logo

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতা

সা জে দু ল  আ উ য়া ল

 

অভিমুখ

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের ভাষা ও চলচ্চিত্র নির্মাণরীতির নান্দনিক সৌকর্য অন্বেষণ বর্তমান রচনার মৌল অভিপ্রায়। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল উত্তরকালে বাংলাভাষী অঞ্চলে যে কজন চলচ্চিত্রস্রষ্টা আছেন তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত শুদ্ধতম চলচ্চিত্রনির্মাতা। তাঁর চলচ্চিত্রের নানামুখী মূল্যায়ন হয়েছে। তিনি নিজেও তাঁর কৃত চলচ্চিত্রকর্ম সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা-নান্দনিকতা অনুধাবনের জন্য নানাজনের মূল্যায়ন ও তাঁর নিজের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাঠ করা হয়েছে তাঁর চলচ্চিত্রসমুদয়। এই পাঠপ্রক্রিয়া থেকেই প্রয়োজনীয় খোরাক সংগ্রহ করে রচিত হয়েছে বক্ষ্যমাণ রচনা।

রচনাকর্মের অভিমুখের কারণেই আমলে নেওয়া হয়েছে ‘চলচ্চিত্রের ভাষা’ ও ‘চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা’ প্রসঙ্গ দুটিকে। তাত্ত্বিকভাবে বিষয় দুটিকে বোঝার উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান প্রয়োগ করা হয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতার মাত্রাকে পরখ করার ক্ষেত্রে। তাঁর চলচ্চিত্রসমুদয়কেও ‘বিষয়’-এর নিরিখে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। কারণ সমগ্রকে শ্রেণিতে ফেলে বিচার করলে খ-কে সম্যকভাবে ধরা যায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রযজ্ঞের দুটি দিক তথা ‘ভাষা’ ও ‘নান্দনিকতা’কে বোঝার তাগিদ থেকে ‘চলচ্চিত্রের ভাষা’ ও ‘চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা’ সম্পর্কে আলোচনা জরুরি বলে মনে করছি। বলা দরকার যে একটা স্ট্রাকচারাল-ফাংশনাল-ডিসকার্সিভ অ্যাপ্রোচ থেকেই শ্রেণিভুক্ত চলচ্চিত্রগুলোকে অনুধাবনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

চলচ্চিত্রের ভাষা

চলচ্চিত্র একটি ‘ভাষা’ না ‘ভাষা-ব্যবস্থা’ এ নিয়ে তর্ক আছে। তবে এটা সবাই মেনে নিয়েছেন যে চলচ্চিত্র একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা-ব্যবস্থা না হলেও আংশিকভাবে এটি একটি ভাষাই। ভাষা, কিন্তু একপাক্ষিক (চলচ্চিত্রgদর্শক); কথ্যভাষার মতন দ্বিপাক্ষিক নয় (কথক1 শ্রোতা)। চলচ্চিত্র যে-যে উপকরণ নিয়ে একটি ভাষা হয়ে উঠেছে সে সম্পর্কেও একটি সাধারণ মতৈক্য আছে। চলচ্চিত্রের অভ্যমত্মরীণ উপকরণের মধ্যে পড়ে দৃশ্যমাত্রাগত ইমেজ, শব্দমাত্রাগত ইমেজ ও সম্পাদনাকর্ম। মূলত এই তিনটি দিক নিয়েই চলচ্চিত্রের সাংগঠনিক কাঠামোটি গঠিত হয়েছে। চলচ্চিত্রে দৃশ্য যেমন একটি ইমেজ, শব্দও তেমনি ইমেজের পর্যায়ে পড়ে। এই ইমেজসমূহের মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্রস্রষ্টা তাঁর আখ্যানটি দর্শকের সামনে পেশ করেন। ইমেজগুলো সততই নিজ সংস্কৃতির গভীর-তল থেকে ওঠে আসে। চলচ্চিত্রের ভাষা সংগঠনে ইমেজ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই ইমেজসমূহের পাঠপ্রক্রিয়া থেকেই জন্ম নেয় চলচ্চিত্রটির মধ্যে গুঁজে দেওয়া আখ্যানের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র। দৃশ্য ও শব্দগত ইমেজ দিয়ে যে আখ্যানটিকে চলচ্চিত্রনির্মাতা দর্শকের সামনে উপস্থাপন করতে চান তাকে বোধগম্যভাবে একটি সূত্রে গেঁথে দেওয়ার জন্যই প্রয়োজন পড়ে সম্পাদনাকর্মের। এক অর্থে এই সম্পাদনাকর্মই চলচ্চিত্র সৃষ্টির মূল নিয়ন্ত্রক। এই কর্মের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয় চলচ্চিত্রস্রষ্টার নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার স্বরূপ।

চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তাদের ব্যবহারের ধরনের ভেতর দিয়েই তৈরি হয় চলচ্চিত্রের ভাষা। যন্ত্রগুলোই দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজগুলো ধারণ করে – সম্পাদনাকর্ম ইমেজগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, যা সম্পূর্ণত একটি যন্ত্রনির্ভর প্রক্রিয়া। চলচ্চিত্রের ভাষা তাই যন্ত্রনির্ভর ভাষা – এর উপকরণগুলোও তৈরি হয় যন্ত্রকৌশলের সাহায্যেই। নির্মিত চলচ্চিত্রে এই উপকরণগুলোর ক্রিয়া করার ধরন; যন্ত্রের নির্বিকার চরিত্রের ঊর্ধ্বে ওঠে দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজগুলোর প্রাণময় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া; সমগ্র চলচ্চিত্রে দ্যোতনা ও তাৎপর্য নির্মাণ করার প্রচেষ্টা – সব মিলিয়ে তৈরি হয় চলচ্চিত্রের ভাষা। চলচ্চিত্রনির্মাতা এই ভাষার সাহায্যেই একদা পাওয়া তার মনের বিশেষ ভাবটিকে যান্ত্রিক পরিবেশের ভেতর দিয়ে দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজে রূপামত্মরিত করে চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেন। এই সৃষ্টিকরণ প্রক্রিয়ায় মিজ-অঁ-শট, মিজ-অঁ-স্যিন ও মমত্মাজ চলচ্চিত্রস্রষ্টাকে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

অক্ষরনির্ভর ভাষায় থাকে নানা পর্যায়ক্রম; থাকে নানা ধরনের যতিচিহ্ন, নানা কাল, বাক্যরীতি ইত্যাদি। চলচ্চিত্রের ভাষায়ও এসবের উপস্থিতি বিদ্যমান। একটা তীর-চিহ্ন এঁকে বিষয়টি বোঝা যেতে
পারে : সাহিত্যকর্মের বেলায় অক্ষরgশব্দgবাক্যgসত্মবকgঅধ্যায়gগল্প। চলচ্চিত্রকর্মের বেলায় ফ্রেমgশটgস্যিনgসিকোয়েন্সgচলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র যন্ত্রনির্ভর আঙ্গিক হলেও ভাষার এই অমত্মর্গত বিন্যাসক্রমটি ধারণ করেই ভাষা হয়ে উঠেছে। এই বিন্যাসের ধরনের কারণেই চলচ্চিত্রকারদের সৃষ্ট চলচ্চিত্রের প্রকরণগত পরিচর্যার দিকটি ভিন্ন হয়; ভাষাটিও হয়ে ওঠে নিজ নিজ গ্রন্থনা-ধরনসাপেক্ষ। বস্ত্তত দৃশ্য ও শব্দগত ইমেজসমূহের গ্রন্থনার ধরনের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয় সৃষ্ট চলচ্চিত্রের ভাষা ও চলচ্চিত্রকারের নন্দনভাবনার স্বরূপটি।

 

চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা

অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে তাদের স্ব-স্ব নন্দনতাত্ত্বিক পরিকাঠামোটি নির্দিষ্ট হয়েই আছে। বহুকাল ধরে চর্চিত হওয়ার ফলে এদের নান্দনিকতার ভিত্তিটি সম্পর্কে নানামুখী মতবাদও গড়ে উঠেছে। চলচ্চিত্র অপেক্ষাকৃত নতুন শিল্পমাধ্যম বলে ‘চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব’ বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণভাবে শাস্ত্রাবদ্ধ হয়নি। তবে অন্যান্য শিল্পাঙ্গিকের নান্দনিকতার ধরনটি অন্বেষণের ক্ষেত্রে যেসব প্রশ্ন ও বিবেচনার মুখোমুখি হতে হয় সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব অন্বেষকদেরও হতে হয়। নন্দনতত্ত্বের বিষয়টি দর্শনশাস্ত্রের শিল্পসম্বন্ধনীয় চিমত্মাভাবনার আওতাধীন। শিল্পকর্মের রূপ-রস-কামিত্ম; শিল্পীর অভিপ্রায়; শিল্পকর্মে স্থিত চিমত্মাসমূহ; সত্য, সৌন্দর্য, গূঢ়ার্থ, সমাজ-প্রসঙ্গ, ইঙ্গিত, ভাবাদর্শ ইত্যাদির অবস্থান অন্বেষণ সব শিল্পের নন্দনতত্ত্বের মূল উপজীব্য। চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব দাঁড় করানোর ক্ষেত্রেও উলিস্নখিত বিষয়গুলো বিবেচনার দাবি রাখে। সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রশ্নও উত্থাপিত হতে পারে : কোন গুণের কারণে চলচ্চিত্রটি শিল্পপদবাচ্য ও চলচ্চিত্রটির কোন অংশগুলো মানসম্পন্ন, অংশগুলো কীভাবে সমগ্রের মধ্যে ক্রিয়া করে, কী ধরনের ভূমিকা পালন করে, দর্শকমননে কোন ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করে প্রভৃতি।

তাছাড়া কী ধরনের সামাজিক নৈতিক সমস্যা চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছে এবং চলচ্চিত্রকার সেসব সমাধানের লক্ষ্য কী ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন তা-ও বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। নির্মিত চলচ্চিত্র প্রকৃতপ্রসত্মাবে কতকগুলো চিহ্নের সমষ্টি – আমরা বাসত্মবিক অর্থে চিহ্নের এক বিশাল সাম্রাজ্যেই বাস করি। তাই চলচ্চিত্রে দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজ দিয়ে যে চিহ্নসমূহ পেশ করা হলো তাদের তাৎপর্য নির্ণয় না করে চলচ্চিত্রের নান্দনিকতার জগতে প্রবেশ করার দরজাটি খোলা যাবে না। চলচ্চিত্রতাত্ত্বিকরা এই দরজা খোলার চেষ্টাই তাঁদের তত্ত্বে করেছেন।

এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধানও জরুরি যে কোন সামাজিক পটভূমিতে একটি চলচ্চিত্রের জন্ম হয়েছে; চলচ্চিত্রস্রষ্টার জীবনচক্রের কোন পর্যায় ও অবস্থার প্রতিফলন সৃষ্ট চলচ্চিত্রে ঘটেছে; চলচ্চিত্রটির মধ্যে দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজগুলো কোন প্রক্রিয়ায় সঞ্চিত হয়েছে; ইমেজগুলো কোন ধরনের কালচারাল কোড প্রকাশ করেছে; সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রকারের নন্দনভাবনার পরিচায়ক প্রবণতাগুলো কী রকম? অন্যদিকে ‘চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব’ চলচ্চিত্রটিকে শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করে একে পাঠ করতে উৎসাহী; চলচ্চিত্রকারের বলবার বিষয়কে কতটা শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা নির্ণয়ে তৎপর। এ নির্ণয়ে সৌন্দর্যের ধারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দর্শক ও তাত্ত্বিকদের রুচিবোধ ও আনন্দ পাওয়ার ধরনকে মান্য করা হয়। সেজন্য চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্বকে অন্যান্য শিল্পকর্ম অবলোকন-অনুধাবন করার যেসব বিধান-নীতিশাস্ত্র আছে তার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। চলচ্চিত্রে নন্দনতত্ত্বের দুটি বিশেষ দিক আছে : প্রথমত, এর একটি সাধারণ দিক আছে যেটি চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত নান্দনিক অনুভবের বিষয়গুলো অবলোকন করে; দ্বিতীয়ত, এর একটি সুনির্দিষ্ট দিক আছে যেটি নির্বাচিত চলচ্চিত্রের বীক্ষণকর্মকে ঘিরে আবর্তিত হয়, যাকে চলচ্চিত্র সমালোচনা বলা হয়। বর্তমান রচনায় এই ‘সুনির্দিষ্ট দিক’টিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং তদীয়সূত্রে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বিরচিত চলচ্চিত্রগুচ্ছের ভাষা ও নান্দনিকতার মাত্রাকে অবলোকন-অনুধাবন করার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজটি সম্পন্ন করার তাগিদ থেকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রনিচয়কে বিষয়ের দিক থেকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে হয়েছে। রচনাকর্মের প্রতিপাদ্যের দিকে লক্ষ রেখেই এই শ্রেণি বিভাজনটি করা হয়েছে। বিভিন্নজন তাঁদের অন্বেষণের বিষয়ের নিরিখে বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রসমগ্রকে ভিন্নতর শ্রেণিতে নিশ্চয়ই বিভাজন করবেন।

 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের শ্রেণিবিন্যাস

ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্র : চরাচর (১৯৯৩), লাল দরজা (১৯৯৬), উত্তরা (২০০০), স্বপ্নের দিন  (২০০৪), কালপুরুষ (২০০৫), আমি ইয়াসিন আর আমার মধুবালা (২০০৭)।

সমষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্র : দূরত্ব (১৯৭৮), নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯), গৃহযুদ্ধ (১৯৮১), আন্ধিগলি (১৯৮৪), তাহাদের কথা (১৯৯২), মন্দমেয়ের উপাখ্যান (২০০২)।

শিল্প ও শিল্পীপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্র : শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি (১৯৮২), ফেরা (১৯৮৬) ও বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯)।

 

বর্তমান রচনার অন্বেষণের পরিধি বিবেচনা করে তিনটি শ্রেণি থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে মোট ছয়টি চলচ্চিত্র বীক্ষণের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। প্রথম শ্রেণি থেকে তিনটি (চরাচর, লাল দরজা ও উত্তরা), দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দুটি (নিম অন্নপূর্ণা ও তাহাদের কথা) এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে একটি (ফেরা) চলচ্চিত্র বাছাই করা হয়েছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রসমগ্রকে বিষয়ের নিরিখে ভাগ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে এদের ভাষা ও নান্দনিকতার মাত্রা দুটি বোঝার প্রচেষ্টাকে যুক্তিবদ্ধ প্রসত্মাবনার আওতায় আনা। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র অনুধাবন করতে গিয়ে সোমেশ্বর ভৌমিক চলচ্চিত্রস্থ বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : ‘… ভাষা, হোক তা সাহিত্যের, হোক চলচ্চিত্রের, কোনও স্বয়ম্ভূ অসিত্মত্ব তো নয়। বিষয়বস্ত্ত নির্ভরতাই তার বৈশিষ্ট্য। শিল্পীর বক্তব্যে যে অমত্মর্বস্ত্ত আর সমস্যা বিচারের যে দৃষ্টিকোণ তাকে ব্যঞ্জনা দেয় ভাষা, শৈলী সেগুলিকে করে অলঙ্কৃত। … বিষয়বস্ত্তর উৎস আবার শিল্পীর চৈতন্য তথা জীবনজিজ্ঞাসা।’ সোমেশ্বর ভৌমিকের এই বিবেচনা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনভাবনার সুলুক অন্বেষণে কিছুটা হলেও পথ দেখাবে।

 

ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতা

চরাচরের বিষয় ব্যষ্টি লখিন্দরকে ঘিরে আবর্তিত। পাখি ধরে বিক্রি করা তার পৈতৃক পেশা। নেশা, ধরা পাখি মাঝে মাঝে ছেড়ে দেওয়া। ছেলে নিতাই মৃত, ঘরে স্ত্রী সারি বর্তমান, গৌরী নামের একটা মেয়ে লখিন্দরকে মনে মনে ভালোবাসে। এরা সবাই ব্যষ্টি হিসেবেই যার যার গ–তে বিচরণ করে। এই রকম অনেকের মাঝে থেকেও লখিন্দর একা। অভাব তার নিত্যসঙ্গী। স্ত্রী সারি তাই প্রেমিক নটবরের সঙ্গে গৃহ ত্যাগ করে। লখিন্দর পড়ে থাকে তার পাখি নিয়ে, স্মৃতি আর
স্বপ্ন-কল্পনা নিয়ে। মানুষের সম্পর্ক-ব্যবস্থার মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের ক্রিয়াশীলতা, মতিচ্ছিন্ন মানুষের নৈঃসঙ্গ্যচেতনা, নারীর যৌনতা আখ্যানে বিশেষ গুরুতব পেয়েছে। প্রফুলস্ন রায়ের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে লখিন্দর কেমন নিঃসঙ্গ। সবাই এবং সবকিছুই যেন তাকে প্রতারিত করেছে – সংসার, পরিজন, সময়, সমাজ। এ বিপন্ন বোধই তাকে বাসত্মবতা ছেড়ে নির্বাসত্মবতায় সরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। এই সরে যাওয়ার মুহূর্তগুলো চলচ্চিত্রে লখিন্দরের দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত হয়েছে – কখনো স্বপ্নে, কখনো কল্পনায়।

বিষয়বস্ত্তই স্বপ্ন ও কল্পনাকে ডেকে এনেছে। লখিন্দরের বাসত্মবতা ছেড়ে স্বপ্ন ও কল্পনায় পরিভ্রমণের কারণে চরাচরের দৃশ্য ও শব্দখ- সংগঠনরীতি আর সর্বদা বাসত্মবানুগ থাকেনি। দৃশ্যখ–র লয় হয়ে পড়েছে স্থানে স্থানে ধীর – যেমনটা স্বপ্ন ও কল্পনায় হয়ে থাকে। ফলে বাসত্মবধর্মী চলচ্চিত্র থেকে ভিন্ন হয়ে পড়েছে চরাচরের বুনন তথা সম্পাদনাকর্মটি। সেলাইবিহীন মনে হয় পুরো চলচ্চিত্রটি। এর দৃশ্যপুঞ্জগুলো একটা আরেকটার গায়ে এমনভাবে মিশে গেছে যে দর্শকের পক্ষ তা ঠাহর করাও মুশকিল – ‘এইসব দৃশ্যপুঞ্জ দীর্ঘ কবিতার এক-একটি সত্মবকের মতো, সমগ্রে গাঁথা থেকেও সত্মবকের গড়নের সম্পূর্ণতায় এক-একটি তাৎপর্যময় সত্মর প্রতিষ্ঠা করে দিচ্ছে। বস্ত্তত চরাচরের দৃশ্যখ- নির্মাণ ও পরস্পর সংস্থাপনের ধরনের কারণেই এর গতি মন্থর ও ভাষা কাব্যধর্মী। এই চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ অংশই সম্পন্ন হয়েছে বিমূর্তন প্রক্রিয়ায়। এই বিমূর্তন বা অ্যাবস্ট্রাকশন শিল্পকর্মের বিশেষ একটি দিক। চলচ্চিত্রশিল্পে এই বিমূর্তন প্রক্রিয়াটি সাঙ্গ করা হয় দৃশ্য, শব্দ ও সম্পাদনাকর্ম দ্বারা।

চরাচরে বিমূর্তন প্রক্রিয়াটি রিয়েলিটি ও অ্যাবসার্ডিটির মিলন-মিশ্রণ তথা মিউটেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। চরাচরের শেষ দৃশ্যে লখিন্দর যে দরজা খুলে সমুদ্রের দিকে ওপরে হাত তুলে দৌড়োল সেটা তার স্বপ্ন, কিন্তু তার ঘর, ঘরের দরজা এগুলো বাসত্মব। বুদ্ধদেবের ভাষায় – ‘সমুদ্র যদিও সে জীবনে দেখেনি, কিন্তু তার স্বপ্ন কল্পনা – সে কিন্তু জেগে জেগেই সেসব দেখছে। রিয়েলিটি ছিল লখার ওই দরজা খোলা অবধি। এরপর যেটা শুরু হলো সেটা স্বপ্নের, অজানা, অচেনা, ইচ্ছের যাত্রা। তাই লখাও এমনভাবে এমন ভঙ্গিতে দৌড়োল, মনে হলো যেন ও-ও বুঝি পাখি হয়েই উড়ে যাবে। এইভাবে ন্যারেটিভ ফরম্যাটে
নন-ন্যারেটিভ ব্যাপার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।’ তাতে করে চরাচরের ভাষা লখিন্দরের মনসত্মাত্ত্বিক পরিভ্রমণের অনুষঙ্গে গঠিত হয়েছে বলে অনুমিত হয়। লখিন্দর তথা প্রথম পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই দর্শক সবকিছু দেখছে – এই পুরুষ ব্যষ্টি হিসেবে একলা – নিজের তৈরি করা জগৎ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায়ই সে শেষ পর্যমত্ম খুঁজে পায় না, যেন বা খুঁজতেও চায় না।

চরাচর-এর দৃশ্যমাত্রা সংগঠনে সত্মবক বা এপিসোডকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে – এর আখ্যানের অগ্রগমনও তাই এপিসোডিক। ক্যামেরা খুব ধীরগতিতে প্যান করে; লো-অ্যাঙ্গেল হাই-অ্যাঙ্গেল শট, জুম ইন-আউট, টিল্ট আপ-ডাউন – দৃশ্যধারণের প্রচলিত সব ধরনই ব্যবহৃত হয়েছে এপিসোডগুলো নির্মিতিতে। ফ্রেমিংয়ের ক্ষেত্রে ফ্রেমের ভেতর আরেকটি ফ্রেমের অসিত্মত্ব প্রায়শই দেখা যায়। হয় জানালা, না হয় দরজা দিয়ে বাইরেটা ধরেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এটা তাঁর শট কম্পোজিশনের একটা বিশেষ প্রবণতা, যা বুদ্ধদেবের শেষ চলচ্চিত্র জানালা (২০১০) পর্যমত্ম বিসত্মৃত। চরাচরে পটভূমি বা ল্যান্ডস্কেপ নিজেই যেন একটি চরিত্র – যেন বা সবচেয়ে বড় চরিত্র। প্রকৃতি, মানব মনসত্মত্ত্ব ও সমাজের কঠিন বাসত্মবতা – এই তিনের আমত্মঃসম্পর্কের চলচ্চিত্র চরাচর। এই তিনের দোলাচলে পড়ে লখিন্দরের মন কীভাবে ক্রিয়া করে তা-ই ধৃত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। একে তাই একটি মনসত্মাত্ত্বিক চলচ্চিত্র বলা অসংগত হবে না। এর বুননকর্মে বুদ্ধদেব আশ্রয় নিয়েছেন কবিতার চালের কাছে। কবিতাই পারে মানুষের মনের ভাবকে মহিম্ময় করে তুলতে, একটা সাবলাইন সত্মরে নিয়ে যেতে। চরাচর অনুধাবনকালে জন ডবিস্নউ হুড বিষয়টি লক্ষ করে তাই লেখেন – ‘Charachar brings to Indian cinema a new perception of the sublime in poetic film’.

মূলত দুটি সত্মরে চলচ্চিত্রটির আখ্যান চলাফেরা করে – বাসত্মব ও স্বপ্ন বা কল্পনা সত্মর। দ্বিতীয় সত্মরে অতীত নির্মাণে ফ্ল্যাশব্যাক ব্যবহৃত হয়েছে; কল্পনা নির্মাণে বিমূর্তন প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছে। এর অধিকাংশ দৃশ্য চিত্রকলার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে – প্রকৃতিতে স্থিত আলো-ছায়ার বিন্যাস, রংনিচয়, অনুজ্জ্বল পটভূমি, জলে প্রতিফলিত প্রকৃতি দৃশ্যমাত্রায় ব্যবহার করার কারণে কোনো কোনো জায়গা চলমান চিত্রকলা বলে ভ্রম হয়। শব্দমাত্রায় স্থিত ইঙ্গিতপূর্ণ সংলাপ, আবহসংগীত হিসেবে নিঃসঙ্গ বাঁশির সুর, পাখির ডাক, ডানা ঝাড়ার শব্দ, সমুদ্রের গর্জন প্রভৃতি দৃশ্যমাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবে ক্রিয়া করেছে। সম্পাদনাকর্মে কাট ও মিক্সই শুধু ব্যবহৃত হয়েছে। দৃশ্যের শস্নথ গতির কারণে কাট বা দৃশ্যছেদে আখ্যান ধাক্কা খায় না বললেই চলে। সব মিলিয়েই চরাচরের ভাষা কাঠামোটি সংগঠিত হয়েছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নন্দনভাবনার নানাদিকও এই ভাষাকাঠামো পাঠপ্রক্রিয়া থেকে উন্মোচিত হয়। বস্ত্তত ভাষা ও নন্দনভাবনা একে অপরের পরিপূরক। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নন্দনভাবনা তাঁর মগ্নচৈতন্য, জীবনদর্শন ও বিশ্ববীক্ষার নিরিখেই রূপ লাভ করেছে। চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্বের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে নির্মিত চলচ্চিত্রে যেসব বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে, যেসব তাৎপর্য সন্নিবেশিত হয়েছে, যেসব গূঢ়ার্থ গুঁজে দেওয়া হয়েছে সেগুলো উদ্ধার করা। চরাচরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ব্যষ্টি লখিন্দরের একাকিত্ব, অসহায়ত্ব চিত্রিত করার মধ্য দিয়ে সমষ্টি সত্মরে মানুষের বন্দিত্ব ও মুক্তির মেটাফোর তৈরি করেছেন। এ কাজে পাখিকে খাঁচায় বন্দি করা এবং খাঁচাছাড়া করার রূপকটি বারবার দেখিয়েছেন তিনি। সম্ভবত তাঁর জীবনদর্শনের প্রতিফলনই ঘটেছে রূপকটিতে।

লাল দরজাও ব্যষ্টি নবীনকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত। যদিও ব্যষ্টি হিসেবে এই আখ্যানে বেলা, দীনু, কুশলসহ অনেকেই আছে। এতে নবীনকে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত সংকটে নিমজ্জিত অবস্থায় দেখা যায়। চরাচরে লখিন্দর যেমন তার সংকট থেকে বের হতে না পেরে কল্পনার কাছে আশ্রয় নেয়; লাল দরজাতেও নবীন সংকট নিরসনের কোনো উপায় না পেয়ে কল্পনায় শৈশবে ফিরে যায়। এর আখ্যান বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নিজের। আখ্যানে কয়েকটি ছোট ছোট উপ-আখ্যানের উপস্থিতি আছে। দাঁতের ডাক্তার নবীন দত্ত-স্ত্রী বেলা; বেলা-বেলার প্রাক্তন প্রেমিক অর্ণব; বাবা নবীন-ছেলে কুশল; বড়বেলার  নবীন-ছোটবেলার নবীন; ড্রাইভার দীনু-ডাক্তার নবীন; দীনু-তার স্ত্রীগণ-প্রেমিকা; গুলিতে নিহত নারী-স্বামীকে ঘিরে উপ-আখ্যানগুলো গড়ে উঠেছে। বেলা দাম্পত্য জীবনে অসুখী। প্রাক্তন প্রেমিকের সান্নিধ্যে সুখ খোঁজে। নবীন মানসিক রোগে আক্রামত্ম যদিও সে ভাবে তার শারীরিক কোনো অসুখ আছে। একসময় স্ত্রী ঘর ছাড়ে। ছেলে কুশল সবকিছুর জন্য বাবাকে দায়ী করে। এই উপ-আখ্যানটি কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংসারিক বাসত্মবতার একটি প্রসঙ্গ ধরে আছে। আরেকটি উপ-আখ্যান নবীনের গাড়ির ড্রাইভার দিনু ও তার দুই স্ত্রী এবং এক প্রেমিকার সুখী জীবন যাপনের প্রাত্যহিক ঘটনাকে ঘিরে ঘটে। নবীন তার সংকটাপূর্ণ অবস্থার সঙ্গে দীনুর সদা আনন্দময় অবস্থার তুলনা করে নিজেকে বুঝবার চেষ্টা করে। এটিও সমাজবাসত্মবতার একটি দিককে নিয়ে বেড়ে ওঠে। আরেকটি উপ-আখ্যান নবীনের শৈশবকে আশ্রয় করে রচিত। এটি ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে নবীনের সংকটাপন্ন অবস্থায় ফিরে ফিরে আসে। একেবারে শেষে যখন নবীনকে তার স্ত্রী-ছেলে ছেড়ে চলে যায় এবং সে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়ে, তখন সে তার শৈশবের নবীনের কাছে ফিরে যায়, বাসত্মবে নয় কল্পনায়। আরেকটি উপ-আখ্যান নবীনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা রাসত্মায় গুলি করে মারা মহিলাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়, টেলিভিশনের খবরের মাধ্যমে নবীন বুঝতে পারে যে ওই মহিলার অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তার স্বামী কাউকে দিয়ে এই হত্যাকা- সংঘটিত করেছে। একপর্যায়ে নবীন যখন জানতে পারে যে তার স্ত্রী বেলারও অর্ণবের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তখন তাকেও মারার জন্য সে কালু নামের এক গু-াকে ভাড়া করতে উদ্যোগী হয়, কিন্তু এ কাজে সে সফল হতে পারে না।

লাল দরজার আখ্যানে বাসত্মবতা, স্বপ্ন, কল্পনার মিশ্রণ থাকায় এর ভাষাও মিশ্ররীতির চলচ্চৈত্রিক ভাষা হয়ে উঠেছে। বাসত্মবের টানা রূপায়ণ না ঘটিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আখ্যানকে ভেঙেছেন স্বপ্ন, কল্পনার দৃশ্য এনে। স্মৃতি, বিশেষ করে তাঁর নিজের শৈশবে চেরাপুঞ্জির পাহাড়ে লাল চাদর গায়ে দিয়ে কুয়াশামাখা ভোরে সবুজ ঘাসের মধ্য থেকে লাল ভেলভেট পোকা হাতের তালুতে নেওয়া – ‘ছোটি মোটি পিঁপড়া বটি লাল দরজা খোল দে’ বলা, বন্ধ লাল দরজা খুলে যাওয়ার দৃশ্য এবং মায়ের উল বোনা, উলের বল সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়া, মায়ের রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া – সব বেশ বিলম্বিত লয়ে ধরা হয়েছে। অন্যান্য দৃশ্য কিন্তু দ্রম্নত বা স্বাভাবিক লয়েই ঘটে যায়। চলচ্চিত্রে বিলম্বিত লয় কিন্তু নিজে নিজেই জন্ম নেয় না, চলচ্চিত্রের কারিগরি দিকসমূহ ব্যবহার করেই তা তৈরি করতে হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এই লয় তৈরি করেছেন ক্যামেরা-স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে। সাধারণত ক্যামেরায় প্রতি সেকেন্ডে ২৪টা ফ্রেম যায়। তাতে সবকিছু স্বাভাবিক গতিতে চলে। কিন্তু ছোট্ট নবীন যখন বাবাকে ছড়া বলে লাল দরজা খোলার উদ্যোগ নেয় তখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ক্যামেরার স্পিড ২৪ ফ্রেম থেকে ধীরে ধীরে ৪৮ ফ্রেমে নিয়ে যান। এতে দৃশ্যটি সেস্না মোশনে ঘটতে দেখা যায়। তখন আর দৃশ্যটিকে ঠিক বাসত্মব বলে মনে হয় না, একটা ইল্যুশন তৈরি করে দর্শকের সামনে এবং অন্যরকম একটা অনুভবের জন্ম দেয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত দৃশ্যটি ধারণের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন যে – ‘কতটুকু সেস্না করবেন একটা বিষয়কে দর্শকের কাছে অনুভূতিগ্রাহ্য করে তুলে ধরার জন্য, সেটা পরিচালক হিসেবে আপনাকেই একদম ঠিক করে ফেলতে হবে।’ লাল দরজার প্রথম দৃশ্যটির গতিও স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু শস্নথ। এ বিষয়ে বুদ্ধদেবের ভাষ্য :

