logo

বাংলার সমকালীন ভাস্কর্যের রূপরেখা একটি প্রদর্শনী-পরিক্রমা

মৃ ণা ল  ঘো ষ
কলকাতার ‘এমামি চিজেল আর্ট গ্যালারি’তে সম্প্রতি (১৪-৩০ জুলাই ২০১১) অনুষ্ঠিত হলো পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন ভাস্কর্যের একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। একুশজন ভাস্করের প্রত্যেকের দুটি করে কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী। এর মধ্যে ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত প্রবীণ ভাস্কর যেমন আছেন, তেমনি এর পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি-স্থানীয় ভাস্কররাও আছেন। ফলে এই প্রদর্শনী ১৯৬০-এর দশক থেকে একবিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যের বিবর্তনের একটি রূপরেখা তুলে ধরে। একেবারে সম্প্রতি আমাদের ভাস্কর্যের রূপারোপ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল ও বহুমাত্রিক হয়েছে। এই প্রদর্শনীতে তার কিছু আভাস আছে কিন্তু সামগ্রিক পরিচয় নেই। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-র দশকের শিল্পীদের প্রকাশভঙ্গিরই প্রাধান্য এখানে।
আলোচ্য প্রদর্শনীর প্রতিটি কাজ আমরা নিবিষ্টভাবে দেখব। তার আগে আমাদের আধুনিক ভাস্কর্যের সূচনা ও রূপান্তর সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রেক্ষাপটটি জানলে পরবর্তী রূপের বিকাশকে অনুধাবন করা সহজতর হয়। আমাদের চিত্রকলার বিকাশের সঙ্গে ভাস্কর্যের বিকাশের একটু পার্থক্য আছে। ব্রিটিশরা এদেশে আসার পর থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আমাদের দেশে উচ্চকোটির মানুষের পরিশীলিত শিল্প-প্রকাশের পরিমণ্ডলটি খুবই ছায়াচ্ছন্ন ছিল। শিল্পকলায় ভারতবর্ষের যে মহৎ অবদান, ত্রয়োদশ শতকের পর থেকে তা অন্ধকারে আবিল হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ছবি ও ভাস্কর্য দুয়েরই বিকাশ রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু লৌকিক স্তরে একটা প্রবাহ কিন্তু ছিল। ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তৃত হওয়ার পরে ব্রিটিশ রাজপুরুষ এবং তাঁদের শিল্পতাত্ত্বিকরাও মনে করতেন, ভারতবর্ষে লালিত শিল্পের কোনো ঐতিহ্য নেই। শুধু ইংরেজ কেন আমাদের দেশের অনেক বিদগ্ধ মানুষও মনে করতেন চিত্র-ভাস্কর্যে আমাদের দেশ পাশ্চাত্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে।
অজ্ঞতাজনিত এরকম একটা পরিমণ্ডলে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী আমাদের দেশে শিল্পচর্চা প্রসারের জন্য এবং কিছু শিল্পী-কারিগর তৈরির জন্য শিল্পশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। ভারতবর্ষে প্রথম আর্ট স্কুল খুলেছিল মাদ্রাজে ১৮৫০ সালে। কলকাতায় ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টে’র সূচনা হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। সেটাই পরে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট এবং ১৯৫১ থেকে ‘গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটে’ রূপান্তরিত হয়। এই আর্ট স্কুলে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার আঙ্গিকে চিত্র ও ভাস্কর্য শিক্ষা দেওয়া হতো। ১৮৫০-এর দশক থেকে ১৯০০ সালের আগে পর্যন্ত এই স্বাভাবিকতার আঙ্গিকই ছিল আমাদের চিত্র ও ভাস্কর্যের একমাত্র প্রকাশভঙ্গি। এই আঙ্গিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বাংলাতেও অনেক ভাস্কর কাজ করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। রোহিনীকান্ত নাগ (১৮৬৮-১৮৯৫), হিরণ¥য় রায় চৌধুরী (১৮৮৪-১৯৬২), ফণীন্দ্রনাথ বসু (১৮৮৮-১৯২৬) থেকে শুরু করে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী (১৮৯৯-১৯৭৫) পর্যন্ত অনেক ভাস্কর স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু তাঁদের কাজে দেশীয় ঐতিহ্য তথা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো প্রকাশ ছিল না।
