মা হ মু দ আ ল জা মা ন
শিল্পী রফিকুন নবীর সাম্প্রতিক একক প্রদর্শনীটি নানা কারণে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল। একদিকে তিনি ক্যানভাসে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশালত্বের অনুভব, সঞ্চার করেছেন নবমাত্রা। ঊনত্রিশটি কাজের এই প্রদর্শনীতে অ্যাক্রিলিক ও জলরঙের কাজ ছিল। সবগুলো কাজই ছিল শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। বৃহৎ ক্যানভাস যেমন ছিল তেমনি ছিল ছোট ক্যানভাস। জলরঙের কাজগুলো শুধু সান্দ্র শ্যামল হয়ে ওঠেনি, তিনি যে এ-মাধ্যমে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সৃজনশীল শিল্পী, তা প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তাঁর সৃজনক্ষমতা যে কত তীব্র ও তীক্ষ্ণ এবং শিল্পের সুষমায় কত হৃদয়গ্রাহী এই জলরঙের কাজগুলোতে তা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছিল। তাঁর জলরঙের এই সৃষ্টিগুচ্ছে রঙের তীব্রতা ছিল না বা রং নিয়ে তিনি বিশেষ কোনো ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে চাননি। অন্যদিকে তাঁর বৃহৎ ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে করা বেশ কয়েকটি কাজে তাঁর সৃজনকুশলতায় জীবনের বাস্তব কিছু অনুষঙ্গ বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছিল। এই চিত্রধারায় বিষয়ের অন্তর্নিহিত বোধ অঙ্কনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ সৃজনশীল শিল্পী। এদেশের শিল্পধারায় যে নিত্যনতুন যাত্রাপথ নির্মাণে পারঙ্গম তিনি, সে-কথা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করল তাঁর সাম্প্রতিক প্রদর্শনী। এদেশের শিল্পানুরাগীরা দীর্ঘদিন থেকে বিমূর্ত, আধাবিমূর্ত এবং ফর্ম নিয়ে নানা নিরীক্ষাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। যৎসামান্য ভাটা পড়লেও বাস্তবধারার কাজে এখনো অনেকেই সক্রিয়। বিশেষত কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর ও সমরজিৎ রায়চৌধুরী। পূর্বসূরি চিত্রীরা বাস্তবধারার সৃজনে যে চারিত্র্য সৃষ্টি করেছিলেন একদিকে তা ছিল ঐতিহ্যিক প্রবাহে নিমজ্জন ও বাংলাদেশের জনজীবনেরই রূপায়ণ। সন্দেহ নেই, কিছুটা শীর্ণ হলেও এই ধারাটির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের চিত্রধারা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়েছে। এই ধারায় বৃহৎ ক্যানভাসে প্রতিফলিত বাংলাদেশের জনজীবন রফিকুন নবীর অঙ্কনে মহীয়ান হয়ে উঠেছে।
রফিকুন নবী দীর্ঘদিন থেকে বাস্তবধারায় তাঁর প্রত্যক্ষজাত অভিজ্ঞতা থেকে চিত্র অঙ্কন করে চলেছেন এবং সহজাত কুশলতা অর্জন করেছেন। তাঁর কাজে নানাভাবে বাঁক ফেরা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বিগত এক দশকে তিনি জলরং, কাঠখোদাই, অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে কাজ করেছেন। কাঠখোদাইয়ের কাজে তিনি কখনো আধাবিমূর্ততায় জীবনের অনুষঙ্গকেও তুলে ধরেছেন। এইসব মাধ্যমে তাঁর আশ্চর্য দখল ও শক্তিমত্তার পরিচয় আমরা পেয়েছি। শিল্পের মুক্তি ও রূপায়ণ নবব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁরই হাতে।
