logo

বাংলাদেশের চিত্রকলায় প্রকৃতি জয়নুল আবেদিন থেকে জাহিদ ইকবাল

ন জ রু ল  ই স লা ম

এক সময়ে এমন একটি ধারণা বেশ প্রবল ছিল যে চিত্রকলা হচ্ছে প্রকৃতি বা নিসর্গের নকল (‘আর্ট ইজ ইমিটেশন অব নেচার’)। সময়ের বিবর্তনে নকল কথাটির ব্যাখ্যা হয়েছে নানাভাবে। একেবারে হুবহু নকল বা বাস্তববাদী রূপায়ণ থেকে শুরু করে অভিব্যক্তি প্রকাশ তথা পরাবাস্তব কিংবা বিমূর্ত রূপক আঙ্গিকেও নিসর্গচিত্র নির্মাণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ব্রিটিশ শিল্পতাত্ত্বিক ডেভিড বেলের মতে, ‘একটি নিসর্গচিত্র কোনো একটি স্থানের প্রতিচিত্র মাত্র নয়, বরং তা শিল্পীর ব্যক্তিত্বেরও প্রতিচ্ছবি এবং শিল্পী যে যুগের মানুষ তার অঙ্কিত চিত্র সেই যুগেরও প্রতিচ্ছবি।’ একাদশ শতাব্দীর চীনা শিল্পী কু’ও সি’র কাছে নিসর্গচিত্র আরো বেশি নিগূঢ় অর্থবহ। তিনি লিখেছেন, ‘একজন শিল্পীর উচিত নিসর্গের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলার চেষ্টা করা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃতির মূল তাৎপর্য পরিষ্কারভাবে বোঝা না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করা।’ অর্থাৎ নিসর্গকে আপন অভিজ্ঞতায় ধারণ না করে শিল্পীর নিসর্গচিত্র অাঁকা উচিত নয়। অনেকটা এ-ধরনের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বা ‘এক্সপেরিয়েনশিয়াল’ শিল্প সৃজন দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও। নদী নিসর্গ অাঁকার আগে তিনি দীর্ঘ সময় নদীবক্ষে নৌকা ভ্রমণের উদ্যোগ নিতেন। এমনও ঘটনার কথা তাঁর ছাত্রদের মুখে শোনা যায় যে, তিনি ছবি আঁকার উদ্দেশ্যে সারাদিন নৌকায় করে নদীতে বেড়ালেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেদিন হয়তো তাঁর ছবিই অাঁকা হলো না, নদীর অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ হয়নি, তাঁর এমন মনে হওয়ার কারণে।

