সাইফুল ফারদিন
এক
বিশ্বের প্রভাবশালী ও মার্জিত ফিল্মমেকারদের মধ্যে সুইডিশ ফিল্মমেকার ইংমার বার্গম্যান অন্যতম। বার্গম্যান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন একাধারে চলচ্চিত্র, থিয়েটার ও টেলিভিশন মাধ্যমে। বার্গম্যান বিখ্যাত তাঁর বহুমুখী ক্যামেরাওয়ার্কের জন্য, খন্ডিত ন্যারেটিভ স্টাইল এবং সূক্ষ্মভাবে মানুষের একাকিত্ব, দুর্বলতা, যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলার জন্য।
বার্গম্যান বেড়ে ওঠেন ধর্মীয় গোঁড়া এক লুথার্ন ফ্যামিলির মধ্যে। যার প্রভাব তাঁর কাজের মধ্যে স্পষ্টতই দেখা যায়। ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের কর্মক্ষেত্রের সম্পর্ক খুঁজে ফিরতে দেখা যায় তাঁর চরিত্রগুলোর মধ্যে। তাঁর চরিত্রগুলোকে কখনোই অতিরিক্ত ধার্মিক দেখা যায় না, তাদের সর্বদাই পরোক্ষভাবে নৈতিকতার আদর্শ নির্ধারণ খুঁজে ফিরতে দেখা যায়। কঠোরভাবে তারা কর্ম ও উদ্দেশ্য পরীক্ষা করে, তারা কোনটা ভালো কোনটা খারাপ কিংবা ঠিক ভুল ইত্যাদির সঠিকতা নিরূপণ করতে ব্যস্ত থাকে। এছাড়া ধর্মীয় আর্ট রিলেটেড ব্যাপারগুলোর প্রভাব তাঁর কাজের মধ্যে পাওয়া যায়। বাইবেলের গল্পের গ্রাফিক উপস্থাপনযোগ্য বিষয় কিংবা চার্চের ভিস্যুয়াল ব্যাপারগুলো তাঁকে আকর্ষণ করত।
বার্গম্যান স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে আর্ট, ইতিহাস ও সাহিত্য বিষয়ে ভর্তি হন ১৯৩৭ সালে। এখানে তিনি ভার্সিটির থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাটক লেখা, অভিনয় ও স্টুডেন্ট প্রডাকশন নির্দেশনা দিতে শুরু করেন। মাস্টার অলফসগার্ডেন থিয়েটার ও সাগাস থিয়েটারে ট্রেইনি নির্দেশক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিনের মাথায়ই হেলসিংবর্গ থিয়েটার থেকে ফুলটাইম ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব পান। এখানেই তিনি সভেন্সক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রধান কার্ল-এনদার্স ডায়ামলিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান এবং তাঁর হাত ধরেই বার্গম্যানের চিত্রনাট্যে তখনকার সময়ের সুইডেনের খ্যাতিমান পরিচালক আলফ সজবার্গ সিনেমা নির্মাণ করেন। এই সিনেমা দেশে এবং দেশের বাইরে ভালো সাড়া ফেলার কারণে বার্গম্যান এর পরের বছরই ১৯৪৫ সালে নিজের লেখা চিত্রনাট্যে সিনেমা পরিচালনার সুযোগ পান। কিন্তু প্রথমদিককার কয়েকটি সিনেমায় বার্গম্যান খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেননি। তখন তাঁর সিনেমার অবস্থা সুইডিশ ফিল্মমেকিংয়ের মতোই জীর্ণপ্রায়। ১৯৫২ সালে সিক্রেট অব উইমেন এবং সামার উইদ মনিকা সিনেমা দিয়ে আলোচনায় আসেন বার্গম্যান। এই দুটি সিনেমাকে বার্গম্যানের প্রথম পরিপক্ব কাজ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৫৫ সালে স্মাইল অব এ সামার নাইট সিনেমার মাধ্যমে বার্গম্যান প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সফলতা পান। এরপর ১৯৫৭ সালে দ্য সেভেন্থ সিল ও ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিমান হয়ে যান। মধ্যযুগীয় সমাজে খ্রিষ্ট ধর্মে রূপান্তরের ওপর ১৯৫৯ সালে নির্মাণ করেন দ্য ভার্জিন স্প্রিং। এই সিনেমা বিদেশি ভাষার সিনেমা ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে নেয়। ষাটের দশকে বার্গম্যান দুটি ট্রিলজি নির্মাণ করেন। প্রথম ট্রিলজি হলো – থ্রু এ গ্লস ডার্কলি, উইন্টার লাইট ও দ্য সাইলেন্স। দ্বিতীয় ট্রিলজি হলো – পারসোনা, আওয়ার অব দ্য উলফ ও শেইম। শক্তি এবং শক্তি প্রয়োগের বিখ্যাত দৃশ্যসহ ১৯৬৬ সালে বার্গম্যান নির্মাণ করেন পারসোনা।