সেই সময়ের চিত্রকলাতেও একই সমস্যা ছিল। অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতাতেই শিল্পীরা কাজ করতেন। এই আঙ্গিকের মধ্য দিয়েই কেরলের রাজা রবিবর্মা ও বাংলায় বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেক শিল্পী সেই সময়ের চিত্রশৈলীতে গভীর অবদান রেখেছেন। চিত্রকলায় এই দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে ১৮৯৭ সাল থেকে। তখন স্বাদেশিকতার একটা পরিমণ্ডল ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছিল। শিল্পী ও ভাবুকদের মধ্যে প্রশ্ন জাগছিল আমাদের চিত্রকলা কেন আমাদের ঐতিহ্যের ভিত্তি থেকে গড়ে উঠবে না? আমরা কেন ব্রিটিশ আঙ্গিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব? যাঁর ভেতর প্রথম এই ভাবনা এসেছিল তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথও ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক আঙ্গিকে প্রশিক্ষিত শিল্পী ছিলেন। কিন্তু স্বাদেশিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ঐতিহ্য-অন্বিত এক প্রকাশভঙ্গি গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। ১৮৯৭ সালে তাঁর ‘রাধাকৃষ্ণ’ চিত্রমালার মধ্য দিয়ে এই প্রয়াসের সূচনা। তারপর জীবনব্যাপী সাধনায় তা নানা দিগন্তে প্রসারিত হয়। ১৯৯৬ সালে ই.বি. হ্যাভেল কলকাতার আর্ট স্কুলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ভারতের শিল্পকলার ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, শিল্পশিক্ষায় কেন সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের কোনো প্রকাশ নেই।
কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের শিল্পশিক্ষায় তিনি ভারতীয় রীতির প্রচলনে প্রয়াসী হন। ১৮৯৭ সালে তাঁর সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। তাঁদের দুজনের যৌথ উদ্যোগে শিল্পশিক্ষায় ও সৃষ্টিতে ভারতীয় শৈলী প্রাধান্য পেতে থাকে। পরে অবনীন্দ্রনাথের শিষ্যপরম্পরার মধ্য দিয়ে তা নানা দিগন্তে প্রসারিত হয়। এ ক্ষেত্রে নন্দলাল বসুরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, অসিত কুমার হালদার, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমুখ শিল্পী ও তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্য দিয়ে বিংশ শতকের শুরু থেকে ১৯৪০-এর দশকের আগে পর্যন্ত ভারতীয় নন্দনচেতনাভিত্তিক যে চিত্রকলার বিকাশ ঘটে সেটাই নব্য-ভারতীয় ঘরানা নামে দেশে ও বিদেশে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়। বাংলা তথা ভারতীয় চিত্রকলা তার নিজস্ব আত্মপরিচয়ে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।