বিষয় বিবেচনায় ঐতিহ্যগতভাবেই মানুষ ও প্রকৃতি শিল্পীদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রেও এরকম সাধারণ মন্তব্য করাই যায়। বিষয় হিসেবে কখনো মানুষ কিংবা প্রকৃতি আলাদা সত্তায় উপস্থিত, আবার অনেক সময় দুটো বিষয় একাকার হয়েছে। তাছাড়া উপস্থাপনার আঙ্গিক বা ঢঙে বৈচিত্র্য তো থাকেই। একেবারে সরাসরি প্রতিনিধিত্বশীল চিত্ররীতি বা বাস্তববাদী রীতি থেকে শুরু করে রূপবাদী ও প্রকাশবাদী শৈলী কিংবা আধা-বিমূর্ত ও পূর্ণ বিমূর্ত শৈলী কিংবা উত্তর-আধুনিক ইত্যাদি নানা শৈলীতেই বিষয় উপস্থাপিত হতে পারে। চিত্ররীতি পরম্পরা ঐতিহাসিকভাবে যেমন বিবর্তিত হয়েছে, আবার দেখা গেছে, পুরনো রীতি বা শৈলী পরবর্তীকালে সমাদৃত হয়েছে, হয়তো তাতে কিছু নতুনত্ব এনেই। মাধ্যম ব্যবহার এবং উপস্থাপনার কলাকৌশলও পরিবর্তিত হতে দেখা গেছে। বিষয় হিসেবে প্রকৃতি বা নিসর্গ পুরনো হলেও অত্যন্ত আধুনিক ও সমকালীন শিল্পীদের মধ্যেও এর অব্যাহত পক্ষপাত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে প্রকৃতিনির্ভর শিল্পী হিসেবে এদেশের আধুনিক চিত্রকলার প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিত্ব শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নামই সর্বাগ্রে স্মরণীয়। জয়নুল মূলত প্রকৃতি ও মানুষের শিল্পী। মানুষের ছবি অাঁকতে গিয়ে যেমন তিনি ব্যক্তিবিশেষের প্রতিকৃতি অাঁকায় নিরুৎসাহী, বরং বাঙালি ব্যক্তিসত্তা, মানুষের জীবন ও সংগ্রাম আঁকায় আত্মনিবেদিত ছিলেন, প্রাকৃতিক দৃশ্য অঙ্কনেও তিনি বাংলাদেশের প্রকৃতির মৌলিক দিক তুলে ধরতেই অধিক উৎসাহী ছিলেন। এই মৌলিকত্ব খুঁজতে গিয়ে তিনি হয়তো কিছু কিছু বাস্তববাদী প্রতিনিধিত্বমূলক নিসর্গচিত্র এঁকেছেন, কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির মেজাজকে ধরতে চেষ্টা করা। তাঁর শিক্ষানবিশিকালে তিনি পশ্চিম বাংলার দুমকা অঞ্চলে সাঁওতাল পল্লী এঁকেছেন জলরং ও তেলরঙে, ময়মনসিংহ, বিশেষত ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতিবেশ এঁকেছেন কালি, কলম আর জলরঙে। এইসব চিত্রে ইউরোপীয় শিল্পীদের মতো  বাস্তববাদী আঙ্গিকই মুখ্য। কিন্তু তাঁর ‘খেয়াপারে’ (১৯৫১), ‘নদী পারাপার’ (চিত্র ১৪) অথবা ‘কালবৈশাখী’ (১৯৫১) এইসব চিত্রে প্রকৃতির প্রতিকৃতি অঙ্কনের চেয়ে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রূপটাকেই ধরা হয়েছে বেশি এবং অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রাচ্য শিল্পীর যথার্থ মানসিকতা নিয়ে। তাঁর ‘কালবৈশাখী’ (১৯৫১) ছবিটি এক অসাধারণ চিত্র। অত্যন্ত ন্যূনতম হালকা রং ও অসম্ভব শক্তিশালী তুলির টানে কালবৈশাখীর আকস্মিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন, দুজন মানুষ কীভাবে ঝড়ের মুখে আত্মরক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন তা দেখিয়েছেন। চিত্রপটে মানুষের উপস্থিতি ঝড়ের তীব্রতা বোঝাতে সাহায্য করেছে। পুরো কম্পোজিশনটিই অসামান্য। জয়নুল অসংখ্য প্রকৃতিবিষয়ক ছবি এঁকেছেন, তাতে নদী দৃশ্য প্রাধান্য পেয়েছে, নদীতে অবশ্যই নৌকার উপস্থিতি ছিল, গুণটানার দৃশ্যও নদীভিত্তিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রকৃতি জয়নুলের তুলিতে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তবে শুধু প্রকৃতির শান্ত মেজাজই তাঁর তুলিতে ধরা দেয় নাই। পাশাপাশি প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি জয়নুলকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করেছে। ১৯৭০ সনের উপকূলীয় সাইক্লোন ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রায় পাঁচ লক্ষ বাঙালির প্রাণ সংহার করেছে। শিল্পাচার্য তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে গিয়েছিলেন দুর্গত এলাকায়। ফিরে এসে একাগ্র নিবিষ্টতায় সৃষ্টি করলেন এক অবিস্মরণীয় দীর্ঘচিত্রালেখ্য ‘মনপুরা ’৭০’। তিরিশ ফুট দৈর্ঘ্যের সাদাকালো চিত্রটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার করুণ দৃশ্য তুলে ধরেছে। জয়নুলের ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার সঙ্গে আঙ্গিকগত মিল আছে মনপুরা ’৭০-এর। এই রকম মানবিক বিপর্যয়ের হৃদয়বিদারক চিত্র প্রথমটি মানবসৃষ্ট, পরেরটি প্রকৃতিসৃষ্ট।