লাল দরজার প্রথম দৃশ্যটি পাহাড়ের গায়ে মেঘের দৃশ্য…। প্রথম এই দৃশ্যই কিন্তু একটি চরিত্রের ভাবনার দৃশ্য, সে ভাবছে আর তার কাছে সেই দৃশ্যগুলো ফিরে আসছে সুদূর অতীত থেকে। এখানে যদি মুভমেন্টটা একেবারে নর্মাল ২৪ ফ্রেমের হতো, তাহলে কোনও ইল্যুশন তৈরি হত না।… আমি ২৬ ফ্রেমে করলাম রিয়েলিটি থেকে একটু এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যেটা কিন্তু আবার সম্পূর্ণ ইল্যুশনের চেহারাও নয়।… অথচ কেমনভাবে যেন রিয়েল-নন-রিয়েল এর মাঝের কোনো ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়েছে জিনিসগুলো। এজন্যই ২৬ ফ্রেমে ওই অংশগুলো টেক করছিলাম।১০

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতি থেকে লাল দরজার চলচ্চৈত্রিক ভাষা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রের ভাষার গুরুত্ব যে চলচ্চিত্র নির্মাণের যন্ত্রপাতির নির্বিকার চরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েই মনসত্মাত্ত্বিক একটা অনুভবের জন্ম দেওয়ার মধ্যে নিহিত তা-ও উদ্ধৃতিটি থেকে স্পষ্ট হয়। আর এখানে এসেই চলচ্চিত্রের ভাষা ও চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে। বস্ত্তত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চৈত্রিক নন্দনভাবনা তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণরীতি বা শৈলী থেকেই রূপ লাভ করেছে। এ পর্যমত্ম লাল দরজার যে দৃশ্যগুলো আলোচনায় এলো, এগুলোতে কোনো নাটকীয় উপাদান নেই সত্য কিন্তু কাব্যিক চলচ্চিত্রের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়ে গেছে। সত্যজিৎ চৌধুরীর মতে – ‘এসব দৃশ্য কোনো গল্প বলে না। গভীর কবিতার মতো, অব্যর্থ চিত্রকলার মতো বোধের মধ্যে আবেশ আনে, মগ্ন করে আনে। ভারতীয় সিনেমায় এমন করে ভেতর দিকে টেনে নেবার মতো কাজ বিরল। বুদ্ধদেব প্রতিপন্ন করেন, ফিল্মের শুদ্ধ ভাষায় শুদ্ধ কবিতা বা শুদ্ধ চিত্রকলা অবিরোধে মিলে যেতে পারে।’১১

দৃশ্যমাত্রার মতো লাল দরজার শব্দমাত্রায়ও বুদ্ধদেব তাঁর কাব্যবোধ জুড়ে দিয়েছেন। অতিকথনের দায় থেকে বরাবরই চলচ্চিত্রকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন বুদ্ধদেব – লাল দরজা ততটা না হলেও বেশ কিছু চলচ্চিত্র তার সাক্ষ্য বহন করে। বুদ্ধদেবের এই প্রকল্প তাঁর নন্দনভাবনার একটি বিশেষ দিক। অাঁটসাঁট সংলাপে-ইঙ্গিতে দর্শকের বোধকে জাগিয়ে দেওয়া, হাস্যরস উৎপাদন করা, চিমত্মামুখর করে তোলা, একই সঙ্গে অতীতকে পুনর্নির্মাণ করা, চরিত্রের মনসত্মত্ত্বের প্রকাশ ঘটানো, জীবন, যৌনতা, জগৎ সম্পর্কে মমত্মব্য রাখা ইত্যাদি লাল দরজার সংলাপসমগ্রের মধ্যে পাওয়া যায়। এর আবহসংগীত সংগঠনের মধ্যেও কাব্যিক পরিমিতিবোধ ক্রিয়াশীল। শুরুতে চেরাপুঞ্জি পাহাড়ে ছোট্ট নবীনের ভেলভেট পোকা খুঁজে বেড়ানোর সময় বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ব্যবহার করা হয়। বড়বেলার নবীনের বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোর দৃশ্যে এই প্রাতিষঙ্গিক শব্দটি মোক্ষম শব্দ হিসেবে দৃশ্যমাত্রার আবেদনকে পরিপুষ্ট করেছে। এই শব্দের সঙ্গে বাজে চলচ্চিত্রটির থিম টিউন – নিঃসঙ্গ, একাকী একটি সুরখ-। এই সুরখ–র মাত্রিক ব্যবহার চলচ্চিত্রটির শেষাংশেও করা হয়েছে। বড়বেলার নবীন তখন বিধ্বসত্ম, স্ত্রী-পুত্র তাকে ছেড়ে গেছে, যেন বা জীবনও। নগরায়ণের ফলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, ব্যক্তি থেকে সমষ্টির মধ্যে যে অনন্বয়-পারক্য তৈরি হয়েছে, নবীনের দাম্পত্য জীবনে যে যৌনশীতলতা দেখা দিয়েছে – সবকিছু তাকে ব্যতিব্যসত্ম করে তোলে। উপায় না দেখে সে আবার ডাক্তারের কাছে যায় – দেখে সবকিছু ফাঁকা, কোথাও কেউ নেই। থাকবে কী করে, যাঁকে ডাক্তার হিসেবে চলচ্চিত্রে দেখা যায় তিনি যে নবীনেরই সম্প্রসারিত সত্তা! তখন সাদা ধোঁয়া চারদিক থেকে উঠে আসে। নিজের ঘরে ফিরে এসে তালা খুলতে গিয়ে চাবি পায় না। তখন সে ছোট্টবেলার সেই ছড়াটি কাটে। সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে থিম টিউন, চারদিক থেকে ধোঁয়া উঠে আসে। ধোঁয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয় চেরাপুঞ্জির কুয়াশা। বড়বেলার নবীনকে সেই কুয়াশার মধ্যে দেখা যায়। লাল চাদর গায়ে ছোট্টবেলার নবীন তাকে হাত বাড়িয়ে মাথা নেড়ে কাছে আসার জন্য আহবান করছে। থিম টিউনের সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ হয়, লাল দরজাটি ধীরে ধীরে খুলে যায়। ছোট্ট নবীন, ছোটবেলা ও লাল দরজা বড়বেলার নবীনের আশ্রয় হয়ে ওঠে। নবীনের মা তাকে বলেছিল দরজাটির সহ্যক্ষমতা অনেক, নবীন নিজেকে লাল দরজার সঙ্গে তুলনা করে। সবকিছু হারানোর পর সে-ও সহ্যক্ষমতা বাড়ায়, নিজের একাকিত্বকে মেনে নেয়। দৃশ্য ও শব্দমাত্রাগত ইমেজ দিয়ে একধরনের কাব্যিক বাসত্মবতা তৈরি করেছেন বুদ্ধদেব, যা তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনভাবনার পরিচায়ক।

দ্রম্নত লয়ের একরৈখিক সম্পাদনারীতির মাধ্যমে দৃশ্য ও শব্দখ- জুড়ে দিয়ে তৈরি লাল দরজা ব্যক্তি নবীনের সংকটকে সম্মুখবর্তী করে। সংকটের এপিসেন্টার বা উৎসস্থল হিসেবে যৌনতা একটি প্রসঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনার লক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে যে তিনি নবীন ও বেলার সংকটকে সমাজপটের মধ্যে ভরে বুঝতে চেয়েছেন। নগরায়ণের ফলে উদ্ভূত সমাজ-সংকট থেকেই পারিবারিক সম্পর্ক-ব্যবস্থার মধ্যে যে ভাঙন দেখা দিচ্ছে, এ বিবৃতিটি লাল দরজা সমীক্ষণের পর বলা যায়।

উত্তরায় একাধিক ব্যষ্টির নানামুখী সংকট চিত্রিত। আখ্যানের পটভূমি রাঢ় বাংলার বিহার অঞ্চল। এখানে নির্জন রেলস্টেশন, গির্জাকে ঘিরে ঘটে নানা ঘটনা। অনেকগুলো ব্যক্তি-চরিত্রকে একসঙ্গে টানা হয়েছে এই আখ্যানে। আখ্যানটি সমরেশ বসুর গল্প থেকে নেওয়া। বলরাম ও নিমাই রেলস্টেশনে চাকরি করে। একজন সিগন্যালম্যান, অন্যজন গেটকিপার। দুজনই অবিবাহিত। অবসরে তারা কুসিত্ম লড়ে। নিজেদের সব ধরনের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আখ্যানে আছে স্থানীয় চার্চের পাদরি পাস্টার সাহেব যিনি দুস্থজনে সেবা দেন। অথচ তাঁকেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা কুপিয়ে হত্যা করে! আছে উত্তরা নামের নহলী বউ, যাকে বলরাম বিয়ে করে আনে। বিয়ের পর বলরাম আর নিমাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। পরিণামে উত্তরা ঘর ছাড়ে, ধর্ষণের শিকার হয়, মৃত্যুবরণ করে। আছে বামন গার্ড, যে আখ্যানের শেষের দিকে উত্তরাকে বিয়ে করতে চায়। সবাই মিলে আবার সমষ্টি; ব্যষ্টির সংকট একপর্যায়ে সমষ্টি তথা সমাজসভ্যতার সংকট বলে প্রতিভাত হয়।

এ চলচ্চিত্রের আখ্যানে মূল পস্নটের পাশাপাশি একাধিক সাব-পস্নট বয়ে চলে। এতে বাসত্মব ঘটনাই প্রধান, বামনদের উপস্থিতিটিই শুধু সত্যি কি না সন্দেহসাপেক্ষ। বিসত্মীর্ণ প্রামত্মর, বনভূমি, নিরালা স্টেশন – এরই মধ্যে সমসত্ম ঘটনা ঘটে। এর দৃশ্যমাত্রায় স্ট্যাটিক ফ্রেমের আধিক্য বেশি – ফ্রেমগুলো চিত্রকলার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। ফ্রেমের ওপরের অংশে আকাশ দৃষ্ট হয় প্রায়শই। ক্যামেরাকে লো-বেইজে বসিয়ে শট নেওয়া হয়েছে। ট্রাক শট, প্যান খুবই ধীর গতির। লং টেইক আছে চলচ্চিত্রজুড়েই। এক ফ্রেমের মধ্য দিয়ে আরেকটি ফ্রেম তৈরি করা হয়েছে – এক্ষেত্রে ঘরের, গাড়ির, ট্রেনের জানালা-দরজা দিয়ে বাইরেটা ধরা হয়েছে। সিলুএট বা অনুজ্জ্বল পটভূমিতে তোলা দৃশ্যও মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে চলচ্চিত্র-পরিসরে। সব মিলিয়ে এ চলচ্চিত্রের ভাষা কাব্যময়, যা বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনার নিরিখেই গঠিত। তাঁর নন্দনভাবনা তাঁর কাব্যিক অমত্মর্দৃষ্টি থেকে গড়ে উঠেছে। এই অমত্মর্দৃষ্টি আবার কিছুটা অঁদ্রে তারকোভস্কি-প্রভাবিত। তারকোভস্কির মতো বুদ্ধদেবও মনে করেন যে চলচ্চিত্র – কবিতা ও সংগীতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।১২ এ সত্য মেনে নিয়ে এটাও বলা দরকার যে চলচ্চিত্রশিল্পের দৃশ্যমাত্রা সংগঠনে চিত্রকলার প্রভাবও কম নয়। যার প্রমাণ উত্তরায় বিদ্যমান।

উত্তরার শব্দমাত্রার নানাবিধ উপাদানও দৃশ্যমাত্রাকে পোয়াতি হতে সাহায্য করেছে। শুরু ও শেষে পাতাঝরার দৃশ্যের সঙ্গে পাখির ডাক, থিম টিউন, লোকগান, মুখোশ নৃত্যের বাদ্য, শব্দহীন ফ্রেম – সবকিছু মন কেমন করা আবহ তৈরি করে। লোকগানের ভেতর দিয়ে রাঢ় অঞ্চলের সমাজ-সংসার-ধর্ম-সংস্কার প্রভৃতি প্রসঙ্গ প্রকাশ পেয়েছে। সংলাপেও এই অঞ্চলের কথ্যরীতি ব্যবহৃত হয়েছে – এতে করে আখ্যানটি স্থানীয় ভিত্তি পেয়েছে। স্থানীয় চরিত্ররা রাঢ় অঞ্চলের কথ্যরীতিতে কথা বললেও পাদরি ও বামন গার্ড কলকাতার কথ্যরীতিতে কথা বলে।  ধারাবাহিক সম্পাদনা কৌশলের সাহায্যে পরপর দৃশ্য ও শব্দমাত্রা সংস্থাপন করে উত্তরা নির্মিত – এর লয় মন্থর। কোথাও কোনো তাড়াহুড়া নেই – যেমনটা প্রকৃতিতে দেখা যায়। প্রকৃতি নিজেও এই চলচ্চিত্রের প্রধান একটি চরিত্র – সংকটে তাকেও পড়তে হয়।

নিসত্মরঙ্গ, উদাসীন প্রকৃতিতে অস্থিরতা তৈরি করে ধর্মীয় গোঁড়ামি, আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা, ধর্ষণ ও হত্যা, যন্ত্রচালিত গাড়িতে করে আসা বাইরের মানুষ। এসবের বিরুদ্ধে বুদ্ধদেব দাঁড় করান স্থানীয় লোকসংস্কৃতিকে – শেষ দৃশ্যে লোকনৃত্যের সঙ্গে যে লোকগান গীত হয় তাতে স্থানীয়দের দুঃখ-কষ্ট-সংকট-আশার কথা প্রকাশ পায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নন্দনভাবনার একটি বিশেষ দিক প্রকাশ পেয়েছে উত্তরার মূল বক্তব্য দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে।
কবি-চলচ্চিত্রস্রষ্টা হিসেবে তিনি মানুষের সামগ্রিক সংকটের কারণ দর্শানোর পর এ সংকট থেকে উত্তরণের পথের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। পাপিয়া মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন :

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এমনই একজন মানুষ যিনি উন্নত মানবিক বোধের পরিচর্যা করেন। …বুদ্ধদেবের এই ছবিতে প্রাধান্য পেয়েছে নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত সংকট তথা সামাজিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট, সর্বোপরি মানবিক সংকট। তাঁর অন্য ছবির মতোই ব্যক্তিগত সংকটকে বৃহত্তর রাজনৈতিক সংকটের সংলগ্ন করে তা থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন তিনি।১৩

 

একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে বুদ্ধদেব জানেন শিল্পকর্ম নিজে থেকে সমাজ-সংকট নিরসন করতে পারে না। তবে যে কাজটা করে সংকট থেকে উত্তরণের আকাঙক্ষা জনমনে জাগিয়ে দেয়। উত্তরায় এই জাগিয়ে দেওয়ার কাজটি করা হয়েছে বামন গার্ডের সংলাপে, যেখানে তিনি উত্তরাকে বলেন – ‘বামন গার্ড : লম্বা মানুষ তো দেখলে এতকাল। কিছু করতে পারল তারা? পৃথিবীটা বদলাল? খালি যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ। জানো, আমাদের গ্রামে আমরা একটা স্বপ্ন দেখি। উত্তরা : কী স্বপ্ন? বামন গার্ড : দেখি আশপাশে সব আমাদের মতো বামনে ভরে গেছে। তারাই চালাচ্ছে সব। মানুষ ভালো আছে।’১৪ এই বামন সম্প্রদায় নিশ্চিতভাবেই একটি প্রতীকী সম্প্রদায় যারা শুভতার, মরমীয়তার, সহিষ্ণুতার মঙ্গলবীজ বর্তমান যুদ্ধজীর্ণ উষরক্ষেত্রে বপন করতে চায়। এই বামন গার্ডের সংলাপের মধ্য দিয়েই বুদ্ধদেব স্বপ্ন ফেরি করেন দর্শকমননে। গার্ড যখন বলেন যে – ‘যারা স্বপ্ন দেখে না, তারা স্বপ্ন দেখার লোকগুলোকে সরিয়ে দিতে চায়’ তখন কী আর বুঝতে বাকি থাকে যে এই অনুভব আসলে বুদ্ধদেবের নিজেরই! তিনিই স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন বামন সম্প্রদায়ের পেছনে। বামন সম্প্রদায়কে প্রতীকরূপে ‘উত্তরা’য় আনা ও তাদেরকে দিয়ে মূল বক্তব্য প্রকাশ করা বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনার শৈল্পিক প্রকাশই বটে।

 

সমষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতা

নিম অন্নপূর্ণা উপনিবেশ-উত্তর পশ্চিমবাংলার সমাজবাসত্মবতার সামষ্টিক সংকটের চলচ্চিত্র। কমলকুমার মজুমদারের গল্প অবলম্বনে তৈরি এ চলচ্চিত্র সম্পূর্ণভাবেই একটি বাসত্মববাদী নির্মাণ। সমষ্টির সংকট বটে কিন্তু তাকে রূপ দেওয়ার জন্য ব্যষ্টিকে আনতে হয়েছে চরিত্র করে; বাসত্মবখ- হয়েছে দৃশ্যমাত্রার প্রধান উপাদান। খাদ্যের অভাবে গ্রামে টিকতে না পেরে ব্রজ তার স্ত্রী প্রীতিলতা ও দুই কন্যা যূথী ও লতিকে নিয়ে ট্রেনে চেপে কলকাতা চলে আসে। বসিত্মতে ওঠে। ব্রজ কাজ খোঁজে, পায় না। ধার করতে যায়, তাও পায় না। বড় মেয়ে যূথী চায়ের দোকানে কাজ নেয়। ছোট মেয়ে লতি এক বাড়ির বারান্দা থেকে খাঁচার পাখির জন্য বরাদ্দ ছোলা চুরি করে খায়। ব্রজর সংসার চলে ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করে, পাশের ঘর থেকে আটা এনে। ব্রজের পাশের খুপরিতে এক বৃদ্ধ ভিখারি থাকে। সে বসত্মায় চাল জমায়। প্রীতিলতা তা জানে। ক্ষুধার তাড়নায় প্রীতিলতা ভিখারিকে একদিন হত্যা করে চালের বসত্মাটি হাতিয়ে নেয়। অনেক দিন পর ভাত রান্না হয় ব্রজর ঘরে। অনেক দিন পর ব্রজ গরম ভাতের গন্ধ পায়। পেট পুরে সবাই খায়। শুধু প্রীতিলতা সবার সঙ্গে সমানতালে খেতে পারে না। একসময় প্রীতিলতা বৃদ্ধের ঘরের জানালার দিকে তাকায়। তার মুখে বমির ভাব। বাইরে এসে বমি করে, ভাত বের হয়ে আসে, প্রথম দৃশ্যের মতন। বস্ত্তত প্রথম দৃশ্যের পরই আখ্যান ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যায় এবং সেখান থেকে ফিরে এসেই শেষ হয়। যদিও এরপর একটি দৃশ্য যোগ করে বুদ্ধদেব অভাব-ক্ষুধা-দারিদ্রে্যর মিছিল যে থেমে নেই তা দেখান। এক ব্রজর গল্প আপাতত শেষ হলেও ব্রজর মতোই আরেকটি পরিবার ট্রেনে চেপে কলকাতা অভিমুখী হতে দেখা যায়।

মূল গল্পটি দেশভাগপূর্ব পশ্চিম বাংলার সমাজকাঠামোতে যে মন্বমত্মর দেখা দেয় এবং এর ফলে গ্রামীণ সমাজ থেকে ভিক্ষার আশায় কলকাতায় যে জনস্রোত ছুটে আসে, সেই পটভূমিতে রচিত। বুদ্ধদেব গল্পটিকে দেশভাগোত্তর সমাজবাসত্মবতায় প্রতিস্থাপন করে একটি নির্বিশেষ সময়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এখনো যে অভাব-দারিদ্রে্যর কারণে জনস্থানামত্মর প্রক্রিয়া চলছে তার কথা বলেছেন বুদ্ধদেব। মূল গল্প থেকে কিছুটা গ্রহণ করেছেন, কিছুটা বর্জন করেছেন এবং প্রয়োজনে কিছু বিষয় সংযোজনও করেছেন। তবে গল্পের মূল বক্তব্যকে মান্য করেই চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষায় নিম অন্নপূর্ণা নির্মাণ করেছেন। এ বিষয়ে বুদ্ধদেবের মতামত হচ্ছে :

সিনেমা সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাষায় বেড়ে ওঠা অন্য একটি মাধ্যম। লিখিত ভাষার সঙ্গে যার প্রয়োগগত কোনো মিল নেই। দশ-বারো পাতার গল্পটির একশো পাতার প্রাথমিক খসড়া চিত্রনাট্য যখন দাঁড়িয়েছে তখন লিখিত ভাষায় ‘নিম অন্নপূর্ণা’র ওপরের আবরণের সঙ্গে তার মিলের চেয়ে হয়তো অমিলই বেশি। আমি যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি মূল কাহিনি বা গল্পকে, তাই এসেছে চিত্রনাট্যে। ফলে চলচ্চিত্রে বিষয়টিতে এসেছে পরিচালকের সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, সমসময়ের সঙ্গে বিষয়টির যোগাযোগ ঘটিয়ে নতুনভাবে ভাবনার ব্যাপারটি। ফলে সময় বদলেছে, নতুন চরিত্র এসেছে, যূথী লতি হয়ে গেছে, ঘটনা এসেছে, নতুন সংলাপ এসেছে, এমনই হয়।১৫

 

বুদ্ধদেবের ভাষ্য থেকে ‘নিম অন্নপূর্ণা’ সম্পর্কে তাঁর নিজের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি অবগত হওয়া যায়। বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্র নিম অন্নপূর্ণা আর কমলকুমার মজুমদারের গল্প ‘নিম অন্নপূর্ণা’ মাধ্যম ও ভাষাগতভাবেই আলাদা। ‘নিম অন্নপূর্ণা’র ভাষা বিষয়বস্ত্তর কারণেই গদ্যধর্মী, কাব্যিকতা প্রশ্রয় পায়নি। ক্ষুধা আর অভাবের রাজ্যে জীবন যে গদ্যময়! এতে ইতঃপূর্বে আলোচিত ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রের মতন কল্পনা ও স্বপ্নের স্থান হয়নি। বাসত্মব যে বড় নির্মম-নিষ্ঠুর। দৃশ্যসমূহের পশ্চাৎপট মনোরম প্রকৃতি-ল্যান্ডস্কেপনির্ভর নয়, যা ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রে দেখা যায়। এর দৃশ্যপট দিনানুদৈনিক ঘটনানির্ভর।

দৃশ্যমাত্রায় নিষ্ঠুরতার চিত্রায়ণ প্রথম দৃশ্যেই করা হয়েছে : প্রীতিলতাকে দেখা যায় ক্যামেরার সামনে এসে বমি করতে, শেষ দৃশ্যেও তাই। তখন দর্শক বুঝতে পারে এই নিষ্ঠুরতা চিত্রায়ণের প্রকৃত কারণ। বস্ত্তত ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে কাহিনি উন্মোচনে। ফ্ল্যাশব্যাক চলচ্চিত্র ভাষার নিজস্ব সম্পদ। সমষ্টিপ্রধান বিষয় বলে আলোচ্য চলচ্চিত্রে লোকেশন শুটিংকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রেললাইনের পাশের বসিত্ম, বাতিজ্বলা মহানগর কলকাতা, বিদ্যুৎচালিত ট্রেন, ট্রাম, বাস সবই ঘটনাস্থলে উপস্থিত। শট ধারণের সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে : প্যান, ট্র্যাক ইন-আউট, টিল্ট আপ-ডাউন, জুম ইন-আউট, লং টেক,  টপ-লো অ্যাঙ্গেল শট, অ্যারিয়াল শট, হ্যান্ড হেল্ড শট, স্ট্যাটিক শট ইত্যাদি। বেশিরভাগ দৃশ্য প্রাকৃতিক আলোতে চিত্রিত। ঘটনাস্থলে কুকুর, বেড়াল, আকাশে উড়মত্ম পাখির উপস্থিতি, অভিনয়ের স্কিম, চলচ্চিত্রের গতি, ডিটেইলসের ব্যবহার সবই বাসত্মবধর্মী। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় যে নিম অন্নপূর্ণায় নব্য-বাসত্মববাদী চলচ্চিত্রধারার লক্ষণ সুপরিস্ফুট। শট কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে ফ্রেমের ভেতরে ফ্রেম দৃষ্ট হয়। দরজা-জানালার মধ্য দিয়ে বাইরেটা ধরার বুদ্ধদেবীয় প্রবণতা এ চলচ্চিত্রেও বিদ্যমান। দৃশ্যমান ঘটনা দিয়ে ক্ষুধা নির্মিত হয়েছে, পাখির খাঁচা থেকে লতির ছোলা চুরি করে খাওয়া, বুড়ো ভিখারিকে মেরে চালের বসত্মা কেড়ে নেওয়া অভাবকে নথিভুক্ত করে। অভাব-ক্ষুধা এমনই যে, যে প্রীতিলতা বৃদ্ধ ভিখারির ফিরিয়ে দেওয়া দেয়াশলাইটি হাতে ধরে নিতে চায় না ভিখারি জাতের দিক দিয়ে নীচু বলে, সেই প্রীতিলতাই ক্ষুধার জ্বালায় তার সঙ্গে ধসত্মাধসিত্ম করে চালের বসত্মাটি ছিনিয়ে নেয়!

দৃশ্যমাত্রার মতো শব্দমাত্রার উপাদান দিয়েও বুদ্ধদেব ক্ষুধা-অভাব-দারিদ্র্যকে উপস্থাপন করেছেন। ব্রজ ও তার পরিবারের ট্রেনে চেপে কলকাতা আসার দৃশ্যেই একজন ধারাভাষ্যকার ব্রজর জীবনের গল্প বলা শুরু করে – ‘এক ছিল ব্রজ, তার ছিল এক বউ প্রীতিলতা। তাদের ছিল দুই মেয়ে, যূথী আর লতি। … একদিন আকাল নেমে আসে সেই গ্রামে’ ইত্যাদি। তৃতীয় পুরুষ কথাগুলো বলে। একে ‘ভয়েস ওভার ন্যারেশন’ বলা হয়ে থাকে, যা চলচ্চিত্র ভাষার নিজস্ব একটি উপাদান। বুদ্ধদেব স্বয়ং এই তৃতীয় পুরুষ। তিনিই নিম অন্নপূর্ণার কথক। এটি যে আকালের-মন্বমত্মরের গল্প তা প্রকাশ করার জন্য ধারাভাষ্যকারের প্রয়োজন ছিল। ভয়েস ওভার ন্যারেশন শুধু দর্শক কি দেখছে তা ব্যাখ্যা করে না, বরং কাউন্টার পয়েন্ট তথা দৃশ্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এতে দৃশ্য ও শব্দ উভয় ইমেজ একত্র হয়ে ন্যারেটিভ ইউনিটে পরিণত হয়।১৬

ধারাভাষ্য ন্যারেটিভকে সুসংহত করে; আবার এর ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করে দর্শককে এই অনুভবে আসতে বাধ্য করে যে, যা দেখানো হচ্ছে তা বাসত্মবের চলচ্চৈত্রিক উপস্থাপন – এর মধ্যে ডুবে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিবাদী ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে ধারাভাষ্যকে চলচ্চিত্রস্থ আখ্যান থেকে বিযুক্ত করার একটি চলচ্চৈত্রিক উপাদান হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। এই সূত্রে নিম অন্নপূর্ণাকে প্রতিবাদী ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বলা যায়। শুরুর মতো এ চলচ্চিত্রে ধারাভাষ্য মাঝে ও একেবারে শেষেও ব্যবহৃত হয়েছে। এক ব্রজর গল্প শেষ হতে না হতেই ব্রজর মতোই আরেকটি অভাবী পরিবারকে ট্রেনে চেপে কলকাতার দিকে আসতে দেখা যায়। দৃশ্যের সঙ্গে ধারাভাষ্য লেপটে দেন বুদ্ধদেব – ‘ব্রজ আর প্রীতিলতার জীবনে সত্যিই কোনো গল্প ছিল না। … একদিন ওরা আর গেরস্থ থাকলো না। লতি গাড়ি চাপা পড়লো। … যূথী পালিয়ে গিয়েছিল বিশুর সঙ্গে। ব্রজ, ব্রজর বউ প্রীতিলতা এদেশের আরও অনেক নামহীন, গোত্রহীন, পেটে ভাতহীন লক্ষ লক্ষ ব্রজ আর প্রীতিলতাদের ভিড়ে হারিয়ে গেল। তবু নতুন ব্রজ নতুন প্রীতিলতাদের সব হারিয়ে কলকাতায় চলে আসা থেমে থাকলো না’।১৭ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, চলচ্চিত্রভাষার এই বিশেষ উপাদান ধারাভাষ্যকে ব্যবহার করে বুদ্ধদেব যেভাবে তাঁর বক্তব্য হাজির করেন তা তাঁর নন্দনভাবনার স্বরূপ প্রকাশ করে। জন ডবিস্নউ হুড এই ধারাভাষ্যকে ‘কোডা’ তথা সংগীতের সমাপ্তি অংশ বলে অভিহিত করেছেন।১৮ ধারাভাষ্যের সাংগীতিক ব্যবহার প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রবীক্ষক অচিমত্ম্য নন্দী লিখেছেন :

ছবিতে ব্রজ প্রীতিলতাদের গল্প শেষ হওয়ার মুখে বুদ্ধদেব গল্পকে ভেঙ্গে দিয়ে তার বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যান। … আমরা দেখি একটি ট্রেন আসছে। ট্রেনের দৃশ্যটি হুবহু প্রথম দৃশ্যের মতো করে তোলা। নতুন বর, বউ, হেঁপো রুগি, জানলা দিয়ে দেখা বাইরের দৃশ্য, সব ঠিক ঠিক রেখে শুধু ব্রজ প্রীতিলতা লতি যূথীর জায়গায় ওদের বয়েসি অন্য মানুষজনকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে বুদ্ধদেব ছবির কাহিনি এবং আঙ্গিকে পৃথক ডাইমেনশন এনে দেন।… একটি প্রতীকী দৃশ্যের অবতারণা করেন।… ব্রজ প্রীতিলতারা যখন মরছে তখন অন্য মেরুর লোকেরা কী করছে? অরণ্যদেবের সংবাদ পাঠের (ধারাভাষ্য) মধ্যে তার আভাস মেলে। বুদ্ধদেব শুধু এই দুটো অবস্থাকে পাশাপাশি এনে দর্শকের চোখের সামনে মেলে ধরেন। এতক্ষণ যে দর্শক গভীর সহানুভূতির সঙ্গে ব্রজ এবং তার পরিবারের প্রতিপক্ষ রাখছিলো, সে হয়ে পড়ে ভীষণ অসহিষ্ণু। অভিনব এই দৃশ্য পরিকল্পনা। কোন রকম ‘বড় কথা’ না বলেই বুদ্ধদেব ছবিটিকে প্রতিবাদী করে তোলেন।১৯

