ই ম তি য়া র শা মী ম
জোসেফ বারতোলুচ্চি মারা গেছেন।
বছর দুয়েক হলো শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা স্থবির করে ফেলেছিল তাঁকে। অবশ্য এ-অসুখে আক্রান্ত হওয়ার অনেক আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন সালেনতোতে, একটি বাড়ি কিনেছিলেন ডিসোর কেন্দ্রস্থলে এবং থাকতেন সেখানেই। শ্বাসকষ্ট তীব্র হয়ে উঠলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের একটি হাসপাতালে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। এভাবে খুব অল্প বয়সেই চলে যেতে হলো আমাদের প্রিয় পরিচালক জোসেফ বারতোলুচ্চিকে, যিনি কেবল ইতালিতে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর পরিচালনার শক্তিমত্তার গুণে। একবিংশ শতাব্দীতে পঁয়ষট্টি বছর বয়সের মৃত্যুকে অকালমৃত্যু ছাড়া কীই-বা বলা যেতে পারে!
ওদিপাস থেকে ওথেলো – জোসেফ বারতোলুচ্চির প্রিয় ছিল এরকম সব ক্লাসিক্স। আবার নিবিড় ঘনিষ্ঠ সখ্য ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। পরিচালনার অমিত শক্তিমত্তা তাঁকে খুব অল্প সময়েই পরিচিত করে তুলেছিল সারা পৃথিবীতে। সত্যি কথা বলতে গেলে, ব্যক্তি জোসেফ বারতোলুচ্চি সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা – তাঁর চলচ্চিত্রের দর্শকরা, যত না জানি তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো সম্পর্কে। জোসেফ বারতোলুচ্চি অনালোচিত থাকার একটি কারণ সম্ভবত এই যে, বিশ্বচলচ্চিত্রে তাঁর ভাই বার্নার্ড বারতোলুচ্চির প্রভাব। কিন্তু দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল জোসেফের, ভাইয়ের হাত ধরে চলচ্চিত্রে এলেও অভিজ্ঞতা নিংড়ে তিনি নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলার উপযোগী করে তুলেছিলেন। জোসেফ-বার্নার্ডের বাবা আতিলো সারা বিশ্বে কবি হিসেবে তেমন পরিচিত না হলেও ইতালিতে বেশ পরিচিত। আতিলোর বন্ধুর তত্ত্বাবধানে চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি হয় বার্নার্ড বারতোলুচ্চির। আর বড় ভাই বার্নার্ডের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জোসেফ চলচ্চিত্রে পা ফেলেন ১৯৭০-এ। ততদিনে বার্নার্ড চলচ্চিত্রে নিজের একটি জগৎ গড়ে তুলেছেন এবং ওই সময় তিনি নির্মাণ করছিলেন দ্য স্পাইডার’স্ট্রাটাজেম।
জোসেফ বারতোলুচ্চি জন্ম নিয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে তখন, ইউরোপ বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী বৃত্তে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটেছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের নতুন কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইতালির চলচ্চিত্র অঙ্গনে বিকশিত নিওরিয়ালিজমের ধারা তখন ক্রমশই পুষ্ট হচ্ছে এবং প্রভাবিত করতে শুরু করেছে বিশ্বের চলচ্চিত্রনির্মাতাদের। জোসেফ বারতোলুচ্চির শৈশব ও কৈশোরকাল ছিল এই নিওরিয়ালিজমের কাল। জনপ্রিয় সংস্কৃতির নজরদারি করার জন্য ১৯৩০-এর দশকে ইতালির ফ্যাসিবাদীরা একটি রিভিউ বোর্ড গঠন করেছিল এবং শুধুমাত্র সিনেমা নির্মাণের লক্ষ্য থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব ইতালিতে গড়ে তুলেছিল বড় এক শহর সিনেসিট্টা। রেবার্তো রোসেলিনি, ফেদেরিকো ফেলিনি এবং মিকেলাঞ্জেলো অ্যান্টোনিওর মতো বড় বড় পরিচালকও তাঁদের সিনেমার কাজ করেছেন এখানে। অবশ্য ইতালির সিনেমা পথ চলতে শুরু করেছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। গতানুগতিকভাবে এর যাত্রা শুরু হলেও খুব তাড়াতাড়িই ইতালির চলচ্চিত্র নতুন নিরীক্ষণের জগৎ খুঁজে পায় তখনকার ফিউচারিজম আন্দোলনের ফলে। চিত্রকলা ও সাহিত্য থেকে এর সূত্রপাত ঘটলেও খুব তাড়াতাড়িই তা প্রভাব ফেলে সংস্কৃতিচর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে। ১৯১৬ সালে ইতালিতে প্রকাশিত হয় ম্যানিফেস্টো অব ফিউচারিস্টিক সিনেমাটোগ্রাফি – যাতে যুক্ত স্বাক্ষর করেন ফিলিপ্পো মারিনেত্তি, আরমান্দো গিনা, ব্রুনো কোরা, গিয়াকোমো বালা প্রমুখ। ফিউচারিস্টদের আরাধ্য ছিল যন্ত্র এবং গতি। মারিনেত্তি ঘোষণা দিয়েছিলেন, একটি তথাকথিত সুন্দর ভাস্কর্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুন্দর একটি বিদ্যুৎগতির মোটর। যন্ত্রসভ্যতার যন্ত্রশক্তি নন্দনতত্ত্বের ওপর যে-প্রভাব ফেলেছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ফিউচারিজম বা ভবিষ্যবাদের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু ভবিষ্যবাদ বেশিদিন রাজত্ব করেনি, একইভাবে সিনেমাকে একটি আইডিয়াল আর্ট ফর্ম মনে করলেও ভবিষ্যবাদনির্ভর চলচ্চিত্র কোনো সুনির্দিষ্ট চলচ্চিত্রিক ধারা হয়ে উঠতে পারেনি। গতি, বিশেষ এফেক্ট ও সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যবাদী চলচ্চিত্রকার চেষ্টা করেছেন ইতালির চলচ্চিত্রের উত্তরণ ঘটানোর। ফিউচারিজমকে ভিত্তি করে ইতালিতে যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল, তার প্রায় সবই অবশ্য কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে – তবে ওই সময়ের বিভিন্ন সমালোচকের আলোচনা থেকে জানা যায়, অ্যান্তন গুইলিও ব্রাগাগলিয়া পরিচালিত ১৯১৭ সালের ভবিষ্যবাদী সিনেমা থাইস একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র – যা পরবর্তীকালে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট সিনেমা উত্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ফিউচারিস্টিক ফিল্ম মুভমেন্ট বা ভবিষ্যবাদী চলচ্চিত্র আন্দোলন ইতালিতে স্বল্পস্থায়ী হলেও এটি চলচ্চিত্রনির্মাতাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছিল নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা। মহাযুদ্ধের কারণে প্রচারণামূলক সিনেমা তৈরির হিড়িক পড়ে গেলেও নিরীক্ষার প্রবণতা যে মিইয়ে যায়নি, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ওই সময়ে নির্মিত লুসিনো ভিসকনটির অবসেশন সিনেমাটিতে – যা নিওরিয়ালিজমের ধারণাকে প্রথম উচ্চকিত করে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই এ-ধারায় নির্মিত হতে থাকে আরো অনেক সিনেমা। বিশেষ করে রেবার্তো রোসেলিনি এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন। একে একে তিনি নির্মাণ করেন রোম, ওপেন সিটি (১৯৪৫), পাইসা (১৯৪৬) এবং জার্মানি ইয়ার জিরো (১৯৪৮)। যুদ্ধমধ্যবর্তী ও পরবর্তী বিপর্যস্ত ইতালির অর্থনৈতিক ও নৈতিক পরিপ্রেক্ষিত আর জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এই নতুন বাস্তবতাবাদকে প্রাণিত করে। এমনকি ইতালির চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করে যুদ্ধপরবর্তী এ-অবস্থা। আর চলচ্চিত্র নির্মাণের নতুন প্রক্রিয়া সিনেমার কাহিনিকেও নতুন