জয়নুল আবেদিন শুধু প্রকৃতিকে চিত্রিত করেননি, প্রকৃতি থেকে তিনি তাঁর নন্দনতত্ত্বের মৌলিকত্বও গ্রহণ করেছেন। বাংলার নদী থেকে শিখেছেন সবেগ, সতেজ, রঙিন রেখার ব্যবহার এবং বাংলার পানি, আকাশ আর বৃষ্টি থেকে নিয়েছেন স্বচ্ছ, সজীব রং। জয়নুল সমতলের নদী নিসর্গ যেমন এঁকেছেন, তেমনি এঁকেছেন পাহাড়ি এলাকার নিসর্গদৃশ্য।

বাংলাদেশের অপর এক মহান শিল্পী কামরুল হাসানও মূলত প্রকৃতি ও মানুষের শিল্পী। বাংলাদেশের নদী, ফসলের মাঠ এবং মেঘময় আকাশ ইত্যাদি নিসর্গদৃশ্য তাঁর চিত্রকলায় যথার্থ মেজাজে প্রতিফলিত হয়েছে। কামরুলের নিসর্গদৃশ্য জলরঙে অাঁকা, জলরঙের স্বচ্ছ চরিত্রই এইসব চিত্রের জন্য উপযুক্ত এবং তাঁর ছবির আঙ্গিক এদেশের নিসর্গের মতোই জটিলতাহীন। তিনি ’৭০ সনের ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। সমবাস্তববাদী আঙ্গিকে তিনি নিসর্গচিত্র এঁকেছেন, যদিও একই সময়ে মানববিষয়ক ও সামাজিক বাস্তবনির্ভর ছবিতে তিনি ফর্ম নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ফর্ম ভেঙেছেন।

বাংলাদেশের প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে যিনি মূলতই একজন প্রকৃতিনির্ভর শিল্পী, তিনি সফিউদ্দীন আহমেদ। প্রথম পর্বে তিনি প্রাকৃতিক দৃশ্যের একজন বিশ্বস্ত শিল্পী ছিলেন। পশ্চিম বাংলার সাঁওতাল পরগনার বনের দৃশ্য অথবা গ্রামের দৃশ্য, গ্রামবাংলার ধান মাড়াইয়ের দৃশ্য ইত্যাদি তাঁর হাতে স্থায়িত্ব লাভ করেছে। পরবর্তীকালে সফিউদ্দীন নিসর্গকে ব্যবহার করেছেন নান্দনিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য। বাংলাদেশের নদী, মাছ ধরার জাল, নদীতে নৌকো, প্রকৃতির গাছ, গাছের পাতা, এইসবই তিনি ব্যবহার করেছেন চিত্রকলার রেখা, রং, ভূমির আকৃতি এবং ফর্ম সহজীকরণের কাজে। সম্ভবত একথা অতিরঞ্জন হবে না যে, বাংলাদেশের নিসর্গ থেকে চিত্রকলার নান্দনিক বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করতে পেরেছেন সফিউদ্দীন আহমেদই সবচেয়ে বেশি। জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের নিসর্গকে দূরপ্রাচ্য দেশীয় ক্লাসিক্যাল রীতিতে সার্থকতামন্ডিত করেছেন আর সফিউদ্দীন সে-কাজটি করেছেন আধুনিক পাশ্চাত্য সমবিমূর্ত জ্যামিতিক পদ্ধতিতে। সফিউদ্দীন আহমদ ’৫৫-র বন্যার বাস্তবতা খুব চমৎকারভাবে শিল্পিত করেছেন তাঁর বিভিন্ন গ্রাফির প্রিন্ট মাধ্যমে। তাঁর ছবিতে বন্যার কোনো রুদ্ররূপ নয়, বরং তার একটি বিস্তীর্ণ পরিসরের শান্ত সমাহিত বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে। জয়নুল ও সফিউদ্দীন উভয়ের নিসর্গনির্ভর কাজই এদেশের নিসর্গচিত্র তথা চিত্রকলার নান্দনিক উৎকর্ষের জন্য স্মরণীয়।