এর বাইরে বার্গম্যানের বিখ্যাত সিনেমাগুলো হলো – অটাম সোনাটা, ফানি এবং আলেক্সান্দার, দ্য ম্যাজিশিয়ান, অল দিস উইমেন, দ্য টাচ ইত্যাদি। বার্গম্যানের বেশিরভাগ সিনেমা নিয়েই দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের আলোচনা বার্গম্যানের সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমা দ্য সেভেন্থ সিল নিয়ে।
দুই
দ্য সেভেন্থ সিল নিঃসন্দেহে বার্গম্যানের তো বটেই, বিশ্বের সেরা সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম। চোদ্দ শতকের ত্রাস ব্ল্যাক ডেথের সমকালীন সময়ের ওপর নির্মিত ধর্মগ্রন্থগুলোকে ছুঁয়ে যাওয়া এ সিনেমার অন্যতম সফল দিকদর্শন ও সিনেমার মেলবন্ধন। এ সিনেমায় আমরা দেখি ধর্ম দর্শন, শয়তান ও অস্তিত্ববাদ নিয়ে প্রশ্ন এবং উত্তর খুঁজে ফেরার প্রচেষ্টা।
বার্গম্যান ১৯৫৩-৫৪ সালের দিকে উড পেইন্টিং নামে একটা নাটক লেখেন এবং ১৯৫৪ সালে এটার নির্দেশনাও দেন। পরবর্তীকালে এ নাটকটিকেই তিনি সিনেমায় রূপ দেন দ্য সেভেন্থ সিল নামে।
এই ছবির মাধ্যমেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত সিনেমামেকারদের সারিতে নাম লেখান। সেই ১৯৫৭ সালে যেমন মেধাবী প্রজ্ঞাবান ও বিচারশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা এ সিনেমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন তেমনি আজো। এ সিনেমা সেই একই শ্রেণির দর্শকদের আন্দোলিত করে, নতুন করে ভাবায়। এ সিনেমা নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, দীর্ঘ আলোচনার খোরাকই নয়, এর মাঝে আছে মানবজাতির সবলতা ও দুর্বলতার নির্দয় ও সঙ্গে সঙ্গে মনোহর পরীক্ষা।
তিন
সুইডিশ ধর্মযোদ্ধা আন্তনিয়াস ব্ল্যাকক ক্রুসেডস থেকে ফিরে আসছে নিজ দেশে বর্মবাহক জনকে সঙ্গী করে। সমুদ্রপারে ক্যাম্প করে রাত্রিযাপন শেষে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই ব্ল্যাক লক্ষ করে কেউ একজন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। ব্ল্যাক জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, সে মৃত্যু এবং সে জানায় ব্ল্যাকের সময় শেষ হয়ে এসেছে। ব্ল্যাক মানতে চায় না, একপর্যায়ে ব্ল্যাক মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে বসে তাঁর সঙ্গে দাবা খেলে তাঁকে হারিয়ে তারপর তার কাজ সমাধা করার জন্য। শর্ত হচ্ছে, যদি মৃত্যু তার সঙ্গে হেরে যায় তবে তাঁকে মুক্ত করে দিতে হবে। মৃত্যু শর্ত মেনে নিয়ে দাবা খেলতে বসে পড়ে।
