logo

বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির মহাকাব্য ১৯৭১

কা বে রী  গা য়ে ন
‘Identities are the names we give
to the different ways we are
positioned by, and position ourselves
within, the narratives of the past’
(Stuart Hall, 1990-225)
আত্মপরিচয় গঠনের অনিবার্য উপাদান হলো স্মৃতি। আত্মপরিচয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে অংশে স্মৃতি বিশেষভাবে উপযোগী সেটি কেবল ‘সত্য’ দাবিদারিত্বের জন্য নয়, বরং কোনো ঘটনার ধারাবাহিক অস্বীকৃতি, মুছে ফেলার প্রয়াস বা বিকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মোচন গোটা প্রক্রিয়াকে মামুলি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ছাড়িয়ে সংস্কৃতির অংশ করে তোলে। স্মৃতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক  চরিত্র তাই কোনো জাতির আত্মপরিচয়ের সংকটকালীন মুহূর্তে বিস্মৃতি ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সামষ্টিক যুদ্ধকে জারি রাখে, যাকে বলেছেন মিলান কুন্ডেরা, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির যুদ্ধ। সাংস্কৃতিক পাঠের অন্যতম অনুসিদ্ধান্ত হলো, পরিচয়ের নির্মাণ একটি প্রক্রিয়া, যা কোনো অনিবার্য অতীত সম্পর্কে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের ফলাফল নয় বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার অবিরাম জটিল এক প্রবাহের ফলাফল। ক্ষমতা যখন কোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে পালটে দিয়ে নতুন ইতিহাস নির্মাণ করতে চায়, তখন মূল ইতিহাসের পক্ষে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলো সাক্ষ্য দেয়, সাক্ষ্য দেয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্মৃতি। বিরুদ্ধ প্রবল শক্তি তাই এই সাক্ষ্যগুলো মুছে ফেলতে চায়। রেসকোর্সের ময়দানকে বানিয়ে ফেলে শিশুপার্ক, ৭ মার্চের স্মৃতিকে মুছে ফেলার জন্য। কিন্তু ক্ষমতা পরাস্ত হয়েছে ১৯৭১-এর ৭ মার্চে রেসকোর্সের ময়দানে উপস্থিত থাকা জাতির স্মৃতির কাছে। সেই প্রজন্মের কাছে তাই শিশুপার্ক রেসকোর্সের ময়দান হয়ে তবু থেকে যায়। কিন্তু সেদিন যারা রেসকোর্সে উপস্থিত থাকার জন্য জন্ম নেয়নি, তাদের কী উপায়? এখানেই সংস্কৃতির প্রামাণ্য দলিলের দায়বদ্ধতা। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের মতো কিংবা প্রবলতরভাবে যুদ্ধ-প্রামাণ্যচিত্র বা ওয়ার ডকুমেন্টারি একটি শক্তিশালী জরাঁ তৈরি করেছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। যুদ্ধ-প্রামাণ্যচিত্রেরও নানা ধারা তৈরি হয়েছে উদ্দেশ্য ও উপায়ভেদে।
মোটাদাগে যুদ্ধ-প্রামাণ্যচিত্রের দুটি ব্যবহার খুব তাৎপর্যপূর্ণ, দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যুদ্ধকালীন নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে কোনো রাষ্ট্র কেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, সেই নৈতিক অবস্থানটি তৈরি করতে প্রয়াস দেখা যায়, এগুলো প্রায়শই থাকে প্রপাগান্ডামূলক। ফ্রাঙ্ক কাপরা ও তাঁর সহযোগীদের নির্মিত সাতটি প্রামাণ্যচিত্র এ-বিষয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কেন আমেরিকার সৈন্যরা যুদ্ধে যাবে – এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই নির্মিত তাঁর Prelude to War (1942), The Nazis Strike (1943), Divide and Conquer (1943), The Battle of Britain (1943), The Battle of Russia (1943), The Battle of China (1944) and War Comes to America (1945)| )। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ Royal Air Force (RAF)-কে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম ব্রিটিশ প্রপাগান্ডা চলচ্চিত্র The Lion Has Wings (Michael Powel, Adrian Brunel, Brian Desmond Hurst, Alexander Korda, 1939) এমনই এক প্রামাণ্যচিত্র। আর যুদ্ধোত্তরকালে বিজয়ী রাষ্ট্র উপস্থাপন করে তার জনগণের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনি। বিজিত রাষ্ট্রের প্রামাণ্যচিত্র মূলত ব্যাপৃত থাকে তার বিজয়ী না হওয়ার পেছনের কারণগুলোর ব্যাখ্যায়। সেসব কারণের মধ্যে নিজস্ব জনগণের বীরত্ব সত্ত্বেও কীভাবে কোনো ভুলের কারণে কিংবা সহযোগী কোনো রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্ত বা কোনো খণ্ডযুদ্ধে যদি তাদের বিজয় হয়ে থাকে, সেসবের উপস্থাপনে। অপর কোনো রাষ্ট্রকে অধিগ্রহণের কারণে যদি অনেক বেশি নিন্দিত হতে হয়, তবে তার যৌক্তিকতা হাজিরেও সচেষ্ট দেখা যায় বিজিত দেশের যুদ্ধ-চলচ্চিত্রকে।
তবে যুদ্ধ-প্রামাণ্যচিত্রের আরেক ধারা এসব প্রপাগান্ডা চরিত্র ছাড়িয়ে মানবিক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে তীব্র করে তোলে, অথবা অতীত অবশেষ থেকে ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয় এবং এসব প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা থেকে আসা ব্যক্তিগত স্মৃতিকে এমনভাবে তুলে ধরে, যা দর্শককে জীবনের চেয়ে বিশাল (larger than life) কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবার অনুভূতি দেয়। এ-জাতীয় প্রামাণ্যচিত্রগুলো দেখা যায় সাধারণত কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অনেক পরে, ইতিহাসের বিস্মৃতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য।
যুদ্ধকালীন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা বাইরের পৃথিবীকে জানানো অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে। সেই অনিবার্যতা থেকে জহির রায়হানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিছু প্রামাণ্যচিত্র তৈরির। প্রথমেই তিনি নির্মাণ করেন Stop Genocide| এই প্রামাণ্যচিত্র এদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানের গণহত্যার অপরাধ এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ ঘোষণার যৌক্তিকতাকে এত সফলভাবে প্রমাণ করতে সমর্থ হয় যে তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক নির্মিত হয় আলমগীর কবিরের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় Liberation Fighters, জহির রায়হানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় A State is Born Ges Innocent Millions| ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপর যে কালো পর্দা নেমে আসে রাজনীতিতে, তার প্রভাব আমরা দেখি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতেও। প্রামাণ্যচিত্রের কথা বলতে গেলে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিস্মৃতিকে ফের স্মৃতিতে প্রবলভাবে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তারেক মাসুদের মুক্তির গান (১৯৯৫) আর মুক্তির কথা (১৯৯৯) ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তানভীর মোকাম্মেলের যাত্রা যদিও স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র হুলিয়া (১৯৮৫) থেকে এবং প্রধানত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনিচিত্রে কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদ : নিঃসঙ্গ সারথি (২০০৬) থেকে যুদ্ধ-ইতিহাসের পথে তার প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে যে অভিযাত্রা, তারই ধারাবাহিকতার সাম্প্রতিকতম এবং বিশদতম সংযোজন ১৯৭১।
ছবি পরিচিতি : ‘সবচেয়ে সেরা সময়, সবচেয়ে বেদনার সময়’!