আনোয়ারুল হক খুব বেশি এঁকেছেন এমন বলা না গেলেও, তিনিও যে মূলত একজন নিসর্গনির্ভর শিল্পী ছিলেন, একথা মানতে হবে। সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়, শান্ত সমুদ্রসৈকত অথবা নদী যেমন এঁকেছেন অনেকটা রূপবাদীরীতিতে, তেমনি অশান্ত কালবৈশাখীর ছবি এঁকেছেন মূলত প্রকাশবাদী আঙ্গিকে। তাঁর একটি অনবদ্য কাজ জলরঙের ‘নিসর্গ’, পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা বৃক্ষশোভা, সমুদ্রতট ও আকাশ।

চল্লিশের দশকের শিল্পীদের মধ্যে এস এম সুলতানও প্রকৃতি ও মানুষের শিল্পী। প্রাথমিক পর্বে তিনি মূলতই নিসর্গশিল্পী। সুলতান নিসর্গকে দেখেন খুব কাছ থেকে। তাই জয়নুল, সফিউদ্দীন বা কামরুলের মতো সামান্যীকরণের পরিবর্তে তাঁর ছবিতে গাছপালার খুব বিস্তারিত ও জটিল বর্ণনা দেখা যায়। তাঁর ছবিতে বাংলাদেশের গ্রামের দৃশ্য, বিশেষত যশোর অঞ্চলের তাল, নারিকেল, খেজুর, কলা, আম প্রভৃতি গাছ, পুরনো বদ্বীপ এলাকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছোট ছোট নদী, ডোবা, জলাশয় প্রভৃতি ধরা পড়েছে। নিসর্গ অঙ্কনে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কখনো ইউরোপীয় ইমপ্রেশনিস্ট ধারায় (ভ্যান গগের স্টাইল মনে করায়), কখনো বা ইচ্ছাকৃত নাইভ প্রকৃতির ঘটনা ও কাহিনির বর্ণনায় অতিরঞ্জনও দেখা যায়। তাঁর মাধ্যম মূলত তেলরং। সুলতানের দৃষ্টিতে গ্রামবাংলার বিভিন্ন ধরনের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের আদর্শায়িত পরিচয় পাওয়া যায়। তবে আপাতবাস্তবতার পরেও থাকে এরই মাধ্যমে উপস্থাপিত প্রতীকী তাৎপর্য। তাঁর ছবিতে অবশ্য কর্মব্যস্ত, উৎপাদনশীল নর-নারীর অবয়বই মুখ্য গুরুত্ব পায়, নিসর্গ সেখানে পশ্চাদভূমি মাত্র।

বাংলাদেশের চিত্রকলায় দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে পরিচিত ঢাকা চারুকলা কলেজের প্রথম দিকের ছাত্ররা যাঁরা পঞ্চাশের দশকেই শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশের প্রকৃতির স্মরণীয় চিত্র অঙ্কন করেছেন। প্রথমদিকে তাঁদের অঙ্কনপদ্ধতি বাস্তববাদী হলেও পববর্তীকালে তাঁদের কাজে প্রকৃতি বা নিসর্গ রূপ পেয়েছে ইমপ্রেশনিস্ট ধারায়, অথবা আধা-বিমূর্ত পাশ্চাত্য জ্যামিতিকতায়, কিউবিস্ট ধারায় অথবা আধা-বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় এবং সবশেষে পরাবাস্তববাদী পদ্ধতিতে।

মোহাম্মদ কিবরিয়া, হামিদুর রাহমান, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মুবিনুল আজিম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, শাহতাব প্রমুখ শিল্পী পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নিসর্গের গুরুত্বপূর্ণ চিত্র এঁকেছেন।