চিত্রকলার সঙ্গে আধুনিক ভাস্কর্যের পার্থক্য এটাই যে, ভাস্কর্যের কোনো নব্য-ভারতীয় ঘরানা ছিল না। কলকাতায়, এমনকি  শান্তিনিকেতনেও ১৯৩০-এর আগে পর্যন্ত ঐতিহ্য-অন্বিত আধুনিক ভাস্কর্যের কথা কেউ ভাবেননি। এক্ষেত্রে একমাত্র পথিকৃৎ শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্কর (১৯০৬-১৯৮০)। রামকিঙ্কর বাঁকুড়া জেলার গ্রামের মানুষ ছিলেন। শৈশব থেকেই ছবি ও ভাস্কর্যে তাঁর প্রতিভার প্রকাশ পেতে থাকে। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের নজরে আসেন তিনি। রামানন্দের প্রচেষ্টাতেই ১৯২৪ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে যান এবং নন্দলাল বসুর কাছে শিল্পশিক্ষা শুরু করেন। শান্তিনিকেতনে জ্ঞানচর্চার পরিমণ্ডল এবং রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য তাঁকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। ছবি ও ভাস্কর্য উভয় ক্ষেত্রেই তার প্রকাশ ঘটে। ১৯৩৫-এ রামকিঙ্কর শান্তিনিকেতনে ‘সুজাতা’ নামে একটি পরিবেশ ভাস্কর্য গড়েছিলেন। সিমেন্ট-কংক্রিটে তৈরি এই শীর্ণ, দীর্ঘায়ত মানবী মূর্তিতে উদ্ভাবিত হয়েছিল যে অভিনব রূপ, আমাদের দেশে ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতায় তার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। ১৯৩৮-এর ‘সাঁওতাল পরিবার’-এ তিনি প্রবহমান জীবনের সঙ্গে শিল্পকে মিলিয়ে দিলেন। উদ্ভাবিত হলো নতুন রূপরীতি, যার ভেতর দেশীয় লৌকিক, আদিমতা, ধ্র“পদী ভাস্কর্যের সারাৎসার এবং পাশ্চাত্য আধুনিকতার কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটল। রামকিঙ্কর তাঁর পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেকেই বারবার অতিক্রম করেছেন। ১৯৪৩-এর ‘হার্ভেস্টার’, ১৯৫৪-র ‘কলের বাঁশি’, ১৯৪১-এর ‘দীপস্তম্ভ’, ১৯৪০-এ গান্ধীজির পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি ‘ডান্ডিমার্চ’, ১৯৫৩-র গতি বা ‘মিথুন’ থেকে ১৯৬০-এর দিল্লিতে করা ‘যক্ষ-যক্ষী’ পর্যন্ত বা তার পরেও তাঁর ভাস্কর্যের যে-বিস্তার, তা সারাবিশ্বের আধুনিকতার প্রেক্ষাপটেই অবিস্মরণীয়। আমাদের আধুনিক ভাস্কর্য নতুন প্রাণে দীপ্ত হয়ে উঠল।
রামকিঙ্করের রূপরীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য এক সমন্বয়চেতনা। রামকিঙ্করের পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের অন্যান্য ভাস্কর, ১৯৪০-এর দশকে যাঁদের প্রতিষ্ঠা, তাঁরাও এই সমন্বয়ের সাধনাই করেছেন। তাঁদের প্রায় সকলেই যে-কাজ করেছেন, তাতে মেধার দীপ্তি ছিল। বুদ্ধি দিয়ে তাঁরা আহরণ ও আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছেন রঁদা, মাইঅল, বুর্দেল থেকে ব্রাঁকুসি, হানস আর্জ, হেনরি মুর ও বারবারা হেপওয়ার্থ পর্যন্ত পাশ্চাত্যের আধুনিক ভাস্করদের রূপচেতনার বৈশিষ্ট্য এবং বিমূর্তায়ন ও সরলীকরণের সারাৎসার। এর সঙ্গে মেলাতে চেয়েছেন ভারতের ধ্র“পদী ও লৌকিক ভাস্কর্যের অন্তর্নিহিত গুণাবলিকে। কিন্তু গভীরতর কোনো দায়বোধ এবং অনন্য কোনো নন্দনবোধের অভাবে এ সমন্বয় থেকে অভিনব কোনো দীপ্তি উদ্ভাসিত হয়নি অনেকের কাজেই।
চল্লিশের শিল্পী ও প্রথম প্রজন্মের অন্তর্গত ভাস্করদের মধ্যে বাংলায় যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রদোষ দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৯১), চিন্তামণি কর (১৯১৫-২০০৫), শঙ্খ চৌধুরী (১৯১৬), সুধীর রঞ্জন খাস্তগির (১৯০৭-৭৪), প্রভাস সেন (১৯১৯-২০০১), সুনীল পাল (১৯২০), সোমনাথ হোর (১৯২১-২০০৬), মীরা মুখোপাধ্যায় (১৯২৩-১৯৯৮) প্রমুখ। এর মধ্যে দায়বোধের প্রগাঢ়তায় গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নতুন মূল্যবোধ তৈরি করতে পেরেছেন সোমনাথ হোর ও মীরা মুখোপাধ্যায়। সোমনাথ হোর অবশ্য ভাস্কর্য শুরু করেছেন অনেক পরে ১৯৭৪ সালে। আদিম ও অভিব্যক্তিবাদী আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে