logo

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সংখ্যালঘু থিমের উপস্থাপনা : প্রসঙ্গ জীবনঢুলী

সা জে দু ল  আ উ য়া ল

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণক্ষেত্রে এখন বেশ কয়েকটি অভিমুখ লক্ষ করা যায়। এই অভিমুখগুলো তৈরি হয়েছে প্রধানত যেসব উৎস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থের জোগান আসছে সেই উৎসগুলোর ব্যবসায়িক-মতাদর্শিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-অভিপ্রায় থেকে। উৎসগুলোর মৌল অভিপ্রায় থেকেই নির্ধারিত হয়েছে নির্মিত চলচ্চিত্রের থিম-বিষয়। স্টুডিওভিত্তিক বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র-প্রযোজকরা ফর্মুলাভিত্তিক চলচ্চিত্রে অর্থ লগ্নি করেন, কাজেই তাঁদের চলচ্চিত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ‘বিষয়’ হিসেবে খুব কমই আসে। কারণ সংখ্যালঘু থিমের উপাদানসমূহের প্রদর্শন এই বিষয়সংবলিত চলচ্চিত্রে করার সুযোগ খুব কম থাকে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক কাহিনি-সংখ্যালঘুদের জীবনচর্যা উঠে আসে বেশি পরিমাণে। কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাও সংখ্যালঘু থিমকে গুরুত্ব দেয়, অর্থ লগ্নি করে। স্বাধীন বা ব্যক্তিগত পুঁজি দ্বারা নির্মিত চলচ্চিত্রেও এই থিম জায়গা করে নেয়, মাঝে মাঝে।

বস্ত্তত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রেই সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের উপস্থাপনা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। বিষয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণার দাবি রাখে। বর্তমান রচনাকর্মে এর আনুপূর্বিক ইতিবৃত্ত প্রণয়ন ও মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাই শুধু সম্প্রতি ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১২’ প্রদান উপলক্ষে গঠিত জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে সংখ্যালঘু থিমের ওপর নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্র (ও আমার দেশের মাটি, পিতা ও কারিগর) এবং সদ্য নির্মিত ও পরিচালকের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ২৩ অক্টোবর ২০১৩-তে দেখা জীবনঢুলী পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে। বলা প্রয়োজন, বর্তমান রচনাকর্মে প্রথম তিনটি চলচ্চিত্রের কাহিনি-কাঠামো ও প্রধান প্রবণতাটি উল্লেখপূর্বক শুধু জীবনঢুলী বিশদভাবে বীক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। উল্লিখিত চলচিচত্র-চতুষ্টয়ের
কাহিনি-কাঠামোর সমাজতাত্ত্বিক অনুধাবন থেকে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রযোজক-চলচ্চিত্রকারদের দৃষ্টিভঙ্গি জ্ঞাত হওয়া যাবে। অতীত ও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা ও অবস্থানের ধরনও স্পষ্ট হবে।

সংখ্যালঘু থিমের ওপর নির্মিত যে তিনটি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে পরীক্ষণের সুযোগ হয়েছিল তার মধ্যে ও আমার দেশের মাটির
কাহিনি-কাঠামোটি এরকম :

ও আমার দেশের মাটি চলচ্চিত্রের প্রধান দুই চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা রমেশ ও কমান্ডার দিনু সিকদার। রমেশ একজন গ্রামীণ ডাক্তার। চার পুরুষ ধরে তারা এ পেশায় নিয়োজিত। কলেজপড়ুয়া মেয়ে গীতাকে নিয়ে তার সংসার। তুলসীতলার অদূরে বাড়ির দাওয়ায় প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় গানের আসর বসে। সে আসরের নিয়মিত শ্রোতা মুনির। মুনির দিনু সিকদারের ছোট ছেলে; উচ্চশিক্ষিত, মানবতাবাদী লেখক।

দিনু সিকদারের বড় ছেলে সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল। দেশে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হয়েছে। নিহত সেনা অফিসার দিনু সিকদারের বড় ছেলের বউ সদ্য বিধবা কলাবতী এ চলচ্চিত্রের অপর একটি চরিত্র। যে দেবর মুনিরের প্রতি কিছুটা দুর্বল।

রমেশ ডাক্তারের মেয়ে গীতা ও মুনির পরস্পরকে পছন্দ করে। এ চলচ্চিত্রে রমেশ ডাক্তারের বাড়িটি অবস্থানগত কারণে বেশ আকর্ষণীয় একটি স্থান। গ্রামের বাবলু মেম্বারের চোখ পড়ে বাড়িটির দিকে। যে বাবলু মেম্বারের বাবা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ছিল। বাবলু মেম্বারের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা একটি মৌলবাদী সংগঠনের লোকজনের সঙ্গে। বাবলু মেম্বার বাড়িটি বিক্রি করে মুক্তিযোদ্ধা রমেশ ডাক্তারকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য গোপনে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং নানা রকম ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। প্রায় প্রতি রাতেই রমেশের বাড়ির ঘরের চালে বাবলু মেম্বার তার পোষা ক্যাডারদের দিয়ে ঢিল ছুড়ে মারে।

রমেশ ডাক্তার কৃষ্ণভক্ত। বাড়ির সামনে মন্দিরে সে নিয়মিত কৃষ্ণপূজা করে। এক রাতে বাবলু মেম্বারের লোকজন মন্দিরটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বাবলু মেম্বারের হাত থেকে রেহাই পেতে মধ্যরাতে রমেশ ডাক্তার ছুটে যায় দিনু সিকদারের কাছে। কিন্তু দিনু রমেশকে অভয় দেওয়া ছাড়া কার্যত কিছুই করতে পারে না। এক রাতে লোকজনসহ বাবলু মেম্বার রমেশের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেয় এই বলে যে, সাত দিনের মধ্যে বাড়িটি লিখে দিয়ে গীতাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে না গেলে মেয়েটির বিপদ হবে।

রমেশ তার সুহৃদ মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল মাস্টার ও দিনু সিকদারের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। কারণ এখন তার কাছে তার দেশ ও চার পুরুষের বসতবাড়ির চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বিবাহযোগ্য মেয়ের সম্ভ্রম। রমেশ সিদ্ধান্ত নেয় দেশ ছেড়ে যাবে ঠিকই; কিন্তু চার পুরুষের বসতবাড়ি একজন রাজাকারের পুত্রকে লিখে দিয়ে তার ভিটেবাড়ির পুণ্য মাটি অপবিত্র করবে না। তাই রমেশ বাড়িটি তার কমান্ডার দিনু সিকদারকে দিয়ে যাবে সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো দিন যদি রমেশ ভারত থেকে দেশে ফিরে আসে তাহলে সে তার বসতবাড়িটি ফেরত পাবে এই আশায়। ওই সিদ্ধান্তের পর এক রাতে গোপনে নিজ বাড়িতে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে বাড়ি হস্তান্তরের দলিলটি সই করে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে রমেশ। মুক্তিযোদ্ধা রমেশ মেয়ে গীতাকে ডেকে জানায়, ‘যতটুকু যা নেওয়া যায় গুছিয়ে নিস মা, আজ রাতেই এই দেশ ছেড়ে চলে যাব।’