 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের ভাষা ও তাঁর নন্দনভাবনার একটি বিশেষ দিকের পরিচয় পাওয়া যায় উপরোলিস্নখিত উদ্ধৃতিটি থেকে। গোটা একটি দৃশ্যকে বুদ্ধদেব ‘প্রতীক’ করে তুলেছেন। এবং তা দিয়েই নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করেন। কাজটি তিনি করেছেন শৈল্পিকভাবেই, তাঁর অভিরুচির নিরিখেই। পাখি, পেস্ননও একধরনের প্রতীক হিসেবেই এ চলচ্চিত্রে এসেছে।

শব্দমাত্রার উপাদান হিসেবে সংলাপ এ চলচ্চিত্রে মিনিমালিস্ট অ্যাপ্রোচ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে। অল্প কথায় বাসত্মবধর্মী সংলাপের মাধ্যমে চরিত্রের মনসত্মত্ত্ব, ঘটনাবলির নেপথ্য কারণ, ব্রজ-প্রীতিলতাদের অতীত ইতিহাস ইত্যাদি ব্যক্ত হয়েছে। তবে অতীত নির্মাণ করতে গিয়ে তথা ব্রজর গাঁয়ের কথা, জমিজমার কথা, নিজেদের বিয়ে প্রসঙ্গ ইত্যাদি দর্শকদের জানাতে গিয়ে যে সংলাপগুলো এসেছে সেগুলো আরোপিত বলে মনে হয়েছে। এরকম একটি বাসত্মবধর্মী নির্মাণে এধরনের সংলাপ না থাকলেই ভালো হতো। ছোট্ট মেয়ে লতির মুখে – ‘জল চিবিয়ে খেলে পেট ভরে যায়’ সংলাপটিও বেমানান লেগেছে। অচিমত্ম্য নন্দীর মতে, ‘এই সংলাপের মজা আছে, কবিতার পঙ্ক্তির মতো তীক্ষনতা আছে। কিন্তু যে বাসত্মবতা উনি ছবিটিতে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন, সংলাপটি তার অমত্মরায় হয়ে দাঁড়ায়।’২০ এটুকু ছাড় দিলে বাকি সব সংলাপই পরিমিত, বাসত্মবধর্মী, ক্ষুধার আগুনে পোড়া, অভাবের দুর্দিনে ঝলসানো – ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রের মতন হেঁয়ালিপূর্ণ নয়।

ব্রজর সংলাপে ভাতের গন্ধ পাওয়ার প্রসঙ্গ, অভাবী কারো ট্রেনের তলায় আত্মহত্যা করার খবর প্রীতিলতাকে দেওয়া, ঘরের সবাই এটা সেটা বলে ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়া চলচ্চিত্র-পরিসরে অভাব ও কষ্ট উৎপাদন করে। খালি গলায় বৃদ্ধের কণ্ঠের ছাড়া-ছাড়া গানও সুপ্রযুক্ত – ‘এই গান প্রীতিলতাকে তার ফেলে আসা সুখের দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং এই কাজটুকু সম্পন্ন করেই সংগীতের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তা কখনো দর্শকের আলগা মনোরঞ্জনের কারণ হয় না। তা যদি হতো, তবে সেটা ছবিতে ছন্দপতন ঘটাতো নিশ্চয়ই।’২১ বাসত্মবধর্মী চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহারের ধরন নির্মাতার নন্দনভাবনার আলোকেই সম্পন্ন হয়েছে। আরেকটি জায়গায় যেখানে বৃদ্ধ আর প্রীতিলতা চালের বসত্মা নিয়ে ধসত্মাধসিত্ম করছে তখন সাউন্ডট্র্যাকে ঢাকের বাদ্য ও রেডিওতে দেশাত্মবোধক একটি গানের প্রথম অংশ শোনা
যায় : ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্থাঁ হামারা।’ কিছুটা যেন ব্যঙ্গ করলেন বুদ্ধদেব ভারতবর্ষের বর্তমান অবস্থাকে এই গান দিয়ে। এখানেও তাঁর নন্দনভাবনার প্রয়োগ ঘটেছে। ‘দূরত্ব’তে সাউন্ডট্র্যাকে আবহসংগীত হিসেবে সংগীতখ- বাজতে শোনা যায় – নিম অন্নপূর্ণায় তা উধাও। এখানে পারিপার্শ্বিক শব্দ হিসেবে কাকের কর্কশ ডাক,
ট্রাম-বাস-ট্রেনের ধাতব শব্দ, বাচ্চার কান্না, ড্রামের বাদ্য ইত্যাদিই প্রধান হয়ে উঠেছে। অভাবের অনুবাদে এইসব শব্দখ–র প্রয়োগ বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনার একটা অংশ যেন।

নিম অন্নপূর্ণার সম্পাদনাগত কাঠামোটি মিশ্ররীতির – আখ্যানের কিছু অংশ নিটোল। টানা গল্প এগিয়ে নেওয়ার রীতি দ্বারা গঠিত। দৃশ্য ও শব্দখ–র নিরবচ্ছিন্ন মিশ্রণে আখ্যান এগিয়ে যায়; কিছু অংশ নথিচিত্রের ঢংয়ে চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছে। ফলে এর ভাষাশৈলীতে বুদ্ধদেবের নিজস্ব একটি ভাবনা কাজ করেছে। নিম অন্নপূর্ণার তাৎপর্যগত মাত্রাটিতেও বুদ্ধদেবের জীবনদর্শনের পরিচ্ছাপ পাওয়া যায়, যা তাঁর নন্দনভাবনার নিরিখেই গঠিত। বুদ্ধদেবের মানসকাঠামোতে নারী চরিত্র তার সব কটি রূপ নিয়েই উপস্থিত। নিম অন্নপূর্ণাতেও প্রীতিলতার যৌনতার প্রকাশ দেখিয়েছেন একটি দৃশ্যে, যেখানে রাতে রিরংসা প্রসারের জন্য সে ব্রজর কাছে আসে। কিন্তু ব্রজ কোনো সাড়া দেয় না, অভাবে পড়ে সে যৌনশীতলতায় ভুগছে। নারী-পুরুষের যৌনতার প্রসঙ্গটি এনে বুদ্ধদেব একটি বক্তব্য উপস্থাপন করলেন : অভাব মানুষের সব ধরনের কামনা-বাসনাকে পঙ্গু করে দেয়।

নিম অন্নপূর্ণা দারিদ্র্য-দুঃখে লীন মানুষের কাব্য। সম্ভবত এ কারণেই এটি সাদা-কালোয় নির্মিত। তাই যদি হয়, তাহলে
সাদা-কালোয় নির্মাণের প্রবণতাকে নিশ্চয় করে বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনার একটি প্রসঙ্গ বলে ধরে নেওয়া যায়। চলচ্চিত্রটি ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর নির্জন একাকিত্বের একস্বরিক পাঁচালী নয়, সমষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর ক্ষুধা-অভাব-দুর্ভিক্ষের বহুস্বরিক পাঁচালী। বুদ্ধদেব ক্ষুধার নন্দনতত্ত্বের সন্ধান করেছেন নিম অন্নপূর্ণায়।

তাহাদের কথার আখ্যান ব্যষ্টি শিবনাথকে কেন্দ্রে রেখে এগিয়ে গেলেও শিবনাথের নিজের একার আখ্যান নয়। এটা ব্রিটিশবিরোধী সর্বভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রাম, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিপস্নবীদের কারাবরণ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিশ্বাসঘাতকতা, ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং তৎপরবর্তী পশ্চিম বাংলার সমাজ-রাজনৈতিক বাসত্মবতার পটভূমিতে পরিব্যাপ্ত সামষ্টিক আখ্যান। কমলকুমার মজুমদারের গল্পকে গ্রহণ-বর্জন-সংযোজন প্রক্রিয়ায় সিদ্ধ করে বুদ্ধদেব তাঁর নিজের বলবার বিষয়টিকে চলচ্চৈত্রিক ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। শিবনাথ পূর্ব বাংলার মানুষ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশভাগের পূর্বে ১১ বছর জেল খাটে ও একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। দেশভাগের পর ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে (১৯৫১-’৫২) শিবনাথ পূর্ব বাংলার পাগলা গারদ থেকে পশ্চিম বাংলার গড় শিমলায় স্থানামত্মরিত হয়। এখানে তার স্ত্রী হেমাঙ্গিনী, পুত্র জ্যোতি এবং কন্যা অন্নপূর্ণা বাস করে। পূর্ব বাংলার বিপস্নবী বন্ধু বিপিন ও মহীতোষও এখানেই থাকে।

গড় শিমলায় এসে শিবনাথ বুঝতে পারে, যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সংগ্রাম করেছিল তার কিছুই এখন আর নেই। বিপিনও বদলে গেছে। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে আছে। শুধু মহীতোষ আদর্শ না বিকিয়ে সাঁওতাল এলাকায় গিয়ে স্কুল খুলে ছেলেমেয়েদের পড়ায়। জাদুকর আবদুলস্নাহ তার সাগরেদ বামনীকে নিয়ে জাদু দেখায়। শিবনাথকে ব্যবহার করতে চায় বিপিন তার ইলেকশনের স্বার্থে। বিপিন সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে এক মাড়োয়ারি (আত্মারাম) সাহায্য করছে। মাড়োয়ারি একটা স্কুল খুলতে চায়, যেখানে শিবনাথকে শিক্ষক হতে বলে। এর জন্য তার একটা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দরকার, স্থানীয় ডেপুটির কাছে নিয়ে যাওয়া হয় সার্টিফিকেটের জন্য। ডেপুটি শিবনাথের কাছে জানতে চায় সে ‘টেররিস্ট’ কি না। শিবনাথ কোনো জবাব না দিয়ে চলে আসে। একদা স্বাধীনতার সংগ্রামীকে আজ টেররিস্ট ভাবা হয়! শিবনাথ কোনোকিছু মেনে নিতে পারে না, প্রত্যাখ্যান করে। হেমাঙ্গিনী চেয়েছিল শিবনাথ সবকিছু মেনে নিক, তাহলে একটু ভালো থাকা যাবে, শিবনাথ হেমাঙ্গিনীর অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করে। শুধু ছেলে জ্যোতি বাবাকে বুঝতে পারে, তার পাগলামিকে মেনে নেয়। অন্যরা তাকে পাগল ভেবে হেনস্থা করে। শেষমেশ শিবনাথের পায়ে শিকল পরানোর চেষ্টা চলে। শিবনাথ বুঝতে পেরে বাইরে ছুটে আসে, এসে দেখে জাদুকর আবদুলস্নাহ মানুষকে জাদু দেখিয়ে সমাজের সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কাজটি করেই চলেছে। জাদুকর যেন বিপিন, আত্মারাম, ডেপুটি এবং অনুপস্থিত ক্ষমতা কাঠামোর সেবাদাস। শিবনাথ এই সেবাদাসকে হত্যা করে, পরিণামে তাকে আবার জেলবাস বরণ করতে হয়। এই যে আখ্যান তা সমষ্টির সংকটকেই পর্দায় উপস্থিত করে। এতে ব্যষ্টির কল্পনা ও স্বপ্নের চিত্রায়ণ নেই।

সমষ্টির সংকটের উপস্থাপনায় বাসত্মব ঘটনাখ-, প্রকৃতি, নির্মাণকালীন সমাজ-রাজনৈতিক বাসত্মবতা (১৯৯১-৯২) স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামো ইত্যাদি দৃশ্যমাত্রায় প্রাধান্য পেয়েছে। শুরুতেই গোধূলির লালচে আকাশ, রাজসিক সৌন্দর্যের অধিকারী প্রকৃতি দৃষ্ট হয়। তার মধ্যে এক ফেরিওয়ালা, পিঠে বিরাট একটি আয়না বেঁধে মেয়েদের সাজগোজের জিনিস নিয়ে ডাকতে ডাকতে চলেছে। বিপিনসহ শিবনাথ ট্রেন থেকে নেমে এই পথেই, এই অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভেতর দিয়েই বাড়ি আসে – স্ত্রী, পুত্র, কন্যার সঙ্গে দেখা হয়। তারপর থেকে আখ্যানে যা যা ঘটে সবই অসমতল, উঁচু-নিচু ভূমি, রেলওয়ের ব্রিজ, বৃক্ষশোভিত বন, শামত্ম-স্থির নদী, বিসত্মীর্ণ প্রামত্মর, টিলা প্রভৃতির মাঝেই ঘটে। ক্যামেরা এসব ছেড়ে কোথাও যায় না। বুদ্ধদেব এরকম কম্পোজিশন, ফ্রেমিং, ক্যামেরার চলাচল দিয়েই তাহাদের কথার দৃশ্যমাত্রাটি তৈরি করেছেন। এটা এই চলচ্চিত্রের ভাষাশৈলীর অন্যতম একটি দিক। চরাচরের নির্মাণশৈলীর প্রবণতাটি এখানেও পাওয়া যায় – জানালা, দরজা, আয়নার ভেতর দিয়ে এ চলচ্চিত্রেও চরিত্রদের ধরা হয়েছে। এর ফলে ফ্রেমিং নিখুঁত ও কাব্যিক হয়ে উঠেছে। ক্যামেরার চলাচল হয়েছে কবিতার চরণের মতো ছন্দোবদ্ধ, মাত্রানির্ভর, পর্বভিত্তিক; যা চলচ্চিত্রটির ভাষাশৈলীকে নির্মাণ করেছে। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ চৌধুরীর অভিমত :

বুদ্ধদেবের শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ভেনু (ক্যামেরা সঞ্চালক) ক্যামেরাকে শস্নথ রাখে, মাঝে মাঝে সময় বইয়ে দেন, টাইম ল্যাপস করেন। এই আঙ্গিক-প্রকরণ দর্শককে বিষয়ের অমত্মঃসত্মরে টেনে নিতে সাহায্য করে। মন ধাক্কা পায় না ‘কাট’গুলোতে বরং নিমজ্জিত হয়ে যায়। এবং ক্যামেরার এই প্রকরণের সাহায্যেই বুদ্ধদেব নীরবতা-ভাষা ব্যবহার করেন শিল্পের উঁচু মান মনে রেখে। ঘরের ভেতরের কিছু দৃশ্যেও ক্যামেরার ব্যবহার নিছক প্রকরণগত কারণেই স্মরণীয়। ক্যামেরা ধীর, কিন্তু অনায়াস গতিতে সামনে যায়, পিছিয়ে আসে, ডাইনে-বাঁয়ে যায়। একবারও না কেটে এর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন অবস্থানে বসা বা দাঁড়ানো চরিত্রগুলোকে কী করে ক্যামেরা ধরেছে, সচেতন দর্শককে ভাবায়। … বুদ্ধদেব একটা ট্রলির ওপর আর একটা ট্রলি চাপিয়ে তার ওপরে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন। ওপরের ট্রলি প্রয়োজনে সামনে গেছে বা পিছিয়ে এসেছে, আর নিচের ট্রলি ঠেলে চালিয়ে প্রয়োজন মতো ক্যামেরা ডাইনে-বাঁয়ে নিয়েছেন। এই উদ্ভাবনে ঘরের মধ্যের দৃশ্যগুলোতে এত মসৃণ স্বচ্ছন্দ গতি এসেছে। ‘কাটে’র ঝাঁকুনি কোথাও এই মসৃণতাকে আহত করেনি। ছবির মেজাজের দিক থেকেই, এর বিশিষ্ট শৈলীর দিক থেকেই প্রকরণগত বিঘ্ন এভাবে উত্তরণের উপায় নিয়ে ভাবতে হয়েছে।২২

 