চার্লস ডিকেন্সকে স্মরণ করে এই প্রামাণ্যচিত্রের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সাল স্বাধীনতা অর্জনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গৌরবের এক বছর হলেও ১৯৭১ সালে এদেশের মাটিতে ঘটেছিল ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড, ধ্বংস ও নিপীড়নের অসংখ্য করুণ সব ঘটনা। ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের মানুষের জীবনে, যথার্থই ছিল চার্লস ডিকেন্সের ভাষায় Ñ ‘সবচেয়ে সেরা সময়, সবচেয়ে বেদনার সময়’!
সেই অবিস্মরণীয় ১৯৭১ সালের মূল ঘটনাবলি নিয়ে নির্মিত হয়েছে তানভীর মোকাম্মেলের তিন ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট দৈর্ঘ্যরে গবেষণানির্ভর মেগা-ডকুমেন্টারি ১৯৭১।
প্রায় সাত বছর ধরে গবেষণা ও শুটিং করে এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। মোট আড়াইশো ঘণ্টা ফুটেজ শুট করা হয়। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, খুলনা, যশোর, বরিশাল, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং ভারতের কলকাতা, দিল্লি এবং যেসব জায়গায় শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিল এমন কিছু জায়গাতেও প্রামাণ্যচিত্রটির শুটিং করা হয়। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ফিল্ম আর্কাইভ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য সর্বমোট একশ ছিয়াত্তর জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতা, সেক্টর কমান্ডার, গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ, ধর্ষিত নারী, শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী মানুষ ও প্রত্যক্ষদর্শী। ‘প্রথম অধ্যায়’ ও ‘শেষ অধ্যায়’ এভাবে আলাদা দুই পর্বে প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শন করা হবে।
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়
এই প্রামাণ্যচিত্রের টাইটেল পেজ শুরু হয়েছে ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’ গানটির উদাত্ত ডাকের মধ্য দিয়ে, যা শুরুতেই প্রতিষ্ঠিত করে দেয় এই প্রামাণ্যচিত্রের মুড, দর্শক প্রস্তুত হতে থাকেন যে দামে বাংলাকে কেনা হয়েছে, সেই দামের মুখোমুখি হতে। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে মোট দশটি এপিসোড।
প্রাক-কথন
এযাবৎকালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বা প্রামাণ্যচিত্রে ইতিহাসটি শুরু হতে দেখেছি ১৯৭০-এর নির্বাচনকে ঘিরে। কিন্তু এখানে শুরুতেই প্রাক-কথন অংশে দেখিয়ে দেওয়া হয় ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং পরবর্তী সময়ে লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ বা ‘ংঃধঃবং’ গঠনের সিদ্ধান্তকে কীভাবে মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ টাইপের ভুল বলে ‘ংঃধঃব’ বানিয়ে দেন এবং বলেন যে পাকিস্তান হবে কেন্দ্রশাসিত একক রাষ্ট্র। বাংলাকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ, পাঞ্জাবকে ভাগ করে পাঞ্জাবের পশ্চিম অংশ এবং সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশগুলো নিয়ে গঠন করা হলো পাকিস্তান। এই অংশটিতে, বিশেষ করে ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়কার কিছু দুর্লভ ফুটেজের বিষয়টি উল্লেখ করতেই হয়। দেশভাগের একটি আর্কাইভাল দৃশ্যের উল্লেখ না করলেই নয়। ট্রেনভর্তি মানুষ ভারত থেকে পাকিস্তানে ঢুকছে। একটি মাত্র শট এবং একটি শটই যথেষ্ট। পূর্ব বাংলা অংশটি পরিচিতি লাভ করল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে এবং বাকি অংশ পরিচিতি লাভ করল পশ্চিম পাকিস্তান হিসেবে। এরপরই আর্কাইভাল ফুটেজ থেকে নির্মিত ফুটেজে চলে যাওয়া হলো, যেখানে খুব পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেওয়া হলো কীভাবে কৃষকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমে উৎপাদিত পাটকে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে দেখছে উপনিবেশ হিসেবে। দেখিয়ে দেওয়া হলো ভাষার ওপর আঘাত আর বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক মাত্র কয়েকটি কথায় দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতার কথা আর তার পেছনের বঞ্চনার কথাটি বলে দিলেন। মূলধারা ’৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ভাসানী, আইয়ুব খান, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী, দুই অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিষয় বিশদ তুলে ধরলেন। ব্রিগেডিয়ার (অব.) মজুমদার আর মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর সাক্ষাৎকারে উঠে এলো
পাকিস্তানের মিলিটারি অ্যাকাডেমি, যা কাকুল অ্যাকাডেমি নামে পরিচিত, সেখানকার অভিজ্ঞতা Ñ বাঙালি অফিসারদের সেখানে ‘বাঙালি বাবু’ বা ‘চাউল খানেওলা বাঙালি’ হিসেবে হেনস্তা করার এবং সাতদিনেও একবার ভাত না খেতে দেওয়ার অভিজ্ঞতা। ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন জানালেন, তিনি বিদেশে পড়তে যেতে পারেননি টাকা থাকা সত্ত্বেও, পাকিস্তান সরকার তাঁকে পাসপোর্ট দেয়নি। আলী যাকের, রেহমান সোবহান এবং বঙ্গবন্ধু Ñ তিনজনের বয়ানেই স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তান ছিল এক ঔপনিবেশিক বাজার।’ এরপর ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬৬ সালে লাহোরে উত্থাপিত ৬-দফা, ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতাদের গ্রেফতার, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নভেম্বরে উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস এবং ৭ ডিসেম্বর মুজিবকে ক্ষমতায় যেতে না দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভুট্টোর হাত মেলানোর কাহিনিকে পর পর গেঁথে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে নির্মিতি দেওয়া হয়েছে এই অংশে। পাকিস্তানি কবি আহমেদ সালিমের সাক্ষাৎকার এই পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তিনি বললেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলনীতি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। সেই দিক থেকে মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে না দেওয়া ঠিক হয়নি।’