গাঁথুনি দিতে থাকে। কেননা, সিনেমা তৈরির জন্য ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির সময় গড়ে তোলা বিশাল সিনেসিট্টাকে তখন দখল করে নিয়েছিল উদ্বাস্তুরা। তাই সিনেমার শুটিং করতে হতো যুদ্ধে পরাজিত দেশটির বিধ্বস্ত রাস্তার পাশে, উন্মুক্ত স্থানে, এমনকি শুটিং করার উপযোগী নয় এমন অনেক স্থানেও। এসব কারণে সিনেমার শুটিংয়ের প্রক্রিয়া ব্যাহত হলেও সিনেমাকে ঘিরে নতুন নতুন চিন্তার উন্মেষের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি ভূমিকা রাখে। ভিট্টোরিও ডি সিকার-পরিচালিত এবং সিজার জাভাট্টিনির কাহিনিতে নির্মিত বিভিন্ন সিনেমা যেমন স্যুসাইন (১৯৪৬), দ্য বাইসাইকল থিফ (১৯৪৮) এবং মিরাকল ইন মিলান (১৯৫১) তখনকার ইতালির সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরে। বিশেষ করে ১৯৫২ সালে ডি সিকার নির্মিত উমবার্তো ডি নিওরিয়ালিজম ধারার সিনেমার চূড়ান্ত এক অভিব্যক্তি তুলে ধরে দর্শকদের সামনে। উমবার্তো ডি তখন থেকে এমনকি এখনো অনেক বিশ্লেষক ও দর্শকের কাছে ডি সিকার মাস্টারপিস এবং ইতালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রগুলোর অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচিত। অবশ্য উমবার্তো ডি কোনো ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি এবং এমনকি ইতালির টেলিভিশনগুলোতেও এটি প্রদর্শিত হয়েছে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র। এর কারণ সম্ভবত এই যে, যুদ্ধপরবর্তী ইতালির নতুন সামাজিক মূল্যবোধ, নতুন মনস্তত্ত্ব ও নতুন অর্থনীতিকে এ-সিনেমায় তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। প্রথানুগত এবং কর্তৃত্ববাদী ধারাটি তাই অলিখিত ও অঘোষিতভাবে বর্জন করে
এ-সিনেমাটিকে। রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল উভয় ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিই
এ-চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে সফলভাবে – যে-কারণে উভয় পক্ষই নীরবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এ-সিনেমা থেকে। শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে এক্সপ্রেশনিজম যেরকম নতুন এক জগৎ উন্মোচন করেছিল এবং আলোচিত হয়েছিল, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও নিওরিয়ালিজম ঠিক একইভাবে নতুন এক দুয়ার খুলে দিয়েছিল, প্রচণ্ড তর্কবিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
কিন্তু ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকেই গোটা ইউরোপের চলচ্চিত্রে নতুন এক আবেদন নিয়ে আসে ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ মুভমেন্ট। ফেদেরিকো ফেলিনির মতো গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকাররা নিওরিয়ালিজমের মধ্যে দিয়ে উঠে এলেও ঋদ্ধ হয়ে ওঠেন নিউ ওয়েভ মুভমেন্টের কারণে। ফেলিনিরা নিওরিয়ালিজম থেকে সরে এসেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়আশয় ও প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে দেখার ও বোঝার অবকাশ তৈরি করেছেন। কিন্তু নিওরিয়ালিজম শুধু ইতালিরই নয়, সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতেই কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করা যায় জোসেফ বারতোলুচ্চির এ কথা থেকে – ‘সিনেমার জন্ম হয়েছে নতুন