তিনি যে ক্ষত-লাঞ্ছিত বিপন্নতার প্রতিমূর্তি তৈরি করেছেন, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতেই তার স্বাতন্ত্র্য অসামান্য মীরা মুখোপাধ্যায় প্রবেশ করলেন দেশের লৌকিক জীবনের গভীরে। আদিবাসী ও উপজাতীয় মানুষদের যে ধাতু ঢালাই পদ্ধতি, সেটাকে অনুধাবন ও আয়ত্ত করার চেষ্টা করলেন উপজাতীয় মানুষদের বিভিন্ন ভাস্কর্য কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে। ডোকরা ভাস্কর্য পদ্ধতি এর মধ্যে একটি। এই দেশজ প্রকরণ তাঁর ভাস্কর্যের আঙ্গিকে এমন এক ঐতিহ্য-সম্পৃক্ত আত্মপরিচয় নিয়ে এলো, আমাদের আধুনিকতায় যার কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত ছিল না।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের হাতে ভাস্কর্যের রূপরীতি আরো অনেক বিস্তৃত হয়। তাঁদের বলা যেতে পারে দ্বিতীয় প্রজন্মের ভাস্কর। বিশ্বভারতীর কলাভবনে রামকিঙ্করের কাছে শিখে পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অজস্র ভাস্কর। সারা ভারতে তাঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলা বা পূর্বাঞ্চলে কাজ করে যাঁরা বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুষেণ ঘোষ (১৯৪০), জনক ঝংকার নার্জারি (১৯৪৮), বিপুল কান্তি সাহা (১৯৪৪), তারক গড়াই প্রমুখ। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে প্রদোষ দাশগুপ্ত শিক্ষক ছিলেন ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত। তাঁর কাছে শিখে পরবর্তী জীবনে ভাস্কর হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন অজিত চক্রবর্তী (১৯৩০-২০০৫), উমা সিদ্ধান্ত (১৯৩৩), শর্বরী রায়চৌধুরী (১৯৩৩), তিনি পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী কলাভবনে শিক্ষকতা করেছেন, বিপিন গোস্বামী (১৯৩৪), তিনিও কলাভবনে শিক্ষক ছিলেন, মাধব ভট্টাচার্য (১৯৩৩), রঘুনাথ সিংহ (১৯৩৩), শঙ্কর ঘোষ (১৯৩৪), গোষ্ঠ কুমার (১৯৩২), সুবল চন্দ্র সাহা (১৯৩৩) প্রমুখ। এর মধ্যে রঘুনাথ সিংহ ব্যতিক্রমী। আদিম লৌকিক রূপকল্পকে ব্যবহার করে তিনি পুরাণকল্পকে যেভাবে আধুনিকতায় অভিষিক্ত করেছেন তাতে আত্মপরিচয়ের এক স্বতন্ত্র মাত্রা তৈরি হয়েছে। এই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেই ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন চিন্তামণি কর। তাঁর কাছে শিখে পরবর্তীকালে খ্যাতি অর্জন করেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেবব্রত চক্রবর্তী (১৯৩৫), সুরজিৎ দাস (১৯৩৫), মধুসূদন চক্রবর্তী, মধুসূদন চ্যাটার্জি, অনিট ঘোষ, বিমান দাস, নিরঞ্জন প্রধান (১৯৪০) প্রমুখ। এসব শিল্পীর কাজে রূপাবয়বের কিছু সাধারণ ঐক্য আছে। পাশ্চাত্য আধুনিকতার ভিত্তির ওপর তাঁরা আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছেন দেশীয় রূপরীতির কিছু বৈশিষ্ট্য। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার, কখনো বা পুরাণকল্প বা কিছু অধ্যাত্মচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁদের কাজে।
