logo

বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রে সাম্প্রতিক প্রবণতা

মাহমুদুল হোসেন

এ কথা এখন পুরনোই যে, বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার যাত্রা স্টপ জেনোসাইডের বিপস্নবী আত্মপ্রকাশের ভেতর দিয়ে। একটি বিকল্প রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সংগ্রামের কালে, প্রথাগত চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এই চলচ্চিত্রের জন্ম এবং বিশ্ব মানবতার আনুকূল্য তার প্রতীতিতে প্রধান। এর প্রধান ইমেজ ফ্রেমগুলো গতানুগতিক ফ্রেমের সঙ্গে অসম্পর্কিত এবং এসব ইমেজের বিষয় নিম্নবর্গের মানুষ; সেসব মানুষ – একটি দেশের জন্ম যাদের কাছে সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ দাবি করেছিল। স্টপ জেনোসাইডের ধারাভাষ্য এক বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার। এভাবে চলচ্চিত্রের এক বিকল্প নন্দনতত্ত্বের প্রবচন এই ছবিতে। অথচ বেদনা এই যে, এই ধারায় যে রাষ্ট্রের জন্ম সেখানে শিল্প ও জাতীয় চলচ্চিত্রের বিকাশ সহজ হয়নি। দেশপ্রেমের জলো জিগির তুলে আদায় করে নেওয়া নিশ্চিত, প্রতিযোগিতাহীন বাজারে কালো টাকার পুঁজি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের হতাশাব্যঞ্জক ধারাকে প্রবাহিত রেখেছিল এবং মধ্য সত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনাবলির ভেতর দিয়ে জাতি এক যৌথ ডিমেনশিয়া এবং ডিপ্রেশনে নিমজ্জিত হয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি জেগে ওঠা তারুণ্যের হাত ধরে শুরু হয় বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন। তাদের মাথার ওপর আলমগীর কবির – স্টপ জেনোসাইডে জহির রায়হানের নিকট সহযোগী। এই আন্দোলনের ইতিহাস এবং হাল অবস্থা বিষয়ে বিসত্মারিত লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়; আমরা আগ্রহীজনরা এ বিষয়ে জানিও কম বা বেশি।

 

কিন্তু লক্ষ করি, বাংলাদেশে, সম্ভবত আরো অনেক দেশের মতোই, প্রামাণ্যচিত্র মাত্রই বিকল্প চলচ্চিত্র। এ দেশে আজ পর্যন্ত যত প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে তার সিংহভাগ এসেছে সেসব নির্মাতার কাছ থেকে যারা বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের যোদ্ধা বা সহযাত্রী। কিন্তু সেটিই একমাত্র লক্ষণ তো নয় বিকল্প চলচ্চিত্রের। বলা হয়েছে বিষয়ের ভিন্নতা, প্রযুক্তির ভিন্নতা, দৈর্ঘ্যের স্বাধীনতা, নির্মাতার অভিব্যক্তি প্রকাশের এবং তা প্রদর্শনের স্বাধীনতা – এসব হচ্ছে বিকল্প চলচ্চিত্রের মূল লক্ষণ। এবারে দৃষ্টি ফেরাই বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র কর্মকা–র দিকে। একটি বড়সংখ্যক প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে বিকল্প ফরম্যাটে, প্রথমে ১৬ মিলিমিটার ফিল্ম এবং পরে অ্যানালগ ভিডিওতে এবং সম্প্রতি ডিজিটাল ভিডিওতে। হালে ফরম্যাটের ভিন্নতা আর নেই হয়তো মূলধারা এবং বিকল্প নির্মিতিতে। কিন্তু ফরম্যাটকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। আমরা তো জানি, ডিজিটাল ফরম্যাটে চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স এবং সিজিআইয়ের ব্যবহার করে, সব রেকর্ড ছাড়ানো বাজেটে যেমন সিনেমা বানানো যায়, তেমনি আবার একেবারে ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়ে, অবিশ্বাস্য কম বাজেটেও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। ফরম্যাটে নয়, চলচ্চিত্রের শরীরে লেখা থাকে এই ভিন্নতা। আজকের বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রামাণ্যচিত্রের গায়ে সেই ভিন্নতার ছাপ। ফরম্যাটের পর বিকল্পের আরেক বড় লক্ষণ তার বিষয় নির্বাচনে। যেসব প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হচ্ছে গত চার দশক ধরে তাদের বিষয় যে কোনো অর্থেই গতানুগতিক চলচ্চিত্রের বিষয় থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন। এমনকি যখন মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি নির্মিত হয়েছে তখন মূলধারার চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের যে উপস্থাপনা তা থেকে প্রামাণ্যচিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনা একেবারে ভিন্ন রূপ নিয়েছে। মুক্তির গান, তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথি, ১৯৭১, স্বাধীনতা, অপরাজেয় বাংলা, বিধবাদের গ্রাম অথবা সম্প্রতি জন্মসাথী, সবাই একজাত, ট্রু, ফলস অ্যান্ড এ রেভুলেশন – এসব এবং আরো অন্যান্য ছবি এই কথায় সমর্থন জোগাবে।

 