জফ ও মিয়া এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা ঘুরে ঘুরে নাচ-গান করে বেড়ায়। তাদের অন্য সঙ্গী দলের পরিচালক স্কেট। স্কেট, জফ-মিয়া ও তাদের এক বছর বয়সী ছেলে মাইকেল এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে তাদের পরিবহনকারী ঘোড়ার গাড়িটিতে। জফ ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দূর থেকে দেখতে পায় এক মহিলা তার বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে এবং তার মনে হয় এ মহিলাটি আর কেউ নয়, এ স্বয়ং কুমারী মেরি। সে তাৎক্ষণিক গিয়ে মিয়াকে ঘুম থেকে তোলে এবং বলে সে কুমারী মেরিকে ছেলেকে সঙ্গে করে হেঁটে যেতে দেখেছে। মিয়া তার কথা বিশ্বাস না করে বরং গান শুনতে চাইলে জফ গান ধরে।
ব্ল্যাক ও জন যাওয়ার পথে চার্চের পাশে থামে, জন ভেতরে গিয়ে দেখে একজন পেইন্টার দেয়ালে ব্ল্যাক ডেথ নিয়ে ছবি আঁকছে, পেইন্টারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা জুড়ে দেয় জন। চার্চের বাইরের অংশে ব্ল্যাক সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ করতে করতে একসময় আবিষ্কার করে, সে আসলে মৃত্যুর সঙ্গে কথা বলছে। ব্ল্যাক মৃত্যুর কাছে তার ভেতরের কথাগুলো স্বীকার করে ফেলে। চার্চের বাইরে এসে ব্ল্যাক দেখে এক যুবতী মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে। কথা বলার চেষ্টা করে সে, কিন্তু মেয়েটি অচেতন। চারপাশে মানুষজনের হইচই, সবাই বলছে এই মেয়ে সাক্ষাৎ ডাইনি, এর সঙ্গে শয়তানের সরাসরি যোগাযোগ আছে।
পথে পানির জন্য নেমে জন পথের ধারে এক বাড়িতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার পূর্বপরিচিত এক সেমিনারি ছাত্র ‘রাভাল’কে, যে মৃত এক মহিলার শরীর থেকে চুড়ি, আংটি চুরি করতে গিয়ে এক মেয়ের কাছে ধরা খেয়ে তাকে ধমকায়, এমনকি তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। জন মেয়েটিকে উদ্ধার করে তার সঙ্গে নিয়ে আসে।
শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অস্থায়ী স্টেজ করে জফ, মিয়া ও স্কেট পারফর্ম করছে। সামনে অনেক দর্শক উপভোগ করছে। দর্শক সারিতে অন্য অনেকের মাঝে আছে গ্রামেরই মধ্যবয়স্ক লোক ব্ল্যাককস্মিথ প্ল্যাগ ও তার রূপবতী স্ত্রী লিসা। আরো আছে ব্ল্যাক ও জন। লিসা স্কেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। স্কেটও লিসাকে দেখে বিমোহিত হয়ে যায়। স্কেট স্টেজের পেছনে গেলে লিসাও তাকে ফলো করে স্টেজের পেছনে থাকা বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে স্কেটকে ডাক দেয় তার কাছে যাওয়ার জন্য। স্কেট উপেক্ষা করতে পারে না লিসার মতো রূপবতী মেয়ের ডাক। তারা দুজন বনের ভেতরে ঢুকে যায়। জফ ও মিয়া পারফর্ম করেই যাচ্ছে। এমন সময় বড় এক ধর্মীয় শোভাযাত্রা এদিকে আসতে থাকে। শোভাযাত্রার মধ্যে কেউ একজন বিরাট এক ক্রস বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বেত্রাঘাত করছে নিজেরা নিজেদের। অনেক মানুষের উপস্থিতি দেখে কিছুক্ষণের জন্য থামে দলটি। ধর্মযাজক বক্তৃতা দিতে শুরু করেন সবার উদ্দেশে। বক্তৃতা শেষে দলটি আবার আগের মতো হাঁটতে শুরু করে। ব্ল্যাক ও জন এ দলটি সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মেতে ওঠে। জন যারপরনাই এই দলটির ওপর বিরক্ত, এমনকি দলটিকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতেও ছাড়ল না। একটু পরে স্মিথ এসে জনের কাছে জানতে চাইল তার স্ত্রীকে সে দেখেছে কি না। জন না বললে সে লিসাকে পাবের দিকে খুঁজতে চলে যায়।