পঞ্চাশের দশকের শিল্পী আমিনুল ইসলাম ও হামিদুর রাহমান নিসর্গদৃশ্যকে ক্রমান্বয়ে আধা-বিমূর্ত এবং বিশেষত জ্যামিতিক সহজ ফর্মে রূপান্তরিত করেছেন। দুজনের মধ্যে হামিদুর রাহমানই অধিকতর প্রকৃতিনির্ভর শিল্পী ছিলেন। বাংলাদেশে প্রকৃতির অন্যতম ভয়াল রূপ, বন্যা, তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। সর্বগ্রাসী প্লাবনে গ্রামীণ মানুষের, বিশেষ করে নারীর অসহায়ত্ব মর্মস্পর্শী আবেদন পেয়েছে তাঁর একাধিক কাজে। বাংলার নদীও সহজ প্রতীকী রূপ পেয়েছে হামিদের কাজে। মোহাম্মদ কিবরিয়া প্রথম দিকে মানুষ ও প্রকৃতিনির্ভর আধা-বিমূর্ত পরাবাস্তববাদী শিল্পী হলেও পরবর্তীকালে পরিপূর্ণ বিমূর্ত শিল্পী হিসেবেই খ্যাতি পেয়েছেন, তবে তাঁর বিমূর্ত ছবির রং ও টেকচারের উৎস বা প্রেরণা যে অনেকটাই এদেশের মাটি, জল ও আকাশ, একথা মানতে হবে।

আবদুর রাজ্জাক মূলত একজন নিসর্গনির্ভর শিল্পী। তাঁর ৫৮ বছরের শিল্পীজীবনে নিসর্গের প্রতি আগ্রহ ঐকান্তিক ছিল, এমনটাই প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বাস্তববাদী, পরে প্রকাশবাদী, এমনকি বিমূর্ত শৈলীতে উপস্থাপন করেছেন তাঁর প্রকৃতিনির্ভর চিত্রকলা। শেষের দিকে, যখন তেলরঙের কাজে তিনি একেবারে প্রকাশবাদী বিমূর্ত ধারার শিল্পী, তখন একই সঙ্গে তিনি জলরঙে নিসর্গদৃশ্য অাঁকায় রূপান্তরবাদী শিল্পী। তাঁর অাঁকা অসংখ্য নদী-দৃশ্য, কিংবা সুন্দরবন চিত্রকলা এ ধারার অনবদ্য কাজ। বিমূর্ত প্রকাশবাদী ধারায় তিনি রং ফরমের নিরীক্ষা করতেন, আশপাশের উদ্ভিদজগৎ কিংবা পরিবর্তশীল আকাশ ছিল তাঁর প্রিয় প্রেরণা।