মুক্তিযুদ্ধের বাইরে বিপন্ন প্রতিবেশ, লিঙ্গ বৈষম্য, শিশুদের প্রতি বৈষম্য, জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগতভাবে প্রামিত্মক জনগোষ্ঠীর দিকে দৃষ্টিক্ষক্ষপ, ইতিহাসের বিকল্প পাঠ, জনপদ, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ব, মহৎ জীবন – এমনি বিচিত্র বিষয়ে পক্ষালম্বনের, অ্যাক্টিভিজমের, ইন্টারভেনশনের এবং শিল্পিত মানবিক দৃষ্টিক্ষক্ষপের কাজটি করে চলেছে বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র। এভাবে বিষয় ভাবনায় সে নিঃসন্দেহে বিকল্প চলচ্চিত্র চর্চার প্রধান আধার। প্রামাণ্যচিত্রকে কখনো ব্যবসায়ীদের ঠিক করে দেওয়া দৈর্ঘ্যের মাপ মেনে নিতে হয়নি। পাঁচ মিনিট থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত যে কোনো দৈর্ঘ্যের ছবি নির্মিত হচ্ছে – নির্মাতার অভিব্যক্তি সৃষ্টির চাহিদা অনুসারে।

 

অন্যদিকে প্রামাণ্যচিত্র অনেক ক্ষেত্রেই নির্মাতার নিজেরই ছবি; অন্তত ছবি প্রকাশে তারা তাদের স্বাধীনতাকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন আর প্রদর্শন স্বত্ব অনেক ক্ষেত্রেই নির্মাতা সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। নানা ধরনের সামাজিক এজেন্ডা নিয়ে কর্মরত দেশি-বিদেশি সংস্থাসমূহ এবং অল্প সংখ্যায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কিছু ছবি প্রযোজনা করছে; কেউ কেউ হয়তো বিদেশি তহবিল সংগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছে। আবার অনেক তরুণ নির্মাতা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিষয়ক পাঠের অংশ হিসেবে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। সরকারি উদ্যোগে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট এরকম কিছু সুযোগ সৃষ্টি করছে। নানা প্রতিষ্ঠান – যেমন বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ, বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কারিগরি সহায়তায় অথবা কর্মশালার অংশ হিসেবে অনেকে ছবি করার সুযোগ পাচ্ছে। এসব ছবি নির্মাতার স্বাধীন অভিব্যক্তিকে নিশ্চিত করছে এবং ছবিটির প্রদর্শন স্বত্বও নির্মাতা বজায় রাখতে পারছে।

 

সুতরাং, মোটা দাগে এ কথা বলা যায় যে, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ একটি স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাণ প্রচেষ্টাই – এবং এভাবে বিকল্প চলচ্চিত্রের একটি প্রধান কণ্ঠস্বর। এ কথা জোর দিয়ে বলতে চাই যে, প্রামাণ্যচিত্র কেবল বিকল্প চলচ্চিত্র নয়, বরং সমাজের প্রবল শক্তিমান অন্যায্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও এক বিকল্প অবস্থান প্রায়ই।

 

বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের সাম্প্রতিক প্রবণতা :

 

কিন্তু বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো কী? এরকম একটি সর্বব্যাপী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি সবসময়ই দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করি। প্রথম কারণটি খুবই বস্ত্তনিষ্ঠ। সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত সব প্রামাণ্যচিত্র আমার দেখা নেই। যেসব ছবি দেখা হয়ে ওঠেনি তার ভেতর গুরুত্বপূর্ণ ছবি থাকাও অসম্ভব নয়। সেটা প্রবণতার অনুসন্ধানে বড় সীমাবদ্ধতা হয়ে উঠতে পারে। আবার যেসব ছবি দেখেছি তাদের ওপর ভিত্তি করে একটি ধারণা প্রসত্মাব করা যেতে পারে। এরকম একটি ধারণা অনেকাংশেই বিষয়ীগত; কারণ ব্যক্তির দেখার ভঙ্গিটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই কোনো সিদ্ধান্ত বা মূল্যায়ন নয়; বরং কিছু অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করব।

 

প্রামিত্মকতার প্রামাণ্যকরণ :

 

প্রামিত্মকতা বিষয়ে আগ্রহ প্রামাণ্যচিত্রের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে যা মূলধারার ডিসকোর্সের বাইরে, তাকে উপস্থিত করার মিশনটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতারা গ্রহণ করেছিলেন সেই নানুক অব দ্য নর্থের সময় থেকেই। বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র এর ব্যতিক্রম নয়। ষাটের দশকের সারমন্স ইন ব্রিক বা ১৯৭১-এর স্টপ জেনোসাইড তো প্রামিত্মকতা থেকেই যাত্রা করেছিল। অথবা নববই দশকের তারেক শাহরিয়ারের কালিঘর বা তারও আগে কৃষ্ণনগরের মতো যৌথভাবে নির্মিত ছবিতে প্রামিত্মক জীবনই গুরুত্ব পেয়েছিল।

 