বুদ্ধদেব যে তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা বিষয়ের অমত্মঃসত্মরের প্রয়োজনে, দৃশ্যের মূল ভাব-বিভাবের প্রকাশ ঘটানোর স্বার্থেই সৃজন করেছেন তার কিছুটা আভাস উদ্ধৃতিটি থেকে পাওয়া যায়। অনেক দৃশ্যে সার্কুলার ট্রলির ব্যবহার করে দৃশ্য সংগঠনে কাব্যিক স্থিরতা এনেছেন বুদ্ধদেব। লং ট্র্যাক শট, সেস্না ট্র্যাক ইন-আউট, টিল্ট আপ-ডাউন, ধীর লয়ের প্যান, স্ট্যাটিক শট তাহাদের কথার ভাষা নির্মাণে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। প্রায়শই জানালা, আয়না থেকে প্যান করে প্রকৃতিতে চলে যায় ক্যামেরা; ট্রেনের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখে শিবনাথ, বিপিনের ঘরেও জানালা দরজা দিয়ে বাইরেটা ধরা হয়; শিবনাথের ঘরের জানালা দিয়েই বাইরের বৃষ্টি ধরা হয়, অনেকগুলো জানালা ঘুরে আসে ক্যামেরা একই শটে; স্কুলের জানালা দিয়ে ধরা হয় শিবনাথকে; নির্জন ব্রিজের ওপর দিয়ে ধীরগতিতে চলে যায় রেলপুশ ট্রলি; রেলের ব্রিজের পিলারের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা জ্যোতি, অন্নপূর্ণাকে ধরা হয় – বিভাব জন্মানো কম্পোজিশন – ল্যান্ডস্কেপের অনবদ্য ব্যবহার – সব মিলিয়ে এ চলচ্চিত্রের ভাষাটি অবয়বিত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, এ চলচ্চিত্রে রাতের দৃশ্য অনেক। চলচ্চিত্রে রাত তথা আলো-অাঁধারি তৈরি করা কঠিন। চলচ্চিত্রে আলো দিয়েই অন্ধকার তৈরি করতে হয় – আলোর ব্যবহারের ধরনের ওপরই নির্ভর করে দৃশ্যের মেজাজ। তাহাদের কথায় আলোর নান্দনিক ব্যবহার করে বুদ্ধদেব তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা বয়ন করেছেন। চলচ্চিত্র যে প্রকৃত প্রসত্মাবে আলোর শিল্প তা বুদ্ধদেবের অন্যান্য চলচ্চিত্র দর্শনেও বোধগম্য হয়।

চলচ্চিত্রের ভাষার ক্ষেত্রে শব্দমাত্রাও দৃশ্যমাত্রার সমান ভূমিকা রাখে। তাহাদের কথায় শব্দমাত্রার প্রধান উপাদান হিসেবে সংলাপ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। সংলাপে অতীত নির্মিত হয়েছে : ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ, বিপিনদের বর্তমান অবস্থায় জমি-বাড়ি-অর্থের মালিক হওয়া, মহীতোষের দেশভাগোত্তর অবস্থা মেনে না নেওয়া – ইলেকশনের টিকিট, পারমিট, নেতৃত্ব, পার্টির তরফ থেকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে উচ্চপদ দেওয়ার প্রসত্মাব ফিরিয়ে দেওয়া, শিবনাথের ১১ বছরের কালাপানি, ইংরেজ সাহেবকে গুলি করে মারা, পূর্ব বাংলায় ফেলে আসা তাহেরপুরের কথা স্মরণ রাখা ইত্যাদি বিষয়ক সংলাপ অতীতকেই পুনর্নির্মাণ করে। বিপিন যে নাকখত দিয়ে ছাড়া পেয়েছে, শিবনাথ যে তা না দিয়ে ১১ বছর জেল খেটেছে, শিবনাথের জন্য পাবনার পাগলা গারদই ভালো ছিল, এসব প্রসঙ্গও সংলাপেই নির্মিত হয়। শিবনাথের বাবা দেশ ছাড়ার শোকে পদ্মায় ঝাঁপ দিয়ে মরে। মা কলকাতার রিফিউজি ক্যাম্প থেকে পাগল হয়ে পালায়, এসব তথ্যও সংলাপেই পাওয়া যায়।

এ চলচ্চিত্রের তাৎপর্যও কিছুটা সংলাপে বিবৃত হয়েছে। মহীতোষের সংলাপে বুদ্ধদেব এ তাৎপর্য স্থাপন করেন যে ‘লড়াই কখনও থাইম্যা থাকে না। অনমত্মকাল ধইরা চলে।’ ইংরেজ চলে গেলে যে দেশটা দেশীয় লুটেরা-পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে, তা-ও মহীতোষের সংলাপে ব্যক্ত করেন বুদ্ধদেব। মহীতোষ শিবনাথের সমামত্মরাল একটি চরিত্র। শিবনাথের মনমানসিকতার সম্প্রসারিত একটি মনসত্মাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব যেন মহীতোষ। শিবনাথের সংলাপেও তাৎপর্য গুঁজে দিয়েছেন বুদ্ধদেব। শিবনাথ বিপিনকে প্রশ্ন করে – ‘পাগল আমি না তোমরা … আমারে আমার স্বপ্নগুলা নিয়া বাইচ্যা থাকতে দাও।’ স্বপ্ন পাচার করেন বুদ্ধদেব শিবনাথের সংলাপে। শিবনাথ এ কথাও বলে যে – ‘আমার মা-ও নাই, মাদারল্যান্ডও নাই।’ বস্ত্তত সংলাপের মধ্য দিয়েই বুদ্ধদেবের বক্তব্য ও নন্দনভাবনার সারাৎসার প্রকাশিত হতে থাকে চলচ্চিত্রটিতে।

এ চলচ্চিত্রের আবহসংগীতে কর্কষধ্বনির ব্যবহার নেই। নস্টালজিয়া আক্রামত্ম সংলাপের সঙ্গে স্মৃতিমেদুর, মন কেমন করা সুরখ- বাজে। সাঁওতালদের ঝুমুর তালের গান পটভূমির বিসত্মৃতি বাড়িয়ে দেয়। রাতে ঝিঁঝিঁর ডাক নিসত্মব্ধতাকে আরো নীরব করে। ধীর গতির প্যানের সঙ্গে লঘু সুরে বাঁশি বাজে। বুদ্ধদেব সাউন্ড ইমেজকে ভিজ্যুয়াল ইমেজের সঙ্গী করে তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা দাঁড় করান এভাবেই।

তাহাদের কথা চলচ্চিত্রের ভাষা দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সম্পাদনাকর্মকেও বুদ্ধদেব শটস্থ ভাব-বিভাব-বিষয়ের নিরিখে সাঙ্গ করেছেন। বাছাইকৃত শটসমূহকে গেঁথে ছন্দোবদ্ধ সিন তৈরি করেছেন; সিনগুলোকে জোড়া দিয়ে ধীর গতিসম্পন্ন সিকোয়েন্সের জন্ম দিয়েছেন। সিকোয়েন্সনিচয়কে পরপর সংস্থাপন করে সত্মবক গঠন করেছেন; সত্মবকে সত্মবকে সাজিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন। এ কাজে মসৃণ কাট ও মিক্সের ওপরই নির্ভর করেছেন নির্মাতা। এর ফলে চলচ্চিত্র-পরিসরে ধীরলয়ের জন্ম হয়েছে। তাহাদের কথায় লয়ের উৎপাদন প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব জানান :

গল্পের পর স্ক্রিপ্টের প্যাটার্ন অর্থাৎ তা ন্যারেটিভ বা নন-ন্যারেটিভ বা দুয়ে মিলেমিশে ছবি হবে কিনা ঠিক করার পর আরেকটি বিষয় থাকে। সেটি হলো ছবির লয় কেমন হবে। এবং ছবিটির তাল বা ছন্দ বা রিদম কেমন হবে। লয় ব্যাপারটা এক-একটা ছবিতে এক এক রকম হয়। ধরুন, তাহাদের কথায় যে বিলম্বিত লয় ছিল তার মূল কারণ ছবিটির মূল চরিত্র শিবনাথ। যাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ছবির সুর।২৩

 

বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রের ভাষা ও তাঁর নন্দনভাবনার একটা জবানবন্দি পাওয়া যায় ওপরের উদ্ধৃতিটি থেকে। জন ডবিস্নউ হুড তাহাদের কথার সম্পাদনা কৌশলকে discontinuous editing তথা ধারাবাহিকতাহীন সম্পাদনা পদ্ধতি বলে অভিহিত করেছেন। এতে আখ্যান হয়ে পড়েছে কিছুটা ভাঙা ভাঙা, যা সময়কে সৃষ্টিশীল উপায়ে সংকুচিত করেছে, যা শিবনাথের সময় সম্পর্কিত দ্বিধাকে প্রকাশ করতে সহায়ক হয়েছে। তাছাড়া কিছু oppositional cut আছে, যেগুলো চলচ্চৈত্রিক সময় ও পরিবেশ সম্পর্কে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। যেমন একটি ঝড়ের দৃশ্যে জাদুকর আবদুলস্নাহ ও বামনিকে শিবনাথের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, কাট করে একই কম্পোজিশন থেকে নেওয়া পরবর্তী শটেই দেখা যায় তারা সবাই আছে কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি নেই; আরেকটি দৃশ্যে রাতে শিবনাথকে শিকল দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করা হলে সে ছুটে পালিয়ে বাইরে বনভূমিতে চলে আসে, কাটের মাধ্যমে পরের দৃশ্যে দেখা যায় সে বনভূমির মধ্য দিয়ে দৌড়োচ্ছে কিন্তু তখন দিন, রাত নয়।২৪ শট-সিন সংস্থাপনের এই প্রক্রিয়া নিশ্চয় করে বুদ্ধদেবের প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও শিল্পবোধকে জানান দেয়।

এ চলচ্চিত্রের তাৎপর্যগত মাত্রাটি বহুসত্মরবিশিষ্ট। একাধিক তাৎপর্য, বিবৃতি, বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে এতে। দেশভাগোত্তর পশ্চিম বাংলার সমাজকাঠামোর মধ্যে ব্যষ্টি শিবনাথের নির্জন সংগ্রামের চলচ্চৈত্রিক অভিব্যক্তি ঘটেছে তাহাদের কথায় যা একসময় সমষ্টির সংকট হিসেবেই প্রতিপন্ন হয়। বিষয়টি লক্ষ করে পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :

পরিচালক অর্থাৎ টেকস্টটির স্রষ্টার এ সময় ও ইতিহাসের সঙ্গে একটি সংলাপ এ ছবি। বিশেষ বীক্ষা বা ভিশন থেকে জাত এই ছবিটি আদ্যমত্ম রাজনৈতিক। এ মুহূর্তে যে তাহাদের কথা তিনি বলছেন, তা আসলে আমাদের কথা; এখানে যে পচন, যে বিট্রেয়াল বা বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু ওই ১৯৪৭ ও পরবর্তীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, তারপরের চার দশকব্যাপী ক্রমিক অধঃপতন, ক্রমিক চৈতন্যের মড়ক, রাজনীতি নামক মহান স্বপ্নের চরিত্রহীনতায় ধসে যাওয়ার কথাও বটে। … শিবনাথ সদর্থক চরিত্র। সে মানসিকভাবে বিপর্যসত্ম, পাগল – এ কথা যারা বলে, বুদ্ধদেব ছবির গভীর সত্মরে দেখান, আসলে উল্টো। সেই সুস্থ; সেই সুস্থ এক স্বপ্নের বীজকে বহন করে নিয়ে চলেছে … শিবনাথের তিক্ততা … কেবল ব্যক্তিক থাকে না। হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক। … ডমিন্যান্ট আইডিয়লজির প্রবল প্রত্যাখ্যানে তাহাদের কথা শুধু একটি ফিল্ম থাকে না, হয়ে ওঠে এক উচ্চারণ, utterance।২৫

 

উদ্ধৃতিটি দেশভাগ সম্পর্কে বুদ্ধদেবের তাত্ত্বিক অবস্থানটি যেমন নির্দেশ করে, তেমনি চলচ্চিত্রটি যে সমষ্টির সংকটকে কেন্দ্রে রেখে নির্মিত
তা-ও প্রতিস্থাপন করে। বর্তমান সময়েও চলচ্চিত্রটির বক্তব্যের যে প্রাসঙ্গিকতা আছে, এটি যে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র তা-ও স্পষ্ট করে উদ্ধৃতিটি। এ চলচ্চিত্রে প্রতীকী চরিত্র দিয়েও তাৎপর্য নির্মাণ করা হয়েছে : যেমন জাদুকর চরিত্রটি, প্রতারক-নিপীড়ক সমাজবাসত্মবতাকে সে জিইয়ে রাখে জনগণকে ভেড়া বানিয়ে। শিবনাথ যখন তার স্ত্রী ও বিপিনের তৈরি শিকলে বাঁধা পড়তে না চেয়ে ঘর থেকে ছুটে পালিয়ে জঙ্গলের পথে দৌড়োয়, তখনই দেখে জাদুকর জাদু দেখাচ্ছে, শিবনাথকে পেয়ে জাদুকর তার হাতে থুতু দিয়ে তা চাটতে বলে। শিবনাথ আক্রোশে তাকে হত্যা করে। ব্রিটিশপর্বে শিবনাথ ইংরেজ সাহেবকে গুলি করে হত্যা করে জেলে যায়, স্বাধীন (?) ভারতে প্রতারক সময় ও উচ্ছিষ্টভোগীদের দোসর জাদুকরকে হত্যা করে পুনরায় জেলে যায়। ফেরিওয়ালা-ও একটি প্রতীকী চরিত্র, জাদুকরের বিপরীতে তাকে স্থাপন করা হয়েছে আখ্যানে। পার্থপ্রতিমের মতে ‘ফেরিওয়ালা, যার আছে এক উজ্জ্বল আয়না। সে বিচ্ছিন্ন, তার আয়নাটি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে যায়, হাওয়ায় ঝরে পড়ে। এদের আয়নায় কখনই স্থির ধরা দেয় না সমাজ ইতিহাস, মাঝে মাঝে ছায়া ফেলে। কোনো হিগেমনি বা কর্তৃত্ব রচনা করতে পারে না। অথচ এদেশের অর্থনীতিতে সমাজে এরাই নতুন ডাক আনে…।’২৬ এধরনের প্রতীকী চরিত্র তৈরি করে নিজের বক্তব্য, বিবৃতি পেশ করার কৌশল বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনার সাক্ষ্য দেয় এবং তার চলচ্চিত্র ভাষার স্বরূপ নির্ণয় করে।

তাহাদের কথা ব্যষ্টি শিবনাথের পরাজয়ের আখ্যান হলেও এর শেষে সমষ্টির উত্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন বুদ্ধদেব শিবনাথের শিশু পুত্র জ্যোতির সরব উপস্থিতির মাধ্যমে। জ্যোতিকে শুরু থেকেই শিবনাথের প্রতিভূ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চারা যখন তার বাবাকে পাগল বলে ক্ষ্যাপায় বা তার মা ও বিপিন কাকা যখন শিবনাথের পায়ে শিকল পরাতে চায় তখন সে তা মানতে পারে না। শিবনাথকে যখন হাতকড়া পরা অবস্থায় ট্রেনে চেপে জেলে যেতে হয় তখন এই জ্যোতিই ট্রেনের পিছু পিছু দৌড়োয়। কেন দৌড়োয়? বুদ্ধদেবের নিজের কথায় তার উত্তর এরকম :

তাহাদের কথায় ছবির শেষে দেখতে পাই, কুয়াশার মধ্যে ট্রেন শিবনাথকে নিয়ে মিলিয়ে যায়। তার ছেলে জ্যোতি দৌড়োতেই থাকে লাইন ধরে। শিবনাথ কীভাবে যেন বুঝতে পেরেছিল যে, তার ছেলেমেয়ে দুজনেই তাকে ভালোবাসে। কিন্তু ছেলের মধ্যে কোথায় যেন একটা বাবাকে আবিষ্কারের চেষ্টা আছে। ফলে শিবনাথ এক জায়গায় বলে, জ্যোতির চোখে লড়াইকে পিছিয়ে দেবার মানুষগুলোর ছায়া যেন না পড়ে। এমন কিছু মানুষ থাকেনই যাঁরা সবকিছু নিজের স্বপ্নের সঙ্গে মেলাতে পারেন না। ফলে কষ্ট পান কিন্তু স্বপ্নই দেখে। … হয়তো জ্যোতি একামত্মভাবে আমারই। কেননা জ্যোতি এখনও বেঁচে আছে। বড়ো হচ্ছে আসেত্ম আসেত্ম, সমসত্ম স্বপ্ন নিয়ে। কোথায় আছে জানি না কিন্তু নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে। হয়তো এমন স্বপ্নসন্ধানী একাধিক জ্যোতি আছে।২৭

