হা মি দ কা য় সা র
যে দেশে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খঁাঁর মতো সুরসম্রাটের জন্ম হয়েছে – সেদেশে নদীর বুক কখনই শুকিয়ে যেতে পারে না, সেদেশের আকাশ কখনই শ্বাসরুদ্ধকর কার্বন ডাইঅক্সাইডে আচ্ছন্ন থাকতে পারে না, সেদেশের মৃন্ময়ী মাটির চিন্ময়ী স্বাদ কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে পারে না, সেদেশের মানুষের মনের বাৎসল্য কিছুতেই মুছে যেতে পারে না – হতে পারে না জিঘাংসুপ্রবণ। সেই স্বর্গীয় বার্তাটাই যেন ছড়িয়ে দিয়ে গেল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রাণভোমরা ঢাকায় বসা মার্গীয় বা শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর বেঙ্গল ফাউন্ডেশন-নিবেদিত ‘বেঙ্গল আইটিসি এসআরএ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১২’।
কেন এই আশাবাদ, শিল্পের এই স্তুতি? কেননা ২৯ ডিসেম্বর সারারাত সংগীত উপভোগ করে ৩০ ডিসেম্বর ভোর পাঁচটায় – রাত জাগার পুরো ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে আমি হেঁটে হেঁটে বনানী আর্মি স্টেডিয়াম থেকে গুলশান নিকেতনে যাওয়ার জিয়নীশক্তি এই সংগীত-সঙ্গ থেকেই যেমন অর্জন করেছিলাম, তেমনি আবিষ্কার করেছি যেন শাস্ত্রীয় সংগীতের এই প্রসাদগুণে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী অধ্যুষিত ঢাকা পরিণত হয়েছে সন্তের শহরে। তা না হলে কীভাবে শুধু আমি একাই নই, আরো অনেক মানুষ নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে? হেঁটে যারা ফিরছিল তারা হয়তো আমার মতো কোনো এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে অথবা শখ করেই ফিরছিল, কারণ বাড়ি ফেরার সমস্ত আয়োজনই করে রেখেছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। প্রতিটি রাস্তার উদ্দেশেই ছিল বিআরটিসির দোতলা বাস। সিএনজি, ট্যাক্সিসহ অন্যান্য যান তো ছিলই।
যাহোক, আমি শুধু আমার কথাই বলি, সুবহে সাদিকের সেই নির্জনতায় আমার হেঁটে যাওয়া ছাড়া বুঝি গত্যন্তর ছিল না। কেননা আমি তখনো অজয় চক্রবর্তীর রাগ বন্দিশে আচ্ছন্ন হয়ে আছি, সেই রাগ থেকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে চাইছিলাম না। সেদিনকার আসরের শেষ শিল্পী ছিলেন তিনি। পাতিয়ালা ঘরানার বর্তমান সময়ের যোগ্যতম প্রতিনিধি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী প্রথমে শুনিয়েছিলেন রাগ আহির ললিত। এই রাগের স্রষ্টা সদ্য প্রয়াত পণ্ডিত রবিশঙ্কর। অজয় চক্রবর্তী বিনয় অভিভাষণে গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে দর্শকের প্রতি বিনয় সম্ভাষণের মাধ্যমে নিমগ্ন হয়ে রইলেন দীর্ঘক্ষণ আহির ললিতে। এরপর তিনি আবির্ভূত হলেন স্বরূপে। যেন ভাঁজ খুলে বের হয়ে এলো তাঁর আসল ক্ষমতার পরিচয়। প্রচলিত বন্দিশের পরিবর্তে গাইলেন স্বরচিত বন্দিশ – ‘চহুদিশ পান্ছি মাচায়ে শোর, রাতভর গুণীজন গায়ে বাজায়ে, আজ আনন্দময় ভোর।’ পরিবেশনের আগে জানালেন তিনি, এটি রচনা করেছেন মাত্র আধঘণ্টা আগে। বিলম্বিত একতালে ‘জাগো সাভেরা’ গেয়ে গেয়ে তিনি যে ভোর নিয়ে এলেন, আমি হাঁটছিলাম তারই আলোর বোধ হৃদয়ে নিয়ে।
