logo

বিমূর্ত, মূর্ত ও জগৎ তামাশা

জা ফ রি ন  গু ল শা ন
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের যে কজন শিল্পী বিমূর্ত আঙ্গিকে শিল্পকর্ম করে যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে মাহমুদুল হক অন্যতম। দীর্ঘ সময়ের একনিষ্ঠতা ও পরিশ্রমে মাহমুদুল হকের বিমূর্তায়নে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছে। যদিও যাঁরা শিল্পজগতের ইতিহাস জানেন তাঁরা সহজেই উপলব্ধি করেন, শিল্পী মাহমুদুল হকের চিত্রকলা রচনা প্রক্রিয়ার উৎসের উৎসাহ সম্বন্ধে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বিমূর্ত রীতিতে শিল্পনির্মাণে সবচেয়ে অগ্রগণ্যভাবে সফল বলে সকলেই মানেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়াকে। যদিও কিবরিয়া নিজেকে কখনই বিমূর্তধারার শিল্পী বলে মনে করতেন না। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদরা যখন বিভিন্ন উপায়ে ব্যস্ত নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের চারু ও কারুশিল্পের অঙ্গনকে গুছিয়ে আনতে, তখন একাধারে ‘রিয়ালিজমে’র চর্চা চলছিল। এরপর এদেশের শিল্পীদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষার্থে ইউরোপে যান, তখন ইউরোপজুড়ে বিমূর্ত শিল্পধারার উচ্চতর অবস্থান। আমাদের শিল্পীরা বিমূর্তায়নে প্রভাবিত হলেন, তাঁরাও এ চর্চা শুরু করলেন। কিবরিয়াও এভাবেই শুরু করলেন। মাহমুদুল হক মোহাম্মদ কিবরিয়াকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন। তিনি কিবরিয়া-পরবর্তী বিমূর্ত চিত্রধারায় কাজ করেছেন সফলতার সঙ্গে। ‘বিমূর্ত’ হলো বাস্তবতাকে অধিবাস্তব প্রক্রিয়ায় দেখা। কিংবা পরিমিত কোনো বস্তুকে না এঁকে কিছু জ্যামিতিক ফর্ম, রেখা, রং, টেক্সচারের কম্পোজিশনে তৈরি হওয়া নতুনতর একটি বাস্তবতা, যার মধ্যে দর্শক উৎসের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো স্বাধীন অর্থ স্থাপন করতে পারে। এ কারণে বিমূর্ত চিত্রধারাকে বোঝার চেষ্টার প্রক্রিয়ায় দর্শকের মনোজাগতিক জ্ঞান-চিন্তা-চরিত্র বৈশিষ্ট্য এক ধরনের স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম পায়। যদিও আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে চারুশিল্প ধারাগুলোর মধ্যে অ্যাবস্ট্রাকশন অধিকাংশ মানুষের বোধগম্যের বাইরের বিষয় বলে অনেকের ধারণা। কিছুটা সত্যতা বিদ্যমান, কিন্তু যখন বিশ্বায়নের যুগের হাওয়া লাগছে, তখন এর গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছে বিশেষ একটি শ্রেণির কাছে।
মাহমুদুল হক রং লেপনে খুব পরিমার্জিত ব্যাকরণসিদ্ধতার সঙ্গে গুরুত্ব দেন শিল্পকর্মের আন্তরিক চাহিদাকে পূর্ণতা দেওয়ার। ফলে রঙের বাহুল্য নেই। নরম আবেশি আবহাওয়া তাঁর ছবির মূল বৈশিষ্ট্য।
স্পেস ডিভিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তাঁর চিত্রে। চতুর্ভুজাকৃতির অধিকাংশ ক্যানভাসে চতুর্ভুজ জ্যামিতিক ফর্ম, কখনো দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যে তো কখনো ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের আদলে নির্মিত। কোথাও কোথাও ভারী ‘ইমপ্যাস্টো’ পদ্ধতিতে রং লেপন এবং অনেকগুলো তলের উপস্থিতি ক্যানভাসকে বর্ণনাময় গুণ প্রদান করেছে। মাহমুদুল হক ১৯৪৫ সালে বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮-তে বিএফএ করেন বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়, অর্থাৎ বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চারুকলা অনুষদ থেকে। ১৯৮১-৮২ সালে জাপানের সুকুবা ইউনিভার্সিটি থেকে ছাপচিত্রের ওপর রিসার্চ করেন প্রফেসর শিরোকি তোশিওকির তত্ত্বাবধানে। ১৯৮৪-তে সেখানে মাস্টার্স করেন। দেশে ষোলোটি একক প্রদর্শনী করেন। এছাড়া বিভিন্ন দেশে তেইশটি একক প্রদর্শনী করেছেন। বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনী করছেন। ১৯৯২ সালে দশম জাতীয় শিল্পকলা প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৯৬-তে দ্বাদশ কুয়েত আন্তর্জাতিক বিয়েনালে দ্বিতীয় পুরস্কার এবং ২০০৬ সালে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত ‘সুলতান পদক’সহ দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা পেয়েছেন। বিয়াল্লিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অধ্যাপনা করেছেন এবং বর্তমানে ‘সফিউদ্দীন বেঙ্গল প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’তে উপদেষ্টা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শিল্পী মাহমুদুল হকের ‘বিদ্যমানতার পুনর্নির্মাণ’ (Re-Enacting Actuality) শিরোনামের প্রদর্শনীটিতে বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস্-এ ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছে।