 

শিল্প ও শিল্পীপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রের ভাষা ও নান্দনিকতা

ফেরা শিল্প ও শিল্পীর সংকট নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র। এক অর্থে এটা ব্যষ্টি ও সমষ্টির মিলিত সংকট উপস্থাপন করে। শিল্পকর্ম সমষ্টির বিমোক্ষণ ঘটায়, শিল্পী তথা ব্যষ্টিকে সুকুমার বৃত্তি চর্চায় নিমজ্জিত রাখে। যখন শিল্প ও শিল্পী সংকটে পড়ে তখন দুয়ের মধ্যে অস্থিরতার প্রকাশ ঘটে; একটি সমাজের সাংস্কৃতিক বাতাবরণ সংকটের সম্মুখীন হয়। ফেরাতে আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি ধারা হিসেবে যাত্রা ও এর শিল্পীদের বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে যে সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচিত ‘সংক্রামক’ গল্পের চলচ্চিত্ররূপ ফেরা। এ চলচ্চিত্রের জন্যও গ্রহণ-বর্জন-সংযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই চিত্রনাট্য রচনা করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত।

কেন্দ্রীয় চরিত্র শশাঙ্ক যাত্রাপালা লেখক, অভিনয়শিল্পী। একসময় যাত্রাদলের মালিক ছিলেন তার জমিদার বাবা। দেনার দায়ে শশাঙ্ক যাত্রাদল বেচে দিয়েছিল এক কাঠ ব্যবসায়ীর কাছে। এখন তার গাঁয়ের লোক নীতিবাক্যপ্রধান শিল্পমূল্যে সজ্জিত পালা দেখতে আগ্রহী নয়। তারা চটুল নাচ-গাননির্ভর সসত্মা বিনোদন চায়। শশাঙ্ক পুরনো পৈতৃক জমিদারবাড়িতে একা থাকে, তার স্ত্রী যমুনা তাকে ছেড়ে তার এক বিশ্বসত্ম বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেছে। স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ার পেছনে সে নিজেও দায়ী। যাত্রাশিল্পের টানে সে স্ত্রীকে যথেষ্ট সময় দেয়নি। তাকে দেখভাল করে ভৃত্য রাশু। রাশু এক মূক-বধির নারীকে নিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে যাত্রাদলে ভাঙন ধরে, শশাঙ্কও যাত্রাশিল্পকে নিয়ে বাণিজ্য করার মানসিকতাকে মেনে নিতে পারে না। ফলে যাত্রাদল ছেড়ে দেয়, একা কালদীর্ণ জমিদারবাড়িতে বসেও তার পছন্দমতো পালা লেখে, মদ্য পান করে আর যাত্রাদলের পুরনো প্রপস সাজিয়ে রাখা ঘরে একা একা ঘুরে বেড়ায় নিশি পাওয়া-ঘোরে থাকা মানুষের মতন।

আখ্যান মোড় নেয় যখন শশাঙ্কের স্ত্রীর বোন সরযূ ও তার ছোট ছেলে কানু এসে পুরনো জমিদারবাড়িতে আশ্রয় নেয়। শশাঙ্ক তার ছেড়ে যাওয়া স্ত্রী যমুনার প্রতি তার ক্ষোভ সরযূর ওপর ঝাড়ে। বিধবা, সাদা শাড়ি পরা সরযূকে তার স্ত্রীর রঙিন শাড়ি, গয়না পরায়, বিছানায় নেয়। কানু সব দেখেশুনে শশাঙ্কের ওপর চটে থাকে। ওদিকে রাশু মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করে কল্যাণীকে বিয়ে করে, কিন্তু গণধর্ষণের শিকার হয়ে কল্যাণী মারা গেলে রাশু গাছে চড়ে আত্মহত্যা করে। একপর্যায়ে যাত্রাদলের ব্যবহার্য প্রপস ও যাত্রা সম্পর্কে কানুর কৌতূহল শশাঙ্ককে কানুর প্রতি ঔৎসুক্য করে তোলে, কানাইয়ের মধ্যে নিজের ছোটবেলাকে আবিষ্কার করে; ভাবে তার মধ্য দিয়েই যাত্রাশিল্পের চর্চাকে অব্যাহত রাখা যাবে; নিজের শিল্পগুণসম্পন্ন যাত্রাপালা লেখার অভ্যাস অব্যাহত রাখা যাবে। এরকম একটি ভাবনা থেকেই শশাঙ্ক যেন নিজের শিল্পীসত্তার কাছেই ফিরে আসে। ফেরার আখ্যানের এখানেই ইতি ঘটে।

এই আখ্যানের দৃশ্যমাত্রার লয়ও ধীর গতির। কারণ এর দৃশ্যখ-সমূহের অধিকাংশই শশাঙ্কের বিক্ষিপ্ত অথচ সামন্ত মানসিকতায় স্থিত সুস্থিতির প্রকাশ। দৃশ্যমাত্রা তৈরিতে ধীর গতির প্যান, ট্র্যাক ইন-আউট, টিল্ট আপ-ডাউন, জুম ইন-আউট, লো অ্যাঙ্গেল-টপ অ্যাঙ্গেল শট ব্যবহৃত হয়েছে। দৃশ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে ডিটেলের ব্যবহারে। কানুর দৃষ্টিতে যাত্রাদলের পুরনো প্রপস যেমন তলোয়ার, মুকুট, রাজা-রানী-সন্ন্যাসীর পোশাক ইত্যাদি দেখানো হয়েছে। কানু আরো দেখে পুরনো মরচে ধরা ট্রাঙ্ক। তাতে লেখা ‘অন্বিকা নাট্য কোম্পানী, প্রোঃ শ্রী শশাঙ্ক নারায়ণ রায়, বন্দিপুর’। সাউন্ড ট্র্যাকে যাত্রার বাজনা বাজে। ছোট্ট দুটি এপিসোড বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে : ঘোড়া চুরির দৃশ্য এবং পরিত্যক্ত বাগান থেকে গাছ কেটে নেওয়ার চেষ্টা ও তাতে শশাঙ্কের বাধা দেওয়া। শশাঙ্কের পরিবারের মৃতজনদের স্মরণে তৈরি স্মৃতিসত্মম্ভও দৃশ্যমাত্রায় স্থান পেয়েছে। এগুলো এ চলচ্চিত্রকে একটি বাসত্মববাদী নির্মাণ করে তুলেছে, ফলে এর ভাষাটি স্বাভাবিকতাবাদী।

দৃশ্য সংগঠনের ক্ষেত্রে মিজ-অঁ-শট ও মিজ-অঁ-সিনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। লং টেকের ব্যবহার দৃশ্যে স্থিরতা এনেছে, যা এই চলচ্চিত্রের মূল লয়। কল্পনার প্রসঙ্গ নেই বলে বিমূর্তনের প্রচেষ্টা এই চলচ্চিত্রে নেই। এই চলচ্চিত্রের দৃশ্যভাষা নির্মিতিতে পুরনো ভগণদশার জমিদারবাড়ির ঘর, দরজা, জানালা, খিলান, সিঁড়ি, পরিত্যক্ত বাগান, পুরনো পালঙ্ক, আসবাবপত্র, যাত্রাশিল্পে ব্যবহৃত প্রপস প্রভৃতি সহায়ক হয়েছে। শশাঙ্ক জমিদার তনয়, জমিদারদের স্বভাব সে ধরে রেখেছে : পায়রা, কুসিত্মগির পোষা, দাবা খেলা, মদ্যপান, দরবারি গান শোনা, চলাফেরার মূর্তিমান আভিজাত্যের প্রকাশ সবই শশাঙ্কের মধ্য দিয়ে দেখান বুদ্ধদেব। দৃশ্য কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে আয়নার ব্যবহার বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রের ভাষা সংগঠনে বরাবরই এক বিশেষ ভূমিকা রাখে, এ চলচ্চিত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যাত্রাশিল্প নিয়ে শশাঙ্কের আচ্ছন্নতার সম্প্রসারণ ঘটানো হয় কানুর মধ্যেও। কানু রাতে স্বপ্নে যাত্রার দৃশ্য দেখে। অতীত নির্মিত হয় দৃশ্যমাত্রায়। এ অতীত তার ভবিষ্যতেরই ‘ইঙ্গিত’। কানুকে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয় যাত্রাশিল্পে তার আগ্রহ সৃষ্টির মাধ্যমেই। তার আগ্রহের কারণেই তো শশাঙ্ক আবার নিজের শিল্পীসত্তাকে ফিরে পায়। ‘ইঙ্গিত’ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের নিজের অভিমত হচ্ছে :

ভালো সিনেমা অহেতুক বকবক করে না। অপ্রয়োজনীয় শব্দ আর কথোপকথন অতিষ্ঠ করে তোলে না। বরং ইমেজগুলো উপহার দেয় নানা ইঙ্গিত এবং সংকেত। এই ইঙ্গিতময়তাই জন্ম দেয় মিনিমালিজম এবং সেই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে মিসিং লিংকের। ভালো সিনেমা এই ইঙ্গিতের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই তার বিষয় উপস্থাপন করে। একজন কবি বা সাহিত্যিক বিভিন্ন শব্দ একসঙ্গে সংস্থাপন করে যে সুন্দর বাক্যটি রচনা করেন সেটি অনেক কিছু বলে দিয়েও কিছু বাকি রাখে, সেটিই ইঙ্গিত।২৮

 

দৃশ্য তথা ভিজ্যুয়াল ইমেজ দিয়ে যেমন ইঙ্গিত দেওয়া যায় তেমনি শব্দ তথা সাউন্ড ইমেজ দিয়েও ইঙ্গিত ও মিসিং লিংক তৈরি করা যায়। ফেরায় সরযূ যখন বুঝতে পারে কানুকে শশাঙ্ক তার নিজের দলে টানছে তখন সে শশাঙ্ককে বলে – ‘কানুকে তুমি ছেড়ে দাও।’ মদের ঘোরে এ কথার মানে শশাঙ্ক বোঝে না। সংলাপে এ জায়গায় এ ইঙ্গিতই দেওয়া হয় যে কানুর মধ্যে একটা পরিবর্তন আসন্ন। দর্শক এই মিসিং লিংকটা অনতিপরেই দেখতে পায় যখন শশাঙ্কের পথেই কানু হাঁটা শুরু করে। চলচ্চিত্রে অনেক প্রসঙ্গই ইঙ্গিতে বলা হয়েছে। শশাঙ্কের স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ইঙ্গিতপূর্ণ সংলাপে ব্যক্ত হয়েছে। কিছু প্রসঙ্গ উহ্য রাখা হয়েছে। সংলাপে বেশি জিনিস না ধরানো বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রভাষার একটি বিশেষ দিক। এটা একই সঙ্গে তাঁর নন্দনভাবনারও সূচক। এখানে এসেই তাঁর চলচ্চিত্র কবিতার ইঙ্গিতময়তার সঙ্গে বেজায় মিলে যায়।

কোনো বাক্য ব্যয় না করেও শুধু রং দিয়েও ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে ফেরায়। সরযূকে শশাঙ্কের ছেড়ে যাওয়া স্ত্রীর শাড়ি পরতে বাধ্য করে শশাঙ্ক। বিধবা সরযূ সাদা শাড়ি ছেড়ে রঙিন শাড়ি পরে। রং এখানে রূপক হিসেবে কাজ করছে – তবে এখানে রং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শশাঙ্কের মনের রং পরিবর্তিত হওয়াকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, না স্ত্রীর বোনকে মানসিকভাবে নিপীড়ন করাকে বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়, সম্ভবত ইঙ্গিতের কাজই এরকম দ্ব্যর্থবোধকতার জন্ম দেওয়া। দ্বিতীয় ইঙ্গিতটিই সত্য হতে পারে, কারণ সরযূ যখন রঙিন শাড়ি গয়না ঘুঙুর পরে রাতে শশাঙ্কের ঘরে যায়, হাতের চুড়ি দিয়ে শব্দ করে, সে নির্বিকার, ঘুমে অচেতন। সরযূ ফিরে আসে তার ঘরে, ছেলের পাশে। লক্ষণীয় যে এ চলচ্চিত্রেও বুদ্ধদেব যৌনতা, বিশেষ করে নারীর যৌনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। সরযূর অচরিতার্থ কামস্পৃহা গভীর রাতে গুমরে মরে। বুদ্ধদেবের নন্দনভাবনা এভাবেও প্রকাশ পায় ফেরার শরীরে।

এ চলচ্চিত্রে দৃশ্যমাত্রায় দুই কুসিত্মগিরের লড়াই ফিরে ফিরে আসে। জন ডব্লিউ হুডের মতে, এটি একটি মোটিভ হিসেবেই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এতে শশাঙ্কের নিষ্ঠুর মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে। দৃশ্যমাত্রায় শশাঙ্কের নিঃসঙ্গ চেতনার রূপায়ণ ঘটেছে নানা মাত্রায় – তার একাকিত্ব, যাত্রাশিল্প ঠিকভাবে চলছে না বলে তার নিজের ও অন্যের প্রতি ক্ষোভ, সন্দিগ্ধচিত্ততা – সবকিছুই ইঙ্গিতবহুল দৃশ্যমাত্রায় সংক্ষেপে প্রকাশ করেছেন বুদ্ধদেব। একেবারে নিজস্ব ধরনের পোয়েটিক টেকনিক ব্যবহৃত হয়েছে। বাসত্মবের টানা রূপায়ণের পরিবর্তে ফেরাতে বিমূর্তনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারার পস্নট বিভাজনরীতি থেকেও কিছু সরে এসেছেন বুদ্ধদেব। এ চলচ্চিত্রে খোলসের দিক থেকে বাইরে বাইরে সরল একরৈখিক আখ্যান বলার রীতি অনুসৃত হলেও তলে তলে গভীর-তল-ছোঁয়া তাৎপর্য রচনা করে চলেন বুদ্ধদেব।২৯

দৃশ্য ও শব্দমাত্রা দিয়ে এ চলচ্চিত্রে তাৎপর্য বুনে বুনে এগিয়ে গেছেন বুদ্ধদেব। শব্দমাত্রায় সংলাপের পাশাপাশি প্রতিবেশ উপযোগী শব্দ, আবহসংগীত, গান ব্যবহৃত হয়েছে, যা চলচ্চিত্রটির বাসত্মবধর্মী ভাষা সংগঠনে অবদান রেখেছে। সম্পাদনাগত কাঠামোটি একরৈখিক নয়, বারবার আখ্যান দিক বদল করেছে, বেশ কয়েকটি উপ-আখ্যান একসঙ্গে এগিয়েছে। শশাঙ্ক-যাত্রা; রাশু-কল্যাণী, শশাঙ্ক-সরযূ-কানু; শশাঙ্ক-কানু উপ-আখ্যানগুলো পরস্পর সম্পর্ক রেখে মূল আখ্যানটি গড়ে তুলেছে। ঘন ঘন কাট ব্যবহার না করায় সম্পর্কগুলো ছেদহীন মনে হয়েছে। এর ফলে মূল আখ্যানটির ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে কম মাত্রায়। দৃশ্যমাত্রার গতি মন্থর। বুদ্ধদেব লয় হিসেবে বিলম্বিত লয়কেই বেছে নিয়েছেন। এটা তাঁর নন্দনভাবনার লক্ষণ। নান্দনিক সৌকর্য নির্ভর করে শিল্পাঙ্গিকের উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করা হয় তার প্রকৃতির ওপর।৩০ বুদ্ধদেব চলচ্চিত্রশিল্পের সাংগঠনিক উপাদানসমূহ (আখ্যানের বৈশিষ্ট্য, দৃশ্যমাত্রা, শব্দমাত্রা, সম্পাদনাগত মাত্রা ও তাৎপর্যগত মাত্রা) ব্যবহার করে ফেরা নামের যে চলচ্চিত্রটি সৃষ্টি করেছেন তাই হয়ে উঠেছে এর ভাষা ও নন্দনভাবনার স্মারক। এ দুয়ের মাধ্যমেই তিনি চলচ্চিত্রটিতে বপন করে গেছেন তাৎপর্যসমূহ।