যথারীতি ওইদিন সন্ধ্যাবেলাতেও রমেশ ডাক্তারের বাড়ির আঙিনায় গানের আসর হয়। আসর শেষ হলে সবাই যে যার মতো বাড়িতে চলে যায়। তখনই শুরু হয় রমেশ ও গীতার বাড়ি ও দেশ ছেড়ে যাবার প্রস্ত্ততি। নদীর ঘাটে নৌকায় প্রয়োজনীয় যা কিছু জিনিসপত্র তুলে রমেশ যখন অস্থিরভাবে পায়চারি করছে তখন নদীর ঘাটে আসে দিনু সিকদার। আর হয়তো এ জীবনে কোনো দিনই স্যালুট করা হবে না ভেবে কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে আরো একবার স্যালুট করে রমেশ ডাক্তার। কমান্ডার কান্নাজড়িত কণ্ঠে রমেশকে বলে, ‘ভাই, তুমি এই দেশ ছেড়ে যেও না।’ রমেশ তার কমান্ডারকে জানায়, ‘কমান্ডার ভাই, সাবধানে থাকবেন। ভাই, আমি দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়ে অর্থকষ্ট আর মনঃকষ্টে থাকলেও নিরাপদে থাকব। আর আপনি নিজ দেশে থেকেও নিরাপদ না। তাই বিচার করেন। ওই রাজাকারদের বিচার করেন। কারণ যতদিন ওই রাজাকারদের বিচার না করবেন, এ দেশে ততদিন কোনো মুক্তিযোদ্ধাই – সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলমান যেই হোক, কোনো মুক্তিযোদ্ধাই বা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা তাদের নাতি-নাতনি কেউ নিরাপদ না।’ রমেশ ডাক্তার নৌকায় ওঠার আগে নিজ দেশের পুণ্যভূমিকে প্রণাম করে নৌকায় ওঠে। পিতার অনুমতি নিয়ে মুনির গীতাদের বাড়ির বাসিন্দা হয়। কারণ ক্রয়সূত্রে ওই বাড়ির মালিক তার পিতা দিনু সিকদার। মুনির সিদ্ধান্ত নেয় বাকি জীবনটা সে রমেশ কাকু আর গীতার স্মৃতিবিজড়িত ওই বাড়িতেই কাটাবে।

কয়েকদিন পর বাবলু মেম্বার কয়েকশ লোক নিয়ে রমেশ ডাক্তারের ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে হামলা চালায় এবং দিনু সিকদারের ছেলে মুনির ও তার বিধবা পুত্রবধূ কলাবতীকে অবৈধ সম্পর্কের মিথ্যা অজুহাত দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে বাড়ির উঠানে ফেলে রেখে চলে যায়। খবর পেয়ে ছুটে আসে দিনু সিকদার। তখন তার রমেশ ডাক্তারের বলে যাওয়া সেই কথাটি মনে পড়ে সবার আগে। দিনু সিকদারের পুত্র মুনিরের প্রিয় গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’ দিয়ে কাহিনি শেষ হয়।

ও আমার দেশের মাটি (২০১২)সহ অন্য তিনটি চলচ্চিত্র দেখে কয়েকটি প্রশ্ন মনে জেগেছে : এগুলো নির্মাণের জন্য অর্থলগ্নি করেছে কে বা কারা? নির্মাতাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বলবার বিষয়টি কী? দর্শক মননে এগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে এবং এদের সামাজিক উপযোগিতাটি কোথায়? ও আমার দেশের মাটি নির্মাণের জন্য

অর্থলগ্নি করেছে ‘ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড’-এর অঙ্গসংগঠন ‘ডেসটিনি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস লিমিটেড’। ডেসটিনি একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান – সরকার নানা ধরনের মামলা এর বিরুদ্ধে করেছে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সরকার রাজাকারদের বিচার করছে। ডেসটিনিও এই চলচ্চিত্রের কাহিনি-কাঠামোর মধ্যে এই বিচার করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে চেয়েছে। সুতরাং কেউ যদি ভাবে যে সরকারকে তুষ্ট করার লক্ষ্যেই এ ধরনের থিম নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ তারা নিয়েছে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে কি? নির্মাতার বলবার বিষয়টিও রমেশ ডাক্তারের সংলাপে প্রকাশ করা হয়েছে। রমেশের মুখ দিয়ে বলা হয়েছে : ‘যতদিন ওই রাজাকারদের বিচার না করবেন এ দেশে ততদিন কোনো মুক্তিযোদ্ধাই – সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলমান যেই হোক, কোনো মুক্তিযোদ্ধাই বা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা তাদের নাতি-নাতনি কেউ নিরাপদ না।’ রমেশের সংলাপেই এ চলচ্চিত্রের মূল বক্তব্যটি স্থাপন করা হয়েছে।

একই সঙ্গে সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের বিষয়টিও কাহিনিতে আনা হয়েছে। দেখানো হয়েছে রমেশ ডাক্তারের বাড়িটি বাবলু মেম্বার দখলে নিতে চায়, সে জন্য রমেশকে নানা রকম ভয়ভীতিও দেখায়, যাতে সে দেশ ছেড়ে চলে যায়। বাবলুর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ছিল এবং বাবলু এখন একটি মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এ কথা সত্যি যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ নানা কারণে বর্তমান সময়েও দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে; তাই বিষয়টিকে কীভাবে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করা উচিত তা নিয়ে ভাবা দরকার। কারণ বিষয়টি স্পর্শকাতর। এই চলচ্চিত্রের কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন অনন্ত হীরা, এর পরিচালকও তিনি।

সংখ্যালঘু থিমের ওপর নির্মিত দ্বিতীয় যে চলচ্চিত্রটি দেখেছি তার নাম পিতা। এর কাহিনি-কাঠামোটি এরকম :

হিন্দুপাড়ার মাতববর নিতাই ঠাকুরের বাড়িতে সভা বসেছে যুদ্ধের উড়ো খবর নিয়ে। অন্যদিকে মিটিং হচ্ছে গ্রামের প্রধান জমাদার সাহেবের বাড়িতে। কোনো অবস্থায়ই পাকিস্তানকে বিভক্ত হতে দিতে রাজি নন তিনি।

জেলে বিপিনের ছেলে শরৎ প্রচন্ড একরোখা। কোনো অবস্থায়ই পালিয়ে যেতে রাজি নয় সে। প্রয়োজনে যুদ্ধ করবে। পল্লবী, তার রূপবতী স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, যে-কোনো সময় বাচ্চা হবে। বাবা বিপিনের সঙ্গে এই নিয়ে বিবাদ। জলিল একমাত্র মুসলমান কামার এই হিন্দুপাড়ায়। সে বিষু কর্মকারের পালিত সাগরেদ, যাকে বিষু সন্তানের মতো স্নেহ করে। বিষু অন্ধ কামার। জলিলের স্ত্রী কুসুম তিন ছেলে সহিদ, সামসু, সামাদ ও এক মেয়ে লীলাকে রেখে কিছুদিন আগে মারা গেছে। শর্মিলী কিশোরী বিধবা। নিতাইয়ের মেয়ে। জলিলের মা-হারা সন্তানদের প্রতি গভীর মমতা তার কিন্তু তার মা ভালোভাবে দেখেন না এই মমতাকে।

এক ভোরে একটি বুনো শূকর দলছুট হয়ে ঢুকে পড়ে নকলার এই পাড়ায়। শুরু হয় পিতার মূল কাহিনি, মানুষের উত্তেজনা, আনন্দ, প্রেম, যুদ্ধ ও কষ্টের গল্প।

পাকিস্তানি আর্মির দল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তছনছ করে দেয় সমস্ত পাড়াটি। নির্বিচারে হত্যা করে সকল হিন্দু পুরুষদের। ধরে নিয়ে যায় শর্মিলীসহ আরো অনেক নারীকে। জঙ্গলে, পানিতে, ডোবায় লুকিয়ে জান বাঁচায় জলিল ও তার তিন ছেলে। শরৎ অন্তঃসত্ত্বা পল্লবীকে নিয়ে লুকায় গভীর জঙ্গলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পল্লবীর জন্য তাকে বের হতে হয় জঙ্গল থেকে, ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।

