জা ফ রি ন গু ল শা ন
‘যখন গভীর রাত্রে তারায় তারায়
আকাশ ধরণী মুগ্ধ হয়ে কথা কয়
তখন তটিনী ধায় সাগরের পানে
যখন বিরহী তার বেদনা ছড়ায় গানে গানে
পাখিরা ফিরিবে নীড়ে ক্লান্ত দিন শেষে
হয়ত কাহারও মনে পড়িবে নিমেষে
একদা ছিলাম আমি আর নাই
সেও পরম ভাগ্য, জন্ম মোর যায়নি বৃথাই।’
জীবনকে যিনি মহত্তর উদ্দেশ্যে সাধনা করেছেন সেই ব্যক্তিত্বের জন্ম শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে ঘটে। তেমনই মহৎ জীবনকে শ্রদ্ধা জানাই আমরা আনতশিরে। শ্রদ্ধা জানাই বাংলাদেশের প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামালকে (১৯১১-১৯৯৯)। কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম সুফিয়া কামালের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে দেশব্যাপী।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অনন্যসাধারণ এই মানুষটির জন্ম হয়েছিল বরিশালের
শায়েস্তাবাদে এক অভিজাত পরিবারে ১৯১১ সালের ২০ জুন। বাবা সৈয়দ আবদুল বারী পেশায় উকিল ছিলেন। তিনি সাত বছর বয়সে পিতৃহারা হন। পরে মানুষ হয়েছেন নানাবাড়িতে, রক্ষণশীল পরিবারে শায়েস্তাবাদে। বাড়িতে থেকেই স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত করে তোলেন নিজেকে। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয় সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে, যিনি সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবায় সুফিয়া কামালকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। স্বামী তাঁকে বাংলা শিক্ষায় উৎসাহিত করেন। সৌভাগ্যবান ছিলেন বলেই তৎকালীন মুসলিম অভিজাত সংসারের অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাননি। বরং তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এমন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য, যে-সংগ্রাম মানুষকে মুক্ত করবে মানবিকতায় আর নারীকে শতাব্দী-পুরনো শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবে মানুষ হিসেবে যোগ্য সম্মানে।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অসহযোগ-পর্বে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বরিশালের জনসভায় সাক্ষাতের সুযোগ পান। নিজ হাতে চরকায় কাটা সুতা গান্ধীজির হাতে তুলে দেন। প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিম বধূর উপস্থিত হওয়া অসম্ভব ছিল সে-সময়ে, তাই সিঁদুর পরে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছিল। এভাবে দেশের পক্ষের সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করলেন চেতনার জায়গা থেকে। বাড়িতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়ার সুযোগ, পারিপার্শ্বিক সহমর্মিতা বেগম সুফিয়া কামালকে সংগ্রামী চেতনায় ও মহৎ কর্মযোগে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত করে।
ত্রিশের দশকে কলকাতায় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তাঁর সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতীনের কর্মী হিসেবে বস্তিতে বস্তিতে কাজ করেছেন। ১৯৪০-এ বর্ধমানে থাকাকালীন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির নেত্রী মণিকুন্তলা সেনের সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেন। কলকাতায় ’৪৬-এর দাঙ্গায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কামরুল হাসান ও অন্যদের সঙ্গে দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন।
পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালি যে-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগোতে থাকে, সে-সংগ্রামে বেগম সুফিয়া কামাল বাঙালি নারীর রাজনৈতিক-সামাজিক অভ্যুদয় ঘটান। বেগম রোকেয়া নারী মুক্তির যে-পথের সন্ধান দিয়েছিলেন, বেগম সুফিয়া কামাল সেই পথকে আরো বিস্তৃত করেছেন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নারী সমাজের নতুন জীবনবোধের নতুন ব্যক্তিত্বের এক সংজ্ঞা তৈরির মাধ্যমে। নারীকে পুঁজিবাদী সমাজ যেভাবে একই সঙ্গে স্বাধীনতার কথা বলে প্রতারণার আশ্রয় নেয় ও বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করে, নারীর সম্মানহানি করে নিকৃষ্টতম উপায়ে, বেগম সুফিয়া কামাল সেই জায়গায় নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিবাদী অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিশেষত মধ্যবিত্ত গৃহস্থ নারীদের রাজনৈতিক চেতনার আন্দোলনে সমর্থ করে তুলেছিলেন।
একজন কবি, সংস্কৃতিনেত্রী, নারীনেত্রী, সমাজসেবক সুফিয়া কামালের আবির্ভাব তৎকালীন পশ্চাৎপদ বুদ্ধিজীবী মুসলিম সমাজের অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদান রেখেছে। কলকাতায় উদার মানবতাবাদী সাংবাদিক সওগাত সম্পাদক শ্রদ্ধেয় প্রয়াত নাসিরউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ, কবিতা প্রকাশের সুযোগ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পত্রালাপ এবং জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবাত্মক সাম্যবাদী চিন্তাধারা কবি সুফিয়া কামালের চেতনার জগতে মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে। এই দুইজনকে তিনি আমৃত্যু শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।
১৯৪৮ সালের পর কাজী মোতাহার হোসেন, প্রগতিশীল শিখাগোষ্ঠী, সাহিত্যচক্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সমস্ত সংগঠন প্রগতিশীল নারী বন্ধুদের সুযোগ করে দিতে থাকে মুক্তবুদ্ধি-চিন্তাচর্চায়। সুফিয়া কামালের সঙ্গে শামসুন্নাহার মাহমুদের যোগাযোগ ঘটে। কবি সুফিয়া কামাল বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে নিয়ে মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীর অধিকারের প্রশ্নে আইন সংশোধনের দাবি তোলেন।