বহু তাৎপর্যময় ফেরার মূল সংকট ঘনীভূত হয় যাত্রাশিল্পের শৈল্পিক শুদ্ধতার প্রশ্নে। এ সংকট যুগপৎ শিল্প ও শিল্পীর। যাত্রাশিল্প শুদ্ধতা হারায় সাংস্কৃতিক রুচি বিকৃতির অনুষঙ্গে; শিল্পী তথা শশাঙ্ক সংকটে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয় যাত্রাশিল্পের শুদ্ধতা রক্ষার তাগিদে। বুদ্ধদেব শিল্প ও শিল্পীর সংকট তার নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্রে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের ভাষ্য :

শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি, ফেরা এবং বাঘবাহাদুর – এই তিনটি ছবিতেই কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি একজন পারফরমারের সমস্যার কথা। একজন শিল্পীর সমস্যা নিয়ে ভেবেছি। … আমার ফেরা ছবির যে নায়ক সে যাত্রা ভালোবাসে, পালাগান লেখে এবং সে দর্শকদের তার সেই পালার মধ্য দিয়ে, অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কিছু বলতে চায়। তার দর্শক গ্রামের সাধারণ মানুষ। সেই মানুষগুলোর চরিত্ররহস্য কিন্তু সে বোঝে। তবু বলেছে সফোক্লিস, শের আফগানের কথা। যদিও সে দেখছে দর্শক ঠিক চাইছে না এসব। এভাবে আর্থিক চাপে সে তার যাত্রাদল বিক্রি করে। … তার জমিজমা বিক্রি করে। কিন্তু এরপর সে এমন এক অবস্থায় পৌঁছায় যেখানে তার আর কোনো দর্শক নেই। তখন সে ভাবছে, তার যদি একজন দর্শকও থাকে তাহলেই সে পালা লেখার কাজটা চালিয়ে যাবে। সেই দর্শক সে খুঁজে পায় একটা বাচ্চা ছেলের মধ্যে। ভবিষ্যতের যে প্রজন্ম তার মধ্য দিয়ে সে দর্শককে খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে লেখাটা তাকে চালিয়ে যেতেই হবে।৩১

উদ্ধৃতিটি থেকে শশাঙ্ক-কানু উপ-আখ্যানের তাৎপর্যটি স্পষ্ট হয়। সদ্বিচারে বুদ্ধদেব কানুকে শিশুপ্রতিমা হিসেবে আশাবাদের প্রতীক করে তুলেছেন। কানুই এ চলচ্চিত্রের মূল সংকট থেকে উত্তরণের পথ নির্দেশ করে। শশাঙ্ক যেন নিজেকেই খুঁজে পায় কানুর মধ্যে। ফিরে আসে নিজের কাছে। তার শিল্পবোধকে কানুই টেনে নিয়ে যাবে, এরকম একটি স্বপ্ন সে কানুকে ঘিরেই দেখে। শশাঙ্ক শিল্পে-খাওয়া মানুষ; শিল্পই তার ধ্যান, শিল্পহীন জীবন তার কাছে অর্থহীন। তাই সে যাত্রাশিল্পকে উপজীব্য করে পণ্যপূজা হতে দিতে চায় না। বুদ্ধদেবও শিল্পে-খাওয়া ও চলচ্চিত্রে-পাওয়া মানুষ, তিনি বারবার তাঁর ‘মন কেমন করা’ চলচ্চিত্রগুচ্ছের মধ্য দিয়ে শিল্পের কাছেই ফিরে আসেন। কোথাও গিয়ে যেন ফেরার শশাঙ্ক, বাঘবাহাদুরের ঘুনুরাম, শীত গ্রীষ্মের স্মৃতির শৈবাল হয়ে গেছেন বুদ্ধদেব স্বয়ং। এরা যেন বুদ্ধদেবের প্রাণ, কবিসত্তা, মানবদরদি মনের প্রতিভূ। প্রণবরঞ্জন রায় ঠিকই ধরেছেন যে ‘বুদ্ধদেব শিল্পী হিসাবে শিল্পের দাবির কাছে, মানুষ হিসাবে নিজের কাছে, মানবিক সম্পর্কের কাছে, মানবিক-অনুভূতির কাছে দায়বদ্ধ। তিনি মনে করেন এগুলিই শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। … শশাঙ্ক তো বুদ্ধদেবের মতনই একজন পারফরমিং আর্টের স্রষ্টা, তার চরিত্র সৃষ্টি করে বুদ্ধদেব কি শিল্পী হিসেবে নিজের সমস্যা এবং নিজের প্রত্যয়ের কথাই বলতে চাননি? মনে তো হয় সব ঘনিষ্ঠ আত্মসচেতন শিল্পসৃষ্টির মতনই ফেরা কিঞ্চিদধিক আত্মজৈবনিক সৃষ্টি।’৩২

 

অভিনিষ্পত্তি

শিল্পকর্ম সততই দুঃখবোধসঞ্জাত। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবি। ‘কবির হৃদয়ে’ দুঃখবোধ বারো গুণ বেশি হয়ে বাজে। তার চলচ্চিত্রও ব্যষ্টি ও সমষ্টির দুঃখেরই পদাবলি। বর্তমান রচনায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত রচিত ছয়টি চলচ্চিত্রে বিদ্যমান চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনভাবনার উপস্থিতিকে পাঠ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উপলব্ধ হয়েছে যে তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনতাত্ত্বিক পরিকাঠামো সংগঠনে নিজ দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাতাবরণ যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনি বিশ^ চলচ্চিত্রের কোনো কোনো স্রষ্টার কাজেরও পরিচ্ছাপ পড়েছে। এতদ্সঙ্গে দেখা গেছে চলচ্চিত্রগুলো শিল্প-চলচ্চিত্র পর্যায়ভুক্ত এবং নির্মাতার দুঃখবোধজাত ব্যক্তিগত উচ্চারণের ফসল। স্ব-উদ্ভাবিত চলচ্চৈত্রিক ভাষা ও স্বকীয় নন্দনভাবনার সাহচর্যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত। মানবদরদি এই চলচ্চিত্রশিল্পীকে ব্যষ্টি ও সমষ্টির নানাবিধ সংকট এবং শুদ্ধ শিল্প ও শিল্পীর সংকট ভাবিয়েছে। তার চলচ্চিত্র শিল্প-চলচ্চিত্র পদবাচ্য, নিরীক্ষাধর্মী, কাব্যিক তো বটেই। প্রাথমিক সত্মরে বাসত্মবমথিত একটা আখ্যান থাকে। কিন্তু অচিরেই তাতে মিশে যায় কল্পনা, জড়িয়ে ধরে স্বপ্ন, ব্যাপ্তি পায় বক্তব্য।

ব্যষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রে ব্যষ্টির সংকট, নৈঃসঙ্গ্যচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, আশাবাদ, যৌনতা ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। এগুলো ধরার জন্য বাসত্মবতার সঙ্গে স্বপ্ন-কল্পনা মেশাতে হয়েছে। এ সূত্রে এ ধাঁচের চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনভাবনা বুদ্ধদেবের নিজস্ব রুচি ও শিল্পবোধের দ্বারা নিরূপিত হয়েছে। সমষ্টিপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রে অভাব, নিষ্ঠুরতা, অনন্বয়, মানবিক সম্পর্ক-ব্যবস্থার অবনমন, মানবতাবাদ, আশাবাদ, রাজনীতি, সমাজ সংকট, গূঢ়ার্থ প্রভৃতি আদৃত হয়েছে। শিল্প ও শিল্পীপ্রধান বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্রে শিল্পের শুদ্ধতার বিষয়টি সামনে এসেছে এবং এর বিকৃতিতে শিল্পী মানসিক সংকটে পড়ে যে বৈক্লব্যের শিকার হয় তা চিত্রিত হয়েছে; আত্ম ও গণবিমোক্ষণের জন্য শিল্পের যে একটি উপযোগিতা আছে তা ব্যক্ত হয়েছে।

বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রে কতকগুলো বিষয় রিপিটেটিভ মোটিফ হিসেবে ফিরে ফিরে এসেছে : বামন, কুসিত্ম লড়া, আশাবাদের প্রতীক হিসেবে শিশুপ্রতিমা, লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান, কালচারাল কোড, মিনিমালিস্ট অ্যাপ্রোচ প্রভৃতি। সব মিলিয়ে তাঁর কৃত চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রের ভাষায় লিখিত একেকটি উপন্যাস। এইসব চলচ্চৈত্রিক উপন্যাসে বহুস্বর, বহুসত্মর, বহুভঙ্গিমা, বহুবচনের উপস্থিতি প্রবল। স্বরগুলো কখনো ব্যষ্টির, কখনো সমষ্টির আবার কখনো উভয়ের। প্রকৃত প্রসত্মাবে স্বরগুলো বুদ্ধদেবের শিল্পীসত্তার আর্তি, হাহাকারেরই স্পন্দন। শিল্পী হিসেবে যে কষ্টগুলো তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের আখ্যানগুলোতে দেখতে পেয়েছেন সেই কষ্টগুলোকেই তিনি চলচ্চিত্রের ভাষা ও নন্দনভাবনা দিয়ে চলচ্চিত্র-পরিসরে খোদাই করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি শুধু চলচ্চিত্র স্রষ্টার দায়িত্বই পালন করেননি, একজন সমাজ-সমীক্ষক, ইতিহাসবিদ, সমাজ-মনসত্মাত্ত্বিক ও দার্শনিকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি শুধু বহু চরিত্রের স্বরে তাদের কষ্টের বয়ানই উপস্থিত করেননি, নিজের কথাটিও চলচ্চিত্র নির্মাণের ছলে বলেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন সমাজ-পরিসরে কষ্ট-দুঃখ-অভাব-পারক্য থাকবেই, এগুলো লাঘব করতে হলে এগুলো যে কারণে উৎপন্ন হয় সেগুলো নিরসন করতে হবে। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়ে কাজটি করা যাবে না, নিজে উপস্থিত থেকে বা প্রতিনিধি রেখে গিয়ে কাজটি করার বাসনা জিইয়ে রাখতে হবে। ক্রমাগত চলচ্চিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে এই বাসনা জিইয়ে রাখার স্বপ্ন তিনি দর্শকমননে চালান করেছেন। তাঁর চলচ্চিত্র তাঁর নিজের কথায় : ‘‘একটি ফাঁকা গস্নাসে কিছুটা স্বপ্ন, কিছুটা বাসত্মব আর কিছুটা ম্যাজিক মিশিয়ে যে ‘শেক’টি তৈরি হয় তাই আমার সিনেমা।’’৩৩ এই শেক পান করে দেখলাম এর স্বাদ অমৃতসমান। n

 

 

তথ্যনির্দেশ ও টীকা

১.      দ্রষ্টব্য : Metz, Christian. Film Language : Semiotics of the Cinema, Oxford University Press, New York, 1974, p. 40

২.     আউয়াল, সাজেদুল। চলচ্চিত্রকলার রূপ-রূপামত্মর, দ্বিতীয় সংস্করণ, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ১৪৮।

৩.     Freeland, Cynthia A. & Waternberg, Thomas E., Philosophy and Film, Routledge, New York, 1995, p.5

৪.     চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে লেখা হয়েছে – ‘Aesthetics covers reflection upon the phenomena of signification considered as artistic phenomena. The aesthetics of cinema is therefore the study of the cinema as an art and the study of films as artistic messages. It implies a conception of ‘beauty’ and thus of the taste and pleasure of the spectator as well as the theoretician. Film aesthetics therby depends upon general aesthetics, philosophical discipline concerned with all arts. Aesthetics of the cinema presents two facets : first, there is the general aspect that contemplates the aesthetic effects proper to the cinema; second, there is the specific aspect, centered on the analysis of particular works. This is film analysis, or criticism in the normal sense of the term, as it is used in the plastic arts and musicology.

– Aumont, Jacques et. al. Aesthetics of Film, University of Texas Press, Austin, 1992, p. 6

৫.     ভৌমিক, সোমেশ্বর। ‘মৃণাল সেনের অমত্মহীন অন্বেষণ’, মৃণালমানস, সাজেদুল আউয়াল (সম্পাদক), রোদেলা, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৭১

৬.     চৌধুরী, সত্যজিৎ। ‘চরাচর : যেন বা দীর্ঘ কবিতা’, চিত্রনাট্য সংগ্রহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৫৯৯

৭.     দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। কীভাবে ছবি করি কীভাবে ছবি হয়, পরম্পরা, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৫০-৫১

৮.     Hood, John W. The Essential Mystery, Sangam Books Limited, London, 2000, p. 303

৯.     দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৭, পৃ. ৩৭

১০.   পূর্বোক্ত, পৃ.৩৬

১১.    চৌধুরী, সত্যজিৎ। ‘লাল দরজা : সভ্যতার ব্যাধি’, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬, পৃ. ৬০৩

১২.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। ‘কবিতা ও চলচ্চিত্র’, স্বপ্ন সময় ও সিনেমা, বাণীশিল্প, কলকাতা, ১৯৯৩, পৃ. ৩৬

১৩.   মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া। ‘নতুন শতাব্দীতে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নতুন ছবি উত্তরা : বিশ্ব প্রেমের জীবমত্ম গ্রন্থ’, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬,
পৃ. ৬০৮-৬০৯

১৪.    দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। ‘‘উত্তরা’’, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬, পৃ. ৪০১

১৫.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। ‘চিত্র পরিচালকের নিবেদন’, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬, পৃ. ৫৫৭

১৬.   Kawin, Bruce F. Mindscreen : Bergman, Godard and First-Person Film, Princeton University Press, Princeton, 1978, p. 5-6

১৭.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। নিম অন্নপূর্ণা, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬,
পৃ. ১০৩-১০৪

১৮.   Hood, John W. op.cit., Note no. 8, p. 282

১৯.   নন্দী, অচিমত্ম্য। ‘চলচ্চিত্রে নিম অন্নপূর্ণা,’ পূর্বোক্ত, পাদটীকা
নং ৬, পৃ. ৫৬১-৫৬২

২০.   পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬১

২১.   পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬১

২২.   চৌধুরী, সত্যজিৎ। ‘প্রতিবাদী স্বপ্নের আখ্যান’, পূর্বোক্ত, পাদটীকা
নং ৬, পৃ. ৫৯৩-৫৯৪

২৩.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৭, পৃ. ৪৮

২৪.   Hood, John W. op.cit, Note no. 8, p.303

২৫.   বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম। ‘তাহাদের কথা : আমাদের কথা’, পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬, পৃ. ৫৮৬

২৬.   পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৮৬

২৭.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৭, পৃ. ৭২

২৮.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৭, পৃ. ৬৪-৬৫

২৯.   Hood, John W. op.cit., p.293-294

৩০.   Art is, then, a definite practice, and what it produces in transformation of its raw material is given in the form of an ‘aesthetic effect’ .

– Rodowick, D.N. The Crisis of Political Modernism : Criticism and Ideology in Contemporary Film Theory, University of California Press, Berklay, 1994, p. 81

৩১.   দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৭, পৃ. ৭১-৭২

৩২.   রায়, প্রণবরঞ্জন। ‘নরেন্দ্রনাথ মিত্রর ‘সংক্রামক’ : বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ফেরা,’ পূর্বোক্ত, পাদটীকা নং ৬, পৃ. ৫৬৬

৩৩.          দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব। পূর্বোক্ত, চতুর্থ প্রচ্ছদ

Leave a Reply