তৃতীয় প্রজন্মের ভাস্কররা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রজন্মের ভাস্করদের কাছে প্রশিক্ষিত হয়েছেন। তাঁদের জন্ম ১৯৫০-এর দশকে। ১৯৮০-র দশকে তাঁরা স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত আমাদের যে প্রচলিত রূপরীতি তাকেই নানাভাবে প্রসারিত করেছেন এই প্রজন্মের অনেক ভাস্কর। আবার অনেকে এই প্রচলিত রূপরীতিকে ছাড়িয়ে গেছেন। তৈরি করেছেন নতুন পরিসর। রূপের নতুন অভিজ্ঞান। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম মোটামুটি রূপবিন্যাসের একই মডেলকে অনুসরণ করেছেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার ভিত্তির ওপর ঐতিহ্যের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। এই মডেলটা সম্পূর্ণই পালটে গেল ১৯৯০-এর দশকে নবীন শিল্পীদের হাতে বিশ্বায়ন ও   উত্তর-আধুনিকতার যৌথ ও দ্বান্দ্বিক অভিঘাতে।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে আমরা যেসব কাজ দেখছি তাতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অনুসৃত মডেলেরই প্রাধান্য। পরবর্তী প্রজন্মের নতুন মডেলের প্রকাশও রয়েছে কিছু কিছু। আমরা মোটামুটি শিল্পীর সময়ের ক্রম অনুসারে কাজগুলি দেখে যাব। অর্থাৎ ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের দিল্লির দিকে আসব।
ষাটের দশকের দুজন শিল্পী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। উমা সিদ্ধান্ত ও বিপিন গোস্বামী। এই প্রজন্মের আরো অনেক শিল্পী এখনো সক্রিয় আছেন। তাঁদের কয়েকজনের কাজ থাকলে ভালো হতো। উমা   সিদ্ধান্তের দুটি কাজের মধ্যে ‘থ্রি ফেসেস’ শীর্ষক ব্রোঞ্জটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনটি মুখের সমাহার এই রচনা। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রিমিটিভ’, ‘হর্স উওম্যান’ ও ‘জ্যাকেল উওম্যান’। আদিম শিল্পের অনুরণনে গড়ে উঠেছে এই তিনটি অভিব্যক্তিবাদী মুখ। কোনো আখ্যান নেই এর ভেতর। তিনটিই বিশুদ্ধ রূপ বা ‘ফর্ম ইটসেলফে’র প্রকাশ। কিন্তু তা হয়ে উঠেছে সময়ের অন্তর্নিহিত তমিস্রার প্রতীক। এই কালচেতনা ষাটের ভাস্কর্যের একটি বৈশিষ্ট্য। কেউ কেউ অবশ্য ফর্ম-চেতনাকেও প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিপিন গোস্বামীর ‘এলিফ্যান্ট’ শীর্ষক ব্রোঞ্জটিতে একটি স্ফীতকায় হাতির উপস্থাপনা। সেই হাতির পিঠের ওপর বসে আছে পরিচয়হীন দুটি মানুষ। এখানে সবটাই স্ফুরিত আয়তন এবং উত্তল বা কনভেক্স। অবতলতার উপস্থাপনা খুবই কম। শূন্য পরিসর বা নেগেটিভ স্পেস একেবারেই নেই। এই আয়তনময়তা এসেছে ভারতীয় লৌকিক ও ধ্র“পদী শিল্প থেকে। কালীঘাটের পটের অবয়ববিন্যাস যার একটি দৃষ্টান্ত। এই দেশীয় ঐতিহ্যের ওপরই অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখিনতা মিলেছে এই রচনাটিতে। তাঁর দ্বিতীয় রচনা ‘আন্ডার দ্য ট্রি’তে প্রাধান্য পেয়েছে এক্সপ্রেশনিস্ট বা অভিব্যক্তিবাদী অনুষঙ্গ। লৌকিক ভাস্কর্যের কল্পনাদীপ্ত ব্যবহার বিপিন গোস্বামীর কাজের একটি বৈশিষ্ট্য। সেই ভিত্তির ওপরই এখন তিনি রূপ ভেঙে অভিব্যক্তির দিকে নিয়ে যান।
১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত ভাস্করদের মধ্যে এই প্রদর্শনীতে রয়েছেন বিমান বিহারী দাস, অসীম বসু, মানিক তালুকদার ও জনক ঝংকার নার্জারি। বিমান বিহারী দাসের কাজে অনেক সময়ই কিছুটা আধ্যাত্মিকতার আবহ থাকে। এই প্রদর্শনীর কাজ দুটিতেও তা আছে কিন্তু খুবই পরোক্ষভাবে। ‘নায়িকা’ শীর্ষক ব্রোঞ্জটি এক বসে থাকা মানবীর উপস্থাপনা। তার অভিব্যক্তির মধ্যেই কিছুটা আধ্যাত্মিকতার আবহ রয়েছে। রচনাটি একটি বৈশিষ্ট্য নেগেটিভ স্পেস বা শূন্য পরিসরের কল্পনাদীপ্ত ব্যবহার। মানবীর শরীর ও একটি হাতের মধ্যবর্তী অংশে যে শূন্য পরিসর রয়েছে, তা সামগ্রিক অবয়বের আয়তনময়তার সঙ্গে এক কাব্যিক সংঘাত গড়ে তোলে। তাঁর দ্বিতীয় রচনাটির শিরোনাম ‘বাডিং জয়’। আলম্বভাবে স্থাপিত দীর্ঘায়ত রচনা। অনেকটাই বিমূর্ত। মনে হচ্ছে যেন বীজের দুটি পাপড়ি খুলে যাচ্ছে। আর ভূমি থেকে বেরিয়ে আসছে অঙ্কুর। খুবই ছন্দোময় রচনা। পাশ্চাত্য আধুনিকতার আঙ্গিকের সঙ্গে ভারতীয় অধ্যাত্মচেতনার সমন্বয়।