জফ স্থানীয় পাবে বসে আছে। সেই সেমিনারি ছাত্র রাভাল তার হাতে থাকা সিলভারের চুড়িটি জফকে কেনার জন্য বললে জফ জানায়, তার কাছে এটা কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এমন সময় রাভাল জফের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, গায়ে হাত দেয়, জফকে বাধ্য করে বিকৃত ভঙ্গিতে নাচতে। তা দেখে পাবের অন্য সকলে মজা লোটে। পরে জন এসে জফকে উদ্ধার করে রাভালের হাত থেকে।
ব্ল্যাক ও মিয়া বসে গল্প করছে, মাইকেল তাদের সঙ্গে বসে। কিছুক্ষণ পর জফ আসে আহতাবস্থায়। মিয়া স্বামীর সেবা করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর স্বামীকে ব্ল্যাকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। জফ ও ব্ল্যাক প্লেগ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে থাকে। ব্ল্যাক জফকে জানায় পাশের একটা এলাকার কথা, যেখানে নাকি প্লেগ থেকে বাঁচার সম্ভাবনা খানিকটা বেশি। তারা সেখানে যাবে বলে মনস্থির করে। দুজনকে ভেতর থেকে বন্য স্ট্রবেরি ও দুধ এনে দেয় মিয়া। জফ একধরনের তারের বাজনা বাজায় আর ব্ল্যাক তার স্ত্রীর কথা বলতে থাকে। ব্ল্যাককে অনেকটা সুস্থির দেখায়।
জফ ও মিয়া প্রস্ত্ততি নিচ্ছে অন্যত্র যাওয়ার জন্য। ব্ল্যাক, জনও তাদের সঙ্গে যাচ্ছে। জনের সঙ্গে স্মিথ। সে তার হারানো স্ত্রীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চাঁদনী রাত। একদল মানুষ একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। স্মিথ লক্ষ করে, বিপরীত দিক থেকে একজোড়া মানব-মানবী হাতে হাত ধরে হেলেদুলে হেঁটে আসছে। মানবীটাই স্মিথের হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী লিসা, সঙ্গের মানবটি স্কেট। স্কেট স্মিথকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। লিসা স্মিথ ও স্কেটের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু লাভ হয় না। একপর্যায়ে স্কেট নিজের বুকে ছুরি মেরে সুইসাইড করার ভান করে মাটিতে পড়ে গেলে স্মিথ শান্ত হয়। কিছুক্ষণ পর স্কেট উঠে নিজেকে নিজে বাহবা দেয় এমন নিখুঁত খেল খেলার জন্য। স্কেট লাফ দিয়ে গাছে উঠে সেখানে ঘুমানোর আয়োজন করে। একটু পরে করাতের আওয়াজ শুনতে পেলে নিচে তাকিয়ে দেখে মৃত্যু তার গাছ কাটছে। স্কেটের পরিবার কীভাবে তার ওপর নির্ভরশীল, সে মারা গেলে তাদের কী হবে, এটা-সেটা বোঝানোর পরও লাভ হয় না।
বিরাটকায় চতুর্ভুজাকৃতির কাঠের ফ্রেমের মাঝখানে ঝুলিয়ে একটা মেয়েকে এনে রাখে একটি দল। ব্ল্যাক ও জন চার্চের সামনে যে মেয়েটিকে দেখে এ সেই মেয়ে। মেয়েটিকে পোড়ানোর আয়োজন করা হয়। ব্ল্যাক মেয়েটির কাছে এটা-সেটা জানতে চেয়ে নির্দিষ্ট কোনো উত্তর পায় না, দেখতে পায় শুধু ভয়ার্ত এক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের মুখ।
বনের মধ্যে ব্ল্যাক বসে বসে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্য খেলা পুনরারম্ভ করবে বলে। পাশেই জফ আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে। সেমিনারি ছাত্র রাভাল প্লেগ আক্রান্ত হয়ে এদের কাছে এসে পানি চাইলে কেউ তাকে পানি দিয়ে সাহায্য করে না। সে সবার সামনেই ঘুরপাক খেয়ে পড়ে মারা যায়।
