মো স্ত ফা জা মা ন
আধুনিকতার অন্তিম পর্বে উৎপাদন-নিরপেক্ষ ক্রয়-বিক্রয় ও প্রচার-প্রহসনের বিরামহীনতা অনেক লক্ষণের মাঝে একটি অন্যতম লক্ষণ। নগর নামের যে দেশ বা অঞ্চল তা বিরামহীন নির্মাণ ও নয়া (?) উৎক্ষেপের ক্ষেত্রবিশেষ – অথচ মানব নামের চেতনপ্রাপ্ত যে জাতি এর অধিবাসী – তার প্রতি প্রায় দায়হীন এমনতর নাগরিক কর্মতৎপরতা। বিমূর্ত শিল্পের ব্যাখ্যা অনুসন্ধানে এমত মানববিমুখতার ধারাসমূহে চোখ রাখা যেন আরো দরকারি হয়ে ওঠে। শিল্পী মনিরুল ইসলাম – যিনি এদেশে বিমূর্ততার নতুনতর একটি অধ্যায়ের সূচনাকারী – তাঁর ছবির সূত্রে নাগরিক বিরামহীনতার দিকটিকে আরো স্পষ্টতা দেন। চিত্রতলের দ্বিমাত্রিকতা জারি রেখে চিত্র-মাঝে দৃশ্যজ বিষয় না ফুটিয়ে তার ইঙ্গিতময়তা সৃষ্টি করার যে প্রক্রিয়া – সেই বিমূর্ত ভাষার ছবির রচয়িতা শিল্পী মনির আসলে বিরাম বা যতিচিহ্নের স্রষ্টা।
চিন্তা ও চিন্তাহীনতা, কিংবা বাস্তববাদিতা ও স্বপ্নচারিতা – এমন দ্বৈতবাদী মনোভাব হতে এই শিল্পী দূরের। কার্তেশিয়ান দর্শনের শরীর ও মনের কিংবা বুদ্ধি ও আবেগের দ্বৈততাও শিল্পীর মন কাড়েনি। তিনি অবগত যে মন-শরীর-আবেগ-বুদ্ধির বিভাজন মেকি – কারণ তা স্বতঃসিদ্ধ কল্পনার ভিত্তিতে গড়া। এমনকি এই ধারণাসমূহ স্থায়ীও নয়। আর অন্তিম-আধুনিকতা পর্বের পণ্যায়ন যে বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে নাগরিকের স্বপ্ন তথা ফ্যান্টাসি তৈরি করে দিচ্ছে – তার সফলতাই প্রমাণ করে যে, বাস্তব অবাস্তবের নিকট-প্রতিবেশী – দূরের কেউ নয়। ফলে বলা চলে যে, মনিরের নির্মাণ – বাস্তব থেকে দূরের, কিংবা বাস্তু-বস্তু-অবয়ব ও তাদের বাহ্যিক প্রবর্তনা-নিরপেক্ষ, কিন্তু ভুঁইফোঁড় শিল্প নয়। বরং তা নগর-প্রকল্পের অতি-উৎসাহ, বাচালতা-প্রগলভতাবিরোধী – কিবরিয়ার মতো নীরব না হয়েও বিরামচিহ্ন বিশেষ – যা চেতনপ্রবাহের ধারাবাহিকতার মাঝখানে ছেদ টানে – তবে তাকে নাকচ করে না।
এ বিরাম আসলে বাহ্যিকতা থেকে ছুটি নেওয়ার শামিল – অথচ তারই পরম্পরার অংশবিশেষ। অর্থাৎ শিল্পী মনির অন্তর ও বাহিরের দ্বিপক্ষীয় ধারণাও নাকচ করে একের মধ্য থেকে এই দুই পদের সুরাহা দেন। ফলে আমরা লক্ষ করি ‘এল এক্রোবাতা’ বা ‘একজন অ্যাক্রোবেট’ বা ‘একজন সংগীতবিদে’র মতো ছবিতে বাস্তবের ইঙ্গিত। এই সব চরিত্র আমাদের মধ্যে হাজির হন – অবশ্যই শিল্পের সূত্রে; কিন্তু আমরা তাঁদের কর্মতৎপরতা টের পাই রৈখিকতা কিংবা ফর্মের বা শেইপের চরিত্র ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতার মধ্য দিয়ে। ‘ব্ল্যাক লাভার’ বা ‘কালো প্রেমিক’ নামের চিত্রে যা শুদ্ধ ফর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ – অপর দুই চিত্রে তার ব্যত্যয় লক্ষণীয়। অর্থাৎ মনিরুল ইসলাম পিউরিটির বা বিশুদ্ধতার অনুসন্ধানী নন, বরং নবতর উপায়ে অভিজ্ঞতা কিংবা অভিব্যক্তির জন্ম দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য। এর সাক্ষাৎ প্রমাণ ‘দ্য আর্থ অ্যান্ড দ্য স্কাই’ বা ‘মাটি ও আকাশ’ ছবির ঊর্ধ্বলোকে বিমানের চিহ্ন ব্যবহারের মধ্যে আমরা পাই, চিহ্নিত করতে পারি এর লঘু ভাব। ‘পপ’ ছবির প্রতি পক্ষপাত তাঁর চিত্রভাষায় কখনো ফুটে ওঠেনি – তিনি ইয়োরোপীয় ইনফর্মাল আর্টের সূত্রে হয়তো কোনো কোনো চিহ্ন ব্যবহারের নিজস্ব পদ্ধতি রপ্ত করেছেন। কিন্তু কাট-আউটের মতো যে বিমান চিহ্ন হিসেবে আকাশের রোমান্টিকতা ও ভাবালুতা জাগানোর ক্ষমতা খর্ব করে – এই দিকে লক্ষ করে চিত্রজ সংগঠন বিবেচনায় শিল্পী স্বতঃস্ফূর্ত বিনির্মাণ পদ্ধতির পক্ষে আছেন বলে ঠাহর করা যায়। বলা যায়, তিনি গুরুর মাঝে লঘুর সহাবস্থানে বিশ্বাস রাখেন, এবং চিত্রে রস সৃষ্টির যে লীলা – তার জন্ম দিতে গাম্ভীর্যের বদলে এক সৃষ্টিশীল খেয়ালিপনার দ্বারস্থ হন। লঘু-গুরুর সংঘর্ষ ও এদের মধ্যকার হৃদ্যতা – এই দুই-ই শিল্পী তাঁর চিত্রে ব্যবহার করেন, যা সামাজিক সময় থেকে তাঁর ছবির স্পেসকে আলাদা করে দেয়। সময়ের বাইরে সময়হীন বিরাম তৈরি করাই যদি বিমূর্ত শিল্পীর উদ্দেশ্য হয়, মনির এতে মরবিডিটির বিপরীতে আনন্দলোকের চিহ্ন ফোটাতে চান। অপরদিকে অসম্ভবের অবতারণার মধ্য দিয়েও শিল্পী জীবনের অনির্দেশ্য ও অনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের দিকেও আমাদের দৃষ্টিপাতে উৎসাহ দেন। ‘দিবালোকের ভূত’ ছবিতে হয়তো তিনি আকস্মিকের উপস্থিতি ও এরই সূত্রে বাস্তবের যে ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড়ায় তা নির্দেশ করেছেন। ছবি হিসেবে উপভোগ্য মিডনাইট সারপ্রাইজ বা মধ্যরাতের আকস্মিকতায়ও একই মনোভঙ্গি লক্ষণীয়।
শিল্পী মনিরের উপরোক্ত পাঠের সুযোগ তৈরি হয়েছে শিল্পীর অধুনা অনুষ্ঠিত একক চিত্র-প্রদর্শনীর সূত্রে। বেঙ্গল গ্যালারির নবনির্মিত দ্বিতীয় প্রদর্শনী স্পেস – যার নামকরণ করা হয়েছে বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ – তারই যাত্রা শুরু হলো মনিরুল ইসলামের একক দিয়ে। এই প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির বিশেষ কোনো লক্ষণ আবিষ্কার সহজ কাজ নয়, কারণ এই শিল্পী বহুপ্রজ – তিনি সৃষ্টিশীলতার যে-লোক থেকে চিত্তের খোরাক তৈরি করেন, তা-ও সাংখ্যিক ও রূপকল্পনার মাত্রা – এই দ্বিবিধ গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।