৫২-৬৮-৬৯-৭০-৭১ কিংবা তারও পরে স্বাধীন বাংলাদেশের যে-কোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটে সুবিবেচকের মতো হাল ধরেছেন জাতির পক্ষে, যদিও কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কখনই কাজ করেননি। সুফিয়া কামাল সবসময়ই সৃজনশীল উদ্যোগী কর্মী ছিলেন।
১৯৪৮ থেকে ’৫৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামে পাঁচটি বড়মাপের সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেসব তিনি সফলভাবে আয়োজন করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় পূর্ব বাংলার চরম রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্রান্তিলগ্নে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ (১৯৬১) পালনের ব্যাপক উদ্যোগে সুফিয়া কামাল ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এবং নেতৃত্বের দায়ও গ্রহণ করেন। সামরিক শাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এ দায়িত্ব গ্রহণ করা কম তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। উদ্যাপন অনুষ্ঠানের পর এ উদ্যোগকে স্থায়ী রূপ দিতে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ছায়ানট’ (১৯৬২), সুফিয়া কামাল সংগতভাবেই নির্বাচিত হলেন এর সভাপতি। তাঁর স্থাপিত ছায়ানট সুফিয়া কামালের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করলো গত ১৭ ও ১৮ জুন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নারীদের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির বিভিন্ন পথ খুঁজেছেন বিভিন্ন কর্মোদ্যোগের মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল গড়ে তোলেন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ (বর্তমান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ)। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ‘জননী সাহসিকা’কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে ২০ জুন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা সমাবেশ করে। ২১, ২২, ২৩ জুন তিন দিনব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠান জাতীয় নাট্যশালায়, শিল্পকলা একাডেমীতে আলোচনা, আবৃত্তি, সংগীতানুষ্ঠান, গীতি আলেখ্য, আলোকচিত্র প্রদর্শনী প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে সুফিয়া কামাল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন পরিষদ। দেশব্যাপী বিভিন্ন সংগঠন এই নারীনেত্রীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস্ ও তাঁর পরিবারের সহযোগিতায় আয়োজন করা হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী ‘তাঁর দীর্ঘ ছায়ায়’ শীর্ষক উৎসবের।
প্রদর্শনীতে ১৯-২০ জুন কবির বাসভবন ‘সাঁঝের মায়া’তে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী আর্ট ক্যাম্পে আঁকা তেরোজন শিল্পীর তেরোটি চিত্রকর্ম, সুফিয়া কামালের আসবাব ও চিঠিপত্র, সুফিয়া কামালের সংগ্রহে থাকা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ট্রামের টিকিটের ওপর আঁকা তেইশটি স্কেচ, নাট্যজন আলী যাকেরের তোলা নয়টি আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে।
আর্ট ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, শিল্পী হাশেম খান, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, শিল্পী শহীদ কবির, শিল্পী রোকেয়া সুলতানা, কনক চাঁপা চাকমা, শিল্পী ফরিদা জামান প্রমুখ।
শিল্পীদের ক্যানভাস বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে রং-তুলি ও কবিতার লিপিতে। কবির প্রতিকৃতির সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিবিধ বস্তু কিংবা কবির ব্যবহৃত চেয়ার, মগ, কুশন সরাসরি এঁকেছেন শিল্পীরা। শিল্পীদের ছবির ভাষা আর কবির কবিতার ভাষা একত্রে জয়গান গায় মানবতার। কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে ওঠে সমস্ত ক্যানভাস –
‘মুক্তি লাভ বন্দী আত্মা সুন্দরে স্বপ্নে আয়োজনে,
নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প বিকাশের প্রয়োজনে।’
ট্রামের টিকিটের ওপর আঁকা স্কেচগুলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কবি সুফিয়া কামালকে উপহার দেন। চল্লিশের দশকে আঁকা এইসব অত্যাশ্চর্য স্কেচ ছিল প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ। সুফিয়া কামালের কন্যাদ্বয় এই দুর্মূল্য স্কেচগুলো সযত্ন রেখেছেন। শিল্পমূল্যে এই স্কেচগুলো অসামান্য। কালি ও কলমে স্বল্পতম রেখা-টোনে প্রতিদিনকার জীবনের ছবি শিল্পাচার্য এঁকেছেন।
কবিকন্যা সাঈদা কামালের জলরঙের স্বচ্ছতায় কবির বাসভবন ‘সাঁঝের মায়া’কে স্বপ্নের দেশের মতো পাওয়া যায়। গ্যালারির একাংশের দেয়ালজুড়ে কবির পারিবারিক-কর্মময় সামাজিক জীবনের আলোকচিত্র। কবিপুত্র সাজেদ কামালের পঞ্চাশটি আলোকচিত্রও প্রদর্শিত হয়েছে। এই মহীয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উৎসবের অংশ হিসেবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ‘তাঁর দীর্ঘ ছায়ায়’ শিরোনামে ছবির অ্যালবাম এবং ‘জাগো, রে অন্তর, জাগো’ শিরোনামে কবির প্রিয় গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেছে। ২৭ ও ২৮ জুন সন্ধ্যায় এক সংগীতানুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট শিল্পীরা কবির প্রিয় গান পরিবেশন করেছেন।