কিন্তু বর্তমান দশকে প্রামিত্মকতাকে দেখবার দৃষ্টিতে পরিবর্তন এসেছে। কখনো মনে হচ্ছে এই দৃষ্টিকে নবায়নের একটি চেষ্টা চলছে, একটি বৈশ্বিক চলচ্চিত্র-ভাষা আমরা আত্মস্থ করতে চাইছি। কখনো মনে হচ্ছে এক ধরনের রিফ্লেক্সিভ প্রবণতা প্রধান হয়ে উঠতে চাইছে, যেখানে স্থানিক মরমি ও সহজিয়া রুচির চলচ্চিত্রিক পরীক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। লক্ষ করি দক্ষক্ষণের সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রাম সুতারখালি আর হুরকা নিয়ে কী ভীষণ ভিন্ন মেজাজের দুটি ছবি পেলাম আমরা গেল তিন বছরের মধ্যেই। শুনতে কি পাও সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রামিত্মক মানুষের সংগ্রামের পেশাদার উপস্থাপন। সে বিযুক্তিতে সিনেমা ভেরিতেই সমকালীন এক ঘরানার প্রতিনিধি। কিন্তু চিত্র-ঐশ্বর্য, ব্যষ্টিক ও আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে চলাচল এবং অন্যান্য কারিগরি সম্পন্নতা এই প্রামাণ্যচিত্রকে বিশেষ করে তুলেছে। এরকম দৃষ্টিক্ষক্ষপ, অথবা বলা যাক এরকম চলচ্চিত্রিক রিয়েলাইজেশন, প্রামিত্মকতা বিষয়ে আমরা আগে পাইনি। এই দৃষ্টি যতটা স্থানিক তারও চেয়ে বেশি বৈশ্বিক; সে নিশ্চয়ই এক্সটিক নয় – কিন্তু শুনতে কি পাও সুতারখালির জীবনবিষয়ক এক ভীষণ স্মার্ট আর্টিকুলেশন, এক সম্পন্ন চলচ্চিত্র-অভিজ্ঞতা সবার জন্য।

 

আর দেখুন ঝলমলিয়া। দক্ষক্ষণের আরেক প্রামিত্মক জনপদ হুরকা অথবা তার পৌরাণিক জলাশয়টি নিয়ে যত ছবি আর কথা। আবার সে এক আত্মবীক্ষণও বটে, নির্মাতার নিজের। সে নানাভাবে এক নতুন ছবি। লিখেছি এই ছবি বিষয়ে, ‘ঝলমলিয়া আসলে এক ব্যক্তিগত যাত্রা সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের। সম্ভবত এক অন্তর্যাত্রা, এক শ্রম্নতি-অবলোকন অভিজ্ঞান-প্রচেষ্টা। উন্মুল নাগরিক ইন্দ্রিয়ের শুশ্রূষার আকাঙক্ষাও হয়তো বা। যে জীবন যাপিত, উদযাপিত কিছুই হয়নি তার প্রতি করুণ, কামনাময় দৃষ্টিক্ষক্ষপ; রোমান্টিক, অভিলাষী।

অথচ ঝলমলিয়া এক প্রামাণ্যগল্প – গল্পই যেন, প্রাচ্য যাদুর রসে ডোবানো উৎকৃষ্ট এক কাহিনি-মদিরতা, যা এলোমেলো করে দেয় প্রামাণ্য সব প্রকল্প; এজেন্ডা, ইস্যু, টার্গেট। কিন্তু এসব সার্থকতা কি সে চায়নি? বলব, সম্ভাব্য আপত্তির মুখে, সে উৎকর্ষ তার অর্জিত হয়নি। ঝলমলিয়া প্রামাণ্যকরণ করে ঠিকই, কিন্তু সেটি ঘটে এক শরণার্থী বোধের, সংবেদের। যে ঠিকানা নেই, যে মাটির শুধু কিংবদমিত্ম আছে, যে অসিত্মত্ব নাগরিক বিচ্ছিন্নতায় ট্র্যাজিক, যেসব মানবিক স্বাদু স্বপ্ন নির্মমভাবে দলিত ঝলমলিয়া তাদের অনুসন্ধান, ক্রমাগত বেহিসাবি বিবেচনা; এক অলৌকিক অমর্ত্যের আকাঙক্ষা (মাহমুদুল হোসেন, ২০১৫)।’ … ‘হুরকা গ্রাম হেলালের সকল নাগরিকতার এক সমান্তরাল অসিত্মত্ব হয়ে উঠেছে। তার কেন্দ্রে আছে ঝলমলিয়া – সেই জলাশয় যার স্বাদু জল বেঁচে থাকে, বাঁচিয়ে রাখে। সে স্বচ্ছতোয়া, সে একান্নবর্তী, সে মাতৃময়ী। হেলাল এক আদি নৃলোকের অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করেন, যার ব্যাখ্যাহীন বাস্তবতা আছে, যার লোকগল্পই ইতিহাস। আর ঝলমলিয়া পুষ্পদায়ী, তার শাপলার রূপ হেলালকে জলজ করে তোলে, যেন জলের কিছু কমতি ছিল ঝলমলিয়ার অভিজ্ঞতায়(!), হেলাল নানারকম ক্যামেরা যন্ত্রে তার জলজ মননের ছবি আঁকেন; ঝলমলিয়ার দৃশ্যমানতা, হেলালের মনন অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক স্মৃতিতে জমা হতে থাকে (মাহমুদুল হোসেন, ২০১৫)।’ এভাবে প্রামিত্মকতায় এ আরেক বিশিষ্ট দৃষ্টিক্ষক্ষপ। এ দৃষ্টি স্বজ্ঞাজাত, মানবিক।

