ন জ রু ল ই স লা ম
১৯৪৮ সালে ঢাকায় সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর বড় মাপের প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনা নিঃসন্দেহে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা। এ জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এর মূল পরিকল্পনাকারী। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য-স্বাধীন অতি দরিদ্র দেশে সুকুমার শিল্পের প্রতি উদার ও শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সমর্থন সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল জাতীয় প্রদর্শনী আয়োজনের ও পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চিত্র-প্রদর্শনীর। প্রথম জাতীয় প্রদর্শনীটি বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতে, ১৯৭৫-এর এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৮১ সালে, প্রথম এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। পরবর্তী তিন দশক এই দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীর প্রায় নিয়মিত আয়োজন অবশ্যই প্রশংসনীয়।
সত্তরের দশকেই আমরা দেখেছি প্রবীণ শিল্পী এস এম সুলতানের সাড়া জাগানো সমাজবাস্তবতার প্রতীকী শিল্পকর্ম, মূলত গ্রামীণ জীবন ও সংগ্রাম যার মূল প্রেরণা। পাশাপাশি আরেক প্রবীণ শিল্পী কামরুল হাসানের হাতে অন্যরকম সমাজবাস্তবতার চিত্রায়ণ, যেখানে স্বাধীনতা-উত্তর সমাজের, বিশেষ করে নাগরিক সমাজের, অসামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি তীক্ষè বিশ্লেষণে চিত্রায়িত হয়েছে। প্রবীণ শিল্পী আমিনুল ইসলাম উপকরণে, আঙ্গিকে ও শৈলীতে ব্যাপক নতুনত্ব এনেছেন। তবে অন্যান্য অনেক প্রবীণ শিল্পী আগের মতোই সত্তরের দশকেও শিরোনামহীন বিমূর্ত চিত্রনির্মাণে ব্যাপৃত থেকেছেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটানো হয়। পরবর্তী পনেরো বছরে সামরিক শাসনামলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন নির্বাসিত হয়। জাতীয়তাবাদের অর্থই বদলে ফেলা হয়। আশির দশক পুরোটাই ছিল সামরিক শাসনাধীন। প্রথম সামরিক শাসকের মনমানসিকতায় চারুশিল্পের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি ছিল এমন মনে করার কারণ না থাকলেও তার আমলেই প্রথম এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বঙ্গভবনের সামনে হামিদুজ্জামান খানের তিনটি ঊর্ধ্বমুখী পাখির চমৎকার স্টেইনলেস স্টিলের ভাস্কর্যটিও ১৯৮১ সালের কাজ। পরবর্তী সামরিক স্বৈরশাসক নিজেকে একজন কবি হিসেবে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করতেন। তাঁর দীর্ঘ নয় বছরের শাসনামলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে জাতীয় প্রদর্শনী ও এশীয় দ্বিবার্ষিক প্রদর্শনীসমূহ অনুষ্ঠিত হয়েছে। চারুশিল্পের সৃজনকর্মের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো বাধানিষেধ ছিল বলে মনে হয়নি, তবে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি চর্চাকারী এক শিল্পী উচ্চতম মহলে যথেষ্ট সমাদৃত হতেন। সাধারণভাবে বিমূর্ত ধারার কোনো কোনো শক্তিশালী শিল্পীকেও দেখা গেছে সাময়িকভাবে আরবি ক্যালিগ্রাফি-নির্ভর ক্যানভাস চিত্র সৃজনে উৎসাহী হয়েছেন। তবে ব্যাপকভাবে আশির দশকের অনেকটাই চিহ্নিত করা যায় পূর্ববর্তী দশকসমূহের প্রিয় বিমূর্ত বা সমবিমূর্ত আঙ্গিকের অনুসরণকারী রূপে।