অন্তঃকরণের বিষয়াবলি বাইরের জগৎকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি বাইরের জগৎও হৃদয়ের দেশ শাসন করে। মনিরের চিত্রে এরই খবর আমরা পাই। ফলে বিরতি হওয়া সত্ত্বেও তা এক প্রকার নান্দনিকতার সৃষ্টি করে – যা ভাষ্য উৎপাদনক্ষম না হয়ে ভাষ্য তৈরির খোরাক জোগায়। মূক ও নীরব থাকার প্রক্রিয়া ভিন্ন। বিশেষত পরিচিত বস্তু বিশ্বের গাঠনিক প্রমাণ গরহাজির, এমন চিত্র যে সামাজিক-নান্দনিক অর্থ উৎপাদন করে মনির সেই ভাষার অনুপস্থিতি ও ‘অ’ভাব, এমনকি ‘না’ভাব বা নেগেশন পুরোপুরি গ্রহণ করেন না। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত – ফলে তাঁর ছবিতে যে প্রাণ তড়পায় – তা এমনতর যাতে হর্ষ ও বেদনা রস একত্রে প্রকাশিত হয়ে ওঠে। শিল্পীর অধুনাকালের এই একক – যার শিরোনাম ‘রাপচার অ্যান্ড কন্টিনিউটি, অর্থাৎ ‘ছেদ ও বহমানতা’ – নানান বৈপরীত্যের ধারণা একের আয়ত্তে আনার প্রয়াস।
অঙ্কনশৈলী বা টেকনিকের দিকে দৃষ্টি দিলে এই প্রদর্শনী জ্যামিতিক কাঠামো, জ্যামিতির সুমিতি-পরিমিতি ভেঙে তৈরি কাঠামো, এমনকি ক্যালিগ্রাফির ছন্দনির্ভর রেখা – এ সকল কিছুর মিলনলোক হিসেবে দর্শকের সামনে কিছু উৎকৃষ্ট নমুনা তুলে ধরে। ‘কালো আয়না’, ‘একজন অ্যাক্রোবেট’, কিংবা ‘বসন্তে নারী’ চিত্রগুলো এমন বহুবাচনিকতার সূত্রে সৃষ্ট বলে মনে হয়। অপরদিকে ‘ইনফর্মাল’ বা ‘সজ্জাধর্মী নয়’ এমন চিত্রকল্পও এই প্রদর্শনীবিষয়ক ‘অপর’ বা ভিন্ন এক ভাষ্য তৈরিতে সহায়তা করে। যেমন : ‘ম্যাটাডোর’, ‘জংপড়া ইতিহাস’ কিংবা ‘নৃত্যরত ভূত’ – এসব ছবির আবহ তৈরিতে একধরনের খসড়া অঙ্কন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান মনির। মূলত পাশ্চাত্যের কিছু তূরীয় অর্জনের সঙ্গে প্রাচ্যের – বিশেষ করে দূর-প্রাচ্যের জেন তরিকার চিত্রজ গুণাগুণের সন্ধি ঘটাতে পারঙ্গম এই শিল্পী। তাঁর বহুমাত্রিক এচিং- অ্যাকুয়াটিন্টে এ দক্ষতার উন্মোচন তাঁর শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে, এরই অগ্রসরতর পর্যায় হিসেবে ওপরের চিত্রগুলি উল্লেখযোগ্য। ললিত ও নারীভাব প্রকাশকারী যে কোমলতা তার যে লৈঙ্গিক মাত্রা – সেই চৈতন্যপ্রদেশ থেকে এই ছবিগুলো দূরের। তবে এরা না পুরুষের গাম্ভীর্য ও গুরুভাব দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত, না নারীস্বভাবের পুলক-জাগানিয়া লালিত্যে প্রথিত : এরা লৈঙ্গিক চরিত্র ত্যাগ করে আরো সহজতর, সহজাত প্রকাশভঙ্গি যেন অর্জন করছে।