হতভম্ব দরিদ্র মানুষের মাঝ থেকে ঝলসে ওঠে এক পিতা চরিত্র। শুরু হয় গোলা-বারুদের বিপরীতে বাংলার গ্রামীণ অস্ত্র কাঁচি, বল্লম, দা, টেঁটা, হাতুড়ির যুদ্ধ। গল্পটি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন ঘটে যাওয়া দুই দিনের একটি ঘটনা নিয়ে আবর্তিত।

পিতা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধের পটভূমিতে নির্মিত। ২০১২ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড এটি প্রযোজনা করে। এর কাহিনি-কাঠামোর মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ-পাল্টা আক্রমণকেও দেখানো হয়েছে। ‘দেশ’ বা ‘সরকার’-এর চেয়ে এই চলচ্চিত্রে ‘মাটি’ ও ‘ভিটা’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই গুরুতব

প্রকাশ পেয়েছে গানের মধ্যে – ‘দেশ কি সরকার আমার কী দরকার/না জানি রে ভাই না জানি/না বুঝি রে ভাই না বুঝি/সাত পুরুষের মাটি আমার/কিসের ভয়ে কারে মানি।/হাজার বছরের ভিটা আমার/মায়ের সাজানো এ সংসার/ধরণীর বুক চিরে পিতা করে ফসলেরই আবাদ/বন্ধুর মায়ায় ভাইয়ের ছায়ায় পাগল এ মন জানি।’ এটাই সম্ভবত পিতার প্রধান বক্তব্য, নির্মাতার বলবার বিষয়।
সে-কারণেই শরৎ হানাদার বাহিনীর ভয়ে দেশত্যাগ করতে রাজি হয় না – পাল্টা আক্রমণ করে। যদিও শেষ পর্যন্ত সে জয়ী হয় না। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে শুধু ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাই অংশ নেয়নি, দেশের অভ্যন্তরে আটকে পড়া সাধারণ মানুষও, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরাও যে অংশ নিয়েছিল তা প্রকাশ পেয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এখানেই এই সংখ্যালঘু থিমের সর্বোচ্চ গুরুত্ব। বর্তমানেও সকল প্রতিকূল অবস্থায়ও সংখ্যালঘুদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, এরকম একটি প্রণোদনা পাওয়া যায় চলচ্চিত্রটি দর্শনে। এর সামাজিক উপযোগিতাটিও এখানে উপ্ত। এর কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, পরিচালনাকর্ম – সবই করেছেন মাসুদ আখন্দ।

সংখ্যালঘু থিমের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত তৃতীয় যে চলচ্চিত্রটি দেখেছি তার নাম কারিগর। এর কাহিনি-কাঠামোটি নিম্নরূপ :

এক ধনাঢ্য ব্যক্তি স্বাধীনতাপক্ষের একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেতে স্বাধীনতাযুদ্ধে সাধারণ জনসাধারণের অবদান শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। নূপুর, মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত এক মেয়ে ওই প্রকল্পের হয়ে কাজ করে।

মোতালেব ওস্তাগার (হাজাম/যে খৎনা করে)। কথিত আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার একটি অবদান ছিল। নূপুর তার সাক্ষাৎকার নিতে গ্রামে যায়। বিপত্নীক বুড়ো মোতালেব মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কোনো তথ্য না দিয়ে কেবল নিজের অতীত জীবনে খৎনা করার গল্প, যাত্রা ও অন্যান্য বিষয়ের গল্প এবং স্ত্রী গুলবাহারের গল্প করতে থাকে। ওইসব গল্পের ভেতর দিয়ে নূপুর অনুভব করে তার যদি সহানুভূতি থেকে থাকে তা কেবল এই মোতালেবের মতো আধুনিক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতমনা লোকদের জন্য।

নূপুর চাইলেও বুড়ো প্রায় কোনো কথাই বলে না মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, নূপুরের হতাশার শেষে এসে মোতালেব জানায়, যখন ’৭১-এ
পাকিস্তানি মিলিটারিরা তার অঞ্চলের হিন্দুদের হত্যা করতে আসে তখন এলাকার ওস্তাগার হিসেবে পাকিস্তানি মিলিটারিকে এমন একটি তথ্য সে দেয় যাতে মিলিটারিরা হিন্দুদের আক্রমণ না করে ফিরে যায়।

মোতালেব একটি কোরআন শরিফ মাথায় নিয়ে তথ্য দেয় যে এখানে কোনো হিন্দু নেই। মিলিটারিরা আরেক দিন ফিরে এসে তার কথার প্রমাণ দেখবে বলে ফিরে যায়। আসলে ওটা কোনো কোরআন শরিফ ছিল না, ছিল একটি সাদা কাপড়ে মোড়ানো বই।

নূপুর তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ওই মিথ্যে বলার অপরাধে মোতালেব এখন স্থানীয় মৌলবাদীদের ফতোয়ার কারণে একঘরে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছে। এমনকি যে হিন্দুদের সে বাঁচিয়েছিল, তারাও এখন তার দিকে ফিরে তাকায় না।

কারিগরের প্রযোজনা, কাহিনি-সংলাপ-চিত্রনাট্য রচনা, পরিচালনাকর্ম – সবই সম্পাদন করেছেন আনোয়ার শাহাদাৎ। এরিক পিকচার বাংলাদেশ-এর ব্যানারে একেবারে স্বাধীন পুঁজি, স্বাধীন ইচ্ছার নিরিখে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। স্বাধীন পুঁজির কারণেই এর কাহিনি, বক্তব্য ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নির্মাতার ইচ্ছামাফিক। এই চলচ্চিত্রের তিনিই অথর। এর কাহিনি-কাঠামোতে হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রসঙ্গ এসেছে। তাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে মোতালেব ওস্তাগার কীভাবে রক্ষা করেছিল সে কথা এবং এখন রক্ষাপ্রাপ্তরা তার প্রতি কী ধরনের আচরণ করছে তাও বলা হয়েছে।

এই চলচ্চিত্রে সংখ্যালঘু থিমকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে  – সব ক্ষেত্রেই যে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়নি সে বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। সংখ্যালঘু থিম হলেই যে নির্যাতন, অত্যাচার, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, দেশত্যাগ ইত্যাদি দেখাতে হবে – এ ধরনের স্টেরিওটাইপিং মনোভাব থেকে চলচ্চিত্রটি মুক্ত। মুক্তিযুদ্ধ যে একরৈখিক কোনো ব্যাপার নয়, এটি যে বহুরৈখিক-বহুস্তরিক-বহুমাত্রিক ঘটনার সমাহার, তা এই চলচ্চিত্রে স্পষ্ট – এটি দর্শনে দর্শকের মধ্যে এই সত্যই প্রতিভাত হবে এবং এখানেই এর প্রধান উপযোগিতাটি নিহিত বলে মনে হয়।

এবার আমাদের মূল আলোচ্য চলচ্চিত্র জীবনঢুলীর কাহিনিসংক্ষেপ বর্ণনা করে এর বিষয়ভাবনা ও নির্মাণশৈলী সম্পর্কে আলোচনা করব। কাহিনিটি হচ্ছে :

১৯৭১ সাল। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার অন্তর্গত পরাণপুর গ্রামের গরিব ঢাকি জীবনকৃষ্ণ দাস, যে ‘জীবনঢুলী’ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে গরিব ঢাকি জীবনঢুলীর জীবন কাটছিল সুখে-দুঃখে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাণপুর গ্রাম আক্রমণ করলে শরণার্থী হিসেবে ভারতে পলায়নের সময় জীবনঢুলীর স্ত্রী ও সন্তানেরা চুকনগর গণহত্যায় নিহত হয়। জীবনঢুলী সীমান্ত পার না হয়ে গ্রামে ফিরে আসে। পরাণপুর গ্রামে তখন মালেক শিকদারের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর দোর্দন্ড প্রতাপ। রাজাকাররা জীবনঢুলীকে বাঁচিয়ে রাখে এই শর্তে যে ওকে রাজাকার বাহিনীর বাজনদার হিসেবে ঢোল বাজাতে হবে। নানা অপমান ও লাঞ্ছনা সয়ে রাজাকারদের ঢোলবাদক হয়ে কাটতে থাকে জীবনঢুলীর দিন।

