বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম গুণী ও প্রতিভাদীপ্ত প্রতিনিধি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ বলা যায় বেশ অপরিণত বয়সেই সবাইকে ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দিলেন। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে জীবিত ও সুস্থ প্রাণীরাই শুধু বেঁচে থাকতে পারে শারীরিকভাবে। কিন্তু অসাধারণের বেলায় তা নয়, তাদের দেহগত অসিত্মত্ব শেষ হলেও ওরা বেঁচে থাকেন অসামান্য কালজয়ী ও অগ্রসর চিন্তাবাহিত সৃষ্টির মধ্যে যা আগামী প্রজন্মকে উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাময় দিকনির্দেশনা দিয়ে যায় চিরকালীন এক উদাহরণ হিসেবে। খালিদ সেই নিরিখে যতটা একজন ভাস্কর তার চাইতেও তিনি ছিলেন বেশি সৌন্দর্যপ্রেমী এবং সৃষ্টিশীল শিক্ষক-শিল্পী। সেই ১৯৪২ সালে জন্ম সিলেটের এক বনেদি ধর্মপ্রাণ পরিবারে। তখন সমাজ ছিল শিল্প ও শিল্পী-পৃষ্ঠপোষকতাহীন, অপ্রগতিশীল ও কূপম-ূকতাপূর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, যদিও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৪৮ সালে সেই বৈরী পরিবেশে ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিপরীত স্রোতের বিরুদ্ধে অসীম সাহসের সঙ্গে আর্ট স্কুল স্থাপন করেছেন। তবে ছবি আঁকা যতটা অনুকূলতা পেয়েছিল সেই তুলনায় ভাস্কর্যশিল্প চর্চার শুরু হয়েছিল অনেক পরে। তখনো ভাস্কর্যশিল্প মূর্তি তৈরির মতো বলে ভাবা হতো ধর্মীয় ভ্রান্ত ধারণায় এবং অপব্যাখ্যায়। ধর্মে মূর্তিপূজা কোথাও নিষিদ্ধ কিন্তু ভাস্কর্যশিল্প চর্চা করা বারণ নয়। কেননা ভাস্কর্য-চর্চা শিল্প-সৌন্দর্য সৃষ্টির এক মহত্তম মাধ্যম এবং কোনো ধর্মে সৌন্দর্য সৃষ্টি কখনো নিষিদ্ধ নয়। এই বোধ ও অভিজ্ঞানে ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতায় ভাস্কর-শিল্পীস্রষ্টারা সুগম কাঙিক্ষত পথে শিল্প সৃষ্টির সহযাত্রী হতে প্রভূতভাবে সাহায্য করে আসছেন সেই আদিকাল থেকে। দৃশ্যমান ত্রিমাত্রিক ত্রিতলবিশিষ্ট যে কোনো পদার্থ প্রথমেই দৃষ্টিধারী তা যে কাউকে আকৃষ্ট করে। সেই বিবেচনায় দ্বিমাত্রিক আঁকা-আঁকির চেয়ে ত্রিমাত্রিকতা আগে শুরু হয়েছে, ইতিহাস তাই বলে। প্রাগৈতিহাসিক আমলে শিকারিদের জাদুকরী প্রভাবে শিকার করতে সহজ ও সাহায্য লাভ হবে এই আশায় তারা বিভিন্ন ধরনের মূর্তি ও ভাস্কর্য তৈরিতে সেগুলোর লক্ষ্যভেদে উৎসাহিত হতো এবং সফল হলে প্রাপ্তি এরকম ভাবত। এই কার্যক্রম তাদের এক সামাজিক ও দলীয় প্রথা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ভাস্কর্যশিল্প মানুষের জীবন-ইতিহাসময়তায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরে তা ব্যবহৃত হতে থাকে নানান ধর্মের দেবতা বা দেবীর মূর্তিধারণে, সেই সঙ্গে চিরস্থায়ী অমরতার আশায় রাজা-সম্রাট ও রানী-সম্রাজ্ঞীদের অবয়ব নির্মাণেও। পাথর-মর্মর – এসব নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার চিরকাল টিকে থাকতে সাহায্য করে। সেজন্যে যুগে যুগে এই ভাস্কর্য সৃষ্টির পথ-পরিক্রমা তাদের জন্যে অপরিহার্য আবশ্যিকতায় রূপ নেয় এবং তা এখন পর্যন্ত প্রবহমান ধর্মে ও ব্যবহারিকতায়। প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে ভাস্কর্যশিল্পের বিকাশ শুরু হয় এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর থেকে মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু উপত্যকা ও চীন হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১২৫০-এর ইজিয়ান সভ্যতা, খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-এর গ্রিক সভ্যতা যেখানে বলা হতো মানুষই হচ্ছে সবকিছুর মাপকাঠি। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৭-৬ শতাব্দীর রোমান সভ্যতা থেকে প্রাক-খ্রিষ্টীয় ভাস্কর্য, পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক-রোমান, ১১-১২ শতাব্দীর রোমানেস্ক, গথিক, ইটালিতে ১৪ শতাব্দীর রেনেসাঁস বা পুনর্জাগরণে, যে সময়ে ধর্মীয় অনুশাসনের দেব-দেবী থেকে মানুষের সাধারণত্বে শিল্প-সাহিত্য-স্থাপত্য-ভাস্কর্য-বোধ-চিন্তা-মনন – সবকিছুতে নতুন মাত্রার উত্তরণ ঘটে যা আধুনিক যুগের সূচনাকাল বলে চিহ্নিত। পরের ধারাবাহিকতায় সব কালজয়ী ভাস্করের আবির্ভাব হয় পশ্চিমা বা ইউরোপীয় শিল্পজগতে যেমন ১৩ শতাব্দীতে নিকালো পিসানো, ১৫-তে ডোনাতেল্লো, গিবার্টি, কোয়েরসিয়া এবং ১৬-তে সবকালের সর্বশিরোমণি হিসেবে আখ্যায়িত স্রষ্টা মাইকেলোঞ্জেলো যার সৃষ্টিধারাকে ম্যানারিজম বা কিছু বৈশিষ্ট্যময় রীতির বারবার ব্যবহারে সৃষ্ট – এমন বলা হয়। ১৭ শতাব্দীতে বারোক, রোকোকো, ১৮-তে নিও ক্ল্যাসিক বা নব্য ধ্রম্নপদী ও রোমান্টিক বা ভাববিলাসী-কল্পনাপ্রবণ-বাস্তবধর্মিতার বিপরীতমুখী এবং ১৯-এ অগাস্ট রদাঁ যিনি ইকোল দে বোজ-আর্টস স্কুলে তিন-তিনবার পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারেননি প্যারিসে থেকে, অথচ পরে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন তার অনুপম ভাস্কর্য সৃষ্টির কারণে। বলা যায় রদাঁ থেকেই বিংশ শতাব্দীর ভাস্কর্য নতুন পথে যাত্রা শুরু করে। এই যুগ বিভিন্ন প্রকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন ভাবনা, রীতি, নির্মাণসামগ্রীসহ মানুষের অন্তর্বাহিত স্বপ্ন, ধারণা, আবেগ নিয়ে নানান চিন্তায় ভাস্কর্যের আকার, পরিসর, পরিমাপ, পরিমাণ ও প্রকরণ – সবকিছুতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ হয়। সেই সঙ্গে পোড়ামাটি, পাথর, ধাতু-লোহা, ব্রোঞ্জ, দারু বা কাঠ – এসব ছাড়া পস্নাস্টিক, ইস্পাত ঢালাই, আসবাবপত্রের ভাঙা অংশ, মোটরগাড়ি বা উড়োজাহাজের পরিত্যক্ত দুমড়ানো-মুচড়ানো অব্যবহারযোগ্য উপাদান, আলোকচিত্র, গাছের শেকড়-ডালপালা-গুঁড়ি, পাথরখ-, চলমান চিত্র, শব্দ, সংগীত – সবকিছু নিয়েই ভাস্কর্যশিল্প নতুন সীমানায় সীমাহীনভাবে সৃষ্টিশীল ভাস্করদের সৃষ্টি বৈচিত্র্যে দৃশ্যমান হতে থাকে। কেননা ভাস্কর্য হচ্ছে অনুচ্চ ও উচ্চাবচের দৃশ্যমান শিল্প এবং তার অসিত্মত্ব প্রকাশিত করে না বরং নিজের অসিত্মত্বকে সরবে ও সগৌরবে ঘোষণা করে। এই একবিংশ শতাব্দীতে ভাস্কর্যশিল্পের পরম্পরা সব দেশেই এরকমভাবে প্রবাহিত বিভিন্ন আঙ্গিকে, প্রকরণে আর সৃষ্টিশীল শিল্প কার্যক্রমে। আমাদের দেশেও তার অন্যথা নেই। ব্রিটিশ আমলে আমরা দেশজ বা লোকজ শিল্পের পাশাপাশি আধুনিক ভাস্কর্য ও শিল্পের দেখা পাই। শিল্পে রং ব্যবহার বিভাজন, বুনুনি, মূর্ত, বিমূর্ত, জ্যামিতিক প্রকরণ-বিন্দু, রেখা, ত্রিভুজ, বর্গ, আয়ত; মননে দুঃখ-সুখ, আনন্দ-হতাশা, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন – সব শিল্পীর পটে বা ভাস্করের কাঠামোতে তাদের সৃষ্টি শৈলী ও বিষয় অনুসারে বিধৃত হয়ে থাকে। এভাবেই সেই শিল্পস্রোত বয়ে চলেছে একমনে একযোগে এক নিবিড় সৌন্দর্য-সুষমা সৃষ্টির লক্ষ্যেএবং আমরা বা আমাদের শিল্পী-ভাস্কর-স্রষ্টাগণ সেই শিল্পযাত্রার গর্বিত শিল্পপথিক। পশ্চিমাদের পাশাপাশি ভারতেও ভাস্কর্যসহ চিত্রকলা, স্থাপত্য ও অন্যান্য শিল্প-সংগীত, নৃত্য, নাট্যকলা পৃথক আঙ্গিক ও পরিচয়ে বিকশিত হয়। শিল্প তা যে কোনো মাধ্যমেরই হোক না কেন, তার চারিত্র্য সর্বজনীন কিন্তু এ চর্চিত ও ব্যবহৃত হয় যে দেশ, পরিবেশ বা প্রতিবেশে, সেখানের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিম-ল অনুযায়ী গড়ে ওঠে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপের মতো আমরাও রাজতন্ত্র, ধর্ম, পুঁজিবাদ ও আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতিতে শাসিত ও শোষিত ছিলাম আর এসবের সঙ্গে ছিল দাস ও বর্ণপ্রথার অমানবিক প্রচলন যা শিল্পবিপস্নবের বিসত্মার-সময় পর্যন্ত টিকে ছিল। বলা হয় ধর্মের বিকাশ হয় এশীয় বা পুরনো বা প্রাচ্য দুনিয়ায় আর বিজ্ঞান ইউরোপীয় বা নতুন বা প্রতীচ্য-পাশ্চাত্যবিশ্বে। ধর্মবিশ্বাস ও চর্চা যেখানে নতুন চিন্তা বা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনগ্রসর সেই তুলনায় বিজ্ঞান অগ্রসর ও প্রবহমান। পৃথিবী নামক গ্রহ সূর্যকেন্দ্রিক, বিদ্যুৎ ও বাষ্প যন্ত্র আবিষ্কার ফলে রেল, জাহাজ, মোটর যানবাহন প্রবর্তনে ইউরোপীয় দেশকর্তৃক উপনিবেশিক শক্তি নামে এক নতুন রাজনৈতিক হাতিয়ারের সাহায্যে এশিয়াসহ আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা দখল ও শাসন শুরু যেহেতু তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শক্তিধর এবং কৌশলী হয়ে উঠেছিল অন্যান্য দেশের চেয়ে। ১৭৫৭ সালে ভারত ইংরেজদের