দুই
শিল্পী মাহমুদুল হকের বিমূর্ত বাস্তবতার রোমান্টিসিজমের মূর্ততার বৈসাদৃশ্যপূর্ণ গল্প বলেন শিল্পী ফরিদা জামান। গত ১৩ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত একই গ্যালারিতে ‘নিরন্তর মাটির টানে’ (Bound to the soil) শিরোনামে একক প্রদর্শনীতে এই শিল্পীকে আরো সমৃদ্ধ উপায়ে দর্শক দেখেছে। ফরিদা জামানের শিল্পকর্ম প্রকৃত অর্থেই স্বকীয়তা অর্জন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নদী, জাল, মাছ, পাখি, বিড়ালসহ গ্রামীণ জীবনধারার ছবি আঁকছেন। বাংলাদেশের চিরায়ত কাব্যিক গুণাবলির প্রকাশ ঘটেছে ফরিদা জামানের চিত্রে। জলরং মাধ্যমের কৌশলে রংকে স্বাধীনভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে স্পেস বিভাজন নিয়ে খেলা শুরু করেন তিনি।
মূল চরিত্র বা ফোকাস কেন্দ্রে পরিণত হওয়া ফরিদা জামানের ছবির একটি বৈশিষ্ট্য। রেখাগুলো ছন্দময় লীলায়িত ভাবের ড্রইং নির্ভরতা তৈরি করেছে। তাঁর সৃষ্ট অবয়বগুলো (মানুষ কিংবা পশুপাখি) ওজনহীন হাওয়ায় ভাসমান এক দৃশ্যানুভূতি সৃষ্টি করে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘সুফিয়া’ সিরিজ নিয়ে কাজ করেছেন। ‘সুফিয়া’ নিুবর্গীয় নারীর আখ্যান। বাঙালি নারীর গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে পোষা বিড়াল, পাখির উপস্থিতি সত্য এক বাস্তবতা নির্মাণ করে। উষ্ণ রঙের ব্যবহার (লাল, হলুদ, কমলা ইত্যাদি) সুফিয়ার জীবনের সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের উষ্ণতা সৃষ্টি করেছে। তাই চার্মিং সুফিয়া ছবিতে বাতাসে উড়ছে সুফিয়ার চুল, শাড়ির আঁচল, সুফিয়া স্বপ্নের অভিব্যক্তিময় আবেশে তাকানো, পেছনে কাশবনে বাতাসের চলাচল। অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের এই ছবিটি ২০০৯-এ আঁকা। মাপ ৯০  ৯০ সেন্টিমিটার। বিড়ালের গলার অস্বাভাবিক লম্বা ও আয়েশিপনার পেছনে মাছ ধরার জাল সহজেই দৃশ্যকল্প তৈরি করে বিড়ালের মাছপ্রেম। প্রেম হয় নদীতে ও জালে। ফরিদা জামান মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদী লাগোয়া জেলা চাঁদপুরের মেয়ে। নদী, জল, জাল তাঁর ছবিতে তাই স্মৃতির রোমন্থনে নতুন আঙ্গিকে এসেছে। রং লেপনে আধা বিমূর্তায়ন ঘটেছে শিল্পীর নিজস্ব ঢঙে। ক্যানভাসের চিত্রতলে প্রায়ই বৃত্তাকার ডটের ব্যবহার আদিবাসীদের সচেতন বীক্ষণকে সংযুক্ত করেছে।
ফরিদা জামান ১৯৫৩-তে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে বিএফএ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে। ১৯৭৮-এ ভারতের মহারাজা খায়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়, বরোদা থেকে এমএফএ করেন। ১৯৯৫-এ পিএইচডি করেন বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে। সাতটি এককসহ বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন সদা কর্মচঞ্চল এই শিল্পী। চারুকলা অনুষদে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। সমসাময়িক দুজন শিল্পী মাহমুদুল হক ও ফরিদা জামান এবং সমসাময়িক বাস্তবতায় থেকেও দৃশ্যশিল্পের ভাষায় ক্যানভাসের দ্বিমাত্রিক সম্ভাবনাময় একেবারে বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যগুণ। লৈঙ্গিক বৈপরীত্যও একভাবেই শিল্পীদের মানসিক অভিজ্ঞতার চিত্রায়ণ ঘটায় শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে। এবং একবিংশ শতাব্দীর ত্রয়োদশ বছরে এসে চিত্রশিল্পজ্ঞানের এই বিবিধতা আরো বিচিত্র ও শক্তিশালী উপায়ে নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সদা বিকাশমান প্রগতিশীলতার দিকে।