মধ্যরাত। ব্ল্যাক মৃত্যুর সঙ্গে বসে দাবা খেলছে। জফ ও মিয়া ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ জফ উঠে দেখে ব্ল্যাক কারো সঙ্গে বসে দাবা খেলছে। জফ বুঝতে পারে ব্ল্যাকমৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলছে, ভয় পায় জফ। মিয়াকে ঘুম থেকে তুলে লুকিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
অবশেষে ব্ল্যাক নিজ বাড়ি এসে পৌঁছায়, যেখানে তার বউ তার জন্য অপেক্ষা করে আছে দশ বছর ধরে। সঙ্গে থাকা সঙ্গীদের বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। সবাই বসে টেবিলে যখন ব্রেকফাস্ট করছিল ঠিক তখনই বুঝতে পারে কেউ একজন এসেছে। জনের সঙ্গে থাকা মেয়েটি তাকে অভিবাদন জানায়। মেয়েটির পেছন পেছন সবাই এসে দাঁড়ায় এবং সবাই সবার পরিচয় দেয়। ব্ল্যাক সবার পেছনে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নিজমনে প্রার্থনা করতে থাকে ঈশ্বরের কাছে। জনের সঙ্গে থাকা মেয়েটি হাঁটু গেড়ে বসে বলে ওঠে, ‘খেল খতম’।
রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। জফ ঘুম থেকে ওঠে। পাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় মৃত্যু টেনে ওপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে নাচার জন্য তালে তালে ব্ল্যাক, জন, স্কেট, রাভাল, স্মিথ ও লিসা সবাইকে। জফ মিয়াকে ডেকে দেখায় কিন্তু মিয়া কিছুই দেখতে পায় না।
চার
বার্গম্যান প্রথম তিনটি শটের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দেন সিনেমার আবহ। গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি কনফ্লিক্ট, ব্ল্যাক ও মৃত্যুর সঙ্গে, ঈশ্বর ও জীবনের সঙ্গে। কনফ্লিক্টের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে চরিত্র ইস্টাবলিশ করেছেন বার্গম্যান। মোটাদাগে সিনেমার দুটো দিক দেখতে পাই আমরা। এক. মৃত্যু, মৃত্যুর ভয়, শয়তানকে নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ততা। দুই. পবিত্র সুখী এক পরিবারকে দেখি। এই সিনেমায় আমরা জার্নি করি মূলত ব্ল্যাকের হাত ধরে। পাশাপাশি হ্যাপি ফ্যামিলির মাধ্যমে আমরা পাই ভরসা, ভবিষ্যতের আশা।
ব্ল্যাক তার মৃত্যুর সময় বাড়াতে চায়, চায় আরেকটু সময় বেশি বাঁচতে, খুঁজে পেতে চায় জীবনের মানে, ঈশ্বরের মানে। ব্ল্যাক যখন বুঝতে পারে সে প্রায় হেরে গেছে তখন সে হয়তো ইচ্ছে করেই দাবার ঘুঁটি ফেলে দেয়, নতুন করে শুরু করবে বলে, আরেকটু সময় বাঁচবে বলে। মৃত্যুকে সে অস্বীকার করে না। ব্ল্যাক ও মৃত্যু যখন দাবা খেলতে বসে, টসে মৃত্যু পায় কালো ঘুঁটি। এটা মৃত্যুর আত্মপ্রতীক। ব্ল্যাক পায় সাদা ঘুঁটি, ব্ল্যাক খুঁজে বেড়ায় সত্য ও সুন্দর। পুরো সিনেমাজুড়ে আমরা ব্ল্যাকের উদ্বেগ ও ঈশ্বরকে কিংবা সত্যকে অন্বেষণ করে বেড়াতে দেখি, বিশেষ করে যখন ব্ল্যাক চার্চের মধ্যে মৃত্যুর কাছে তার অজ্ঞাত অনবহিত ব্যাপারগুলো স্বীকার করে বসে। ভয়ে ব্ল্যাককে বেদনামথিত দেখা যায়, ব্ল্যাকএভাবে ভোগার কোনো কারণ খুঁজে পায় না এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তার মধ্যে দ্বিধা জাগে। সে একান্তভাবেই চায় ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস বলবৎ রাখতে কিন্তু দ্বিধা এসে যায়, দ্বিধা থেকে যায়। তার মনে হয় যদি সত্যিই ঈশ্বর বলে কেউ না থাকে তাহলে এই জীবন, এই দোলাচলে ভুগতে থাকা, এতদিন ধরে করে আসা ঈশ্বরপূজা সবই অর্থহীন। আর যদি ঈশ্বর আমাদের কাছে, আমাদের মনে শুধুই আইডল হয়ে থাকেন তাহলে তো এটা আমাদের দুর্বলতা কিংবা ভয় থেকে নির্মিত ছাড়া কিছুই নয়। সে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছে কারণ তার কোনো ধারণা নেই মৃত্যু-পরবর্তী বাস্তবতা সম্পর্কে।