অবয়ব-গঠনের শৃঙ্খলা ও পরিমিতবোধ তাঁর সৃজনের প্রধান গুণ। তিনি যখন সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে বৃহৎ ক্যানভাসে ধীবরজীবনের অনুষঙ্গকে তুলে ধরেন এবং বারোটি মানুষের অবয়বকে আশ্চর্য শৃঙ্খলায় একটি বৃহৎ ক্যানভাসে (১০ ফুট x ৬ ফুট) বিম্বিত করেন, তা দেখে আমরা বিস্মিত হই। এতগুলো মানুষ এবং বৃহৎ পরিসর সম্পর্কে তাঁর শিল্পিত জ্ঞান পর্যবেক্ষণ করে খুব সহজেই এই শিল্পীর শক্তিমত্তা ও দক্ষতা উপলব্ধি করা গেল। শিল্পী রফিকুন নবীর এই অনায়াস দক্ষতা ও ব্রতচর্যায় এক অন্বিষ্ট ভুবননির্মাণের প্রয়াস আমাদের চেতনার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। পটবিভাজন প্রক্রিয়ায় কোথাও এতটুকু ভারসাম্য নষ্ট হয়নি। প্রতিটি অবয়ব যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রতিটি ফিগার তার চরিত্র নিয়ে উজ্জ্বল। এমনকি মনে হয় প্রতিটি মানুষকে তিনি অনেক ভেবেচিন্তে ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। ‘বিশ্রামক্লান্ত ধীবর’ শীর্ষক দীর্ঘ ছবিটির পশ্চাতে রয়েছে মাছ ধরার বিশাল এক সমুদ্রগামী নৌকা, যা ধীবরজীবনেরই সংগ্রামের প্রতীক কিংবা, বলা যায়, জীবনের অনুষঙ্গীবোধসম্পন্ন এক জলযান। পশ্চাতে নীল আকাশ এবং সমুদ্র। ছবিতে যে কেন্দ্রীয় মানুষ বাঁশি বাজাচ্ছে, সে সুখী ও তৃপ্ত; কেউ হুঁকো টানছে, কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে এবং ছবিটির বাঁদিকে চারটি মানুষ তাস খেলছে। এতগুলো অনুষঙ্গ একটি ক্যানভাসে কোনো ভারসাম্য হারায়নি বা টলে যায়নি। জেলে, সমুদ্র, মাছ ধরা, শিশুসহ সাইকেল-আরোহী নিয়ে এই প্রদর্শনীতে তাঁর আরো কিছু কাজ ছিল এবং এই কাজগুলো বিষয়ের বিশালত্বে, শিল্পগুণে ও জীবনের গল্পবর্ণনায় কুশলী।
এই প্রদর্শনীতে তাঁর সৃজনকুশলতার বৈশিষ্ট্য ও সৃজনচরিত্র নবমাত্রা অর্জন করেছে বিশালাকৃতির আরো কয়েকটি ছবিতে। স্বাভাবিকভাবে বৃহৎ ক্যানভাসের ছবিতে পরিসর যে জিজ্ঞাসার জন্ম দেয় এবং পরিসরকে কীভাবে কোনো শিল্পী কাজে লাগান এবং বিভাজন করেন, তা হয়ে ওঠে বেশ তাৎপর্যময়।
এ-প্রদর্শনী সম্পর্কে শিল্পী রফিকুন নবী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। শিল্পীর উত্তরণ-প্রয়াসী মন ও সাম্প্রতিক শিল্প-ভাবনারও প্রকাশ ঘটে এই উক্তিতে – ‘ইচ্ছেটা অবশ্য ছিল, অভ্যাস বদলে দূরে সরে গিয়ে ভিন্ন কিছু ভাবব। দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করব। কিন্তু অাঁকা শেষে আবিষ্কার করলাম, আমি সেই চিরকালের আমিতেই রয়ে গেছি। বিষয়নির্ভরতাকে, বাস্তবধর্মিতাকে এড়ানো যায়নি। আসলে জগৎকে দেখার যে চোখ তা তো যার যার তার তার। অর্থাৎ যার হাতে যা আসে তাইতেই রয়ে যাওয়া যেন দস্ত্তর। প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতটিও তাই। সহজিয়া পথে চলার যে পন্থা তাকে বাতিল করে অন্য ঘরে ঢোকার দিকটি, অতএব, এবারও আর ঘটল না। বয়সটাও বোধহয় আর সেদিকে ধাবিত হতে দিতে চায় না। নিজের কলাকৌশলে থিতু হবার সময় বোধহয় এসেই গেল। ভাবছি সেটাই বা মন্দ কী! তো এবারও প্রকৃতি এবং এর অন্তর্নিহিত যা কিছুতে আকৃষ্ট হই সেসবই বিষয় হিসেবে ছবিতে স্থান পেয়েছে।’ নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বনানী ইত্যাদি বিষয়ই আবার প্রিয়তা পেয়ে গেছে। আর তার সঙ্গে উপস্থিত রয়েছে এসবকে মহিমান্বিত করে বেঁচে-বর্তে থাকা খেটে-খাওয়া মানুষ, খুঁটে-খাওয়া পশু-পাখি। এসবকে ঘিরে রয়েছে রং-রেখা, স্পেস, বিন্যাস আর নকশির মতন খুঁটিনাটি, অনুষঙ্গ হয়ে। সৃজনী উৎকর্ষের দিক থেকে যে পরিপ্রেক্ষিত মুখোমুখি করে তা অতিক্রম করা বেশ কঠিন, তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞান এবং রং ব্যবহারের মুনশিয়ানা এই বক্তব্যে উজ্জ্বল হয়েছে এবং যে মনোভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে তা তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে। শরীরী বিম্ব গঠনে এবং সর্বতো অর্থে এ হয়ে উঠেছে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
শিল্পসুষমায় বাস্তব অনুষঙ্গ
ঢাকা আর্ট সেন্টার-আয়োজিত তাঁর প্রদর্শনীর নাম ‘বাস্তবের অনুষঙ্গ’। স্বাভাবিকভাবে স্মৃতির তাড়না ও ব্যাকুলতা থেকে যে-শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে তাতে ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ছবি হৃদয়ে ধরা পড়েছিল তাকে তিনি রূপায়ণ করেছেন তাঁর পটে। স্মৃতি-উদ্ভূত এই শিল্প সৃষ্টি-উৎকর্ষে এবং শিল্পমূল্যে বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত উন্মোচন করেছে। আমরা এই প্রদর্শনীতে জীবনের রূপায়ণের সিদ্ধহস্ত এক বড়মাপের শিল্প ও শিল্পীকে পেয়েছি। আমাদের ধারণা, দীর্ঘদিন শিল্পানুরাগীদের হৃদয়ে এই প্রদর্শনী স্থায়ীরূপ নিয়ে আন্দোলিত হবে।
রফিকুন নবীর বয়স এখন সত্তর। এই বয়সেও সৃজন-উৎকর্ষে তিনি তরুণদের মতোই সাহসী। ক্যানভাসে তিনি সমাহার ঘটিয়েছেন অনেকগুলো অবয়বের। সর্ববৃহৎ ছবির আকার ১০ ফুট x ৬ ফুট। আরেকটি ৮ ফুট x ৬ ফুট, ৬০ ফুট x ৬ ফুট। এসব চিত্রকর্মে তিনি তুলে ধরেছেন জীবনের নানা অনুষঙ্গ। অবয়ব-গঠনের শৃঙ্খলায়, রসগুণে পরিসর-নিয়ন্ত্রণে এবং জীবনের নিবিড় রূপায়ণে তাঁকে করে তুলেছে দক্ষ এক কুশলী শিল্পী।
তাঁর স্বকীয় চিত্রভাষা চিত্রে দেশীয় আবহের এক মেজাজ সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের মানুষের দুঃখকষ্ট এবং সান্দ্র সৌন্দর্য আশ্চর্য মমতায় প্রতিফলিত হওয়ায় তিনি বাস্তববাদী ধারার অন্যতম চিত্রকরে পরিগণিত হয়েছেন। এই চিত্র-প্রদর্শনী এইসব বিবিধ কারণে খুবই তাৎপর্যময় হয়ে রইল। সামান্য বিষয়, তুচ্ছ ও প্রতিনিয়ত দেখা ঘটনাবলিও একজন শক্তিশালী চিত্রীর হাতে শিল্পিত উৎকর্ষ ও সুষমার সম্মিলনে কত হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে এই প্রদর্শনীর চিত্রগুচ্ছে তা ধরা পড়েছে। সর্বোপরি আমাদের কাছে ভালো লেগেছে বিষয়কে বিন্যাসের ক্ষেত্রে এই চিত্রীর আশ্চর্য দক্ষতা।
সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে রফিকুন নবী শিল্পদক্ষতা ও কুশলতায় কীভাবে নিজেকে অতিক্রম করেছেন তার পরিচয় ধরা আছে। প্রদর্শনীর বেশ কয়েকটি চিত্রের বিষয় বরেন্দ্র অঞ্চলের আটপৌরে জীবন এবং সাধারণ ভূদৃশ্য। মোট ২৯টি কাজ ছিল প্রদর্শনীতে। ছবির বিষয়সমূহ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত। অ্যাক্রিলিক ও জলের অধিকাংশ কাজেই এই স্মৃতির অনুভব ও অনুষঙ্গ প্রাধান্য ও পিতার চাকরিসূত্রে বালাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার করে আছে।
তাঁর শৈশব কেটেছিল বৃহত্তর রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে। যে-কোনো সৃজনশীল মানুষের মানসভূমি গঠনে শৈশবস্মৃতি এক উদ্দীপক ভূমিকা রেখে যায়। রফিকুন নবীকেও এই স্মৃতি নিরন্তর যে চালনা করেছে, প্রদর্শনীর কয়েকটি কাজে তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর আছে; বিশেষত নিসর্গ-প্রত্যক্ষণে ও তার অন্তরায়ণে সৌন্দর্যের রূপ। এই অঞ্চলে সাঁওতাল সম্প্রদায় অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনে যে-ছাপ ফেলেছিল এবং এখনো এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি কত আনন্দময় রফিকুন নবী তা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। সেজন্য তাঁর ছবির গ্রামীণ পুরুষমানুষের অবয়ব অনেকটাই যেন কালো; শ্রমজীবীরা মর্মযাতনায় এবং জীবনযুদ্ধে পরাজিত নয়। এই মানুষজনের নিত্যদিনের জীবনছবি এই সত্যের মুখোমুখি হয়ে বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতের উদ্ভাস ঘটে। নানা অনুষঙ্গ ও বাস্তবতা কখনো এই অঞ্চলের ভূদৃশ্যে প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষত রাঢ়বঙ্গের দিগন্তবিস্তারী ঐশ্বর্য ও মাঝি।
প্রদর্শনীকক্ষে ঘুরেফিরে আরেকটি দিকের উন্মোচন ঘটে ও নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই আমরা। তাঁর এই প্রদর্শনীর সৃষ্টিগুচ্ছে নারীর উপস্থিতি খুবই কম। নেই যে তা নয়। এ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, নারীকে ঘিরে কোনো ধরনের ভাবালুতায় তিনি আবর্তিত হতে চাননি। বরং তারুণ্যে যে-অঙ্গীকারে স্পন্দমান হয়েছিলেন, মানুষের দুঃখ ও যাতনাকে অনুভব করা, এ-নিয়েই তাঁর শিল্পযাত্রা বিবর্তিত হতে চেয়েছে। এই দুঃখ ও যাতনা পর্যবেক্ষণ করি তাঁর অঙ্কিত মানুষের মুখে। বিষাদও যে উঁকি দেয়নি তা নয়। কিন্তু এ-বিষাদকে অতিক্রমণের আশ্চর্য এক অঙ্গীকারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখানেও তিনি বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন।
পেছন ফিরে দু-একটি কথা এবং এই প্রদর্শনী