বাস্তবতাবাদের সঙ্গে সঙ্গে’। লেখাই বাহুল্য, জোসেফকে নিওরিয়ালিজম ধারার সিনেমাগুলো আন্দোলিত করেছিল। নিওরিয়ালিজম তাঁকে দিয়েছিল সিনেমাটিক ইমেজ তৈরি ও কাহিনি বর্ণনার ও নতুন নন্দনতত্ত্ব নির্মাণের ভাবনা। জোসেফের মধ্যে নতুন রাজনীতি ও সিনেমার র্যাডিক্যাল উত্থানের কনসেনশাস তৈরি করেছিল নিওরিয়ালিজম। এমনকি কমেডিকে যেভাবে তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে কাজে লাগিয়েছেন, তা থেকে মনে হয় পিঙ্ক রিয়ালিজমও তাঁকে আন্দোলিত করেছিল।
জোসেফ বারতোলুচ্চি যে নিওরিয়ালিজমকে বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করেছেন তার অন্যতম একটি কারণ বোধকরি এই যে, চলচ্চিত্রে তাঁর হাতে খড়ি হয় বড় ভাই বার্নার্ড বারতোলুচ্চির ছায়ায় কাজ করার মধ্যে দিয়ে এবং বার্নার্ড বারতোলুচ্চি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন অনেকটা ভিসকোনটির ধারায়। রাজনৈতিক অপেরার ট্র্যাডিশনকে তিনি সংযুক্ত করেছিলেন এই ভিসকোনটির ধারার সঙ্গে তাঁর সিনেমায়। বার্নার্ড বারতোলুচ্চির কোনো কোনো চলচ্চিত্রের কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কৃষক। এই শ্রেণির মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বিপ্লবাত্মক সম্ভাবনা, তাঁর সৃষ্টিকর্মে বিভিন্নভাবে ঘটেছিল ঐতিহাসিক গণসচেতনতার বহিঃপ্রকাশ, তা ছাড়া তাঁর কাজে ছিল বিপ্লবাত্মক রোমান্টিসিজম। প্রথানুগত বাস্তবতাবাদের সঙ্গে এপিক বিমূর্তায়নের সংমিশ্রণ ঘটে এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে তিনি স্থাপন করেছিলেন কৃষকচরিত্রকে এবং এভাবে তাদের দিয়েছিলেন ব্যক্তির স্বতন্ত্রতা। অন্যদিকে আবার লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিসের মতো সিনেমা নির্মাণের মধ্যে দিয়ে হয়ে ওঠেন রেফারেন্স পয়েন্ট, যা এখনো আমাদের খুঁজে নিতে হয় সাম্প্রতিক সিনেমায় সেক্সুয়ালিটির দর্শন খুঁজতে গেলে। এভাবে বার্নার্ড বারতোলুচ্চি তাঁর ভাই জোসেফের ওপর দুদিক থেকে প্রভাব ফেলেন – একদিকে জোসেফের মধ্যে ঐতিহাসিক গণসচেতনতার ব্যক্তিক রোমান্টিক অভিব্যক্তি নির্মাণের, অন্যদিকে বিপ্লবাত্মক প্রবণতাগুলোর সঙ্গে সেক্সুয়ালিটির সংযোগ ও কনফ্লিক্ট অনুসন্ধানের ঝোঁক তৈরি করেন। চলচ্চিত্রে জোসেফের প্রথম কাজ ছিল, আগেই লেখা হয়েছে, তাঁর ভাই বার্নার্ডের সঙ্গে। এটি নির্মিত হয়েছিল হোর্হে লুইস বোরহেসের থিম অব দ্য হিরো অ্যান্ড ট্রেইটর অবলম্বনে, ইতালির টেলিভিশনগুলোর জন্যে। নানা কারণেই দ্য স্পাইডারস স্ট্রাটাজেম নামের এ সিনেমাটি আলোচিত হয় এবং তা জোসেফের ভাগ্যকেও নির্ধারণ করে দেয়। আরো কয়েক বছর তিনি বার্নার্ড বারতোলুচ্চির সহ-লেখক হিসেবে ভূমিকা রাখেন বিখ্যাত স্ক্রিন প্লে নভেসেন্টো বা নাইনটিথ সেঞ্চুরি নির্মাণের কাজে।
বার্নার্ডের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা জোসেফকে দিয়েছিল বিশেষ করে সংলাপ তৈরির অনবদ্য ক্ষমতা। ভাইয়ের মতো তাঁর চলচ্চিত্রও মুক্ত বুর্জোয়া শ্রেণির স্বপ্ন, বিষাদ, নৈতিকতাহীনতা আর কল্পনার খবরদারিত্ব থেকে, দখলদারিত্ব থেকে। তাঁর সমসাময়িক ও পূর্বসূরি আরো দুই পথিকৃৎ অ্যান্তোনিও মিকেলাঞ্জেলো ও বার্গম্যান থেকে তিনি ক্রমশই আলাদা হয়ে পড়েন – কি কাহিনি নির্মাণের দিক থেকে, কি সিনেমা নির্মাণের কৌশলের দিক থেকে। সংলাপ রচনার ক্ষমতা জোসেফের অন্যান্য ক্ষমতাকেও নির্ধারণ করে