যুদ্ধের আগে পাশের গ্রামের সচ্ছল দত্তদের বাড়িতে দুর্গাপূজার ঢাক বাজাতে যেত জীবনঢুলী। ওখানে সে দত্তদের বাড়ির সুন্দরী তরুণী বউটিকে দেখেছিল, যার শুচিতা ও সৌন্দর্য জীবনঢুলীকে মুগ্ধ করেছিল। যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাতে বন্দি হয় দত্তবাড়ির সেই বউটি। জানালার শিকের ফাঁকে মাঝে মাঝে সেই বন্দি নারীর মুখ দেখতে পায় জীবনঢুলী।

যুদ্ধের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পরাণপুর গ্রামে সফল আক্রমণ চালায়। রাজাকাররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে যে বাড়িতে দত্তবাড়ির বউটিকে আটকে রাখা হয়েছিল সেটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। জানালার শিকের মাঝে একবার কেবল দেখা যায় বউটির ভয়ার্ত মুখ। জীবনঢুলী আগুনে-পুড়তে-থাকা বাড়িটার চারপাশে পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে ঢাক বাজাতে থাকে। প্রথমে ধীরে, পরে দ্রুতলয়ে।

ঢাকের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গান : ঢাক তুমি বাজো/বিসর্জনের দুঃখে বাজো/আগমনীর সুখে সাজো/দুঃখ ভোলার ছন্দে বাজো/বাংলার ঘরে \&/ শরৎকালে কারে খোঁজো/চৈত্রের তান্ডবে বাজো/যুগের বঞ্চনাতে কাঁদো/বাংলার ঘরে \/বাংলার দুঃখেতে বাজো/বাংলার স্বপ্নেতে আজো/আগামীর আনন্দে হাসো/বাংলার ঘরে \

জীবনঢুলী সরকার-প্রদত্ত অনুদানে নির্মিত। সহ-প্রযোজক হিসেবে যুক্ত ছিল কারুকাজ বলে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এতে মুক্তিযুদ্ধ ও সংখ্যালঘু থিমকে মাত্রাসহযোগে চিত্রিত করা হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেলের স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও সংখ্যালঘু থিম বারবারই ফিরে ফিরে এসেছে। তাঁর হুলিয়া, চিত্রা নদীর পারে, নদীর নাম মধুমতি, রাবেয়া, ১৯৭১ প্রভৃতি তার প্রমাণ। বরাবরের মতো জীবনঢুলীতেও মুক্তিযুদ্ধ ও সংখ্যালঘুদের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন তানভীর মোকাম্মেল। এর কাহিনির শেষাংশে ধ্বংস ও সাময়িক পরাজয়ের মধ্যে জীবনকৃষ্ণ দাসের ঢাক বাজানোর সঙ্গে যে গান গীত হয়, তার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে নির্মাতার মূল বক্তব্যটি। দুঃখ, বিসর্জন, তান্ডব, বঞ্চনার মধ্যেও নির্মাতা নতুন দিনের আগমনের স্বপ্ন দেখেন – আগামীতে বাংলার ঘরে ঘরে যে দিন আসবে তা আনন্দময় ও সুখমন্ডিত হবে এই প্রত্যাশা নির্মাতার। এই প্রত্যাশা তিনি তখনই করছেন যখন মুক্তিযোদ্ধারা পরাণপুর গ্রামে সফল আক্রমণ চালায়।

সংখ্যালঘু থিমের ওপর নির্মিত যে তিনটি চলচ্চিত্র ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে সেগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত অত্যাচার, ধর্ষণ, হত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন প্রভৃতি দেখানো হয়েছে; দেশত্যাগেও তারা কখনো কখনো বাধ্য হয়েছে; তাদের ঘরবাড়ি-জমিজিরাত দখলের চেষ্টাও দেখানো হয়েছে। এসবের অনেক প্রসঙ্গ জীবনঢুলীতেও আছে।

৩.১ বিষয়ভাবনা

জীবনঢুলীর কাহিনি-সংলাপ-চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন তানভীর মোকাম্মেল নিজেই। তিনিই এই চলচ্চিত্রের অথর। মুক্তিযুদ্ধ ও সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে এতে। এই দুটি বিষয়ের ওপর তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক দখল দীর্ঘদিনের। দেশভাগ, দেশত্যাগের পটভূমিও তাঁর জানা। এ অঞ্চলে সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের অতীত অবস্থান ও বর্তমান অবস্থাও তাঁর অজানা নয়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে যেখানে এই অঞ্চলে প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ছিল, এখন এখানে তা কমতে কমতে ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী এসে ঠেকেছে প্রায় ১০ শতাংশে।

সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে কমেছে-কমছে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে হিন্দুরা কিছু সংখ্যায় দেশত্যাগ করে; ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার সূচনা হলে আবার তারা দেশত্যাগ করে; ১৯৬৪-৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের আগে-পরে দাঙ্গা হওয়ায় তখনো দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করলে আবার তারা বাড়িঘর ছেড়ে দেশান্তরী হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ জাতীয় চার নীতির একটি নীতি হলেও ১৯৭২-৭৩ সালেও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছিল। ১৯৯০ সালেও কিছুটা দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায়। বাংলাদেশে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে ১৯৯২ সালে। তখনো দেশত্যাগী হয় কিছু মানুষ। ২০০১ সালেও একই ঘটনা ঘটে তবে তা সৃষ্টি হয়েছিল সরকার পরিবর্তন হওয়ার কারণে। সাম্প্রতিক সময়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দন্ড প্রদানের সূত্র ধরে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তান্ডবের ফলেও এই সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন নেমে এসেছে। বৌদ্ধরাও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মিয়ানমারে মুসলমানরা নিগৃহীত হচ্ছে বলে তার প্রতিক্রিয়ায় এ দেশেও বৌদ্ধরা নিগৃহীত হচ্ছে – তাদের উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব ঘটনার মূলে রয়েছে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ধর্মীয় মৌলবাদ প্রভৃতি। আর রয়েছে বিতাড়িত দেশত্যাগীজনদের জমিজিরাত দখলের পাঁয়তারা।

জীবনঢুলীতে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যালঘুদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর-রাজাকারদের অত্যাচার-নিপীড়ন ও সেই সূত্রে দেশত্যাগের ঘটনা দেখানো হয়েছে, মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ সংগ্রামের দৃশ্যও এসেছে শেষের দিকে। সময়নির্ধারিত চলচ্চিত্র বলে ১৯৭১-এর পর সংখ্যালঘুদের সমাজ-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে যে অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে বসবাস করতে হয়েছে-হচ্ছে সেসব প্রসঙ্গ এ চলচ্চিত্রে আসেনি। জীবনঢুলীর কাহিনি বাগেরহাট জেলার পরাণপুর গ্রামের এক ঢাকির জীবনবাস্তবতাকে ঘিরে আবর্তিত। তাৎক্ষণিক ও তাৎস্থানিক অন্যান্য ঘটনাও স্থান পেয়েছে, যেগুলোতে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনমূলক নানা অবস্থা ধরা আছে। এই অবস্থাসমূহ প্রকাশ পেয়েছে প্রধানত ঘটনাখন্ড ও সংলাপের মধ্য দিয়ে। গান, স্লোগান (ছয় দফার সংগ্রাম –  চলছেই চলবে/তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা মেঘনা যমুনা/তোমার নেতা আমার নেতা – শেখ মুজিব শেখ মুজিব), ছড়াও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে কাহিনিকে মাত্রা দিতে। সংলাপের ভাষা আঞ্চলিক হওয়ায় ঘটনাখন্ডগুলো স্থানীয় ভিত্তি পেয়েছে। তবে পাগল গফুরের মুখে উচ্চারিত ‘বেলপাতা’ শীর্ষক  ছড়াটি অনেক দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। এছাড়া হঠাৎ করেই যেন পাকিস্তানি বাহিনী পরাণপুর গ্রামে প্রবেশ করে  – বাস্তবে ওই সময় মিলিটারিরা গ্রামে আসার আগে স্থানীয়রা তাদের আসার খবর পেয়ে যেত। জীবনঢুলীতে তেমনটি হয়নি। ওরা যে আসতে পারে তেমন একটা আভাস কাহিনি-কাঠামোতে থাকা মনে হয় দরকার ছিল।