এই পর্বে তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। একটি অজানা তথ্য পাওয়া যায় জনাব আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারে। তিনি জানান, এইসব দিনগুলোর কোনো একদিন বঙ্গবন্ধু তাঁদেরকে চিরকুট দিয়ে জানান, ‘আমি না থাকলে তাজউদ্দীন তোমাদের নেতা।’ ইতিহাসের এই আখ্যানভাগ অমূল্য।
ষড়যন্ত্রের নীলনকশা
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন তাদের দেওয়া নির্বাচনী ম্যান্ডেট হিসেবে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের জন্য দিন গুনছেন তখন জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদ, জেনারেল পীরজাদা এবং অন্যান্য সামরিক জান্তাকে ভুট্টো তাঁর লারকানার প্রাসাদে ‘হাঁস শিকার’ করার আমন্ত্রণ জানান। আর ১ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন ইয়াহিয়া। মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়া জানান, ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানি মিলিটারি হকসের (HAWKS) কথা। এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, পাকিস্তান আর্মির চিফ অফ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান, মেজর জেনারেল ওমর, আইএসআইয়ের মেজর জেনারেল আকবর। এই নিরেট তথ্যের পাশাপাশি আমরা দেখতে থাকি পূর্বাণী হোটেল থেকে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা, অসহযোগ আন্দোলনের ফুটেজ, যা হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাবুর্চি পর্যন্ত সকলেই পালন করতে থাকেন। বিষয়টি হিউমারের সঙ্গে উপস্থাপন করেন ড. কামাল হোসেন। এই অসহযোগ চলাকালে হঠাৎ একদিন ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি সেক্রেটারি জেনারেল কন্ট্রোল রুমে ফোন করে জানালেন যে, তখন ঢাকায় অবস্থানরত ইয়াহিয়া খান তিনদিন ধরে কোনো খাবার পাননি; কারণ বাবুর্চিরাও অসহযোগ করছেন তখন, তাঁরা রান্না করেননি।
এই প্রামাণ্যচিত্রের অসাধারণ গুণ বোধহয় এখানে যে, যাঁকে দিয়ে যে বক্তব্যটি তুলে আনা হয়েছে, তিনিই সেই বিষয়ে মন্তব্য ও ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ মার্চ বালুচের কসাই হিসেবে খ্যাত টিক্কা খানের এবং ১৫ মার্চ ইয়াহিয়ার ঢাকায় আগমন, সংবিধান না থাকলে কীভাবে মার্শাল ল তুলে ফেলা সম্ভব প্রশ্ন তুলে প্রবেশনাল সংবিধান তৈরির জন্য কালক্ষেপণ Ñ এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে কামাল হোসেনের বক্তব্যে। আবার পাকিস্তান সরকারের যুদ্ধ প্রস্তুতির বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহর বক্তব্যে। ভুট্টো আসার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে ঢাকায় অবস্থানরত অন্যরা চলে গেলেন আর কোয়েটা থেকে নবম ডিভিশন এবং খারিয়া থেকে ষোলো ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হলো, কীভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি-পশ্চিম সেনা অনুপাত রাতারাতি ৫০-৫০ থেকে মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ ৪:১ এবং পরে ৬:১-এ চলে এলো এই বর্ণনাগুলো এসেছে এই পর্বে। আবার এই সময়ে সংঘটিত চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, খুলনার খালিশপুর, সৈয়দপুর ও সান্তাহারে বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা, বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের বর্ণনাও বাদ পড়েনি। প্রখ্যাত উর্দু লেখক মুশতাক আহমেদ বর্ণনা করেছেন কীভাবে পাকিস্তান বিহারিদের ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামায়, কীভাবে তাদের অনগ্রসর করে রাখা হয়েছে।  ইতোমধ্যে
পাকিস্তানি জাহাজ সোয়াত এসে ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বাঙালি শ্রমিকেরা অস্বীকৃতি জানিয়েছেন অস্ত্র খালাস করতে। সেই সময়কার বর্ণনা উঠে এসেছে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার (অব.) মজুমদারের কথায়। টিক্কা খান, জানজুয়া Ñ এঁরা খুব জোর দিতে লাগলেন অস্ত্র খালাসের জন্য, আমরা জানলাম জেনারেল মিট্টা ছিলেন আরেক কাঠি সরেস। তিনি বললেন, ‘সমস্ত নদী রক্তে লাল হয়ে গেলেও অস্ত্র খালাস করতে হবে।’
অপারেশন সার্চলাইট
সাধারণভাবে আমরা জানি পাকিস্তানি আর্মি ঘুমন্ত ঢাকার ওপরে কামান চালিয়ে দিলো, যার পূর্বাপর পাওয়া যায় না। প্রামাণ্যচিত্রটির এই পর্ব শুরু হয়েছে মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূঁইয়ার দেওয়া চমকপ্রদ কিছু তথ্য দিয়ে। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত হয়েছে, ক্র্যাকডাউন হবে। জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা লিখলেন নীল কাগজে পেনসিল দিয়ে ‘Operation Search Light’। ২০ মার্চ খাদিম হোসেন রাজা বসলেন চিফ অফ স্টাফ জেনারেল হামিদের সঙ্গে। হামিদ অনুমোদন দিলে অনুমোদন পাওয়া গেল ইয়াহিয়ার কাছ থেকেও। একই দিনে পাকিস্তানি জেনারেলরা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে যুদ্ধ পরিকল্পনা ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। ২৪ মার্চ খাদিম হোসেন রাজা এবং জেনারেল মিট্টা জেনারেল আনসারীকে নিয়ে গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের কাছে। কীভাবে তারপর প্রেসিডেন্ট সব সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলবেন বলে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে ঢাকা নিয়ে এলেন এবং সেখানে রেখে আসা হলো ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে, যে আনসারী সরাসরি চলে গেলেন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এবং সেখানে বাধাদানকারী ইপিআর সৈন্যদের গুলি করার মাধ্যমে ২৪ মার্চ ‘পয়েন্ট-অব-নো রিটার্নে’ চলে যাওয়ার যে বর্ণনা দিয়েছেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম এই ধরনের প্রামাণ্য ইতিহাসের বর্ণনা দুর্লভ।