দেয়। অভিব্যক্তি, ল্যান্ডস্কেপ, বিন্যাস, ক্যামেরার প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ও যেন নির্ধারিত হতে থাকে সংলাপেরই প্যাটার্ন থেকে। বিশেষ কোনো অসম্পূর্ণতার বোঝা থেকেও মুক্ত ছিল তাঁর একেকটি শট। এর ফলে তিনি নতুন সময়ের নতুন দর্শকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি জোসেফ বারতোলুচ্চি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন তাঁর বামপন্থার কারণে, কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কারণে। তাঁর সময়ের একজন জনপ্রিয় সংস্কারবাদী কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন এনরিখ বারলিঙ্গুয়ের। জোসেফ বারতোলুচ্চি নিজেও বারলিঙ্গুয়েরকে পছন্দ করতেন। ১৯৭৭ সালে তিনি নির্মাণ করেন কমেডি ধাঁচের চলচ্চিত্র বারলিঙ্গুয়ের, আই লাভ ইউ – যাতে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা রবার্তো বেনিগনি। মাত্র আটাশ দিনের মধ্যে
এ-সিনেমার শুটিং শেষ করা হয়, কিন্তু সেন্সরশিপের কারণে এটির স্বাভাবিক কাহিনি ব্যাহত হয়, তা ছাড়া আঠারো বছরের নিচের ছেলেমেয়েদের দেখার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা যুক্ত হয়। মারিও কিওনি নামের এক তরুণ এ-ছবির নায়ক, যে কি না ভালোবাসে বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতে অথবা পর্নোগ্রাফিক ধরনের ছবি দেখতে। মেয়েদের সামনে সাধু সেজে থাকার চেষ্টা করে সে। এরকমই একদিন সফলভাবে রগড় করা শেষে একজন তাঁকে খবর দেয় যে তাঁর মা মারা গেছে। সারারাত এক ব্রিজের নিচে কিওনি ঈশ্বর, নৈতিকতা আর সেক্স নিয়ে উন্মত্ত সব চিন্তার পর পরদিন সকালে বাড়ি গিয়ে দেখেন, তাঁর মা তখনো বেঁচে। ২০০৪ সালে এ-সিনেমাটির ডিভিডি ইংরেজি ভাষাসমেত প্রথমবারের মতো ‘নট রেটেড’ লেবেলসমেত মুক্তি পায়। এরও দুবছর পর ২০০৬ সালে ইতালিতে মুক্তি পায় এর সম্পূর্ণ সংস্করণ। এ-ছবিতে, লেখা অত্যুক্তি হবে না, পিঙ্ক নিওরিয়ালিজম ছায়া ফেলেছে নানাভাবে।
বারলিঙ্গুয়ের আই লাভ ইউ নির্মাণ ও মুক্তির কয়েক বছর পর ১৯৮০ সালে জোসেফ নির্মাণ করেন ইতালীর কমিউনিস্ট পার্টির পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ডকুমেন্টারি ডার্টি লিনেন। ওই বছর ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির কিছু অভ্যন্তরীণ তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে বারতোলুচ্চি যুক্ত হয়েছিলেন। এই কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি নির্মাণ করেন ডকুমেন্টারি ডার্টি লিলেন। মিলানের সেন্ট্রাল স্টেশনকে প্রেক্ষাপট হিসেবে রেখে কয়েকটি সাক্ষাৎকার আর গল্পের বুনোটে তিনি এটি তৈরি করেছিলেন।
পিসিআই-তে এ-চলচ্চিত্র বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং বিতর্কের পরও ফ্লোরেন্সের ফেস্টিভাল দেই পোপোলিতে প্রথম পুরস্কার পায়।
জোসেফ বারতোলুচ্চি বিশেষভাবে আলোচিত হন ১৯৮৪ সালে সিক্রেটস সিক্রেটস নির্মাণের পর। সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে
চার-চারটি সমান্তরাল কাহিনির ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয় সিক্রেটস সিক্রেটস। জোসেফ যেন তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, শক্তি ও নান্দনিকতা দিয়ে নির্মাণ করেন এ-চলচ্চিত্র। ইতালির সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল এ-চলচ্চিত্রে জোসেফ বয়ান করেছেন একটি প্রজন্মের অপরাধ, বয়ান করেছেন সমাজের ওপরের তলার সন্ত্রাসী প্রজন্মের ভিন্নধর্মী সব ফোবিয়াকে, যা ভীষণভাবে প্রভাব ফেলছে আবার সাধারণ মানুষের ওপরে – বদলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রাকে, সামাজিক বন্ধনকে। জোসেফের যা অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব তা হলো সন্ত্রাসবাদকে উপজীব্য করে এরকম আতঙ্কময়, টান-টান উত্তেজনাময় ও আবেগঘন চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও সেটিকে তিনি মুক্ত রেখেছেন কৃত্রিম সেনসেশনালিজম থেকে। আরো অনেক সিনেমার মতো এ সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন বরার্তো বেনিগনি। জোসেফ তাঁর ফেমিনিন সেনসিবিলিটিকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন এতে।
এই ফেমিনিন সেনসিবিলিটি কেবল সিক্রেটস সিক্রেটসেই নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু থেকেই ছিল জোসেফের মধ্যে এবং তিনি তাকে বিভিন্ন সিনেমায় সফলভাবে কাজেও লাগিয়েছেন। বলা কি ভুল হবে, এও তাঁর এক রেফারেন্স পয়েন্ট – চলচ্চিত্রনির্মাতা থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক পর্যন্ত সবাই জোসেফকে যুগের পর যুগ মনে করবেন বিশেষভাবে তাঁর নারী চরিত্রগুলোর কারণে। তাঁর ফেমিনিন সেনসিবিলিটি তাঁকে দিয়েছিল এমন এক ক্ষমতা, যাকে তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন এবং একের পর এক নির্মাণ করেছেন এই নারীদের, যাদের মধ্যে দিয়ে একদিকে উন্মোচিত হয়েছে নারীর নিজস্ব অবলোকন ও নারীত্বের দর্শন, পাশাপাশি প্রকাশ ঘটেছে জোসেফের নির্বাচিত অভিনেত্রীদের সুপ্ত অভিনয় প্রতিভা – যার বহিঃপ্রকাশ আগে হয়তো কখনই ঘটেনি। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে পুরুষ চরিত্রকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোতেও তাঁর গন্তব্য আসলে নারীর মনস্তত্বের কাছে পৌঁছানো।
প্রসঙ্গত মনে করা যায় জোসেফের লাইফ ইজ স্ট্রেঞ্জ সিনেমার কথা। এর কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সরকারি জনস্বাস্থ্য দপ্তরে কর্মরত এক মনস্তত্ত্ববিদ দারিও – অথচ শেষ পর্যন্ত এ-কাহিনির গন্তব্য নারীর মনন। দারিওর জীবন ছকে বাঁধা – কাজ আর প্রেমিকাকে নিয়ে ঘটনাবিহীন দিন কাটে তার। একদিন তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় স্কুলের পুরনো বন্ধু মারিওর। পুরনো দিনগুলোর স্মরণে তারা ঢুকে পড়ে একবারে। কিন্তু অনেকদিন পর দেখা হওয়ার এই আনন্দ মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, কেননা ড্রিংক করতে না করতেই মারিও অসুস্থ হয়ে পড়ে, শরীর কুঁকড়ে আসে তার, দারিওর কোলে শুয়ে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে।
আর এরপরই পালটে যায় দারিওর ঘটনাবিহীন জীবন। এমন একসময় ছিল, যখন মারিওর বিধবা স্ত্রী অ্যানি ছিল দারিওর ভালোবাসা। সে নতুন করে উপলব্ধি করে অ্যানির অস্তিত্ব। যদিও এর মধ্যেই তার জীবন জড়িয়ে পড়েছে তরুণী এস্থারের সঙ্গে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত আর ঘটনাপরম্পরায় দারিও কেবল নিজের সঙ্গেই নয়, নিজের পেশার উদ্দেশ্যের সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, মনস্তত্বের যে-সংজ্ঞা ও বোধ সে অর্জন করেছে এতদিন ধরে তা তার জন্য হয়ে ওঠে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