সত্তরের দশকে এক ঝাঁক প্রতিভাবান তরুণ শিল্পীর সৃজনশীল শিল্প তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। এঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন ষাটের দশকের মনিরুল ইসলাম, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, অলক রায়, শহীদ কবির, বীরেন সোম, আবুল বারক আলভী, হামিদুজ্জামান খান, আবদুস সাত্তার, কালিদাস কর্মকার প্রমুখ। সত্তরের দশকেই আবির্ভূত শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন, শাহাবুদ্দিন, স্বপন চৌধুরী, চন্দ্র শেখর দে, ফরিদা জামান, নাঈমা হক, তরুণ ঘোষ, নাসিম আহমেদ নাদভী প্রমুখ সত্তরের দশক ও পরবর্তী সময়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এঁদের অধিকাংশই পূর্ববর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের প্রদর্শিত বিমূর্ত ও সমবিমূর্ত শৈলীর ধারায় মূলত অরাজনৈতিক চিত্রকর্ম সৃজন করেছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন চন্দ্র শেখর দে, শাহাবুদ্দিন ও হামিদুজ্জামান, তাঁদের প্রধান প্রেরণা ছিল মুক্তিযুদ্ধ। চন্দ্র শেখর অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই অলংকরণমূলক অবয়বী বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন। হামিদুজ্জামান খান সত্তর ও আশির দশকজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরীহ মানুষের ওপর সংঘটিত নৃশংসতা বিষয়ক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য ও মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব প্রকাশ করেছেন ব্রোঞ্জ ও স্টিল মাধ্যমের ভাস্কর্যে। শাহাবুদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাকেই করেছেন তাঁর চিত্রকলা সৃজনের মূল চরিত্র। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের পাঠ শেষে তিনি বৃত্তি নিয়ে প্যারিসে শিল্পচর্চার সুযোগ পান। সেখানে ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে নিজস্ব শৈলী নির্মাণ করেন। সুগঠিত পেশিবহুল মুক্তিযোদ্ধার প্রচণ্ড গতিশীলতা আকর্ষণীয় বিন্যাসে বিশাল আয়তন ক্যানভাসে উপস্থাপন করেন। তখনকার প্রচলিত বিমূর্ত বা সমবিমূর্ত এবং পরাবাস্তব আঙ্গিকের বিপরীতে তাঁর অবয়বপ্রধান নব্য-বাস্তবধর্মী আঙ্গিক ইউরোপের শিল্পাঙ্গনেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। অপরদিকে প্রবাসী শিল্পী মনিরুল ইসলাম (ফ্রান্সে) ও কাজী গিয়াসউদ্দিনের (জাপানে) প্রতীকধর্মী ও বিমূর্ত আঙ্গিকও আন্তর্জাতিক শিল্প মঞ্চে উচ্চ প্রশংসা লাভ করেছে। এরকমটি সম্ভব হয়েছে তাঁদের কাজের স্টাইল ও কুশলতার জন্য। তাঁদের উভয়ের কাজেই মাতৃভূমির নানা স্মৃতি জাগানিয়া ঘটনা ও প্রতীক সূক্ষ্মভাবে জায়গা করে নিয়েছে। দুজনেই রং ব্যবহারে অত্যন্ত হিসাবি।
সত্তর ও আশির দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিলাভে সমর্থ হয়েছেন আরেক শিল্পী কালিদাস কর্মকার। প্রতীকনির্ভর পরাবাস্তব সৃজন কালিদাসের। তিনি টেক্সচার-নির্মাণে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উৎসাহী। উত্তর-আধুনিক শিল্পশৈলী ইনস্টলেশন বা স্থাপনা দৃষ্টান্তের অন্যতম সূচনাকারী কালিদাস কর্মকার। হামিদুজ্জামান খান স্থাপনাশিল্পের অপর এক পাইওনিয়ার। অলোক রায় মৃৎশিল্পকে সৃজনশীল ভাস্কর্য স্থাপনায় উন্নত করেছেন। সত্তরের শেষে তাঁর উদ্ভাবনী শৈলীর শুরু এবং আশি, নব্বই ও শূন্য দশকে তাঁর উত্তরোত্তর বিকাশ। ছাপচিত্রে মুন্শিয়ানা দেখিয়েছেন গ্রিসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী রফিকুন নবী এবং ভারতে শিক্ষাপ্রাপ্ত আবদুস সাত্তার।