শুধু কি অজয় চক্রবর্র্তী! কার পরিবেশনাটা খারাপ লেগেছে? কার পরিবেশনা থেকে সামান্যও বিচ্যুত থাকা গেছে? ওস্তাদ আলী আহমেদ হোসেনের সানাই, ওঙ্কার দাদারকারের ভোকাল, ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খানের সরোদ, বিদুষী সুজাতা মহাপাত্রর ওড়িশি নৃত্য, ওয়াসিম আহমেদ খানের ভোকাল, ওস্তাদ শাহিদ পারভেজের সেতার, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকারের ভোকাল, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের সরোদ – সবই মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। অথচ আসরে যাওয়ার আগে কত সংশয়ই না ছিল, উচ্চাঙ্গসংগীতের রসাস্বাদন করতে পারব তো? ছ’রাগ এবং ছত্রিশ রাগিণীর কিছুই তো জানি না, কান কি সেভাবে তৈরি হয়েছে? কীভাবে তৈরি হবে? নকল ঘিয়ের পোলাও খেতে খেতে কি আসল ঘিয়ের স্বাদ সহ্য হয়? তাছাড়া আমাদের দেশে তো সেভাবে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চাই হয় না তেমন। সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে আছে এ মাধ্যমটি। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যেমন, তেমনি অধ্যবসায়ের অভাবেও। এখনকার শিল্পীদের প্রবণতা হলো কীভাবে রাতারাতি খ্যাতিমান ও অর্থবান হওয়া যায়, চ্যানেল সংস্কৃতির জোরে গান এখন শোনার চেয়ে দেখার বস্তু হয়ে উঠেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তো কারোরই এই উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরের প্রতি আকর্ষণ থাকার কথা নয়।
আমি না হয় একসময় সচিত্র সন্ধানীতে চাকরি করার সুবাদে সুরসন্ধানী নাম নিয়ে গানের কিছু খোঁজখবর পাঠককে জানাতে গিয়ে গানের ডালিতে যাওয়ার কারণে শাস্ত্রীয় সংগীতের অনেক দিকপালের অমর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। নিয়মিত শোনা হয়েছে রবিশঙ্করের সেতার, ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদ, শিবকুমার শর্মার সন্তুর, ভীমসেন যোশীর ভোকাল, বিসমিল্লাহ খানের সানাই, বড়ে গোলাম আলী খানের ভোকাল, ওস্তাদ আমার খাঁ সাহেব, কিশোরী আমেনকারের ভোকাল। সে কারণে কান যেমন-তেমন, মন কিছুটা তৈরিই ছিল। কিন্তু যাদেরকে সুরসন্ধানীর জন্য সংগীতের খোঁজখবর নিতে হয়নি, তারা কীভাবে শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরক্ত হয়েছে? হয়েছে বোধকরি এদেশে জন্ম নেওয়ার কারণেই। ২৯ ডিসেম্বর আর্মি স্টেডিয়ামে বিকেল পাঁচটার সময় পৌঁছে আমার এ কথাটাই মনে হলো। এদেশের শিরায় শিরায় যেমন নদী, বিল, খাল; এদেশের মানুষের শিরায় শিরায়ও তেমনি সুরের ধারা। সে কারণেই সিলেটের হাওর অঞ্চলকে ঘিরে যেমন সংগীতের এক সমৃদ্ধ ঘরানা তৈরি হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রকৃতিও সে অঞ্চলে জন্ম দিয়েছে অনেক সংগীত মহীরুহের। আর দেশের প্রান্তে প্রান্তে তো সংগীতের একটা বিশুদ্ধতার ধারা প্রবাহিতই আছে। সেই মনন যে জনপ্রিয় এবং চটুল ধারায় হারিয়ে যায়নি, তারই প্রমাণ মিলল যেন আসরের প্রথম সন্ধ্যা থেকেই। আয়োজকরাও যেন এই বিশাল আয়োজনকে উপযুক্ত সাজ দিতে প্রস্তুত হয়েই ছিল। প্যান্ডেল, সাজসজ্জা, মঞ্চ, আলোকসজ্জা, চারদিকে বিশাল বিশাল স্ক্রিন, খাবারের আয়োজন সবকিছুতেই রুচির ছাপের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয়তার দিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে। উচ্চাঙ্গসংগীতের দিকপালসহ বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীতসাধকদের ছবি এবং পরিচিতি তুলে ধরে আয়োজন করা হয়েছে একটি প্রদর্শনীরও। পুরো উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে, প্রথম দিনটি উৎসর্গ করা হয়েছে সংগীতসাধক ওয়াহিদুল হককে। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এই সংগীতজ্ঞ বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক-বাহকদের অন্যতম একজন।