বলা বাহুল্য, শিল্পী মনির সত্তর ও আশির দশকে ছাপচিত্রের জন্যই সুখ্যাতি অর্জন করেন, তাঁর নিজস্ব চিত্রকল্পের যে সাবলীলতা ও ঋতু-প্রকৃতির সৌন্দর্য ধারণে তাঁর যে পারদর্শিতা তারই নবতর অধ্যায় হিসেবে নব্বইয়ের দশকে মনিরের কাগজে তেলরং কিংবা মিশ্র মাধ্যমে করা কাজ আমরা দেখতে পাই। রেখা ও ফর্মের লঘু ছন্দে ভাব প্রকাশের সহজ ভাষা এই স্পেন প্রবাসী শিল্পীর আয়ত্তে ছিল, বর্তমানে তাতে নস্টালজিয়ার প্রতাপ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হয়। ‘আমার কালো প্রেমের বাড়ী’ কিংবা ‘মুখাবয়ব’, অথবা ‘ধ্যান ও সংশয়’ – যেন স্মরণবিষয়ক সারণি।
এই প্রদর্শনী কালো রং বিষয়ে শিল্পামোদীদের পুনর্বিবেচনার পথ প্রসারিত করবে। কালো যে কেবল রাত্রি কিংবা ছায়ার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রবর্তিত – তা নয়, কালো কালচৈতন্য ও স্মৃতিকাতরতারও ধারক। কালচেতনা জীবনানন্দে আমরা ব্যক্তিসত্তার ট্রমা বা মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতের কারণ হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারি; মনিরের শিল্পে এমত ট্রমার উৎপাত কম। বরং যাপিতজীবনের কোনো এক সন্ধিক্ষণে মৃত্যুচিন্তা যে দার্শনিক প্রজ্ঞার জন্ম দেয় – যা জীবনানন্দে চিত্তবিকাশকারী পরামুহূর্তের জন্ম দেয়, তেমন আমিহীনতা থেকে এই কালোর দিকে তাকানো যায় – বলা যায় এই সৌন্দর্য আত্মবিরতির কিংবা আত্মহীনতা অনুভব করার। শিল্পী মনিরের অধুনা সাদা-কালোয় মনোনিবেশ এমন উপলব্ধিসূত্রে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ‘নৃত্যরত ভূত’ কিংবা ‘মধ্যরাতের সংলাপ’ ছবি দুটিতে দুই মাত্রায় এই উপলব্ধির অন্ধকার প্রজায়মন বলে মনে হয়। কালো রং বিষয়ে এমন জাঁকানো আলাপে মনে হতে পারে যে, শিল্পী হয়তো ললিত মাত্রা থেকে দূরে চলে আসছেন; আসলে রঙিন চিত্রকল্পে যে লঘুভাব ফোটাতে তিনি সমর্থ – সেই লীলার স্বাক্ষর এই প্রদর্শনীতেও মেলে।
প্রবীণ এই শিল্পীর কাজে বহুমুখিনতার সূত্রে যে দিকনির্দেশনা একসময়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নানাবিধ আকাক্সক্ষা চাড়িয়ে দিয়েছে, সেই দিক বিবেচনায় এই প্রদর্শনীটি কিছুটা কমজোরি, তবে শিল্পীর ক্ষেত্রে নতুন পথ শুরুর ইঙ্গিতবাহী ঠিক।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011