অসীম বসুর ভাস্কর্যে বিষয় উঠে আসে প্রবহমান জীবন থেকে। মানুষই তাঁর প্রধান বিষয়। তাদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ ইত্যাদিকে তিনি রূপ দেন স্বাভাবিকতাকে ফ্যানটাসি বা কল্পরূপে রূপান্তরিত করে।
জঙ্গমতা বা গতিময়তা তাঁর রূপনির্মাণের প্রধান এক বৈশিষ্ট্য। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে তাঁর দুটি কাজ – ‘রিপোজ’ ও ‘সিয়েস্তা’। দুটিই ব্রোঞ্জ। দুটিতেই চেয়ার ও খাটিয়ার ওপর একটি মানুষকে অর্ধশায়িত অবস্থায় দেখা যায়। মোমের পাতকে ভাঁজ করে তিনি অবয়বে     রূপান্তরিত করেন বলে কোমলতার আবরণ থাকে তাঁর প্রকাশে। কোমলতার মধ্যেই কৌতুক ও করুণা মিশে থাকে।
মানিক তালুকদারের কাজ ষাট ও সত্তরের দশকের সাধারণ প্রবাহ থেকে একটু আলাদা। তাঁর কল্পরূপাত্মক অলংকরণ ততটা বাস্তবতাড়িত নয়। শিল্পের স্বতন্ত্র এক বাস্তব তিনি গড়ে তুলতে চান। এখানে কাঠে তৈরি ‘ফ্যানটাসি’ রচনাটি একটি মানবী রূপের উপস্থাপনা। আলম্বভাবে বেড়ে ওঠা তার শরীর নানা অলংকরণে শোভিত। ব্রোঞ্জের ‘বার্ডস’ রচনাটি রূপের স্বাতন্ত্র্যের দিক থেকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ। একটি বড় পাখি ও কয়েকটি ছোট পাখির সমাহার এই রচনা। পাখিদের শরীরের ত্রিকোনাকৃতি জ্যামিতিক গঠন রূপবিন্যাসের দিক থেকে খুবই মাত্রাময় হয়ে উঠেছে।
জনক ঝংকার নার্জারির ভাস্কর্যও ষাট ও সত্তরের দশকের সাধারণ প্রকাশভঙ্গি থেকে একেবারেই আলাদা। বরং তাঁর কাজে বিশ্বায়ন-পরবর্তী নতুন চেতনার প্রকাশ অনেকটাই রয়েছে। আঙ্গিকেও রয়েছে উত্তর-আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য। স্থাপত্যচেতনা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় তাঁর কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ১৯৯০-এর দশক-পরবর্তী যে নতুন চেতনার বিকাশ তাঁরই পূর্বসূরি বলা যেতে পারে এই শিল্পীকে। এই প্রদর্শনীতে তাঁর দুটি কাজের মধ্যে ‘গেট অব দ্য জার্নি’ পাথর ও ব্রোঞ্জে তৈরি। একটি তোরণ, তার ভেতর দিয়ে নদী বয়ে গেছে। নদীতে নৌকা। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে এক নগ্ন মানবী। কয়েকটি জ্যামিতিক আকারের স্তম্ভ রয়েছে দুপাশে। অসীমের দিকে মানবচৈতন্যের অভিযাত্রা অনেক সময়েই হয়ে ওঠে তাঁর ভাস্কর্যের বিষয়। মার্বেলে তৈরি ‘ডে অ্যান্ড নাইট’ রূপবিন্যাসের সংক্ষিপ্ততায় ও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সাদা পাথরের এক পাশে গোলাকৃতি উত্তল আয়তন, যা সম্ভবত দিনকে সূচিত করছে। অন্য পাশে অবতল। রাত্রির সূচক। বিশুদ্ধ রূপ হিসেবে রচনাটি মুগ্ধ করে।
এই প্রদর্শনীতে ১৯৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত ভাস্করের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। তাঁদের প্রায় সকলের কাজই অবয়বী এবং অধিকাংশেরই রূপ গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য আধুনিকতার ভিত্তি থেকে। তাপস সরকারের দুটি রচনাই ব্রোঞ্জের। শিরোনাম : ‘ফ্লাই ফর্ম’ ও ‘রিদম’। ‘রিদমে’ এক মানবীর শরীর হাঁটুর ওপর ভর করে ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে ছন্দ রচনা করেছে। এই ছন্দবিন্যাসে শূন্য পরিসর বা নেগেটিভ স্পেসের বিশেষ ভূমিকা আছে। একটি হাত মাথার সঙ্গে, একটি হাত কোমরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাঝখানে যে শূন্যতা ও কার্ভ বা বক্রতল সৃষ্টি করেছে তা পায়ের হাঁটুর ভাঁজের বক্রতলের সঙ্গে সাযুজ্য রচনা করে।