বাংলাদেশে আশির দশকে আবির্ভূত প্রতিভাবান শিল্পীদের সংখ্যা রীতিমতো বিস্ময়কর। দশকের শুরুতে কিছু শিল্পীর বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা শিল্পচর্চায় নতুন ধারার সূচনা করতে থাকে। সমাজের নানা অসংগতিপূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতি তরুণ কিছু শিল্পীকে ব্যঙ্গ-রসাত্মক বক্তব্য বিশেষ শৈলীর মাধ্যমে উপস্থাপনায় উৎসাহিত করে। মূলত কার্টুনধর্মী ড্রইং ও পরাবাস্তব আঙ্গিকে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন এই ধারার শিল্পীরা। শিশির ভট্টাচার্য, নেসার হোসেন, ঢালী আল মামুন, সাইদুল হক জুইস, দিলারা বেগম জলী, নীলুফার চমন প্রমুখ শিল্পী যথার্থ উত্তর-আধুনিক চিন্তা-চেতনার শিল্পী।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে একই সঙ্গে বিমূর্ত ও প্রতীকধর্মী শিল্পশৈলীর অনুসরণও দেখা গেছে। জি এস কবির, শাহাদত হোসেন, তরুণ ঘোষ, মোমিনুল রেজা, রোকেয়া সুলতানা, মোহাম্মদ ইউনুস, নাজমা আখতার, খালিদ মাহমুদ, মোখলেসুর রহমান প্রমুখ এ ধারার প্রতিভাবান শিল্পী। বক্তব্যপ্রধান অবয়বী আঙ্গিকের শিল্পী রনজিৎ দাস, নাজলী লায়লা মনসুর, আতিয়া ইসলাম এ্যানী, দীপা হক, মোহাম্মদ ইকবাল প্রমুখ। সমাজের সমস্যাজর্জরিত মানুষ, বিশেষ করে নির্যাতিত নারী ও শিশু এঁদের বিষয়। আশির দশকের অন্যতম প্রধান শিল্পী রোকেয়া সুলতানা প্রথম দিকে শহুরে মধ্যবিত্ত নারী ও শিশু, নগরীয় অব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছুটা ‘নাইভ’ ধরনের ড্রইং-সংবলিত আকর্ষণীয় ছাপচিত্র সৃজন করেছেন। পরের দিকে ‘মাটি, জল ও হাওয়া’ শীর্ষক পরিবেশকেন্দ্রিক রংফর্ম-ভিত্তিক অসাধারণ বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন, এসব কাজের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সমকালীন উত্তর-আধুনিক শৈলীর অন্যতম উদাহরণ বিশাল ক্যানভাসজুড়ে অতিবাস্তব ধারার মানব প্রতিকৃতি। জামাল আহমেদ বাংলাদেশের এ-ধারার কৃতী শিল্পী। তাঁর ব্যক্তিচরিত্রসমূহ সাধারণ নারী ও পুরুষ, বিশেষত নারীমুখ। যৌন সম্পর্ক বিষয়ও তাঁর প্রিয়। জামাল নদী-নিসর্গ ও নগরদৃশ্যও বাস্তবানুগভাবে তুলে ধরেন। নব্য-বাস্তববাদী অন্যান্য কৃতী শিল্পী শেখ আফজাল, আহমদ শামসুদ্দোহা, শাহজাহান বিকাশ প্রমুখ। শেখ আফজাল নগর ব্রাত্যজনের জীবনযাপন অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে উপস্থাপন করেন, শামসুদ্দোহা পরাবাস্তব আঙ্গিকে নিসর্গ ও জনপদ পুনর্নির্মাণ করেন। বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি আঁকেন তাঁর নিজস্ব সহজিয়া স্টাইলে, প্রায় এক রঙা কাজে। নাসরিন বেগম জলরঙে অনবদ্য পরাবাস্তব নিসর্গ ও নগরদৃশ্য কিংবা নারীচরিত্র অঙ্কন করেন। মোহাম্মদ ইকবালের প্রিয় বিষয় শঙ্কিত শিশুমুখ। উপস্থাপনার ভঙ্গি নতুন, শিশুর বিস্ফারিত চোখ, অথবা মুখের বহুমাত্রিক অতিবাস্তবতা ইকবালের বক্তব্যে রহস্যময়তা আরোপ করে। তরুণ শিল্পী কামালউদ্দিন, বিশ্বজিৎ গোস্বামী ও শারদ দাস মানুষের অসহায়ত্বে পরাবাস্তব প্রকাশ রাখেন ক্যানভাস পেইন্টিং মাধ্যমে। ‘দেহ বৃক্ষ’ এবং মানবদেহের খণ্ডিত অংশবিশেষকে অতিবাস্তব পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেন তরুণ আশরাফুল হাসান।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকের এবং একবিংশ শতাব্দীর শূন্য দশকের বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় প্রাধান্য পেয়েছে উত্তর-আধুনিক প্যারাডাইমের বৈশিষ্ট্যসমূহ। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনের সঙ্গে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছেন আমাদের শিল্পীরা। ঢাকার বাংলাদেশ বিয়েনাল, অন্যান্য এশীয় বিয়েনাল ও ত্রিয়েনাল কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, অধিক মাত্রায় শিল্পকলা বিষয়ক লেখালেখি ও প্রকাশনা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আমাদের নবীন শিল্পীগণ সমকালীন আধুনিক শিল্পচিন্তা ও শৈলী ও কলাকুশলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন।