মুক্তিযুদ্ধে প্রামিত্মকজনের অংশগ্রহণ এবং আত্মত্যাগের বিবরণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের আকর্ষণ করেছে বরাবরই। এই প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ও অক্ষুণ্ণ আছে। নারী দৃষ্টিক্ষক্ষপে এই ধারার প্রামাণ্যচিত্র আরো নানাভাবে বিশিষ্ট হয়ে উঠছে। ফারজানা ববি বিষকাঁটা প্রামাণ্যচিত্রে মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এমন তিনজন নারীকে উপস্থাপন করতে গিয়ে ইতিহাসের কিছু বিকল্প পাঠই প্রসত্মাব করেছেন। আর তার ছবির প্রবল প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠতার মাঝে নারীদৃষ্টির কোনো বিশেষ সংবেদ কি ক্রিয়াশীল থাকে? এই আলোচনায় পরে আমরা দেখব যে, সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে নির্মাতা ফৌজিয়া খানের যে গল্পের শেষ নেই ছবিতেও প্রকৃতি হয়ে ওঠে এক প্রধান অংশীদার।

 

অন্যদিকে প্রামিত্মকতার প্রামাণ্যকরণে মিনিমাল বা ন্যূনতার আঙ্গিকটি বরাবরই আকর্ষণ করেছে এ দেশের চলচ্চিত্রকারদের। সে ধারাটি অব্যাহতভাবে বহমান দেখতে পাচ্ছি। মকবুল চৌধুরীর বিলেতপ্রবাসী বাংলাদেশের মানুষদের ১৯৭১ নিয়ে ছবি নট এ পেনি নট এ গান সেভাবেই নির্মিত ছবি। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান যে ন্যারেটিভ তাতে এসব সামান্য মানুষের অসামান্য গল্পগুলো তেমন স্থান করে নিতে পারেনি। সেই প্রামিত্মকতা নিয়ে মকবুলের ছবি। সে ছবি নিয়েছে এক ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের রূপ। তার উপকরণও সামান্য। কিছু স্মৃতিচারণ, কিছু আলোকচিত্র, অডিও ক্লিপ আর সেসব স্থানে অনাটকীয় পিলগ্রিমেজ যেখানে নির্মিত হয়েছিল ইতিহাস। গ্রন্থনার মুন্সিয়ানায় তারা অসামান্য হয়ে উঠছে।

 

জ্যেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রকার ফরিদুর রহমান যখন নির্মাণ করেন অশ্বারোহী তাসমিনা তখন তিনি আস্থা রাখেন মিনিমাল আঙ্গিকেই। যেরকমটি ঘটে মৃদুল মামুনের সবাই একজাত ছবির রিয়েলাইজেশনেও। বলেছেন মামুন এটি শূন্য বাজেটের এক একক চলচ্চিত্র প্রচেষ্টা। এই প্যারাডাইম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্ভবত আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

 

ইন্টারসাবজেক্টিভিটি :

 

দেখা – এই ক্রিয়াপদটি থেকেই যাত্রা করে চলচ্চিত্র। যে দেখে এবং যাকে দেখা হয় চলচ্চিত্রে, তাদের মধ্যে চলে এই দ্বিমুখী লেনদেন – দর্শক এবং দর্শনীয় হিসেবে – একে অপরের সঙ্গে স্থান বদল করে অথবা একে অপরের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে – এই হচ্ছে চলচ্চিত্রে আমত্মঃবিষয়ীগততার প্রাথমিক প্রসত্মাবনা।

এ কথা বোঝা সহজ যে, চলচ্চিত্রের যে দেশ-সময় দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হয় তা তার চরিত্রদের আমত্মঃবিষয়ীগততার অন্তর্গত। আবার চলচ্চিত্রের চরিত্রদের সঙ্গে, তার সময়কালে, দর্শকদের প্রায়ই একটি বোঝাপড়া বা লেনদেনের সম্পর্ক চলমান থাকে। বিষয়টি দুইভাবে কাজ করে। একদিকে দর্শক হিসেবে কেবল চলচ্চিত্র-দর্শকই দেখে না, বরং এরকম একটি বোধ তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, চলচ্চিত্রের চরিত্ররাও তাকে দেখছে। আবার উল্টোদিকে একজন নিষ্ক্রিয় ভয়ারিস্ট থেকে সক্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠে দর্শক। চলচ্চিত্রের চরিত্ররা দর্শকের সঙ্গে সংলাপ প্রসত্মাব করে, তার উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করে, তার বিশ্বাস বা রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দর্শক জড়িত হয়, ডিফেন্স গড়ে তোলে, সংক্ষুব্ধ হয়, পালটা প্রশ্ন করে। এভাবে চলচ্চিত্র এবং দর্শকের স্পেস এক বৃহত্তর ইন্টারসাবজেক্টিভ বলয়ে প্রবেশ করে। গবেষকরা বলছেন, ‘Cinema is not some kind of objectified external universe cut off from the spectator by an impassable barrier that separates the corporeal from the intellectual, or private self from the public space. The intersubjective perspective in film theory maintains that in contemporary cinema the traditional, dialectical poles of inside and outside, subject and object, seeing and being seen no longer seems to be valid. The status of the subject and the object of the look are interchangable : we are surrounded by images that look back at us, aggressively, seductively, provocatively, indifferently. (তারহা লেইন ২০০৭:১০)’।