লাইফ ইজ স্ট্রেঞ্জে জোসেফ বারতোলুচ্চি নারীর মননকে ঘিরে যে নিরীক্ষণ শুরু করেন, পরবর্তী সিনেমাগুলোতেও তা অব্যাহত থাকে। কোনো কৃত্রিমতা নেই, নেই কোনো মেদ ও রুগ্নতা, পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয়, এমনকি সাপের মতো নির্লিপ্ত অথচ চলৎশক্তিরহিত করে ফেলতে পারে এমন সব নারী চরিত্র সৃষ্টিতে জোসেফ বারতোলুচ্চির মুন্শিয়ানা চোখে পড়ে লাভ ইন প্রগ্রেসেও। চোখে পড়ে এনজো মোসকেটোর নাটক অবলম্বনে নির্মিত তাঁর সিনেমা লুপারেলাতে-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত যে সিনেমায় রয়েছে নেপলসে জার্মান দখলদার সৈনিকদের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ মেয়ে নানা (ইসা ড্যানিয়েলি)। কিংবা জোসেফ যে পছন্দ করতেন ইদিপাস থেকে ওথেলো, বোধকরি এসবেরই ছায়া পড়তে দেখা যায় সেকেন্ড ডলসে রিউমোরে ডেলা ভিটা সিনেমাতে – মা ও ছেলের সম্পর্কে। ওগেট্টি স্মারিটির কথাও মনে করা যেতে পারে, যেখানে দাদিমার বাড়ি থেকে মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে ট্রেনে এক নারী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার স্বামীর কাছে থেকে। তারপর রহস্যময় আগন্তুকের মেয়ে পড়তে পড়তে আসলে নিজেকেই সে খুঁজে পেতে থাকে।
লাভ ইন প্রগ্রেসে অবশ্য জোসেফ বারতোলুচ্চি তাঁর একাগ্র দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করেছেন তিন তরুণী নারীর ওপর – মধ্য বয়স থেকে তারা অনেক দূরে। তিন তরুণীর সম্পর্কের আকাক্সক্ষা, আচ্ছন্নতা, বিভ্রম ও ভালোবাসা করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে জোসেফ আসলে বোঝাপড়া করেছেন ফেমিনিটির বিভিন্ন স্টাইলিস্টিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর সঙ্গে। বন্ধুত্ব, দূরত্ব ও নৈকট্য, ঘনিষ্ঠতা এবং ভালোবাসার প্রথম উত্তেজনা এ সব কিছুকেই বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি তরুণীদের মতো করে। এ-চলচ্চিত্র সম্পর্কে জোসেফ নিজেই মন্তব্য করেছেন, এই উদ্যোগে বিশেষ করে সিনেমা বানানোর বিষয়আশয়গুলো খতিয়ে দেখলে খুঁজে পাওয়া যাবে
এরকম রোমারের প্রভাব। বছরের পর বছর জোসেফের যে-কোনো সমস্যায় রোমার কাজ করেছে ওষুধের মতো – তিনি ছিলেন জোসেফের কাছে প্রাণশক্তির সত্যিকারের অনন্য এক উদাহরণ, প্রথাবদ্ধ ভালগারিটির বিপরীতে অনুসরণযোগ্য এক উদাহরণ।
জোসেফ বারতোলুচ্চি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন গত ১৬ জুন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এখনো এক অর্থে অনালোচিত তিনি – এত অনালোচিত যে, এমনকি উইকিপিডিয়ার ইংরেজি সংস্করণে তাঁর কোনো উপস্থিতি নেই; আছে কেবলমাত্র ইতালীয় ভাষায় – তাও সংক্ষেপে। উল্লেখযোগ্য কোনো আন্তর্জাতিক পত্রিকায়ও তাঁকে নিয়ে কোনো অবিচ্যুয়ারিও ছাপা হয়নি, অন্তত চোখে পড়েনি আমার – এমনকি তাঁর মৃত্যুসংবাদটিও খুব সংক্ষিপ্ত, যেন না ছাপালে নিরপেক্ষতা হারাতে হবে এরকম ভয়ে আক্রান্ত কয়েকটি বাক্য কোনোমতে লেখা। সমসময়ের নানা প্রতিযোগিতা, নানা দূরত্ব, নানা সংশয় তাঁকে আড়াল করে রেখেছে ঠিকই – কিন্তু সময় যত গড়াবে, ততই তাঁকে নিয়ে আলোচনা বাড়বে, চলচ্চিত্রে তাঁর অসামান্য গুরুত্বও দ্রষ্টব্য হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে – অন্তত আমার এতে কোনো সন্দেহ নেই, সংশয়ও নেই।