ষাটের দশকের শিল্পীদের অনেককেই নিসর্গনির্ভর শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এঁদের মধ্যে সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, বীরেন সোম প্রমুখ উল্লেখযোগ্যভাবে প্রকৃতিনির্ভর। হাশেম খানকেই সম্ভবত অধিকতর প্রকৃতিনির্ভর শিল্পী বলা যায়। তাঁর ঋতুভিত্তিক চিত্রকলার কথা প্রসঙ্গত স্মরণীয়। অবশ্য নিসর্গ উপস্থাপনায় তিনি বহুলাংশে বিমূর্ত, মূলত বর্ণ-প্রতীক ও পাখি-প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে প্রয়াসী। অন্যদিকে রফিকুন নবী যখন সুন্দরবন বা নদী-নিসর্গ অাঁকেন, তা প্রধানত রূপান্তরবাদী শিল্পরীতি থেকেই। রফিকুন নবী সম্প্রতি নদী, সমুদ্রসৈকত, বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে অসাধারণ শিল্পকর্ম সৃজন করেছেন। খ্যাতিমান প্রবাসী শিল্পী মনিরুল ইসলাম কিংবা কাজী গিয়াসউদ্দিনের কাজে বাংলাদেশের নিসর্গের নির্যাস অনুভব করা যায়, তুলনামূলকভাবে মনিরুলের কাজে প্রকৃতির প্রতিনিধিত্বও। গিয়াসের সম্পূর্ণ বিমূর্ত ধারার অনেক কাজই ‘বৃষ্টি’ অনুপ্রাণিত। একই প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে মাহমুদুল হক অন্যতম বিমূর্ত ধারার শিল্পী, এবং মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতো তাঁর কাজেও বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রং বা সামগ্রিক প্রতিবেশের আস্বাদ পাওয়া যায়, সরাসরি কোনো প্রতিনিধিত্ব নয়। একই ধরনের প্রকৃতিনির্ভরতা দেখি আমরা অপেক্ষাকৃত নবীন আধুনিক শিল্পী রোকেয়া সুলতানার কাজে। তাঁর কাজে মাটি, জল ও আকাশ শীর্ষক চিত্রকলা এরকম ধারণাই দেয়। তার অতি সাম্প্রতিক চিত্রমালা ‘ফাতা মরগানা’ বা সান্ধ্যকালীন মরীচিকার অসাধারণ প্রাকৃতিক বাস্তবতা উৎসারিত, তবে তার সৃষ্ট চিত্রকলা অনেকটাই বিমূর্ত এবং তাতে নিসর্গ অনুভূতিই প্রধান।

সমসাময়িক শিল্পীদের অন্যতম শক্তিশালী শিল্পী বর্তমানে চট্টগ্রাম নিবাসী মনসুর-উল করিম নিসর্গ ও মানুষ এ দুটোর অসাধারণ সমন্বয় ঘটিয়েছেন তাঁর কাজে। তাঁর দৃষ্টিতে প্রকৃতি, ক্ষেতের ফসল এবং উৎপাদনশীল পরিশ্রমী কৃষক যেন একাকার হয়ে যায়। প্রতীকী রীতি ও মিতাচারী রং ও রেখায় তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধন করেন। বিষয় বিবেচনায় অনেকটাই এস এম সুলতানের কাছাকাছি, আঙ্গিকে যথেষ্ট ভিন্ন। মনসুর-উল করিমের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী মিজানুর রহিমের সাম্প্রতিক ঝোঁক নিসর্গবিষয়ক, তিনি মূলত রূপবাদী আঙ্গিকে সাবলীল জলরং করেন।

জামাল আহমেদ ও শামসুদ্দোহাকে অবশ্যই নিসর্গনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নিয়মিতই তাঁরা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে কাজ করেন, জামাল এক ধরনের বাস্তববাদী রীতিতে, শামসুদ্দোহা অনেকটাই পরাবাস্তব বা অতি-বাস্তব। আরো অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আছেন, যাঁরা নিয়মিত না হলেও বিশেষ আয়োজনে নিসর্গভিত্তিক ছবি অাঁকেন। চিত্রক গ্যালারি আয়োজিত ২০০৩ সালের ‘সুন্দরবন’ প্রদর্শনী (মে, ২০০৩) এরকম একটি ব্যবস্থা। এতে আবদুর রাজ্জাক, জামাল আহমেদ, শামসুদ্দোহা, শেখ আফজালের কাজ যেমন ছিল তেমনি ছিল বুলবন ওসমান, রফিকুন নবী, রেজাউন্নবী, নিসার হোসেন, মনিরুজ্জামান, আহমেদ নাজির, জহিরুদ্দিনের অাঁকা সুন্দরবনের ছবি। এ ধরনের আরেকটি আয়োজন ছিল বেশ কয়েকজন মহিলা শিল্পীর খাগড়াছড়ি অভিযান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরের  অাঁকা পার্বত্য চট্টগ্রামের নিসর্গ চিত্রাবলির কথা। সাম্প্রতিককালে নবীন শিল্পী কনক চাঁপা চাকমার পাহাড়ি প্রকৃতি ও মানুষের ওপর অাঁকা ছবির কথাও উল্লেখ্য।