সংলাপ কাহিনি-সংগঠনে ও বক্তব্য প্রকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে জীবনঢুলীতে। যে-কোনো কাহিনির ঘটনাখন্ডের মধ্যে যেসব দ্বন্দ্ব থাকে সেসব দ্বন্দ্বের সংঘর্ষে চরিত্রের জন্ম হয় – উদ্ভূত দ্বন্দ্বসমূহ ও চরিত্রের সংঘর্ষে সংলাপের জন্ম হয়। জীবনঢুলীতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সংলাপের মাধ্যমে কটাক্ষ, অনির্দিষ্টতা ইত্যাদিও প্রকাশ পেয়েছে। যেমন এ চলচ্চিত্রে যুদ্ধের সময় পলায়নরতদের ঘরের ব্যবহৃত তৈজসপত্র ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করার একটা দৃশ্য আছে। সেই দৃশ্যে ফেরিওয়ালা ওজন করার সময় বলে – ‘এইডা ফাও।’ তখন এক হিন্দু রমণী বলে – ‘সবই তো ফাও নিচ্ছ! তবে আর দাম দিচ্ছ কেন?’ অন্যায় করেও ফেরিওয়ালা বলছে – ‘একটা ঈমানের ব্যাপার আছে না?’ দর্শক চরিত্রটি সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যায় এতে। আরেক জায়গায় এক শরণার্থী বলছে যে, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার পর নাম জিজ্ঞাসা করাতে সে তার নাম বলেছে বিজন বিহারী। ‘বিহারী’ শুনে ওরা তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখানে পাকিস্তানি সেনাদের বুদ্ধিহীনতার প্রসঙ্গটি আনা হয়েছে। সংলাপ রচনা ও ঘটনাখন্ডের বিন্যাসে তানভীর মোকাম্মেল নিজ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। সংলাপ দিয়ে তানভীর মোকাম্মেল হিন্দু মৌলবাদের একটি দিকও উন্মোচন করেছেন – এক উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পূজার দিন খাওয়ার আয়োজন করেছেন। তাঁকে বলতে শোনা যায় যে তিনি হিন্দু কায়স্থদের জন্য বসার আয়োজন করেছেন ঘরের ভিতরে আর ধর্মান্তরিত মুসলমানদের জন্য করেছেন ঘরের বাইরে। আরেক জায়গায় জীবনঢুলী তার কাকির সঙ্গে কথা বলছে অত্যাচার ও প্রতিরোধ সম্পর্কে। কাকি : ‘কী করবি ক, কংসরা তো যুগে যুগে জন্মায়।’ জীবনঢুলী : ‘কিন্তু কতা কি কাহি, শ্রীকৃষ্ণরা তো আর যুগে যুগে জন্মায় না।’ এখানে কংস হচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। কংসকে পরাজিত করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। জীবনঢুলীর এই সংলাপটি দিকহীন হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। কারণ যুগে যুগে শ্রীকৃষ্ণরাও জন্মান। তার প্রমাণ তাদের কথার কিছু পরেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনিপটে আগমন। এই মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তানি বাহিনীকে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় পরাস্ত করেছিল। এরাই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা পরাণপুর গ্রামে হঠাৎ করেই আসে। কাহিনিপটে এদের আগমনও একেবারে জানান না দিয়েই ঘটেছে। প্রায় সত্তর মিনিট কাহিনি এগিয়ে যাওয়ার পর তারা আসে। দর্শক হিসেবে একটু হোঁচট খেতে হয় এতে। কিছুটা আরোপিত তো মনে হয়ই। সংলাপের পরই গান এক বিশেষ ভূমিকা রাখে কাহিনিকে মাত্রা দিতে। সাধারণত সংলাপ দিয়ে যে-কথা বলা যায় না সে-কথাই চলচ্চিত্রকাররা গান দিয়ে বলতে চান। জীবনঢুলীতেও একাধিক গান ব্যবহৃত হয়েছে এই সূত্রেই। পরাণপুরের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উদ্বাস্ত্ত হয়ে যখন নিজ দেশ ছাড়ছে, তখন সাউন্ড ট্র্যাকে শ্রুত হয় – ‘মায়ের মাটির অাঁচল ছেড়ে পথ করেছি সাথী’। গানটি সুপ্রযুক্ত, তবে এটি আঞ্চলিক ভাষায় হলে স্থানীয় ভিত্তি পেত। চাপিয়ে দেওয়া বলে মনে হতো না। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক হত্যাকান্ডের পর শোনা যায় – ‘এ কোন ভঙ্গ সময় রঙ্গ করে আমায় নিয়ে …’। এ গানটিও আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত নয়, ফলে এটিও কাহিনির সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি, দৃশ্যমাত্রার সঙ্গে বক্তব্যগত দিক থেকে যথেষ্ট সাযুজ্য থাকা সত্ত্বেও। তবে ‘মাকে ভাসাইয়া জলে/কী ধন লইয়া যাইমু ঘরে …’ গানটি কাহিনির সঙ্গে, দৃশ্যমাত্রার সঙ্গে গেছে, দর্শক মননে আবেগ তৈরি করেই। এর কারণ, এটি আঞ্চলিক ভাষায় গীত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার ফলে চারদিকে পড়ে থাকা লাশ, ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে গানটি মানবিক মুহূর্ত তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। চলচ্চিত্রকারের সৃষ্টিশীলতার ছাপ পরিদৃষ্ট হয় এই গানের চিত্রায়ণে। চলচ্চিত্রে গানের চিত্রায়ণই সবচেয়ে দুরূহ কাজ – এটি তানভীর মোকাম্মেল দক্ষতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছেন। শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাহিনিপটে উপস্থিত হওয়ার সময় সাউন্ড ট্র্যাকে একটি স্টক গান শোনা যায় – ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল …’। গানটি একটি সময় ধারণ করে আছে সত্য কিন্তু এর প্রয়োগের ফলে দৃশ্যমাত্রাটি কাহিনিচিত্রের বদলে প্রামাণ্যচিত্রের চরিত্র অর্জন করে। ফলে দৃশ্যখন্ডটি  কিছুটা আবেদনহীন হয়ে পড়ে।