উপনিবেশে পরিণত হলো। ১৯০ বছর চলল এভাবে। এর মধ্যে তারা বিশ্ব ঐতিহ্যের অসাধারণ বয়নশিল্প তাদের ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক স্বার্থে চিরকালের জন্য মুছে দিল, সেই মসলিন শিল্প আর দেখা যাবে না। তাই এই অমার্জনীয় অপরাধের জন্য তাদের জাতিসংঘের বিশ্ব আদালতে বিচার শুরু করা প্রয়োজন অসামান্য এক বিশ্ব শিল্পের সম্মানার্থে। এর সঙ্গে নীলচাষের অরাজকতা ও বাড়াবাড়ি আছেই। তবে স্বীকার্য যে, ব্রিটিশ আমলেই দুটি বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪-১৮ ও ১৯৩৯-৪৫-এ কালাতিপাত, রাশিয়ার সমাজতন্ত্র, আণবিক বোমার ভয়াবহতা, ফ্রয়েড-ইয়ুংয়ের মনোজগৎ চর্চা – সব আধুনিক বা সাম্প্রতিক শিল্পবোধে আমাদের ঋদ্ধ করে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যসহ। খ্রিষ্টপূর্ব ২-৩ শতাব্দীর বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ ও ইসলামি শাসনের নানান সময়ে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, মূর্তি স্থাপনা গড়ে ওঠে। ৭-৮-১২ খ্রিষ্টাব্দে ময়নামতি, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় ও সম্প্রতি আবিষ্কৃত উয়ারীবটেশ্বরে দেব-দেবী ও বৌদ্ধমূর্তি অনবদ্য সৃষ্টি কুশলতায় বিরাজ করেছে যেখানে প্রস্তর, ঢালাই ধাতু, পোড়ামাটি ও কাঠ বা দারু তক্ষণ রীতি ব্যবহৃত হয়েছে অপূর্ব বিন্যাসে। এসবে ভাস্কর বা শিল্পী, ধর্মযাজক ও পৃষ্ঠপোষক রাজন্যবর্গের – এই ত্রিবিধ সাহায্য-সহযোগিতায় দেখা যায় মূর্তিতত্ত্বের রূপায়ণ ও নান্দনিক দক্ষতা। এরূপ ভাস্কর্য ধর্মীয় আবেগপ্রসূত হলেও দেব-দেবী দর্শনে শক্তির জাগরণ, শামিত্মর বরাভয় ও প্রসন্নতা-পবিত্রতার অনুভূতি নিবিড় ভক্তিতে যাতে দর্শক-ভক্তের মনে উদ্ভাসিত হয়, সেটিই বিবেচ্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। দেব-দেবী বা বুদ্ধের ভাস্কর্য-মূর্তি সব প্রশস্ত বেদির ওপর ন্যস্ত হতো যাতে উঁচু-হয়ে বসানো অবয়ব দূর থেকে দেখা যায় মানুষের উচ্চতা থেকে, সেগুলো বড় করে দেখালে দর্শকদের মনে শ্রদ্ধা-ভক্তি বাড়ে। মাথার পেছনে সূর্য বলয়, আশপাশে নকশা, ফুল, পাখি, ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বর্ণিত সাপ বা প্রাণী-জীব-জন্তুর উপস্থিতি দেখা যায়। পৌরাণিক কাহিনি ছাড়াও সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের নানান দৃশ্য পোড়ামাটি কর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় যেটা বলা যায় ধর্ম ও মানুষের জীবনযাত্রা একই পরিসরে দৃশ্যমান যেমন ১৭২২ সালে সৃষ্ট দিনাজপুরের কান্তজী মন্দিরে এবং অবশ্যই তা সেই সময়ের প্রেক্ষিতে খুব অগ্রসর ও আধুনিক চিন্তায় এবং মননে। ইংরেজদের দ্বারা প্রবর্তিত খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবসেত্মর ফলে যে নব্য ধনী জমিদার শ্রেণি এবং বাবু সংস্কৃতির শুরু হলো তার ফলে চিত্রকলা, সংগীত, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যশিল্পের বিকাশ ঘটে, এ কথা অনস্বীকার্য। তবে বহমান শিল্পধারার স্বাভাবিকতা ইংরেজদের কারণে দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল। এ সময়েই কলকাতায় ১৮৫৪ সালে ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট বা উৎপাদন শিল্প শিক্ষালয়’ স্থাপিত হয় এবং শিল্পজগতে পাশ্চাত্য শিল্প ও প্রাচ্যধারার মেলবন্ধনে নতুন এক শিল্প-পরিসরের সৃষ্টি হয়ে আধুনিক শিল্পকে জানা ও বোঝার পরিবেশ সামনে চলে আসে। তখন ভাস্কর্যে স্বশিক্ষিত ভাস্কর নবকুমার পাল তার ভাস্কর্যশিল্প সৃষ্টিতে এতটা সফল হয়েছিলেন যে, তাকে সেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের একজন শিক্ষক হিসেবে মনোনীত করা হয়। কৃষ্ণনগরের যদুনাথ পালসহ ইটালি-শিক্ষাপ্রাপ্ত রোহিনীকান্ত নাগ, বরিশালের শীতলচন্দ্র ব্যানার্জি, বিক্রমপুরের ফণীন্দ্রনাথ বসু – এরকম অনেক প্রতিভাধর ভাস্করের নাম উল্লেখ করা যায় যারা ভাস্কর্যশিল্পে তাদের অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। প–তব্যক্তিরা বলেছেন, ভারতের ভাস্কর্য সৃষ্টি বিশেষ করে পাথরের, তার সঙ্গে গ্রিক ভাস্কর্যের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়, বিশেষ করে উড়িষ্যার ভাস্কর্যসম্ভার। সেই