চোদ্দ শতক হিসেবে তখনকার সময়ে ব্ল্যাক চরিত্র নিশ্চয়ই আধুনিক চরিত্র। সে তার পাপের নিস্তারের বিষয়ে চিন্তিত নয়, পরকালের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার জন্যও উঠেপড়ে লাগে না; বরং জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত। ব্ল্যাক শেষ অবধি সুখময় কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, যাতে সে তা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
বার্গম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তিনি ব্ল্যাকের তুলনায় জনের প্রতি দর্শকদের বেশি সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন কিংবা করতে চেয়েছেন। অনেকটা তাই, সিনেমার সবচেয়ে পজিটিভ চরিত্র যে জন এটা স্পষ্ট এবং এটাতে কারো দ্বিমত হওয়ার কথা নয় সম্ভবত। জন সন্দেহপ্রবণ অবিশ্বাসী, যে মনে করে জীবন সত্যিকার অর্থেই অর্থহীন। যদিও সে একদমই মৃত্যুকে ভয় পায় না এমন নয়, তার কাছে মৃত্যু হলো শুধুই শয়তান এবং তাই যদি হয় তাহলে এটা খুবই ছোট একটা ব্যাপার যে এতে ভয় পাওয়ার মতো কিছু আছে বলে জন মনে করে না, তাই পাত্তাও দেয় না। আমরা দেখি চার্চের মধ্যে ড্রিংকস করতে করতে জন পেইন্টারকে ক্রুসেড সম্পর্কে বলে এবং এটাও বলে যে এখানে ভর্তি হওয়াসহ সমস্ত প্রক্রিয়াটাই নির্বোধ কাজ ছাড়া কিছুই নয়।
জফ, মিয়া ও মাইকেলকে মানে ফ্যামিলি অভিনেতা দলকে উপস্থাপিত করা হয় সোজাসুজিভাবে, রূপকের আড়ালে কিন্তু উজ্জ্বলতার সঙ্গে। তারা প্রতিনিধি হয়ে আসে পবিত্র, সুখী পরিবারের এবং প্রতিশ্রুতি দেয় সুন্দর আগামীর। তারা হয়ে ওঠেন মানবজাতির সাধারণ সাধুচরিত্রের প্রতীক। তাদের সঙ্গে থাকা অন্য সদস্য দলের পরিচালক স্কেটের সবসময় পরিকল্পনা থাকে কীভাবে নারীদের প্রলুব্ধ করা যায়। মৃত্যু গাছের নিচে কেটে দিলে গাছসহ সে যখন পড়ে মারা যায় তখন পতিত গাছের ওপর একটা কাঠবিড়ালি দেখা যায়, এটা নর্ডিক মিথের আত্মার প্রতীককে চিত্রিত করে। স্কেটের চরিত্রকে আমরা আরেকটু গভীরভাবে যদি দেখি তাহলে দেখা যায় এই চরিত্রটি এমনই এক চরিত্র যে জীবন ও জগতের মানে খুঁজতে চায় না বরং যতদিন বেঁচে আছে ততদিন আনন্দ উপভোগ করে কাটিয়ে দেওয়াতেই বেশি আগ্রহী।
মৃত্যু, মৃত্যুই। এই চরিত্র শূন্যতা কিংবা অর্থহীন কিছুকে চিত্রিত করে। ব্ল্যাক মৃত্যুর সঙ্গে ফাইট করে জীবনের অর্থ খুঁজে বের করার জন্য। মৃত্যু প্রান্তিকভাবে ঈশ্বর সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাকে যখন চার্চের মধ্যে ব্ল্যাক জিজ্ঞাসা করে ঈশ্বর বলে কিছু আছে কি? তখন সে জবাব দেয়, ‘সম্ভবত আসলে কেউই নেই’। মৃত্যুর এই কথা দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় মৃত্যুর চরিত্র। মৃত্যু ঈশ্বর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, ঈশ্বরের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই এবং সে নিজেও দ্বিধান্বিত ঈশ্বর আছে কি নেই।