তলবিন্যাসের এই বৈশিষ্ট্যই ছন্দের অন্যতম উৎস। এই কাজটি প্রচলিত রূপরীতির। তাঁর দ্বিতীয় কাজ ‘ফ্লাইং ফর্মে’ অভিনবত্ব অনেক বেশি। বিমূর্ততারও অভিনব প্রকাশ রয়েছে এই রচনাটিতে। তিনটি গোলাকার দণ্ড লম্বভাবে স্থাপিত। তাদের ওপর ভর করে অজস্র উড়ন্ত পাখি যেন চারদিকে ভেসে যেতে চাইছে। শিল্পীর রূপানুভবের স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল এই রচনাটি।
সুনীল কুমার দাসের কাজে সমাজচেতনাদীপ্ত প্রতিবাদী আবহ থাকে অনেক সময়। এখানে ‘বন্ডেজ’ ব্রোঞ্জটি একটি ছাগলের উপস্থাপনা। তার মুখে জাল লাগানো। গলায় তেকাঠি। সে যাতে গৃহস্থের বা কৃষকের ফসল নষ্ট করতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা। এই প্রতীকী উপস্থাপনায় শিল্পী মানুষেরও পরাধীনতার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। তাঁর দ্বিতীয় রচনাটির শিরোনাম ‘ডাঙ্কি উইথ বার্ড’। এটি অবশ্য নিষ্পাপ সৌন্দর্যের রূপায়ণ। গাধার পিঠের ওপর একটি পাখি বসে আছে। বিমল কুণ্ডুর কাজে পাশ্চাত্য আধুনিকতার জ্যামিতিক উপস্থাপনা অনেক সময়ই একটি মাত্রা হিসেবে কাজ করে। এই গণ্ডিকে ছাড়িয়েও তিনি অবশ্য অনেক সময় উত্তর-আধুনিক কনসেপ্টের ওপর কাজ করেন। তবে এই প্রদর্শনীর দুটি ব্রোঞ্জই আধুনিকতার সীমায় আবদ্ধ। ‘অ্যানিমেল’ একটি কুকুরের উপস্থাপনা। স্বাভাবিকতার মধ্যেই জ্যামিতিক তলবিন্যাস আকর্ষণীয়। ‘রিক্লাইন’ এক অর্ধশায়িতা নারীর উপস্থাপনা।
শ্যামল রায় ও রামকুমার মান্না দুজনেই লৌকিক আঙ্গিকের ভিত্তিতে কাজ করেন। দুজনেরই প্রধান মাধ্যম টেরাকোটা। কিন্তু শ্যামলের লৌকিকে খুব সূক্ষ্মভাবে এক নাগরিক মূল্যবোধ থাকে। রামকুমার সম্পূর্ণভাবেই ভাব ও আঙ্গিক উভয়তই লোকায়তে নিমগ্ন। শ্যামলের দুটি টেরাকোটা রয়েছে Ñ ‘লেডি’ ও ‘ক্লাউন’। প্রথমটিতে সোফার ওপর অর্ধশায়িত এক নগ্নিকা। সদর্থক আয়তনসম্পন্ন অবয়ব। চোখ ও চুলের উপস্থাপনায় লৌকিকের সারল্যময় উপস্থিতি। রামকুমারের দুটি রচনার মধ্যে ‘শিব’ ফাইবার গ্লাসে তৈরি। আদিমতা, লৌকিক ও ধ্র“পদী অনুভবের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন শিবের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। তাঁর নিজের কাজের প্রেক্ষাপটেও এই রচনাটি একটু ব্যতিক্রমী। দ্বিতীয় রচনাটি টেরাকোটার। শিরোনাম : ‘প্রেমলীলা’। সুবিশাল একটি অশ্বত্থ গাছ উঠে গেছে। তার কাণ্ডের শরীরজুড়ে রিলিফ বা নতোন্নতভাবে মানব-মানবীর প্রেমের বিচিত্র লীলা।
তপন কুমার দাস ও সুনন্দা দাস যদিও ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করেছেন, তবু তাঁদের কাজ পূর্ববর্তী প্রজন্মের আঙ্গিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তপন অবশ্য দুটি ব্রোঞ্জেই মানব-অবয়বকে বিমূর্তায়িত করে প্রকাশ করেছেন এবং সেই বিমূর্তায়নে যথেষ্ট অভিনবত্বও আছে। সুনন্দার ‘এন্ড অব পারফর্মেন্স’ এক নগ্নিকা নায়িকার নৃত্যের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিমাকল্প। পূর্ববর্তী প্রজন্মের রূপবোধের প্রকাশ হলেও রচনাটি যথেষ্ট নন্দনঋদ্ধ। তাঁর দ্বিতীয় কাজটি ব্যতিক্রমী ও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ‘পুওরস প্রাইড’ শীর্ষক এই ব্রোঞ্জটিতে একটি থালার ওপর কয়েকটি হাতের বিমূর্তায়িত উপস্থাপনা। দারিদ্র্য ও ক্ষুধার এক বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে রচনাটি।