 

আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রামাণ্যচিত্রে ইন্টারসাবজেক্টিভিটি বা আমত্মঃবিষয়ীগততার উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অন্যতম প্রধান প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ তার ছবিতে দর্শককে সেরিব্র্যালি যুক্ত করেন এবং দর্শক এক ধরনের মানসিক লেনদেনের আবশ্যিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। আবার তার প্রামাণ্য ছবির চরিত্ররা এবং অধ্যায়গুলো তাদের নিজস্ব বিষয়ীগততা বিনিময়ের একটি পরিম-ল গড়ে তোলে চলচ্চিত্রের দ্বিমাত্রিকতার মধ্যেই। নববই দশকে তার নির্মিত রোকেয়া এবং আমাদের ছেলেরা প্রামাণ্যচিত্রে আমত্মঃবিষয়ীগততার শক্তিমান উদাহরণ হয়ে আছে। তার সাম্প্রতিক ছবি এখনো একাত্তর দর্শকের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিরোধকে ভেঙে ফেলে নানা দিক থেকে। দুটি ভিন্ন ফরমালিটির ক্রমাগত ব্যবহার, সময়গত মন্তাজ এবং ন্যারেটিভের ভাঙন দর্শককে উপলব্ধি করে যে, চলচ্চিত্রটি তাকে দেখছে এবং প্রশ্ন করছে অথবা জড়িত করতে চাইছে। তবে যা কৌতূহলোদ্দীপক তা হলো এই চলচ্চিত্রের মধ্যে এক ধরনের কাহিনি চিত্রসুলভ গল্প বিন্যাসের ভঙ্গি। শাহবাগে সূর্যোদয়ের আগেই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়ে যাওয়ার টেলিভিশন ফুটেজ দেখি আমরা। জেল গেটের সেই ফুটেজ শেষ হয় শাহবাগের সেস্নাগানের শব্দের সঙ্গে মিক্স করে। কাদের মোল্লার একটি বিশাল স্থিরচিত্র রং হারিয়ে মোনোক্রোম হয়ে যায়। দৃশ্য ফেড আউট হয়…সেস্নাগান চলতে থাকে। এরপর শাহবাগে সূর্যোদয় এবং কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর শাসিত্মর দাবিতে আন্দোলনের প্রামাণ্যকরণ শুরু হয়। এভাবে শাহবাগের প্রাথমিক উত্তেজকটির নিরাকরণ করে সরল ন্যারেটিভ ভাঙার যে চিত্রনাট্য-ঢং সেটিকে ব্যবহার করেন মানজারেহাসীন মুরাদ। আবার অন্যদিকে এটিও যেন প্রতিষ্ঠিত হয় যে, এই ছবি শাহবাগের ক্রমিক প্রামাণ্যকরণের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে চায়। চলচ্চিত্রের আমত্মঃবিষয়ীগততার আলোচনায় এরকম চিত্রনাট্যের বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ দর্শকের সঙ্গে চলচ্চিত্রের যে ট্রানজেকশন তাতে ন্যারেটিভের অরৈখিকতা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

ভিন্নভাবে শবনম ফেরদৌসীর প্রামাণ্যচিত্র জন্মসাথী দর্শকের সঙ্গে একটি বিষয়ীগত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এমনিতেই রিফ্লেক্সিভ মোডের প্রামাণ্যচিত্রের সঙ্গে দর্শক একভাবে যুক্তবোধ করেন। আর শবনমের ছবিটির জেনেসিসটিই এমন যে, তার ব্যক্তিনিষ্ঠ চিন্তা ক্রমশ ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে চলে। সুধীর এবং শামসুন্নাহারের যে প্রকাশ তা শবনমের প্রশ্নের ভেতর দিয়ে কেবলমাত্র নয়; তার সংবেদ, যুদ্ধশিশু বিষয়ে তার গবেষণা এবং উপলব্ধি থেকে জাত। এভাবে সুধীর, শামসুন্নাহার এবং শবনম তাদের আমত্মঃব্যক্তিক লেনদেনের ভেতর দিয়ে জন্মসাথীকে দর্শকের সামনে উপস্থিত করে। দর্শক এই লেনদেনের মধ্যে যুক্ত হন, শবনমের অনুসন্ধান এবং যাত্রা দর্শককে সংক্ষুব্ধ বা প্রশ্নবিদ্ধ না করলেও তার নিজস্ব সংবেদ ও জিজ্ঞাসা নিয়ে এই যাত্রায় যুক্ত হতে প্রেরণা জোগায়।

 