রাভাল চরিত্রটি জফ-মিয়া চরিত্রের ঠিক উল্টো। সে চুরি করে বেড়ায়, মানুষের সঙ্গে ইচ্ছে করে ঝামেলা করে ভোগান্তিতে ফেলে। সিনেমার সবচেয়ে নেতিবাচক চরিত্র সম্ভবত রাভালই।
পাঁচ
ব্ল্যাক ও জন যখন চার্চে যায় তখন চার্চের ভেতরে এক পেইন্টারকে দেখা যায়, যে দেয়ালে পেইন্টিং করছে। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার যে তার সব পেইন্টিংয়ের বিষয় মৃত্যু। এর কারণ যে ভয় দেখানো এটা তার কথার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়। সে বলে, মৃত্যু-পরবর্তী কী হবে তা নিয়ে মানুষ ভাবুক, ধর্মগ্রন্থের প্রতি উৎসাহী হোক, ঈশ্বরের কৃপালাভের চেষ্টা করুক। এই পৃথিবীময় প্লেগের ছড়াছড়ি সব তো এই অধম মানবজাতির কারণেই। সবাইও আসলে তাই মনে করে যে প্লেগ ঈশ্বর পাপের শাস্তিস্বরূপ পাঠিয়েছেন। এটা নিয়ে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত (যেভাবে এইডসকে মনে করা হয় সমকাম ও বিকৃত যৌনাচারের কারণে শাস্তি হিসেবে পাঠানো হয়েছে)। তাই দেখা যায় নিজেদের পাপের পরিমাণ কমাতে নিজেরাই নিজেদের বিক্ষত করতে করতে এগিয়ে যায়।
বেশিরভাগ দর্শকই হয়তো এ সিনেমায় মধ্যে কিছু খুঁজে পায় না, তারা এটাকে ট্র্যাজিক সিনেমাই মনে করে। মনে করারও কথা, যেখানে মৃত্যু এসে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু তারপরও এই সিনেমায় হাস্যরসাত্মক অনেক কিছুই আছে। সম্ভবত এটাই সবচেয়ে হাস্যরসাত্মক দৃশ্য, যখন স্মিথ বনের মধ্যে তার স্ত্রীকে স্কেটের সঙ্গে হেলেদুলে হাঁটারত অবস্থায় আবিষ্কার করে এবং স্কেটকে ধরার জন্য তার পিছে পিছে ছুটতে থাকে। বিদ্রূপ ও পরিহাসের জন্য পাবের দৃশ্যটি ছিল পুরো ফিল্মের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। দৃশ্যটি শুরু হয় এভাবে – সবাই প্লেগভীতি নিয়ে, ঈশ্বরভীতি নিয়ে, শাস্তিস্বরূপ ঈশ্বর এমন আজাব পাঠিয়েছেন এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে, তারা এটা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু রাভাল যখন ইচ্ছে করে জফের সঙ্গে ঝামেলা করছে এবং তাকে জোর করে বিকৃত ভঙ্গিতে নাচাচ্ছে তখন পাবের অন্য সবাই রাভালের পক্ষ হয়ে জফকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠছে। তারা এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল তাদের পাপের শাস্তির কথা ভেবে, অথচ কয়েক মিনিটের মাথায় তারা আবার সেই পাপ করা শুরু করে দিলো।
ছয়
জীবনের আত্মিক মানে কী? সত্যিই কোনো ঈশ্বর আছে কি? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমরা ঈশ্বরের কী রূপ আবিষ্কার করি? ঈশ্বরকে কী দিতে দেখি আমাদের? মৃত্যু, অপরাধবোধ, যৌনকর্মের জন্য শাস্তি। আর কিছু?
ব্ল্যাক কি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করার মতো কিছু খুঁজে পেয়েছিল? কিংবা জীবনের অর্থই বা কিছু? অথবা আমরা কি সিনেমার শেষে পরিষ্কার কোনো বার্তা পাই ডায়ালেক্টিক্যালি ব্ল্যাক ও জনের মধ্যে? না, অবশ্যই না। শেষ পর্যন্ত অস্পষ্টই থেকে যায়।
তথ্যসূত্র :
১. www.wikipedia.org
২. www.ingmarbergman.se
৩. www.decentfilms.com
৪. www.philfilms.utm.edu
৫. www.artsandfaith.com