জীবনঢুলীর কাহিনি-কাঠামোর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারাই প্রোটাগনিস্ট চরিত্র – এরা অ্যান্টাগনিস্ট চরিত্র তথা পাকিস্তানি
বাহিনী-রাজাকারদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এদের আগে এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ডাক্তারের মধ্যে প্রোটাগনিস্ট অ্যাটিচিউড দেখা যায়, যিনি ভারতে শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে গিয়েও স্বদেশে ফিরে আসেন। কারণ তার মনে হয়েছে, স্বদেশের অসহায় আহত মানুষদের তার মতন ডাক্তারের প্রয়োজন আছে। জায়গাটি দর্শক মননে দাগ কাটে। হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞের কারণে প্রচুর মানুষ শরণার্থী হয়েছে – এটা এই চলচ্চিত্রে দেখানোও হয়েছে – দল বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দেশান্তরী হচ্ছে। তবে অনেকের কাছে এত মানুষ একসঙ্গে যাওয়ার দৃশ্যটি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে না-ও হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে চুকনগরে হত্যাকান্ডের পর এত মানুষই একসঙ্গে পালিয়েছিল। এক সকালেই পাকিস্তানি সেনারা এক হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করেছিল। তখন সব সম্প্রদায়ের মানুষই দুর্বিপাকে পড়েছিল। তার মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্ন-উচ্চ (?!) উভয় বর্ণের মানুষ থাকলেও প্রথম বর্ণের মানুষরাই বেশি নিহত-নিপীড়িত হয়েছিল।

পাগল চরিত্র তানভীরের একটি পছন্দের চরিত্র। তানভীর তাঁর চিত্রা নদীর পারেতে পাগল চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে মন্তব্য করেছেন যে – ‘যাওয়াও যা, আসাও তা।’ অর্থাৎ দেশ ছেড়ে যাওয়া বা আসা একই কথা। জীবনঢুলীতে গফুর পাগলা কয়েকবারই বলে – ‘কী হবে নে, কবে ডা কিডা?’ পাগলের এ ধরনের হেঁয়ালিপূর্ণ সংলাপে ঘটনাক্রমের অনির্দিষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে; একটা অনিশ্চয়তা প্রকাশ পেয়েছে; কাহিনি-কাঠামোর ধারাবাহিকতাও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কাহিনিকে কিছুটা রিলিফও দেয় এই ধরনের সংলাপ। আরো কয়েক জায়গায় পাগল চরিত্রটি এসেছে। তাকে একসময় নদীতে ভাসমান মৃতদেহ থেকে স্বর্ণালঙ্কার খুলে নিতেও দেখা যায়! চরিত্রটিতে অসাধারণ অভিনয় করেছেন স্বনামখ্যাত শিল্পনির্দেশক উত্তম গুহ। চরিত্রটির উপস্থিতি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও চরিত্রটির কথা মন থেকে মুছে যায় না। অনেকটা যাত্রাপালার বিবেক চরিত্রের ছাপে তানভীর তাঁর চলচ্চিত্রে পাগল চরিত্র সৃষ্টি করেন। পাগল চরিত্র হঠাৎ কাহিনিপটে আসে, হঠাৎ উধাও হয় –  কিন্তু একটা মন্তব্য রেখে যায়। এই মন্তব্যে বস্ত্তত চলচ্চিত্রকারের নিজেরই জীবন ও ভুবনভাবনা প্রকাশিত হয়। এই ধরনের চরিত্রের কাঠামোর মধ্যে পরিপূর্ণতা রাখা হয় না। জীবনঢুলীর প্রায় সব চরিত্রই অসম্পূর্ণ-অবিকশিত। এর মূল যে চরিত্র, জীবনঢুলী, তার চরিত্রটিও ছাড়া ছাড়া। এই প্রবণতাটাই ধারণা করি, এই চলচ্চিত্রের চরিত্র সৃষ্টির প্রধান স্কিম। একটা চকিত কাহিনিসূত্র-মন্তব্য-বক্তব্য রেখে সব চরিত্রই কাহিনিপট থেকে উধাও হয়ে যায়। এই ধরনের চরিত্র সৃষ্টির স্কিম তাঁর অন্য কোনো চলচ্চিত্রে নেই। একটা টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাহিনি এগিয়ে যায় – শেষ হয় দত্তবাড়ির বউসহ আগুনে পুড়তে থাকা ঘরের সামনে জীবনঢুলীর ঢাক বাজানোর দৃশ্য দিয়ে।

জীবনঢুলীর কাহিনি-কাঠামো বিশেলষণ করলে দেখা যায়, এর মধ্যে নানা সময় নানাকিছু লয়প্রাপ্ত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। কখনো হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে, কখনো দেশত্যাগের ঘটনা ঘটছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ধর্ষণ করা হচ্ছে ইত্যাদি। এসবের কারণে কাহিনিপটে বারবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম হচ্ছে – যে কোনোকিছু হারালেই
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম হয়। একেবারে শেষেও দেখা যায়, দত্তবাড়ির বউটি আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। এর অভিঘাত এসে পড়ে জীবনঢুলীর মনের ওপর। জীবনঢুলী একজন জাতশিল্পী, ঢাকি। তাই ঢাক বাজিয়েই এই অরাজকতা-অত্যাচারের প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া যে আর কোনোকিছু দিয়ে তার দ্রোহের জানান দেওয়া সম্ভব নয়। তানভীর মোকাম্মেল এই কাহিনির পরিণতিতে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর নিজের দ্রোহচেতনাই প্রকাশ পেয়েছে জ্বলন্ত ঘরের চারপাশে ঢাকির উন্মাদের মতো ঢাক বাজানোর মধ্যে। সমূহ ধ্বংস ও বিসর্জনের বাদ্যের মধ্যে জীবনের আহবানে বেজে ওঠে তার ঢাক। এই ঢাকি প্রকৃত প্রস্তাবে তানভীর মোকাম্মেল স্বয়ং – তাঁর জীবনচেতনাই তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন ঢাকির চরিত্রে। এরকম শিল্পিতভাবে প্রতিবাদ করার কারণেই এই চলচ্চিত্রের বক্তব্যের কাঠামোটি হয়ে উঠেছে নান্দনিক সৌকর্যমন্ডিত। বিষয়ভাবনা বিচারে এই জীবনচেতনা নির্মাতার শিল্পীমনের পরিচায়ক।

৩.২ নির্মাণভাবনা

চলচ্চিত্র একটি নির্মাণ। এর আঙ্গিকগত দিকটি ভাঙলে এর মধ্যে তিনটি উপাদান মূর্ত হয়ে ওঠে : দৃশ্য, শব্দ ও সম্পাদনাকর্ম। জীবনঢুলীর দৃশ্যমাত্রা নির্মাণে ক্যামেরার কাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ক্যামেরা-সঞ্চালক মাহফুজুর রহমান খান নিজ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। কোনো জার্ক ছাড়া দ্রুত গতিসম্পন্ন দৃশ্যখন্ডের চিত্রায়ণ এ চলচ্চিত্রের বিশেষ দিক। এ চলচ্চিত্রে একই দৃশ্যপটে নানামুখী ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ফ্রেমের মধ্যে সব ঘটনার সংস্থাপন করতে গিয়ে নির্মাতাকে মিজ-অ-সিনের আশ্রয় নিতে হয়েছে। এছাড়া এ ধরনের পিরিয়ড ফিল্মের উপায় নেই। সব ঘটনাকে একই স্থান ও সময়ে ধরতে গিয়ে ক্যামেরাকে তাই সর্বদা মুভমেন্টের মধ্যে থাকতে হয়েছে। ফলে ডান-বামে প্যান করা ছাড়াও দৃশ্যধারক ট্রাক শটের ওপরও জোর দিয়েছেন। কখনো কখনো ক্রেইন শটের আশ্রয় নিয়েছেন – ক্রেইন আপ বা ডাউন করে শট নিয়েছেন। এতে দৃশ্যপটে গতি তৈরি হয়েছে। লম্বা লম্বা শটে দৃশ্য ধারণের ফলে কোজআপ শটের সংখ্যা কিছুটা কম।