সন্ধ্যা ছয়টায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণ ও আইটিসি এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
এরপরই বাঙালি জীবনের সঙ্গে যে বাদ্যটি জড়িয়ে গেছে গভীর বন্ধনে, যার সুর ছাড়া বিয়ের মতো অনুষ্ঠান মধুর হয়ে ওঠে না, সেই সানাইবাদনের মাধ্যমে শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। উৎসবের আবহ ছড়িয়ে পড়তে আর দেরি হলো না। ততক্ষণে আসর মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। দশ হাজারের মতো মানুষ মাঙ্গলিক ধ্বনিতে সেই যে বিমোহিত হতে শুরু করল, যার রেশ চার রাত ধরেই জিইয়ে থেকেছে। সানাই বাজালেন বেনারস ঘরানার প্রবীণ সানাইশিল্পী আলী আহমেদ হোসেন খান। ইমন রাগের এক সুনিপুণ পরিবেশনা করলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সংগত করেন হাসান হায়দার খান ও আহমদ আব্বাস খান। তবলায় ছিলেন পণ্ডিত সমর সাহা। তাঁদের যৌথ পরিবেশনা শ্রোতাদের তৃপ্ত করেছে।
এরপর সেতার পরিবেশন করেন ইতিওয়াহ ঘরানার ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ। তিনি প্রথমে বাগেশ্রী রাগে আলাপ জড়িয়ে শ্রোতাদের মগ্ন করে রাখেন, এরপর জোড় ও ঝালায় শ্রোতাদের মগ্নচৈতন্যে শিস বাজিয়ে চলেন। তাঁকে তবলায় যোগ্য সংগত দেন ওস্তাদ আল্লারাখার সুযোগ্য শিষ্য পণ্ডিত যোগেশ শামসি। সেতারের পাশাপাশি মোহাবিষ্ট থাকা গেল তবলায়ও।
সেতারের পর আগ্রা ঘরানার শিল্পী ওয়াসিম আহমেদ খানের ভোকালেও জমে উঠতে সময় লাগল না অডিয়েন্সের। তিনি পরিবেশন করলেন রাগ চন্দ্রকোষ। তাঁকে সংগত করেছেন সঞ্জয় অধিকারী। অন্য কার কী মনের অনুভূতি হয়েছে বলতে পারব না, ওয়াসিম খানের স্বর প্রক্ষেপণে এমনই এক ভাবলোকের জন্ম হয়েছিল আমার, চোখ বুজে দেখছিলাম, সুরের ঝংকারে ঝংকারে বুড়িগঙ্গার সব আবর্জনা সরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে কোথায়। বুড়িগঙ্গার পানি আবার আগের মতো নিটোল হয়ে উঠেছে, অনেক রঙের মাছরাঙা পাখির আবির্ভাব হতে শুরু করেছে সেখানে, আর সে ফিরে পাচ্ছে গভীরতা।
ওয়াসিম আহমেদ খানের পরে এলেন বাংলাদেশের সরোদিয়া ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খান। স্বভাবতই দর্শকদের মধ্যে বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখা গেল। এত বড় একটি আসরে এই প্রথম বাংলাদেশের একজন শিল্পী বলে কথা! ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁরই বংশধর, ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খান দুপাশে দুই মেয়েকে বসিয়ে রেখে যেন জানান দিলেন, বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীতের ভবিষ্যৎ এখনো আছে, সব হারিয়ে যায়নি এখনো, সাধনা-আরাধনা-রীতিসিদ্ধ। তিনি বাজালেন রাগ ঝিঁঝিট। আলাপ-বিস্তারে ভালোই ছিলেন।