এরপর এই অংশে তোফায়েল আহমেদ, কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বক্তব্যে যেমন তুলে আনা হয়েছে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনের অবস্থান ২৫ মার্চের কালরাতে; তেমনি সাধারণ পুলিশদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ এবং থ্রিনটথ্রি ও মার্ক-ফোর দিয়ে তাদের প্রতিরোধের কথা। ওই রাতে তাদের মধ্য থেকে একশ থেকে একশ পঞ্চাশ জন মারা যান আর ধরা পড়েন একশ পঞ্চাশ জন।
ইকবাল হল, যা বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামে পরিচিত, আর জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন ওই সময় পার করে আসা ছাত্ররা Ñ সুরেশ চন্দ্র দাশ, অজয় দাশগুপ্ত, মৃণাল বোস, সত্যরঞ্জন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি এসেছে মেঘনা গুহঠাকুরতার স্মৃতিচারণায়। মধুসূদন দের পুত্র অরুণ কুমার দে বর্ণনা করেছেন তাঁর পরিবারের ট্র্যাজেডি। তবে এই অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন মনে হয় শাঁখারীবাজারে প্রথম যে পরিবারে আক্রমণ চালানো হয়, সেই পরিবারের অমল সূর আর তাঁর মায়ের সাক্ষাৎকার। ২৫-২৬-২৭ তিনদিন ধরে তাঁদের পরিবারে আক্রমণ চালানো হয়। ২৭ তারিখ তিনি দেখেন আঙিনায় পড়ে থাকা তাঁর বাবা-ভাইয়ের লাশ ঠোকরাচ্ছে কাক। শাঁখারীবাজারের নাম হয়েছিল তখন টিক্কা খান রোড আর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বস্তি এলাকা, ধরে নিয়ে যে এইখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষের বসবাস যারা মিছিল করে।
প্রাথমিক প্রতিরোধ
২৫ মার্চ রাতের ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রাম, যশোর, পাবনা, রংপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহে প্রতিরোধ শুরু হয়। থ্রিনটথ্রি, পাখি মারার একনলা বন্দুক, পয়েন্ট ২২ বোর, এয়ারগান, ঢাল-সড়কি, তীর-ধনুক, কাস্তে ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অস্ত্র। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে এবং রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারের নেতৃত্বে সৈন্যরা পালিয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ইপিআরের চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর থেকে মেজর আবু ওসমান বিদ্রোহ করে দখল করেন কুষ্টিয়া শহর।  তাঁর মতে, প্রকৃত জনযুদ্ধ শুরু হয় কুষ্টিয়া থেকে। যে বালুচ রেজিমেন্ট ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে এক হাজার দুশো সৈন্যকে হত্যা করেছিল সেখানে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে এবং পাবনায় ক্যাপ্টেন নুরুল কাদের খানের নেতৃত্বে যেসব যুদ্ধ গড়ে ওঠে, আছে সেসব বর্ণনা। বর্ণনা আছে কুমিরার যুদ্ধে সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের যুদ্ধ। তবে এইসব যুদ্ধের ইতিহাস আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু যে যুদ্ধের কথা ইতিহাসে আর কেউ তুলে আনেননি এ পর্যন্ত, তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগণের যুদ্ধসম্পৃক্তির ইতিহাস।
রণবিজয় কিশোর ত্রিপুরার সাক্ষাৎকার একটি বিশেষ সংযোজন। তিনি জানান পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধ সম্পর্কে। মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে।
বেলাল মোহাম্মদের সাক্ষাৎকারে মেজর জিয়াউর রহমানকে কীভাবে অনুরোধ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করতে এবং তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর নামে এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন ২৭ মার্চ, বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
উঠে এসেছে ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাঙালি মিলিটারি অফিসারদের সভায় মেজর জেনারেল ওসমানীসহ সভার সমন্বিত সিদ্ধান্তে নিজস্ব সরকার গঠনের ব্যাপারটি। এই প্রসঙ্গ তুলে ধরেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ।
গণহত্যা দিকে দিকে
এই পর্বে দেশের সব প্রান্তে যে গণহত্যা চালানো হয় তার এক নির্বাচিত অংশের দলিল পেয়ে যাই। পরিষ্কারভাবে উঠে আসে এই গণহত্যার লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, হিন্দু জনগোষ্ঠী, ছাত্র-যুবক। বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর জাতিগত নিধন চালানো হয়। আর হত্যাকাজে সাহায্য করেছে স্থানীয় বিহারিরা, জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ। ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দেশের বিভিন্ন বিহারিপ্রধান এলাকায় ক্রুদ্ধ বাঙালিদের হাতে বিহারি নারী-পুরুষদের হত্যার প্রসঙ্গটিও বাদ পড়েনি।
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গই যেন। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যেসব শক্তি ক্ষমতায় এসেছে সামরিক বা বেসামরিক লেবাসে, তারা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটিকেই ধামাচাপা দিতে চেয়েছে এবং যেহেতু সাম্প্রদায়িক ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিই ছিল তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের প্রধান সোপান, তাই ভারতের সাহায্য প্রসঙ্গটি এসেছে কেবলমাত্র এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার প্রসঙ্গে, তাও কালেভদ্রে। এই প্রামাণ্যচিত্র প্রথম আলো ফেলেছে বস্তুনিষ্ঠভাবে। ইতিহাসের এক অনালোচিত অধ্যায়কে নির্মাণ করার জন্য পরিচালক যথেষ্ট খেটেছেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, তাজউদ্দীন আহমদ ভারত যান আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। সাহায্য করেছিল ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স।
চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা ড. আসাবুল হকের নেতৃত্বে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে গড়ে ওঠে নানা তৎপরতা।  তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী এবং তাঁর সহযোগী যাঁরা এই কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাঁদের বক্তব্যে সরাসরি তুলে আনা হয়েছে এইসব তৎপরতার ইতিবৃত্ত। যেমন তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী খোলা চিঠি লিখেছিলেন ভারতীয় জনগণকে, অস্ত্র চেয়ে। কয়েকদিন পরে উত্তর এসেছিল, ‘দেখা করো’। তাঁরা দেখা করেছিলেন কর্নেল চক্রবর্ত্তীর সঙ্গে। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষাৎকার পাই আমরা গোলক মজুমদারের। তিনি তখন বিএসএফের আইজি। তিনি প্রথম এই ছোট ছোট ছেলেদের অপরিণত চেহারা, পোশাক ও ব্যবহারে খুবই অবাক হন কিন্তু পরিচয় করিয়ে দেন রুস্তমজীর সঙ্গে। রুস্তমজী কথা বলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ইন্দিরা গান্ধী বললেন তাদের দিল্লি পাঠাতে। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের আলোচনার মূল পয়েন্টগুলো ছিল :
১। এই যুদ্ধ আমাদের। আমাদেরই স্বাধীন করতে হবে। ভারতীয় বাহিনী দেশের ভেতরে যাক, চাই না।
২। আমরা চাই সাহায্য, গ্র“পিং, ট্রেনিং, রি-গ্র“পিং, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য।
৩। এক থেকে দেড় কোটি শরণার্থীর দায় নেওয়া।
৪। বৈদেশিক প্রচার বিষয়ে সাহায্য।
৫। একটি প্রচারমাধ্যম চালানোর ব্যবস্থা করা, যার নাম হবে বাংলাদেশ বেতার।
এই পয়েন্টগুলোতে ভারতের সঙ্গে একটি পরিপূর্ণ সমঝোতা হয় এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়।
মুজিবনগর সরকার
১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান যেহেতু দেশের মধ্যেই হতে হবে তাই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ধার্য করা হয়। এখানেও গোলক মজুমদারের তথ্য খুব কৌতূহলোদ্দীপক। কীভাবে তাঁরা সকল বিধায়ককে জড়ো করেছিলেন এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে, এসেছিলেন তাঁরা চল্লিশটি অ্যাম্বাসাডার গাড়িতে। এই অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, পাঠ করেছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী আর স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। যে বারো জন গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন, তাঁদের মুখেই ধারণ করা হয়েছে সেই অনুষ্ঠানে তাঁদের অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কথা। এই  অনুষ্ঠানে  তাজউদ্দীন মন্তব্য করেছিলেন, ‘এক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, আরেকটি আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য উঠল।’
মৃত্যু-উপত্যকা
সবচেয়ে বেশি নির্মিত দৃশ্য পাই আমরা এই অংশে। রাজশাহীর সারদার থানাপাড়া গ্রামের ওপর দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল হেঁটে গিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেড। কথা বলবে বলে গ্রামবাসীকে জড়ো করে এক হাজার দুশো লোককে নির্বিচারে  ব্রাশফায়ার করেছিল আর পেট্রোলের টিন ছড়িয়ে আগুন দিয়ে দিয়েছিল। বেঁচে যাওয়া ড. জিন্নাতুল আলম বর্ণনা করেন সেই কাহিনি। সারদার থানাপাড়া গ্রামটি এখন বিধবাদের গ্রাম নামে পরিচিত। পরিচালক আশ্চর্য দক্ষতায় এরপর একে একে তুলে আনেন ডুমুরিয়ার চুকনগর গণহত্যা, কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা গণহত্যা, সৈয়দপুরের গোলারহাট গণহত্যা, বরিশালের আটঘরিয়া কুড়িয়ানার গণহত্যা, মৌলভীবাজারের চা-বাগান গণহত্যা, যশোরের মাদ্রাসা গণহত্যা, জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ান গণহত্যা। এসব গণহত্যার কথা বর্ণনা করেন যাঁরা হারিয়েছেন তাঁদের স্বজন, কিংবা নিজেই গেছেন সেইসব অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে। এইসব গণহত্যার পর মৃতদেহ ফেলে রাখা হতো নদীর পাড়ে, পথের পাশে, কারো সৎকার হতো না। কুকুরের-শেয়ালের খাদ্য হয়েছে এইসব মানুষের দেহ। ‘শুধুমাত্র নিজের পছন্দের দল  ও ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার জন্য এতবড় মূল্য আর কোনো জনগোষ্ঠীকে দিতে হয়নি’ বলে এই পর্ব শেষ করেন ধারা-বর্ণনাকারী।
মুক্তিবাহিনী-প্রবাসী সরকার
এই দুই পর্বে আমরা মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অপারেশন দেখি। আর কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোড, যা এখন শেক্সপিয়ার সরণি নামে পরিচিত, সেখানে প্রবাসী সরকারের কাজ এবং বিদেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বরূপটি জানতে পারি মহিউদ্দিন আহমেদ, এইচ টি ইমাম, শিহাবউদ্দিন – এই তিন কূটনীতিকের বরাতে। ১৮ এপ্রিল ভারতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। জানতে থাকি নিউইয়র্কে এ এইচ মাহমুদ আলী, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত, মোয়াজ্জেম হোসেন এবং এস এ করিমের তৎপরতার কথা।
তাহাদের কথা
দুই লাখের বেশিসংখ্যক নারীকে ১৯৭১ সালে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এই তথ্যকে যখন নানা মোড়কে অস্বীকার করার প্রয়াস চলছে, যখন শর্মিলা বোস প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উইড্রো উইলসন সেন্টারের ফান্ডে ১৯৭১ সালে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে ‘গবেষণা’ বই প্রকাশ করছেন, যখন বাংলাদেশের এক পরিচালক কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত চলচ্চিত্রে ‘আমি কি এই প্রথম ধর্ষিত হয়েছি?’ মর্মে প্রশ্ন তুলে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার ধর্ষণকে মোলায়েম করতে চাইছেন, তখন এই প্রামাণ্যচিত্র ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম পাকিস্তান বাহিনীর ধর্ষণ উৎসবকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক আক্রোশের আলোকে যেমন উপস্থাপন করেছেন তেমনি নির্যাতিত ক্ষেত্রবিশেষে পরিত্যক্ত এসব নারীকে বিস্মৃতি থেকে তুলে এনেছে ইতিহাসের অনিবার্য অংশ হিসেবে। ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী এএসপিআর নিয়াজীকে ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলে নিয়াজী গর্বের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘I ask my solders what was your last night’s harvest?’…ৃ[আমরা ফুটেজে দেখতে থাকি] … ‘My soldiers will live here, they will fight here, they will die here and for sex they will go to Jhilam?’