সময়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-শিক্ষায়তনে কৃষ্ণনগরের মৃন্ময় শিল্পীরা বংশগত পরম্পরায় এত অনবদ্য শিল্পকর্ম করতেন যে, যদুনাথ পাল তাদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, কলকাতা সরকারি শিল্প শিক্ষায়তনে ইবি হ্যাভেল ১৮৯৬ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার পরে ভাস্কর্যশিল্পকে ‘ফাইন আর্ট বা সুকুমার শিল্প’ হিসেবে গণ্য করেন। ভাস্কর্যশিল্প খুব শ্রমসাধ্য মাধ্যম তার সঙ্গে মননচর্চা তো আছেই। ভাস্কর্যে আধুনিকতা চিত্রকলা হয়েই রূপ নিয়েছে। প্রথম দিকে স্থাপত্যের অংশ হিসেবে দেখা দিলেও পরে পৃথক সত্তায় প্রকাশিত হয় এবং এতে চিত্রকরদের বিশাল অবদান রয়েছে। বাংলার ভাস্কর্যশিল্পের বিকাশ বলা যায় তা সর্বভারতের ভাস্কর্যরূপের প্রতিনিধিত্ব করে। এজন্য যশোরের হিরন্ময় রায়চৌধুরী তার ছাত্র দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী, যিনি জন্মগ্রহণ করেন রংপুরে, কৃষ্ণনগরের গোপেশ্বর পাল যিনি রবীন্দ্রনাথের সত্তর বছর জন্মানুষ্ঠানে মাত্র পাঁচ মিনিটে টাউন হলে কবির মৃত্তিকা-অবয়ব সৃষ্টি করে আলোড়ন তুলেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র অসিত কুমার হালদার, কলাভবনের প্রথম অধ্যক্ষ, প্রমথনাথ মলিস্নক – এরকম সৃষ্টিশীল ভাস্করদের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায়। তবে বেঙ্গল স্কুলের আদর্শে উজ্জীবিত শিল্পী ও ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী অসামান্য সৃষ্টিশীলতায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। তার ভাস্কর্য সৃষ্টি পস্নাস্টার ও ব্রোঞ্জে অনবদ্যতায় মুখর। তার বাবার প্রতিকৃতি, শীত যখন আসে, শ্রমিকদের বিজয়, রৌদ্র শিব, স্নানের পর রমনী – এসব বাস্তবমুখী, গতিময়, শরীরবিদ্যা সচেতন দেহভঙ্গিমা ও সৌন্দর্যে দুঃখ-কষ্ট, শ্রম, সামাজিক অবিচার প্রকাশে সাধারণ মানুষের সংগ্রামী মনোবল উঠে এসেছে, বিশেষ করে ছয়টি অবয়ব নিয়ে তার ‘শ্রমিকদের বিজয়’-এ, যা মাদ্রাজ ও দিলিস্নতে দেখা যায়। বাংলার ভাস্কর্যে তার সৃষ্টির জন্য তাকে আধুনিকতার সূচনাকারী বলা হয়। এর পরের সময়ে প্রকৃতপক্ষে ভাস্কর্যে আধুনিকতা শুরু হয় শামিত্মনিকেতনে ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ, যিনি বাঁকুড়ার এক দরিদ্র পরিবারের, যারা ক্ষক্ষŠরকর্মে নিয়োজিত ছিলেন সেই সাধারণ থেকে অসাধারণ পর্যায়ে আসা এক বিরল স্রষ্টার হাত ধরে। সুজাতা, সাঁওতাল পরিবার, দীপস্তম্ভ, রবিঠাকুরের অবয়ব – সব গতিশীল, বৈচিত্র্যপূর্ণ, জীবনীশক্তিময় আদিম অভিব্যক্তিতে এমন এক দৃষ্টিকাড়া গঠনে বিম্বিত যে আঙ্গিক ও শৈলী সম্পূর্ণ ভারতীয় শিল্পগুণে প্রতিষ্ঠিত। এই বোধের মূলে অবনীন্দ্রনাথ-হ্যাভেল প্রবর্তিত পাশ্চাত্য নয় প্রতীচ্য শিল্পদর্শনে শিল্প সৃষ্টি সময়ের দাবি, সেরকমই বাস্তবায়িত হতে হবে এবং রবিঠাকুরের শিল্পচিন্তা যা সবকিছুর ওপরে কোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবান্বিত না হয়ে সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত প্রকাশে সৃষ্টিমগ্নতা এই প্রকৃত আধুনিকতায় শিল্পচর্চার চিন্তা এবং সেই মতো ভারতীয় পরিচয়ে অগ্রসরতায় পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি লক্ষ্য করা যায়। রামকিঙ্করের সৃষ্টিশীলতায় পরিদৃষ্ট একই সঙ্গে প্রতীকী, প্রকাশবাদী, অভিব্যক্তিময়, বিমূর্ত-মূর্ত-অর্ধ-বিমূর্ত, পরাবাস্তববাদী, শক্তিধর ভারতীয় স্থৈর্য ও ধ্যানমগ্ন সৌন্দর্যের শিল্প-ঐতিহ্যময়তা। তারই পথ ও শিক্ষায় শিক্ষিত ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরী আধুনিক ভাস্কর্য বিশেষ করে স্টেনলেস স্টিলে অগ্রসর ও প্রগতিশীল ভাস্কর্যচর্চায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পরে ভারত ভাগের সময়ে বাংলার অখ- শিল্পজগৎও ভাগ হয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় সম্প্রসারিত নতুন পরিবেশ ও প্রতিবেশে স্থাপিত হলো। এখানে উল্লেখ্য যে, চিত্রকলা জয়নুল আবেদিন স্থাপিত চারুকলা স্কুলের শিক্ষিত ছাত্র ও কলকাতা থেকে চলে আসা শিক্ষকবৃন্দ-জয়নুল, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, শফিকুল আমিন, আনোয়ারুল হক প্রমুখ দ্বারা শুরু হলেও আধুনিক ভাস্কর্যশিল্প চর্চার প্রবর্তন হয় একজন মুসলিম নারী ভাস্করের মাধ্যমে যিনি ১৯৩০-এ চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ও ইংল্যান্ড থেকে ভাস্কর্যশিল্পে শিক্ষিত হয়ে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় আসেন। ইউরোপের অস্ট্রিয়া, ইটালি, ফ্রান্স ঘুরে ইংল্যান্ডে হেনরি মুর, বারবারা হেপওয়ার্থের আশীর্বাদ নিয়ে ভাস্কর্যশিল্প চর্চায় আত্মনিয়োগ করে এ দেশে আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ রূপে পরিচিতি লাভ করেন। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে ১৯৬৩-তে ভাস্কর্যশিল্প শিক্ষা //// ও শিল্পী আবদুর রাজ্জাক প্রথম ভাস্কর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত হন। পরে আনোয়ার জাহান, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ, হামিদুজ্জামান খান, আইভি জামান, শ্যামল চৌধুরী – এরা তাদের ভাস্কর্যশিল্প চর্চা ও সৃজনে একে একে আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পকে সচল ও ঋদ্ধমান করতে শুরু করেন। শিল্পী, ভাস্কর ও শিক্ষক সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের ভাস্কর-জীবন সার্বিকভাবে জানার উদ্দেশ্যে প্রাগুক্ত দীর্ঘ আলোচনা তার শিল্পকর্মকে বুঝতে সাহায্য করবে বলে পাশ্চাত্য, প্রতীচ্য, ইউরোপ, ভারত ও বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্প বিষয়ে এই আলোকপাত, একঘেয়ে বোধ হলে ক্ষমাপ্রার্থী। সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের জন্ম ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান নাগরিকত্বে, শিক্ষা-বেড়ে ওঠা পাকিসত্মানি হিসেবে আর কর্ম ও শিল্প সৃষ্টি বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয়ে, তবে জাতীয়তা বাঙালিই থাকল। তার এক জীবনে একই দেশে তিন-তিনটি নাগরিকত্বে কালযাপন বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। এই ভাবনা তার সঙ্গে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ দীর্ঘ ২৩ বছর নানান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এবং স্বাধিকার আন্দোলন-ভাষা, সামরিক আইন, শিক্ষা, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন – সব নিয়ে পাকিসত্মানি উপনিবেশিক রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অন্য সবাইয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক আপামর জনগণকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিক্ষুব্ধ পরিবেশটি অনেকের মতো খালিদের শিল্পীসত্তাকে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে গড়ে উঠতে সাহায্য করে সেখানে পরোক্ষক্ষর বদলে প্রত্যক্ষ সৃষ্টিশীলতার কার্যশৈলী বাস্তব কারণে প্রধান বলে বিবেচিত হয়। চিত্রকলার মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলন রাজনীতিকদের কর্মসূচি নেওয়ার আগে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, কার্টুন, দেয়ালচিত্র, সড়কচিত্র – সবকিছুতে সোচ্চার হয় – এমন দেখা গেছে, যেহেতু শিল্পীদের সংবেদনশীল মনে এসব সর্বপ্রথমে রেখাপাত করে প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতায়। সেই তুলনায় ভাস্কর্যে তা পরিদৃষ্ট হয় না তাৎক্ষণিকভাবে, যেহেতু এই শিল্পমাধ্যমটি সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও শ্রমসাধ্য এবং স্থিতিশীল ইতিবাচক প্রতিবেশ-পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করে। তাই আন্দোলনের সময় অতিবাহিত হয়ে যখন স্বাধীনতা অর্জিত হলো তখন ভাস্কর্যশিল্প বিকাশের আনুকূল্যতা পেল এবং তার শৈলী ও কুশলতা সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনে যাতে সুগম হয় সেজন্য সোশ্যাল রিয়েলিজম বা সামাজিক বাস্তবতা রীতির মূর্ত প্রকাশে যুদ্ধের ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বীর শহীদের অবয়ব, বীরাঙ্গনা, নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সবার কাহিনি নিয়ে ভাস্কর্যশিল্প সৃষ্টি হলো, যাকে বলা যায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ভাস্কর্য। খালিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কালজয়ী ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের সামনে দৃঢ়প্রত্যয়ে শত্রুর মোকাবেলা এই অঙ্গীকারের প্রতিরূপ – তিনটি মানুষ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, গ্রামের সাধারণ কৃষক-সহযোদ্ধা ও একজন নারী সেবিকা নিয়ে সুঠাম দেহ ভঙ্গিমায় দ-ায়মান ‘অপরাজেয় বাংলা’ তেমনি এক সামাজিক বাস্তবরীতির এক অনুপম নিদর্শন। ভাস্কর্যটির রূপায়ণ-মূর্তি স্থাপনা ধর্মে নিষিদ্ধ – এই পীড়িত মন-মানসিকতায় তখন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কোথাও সম্ভবপর ছিল না। তবে অন্য জায়গার তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও সেনানিবাসের এলাকা অধিকতর মুক্তমনা ছিল বলে অনেক বাধা পেরিয়ে এই দুটি পরিসরে ভাস্কর্যশিল্পের কোনো সৃষ্টকর্ম স্থাপনা সম্ভব ছিল। অপরাজেয় বাংলার বেলায়ও কথাটি সত্য এবং জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী, প্রয়াত, তার কর্মকুশলতায় টঙ্গীর চার রাসত্মার মোড়ে ভাস্কর আবদুর রাজ্জাকের ‘জাগ্রত বাংলা’ আর সিলেটের শাহজালাল সেনানিবাসে হামিদুজ্জামান খানের একটি ভাস্কর্য নিদর্শনের কথা বলা যায়। এই প্রসঙ্গে আরো একটি অসাধারণ ভাস্কর্যের উল্লেখ করা যায় যেটার বাস্তবায়ন হতে পারেনি সময় ও সুযোগের অভাবে, সেটি হচ্ছে সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ প্রসত্মাবিত একটি জলাশয়ের মধ্যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিমূর্তি জলের উপরিভাগে শুধু মাথা ভাসিয়ে এবং উঁচিয়ে স্থাপিত হবে – এমন। দুর্ভাগ্য, খালিদের এই প্রসত্মাবটা রূপায়িত হতে পারেনি। তবে সময় আছে এখনো খালিদের এই ভাস্কর্য-প্রকল্পটির বাস্তবরূপ দিতে সংশিস্নষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও ভাস্কর কেউ এগিয়ে আসতে পারেন এবং কাজটি বাস্তবায়িত হলে এক বিরল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্যরূপ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে খালিদের প্রতিও সম্মান দেখানো সম্ভবপর হতো। এখানে আরো একটি বিষয় মুখ্য, সেটি হচ্ছে পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যের বিষয় ও শৈলী পশ্চিমা বিশ্বের আধুনিকতায় সৃষ্ট ও তার সেই সময়ের মাস্টার-ভাস্করদের দ্বারা অনুসরিত যেমন রদাঁ, হেনরি মুর, গিয়াকোমেত্তি বা বারবারা হেপওয়ার্থ প্রমুখ যেখানে জ্যামিতিক গড়ন, গঠন, আয়োজন, সমাহার, নৈর্ব্যক্তিক আকুতি, পুঞ্জীভূত দল – সব মূল আকার থেকে অন্য সরলীকৃত বিমূর্ত বা অমূর্ত আঙ্গিকে। এই আধুনিকতা সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে না মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যে, এমনতরো প্রত্যক্ষবোধের গুণ থাকতে হবে যাতে দর্শক সহজেই দেখে উজ্জীবিত হতে পারে। তাই খালিদ নভেরার আধুনিক শৈলীতে না গিয়ে ধ্রম্নপদী আঙ্গিকে তার বিভিন্ন অভূতপূর্ব ভাস্কর্যরূপ সৃষ্টি করেছেন। তার ভাস্কর্য সৃষ্টি প্রধানত তিনটি শৈলী ও আঙ্গিকে দেখা যায়। এক. পোড়ামাটির শিল্পকর্ম-পাখি, জীবজন্তু ও মানুষের প্রতিকৃতি, দুই. দেয়ালচিত্র বা ম্যুরাল, পোড়ামাটি, মোজাইক বা চিত্রোপল বা পচ্চিকারি ও তিন. মাটি, সিমেন্ট বা কাঠে ভাস্কর্য। আবদুর রাজ্জাক যেখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন অর্গানিক বা দেহবিন্যাস জৈবিকতা, খ-, খ-াংশকে একীভূত করা এবং মানব অবয়বে, খালিদ তার বদলে প্রাতিষ্ঠানিক ধারা, বাস্তবমুখিনতা, রাশিয়ার সামাজিক বাস্তবতার শৈলী, শক্তি, দৃঢ়তা, কমনীয়তা, দেহ-সৌন্দর্য ও মানবিক বোধ সঞ্চার করতে চেষ্টা করেছেন। প্রতীকী প্রকাশেও তিনি সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে একটি প্রমাণ আয়তনের পালক-ফুলানো মোরগের ভাস্কর্য আইয়ুব খান প্রবর্তিত প্রেস অর্ডিনেন্সের বিপরীতে সোচ্চার – আমাকে চিৎকার করতে দাও বা লেট মি শাউট, এমন বোধকরি প্রথম প্রতিবাদী ভাস্কর্য যা সেই সময়ের রাজনৈতিক অপশাসনের বিরুদ্ধে সৃষ্ট হয়েছে। এরকম প্রতীকী প্রতিবাদী ভাস্কর্য চাঁদপুরের খালে গণসমাধির ওপর দৃঢ় হাতে রাইফেল উঁচুতে তুলে ধরা ভাস্কর্য, অঙ্গীকার; টঙ্গীর স্কুইব ওষুধ কারখানায় দুই হাতের মধ্যে বীজ রাখা জলাশয়-ঝরনাধারাতে সৃষ্ট অঙ্কুর উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া