ওস্তাদ শাহাদত হোসেন খানের পরিবেশনার পর দর্শক নয়ন সার্থক করতে ওড়িশি নৃত্যের সম্ভার নিয়ে এলেন বিদুষী সুজাতা মহাপাত্র। সুজাতা শুরু করেছেন মঙ্গলাচরণ ও গুরুবন্দনা দিয়ে। এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘নৃত্যের তালে তালে হে নটরাজ’ গানটির সুরে পরিবেশিত নৃত্যটি ছিল মনোমুগ্ধকর। চারুকেশী ও মিশ্র খাম্বাজ রাগের নৃত্যরূপে তিনি অনন্য। সুজাতার প্রতিটি পরিবেশনাই ছিল দৃষ্টিনন্দন, নিপুণ মুদ্রার সঙ্গে ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ মুখভঙ্গি।
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকারের ভোকালে পাওয়া গেল অন্যরকমের এক গভীর স্বাদ। তিনি পরিবেশন করলেন রাগযোগ।
এর মধ্যেই যে কখন গভীর রাত পেরিয়ে শেষ প্রহর শুরু হয়েছে, কেউ বলতেই পারব না। দর্শক একই আবেগ-উচ্ছ্বাস নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে শুনছেন গান। আর সময় করে কখনো কফি পান, কখনো ডিনারটা সেরে নিয়েছেন।
শেষ প্রহরে সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার বাজালেন রাগ ললিত। ইনি ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর কাছেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তেজেন্দ্রনারায়ণ আলাপে আর জোড় বিস্তারে অনায়াসেই রসের সঞ্চার করেছেন। সবশেষে ছিলেন অজয় চক্রবর্তী, যার কথা আগেই বলা হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় রাত শুক্রবার ছিল বলে জনসমাগমও হয়েছিল বেশি। আগের দিন যাঁরা এসেছেন, তাঁরা তো এসেছেনই – নতুন নতুন সংগীতপিপাসুতে প্যান্ডেল ছাড়িয়ে সারা মাঠ সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। এদিনের অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয়েছিল ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁকে। আনুষ্ঠানিকতায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও ট্রান্সকম গ্র“পের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। একই সঙ্গে ছিলেন আইটিসি এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। আবুল খায়ের ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রতি সম্মান জানাতে একটি মহাসড়কের নাম উনার নামে রাখার প্রস্তাব করেন।
আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর মঞ্চে আসেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য। তিনি গেয়ে শোনালেন রাগ শুদ্ধকল্যাণ। অনেক কঠিন রাগকে অনেক সহজ করেই গাইলেন। তরুণ হলেও তিনি যে অত্যন্ত কুশলী শিল্পী সে পরিচয় রাখলেন। তবলায় সমান পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন সন্দীপ ঘোষ।
এরপর উনিশ বছরের তরুণ যশোবন্ত বৈষ্ণব তবলা বাজিয়ে সবার মন কেড়ে নিলেন। আল্লারাখা কলাবন্তের সারেঙ্গি ছিল তাঁর সঙ্গী। দুজনের যুগলবন্দি দারুণ জমে উঠেছিল।
সন্দীপ ভট্টাচার্য গাইলেন কল্যাণ ঠাটের রাগ কেদার। তবলা সংগতে ছিলেন আগ্রা ঘরানার আকরাম খাঁ। শ্রোতারা বিমোহিত হয়েই শুনলেন তাঁর পরিবেশনা।
ওস্তাদ রশিদ খানের নাম শুনেই হাততালিতে মুখরিত হলো পুরো প্যান্ডেল। লক্ষণীয় যে, কলকাতাকেন্দ্রিক ক্ল্যাসিক্যাল বেইজড শিল্পীরা এদেশে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, যেমন ওস্তাদ রশিদ খান, অজয় চক্রবর্তী, ইদানীং কৌশিকি দেশিকান। প্রত্যাশা অনুযায়ীই আসর মাত করলেন ওস্তাদ রশিদ খান। রামপুর-সাহাসওয়ান ঘরানার রশিদ খান এরই মধ্যে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। রশিদ খান গাইলেন মারওয়া ঠাটের পুরিয়া-কল্যাণ। বেশ মেজাজে ছিলেন তিনি, দিল ছেড়ে গাইলেন ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর গাওয়া সেই বিখ্যাত ঠুমরিটি। সার্থকভাবেই গাইলেন।