তবে আমত্মঃবিষয়ীগততার শক্তিমান উদাহরণ জার্মানিতে প্রবাসী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকার শাহীন দিল-রিয়াজের দেশান্তর প্রামাণ্যচিত্রটি। এর মূল ফোকাসটিই হচ্ছে আমত্মঃসাংস্কৃতিক সংলাপ এবং তার নিরীক্ষণ। পূর্ব আর পশ্চিমের পুরনো যে লেনদেন তারই এক ধরনের নবায়ন; যা সাম্প্রতিকতায় প্রসঙ্গায়িত, যার পর্যায়টি ব্যক্তিনিষ্ঠ এবং সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ওই ব্যক্তির মান থেকেই বিবেচনা করা। অবধারিতভাবেই ছবির চরিত্রদের মধ্যে যে আমত্মঃবিষয়ীগত এক পরিম-ল গড়ে উঠতে থাকে তা এই ছবির ফরমালিটি মাত্র নয়, তা-ই এই ছবির বিষয়। এ ছবি সম্ভবত আরো যা চায় তা হলো, দর্শকের মধ্যে এই সংলাপকে প্রবিষ্ট করতে, দর্শককে এই সংলাপে যুক্ত করতে। ছবির ‘অন্য পৃথিবী’ দর্শককে যে প্রশ্নগুলো করে (এসব প্রশ্ন নির্মাণ করে ছবির প্রসঙ্গ ও তাদের ট্রিটমেন্ট) তাদের ভেতর দিয়েই যেন ছবির মানুষেরা দর্শককে দেখে। অথবা এই প্রশ্নগুলোর ভেতর দিয়ে দর্শক নিজেকে নতুন করে দেখে। তার আবেগ, যুক্তি, আগ্রহ, ক্ষক্ষাভ, লজ্জা, ভ্রামিত্ম – এই ছবির দেখাকে ঘিরে – এক বিশেষ বর্ণনা নির্মাণ করে। এই বর্ণনা পূর্ব ও পশ্চিমের সম্পর্কবিষয়ক; আবার দর্শকের নিজের বিশ্বাস, রাজনীতি, অসিত্মত্ব ইত্যাদিতেও সংশিস্নষ্ট। দর্শকের এই বর্ণনা, আমরা তর্ক করতে পারি, এই চলচ্চিত্রের ইন্টারসাবজেক্টিভিটিতে যুক্ত হয়। দেশান্তর ছবির বিষয়ীগততা এভাবে ক্রমাগত, নিরন্তর এক সংলাপের ধারাবাহিকতায় পরিণত হয়।

 

ক্যারোলিন, আনা, ফেলিক্স, জুলিয়ান, রোজা, মিশেল এবং আরো কয়েকজন মিলে এ ছবির জার্মান পক্ষ। আর এ পক্ষে বাংলাদেশ – ঢাকা এবং উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলো। শাহীন আছেন মাঝখানে; অন্তত এভাবেই শাহীন দেখতে চান বিষয়টিকে। পক্ষের ধারণাটি অনুমোদিত হবে না সর্বজনে। কিন্তু পক্ষই আসলে, পশ্চিম আর পূর্ব, গতি আর স্থিতি, ধনী আর দরিদ্র, দাতা আর গ্রহিতা, বৈশ্বিক আর স্থানিক। এভাবে এত বৈপরীত্য, অমিল, দূরত্ব যে পক্ষের ধারণাটিকেই সবচেয়ে লাগসই মনে হয়। আর সেই রাজনৈতিক উপনিবেশকালের দখলদারি ঘনিষ্ঠতাও অনুপস্থিত এখন। ও পক্ষে রাজনৈতিক সঠিকতার পরাকাষ্ঠা, এ পক্ষে আত্মপরিচিতিবিষয়ক নানা তর্ক, উত্তেজনা, স্পর্শকাতরতা; সব মিলে দূরত্ব এখন বেশিই। এই দূরত্বকে পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করলেই দেশান্তর ছবির অ্যাসপিরেশনটিকে ধরা যায়; তার পালসটিকে অনুভব করা যায়। দেশান্তর ভূগোল ও রাজনীতির সীমা পার হয়ে এই বৈপরীত্যের মধ্যে সংলাপ আয়োজন করতে চায়; বৈপরীত্যকেই নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। সে, এই চলচ্চিত্র, আনাড়ি সদর্থক নয়; কোনো চূড়ান্ত ইতিবাচকতা তার লক্ষ্য নয়। সে বরং দুই পক্ষের এই সংলাপকে দর্শকের মধ্যে চালিত করতে চায় এবং দর্শককে যুক্ত করে আমত্মঃবিষয়ীগততার একটি বৃহত্তর এবং সদা-চলমান পরিম-ল নির্মাণ করতে চায়। দেশান্তরের যে সংলাপ তার মধ্যে উত্তর উপনিবেশের এথেনিসিটি কমপেস্নক্স আছে, আধুনিকতাবিষয়ক জটিলতা আছে, ঐতিহ্যবিষয়ক টানাপড়েন আছে, আছে শাহবাগ, আছে রানা পস্নাজা। এসবের ভেতর দিয়ে এক সমৃদ্ধ ইন্টারসাবজেক্টিভ লেনদেন।

 