সেই মনোভঙ্গির ফলাফল কতটা ভয়াবহ ছিল তা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সাহসী উচ্চারণে যেমন উঠে এসেছে, তেমনি অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কুষ্টিয়া, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, বগুড়ার নির্যাতিত নারীরা। যশোরের ক্যান্টনমেন্টে, রূপসার গুদামে দলধর্ষণের শিকার প্রিয়ভাষিণী কমান্ডার গুলজারিন, কর্নেল আবদুল্লাহ, কর্নেল খাট্টাক, কর্নেল জায়ার, মেজর বানরি, কর্নেল আবেদ, লেফটেন্যান্ট সুলতান, মেজর বেলায়েত শাহর নাম অকপটে উচ্চারণ করেন আর বেদনার সঙ্গে মনে করেন তেইশ-চব্বিশ বছরের কোনো নারীর আর্তনাদ, যিনি একই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন অথচ যাঁকে তিনি কখনো দেখেননি, ‘ওরে আমার হাবিব রে… তুই কনে?’
প্রথম পর্ব শেষে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণের মতো নাজুক এক এপিসোড নিয়ে। প্রায় চোদ্দটি এপিসোড নিয়ে এ অধ্যায়।
বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণ
মুক্তিযুদ্ধে হত্যা-ধর্ষণই যে শেষ কথা ছিল, এমন নয়। তাদের দ্বিজাতিতত্ত্ব এদেশকে হিন্দুশূন্য করার ব্রত নিয়েছিল। তাই হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা ছিল নিপীড়নের আরেক রূপ। এমনই এক পরিবার ময়মনসিংহের যতীন সরকার পরিবার। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও চিন্তাবিদ যতীন সরকার এবং তাঁর স্ত্রী কনক সরকারের বক্তব্যে এই রূপটি ধরা পড়ে। যতীন সরকার বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেন, যাঁরা তাঁদের পড়শি, যাঁদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, তাঁরা পর্যন্ত প্রশ্ন করেছেন দেশ স্বাধীন হলে যতীন সরকারের কী লাভ, তিনি কেন এত উত্তেজিত? তিনি বেদনার সঙ্গে বলেন, তখনো আসলে সাংস্কৃতিকভাবে ভেদবুদ্ধি লোপাট হয়নি। আর তাঁর স্ত্রী বর্ণনা করেন কোন প্রেক্ষাপটে তাঁদের ধর্মান্তরিত হতে হয়। তাঁরা অত্যন্ত কৌতুকপূর্ণ ভঙ্গিতে এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন বটে, তবে সেই বর্ণনার মধ্যেই সে-সময়কার ধর্মীয় নির্যাতনের রূপটি ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে।
নির্যাতনের নানা আলেখ্য
পাকিস্তানি বাহিনীর নানা নির্যাতনের সঙ্গে এই প্রজন্মের সামান্যই পরিচয় আছে। নির্যাতনের রূপ কত ভয়াবহ হতে পারে তার সাক্ষ্য নিয়ে এখনো অনেকে বেঁচে আছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের শফিক আলম চৌধুরী দিয়েছেন তেমনই এক বর্ণনা। ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। রাজাকাররা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে।  সেনাক্যাম্পে কয়েকটি বাঘ রাখা হয়েছিল। চারটি বাচ্চা আর তিনটি বড় চিতা। সেই রুমে রাখা হয় শফিক আলম চৌধুরীকে। এই বাঘগুলো ছিল খুবই হিংস্র, যে কেউ পরিদর্শনে এলেই তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাঘগুলো তাঁর কোনো ক্ষতি করেনি। তবে প্রতিদিনই পাকিস্তানি মেজর পরিদর্শনে এসে জনাব শফিককে বলতেন বাঘকে ডাকার জন্য। হিংস্র বাঘের খাঁচার মধ্যে রেখে তাঁরা মজা দেখতেন।
শরণার্থীরা
‘পেছনে মৃত্যু নিয়ে আর সামনে জীবন… ওরা হেঁটেছিল।’
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। এত কম সময়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাইগ্রেশন। গড়ে প্রতিদিন চল্লিশ হাজারের ওপরে মানুষ ভারতে ঢুকেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর মেঘালয়ে যে শরণার্থী ক্যাম্প করা হয়েছিল তার সঙ্গে স্থানীয় মানুষ আর রাজনীতি নির্বিশেষে প্রশাসন, সেবাসংঘসহ ভারতের প্রতিটি মানুষ যে এগিয়ে এসেছিলেন তারই বেদনাঘন চিত্র এই অংশটি। সেই অভিজ্ঞতাকে সাধারণ মানুষ বর্ণনা করেছেন এই প্রামাণ্যচিত্রে। বেশ কয়েকটি ফোকাস গ্র“প ডিসকাশন রয়েছে এই পর্বে। পাশাপাশি যাত্রাপথের, ক্যাম্পের আর সাহায্যের ফুটেজকে মেলানো হয়েছে। তখনকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়, অক্সফামের ফ্রান্সিস জুলিয়ান, ভারতের সেবাশ্রম সংঘের নৃপ্রসাদসিংহ চট্টোপাধ্যায়, রণজিৎ দাস আর বনগাঁর অধিবাসীদের সাক্ষাৎকার এই অংশকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে, সন্দেহ নেই। ফুটেজে মাদার টেরিজার বক্তব্য Ñ ‘বিশ্বের কাছে আমাদেরই জনগণের এক অংশের ওপর এই নির্যাতনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’ বিশ্ববিবেক বাংলাদেশের নিরাশ্রয় মানুষের জন্য বুঝি সত্যিই সেদিন তৎপর হয়ে উঠেছিল, পাশাপাশি এই শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন কত মানুষ মরেছে সেই দীর্ঘশ্বাসও বাদ যায়নি।
বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি
মুক্তিযুদ্ধে এগারোটি সেক্টর গঠিত হয় মেজর পদমর্যাদার অফিসারদের নিয়ে।  এছাড়া  জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ‘জেড’ ফোর্স, মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার জেনারেল অরোরার নেতৃত্বে ‘অপারেশন সরকার’ তৈরি হয় এবং বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের বিবরণ রয়েছে এই পর্বে, যার মধ্যে কেবল সেনাবাহিনী নয় বরং সাধারণ মানুষের যুদ্ধে ট্রেনিং নেওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে। ফেনী-বিলোনিয়া এবং সালদা নদীর যুদ্ধে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি এসেছে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ বাহিনীর গঠন ও কাজ এবং টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, মানিকগঞ্জের হালিম চৌধুরী বাহিনী এবং সিলেটের কমান্ডান্ট মানিক চৌধুরী বাহিনীর কার্যক্রম।
রাজাকার