কিরানা ঘরানার ওস্তাদ মাশকুর আলী খান পরিবেশন করলেন রাগ মালকোষ।
পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত কিছুটা অসুস্থতা নিয়েই গাইলেন, তাঁর সঙ্গে সরোদে ছিলেন কৌশিকি। বুদ্ধদেব দাসগুপ্তের পরিবেশনায় পাওয়া গেল অভিনবত্বের ছাপও। তিনি পিলু রাগাশ্রিত ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ এই রবীন্দ্রসংগীতের সুরকে বন্দিশরূপে ব্যবহার করে তার উদ্ভাবন শোনালেন সরোদে।
পরের শিল্পী কৌশিকি দেশিকান গাইলেন বসন্ত-মুখারিতে ‘নায়না মোরে বাওরে দেখনা চায়ে তুমকো শাম সাভেরে’। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও বাবা অজয় চক্রবর্তীর কাছে তালিম পাওয়া কৌশিকি দেশিকান হিন্দুস্তানি কণ্ঠসংগীতের একালের অন্যতম সেরা শিল্পী। বসন্ত রাগটিকে তিনি গাইলেন অসাধারণ পারঙ্গময়তায় – সুরের সুনিপুণ প্রয়োগ এবং স্বরের সূক্ষ্ম কারুকাজে। কৌশিকির পরের পরিবেশনা ছিল কানাড়ায় দ্রুত তিনতালে গাওয়া ‘ভায়ো ভোর ভোর করে শোর শোর’। এটির পরিবেশনাও ছিল অনবদ্য। কৌশিকির গানে গানেই ভোরের আভাস ফুটে ওঠে।
এ রাতের শেষ শিল্পী ছিলেন সংগীতের আরেক কিংবদন্তি-পুরুষ পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। জগৎজুড়ে খ্যাতিমান এই শিল্পী কাশ্মীর লোকবাদ্য সন্তুরকে ধ্র“পদী সংগীতের বাদ্যযন্ত্রে পরিণত করেছেন। সন্তুরের আদি উৎস অবশ্য পারস্যে। শিবকুমার বাজালেন রাগ অন্তরধ্বনি। রাগটি তাঁরই সৃষ্টি। শিবকুমার জানালেন, এই রাগ তিনি সৃষ্টি করেছেন সাধনার, বিশেষত যোগসাধনার অনুষঙ্গ হিসেবে। তাঁর বাজনায়ও সেই ধ্যানমগ্নতা আছে। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন যোগেশ শামসি। শিবকুমারের সন্তুরের মুগ্ধতা নিয়ে িস্নগ্ধ ভোরে বাড়ি ফেরা হলো।
পর পর দুরাত জাগার ক্লান্তি দেখি স্পর্শ করেনি অনেককেই। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় আসরে গিয়েই মনে হলো। প্রতিরাতেই অভূতপূর্ব সমাবেশ ঘটছে কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, নাট্যকর্মী, সিনেমাশিল্পীসহ অগণিত মিডিয়াব্যক্তিত্বের। করপোরেটজগৎসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের উপস্থিতিও আছে সমানভাবে। সাংস্কৃতিক মেলবন্ধের এমন গুলজার করা মাহফিল বোধহয় এই শহর অনেকদিন পায়নি। পণ্ডিত উদয়শঙ্করকে উৎসর্গীকৃত এদিনের আনুষ্ঠানিকতায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী এবং চিত্রাভিনেত্রী ও সমাজকর্মী শাবানা আজমি। সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং আইটিসি এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর।
এদিন প্রথমেই শশাঙ্ক মুকতেদার ‘তরণ মোরি লাগি রে’ বন্দিশ দিয়ে শুরু করলেন দেশ রাগ। গোয়ার এই শিল্পী আলাপে, বিস্তারে ও তানে ছিলেন স্বচ্ছন্দ; তার মীড়ের কাজও প্রশংসনীয়।
এরপর, আবীর হোসেন সরোদে বাজালেন রাগ পুরিয়া-ধনেশ্রী। আলাপ, জোড় ও ঝালা – প্রতিটি অংশেই তাঁর পরিবেশনা শ্রোতাদের তৃপ্ত করেছে।
আবারো পাওয়া গেল বাংলাদেশের দুজন উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পীকে। এবাদুল হক রাগ হেমন্ত বাজালেন সেতারে। প্রিয়াঙ্কা গোপ শোনালেন রাগেশ্রী।