এর পর থেকেই আমরা আসতে থাকি ১৯৯০-পরবর্তী শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্রে। এখানে এসে এতদিনকার যে প্রকাশভঙ্গি তা অনেকটাই পালটে গেল। পঙ্কজ পাওয়ারের ‘কলাবতী’ শীর্ষক ব্রোঞ্জটি জ্যামিতিকতায় বিশ্লেষিত এক তরুণীর মুখাবয়ব। তাঁর দ্বিতীয় রচনাটি যার শিরোনাম ‘হোম ক্যারি হোম’, রূপবোধের দিক থেকে একেবারে স্বতন্ত্র ধারার। ভূমির ওপর চারটি মানুষের মাথা বসানো রয়েছে। মাঝখানে একটি স্থাপত্যের উপস্থাপনা, যার সঙ্গে এই মাথাগুলি যুক্ত। ওই স্থাপত্যের শীর্ষদেশ থেকে একটি রকেট উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে। এই হচ্ছে কাজটির বিষয়, যা সম্ভবত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই এক প্রতিবাদী আবহ গড়ে তোলে। অখিল চন্দ্র দাসের কাজেও সন্ত্রাসবিরোধী অনুষঙ্গ প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর ‘ফ্যান্টাসমাগোরিয়া-২’ শীর্ষক রচনায় তলোয়ার হাতে এক বহুমস্তকবিশিষ্ট পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথাগুলি সবই পশুর। ‘ফ্যান্টাসম্যাগোরিয়া-৭’ ব্রোঞ্জ ও কাঠের মিশ্র মাধ্যমে তৈরি। সাধুসদৃশ উপবিষ্ট এক মানুষ দুহাতে ওপরে তুলে রেখেছে কাঠে তৈরি বস্ত্রসদৃশ একটি প্লাটফর্ম। তার ওপর অজস্র বন্দুকধারী মানুষ চারদিকে বন্দুক উঁচিয়ে বসে আছে।
আশিস ঘোষের কাজেও মাধ্যম ও আঙ্গিকের বহুমাত্রিকতা আছে, এখানকার দুটি কাজই ব্রোঞ্জ ও বর্ণিল কাঠের সমন্বয়ে তৈরি। শিরোনাম ‘পণ্ডিত অ্যান্ড মাস্ক’ ও ‘ট্রাইবাল লেডি’। দুটিতেই আদিমতার অনুষঙ্গ
আছে। তাপস বিশ্বাসের ‘হ্যাড ইট বিন সো’ শীর্ষক ব্রোঞ্জের রচনাটিতে ছড়ানো জালের ওপর অজস্র মানুষের আনন্দদীপ্ত সঞ্চলন দেখা যাচ্ছে। আঙ্গিকের দিক থেকে একেবারেই ব্যতিক্রমী রচনা এটি। তেমনি ব্যতিক্রর্মী দেবতোষ ঘোষের কাজ দুটি। ‘এনলার্জড টুথব্রাশ’ রচনাটি ইস্পাত ও কাঠে তৈরি। একটি টুথব্রাশের ব্রিসলগুলো ছড়িয়ে আছে। এই হলো বিষয়। ‘এনলার্জড কম্ব’ রচনাটিও কাঠ ও ইস্পাতভিত্তিক মিশ্র মাধ্যমে তৈরি। ওপর থেকে ঝুলছে পাটের তৈরি একরাশ চুল। তার ভেতর একটি সবুজ চিরুনি গাঁথা রয়েছে। গৌতম দাসের টেরাকোটা ‘দ্য চেয়ার’ নয়টি বর্গাকার স্ল্যাবের সমন্বয়ে তৈরি, যার সবগুলিতেই চেয়ারের বিভিন্ন রূপ নিয়ে খেলা। সুতনু চ্যাটার্জির ব্রোঞ্জ ‘আফটার ডিজাস্টার’কে বলা যেতে পারে রূপের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। একটি মুখ ভূমিতে পড়ে আছে। তার ওপর একটি উড্ডীয়মান পাখির ডানা। সুব্রত বিশ্বাস লৌকিক আঙ্গিককে কল্পরূপে অভিষিক্ত শৈশব স্বপ্নের আলেখ্য গড়ে তোলেন। ‘ফাইটিং টেররে’ গ্যাস সিলিন্ডারসদৃশ লম্বভাবে দাঁড় করানো একটি বস্তুর ওপর একটি বিড়াল। তার ওপর বসে আছে একটি বালক। তার দুই হাতে ধরা দুটি ছোরা। ‘টেন্ডার ফ্ল্যুট’ রচনায় দুটি পশুর ওপর দাঁড়িয়ে একটি বালক বাঁশি বাজাচ্ছে।
এই সামগ্রিক সমীক্ষায় বাংলার সমকালীন ভাস্কর্যের ভাব ও আঙ্গিকে রূপান্তর বা বিবর্তনের কিছু আভাস হয়তো পাওয়া গেল। কিন্তু এটাই সম্পূর্ণ নয়। কেননা, আরো অনেক শিল্পী এই সময়ে কাজ করছেন। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের অনেকেই প্রচলিত রীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সকলকে একটি প্রদর্শনীতে পাওয়া সম্ভব নয়। ভাস্কর্য একটি শ্রমসাধ্য ও ব্যয়সাধ্য মাধ্যম। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার খুবই অভাব এখন। তা সত্ত্বেও ভাস্কর্যের সৃজনপ্রক্রিয়া যে থেমে নেই, এটা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ঘটনা।

Leave a Reply