তিন
শিশির ভট্টাচার্য্যরে ড্রইং নিয়ে একক প্রদর্শনী ‘দাগ-তামাশা’ হয়ে গেল ঢাকা আর্ট সেন্টারে। একজন উচ্চ কল্পনাপ্রবণ সৃজনশীল মানুষের ভাষার কৌশলগত দক্ষতার সমন্বিত উপস্থাপন এই ‘দাগ তামাশা’। তামাশা কি শুধুই ‘দাগ’ নিয়ে নাকি আরো বৃহত্তর আঙ্গিকে চলমান ঘটমান তামাশা-মশকরার চিত্রায়ণ? শিশির ভট্টাচার্য্যরে ছবিতে অনেক অনেক চরিত্র। নারী-পুরুষ, চোখ, টিকটিকি, পাখি, খেলনা, বিড়াল, সিসি ক্যামেরা, কাগজের নৌকো, কাক, মাছ, গাছ, পাতা, ফুল, কুকুর, আগুন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি শিশিরের যাপিত জীবনের চেতনা ও কল্পনার সমস্ত কিছুই উপস্থিত। শিশিরের ড্রইংগুলোতে কোনো মূল দৃশ্যকেন্দ্র নেই। বস্তুগুলো ঘুরেফিরে একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। আর রয়েছে বস্তুর রূপান্তর। লেজ কাটা বিড়ালের মাথা হয়ে গেল হাত। সেই হাত গিয়ে মিলিত হলো আরেকটি হাতে, যে হাতের রেখা উৎসারিত অজানা দুজন মানুষের মুখের ড্রইং ভেদ করে চলে যাওয়া দুটো ম্যাচের কাঠিতে। সেটি আবার সংযুক্ত হয়েছে কারো একটি পায়ে এবং এভাবে চলেছে। কে কার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হচ্ছে, আলাদাভাবে বিচার করা মুশকিল। আর সেই হাত হয়ে যাওয়া বিড়ালের মাথা দেখা যায় ওর পেটে। এই বিচিত্র সংযোগ, রূপান্তর ও রেখার গোলকধাঁধা এ সমাজেরই উপস্থাপন।
শিশির ভট্টাচার্য্য বিখ্যাত একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে। দেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সবকিছু শিশির পাঠ করেন বলেই তিনি নির্মাণ করেন নিজের শব্দমালা। শিশিরের ছবির অসংখ্য চরিত্র একটি একটি গুছিয়ে শব্দ সাজালে কবিতা হয়। সদা চলমান চিত্রপটে রয়েছে ছোটগল্পের গুণ-বৈশিষ্ট্য, যেন কোনো শেষ নেই। একই সঙ্গে প্রতিবাদ, প্রেম, যন্ত্রণা, হাসির খোরাক বিদ্যমান। এ সময়ের একজন সামগ্রিক মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের উত্থান-পতন, সংশয়-নির্ভয় রচনা করেছেন শিশির সচেতনভাবেই। তাঁর দ্বিমাত্রিক তলের ড্রইংগুলো ত্রিমাত্রিকতা পেয়েছে ঘন ও ভারি শক্তিশালী রেখায়। শিশির ভট্টাচার্য্যরে চিত্রভাষা সর্বোপরি বাস্তবতার সঙ্গে যে সম্পর্ক স্থাপন করছে তা অনেকটাই সমালোচনামূলক রূপ উদ্ঘাটন করে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘ম্যাজিক রিয়ালিজমে’র সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। সুতরাং শিল্পীর অনেক কথা বলার প্রবণতা শব্দ-বাক্যবিহীন আরেকটি ভাষা মাধ্যমে গিয়ে বহুমাত্রিক চরিত্রের দ্বার উন্মোচন করেছে, সবকিছু মিলিয়ে ‘দাগ-তামাশা’কে সামাজিক বাস্তবতার উপকরণ বলা যেতে পারে। কারণ ভোগবাদী এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিশির ভট্টাচার্য্যরে সমান লয়ের ড্রইংগুলো মানুষের চর্চার ভেতর থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাওয়া কিন্তু সাবলীল স্বাভাবিক সামগ্রিক উন্নত জীবনের প্রতি তামাশার রূপই উদ্ঘাটন করছে। শিশির ভট্টাচার্য্য ১৯৬০ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। প্রদর্শনীটি চলে ১৪ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত।

Leave a Reply