ওস্তাদ মাশকুর আলী খানের পুত্র আরশাদ আলী খানের ললিত রাগটি ছিল সুপরিবেশিত।
সেতারে যোগকোষের বাদনে পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অসাধারণ। তাঁর বাদনে পাওয়া যায় ধ্র“পদ ও খেয়ালের যুগল মিশ্রণ।
সময় যত বাড়তে লাগল মানুষের আগমনও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। কারণ শেষের দিকের শিল্পীদের তালিকায় ছিলেন দুই কিংবদন্তি শিল্পী বিদুষী গিরিজা দেবী এবং পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। তাঁরা দুজনই ব্যক্তিত্ব হিসেবেও বেশ উজ্জ্বল এবং সপ্রতিভ। দুজনই যেন বয়সকে জয় করে নিয়েছেন প্রতিভার দ্যুতি জ্বালিয়ে।
গিরিজা দেবী মঞ্চে আসীন হয়ে প্রথমেই বললেন, ‘ম্যায় উমর দরাজ হো গেয়ি, পর সংগীত সাধনা মে উমর নেহি হোতি’ – আমার অনেক বয়স হয়েছে, কিন্তু সংগীতসাধনার কোনো বয়স নেই। এই কথা যে কত সত্য, তা একটু পরেই প্রমাণ হয়ে গেল তিরাশি বছর বয়সের এই শিল্পীর পরিবেশনায়।
প্রথমে তিনি গাইলেন বিলম্বিত ও দ্রুত একতালে বেহাগ। এই বয়সেও তাঁর কণ্ঠসামর্থ্যে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। গিরিজা দেবীর অসাধারণ পরিবেশনায়, মধ্যরাতে বিলাওয়াল ঠাটের এই রাগটির রোমান্টিক ভাব যেন কী দারুণ ফুটে উঠল। এরপর তিনি গাইলেন ঠুমরি ‘সব নিশি জাগি তুমহার মিলন কো’। বেনারসের এই শিল্পী ঠুমরিটি পরিবেশন করেছেন তাঁর সহজাত অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে। এরপর শোনা গেল ‘ঝনন ঝনন মোরি বাজে পায়েলিয়া’। দূরে যাওয়া প্রেমাকাক্সক্ষীর প্রতি অভিমানী নিবেদন ‘যাও ওহি তুম শ্যাম যাহা সারি রৈন জাগে উও’। সরস ও প্রাণময় উপস্থাপনায় তিনি আসরকে ভরিয়ে রাখলেন।
উদয়শঙ্করের পর বিরজু মহারাজের মতো সম্ভবত কোনো নৃত্যশিল্পীই এতটা যশ ও খ্যাতি পাননি। লক্ষেèৗয়ের কত্থক নৃত্যের এই প্রসিদ্ধ শিল্পী পণ্ডিত বিরজু মহারাজকে কিন্তু ঢাকার মঞ্চ পূর্ণাঙ্গভাবে পেল না। বয়স হলেও সেটা উনার ক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয় কিছু নয়, তিনি চিরতরুণের মতোই ফুর্তিময়, কিন্তু তিনি ছিলেন কিছুটা অসুস্থ। সে কারণেই তাঁর পূর্ণাঙ্গ পরিবেশনা থেকে বঞ্চিত থাকতে হলো, কিন্তু তারপরও তিনি যে নৃত্যমুদ্রা প্রদর্শন করলেন, তা বহুদিন দর্শকের মানসপটে অসাধারণ ইমেজ হিসেবে থেকে যাবে। অনবদ্য পরিবেশনায় তিনি প্রকৃতি ও জীবনের সর্বত্র যে তাল-লয়ের প্রকাশ আছে, এই বিষয়টিই প্রদর্শন করে গেলেন তাঁর অসাধারণ নিপুণ নৃত্যমুদ্রায়। তাঁর ভাষায়, ঘুঙুর দিয়ে তিনি প্রকৃতির লয়-ছন্দকে রচনা করেন। মুদ্রা ও বোলের ছোট ছোট অভিব্যক্তিতে তাঁর পরিবেশনায় ছিল ধ্র“পদী আমেজ।
গিরিজা দেবী ও বিরজু মহারাজের সম্মিলিত পরিবেশনাও ছিল মনে রাখার মতো। গিরিজা দেবী গাইলেন, ‘হে বৈরণ রে কোয়েলিয়া’ ও ‘লারে কঙ্কর মোহে লাজ দে’। তাঁর গাওয়া চৈতির সঙ্গে অভিব্যক্তি দিলেন বিরজু মহারাজ।
বিরজু মহারাজের নৃত্যে সঙ্গী ছিলেন তাঁরই শিষ্যা শাশ্বতী সেন। যাঁরা সত্যজিৎ রায়ের শতরঞ্জ কি খিলাড়িতে দেখেছেন, তাঁরা সবাই মুগ্ধ হয়েছেন এই মেধাবী শিল্পীর কত্থক দেখে। স্বপ্রতিভায় উজ্জ্বল এই শিল্পী পরিবেশন করলেন ‘অহল্যা-উদ্ধার’ নামে একটি অনবদ্য নৃত্য।
গিরিজা দেবী ও বিরজু মহারাজের সঙ্গে তবলায় ছিলেন সঞ্জয় অধিকারী এবং সারেঙ্গি বাজিয়েছেন সারওয়ার হোসেন। দুজনেরই সংগত ছিল মনোমুগ্ধকর।