সমকালীন শিল্পকলার প্রিয় মাধ্যমসমূহ যেমন ভাস্কর্য, স্থাপনা, ডিজিটাল প্রিন্ট, ভিডিওচিত্র, আলোকচিত্র, কোলাজ ও মিশ্র মাধ্যম ইত্যাদির অনুশীলনে এদেশের শিল্পীদের আগ্রহ বেড়েছে। নব্বইয়ে আবির্ভূত এবং শূন্য দশকে ও পয়লা দশকের শুরুতে স্বীকৃতি পাওয়া তরুণ মেধাবী শিল্পীদের সংখ্যা প্রশংসনীয়। এঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বলে মনে করা যায় মাহবুবুর রহমান, তৈয়বা বেগম লিপি, ইমরান হোসেন পিপলু, ওয়াহিদুজ্জামান প্রমুখকে। মাধ্যম ছাড়াও বিষয় বক্তব্যও এই শিল্পীদের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। নারীর অবস্থান তৈয়বা লিপির প্রধান বিষয়।
মিশ্র মাধ্যম, স্থাপনাশিল্প, ভিডিওচিত্র ইত্যাদি সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারার সঙ্গে তাল মিলিয়েই যেন বাংলাদেশের রাগী তরুণ শিল্পীগণ নতুন নতুন মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং এসবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। মিশ্র মাধ্যম, স্থাপনা বা ইনস্টলেশন, নির্মাণ বা কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি শিল্পকলার মাধ্যম হিসেবে ইতোমধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ডিজিটাল ফটোগ্রাফি ও ভিডিওচিত্রও অনুরূপ সমকালীন আধুনিক মাধ্যম, উত্তর-আধুনিকই বলা সংগত। উত্তর-আধুনিক শিল্পকলা সনাতন বা আধুনিক শিল্পের মতো তেমন করে ‘সংগ্রহের’ বিষয় নয়, এর নির্মাণ ও দর্শনই হয়তো যথেষ্ট। ‘পাবলিক আর্ট’ বা ‘অংশগ্রহণমূলক শিল্পকর্ম’, অর্থাৎ শিল্পীর সঙ্গে দর্শকও শিল্পকর্ম সৃজনে অংশ নিতে পারেন, এমন প্রক্রিয়াও উত্তর-আধুনিক শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য। বস্তুত শিল্পের কোনো ধরাবাঁধা সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই, একথা এখন বিশেষ জোর দিয়েই বলা যায়, বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলার বেলাতেও প্রত্যয়টি প্রাসঙ্গিক।
একইভাবে বলা যায়, শিল্পী হবার জন্য শিল্পশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অর্থাৎ আর্ট স্কুল বা কলেজে দীর্ঘ মেয়াদের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা অর্জনও আবশ্যক নয়। শিল্পী সত্তাই বড় কথা এবং সেই সত্তার বিকাশের জন্য অব্যাহত তীব্র আকাক্সক্ষা ও একাগ্র অনুশীলন ১৫তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ ২০১২-তে গ্র্যান্ড প্রাইজ পাওয়া বাংলাদেশের স্বশিক্ষিত শিল্পী কাজী সালাহউদ্দিন আহমেদ চমৎকার দৃষ্টান্ত। তাঁর বিশাল আয়তন কোলাজটি মিশ্র মাধ্যমের ‘শিয়ার ক্যাওস’ বা ‘নেহাতই নৈরাজ্য’ শীর্ষক নিঃসন্দেহে একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম, প্রদর্শনীর অন্যতম সেরা কাজ। সালাহউদ্দিন একনিষ্ঠ সাধনায় একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন, নিজস্ব একটি স্টাইল নির্মাণ করতে পেরেছেন। নগরব্যবস্থার নৈরাজ্যকর পরিবেশ তাঁর শিল্প-অন্বেষার অন্যতম প্রেরণা। সালাহউদ্দিন স্বশিক্ষিত তবে পূর্ণকালীন পেশাদার শিল্পী। প্রায় আট দশক আগে এক মহান বাঙালি কবি স্বশিক্ষিত শিল্পী হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শুরুতে স্বশিক্ষিত শিল্পী সালাহউদ্দিনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
বাংলাদেশের শিল্পকলার নানামুখী উন্নয়ন ও তৎপরতা দেখে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীরভাবে আশাবাদী হতে পারছি।