ভাস্কর্য হিসেবে চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমিতে ডলফিন, ভাটিয়ারি গলফ ক্লাবে একজন গলফারের গতিময় প্রত্যয় দেখা যায়। দেয়ালচিত্রেও তিনি অপূর্ব পোড়ামাটির শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন, যেমন বাংলাদেশ টেলিভিশন রামপুরা স্টুডিওতে আবহমান বাংলা, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ম্যুরাল, এবি ব্যাংক, ব্র্যাক প্রধান কার্যালয়, ঢাকায় ইত্তেফাক ভবনে বিধ্বস্ত বাংলা, গুলশানে বেঙ্গল শিল্প দলের ইন্টারনাল বেঙ্গল প্রমুখে। খালিদের বাস্তবধর্মিতায় কিছু ব্যক্তির অবয়ব মৃৎশিল্পে সৃষ্ট নিপুণ শিল্পকর্ম মনুষ্য আকারে অনবদ্যতায় দেখা যায় জ্ঞানতাপস প্রতিকৃতি-ক্রমিকতায়। এর মধ্যে সূক্ষ্ম শৈলী, আঙ্গিক, বাস্তব গুণময় কাজী মোতাহার হোসেন, পটুয়া কামরুল হাসান, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, তার বন্ধু বিদেশিনী ফ্যান্সি, আহমেদুল আমিন ও আত্মবিশেস্নষণ উল্লেখ্য। এই সময়ে একজন নারীর বক্ষ-সৌন্দর্য নিয়ে আবক্ষ মৃৎ-মূর্তিও তিনি রচনা করেছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুকুমার শিল্প বিভাগের অধ্যাপনার সময়ে তিনটি সুউচ্চ স্তম্ভ নিয়ে কংক্রিট বা ব্রজলেপের স্বাধীনতা স্তম্ভের স্থাপনাও তিনি নকশা করেছিলেন। তবে এতসব সৃষ্টিশীলতার চিত্রশিল্পেও অনবদ্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ব্যতিক্রমীরূপে। তিনি বোধহয় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে প্রথম ও শেষ সৃষ্টিশীল স্রষ্টা যিনি শুধু ফুল নিয়ে চিত্রকর্ম করে গেছেন যা খুব প্রণিধানযোগ্য। তেল রং ও অ্যাক্রিলিকে করা ফুলের নানান আকার শোভা, সৌন্দর্য যা প্রকৃতিতে ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন আকর্ষণীয় বর্ণ ও বিন্যাসে প্রস্ফুটিত সেসবের বাস্তবমুখী রূপ নিয়ে চিত্রপট সাজিয়েছিলেন এবং তা দিয়ে ১৯৯১ সালে একটি একক ফুলেল চিত্রপ্রদর্শনী করেছিলেন যা শুধুমাত্র বিষয় ফুল নিয়ে এরকম আয়োজন বোধকরি প্রথম শিল্প ঘটনা। ভাস্কর আনোয়ার জাহান ছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রথম ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র। তার নৈপুণ্য দারুশিল্পের মধ্যে সুন্দরতায় দেখা গেলেও মৃৎ ও ধাতবশিল্পেও উল্লেখ্য। আদিম একপ্রকার সরলতা দেশীয় ঐতিহ্যের রূপে প্রতিভাত তার সৃষ্টকর্মে। সেই সময়ে মূর্তিগড়া নিষিদ্ধ এই ধর্মীয় বিধিতে তিনি তার ভাস্কর্য নিয়ে বেশ নাজেহাল হয়েছিলেন। মৌলবাদী গোষ্ঠী তার সৃষ্ট একজন বর্শা-ছোড়া খেলোয়াড়ের ভাস্কর্য স্টেডিয়ামের কাছে জিরো পয়েন্টে সড়ক দ্বীপে বেশ বড়সড় দেখতে তা বসিয়েছিলেন যেটি সেনাবাহিনীর সাহায্যে রাতের মধ্যে সরিয়ে অদৃশ্য করতে সক্ষম হয়। ভাস্কর্যশিল্পকে এত ভয় এদের, মনগড়া এক বাতাসে মিশে থাকা ভয়ানক শিল্পাস্ত্র যার কোনো কার্যকারণ নেই ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়া, এটাই শিল্পের ক্রমোন্নতির বাধা, অবাক কা-! অপরাজেয় বাংলা সৃষ্টি করতেও খালিদকে কম বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি। ১৯৭২-৭৩ সালে ডাকসু-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে খালিদকে মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে স্মারক ভাস্কর্য সৃষ্টি করতে বলা হয়। ১৯৭৪ সালে কাজ শুরু হয় কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কাজ থেমে যায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত এরকম চলে, তখন ধর্মান্ধরা এটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন প্রগতিশীল ছাত্রদের দ্বারা তা সম্ভব হয়নি। তখন ছাত্রনেতা মুজাহিদুল সেলিম, মাহবুব জামান, ম. হামিদ তারা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন এবং ভাস্কর্য সৃষ্টির সেই ইতিহাসে স্মরণীয় রইবেন। এরপর ১৯৭৯ সালে আবার ভাস্কর্যের কাজ আরম্ভ হয় এবং এই বছরের ১৬ ডিসেম্বরে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা উদ্বোধিত হয়। তখনকার ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, আলী রিয়াজ, হাসান হাফিজ – তারা ভীষণ সক্রিয় ছিলেন। তারা অপরাজেয় বাংলা যে নামটি সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর দেওয়া, সবাই এই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এই সঙ্গে যারা ভাস্কর্যটির মডেল হয়েছিলেন – বদরুল আলম বেনু, হামিদ মনসুর (ফজলে) এবং সেবিকারূপে হাসিনা আহমেদ – এদের নাম মনে জাগে। আলোকচিত্রী মিশুক মুনীর যিনি খালিদের ওপর ছবি-অ্যালবাম তৈরি করেছিলেন, তিনিসহ নাম করতে হয় প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর যিনি অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি তিন ইঞ্চি পরপর আনুভূমিক ছেদনে কংক্রিট ঢালাইয়ের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে তা উলস্নম্বতায় সৃষ্টি করতে খালিদকে অকুণ্ঠভাবে সাহায্য করেন, যা ইতোপূর্বে যন্ত্রানুষঙ্গ ব্যতিরেকে এমন কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের দেশে শিল্প সৃষ্টিতে পদে পদে এত বাধা সত্ত্বেও, বিশেষ করে ভাস্কর্যশিল্প সৃষ্টিতে তা রাষ্ট্রীয় সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক, ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, ধারণাগত – যা-ই হোক না কেন, সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের মতো অকুতোভয় সংগ্রামী যোদ্ধা-শিল্পী-শিক্ষক-ভাস্কর মহাজনগণের কালজয়ী সৃষ্টি কুশলতায় ও অগ্রসরতায় আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যেনিশ্চয়ই পৌঁছতে পারব। বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রযাত্রা এত চড়াই-উতরাই বাধার বিন্ধাচল পার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক পথপরিক্রমায়। নভেরা আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, নিতুন কু-ু, আনোয়ার জাহান, আব্দুল্লাহ খালিদ, হামিদুজ্জামান খান এদের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ভাস্কর্যের অমসৃণ কিন্তু মানবিক বোধে উদ্ভাসিত সৌন্দর্য ও বোধে নান্দনিক শিল্প সড়কে উজ্জ্বল বিভায়। এই শিল্প মিছিলে একঝাঁক তরুণ ভাস্করের নাম বলতে হয়। যেমন অলক রায়, শামীম সিকদার, মো. এনামুল হক, মুজিবুর রহমান, রাসা, আক্তার জাহান আইভী, মো. তৌফিকুর রহমান, ব্যতিক্রমী ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, মৃণাল হক, মুকুল মুকসুদ্দীন, শ্যামল চৌধুরী, সুলতানুল ইসলাম, মাহবুব জামাল, মোস্তফা শরীফ আনোয়ার, মাহবুবুর রহমান, ময়নুল ইসলাম পল, নাসিমা হক মিতু, সুদীপ্ত মলিস্নক সুইডেন, ইমরান হোসেন, কবীর আহমেদ মাসুম চিশতী, মুকুল কুমার বাড়ৈ, হাসানুর রহমান রিয়াজ, নাসিমুল খবির, ফারজানা ইসলাম মিল্কী – এদের সার্বিক শিল্পপ্রতিভার ভাস্কর্যশিল্প আজ বাংলাদেশের শিল্পজগতে সৃষ্টিশীল এক অভূতপূর্ব নজির ও অনুসরণীয় অভিক্ষক্ষপ সৃষ্টি করে চলেছে যে কারণের জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি। সেই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সখা, বন্ধু ও প্রেরণাময় সহযাত্রী সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদকে হৃদয় দিয়ে স্মরণ করি। চলে যাওয়ার কিছু আগে তার সদ্য বিবাহিত কর্মক্ষম পুত্রসন্তানকে হঠাৎ হারিয়ে তিনি খুব নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। মনে পড়ে এস এম সুলতান, লেখক মাহমুদুল হক (বটু ভাই), চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুহম্মদ খসরু, রফিক আজাদ, সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতার কথা। শেষের দিকে স্পষ্ট বক্তা, ভনিতাহীন, কৌতুকপ্রিয় ও সরল-সহজ মনের তুমুল আড্ডাপ্রিয় খালিদ, স্থপতি আবদুর রশীদ, স্থপতি-শিক্ষক সামসুল ওয়ারেস, ভাস্কর মুজিবুর রহমান, সাংবাদিক তকির, স্থপতি বদরুল, রেজা, জিয়া, মাহবুবুল হক – সবার সঙ্গে বদরুল জিয়ার কার্যালয়ে কিংবা ওয়ারেসের বাসায় নিয়মিত বসতেন ও নানান বিষয়ে আলোচনা-পানাহারের মধ্যে চুপচাপ নিঃশব্দে বসে থাকতেন এবং সবার কথা ডাগর দুটি চোখ মেলে শুনতেন, তারপর হঠাৎ সময়মতো উঠে সবার আগে চলে যেতেন যেমন করে তিনি সত্যি সত্যিই ছেড়ে গেলেন। তার অনুপস্থিতি আমাদের সকলের উপস্থিতিতে সবসময় জেগে রইবে। তার অনসিত্মত্বের ওপর অপার সৌন্দর্যধারা অবিরত বর্ষিত হোক।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011