কুমার বসুর তবলাবাদনও ছিল সংগীতরসিকদের জন্য এক পরম পাওয়া। পণ্ডিত কিষণ মহারাজের শিষ্য, বেনারস ঘরানার কুমার বসু তাল-লয়ের মাধুর্যে ভাবের এক বিস্ময়কর পুলকময় জগতে বিহার করিয়ে আনতে পারলেন সার্থকভাবে।
এ রাতের শেষ শিল্পী ছিলেন আগ্রা ঘরানার বিদুষী শুভ্রা গুহ। হিন্দুস্তানি সংগীতে তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত। রাতের শেষ প্রহরে তিনি শুরু করলেন রাগ টোড়ি। আলাপ-বিস্তার-তান সবদিকেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি। মধ্যরাতে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠান শেষ হলো ভোরের আভাস দিয়েই।
অনুষ্ঠানের শেষ দিন শনিবার ভিড় জমতে খানিক দেরি হলো। কিন্তু ধীরে ধীরে লোকসমাগম বাড়তেই থাকল এবং শেষরাতে যেন উপচে পড়ল ভিড়। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁকে উৎসর্গ করা এদিন আসরের প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। আরো বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং আইটিসি এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর।
প্রথমেই ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায় শোনালেন মারু-বেহাগ। এরপর বিলম্বিত একতালে শুরু করলেন ‘মিতুয়া ম্যায় ক্যায়সে আউ তোরে পাস’। এরপরে ত্রিতালের বোল ছিল ‘পিয়া বিনে তড়প্তে নয়না’। তাঁর সঙ্গে তবলায় ছিলেন ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। দুজনের সওয়াল-জওয়াব উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের আলিফ লায়লা সেতারে বাজালেন দেশ রাগে
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর একটি রচনা। বেশ সাবলীল ছিল তাঁর পরিবেশনা।
এরপর ভিন্ন স্বাদের আমেজ নিয়ে এলেন কর্ণাটকী সংগীতের অন্যতম প্রসিদ্ধ গায়িকা পদ্মশ্রী অরুণা সাইরাম। মালকোষ রাগে ‘সর্বমঙ্গালম মঙ্গল’ গেয়েই তিনি শ্রোতাদের মনোযোগ কেড়ে নিলেন। এরপর যথাক্রমে পরিবেশন করলেন ‘রাধা কারহারা প্রিয়া’, দক্ষিণি সংগীতের তানসেন নামে খ্যাত ত্যাগরাজার অসাধারণ এক রচনার সুমধুর পরিবেশনা। এরপর নমদম। দক্ষিণি সংগীতের রেওয়াজ অনুযায়ী শ্রীগিরিধর মৃদঙ্গমে এবং ঘটমে কুচিভোটলাও দেখালেন তাঁদের বাদনকুশলতা। অরুণা শেষে পরপর গাইলেন বাংলা ভজন ‘হে ভগবতী মহামায়া’ এবং চারশো বছরের পুরনো একটি তারানা।
এরপর অমৃতের স্বাদে আবারো চক্ষু ভেজানোর পালা। ভরতনাট্যম নিয়ে এলেন বিদুষী আলারমেল ভাল্লি। একজন পরিপূর্ণ শিল্পীর প্রতিকৃতি আলারমেলের প্রথম নৃত্য ছিল ‘পৃথিবীর সৌরভ’। প্রকৃতি ও পৃথিবীর সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক নানারূপ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুদ্রা ও অভিব্যক্তিতে। এরপর ছিল ‘বর্ণম’। রূপময় সৃষ্টির বর্ণময়তা ফুটিয়ে তুললেন অভিব্যক্তি এবং অঙ্গ-ভঙ্গিমায়। ব্যক্ত করলেন নিজের অনুভূতিও, ‘একজন চিত্রশিল্পী যেমন রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন, একজন নৃত্যশিল্পী তেমনি ছবি তৈরি করেন তাঁর শারীরিক অভিব্যক্তিতে।’ তাঁর নৃত্যেও দেখা গেল সে-কথারই প্রতিফলন। আলারমেল শিল্পী হিসেবে কতটা পরিশীলিত তা বোঝা গেছে তাঁর প্রতিটি পরিবেশনায়।