ফরিদ আহমেদের ট্রু, ফলস অ্যান্ড এ রেভুলেশন ইতিহাসের প্রামাণ্যকরণ করার পাশাপাশি তার নির্মাণ কৌশলের কারণে দর্শকের সঙ্গে একটি আমত্মঃবিষয়ীগত পরিম-ল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। উদ্ঘাটিত ইতিহাস বা তার উপকরণগুলো দর্শককে সক্রিয় করে তোলে নানা জিজ্ঞাসা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ছবিটির অনুসন্ধানী আবহটি দর্শককে অপেক্ষায় থাকার বদলে মানসিকভাবে সচল করে তোলে।

 

নিরীক্ষা :

 

আঙ্গিকগত নিরীক্ষা বাংলাদেশের কোনো ধরনের চলচ্চিত্রেই যে খুব বেশি হয়েছে এমন নয়। তবে সাম্প্রতিককালে প্রামাণ্যচিত্রে নিরীক্ষার নানারকম প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব নিরীক্ষা একেবারে নতুন কোনো অভিব্যক্তি হয়ে উঠছে এরকম বলতে চাইছি না, কিন্তু নির্মাতারা বাস্তবের প্রামাণ্যকরণে সৃজনশীল হয়ে উঠতে চাইছেন; একটি দৃশ্য অবলোকন মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের ক্ষমতাকে পরখ করে দেখতে চাইছেন; অথবা প্রামাণ্যকরণ এবং অভিব্যক্তি নির্মাণ দুটি বিষয়কেই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছেন।

 

ফৌজিয়া খানের ছবি যে গল্পের শেষ নেই একটি সামাজিক বিষয়কে ভীষণ ব্যক্তিগত একটি মেজাজে প্রামাণ্যকরণ করতে চেয়েছে। নারীর যৌনতার মতো একটি বিষয়কে নিয়ে ছবিটি নির্মাণে চলচ্চিত্রকার প্রতীক ও রূপকের আশ্রয়ে এক কাব্যময় জগৎ নির্মাণ করেছেন। এই কাব্য নারীবাদী সাহিত্য ও প্রকৃতির সমান্তরাল থেকে অনুপ্রাণিত হয়। নারীদৃষ্টির যে প্রকৃতিপ্রবণতা কথা লিখেছি ফারজানা ববির বিষকাঁটা ছবির আলোচনায় সেই বিষয়টিই এই ছবিতে প্রায় এক প্রধান ভিজুয়াল মোটিফ হয়ে ওঠে। অন্যত্র এই প্রবণতাকে ইকো ফেমিনিজম থেকে অনুপ্রাণিত এক চলচ্চিত্রিক অভিব্যক্তি বলে শনাক্ত করেছি। যে গল্পের শেষ নেই নির্মাণ করে নানা ভিজুয়াল প্রতীক আর শব্দের এক সংবেদী আবহ। নির্মাতা ছবিতে নেই; কিন্তু এক শক্তিমান ব্যক্তিগত পাঠ আমরা শনাক্ত করি। আবার নারীকথার দুর্লভ সব উপাত্ত বিষয়টিকে অনিঃশেষ চালিত করে দর্শকের মধ্যে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ফৌজিয়ার আগের ছবি আমাকে বলতে দাও প্রায় একইরকম একটি আঙ্গিককে অনুসরণ করেছিল।

 

নবীন নির্মাতা হুমায়রা বিলকিসের আই এম ইয়েট টু সি দিলস্নী একটি ব্যক্তিগত ভিজুয়াল যাত্রা; দিলিস্নর মতো মেট্রোপলিসের এক ব্যক্তিনিষ্ঠ অভিজ্ঞতার অরৈখিক প্রকাশ। হয়তো এটা তার একটি স্বপ্ন-প্রায় চেতনাপ্রবাহী নির্মিতি, সার্থক কবিতার মতো অমূর্ত কোনো অনুভবের অনুপ্রাণিত প্রকাশ। সাবজেক্টিভ, ক্যানডিড, মন্তব্যহীন দৃষ্টি ও শ্রবণের মধ্যে তীক্ষন এক সংবেদের সঙ্গে ক্রমেই যুক্ত হতে থাকে দর্শক। হুমায়রার নিরীক্ষা দিলিস্ন শহরের বিকল্প দর্শন প্রসত্মাব করে; সেখানে শহরের হতশ্রী বাস্তবতা, সবজি বিক্রেতার আটপৌরে ডাক, অবয়বহীন ট্রাফিক, ডিজিটাল ট্যুরিজম ক্রমাগত চলতে থাকে। অথবা সে এক অন্তর্যাত্রাই আসলে শেষ পর্যন্ত যা অবশিষ্ট থাকে স্মৃতির নশ্বরতায় এক নগর বিষয়ে তাই নিয়ে।

 

২০১০ সালের পরে বাংলাদেশে নির্মিত কিছু প্রামাণ্যচিত্রকে বিবেচনায় নিয়ে কয়েকটি প্রবণতাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা গেল। এই চেষ্টাটি আরো সর্বাত্মক এবং বিশেস্নষণধর্মী করা সম্ভব হলে আমি নিজে তৃপ্ত বোধ করতাম। কিন্তু আপাতত নানা সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে এখানেই থামতে হচ্ছে। সবশেষে ভবিষ্যতের প্রামাণ্যচিত্র প্রসঙ্গে একটি ছোট নিবেদন।

 