রফিকুন নবীর চিত্রসম্ভারে মুগ্ধ রোমান্টিকতার কোনো আবেশ ছিল না। সজ্ঞানে রোমান্টিকতাকে পরিহার করেছেন তিনি। তাঁর চিত্রগুচ্ছের বাস্তব অনুষঙ্গ হৃদয়ের গহিন কোণে যে কতভাবে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে গিয়ে সে-কথাই মনে হলো। হৃদয়ে গুঞ্জরিত হয়ে উঠছিল সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর সৃজনধর্ম ও ভিন্ন ভিন্ন পটে ধৃত অতলস্পর্শী রূপ জীবনের অন্তর্লীন শক্তি কীর্ণ হয়েছিল। মননধর্মিতার গুণে রেখা ও রঙের ঐকতানে প্রদর্শনীর চিত্রগুচ্ছে জীবনের নানা দিকের আশ্চর্য রূপায়ণ তাঁর হাতে নবীন মাত্রায় ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে। চড়া রং তিনি ব্যবহার করেননি। নীল, ধূসর ও সাদা তাঁর ছবিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। তাঁর কম্পোজিশনের পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান, পটে বিষয়কে বিভাজনের দক্ষতা, অনেক ফিগারকে একটি পরিসরে সুষম বিন্যাসে উপস্থাপনের মুনশিয়ানার ফলে এ-প্রদর্শনী যে-চারিত্র্য সৃষ্টি করেছে, তা শিল্পীকে এক উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সেজন্য এই প্রদর্শনী হয়ে উঠল তাঁর সৃজন-উৎকর্ষের ভুবনে এক উদ্দীপক মাইলফলক। এই প্রদর্শনীর বেশ কয়েকটি ছবি-বিশ্রামরত জেলেরা, কিংবা জলরঙে করা ভুটানের ভূদৃশ্য, কলম্বোর সমুদ্রসৈকত যে-শক্তিমত্তা ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতীয়মান হয়েছে, এই কাজগুলোর মধ্য দিয়ে আগের প্রদর্শনী থেকে শিল্পীর উত্তরণ হয়েছে। সিদ্ধি অর্জন করেছেন বিষয়কে উপস্থাপনের সহজ-সরল নিরাভরণ গুণে এবং আমেজসৃষ্টিতে ও রং-ব্যবহারের পরিমিতিতে। রফিকুন নবী যে বাংলাদেশের চিত্রকলায় একজন প্রথম সারির চিত্রকর এ-প্রদর্শনীতে তারই স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। তাঁর সাধনা, শিল্পদক্ষতা ও চিত্রের ভাষানির্মাণে নিরলস চেষ্টার মধ্য দিয়েই তিনি মোড় ফিরলেন। তাঁর ‘পরিবার’ সিরিজ শিল্পানুরাগীদের হৃদয়ে একটি ভিন্ন আসন ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই সিরিজের ছবি থেকেই তিনি শিল্পের মহত্তর ও বৃহত্তর পথসৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিভিন্ন মাধ্যমে করা কাজের সঙ্গে পরিচিত, তাদের কাছে মনে হলো এ-প্রদর্শনীতে তিনি অভ্যস্ত পথ থেকে সরে এসেছেন। সৃষ্টি ও উত্তরণ-প্রয়াসী তাঁর সৃষ্টিসত্তা শিল্প থেকে বৃহত্তর শিল্পিত বোধে পৌঁছে যাওয়ার পথে উন্মুখ। কতভাবে বৈচিত্র্যগুণে ও সৃজনদক্ষতায় তা মূর্ত হয়েছে! এই পরিক্রমা ও সাধনাই তাঁকে নিয়ে গেছে পূর্বসূরি জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পধারায়। অগ্রজদের এই ধারায় অবগাহন করেই সৃজনে সুন্দরকে অভ্যর্থনার শিল্পকুশলতা এই শিল্পীকে একজন শীর্ষ সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সেজন্যই আমরা পেয়ে যাই জীবনঘনিষ্ঠ এক ভুবন, যেখানে জীবন ভিন্নমাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। জীবনের নানাদিকও প্রতিফলিত হয়েছে মর্যাদায় ও শিল্পিত অনুষঙ্গে। বাংলাদেশের চিত্রকলার অঙ্গনে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁর পরিভ্রমণ। এই পথপরিক্রমায় তিনি নানাধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমের কাজে তাঁর ক্রম-উত্তরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর কাজের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যাঁরা পরিচিত তাঁরা বোধকরি জানেন, রফিকুন নবী ছাত্রাবস্থা থেকেই এদেশের চিত্রকলা-অঙ্গনে কেমন করে নিজের আসনকে স্পষ্ট ও বলীয়ান করার জন্য নিরন্তর কাজ করেছেন এবং সৃষ্টির উদ্দামতায় পৌঁছবার একটি পথ তৈরি করেছেন। শিল্পের অন্বিষ্ট ভুবনে আমরা লক্ষ করেছি বাস্তবরীতির কাজ, জীবন ও জীবনের নানাদিককে তিনি কতভাবেই না তাঁর পটে প্রতিফলিত করেছেন।
ষাটের দশকে তাঁর জলরঙে করা চিত্রে সমুদ্রসৈকত, হিমছড়িভিত্তিক ভূদৃশ্য, বৃষ্টিবিধৌত সমুদ্র, কুয়াশা-ঢাকা দিগন্ত, দূরে নৌকার ইঙ্গিতময় উপস্থিতি, জলের অবিরাম আছড়ে পড়া শিল্পানুরাগীদের হৃদয়মনে গেঁথে আছে। সেই প্রদর্শনীর পর থেকে বাংলাদেশের চিত্রকলা-ভুবনে তাঁর বিচরণ ও উপস্থিতি ভিন্নভাবে চিহ্নিত হয়েছিল। তাঁর চিত্রসাধনার ভেতরমুখিন চাপ তাঁকে জলরঙের কাজে প্রেরণা জুগিয়েছে। ষাটের দশকে রফিকুন নবী জলরঙে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জলরঙে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছিলেন তিনি। ধোঁয়াশে পদ্ধতির মধ্যে বিষয়কে শিল্পগুণে উপস্থাপনের ফলে তাঁর জলরং ভিন্ন মর্যাদা আদায় করতে সমর্থ হয়েছিল। জলরঙে আশ্চর্য সিদ্ধি ও শিল্পদক্ষতার জন্য তিনি অগ্রগণ্য জলরং-শিল্পী হিসেবেও খ্যাত।
অন্যদিকে ষাটের দশকে বাংলাদেশের স্বরূপ-অন্বেষার আন্দোলনের সময় থেকে তাঁর সামাজিক অঙ্গীকারের চেতনা প্রখর হয়েছে। সেজন্যই তাঁর শিল্পে জনজীবন এবং দেশ-আত্মার মর্মবেদনার রূপও দক্ষতার সঙ্গে পরিস্ফুট। তারই ছাপ পড়ছিল বিচ্ছিন্নভাবে নানা সৃজনে। অঙ্গীকার ও দেশচেতনা তিনি শিল্পাদর্শে ধারণ করেন বলে বিচ্ছিন্নভাবে নানা সৃজনে তারই ছাপ পড়েছিল।
সত্তরের দশকের প্রথমদিকে তিনি গ্রিসের এথেন্সে স্কুল অফ আর্টস থেকে ছাপচিত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ-সময়ে তাঁর মানসভুবন অধিকতর সমৃদ্ধ হয়েছিল কাঠখোদাইয়ে শিক্ষা নিতে গিয়ে।
শিক্ষক হিসেবে এ-সময়ে তাঁর বিদ্যায়তনে গ্রিসের বিশিষ্ট এক খোদাই চিত্রকরকে পান। তাঁর বৃহৎ আকারের কাঠখোদাই তাঁকে মোহিত করে। বিষয় ও শৈলীকে আয়ত্ত করার পারদর্শিতায় তিনি ভাবিত হন এবং অভিনিবেশসহকারে কাঠখোদাই শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন।
বাংলাদেশের কাঠখোদাই গতানুগতিক রীতির মধ্যে আবদ্ধ ছিল। ত্রিশের ও চল্লিশের কাঠখোদাইয়ের ধারা, আবহ ও শিক্ষাপদ্ধতি থেকে বেরোতে পারেননি এই মাধ্যমের শিল্পীরা। রফিকুন নবী গ্রিস থেকে ফিরে আহরিত জ্ঞান-শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে এই মাধ্যমকে উচ্চস্তরে নিয়ে যান। রং ও বিষয়ে সঞ্চার করেন নতুন মাত্রা। বৃহৎ পরিসরে কিছু কাজ করেন। কাঠখোদাইয়ের দিগন্ত হয়ে ওঠে বিস্তৃত। এভাবেই দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে এদেশের চিত্রকলার ভুবনে নবব্যঞ্জনা আনয়ন করেন তিনি।