রাজন মিশ্র ও সাজন মিশ্র নায়কি-কানাড়ায় পরিবেশন করলেন খেয়াল। শুরু করলেন বন্দিশ ‘বানারা মোরা পেয়ারা বাহন ময়ি জঙ্গল পাথরুয়ারে’ দিয়ে। এরপর দ্রুত তিনতালে গাইলেন ‘সজন বিনা ভই নিরাশ হু’। এরপর রাগ সোহিনিতে একটি তারানা। সবশেষে ছিল একটি ভজন ‘জগৎ মে ঝুটি দেখি হ্যায় প্রীত’। প্রতিটি পরিবেশনাই হাজার হাজার শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন, উদ্দীপ্তও হয়েছেন।
এরপর যখন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার পালা এলো, তখন প্যান্ডেল ছাড়িয়ে লোক যেন পুরো আর্মি স্টেডিয়াম ছাপিয়ে গেছে। চৌরাসিয়া যে এদেশে কতটা জনপ্রিয় এটাই তার প্রমাণ। বয়স শরীরে কামড় বসালেও মনে ঠাঁই পায়নি। মঞ্চে আসীন নিয়ে রস ছড়িয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন, ‘কী বাজাব জানি না, তবে বাজাচ্ছি।’ রাগ মারু-বেহাগে ধীরলয়ে কতক্ষণ বাজালেন, যেন আত্মমগ্নতা, নিজের সঙ্গেই নিজের ঝালিয়ে নেওয়া। সেটা যে ছিল নিজের সবটা ঢেলে দেওয়ার আগের অনুধ্যান, তা বোঝা গেল ধীরে ধীরে, যখন তিনি নিজের মেজাজে ফিরলেন মরু-বেহাগের পর রাগ হংসধ্বনির মাধ্যমে। এরপর একটা লোকজরীতির বাদন শুনিয়ে শ্রোতাদের একেবারে নাচিয়ে ছাড়লেন, উন্মাতাল করে দিলেন বংশীধ্বনির গভীর ছন্দময়তার দোলায় দোলায়। শ্রোতাদের উল্লাসে রাতের সব অন্ধকার ধুয়ে যেতে লাগল।
শেষ শিল্পী ছিলেন পণ্ডিত উলহাস কাশালকার। গোয়ালিয়র, আগ্রা ও জয়পুর এই তিন ঘরানার তালিমেই দীক্ষাপ্রাপ্ত এই শিল্পী প্রতিটি ঘরানাতেই বিহার করিয়ে আনতে পারেন স্বচ্ছন্দে। উলহাস পরিবেশন করলেন মিয়া কি টোড়ি, সাবলীল প্রবাহে। শেষ পরিবেশনা ভৈরবী রাগে ভজন, ‘তুম হো জগৎ কি দাতা, রাখিও লাজ মোর’ যখন শেষ হলো তখন ভোর সংগীতের সকল সুধারসে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে।
না, প্রথম রাতের মতো হেঁটে ফিরতে হলো না। আজ প্রাইভেট কারেই ফেরা হলো। জানালা দিয়ে প্রথম শীতের কোমল ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল। শিশির ঝরা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি হলো কত বিচিত্র এই প্রকৃতি। শীত এসে গায়ে ঠাণ্ডা পুলক বুলিয়ে যায়, বর্ষা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় মন। গ্রীষ্মের খররৌদ্রেও আনন্দের আভা থাকে। এই হাওয়া, এই আগুন, এই শিলা, এই মাটি, এই পানি – যার ওপর দাঁড়িয়ে এই পৃথিবী, তার কত আকার, কত প্রকার, কত ভাব, কত রস – সব অনুভাবই তো – মনের সব পুলক, মনের সব রাগ-অভিমান, দুঃখ-জরা, আনন্দ সবই তো ওই ছটি রাগ আর ছত্রিশটি রাগিণীতে লুকিয়ে আছে। তাই কখনো সানাইয়ে, কখনো সেতারে, কখনো সরোদে, কখনো ভরতনাট্যমে, কখনো ওড়িশি নৃত্যছন্দে, কখনো তবলায়, কখনো ভোকালে বাক্সময় হয়ে ফুটে ওঠে রূপকল্পনা। যার ব্যঞ্জনা যতটুকু গভীর ততটাই সুমধুর। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘উচ্চ আর্টের উদ্দেশ্য নয় শুধু তাক লাগিয়ে দিয়ে বাহবা নেওয়া। দুই চক্ষু জলে ভাসিয়ে দেওয়া, ভাবাতিশয্যে বিহ্বল করা। তার কাজ হচ্ছে মনকে সেই কল্পলোকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া যেখানে রূপের পূর্ণতা। সেখানকার সৃষ্টি প্রকৃতির সৃষ্টির মতোই; কেননা তার মধ্যেও সত্যের শক্তি আছে।’ উচ্চাঙ্গসংগীত আসরের সেই সত্যের শক্তিতে নতুনভাবে জেগে উঠুক এই দেশের মানুষ শুভ্র-সুন্দর-কল্যাণীয়া আনন্দে। ভালো গান দিয়ে ভালো দিন আসুক – তাদের এই উচ্চারণ গানের মতোই সর্বহৃদয়ে প্রবাহিত হোক।
কৃতজ্ঞতা : গোলাম মুস্তাফা