্তিত্বের ধরন সম্পর্কে আলোকপাত করেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আজিজুল হক ও কায়সার হক। এছাড়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, বাংলাদেশে ইতালির রাষ্ট্রদূত জর্জিও গুইলিয়েলমিনো ও শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের কনিষ্ঠ পুত্র শিল্পী আহমেদ নাজির। সূচনায় বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরী এ-গ্রন্থ প্রকাশনার পটভূমি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। গ্রন্থটির সম্পাদক রোজা মারিয়া ফালভো।
গ্রন্থটিতে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের দীর্ঘদিনের একাব্রতী শিল্পসাধনার ও চর্চার বিবরণ, উত্তরণ ও সিদ্ধি বিধৃত হয়েছে। তিনি এই চর্চার মধ্যে দিয়ে কেমন করে এদেশের শিল্প-আন্দোলনকে বহুধারার সৃজনে আলোকাভিসারী ও নতুন মাত্রা দান করেছেন তিনটি প্রবন্ধ ও একটি সাক্ষাৎকারে সে-বিবরণ ধরা আছে।
তিনি এদেশের ছাপচিত্রের জগতে অনন্যসাধারণ এক শিল্পগুরু। সমকালীন চিত্রের ভুবনে প্রধান শিল্পীও বটে। তাঁর সৃজনী উদ্যম, শিল্পিত মানস ও শিক্ষাব্রতী হৃদয়ের স্পর্শে আলোড়িত এবং সিক্ত হয়ে এদেশের অগণিত শিল্পী তাঁদের শিল্পীসত্তাকে আলোকাভিসারী করে তুলেছেন।
সফিউদ্দীন আহমেদ শিল্পীজীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। সকল মাধ্যমের কাজে তাঁর আশ্চর্য দক্ষতা রয়েছে। উৎকর্ষে ও সংখ্যার বিবেচনায় তাঁর সৃষ্টিও কম তাৎপর্যবাহী নয়। অথচ নিজে নিভৃতচারী ও প্রচ্ছন্নে থাকতে ভালোবাসেন বলে অজস্র কাজের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন দেশে কোনো প্রদর্শনী করেননি। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে ১৯৫৯ সালে, নিউ ভিশন আর্ট গ্যালারিতে। বেঙ্গল শিল্পালয় বহু যতœ ও শ্রমে দুটি প্রদর্শনী করেছে।
সফিউদ্দীন আহমেদ কলকাতা আর্ট ইশকুলে (১৯৩৬-৪২) অধ্যয়নকালে ড্রইংকে বিশেষ যতœসহকারে আয়ত্ত করেছেন। সেজন্যে সুদূর সাঁওতাল পরগনা দুমকা আর গঙ্গা নদী-তীরবর্তী অঞ্চল তাঁর নৈমিত্তিক বিচরণের ক্ষেত্র ছিল। মানুষ ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং ড্রইং করার জন্যই তিনি এসব অঞ্চলে নিয়মিত যেতেন। এ-ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দিতে বলতেন তাঁর প্রাণপ্রিয় শিক্ষক রমেন চক্রবর্তী ও অকালপ্রয়াত শিক্ষক আবদুল মঈন। আর অনেকদিন তিনি আর্ট কলেজ থেকে হেঁটে বেশ দূরে কাকুরগাছি গেছেন তাঁর আরেক শিক্ষক প্রহ্লাদ কর্মকারের স্টুডিওতে ড্রইংয়ের পাঠ নিতে। সেই সময় সাঁওতালদের জীবন ও গঙ্গা-তীরবর্তী মানুষজনের নানা অভিব্যক্তিকে অবলম্বন করে তিনি অজস্র ড্রইং করেছেন। পরবর্তীকালে ছাপাই ছবি ও তেলরঙে যখন সাফল্য অর্জন করেন এবং ভারতে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন, তখন এই অবলোকন তাঁর চিত্র-সাধনায় হয়ে ওঠে এক অবলম্বন। তাঁর সকল সৃষ্টির মাধ্যমে ড্রইংই বিশেষ মর্যাদা, ভিন্ন আদল ও মাত্রা নিয়ে
রূপান্তরিত হয়েছে। ড্রইং তাঁর যে-কোনো সৃষ্টির বীজ হয়ে ওঠে এবং তাঁর নির্মাণের বোধের সঙ্গে লগ্ন ও একাত্ম হয়ে যায়।
পঞ্চাশের দশকে তিনি লন্ডনে (১৯৫৬-৫৮) চিত্রচর্চা ও শিক্ষাগ্রহণ করেন। পাশ্চাত্যে এই শিক্ষাগ্রহণ আধুনিকতার নব্যবোধ শেকড়সন্ধানী শিল্পিত মানসযাত্রা তাঁর সকল মাধ্যমকে নতুন মাত্রা দান করেছিল।
পরবর্তীকালে তিনি নানা অভিজ্ঞতা, নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ও অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে এদেশের ছাপাই ছবিরও শিল্পগুরু হয়ে ওঠেন।
আজীবন শিক্ষাব্রতী, শিল্পধ্যান নিমগ্ন ও নিভৃতচারী সফিউদ্দীন ড্রইংয়ে যে কত দক্ষ এবং ড্রইং তাঁর সৃষ্টিভুবনে যে কতভাবে ছাপ রেখে যায় আমরা তাঁর কিছু নিদর্শন দেখেছি। এখানে জীবনের নানা অনুষঙ্গ, ভঙ্গি, নানা মুখ, রমণীদেহের সুডৌল ছন্দ, ফল-বিক্রেতা, ধীবর, নদী, শ্রমজীবী মানুষের নিরন্তর জীবনসংগ্রাম, মাছ ও জাল তাঁকে যেভাবে আলোড়িত করেছে তা তিনি সৃজনখেলায় ধরে রেখেছেন। সফিউদ্দীন নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ও এই শতাব্দীর সূচনায় চারকোল এবং ক্রেয়নে বেশ কিছু ড্রইং করেছেন। কালো রং নিয়ে তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ মন সর্বদাই জিজ্ঞাসা-উন্মুখ ছিল। সেজন্যে ছাত্রাবস্থা থেকেই কালো রঙের প্রতি তাঁর মোহ জন্মেছিল। কালো রং কখনো তীব্র ও তীক্ষè হয়ে উঠেছে তাঁর কুশলী হাতে। গহন কালো এখানে এক অর্থ যোজনা করেছে। কালো রংও যে কত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং আলোর অধিক হয়ে যায়, এই রেখাগুলো যেন তারই প্রমাণ। গতানুগতিকতামুক্ত এসব ড্রইংয়ে তিনি চিত্রের গুণাবলি সঞ্চার করেছেন। ড্রইংয়ে এ-ধরনের নিরীক্ষা খুব একটা দেখা যায় না। রেখার সাবলীল ছন্দের মধ্যে তীব্র ও তীক্ষèভাবে অনুভব করা যায় বিষয়ের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। ফর্মপ্রধান এই সৃষ্টিগুচ্ছে তাঁর চিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপও প্রতিফলিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের চিত্রসাধনায় এই রেখাসমূহ বিভাবসঞ্চারী হয়ে উঠেছে।
এ-গ্রন্থটিতে তাঁর শিল্পীজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং উপরোল্লিখিত ড্রইং, বিভিন্ন সময়ে করা ছাপচিত্র ও চল্লিশের দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে করা তেলরঙের কাজের ধারাবাহিক প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে। এই মুদ্রিত ছবিগুলো খুবই উন্নতমানের। গ্রন্থটি বেঙ্গল শিল্পালয়ে পাওয়া যাবে।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011