নাসরীন বেগম এদেশের অন্যতম প্রতিভাবান নবীন শিল্পী, তাঁর কাজে প্রকৃতির কিছু বিশেষ রূপ, যেমন বন্যা, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি চমৎকার প্রতিফলন পেয়েছে আধা-বিমূর্ত আঙ্গিকে। ফরিদা জামানের হাতে নদী এসেছে নৌকা, মাছ আর জেলের সঙ্গে। বহু ক্ষুদ্র জলাশয়ও তাঁর হাতে চমৎকার প্রতীকী রূপ পেয়েছে। জলাশয় ও জলময়তা ফরিদার কাছে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক শান্তির আধার। লায়লা শার্মিন নিসর্গ, বিশেষত নদী দৃশ্য (এবং নৌকা) উপস্থাপন করেন আকর্ষণীয় সংক্ষিপ্ত প্রতীকী শৈলীতে। এই ধারায় তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে নিবেদিত। কে এম এ কাইয়ুম প্রকৃতির সূক্ষ্ম দিক নিয়ে পরাবাস্তববাদী রীতিতে চমৎকার কাজ করেছেন।

অতি নবীন শিল্পীদের কাছে প্রকৃতি বা নিসর্গ খুব একটা অনুপ্রেরণার বিষয় বলে মনে হয় না। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ে। অতিসাম্প্রতিক দ্বিবার্ষিক (১৫তম, ২০১২) এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সৈয়দ জাহিদ ইকবালের (জ. ১৯৭২) ‘ইমেজ অব নেচার’ ১ ও ২, নিসর্গভিত্তিক বিমূর্ত চিত্র মূলত কিবরিয়া ধর্মীয়, এস রফি (জ. ১৯৭৬) অথবা নবীনতর সঞ্জীব কুমার দাসের (জ. ১৯৭৯) কাজ নিসর্গভিত্তিক পরাবাস্তববাদী।

বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার ছয় দশকের বা তারও কিছু বেশি সময়ের অর্জনের বিষয়গত দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় প্রকৃতিনির্ভরতা এর এক বিশিষ্ট চরিত্র। এদেশের আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, মাঠ, পাহাড়, বন-বনানী, খাল-বিল, নদী, নদীর চর, সমুদ্রসৈকত, ক্ষুদ্র জলাশয়, উদ্ভিদজগৎ সবকিছুই অনুপ্রাণিত করেছে এদেশের শিল্পীদের। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি শিল্পীদের উদ্বিগ্ন করেছে, তাঁদের শিল্পকর্মে সেসব অনুভূতির প্রকাশ এসেছে।

জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে মনসুর-উল করিম, জামাল আহমেদ, নাসরিন বেগম বা অতি নবীন জাহিদ ইকবাল পর্যন্ত বহু শিল্পী নিসর্গনির্ভর ছবি এঁকেছেন। অঙ্কনরীতি বা শৈলীতে তাঁরা ক্রমান্বয়ে বাস্তববাদী থেকে সমবিমূর্ত বা পরাবাস্তববাদী হয়েছেন। কেউ কেউ রীতিমতো অভিজ্ঞতাবাদী ভূমিকাও নিয়েছেন, সৈকতের মাটিতে নিজেরাই গড়াগড়ি করেছেন, কাদা মাখিয়ে জীবন্ত ভাস্কর্য হতে চেয়েছেন। প্রকৃতিকে ভালোভাবে বুঝতে হলে প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যেতে হবে, শিল্পাচার্যের এরকম দর্শনই গ্রহণ করতে চেয়েছেন অনেকে। সফিউদ্দীন আহমেদ, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, মনিরুল ইসলাম, হাশেম খান, কাজী গিয়াস, রোকেয়া সুলতানা প্রমুখ নিসর্গের মৌলিক উপাদানসমূহ ব্যবহার করেছেন তাঁদের সমবিমূর্ত কিংবা প্রতীকী ব্যাকরণে।

শিল্পচেতনার অন্যতম প্রধান উৎস প্রকৃতি – একথা প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলা থেকে।

Leave a Reply