জীবনঢুলী সম্পূর্ণত লোকেশন-নির্ভর চলচ্চিত্র। লোকেশন নিজেই এ চলচ্চিত্রের একটি বড় চরিত্র। প্রায় সব ঘটনাই আউটডোর লোকেশনে সংঘটিত হয়। ইনডোর শুটিংয়ের তেমন কোনো প্রয়োজনই হয়নি। ফলে কৃত্রিম আলো ব্যবহারের প্রয়োজন ততটা পড়েনি – দিনের স্বাভাবিক আলোতেই শুটিংকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। ঘটনাপটে ধর্ষণচেষ্টা একটু বেশি পরিমাণে দেখানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে। বারবার এটা উপস্থাপনের ফলে বিষয়টি অভিঘাত তৈরিতে বাদ সেধেছে। মাঝির হত্যাদৃশ্যটিও খুবই দ্রুত নিষ্পন্ন হওয়ায় তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। আরেকটি দৃশ্যে এক ডাক্তার সীমান্ত পার হয়ে শরণার্থী হওয়ার পরও ভাবছেন যে তাকে আবার নিজ দেশেই ফিরতে হবে। কারণ ওখানে তার দরকার পড়তে পারে। এ জায়গাটিও দ্রুত নিষ্পন্ন হওয়ায় সিনেম্যাটিক মুহূর্ত তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য অভিনয় স্কিমও কিছুটা দায়ী। চলচ্চৈত্রিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে ভোকাল মডিউলেশন খুবই জরুরি। জীবনঢুলীতে কারো কারো অভিনয়ে এর ঘাটতি শ্রুত হয়েছে। অনেকেই চরিত্র ও ঘটনার মেজাজ অনুযায়ী কণ্ঠস্বরের ওঠানামার দিকে সচেষ্ট হননি। ফলে লাউড তথা উচ্চৈঃস্বরিক অ্যাকটিংয়ের প্রাবল্য বেশি মনে হয়েছে। অভিনয় দৃশ্যমাত্রার একটি বড় উপকরণ – এর ওপরই নির্ভর করে ঘটনাখন্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা ও এর অভিঘাত সৃষ্টির বিষয়টি। শতাব্দী ওয়াদুদ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, জ্যোতিকা জ্যোতি, রামেন্দু মজুমদার, তবিবুল ইসলাম বাবু, উত্তম গুহ, পরেশ আচার্য প্রমুখ এই ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ ও ‘অভিঘাত’ সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন। শতাব্দী ওয়াদুদ একটি দুরূহ চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর অভিনয়-ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে তার চরিত্রে দ্রোহচেতনার অভাব লক্ষ করা যায়। এই অভাব মনে হয় তানভীর মোকাম্মেল ইচ্ছে করেই রেখেছেন। কারণ যে সমাজবাস্তবতায় চরিত্রটির বিচরণ-অবস্থান সেখানে সে অধস্তন মানসিকতার অধিকারী – সবদিক থেকেই। সেই অবস্থান থেকে তার পক্ষে সবকিছু সয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করাটাই স্বাভাবিক। সেজন্য স্বজনদের হারিয়েও সে বেঁচে থাকতে চায়, তার ঢাকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তার শিল্পীসত্তাকে জিইয়ে রাখতে চায়। তাকে যখন রাজাকাররা লাথি মারে তখনও সে তা মেনে নেয়। এক রাজাকার বলে – ‘শালা, তুই মানুষ না অমানুষ?’ এ প্রশ্নটি সম্ভবত তার নিজেরও। সবাইকে হারিয়ে আসলে সে কীভাবে বিকারহীনভাবে বেঁচে আছে! সে আসলে একজন শিল্পী। এরকম অধস্তন, খেই হারিয়ে ফেলা চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন শতাব্দী ওয়াদুদ।

চরিত্রবর্গের পোশাক ও ব্যবহার্য দ্রব্যাদি দৃশ্যখন্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টিতে অবদান রাখে। জীবনঢুলীর অনেকেরই পোশাক-পরিচ্ছদ একেবারে নতুন, রঙিন। এতে চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কারো কারো, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের চরিত্রদের পরিধেয় বস্ত্র উইদারিং (Withering) করে কিছুটা মলিন করার দরকার ছিল। গরিব ঢাকির পোশাক এতটা ধোপদুরস্ত হওয়ার কথা কি? পোশাক পরিকল্পনাকারী চিত্রলেখা গুহ বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দিলে ভালো করতেন। জীবনঢুলীর শিল্পনির্দেশক উত্তম গুহ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে সেট নির্মাণসহ ডিটেইলসের কাজটি এমনভাবে করেছেন, যাতে করে বোঝাই যায় না যে এগুলো সবই তৈরি করা! এখানেই তাঁর এ বিষয়ে দক্ষতার প্রমাণ বিধৃত। এ চলচ্চিত্রের হত্যাযজ্ঞগুলো বাস্তবসম্মত হওয়ায় আবেগপূর্ণ হয়ে উঠেছে – বেদনাঘন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে দৃশ্যপটে। এসব হত্যাযজ্ঞসংবলিত দৃশ্যখন্ড নির্মাণে তানভীর মোকাম্মেল তাঁর চলচ্চিত্রবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন। ক্যামেরা-সঞ্চালক ও চলচ্চিত্রকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিধনযজ্ঞ এ চলচ্চিত্রে বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে। শিল্পনির্দেশকও এক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন। জীবনঢুলী এক বিচারে নিধনযজ্ঞবিষয়ক তথা হলোকোস্ট ফিল্ম – এজন্য এতে হত্যাযজ্ঞের ঘটনা বেশি। এত হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও নিউট্রাল কিছু দৃশ্যও দেখানো হয়েছে, যা স্টোরি স্পেসে একটু রিলিফ এনে দেয় – যেমন জাল দিয়ে মাছ ধরা, বৃষ্টি, ঢোলের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়া ইত্যাদি। ধ্বংসের মধ্যেও যে জীবন এগিয়ে চলে, দৃশ্যগুলো তার প্রমাণ।

দৃশ্যমাত্রার পাশাপাশি শব্দমাত্রাও চলচ্চিত্রে অর্থবহ অবদান রাখে। বিষয়টি অবহেলা করলে দৃশ্যমাত্রার সংগঠনে নির্মাতা যতই সৃষ্টিশীলতার পরিচয় রাখুক না কেন, চলচ্চিত্রটি ঝুলে যেতে পারে। দৃশ্যমাত্রার শটে যেমন ক্লোজআপ, মিড শট, মিড লং শট, লং শট ইত্যাদির মাধ্যমে ভিজ্যুয়াল পারসপেকটিভ তৈরি করা হয়, শব্দমাত্রার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে সাউন্ড পারসপেকটিভ তৈরির প্রয়োজন পড়ে। জীবনঢুলীতে এদিকটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে – ফলি সাউন্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে সজাগ ছিলেন নির্মাতা। কোথাও কোথাও অবশ্য তার ব্যত্যয় ঘটতে শোনা গেছে। চরিত্র লং শটে ধরা কিন্তু শব্দ শোনা যাচ্ছে ক্লোজআপে! শব্দের কাল-দৈশিক অবস্থান দৃশ্যের কাল-দৈশিক অবস্থানের নিরিখে ব্যবহৃত না হলে অভিঘাত তৈরি হয় না। দৃশ্যখন্ডের আশপাশে উৎপন্ন পারিপার্শ্বিক শব্দরাজি চলচ্চৈত্রিক মুহূর্ত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। গান শব্দমাত্রার একটি বিশেষ উপাদান। ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, জীবনঢুলীর অধিকাংশ গান আঞ্চলিক ভাষায় রচিত না হওয়ায় তা ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা আরোপিত ঠেকেছে, কয়েকটি গানের সুরও ঘটনাখন্ডের তাৎস্থানিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই মনে হয়নি, বিশেষ করে যে গানে স্টক টিউন ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও সবগুলো গানের সুরই আবেদনপূর্ণ। আবহসংগীতের ক্ষেত্রেও পরিচিত গানের সুর ব্যবহৃত হওয়ায় কোথাও কোথাও তা কাহিনিপটের স্থানিক ভিত্তি দিতে অপারগ হয়েছে। এ চলচ্চিত্রের সুরকার ও আবহসংগীতকার সৈয়দ সাবাব আলী আরজু পরিচিত গানের সুর পরিহার করলে ভালো করতেন। যেসব দৃশ্যে তিনি স্বাধীনভাবে নিজস্ব সাংগীতিক বোধ থেকে সুরখন্ড সৃষ্টি করে প্রয়োগ করেছেন সেসব দৃশ্য একেবারে প্রাণময় হয়ে উঠেছে। জীবনঢুলীর বহু জায়গায় তিনি দৃশ্যের মেজাজমাফিক আবহসংগীত প্রয়োগ করে মানবিক মুহূর্ত-অনুভূতি সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর আবহসংগীত রচনাগুণে চলচ্চিত্রটিও গতিশীল ঘটনাখন্ডের সমাহার হয়ে উঠেছে। তিনি একজন গুণী সুর-সংগীত সমঝদার। তাঁর সাংগীতিককর্ম থেকে আমাদের চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাক আরো সমৃদ্ধ হবে বলে আমার বিশ্বাস।