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ১৯৭১ সালে রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে দেশে প্রায় এক লাখ রাজাকার তৈরি করা হয়। খুলনা শহরের আনসার ক্যাম্প যা ‘ভূতের বাড়ি’ নামে পরিচিত সেখানে মওলানা ইউসুফের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের যাত্রা শুরু। মূল কাজ ছিল মুক্তিবাহিনী, হিন্দু ও আওয়ামী লীগের লোকদের এবং তাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেওয়া, মেয়েদের তুলে নিতে সাহায্য করা এবং লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও জমিজমা কেড়ে নেওয়া। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠা রাজাকার বাহিনীর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল আলবদর ও আলশামস বাহিনী, যাদের কাজ ছিল তালিকা করে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। ফুটেজ, নতুন ধারণ করা দৃশ্য এবং ফাদার রেগানের স্মৃতিচারণায় এদের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। গোলাম আযম স্বাক্ষরিত পাকিস্তান রক্ষা সাহায্য তহবিলের একটি রসিদ বই ছাপা আছে।

আর্টিস্ট
এই অংশের শুরুতে এদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ স্থিরচিত্রের মাধ্যমে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে অবস্থানটি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এরপর কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকেরের সাক্ষাৎকার থেকে আমরা দেখতে থাকি ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে গড়ে ওঠা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কীভাবে অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো, কারা কী দায়িত্বে ছিলেন। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র থেকে কিংবা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ পাঠ ও সংবাদ পরিক্রমা থেকে উদ্ধৃতি সেই সময়কার আবহে নিয়ে ফেলে আমাদের। ফুটবলার সালাউদ্দিনের বর্ণনায় আমরা পাই কীভাবে দুই বাংলার ফুটবল খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছিলেন সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য। আর ওয়াহিদুল হকের প্রাজ্ঞ উচ্চারণে পরিচালক ধরে রাখেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় আমরা যুক্ত হতে দেখি একের পর এক কিংবদন্তির নাম Ñ দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী, সুচিত্রা মিত্র, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম। আর শেষ হয় এই অংশটি রবিশঙ্করের উদ্যোগে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্ট বাংলাদেশের ফুটেজ দিয়ে। এই অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও গেয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্লাপটন, বিলি প্রেসটন, লিওন রাসেল রিংগো স্টারের মতো শিল্পীরা।
মুক্তিযোদ্ধারা
এই এপিসোডে প্রথমে কয়েকটি ফোকাস গ্র“প আলোচনার মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের। এই সময় ঢাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা গ্র“প গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একটির নাম ছিল লাইট গ্র“প। তারা ঢাকার জয়পাড়া বাজার, কাচারিঘাট বান্দুরা বাজার, পালংগঞ্জ বাজারে অপারেশন করেছেন। গেরিলা কমান্ডার মাহবুব আলমের কথায় আম্বরখানা যুদ্ধের কথা যেমন সামনে এসে দাঁড়ায় তেমনি মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ‘ক্র্যাক প্লাটুনে’র বর্ণনা দেন হাবিবুল আলম। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অংশগ্রহণের কিছু উল্লেখও এই প্রামাণ্যচিত্রে পাই আমরা। কিছু ফুটেজ রয়েছে ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে কর্মরত নারীকর্মীদের, সাক্ষাৎকার রয়েছে তারামন বিবি বীরপ্রতীকের।
নৌ-কমান্ডো
আকাশবাণীকে ব্যবহার করে নৌ-কমান্ডোদের আক্রমণের সিগন্যাল বিষয়ে চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে এই পর্যায়ে। যেমন, আকাশবাণীতে পঙ্কজ মল্লিকের গলায় ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’ বাজালে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিতে হতো কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার পুতুল আজ প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি‘ গানটি বাজালে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ চালানো হতো। আর এই সংকেত ধরে একযোগে আক্রমণ চালিয়ে ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামে নয়টি এবং মংলা পোর্টে ছয়টি জাহাজ  ডুবিয়ে  দিয়ে  দুই  পোর্টের  চ্যানেলকেই  তাঁরা  প্রায় অচল করে দিয়েছিলেন। আর সেই সময়কে বর্ণনা করেছেন নৌ-কমান্ডোর সদস্যরাই। বর্ণনা করেছেন সাব-কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন।
বিদেশি সমর্থন
স্থির ছবি ও আর্কাইভাল ফুটেজের অসাধারণ ব্যবহারের মাধ্যমে অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে কারা ছিলেন এই যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থনকারী আর কারা ছিলেন বিরুদ্ধাচরণকারী। প্রথম বিদেশি সমর্থন ছিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোনির। এরপর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস, পিটার শোর, ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো, ইন্দিরা গান্ধী, এডওয়ার্ড কেনেডির ফুটেজ ও বক্তব্য, বিশেষ করে আঁদ্রে মারলোর উত্তেজিত বক্তব্য বাংলাদেশের পক্ষে এবং ব্রিটিশ মিডিয়াকে দেওয়া ইন্দিরা গান্ধীর তীব্র-তীক্ষè-যথাযথ বক্তব্য অনন্য সংযোজন এই পর্বের।
এরপর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি, বাংলার বিমান-বাহিনী, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বুদ্ধিজীবী হত্যা, চূড়ান্ত বিজয় এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই ধারাক্রমে এসে শেষ হয় এই আলেখ্য।
অসাধারণ ১৯৭১
এই প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের এমন এক মহাকাব্যিক দলিল যে চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্য দিকগুলোর আলোচনা খুব অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়। তবে সহজ কথায় বলতে গেলে, এটি ধ্র“পদী প্রামাণ্যচিত্র কাঠামোতে নির্মিত। মূলত ঐতিহাসিক দলিলপত্র এই প্রামাণ্যচিত্রের পাটাতনটি নির্মাণ করেছে। তবে গবেষণাটি শুধু যে প্রামাণ্য দলিলের ওপর নির্মিত হয়েছে মোটেই এমন নয় বরং গবেষণা করা হয়েছে যেসব দৃশ্য পরে নির্মাণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের নির্বাচন করা, তাঁদের সাক্ষাৎকার, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতাকে তার সঙ্গে যুক্ত করা, তাদের নিয়ে নতুন দৃশ্যায়ন এবং আর্কাইভাল ফুটেজ, স্থিরচিত্র, সাক্ষাৎকার এবং বর্তমান নির্দেশকারী দৃশ্যের সমস্বত্ব এবং সমান্তরাল ব্যবহার খুব সহজ বিষয় নয়। সাত বছর গবেষণার পরিশ্রমটি খুব সহজেই বোঝা যায়।