ডিজিটাল প্রযুক্তি সারা পৃথিবীতেই একটি ঘটনা ঘটিয়েছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। সেটি হচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাণের এক ধরনের রহস্য মোচন। এটি যে কোনো পবিত্র মন্ত্রসাধ্য দুর্ঘটনা বিশেষ নয়; সংবেদী মানুষ মাত্রই ছবি বানানোর উদ্যোগ নিতে পারেন – এই কথাটি অন্তত যাদের ওয়াই(Y) জেনারেশন বলা হয় সেই প্রজন্মের মানুষরা আমাদের দেশেও বুঝতে পেরেছেন। এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাণের হালকা ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সহজলভ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও তরুণরা কিছু তত্ত্ব এবং প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করছেন চলচ্চিত্রনির্মাণ প্রসঙ্গে। এর ফল হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশে এখন নানা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অজস্র ছবি তৈরি হচ্ছে। কাহিনিচিত্র হচ্ছে, প্রামাণ্যচিত্র হচ্ছে, ছোট-বড় নানা দৈর্ঘ্যের ছবি হচ্ছে। প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষেত্রে ভালোভাবে মনোযোগী হলে দেখি, স্বাধীনতার পর সত্তর এবং আশির দশকে হাতেগোনা কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। সে তুলনায় নববই দশকে নাটকীয়ভাবেই ছবির সংখ্যা বেড়ে গেছে এবং এর পরের সময়ে সে সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, তারপরও কি যথেষ্ট সংখ্যায় মানসম্পন্ন প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হচ্ছে, অথবা প্রামাণ্যচিত্র কি দর্শকের কাছে পৌঁছচ্ছে বা দর্শকের মধ্যে প্রামাণ্যচিত্র বিষয়ক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এই প্রশ্নগুলো প্রামাণ্যচিত্র বিষয়ক আলোচনায় অবশ্যই প্রাসঙ্গিক, কিন্তু আপাতত আমি যা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি তার বাইরের ব্যাপার। আমার মনে হয়েছে যে, চলচ্চিত্রের এই যে গণতন্ত্রায়ণ তার প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে প্রামাণ্যকরণে। ডকুমেন্টেশন ব্যাপারটা যে কোনো অর্থেই ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং ভিজুয়াল ডকুমেন্টেশনে এখন কেউ জড়তা বোধ করেন না। এ বিষয়ে বিশেষ এগিয়ে নতুন প্রজন্ম। যে কোনো ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেই হাতের মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে তার ছবি ধারণ করে রাখা হচ্ছে। তারপর অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা প্রকাশিত হচ্ছে। এভাবে বাস্তবের নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে সমাজে। তর্ক করা যেতে পারে, এভাবে চলমান বাস্তবতা ছবি ধারণ করায় অভ্যস্ত হয়ে যারা বেড়ে উঠছেন, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্ত্ততিতে তারা পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে এগিয়ে থাকছেন। এর পরের পথটি তাদের মধ্যে কজন হাঁটবেন সেটি কিন্তু ভিন্ন কথা; কিন্তু, তারা আত্মবিশ্বাসে এবং অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকছেন। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধ করি এই নতুন প্রজন্মের শিক্ষণ প্রক্রিয়াটি। এরা যখন শিখবেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কলাকৌশল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তখন তাদের পূর্বার্জিত আত্মবিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো যদি মনে রাখা হয়, তাহলে নতুন প্রামাণ্যচিত্রের পথ সুগম হবে নিশ্চয়ই। হালে প্রামাণ্যচিত্রের এই সংখ্যা স্ফীতির কালে মিডিয়াতে যে গতানুগতিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয় তার আঙ্গিককে মোনোফর্ম নামে আখ্যায়িত করেছেন চলচ্চিত্র-আলোচকরা এবং নিষ্ক্রিয় দর্শকের জন্য বাস্তবের সুবিধাজনক ব্যাখ্যা নির্মাণের একটি পরিকাঠামো হিসেবে এই আঙ্গিককে চিহ্নিত করেছেন। তাদের ভাষায়, ‘a language form where in spatial fragmentation, repetitive time rhythms, constantly moving camera, rapid staccato editing, dense bombardment of sound, and lack of silence or reflective space, play a dominant and aggressive role’ (ওয়াটকিন্স, ২০১৫)। আমাদের নতুন প্রজন্মের সম্ভাব্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের এই প্রবণতা থেকে রক্ষা করা কর্তব্য বলে মনে করি।

 

সূত্র নির্দেশ :

 

ওয়াটকিন্স, পিটার। স্টেটমেন্ট অন ‘মিডিয়া ক্রাইসিস : অন ‘মোনোফর্ম’ অব কনটেমপোরারি মিডিয়া। www.pwatkins.mnsi.net/index.htm থেকে অক্টোবর ২০১৫-তে গৃহীত।

 

লেইন, তারহা (২০০৭)। শেইম অ্যান্ড ডিজায়ার : ইমোশন, ইন্টারসাবজেক্টিভিটি, সিনেমা। পিটার ল্যাং।

 

হোসেন, মাহমুদুল (২০১৫)। ঝলমলিয়া : স্বাদু শেকড়ের সন্ধানে, www.dekhamhossain.wordpress.com থেকে মে ২০১৬-তে গৃহীত।

Leave a Reply