এ চলচ্চিত্রের একটি বড় সম্পদ হচ্ছে এর সম্পাদনাকর্মটি। একেবারে সেলাইবিহীন মনে না হলেও পুরো চলচ্চিত্রটি টান টান উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে এগিয়ে গেছে। দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্য ও দৃশ্যের সঙ্গে শব্দ গেঁথে গেঁথে কাহিনির যে ধারাবাহিকতা এতে তৈরি করা হয়েছে তা কোথাও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বিভিন্ন সময় ও স্থানে সংঘটিত নানা ঘটনা পর পর স্থাপন করে সম্পাদনাকর্মটি সম্পন্ন করেছেন মহাদেব শী। ঘটনাখন্ডগুলোর স্থিতিকাল ও পরস্পর জোড়া দেওয়ার রীতি, বলাই বাহুল্য, নির্ধারিত হয়েছে নির্মাতার মর্জিমাফিক। এক্ষেত্রে নির্মাতা তাঁর চলচ্চিত্রবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তবে সার্বিক বিচারে তিনি বিষয়বিন্যাসে যতটা সফল, নির্মাণশৈলীর ক্ষেত্রে ততটা নন।
শিল্প-চলচ্চিত্র হতে গেলে যে ধরনের প্রকরণ-পরিচর্যা প্রয়োজন তা যেন জীবনঢুলীতে কিছুটা অনুপস্থিত।

৪. সংখ্যালঘু থিমের শেষ কোথায়?

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তেতাল্লিশ বছর আগে। যখন এই অঞ্চলটি ‘রাষ্ট্র’ হয়নি তখনো এখানে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়েছে, তবে সচরাচর বাস্ত্তত্যাগে বাধ্য হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হলেও বিগত তেতাল্লিশ বছরে নানা সময়ে সংখ্যালঘুরা নিগ্রহের শিকার হয়েছে, বিশেষ করে সকল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই। মূলত সংখ্যালঘুদের আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে গণ্য করেই এদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। আওয়ামী লীগ জিতলেও আক্রমণ করা হয়, হারলেও করা হয়। এটাই যেন ওদের নিয়তি!

চারটি চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার পর বলা যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় বিগত তেতাল্লিশ বছরে নানা সময়ে সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন সংঘটিত হয়েছে, তার বহু দিক সবগুলো চলচ্চিত্রেই উপস্থাপিত হয়েছে।   পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর কর্তৃক সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, মানসিক নিপীড়ন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ধর্মান্তরিত করা, হিন্দুদের জমি দখলের পাঁয়তারা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ দ্বারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষা করা, হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার লড়াই,
আলবদর-রাজাকার কর্তৃক অত্যাচার-লুণ্ঠন, শরণার্থী হওয়া, দ্রোহী হওয়া, প্রতিবাদ করা, হিন্দু নিধনযজ্ঞ, দেশত্যাগ করা প্রভৃতি দিক আলোচ্য চলচ্চিত্র চতুষ্টয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। উল্লিখিত দিকগুলোর কিছু কিছু এখনো বাংলাদেশে সংঘটিত হচ্ছে – চলচ্চিত্রনির্মাতারা সেগুলো চলচ্চিত্রে পরিবাহিতও করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা সংখ্যালঘু নিপীড়নে অংশ নিয়েছিল, এখন তেতাল্লিশ বছর পরও কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী একই কর্ম করছে। ও আমার দেশের মাটিতে তা দেখানোও হয়েছে। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। চলচ্চিত্র এই মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে। শুধু সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নমূলক নানা ঘটনা চলচ্চিত্রমাধ্যমে পুনরুৎপাদন করাই যথেষ্ট নয় – এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার প্রসঙ্গটিও আসা দরকার। কারণ চলচ্চিত্র মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সমর্থ। তবে নির্মিত চলচ্চিত্রটি শিল্প-চলচ্চিত্র পর্যায়ভুক্ত হওয়া দরকার – এই ধরনের চলচ্চিত্র মানুষকে উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার অধিকারী করে। দর্শক ঘোরের মধ্যে প্রবেশ করে, ঘোরের মধ্যেই দর্শকের অবচেতন মনে মানবিকবোধের জন্ম হয়, যা সচেতন অবস্থায় হয় না।

৫.

মুক্তিযুদ্ধ যে বস্ত্তত একটি অসাম্প্রদায়িক ঘটনা ছিল চলচ্চিত্রমাধ্যমে তার উপস্থাপন খুবই জরুরি। না হলে নির্মিত চলচ্চিত্রে শুধু হিন্দু সম্প্রদায় তথা সংখ্যালঘুদের ওপর নানাবিধ নিপীড়নের চিত্র দেখালে তা সাম্প্রদায়িক একটি চরিত্র-দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে ফেলে; উপস্থাপনার ধরনটিও হয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক – নির্মাতা যতই অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার অধিকারী হোন না কেন। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার মনে করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই নিপীড়িত হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি চলচ্চিত্রেই প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনাগুলোই উপস্থাপিত হয়েছে। যদিও চরিত্র হিসেবে কিছু মুসলমান চরিত্র চারটি চলচ্চিত্রেই আছে, তাদের কেউ কেউ নিপীড়ন-খুনের শিকারও হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যালঘুদের ওপর নানাবিধ
অত্যাচার-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয়েছিল, সত্য। কিন্তু একে চলচ্চিত্রমাধ্যমে পরিবাহিত করা মানে সেই সন্ত্রাসকে পুনরায় উৎপাদন করা; সেই নির্যাতনকে পুনরায় সংঘটিত করা। তাই এই সংখ্যালঘু থিমকে চলচ্চিত্রসহ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে পরিবহনের সময় সতর্ক থাকা দরকার, যাতে তা একদেশদর্শী না হয়ে পড়ে – সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন না করে ফেলে। কারণ একাত্তর সালে সংঘটিত ক্ষমার অযোগ্য সেই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি আমাদের রাষ্ট্রে কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ঘটে চলেছে! যতদিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ না হবে, ততদিন চলচ্চিত্রে তাদের কথা কোনো না কোনোভাবে উপস্থাপিত হওয়ার প্রয়োজন পড়বেই।

Leave a Reply