ধ্র“পদী নির্মাণশৈলীতেই তিনি অতীতকে প্রধানত সাদা-কালো [ব্যতিক্রমও রয়েছে, যেমন ইন্দিরা গান্ধী, আঁদ্রে মারলোর ফুটেজ] আর বর্তমানকে রঙিন করে উপস্থাপন করেছেন। ফলে ইতিহাস আর বর্তমানের পার্থক্য করা যেমন সহজেই সম্ভব, একই সঙ্গে সম্পাদনা এমনভাবে করা হয়েছে যে ইতিহাস আর বর্তমান জেনারেশন পার্থক্য না হয়ে ধারাবাহিকতা হয়ে উঠেছে। পরিচালক আগাগোড়া ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন, কিন্তু তাই বলে ইতিহাসের অন্তর্গত মানুষকে ভুলে যাননি। বরং সমান দায়বদ্ধতার সঙ্গেই অতীতকে যুক্ত করেছেন বর্তমান যাপিত জীবনের সঙ্গে। ফলে ইতিহাসের তথ্যে ভারাক্রান্ত না হয়ে বর্তমান সময়ের জন্য, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য সম্পর্ককে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছেন।
তিনি এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা এখানে রেখেছেন, যা সচরাচর ইতিহাস পাঠে কমই দেখা যায়। প্রান্তিক মানুষের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা। উদাহরণ হিসেবে বিশেষভাবে বলা যায় তাহাদের কথা বা শরণার্থী এপিসোড দুটির কথা। যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রভাবটি যে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যেও নিঃস্বতরদের ওপরই সবচেয়ে বেশি ন্যস্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, তা বোঝা যায় নারী এবং হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের মাত্রাটা দেখে। তিনি এই সত্যের কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন, সে বিষয়টি খুবই পরিষ্কার। এমনকি বিহারিদের ওপর ক্রুদ্ধ বাঙালিদের চড়াও হওয়ার ব্যাপারটিও তিনি এড়িয়ে যাননি।
নতুন দৃশ্য নির্মাণের সময় মুডকে স্থাপনের যে এক বিশেষ যতœ ছিল সেটি অনুভব করা যায়। যেমন মুক্তিযোদ্ধারা এপিসোডে যখন গেরিলা যোদ্ধাদের ফোকাস দল সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিল, তখন তাদের ভেতরকার বন্ধুত্বকে খুব অনায়াসেই বোঝানো সম্ভব হয়েছে। সহজ কথাকে তিনি সহজেই বলতে চেয়েছেন। ১৯৭১ এমন এক সহজ সত্য, মনে হয় উপস্থাপন অন্য কিছু হলেই বরং অস্বাভাবিক লাগত।
তবে এই প্রামাণ্যচিত্রের মূল শক্তির জায়গা হলো ইতিহাসের সঙ্গে পরিচালকের অনায়াস বোঝাপড়া, ফলে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না বরং অজানা তথ্যগুলো সামনে এলেও সহজেই আত্মস্থ করা যায়। তিনি শুধু উস্কে দিয়েছেন। এই ইতিহাস যাঁদের হাতে একদিন নির্মিত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন তাঁদের স্মৃতিকে যেমন উস্কে দিয়েছেন, তাঁরা স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তেমনি উস্কে দিতে চেয়েছেন অনুসন্ধিৎসু মনকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মগ্রহণ করেনি বা করলেও তাদের বোঝার বয়স হয়নি। অর্থাৎ এই প্রামাণ্যচিত্রে ইতিহাসের অংশীদার মানুষদের একটু উস্কে দিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিতে সাহায্য করেছেন যা গল্পের মতো সেই সময়কে ভুলে থাকা মানুষদের কিংবা সেই সময় সম্পর্কে যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই তাদের ভেতর পূর্ব-প্রজন্মের সবচেয়ে গৌরবের অথচ সবচেয়ে বেদনার সময়টিকে তুলে ধরতে পেরেছেন।
যদিও এই চলচ্চিত্র নিয়ে সমালোচনায় আমার আগ্রহ কম, তবে দু-একটি জায়গায় একটু নজর দেওয়া গেলে বোধহয় ভালোই হতো। যেমন শুরু থেকে অর্থাৎ প্রথম পর্ব থেকেই প্রতিটি এপিসোড টানটান, সবল, গতিময়, তবে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী পর্বটি থেকে এই গতিতে যেন একটু ভাটা পড়েছে। মনে হয় কোথাও বুঝি একটু মনোযোগ বিচ্যুতি ঘটেছে এবং এই অমনোযোগ বুঝি বহাল থাকে শেষ পর্যন্ত। কিছু কিছু এপিসোডের নাম ইংরেজিতে দেওয়া হয়েছে অথচ বাংলায় দেওয়া হয়নি, যেমন Artist।  বিষয়টি  ইচ্ছাকৃত না হলে পালটে দিলে ভালো হয়। দু-একটি জায়গায় ভাষান্তরের ক্ষেত্রে একটু বুঝি অন্যমনস্কতা দেখা যায়, যা অনায়াসে শুধরে ফেলা সম্ভব। রেপ্রিজেন্টেশন তত্ত্ব অনুযায়ী, মূল টেক্সটে যা আছে তা যেমন প্রকাশ করে, যা অনুপস্থিত তাও অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখতে পারলে ভালো হতো আরো হয়তো। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের বহুমাত্রিক অবদানটি উপস্থাপিত হয়নি। ধারা বর্ণনাকারীর গলা ভালো, উচ্চারণেও তেমন অসুবিধা নেই কিন্তু আগাগোড়া পাঠটি কেমন যেন আনন্দিত কণ্ঠে করেছেন মনে হয়। গোটা চলচ্চিত্রের যে গভীরতা, সেটির প্রতি আরেকটু যতœবান হলে ভালো হতো।
যুদ্ধ-চলচ্চিত্রের, বিশেষ করে যুদ্ধ-প্রামাণ্যচিত্রের একটি মুশকিল হলো প্রপাগান্ডামূলক চরিত্র থাকে। পরিচালক বোধহয় সেই বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। তাই প্রপাগান্ডামূলক স্বরটি কখনই খুব উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি বরং ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে বা ভুলে যাওয়ার বা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তার বিপরীতে ‘যেন ভুলে না যাই’ স্বরটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারাই হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। প্রতিটি এপিসোডের মধ্যেই একটি সম্পূর্ণ প্রামাণ্যচিত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সামগ্রিক বিস্মৃতির বিরুদ্ধে এই প্রামাণ্যচিত্র একটি দলিল – স্মৃতির ও আত্মপরিচয়ের কাছে ফিরে আসার এবং প্রয়োজনে নির্মাণ করার। এই মহাকাব্যিক দলিলটি আমাদের প্রিয় সংগ্রহ হয়ে উঠুক।

Leave a Reply