মা হ মু দ আ ল জা মা ন
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে যে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সংগীতের ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রচার ও প্রসারে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রদূতের। সুর সৃষ্টি ও সেতারে তাঁর সৃষ্ট রাগিণী শ্রোতার মনে যে অনুরণন তুলত তা হয়ে উঠত মহান এক প্রাপ্তি। সাধারণ শ্রোতা ও সংগীতবোদ্ধা সকলেই তাঁর কীর্তি, সুর ও ছন্দ থেকে রস গ্রহণ করেছেন। তাঁর মেধা, মনন ও সুর সৃষ্টি মানুষকে গহনলোকে নিয়ে যেত। দেহ-মনে ছড়িয়ে দিত এক প্রশান্তি। রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের পর তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে জিনিয়াস বাঙালি।
সেজন্য বোধকরি তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু ও সখা ইয়েহুদি মেনুহিন তাঁর সংগীতের সৃজনকে তুলনা করেছেন মোৎসার্টের সঙ্গে। মোৎসার্টের প্রতি তাঁরও বিনম্র শ্রদ্ধা ছিল। নিজে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে বারংবার স্মরণ করেছেন মোৎসার্টের ঐন্দ্রজালিক সুরের অনুষঙ্গ। লিখেছেন একটি ক্ষুদ্র নিবন্ধ এই সুরস্রষ্টাকে নিয়ে। এই নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘মোৎজার্টের একটা বড় ব্যাপার যে, তিনি ও তাঁর সংগীত খুব সরল, আবার জটিলও। এ যে কী কঠিন ব্যাপার তা আমরা যাঁরা গানবাজনা করি তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। একেই তো বলে শ্রেষ্ঠ সংগীত। সবে তো দুশো বছর হলো, মানবসভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিনই ভদ্রলোককে শুনতে হবে। আর যেই শুনবে সেই জানবে সংগীতে ভগবানের রূপ কী রকম।’
বিটলসের জর্জ হ্যারিসন তাঁর শিষত্ব গ্রহণ করে ভারতীয় সংগীতের ঐশ্বর্যময় ভুবনে শুধু আপ্লুত হননি, সেই সাংগীতিক ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেছিলেন প্রাণমন দিয়ে। এই তিন বন্ধু তাঁদের সৃজনের পথ ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলিত সুরমূর্ছনাকে নবীন এক মাত্রা দান করেছিলেন, যেখানে লোকসংগীতও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি কর্ণাটকী সংগীতের ঝরনাতলা থেকে তাঁর পরিগ্রহণ অনেক সংগীতবোদ্ধাকে অভিভূত করেছিল।
এই মহান সেতারবাদক বিরানব্বই বছর বয়সে ১১ ডিসেম্বর ২০১২ পরলোকগমন করেছেন। অথচ এই মৃত্যু নিয়ে নিজের মনের ভেতর কত না ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তাঁর।
রবিশঙ্করের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে দিল্লিতে তাঁর এক সংবর্ধনা হয়েছিল। সেদিন হলভর্তি শ্রোতা ছিল। প্রেক্ষাগৃহে শিষ্যবর্গের ঐকতান পরিবেশনের পর রবিশঙ্কর পরিবেশন করেছিলেন যোগেশ্বরী ও মাঁজ খাম্বাজ।
অনুষ্ঠানে শ্রোতারা শুনেছিলেন তাঁর স্মৃতিচারণ। এই স্মৃতিচারণে তাঁর আঁকুতি ছিল বেঁচে থাকার। বলেছিলেন, ‘বিগত কিছুদিনে মৃত্যু কয়েকবারই এসে কড়া নেড়ে গেছে আমার দোরে। আমি কেবল বলেছি, আমায় আরো কয়েকটা দিন সময় দাও। আমার মেয়েটি ছোট, ওকে আর অন্য কিছু ছাত্রছাত্রীকে সুরের তলানি যেটুকু আছে, তা তুলে দিয়ে যেতে চাই। সবুর করবে না?’
পঁচাত্তর বছরের এই আকুতি ও প্রার্থনার পর তিনি বেঁচেছিলেন দীর্ঘদিন। ঈশ্বর তাঁর এ প্রার্থনা শুনেছিলেন। এই দীর্ঘদিন তিনি কন্যা আনুশকাকে মনপ্রাণ দিয়ে শিখিয়েছেন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে কন্যার যে অর্জন হয়েছে আশা করা যায় তাতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মাইহার ঘরানায় নতুন কিছু প্রাপ্তি হবে এবং এই কন্যার মধ্যে রবিশঙ্কর বেঁচে থাকবেন।
জন্ম হয়েছিল বারানসিতে ৭ এপ্রিল ১৯২০ তারিখে। পিতার আদি নিবাস যশোরের নড়াইলে। সেখানেই তাঁর শৈশব কাটে। সে সময়টা খুব সুখের ছিল না। শৈশবে দারিদ্র্যের কষ্টকে বুঝতে দেননি তাঁর মা হেমাঙ্গিনী দেবী। জমানো অলংকার, শাড়ি, এমনকি তৈজসপত্র বিক্রি বা বাঁধা রেখে দিন কাটিয়েছেন। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না দীর্ঘদিন। বাবা ছিলেন ব্যবহারজীবী। বাবা এক মেম বিয়ে করে এতগুলো ভাইকে মায়ের কাছে সমর্পণ করে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। বাব ছিলেন জ্ঞানী, মা খুবই সাধারণ। কোথায় যেন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। বড় হয়ে রবিশঙ্কর এ উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। ছেলেবেলায় এই বারানসির ঘাট ও গঙ্গা নদীর কত স্মৃতি অমোচনীয়ভাবে গেঁথে ছিল তাঁর হৃদয় ও মনে, আত্মস্মৃতিতে তার উল্লেখ আছে। এই আত্মস্মৃতি আর রাগ-অনুরাগ থেকে তাঁর জীবনবৃত্তের সংগ্রামের যে রূপটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তা শুধু একজন শিল্পীর বৈচিত্র্যময় জীবনযুদ্ধের পরিক্রমা নয়, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতেরও এক ইতিহাস। বারানসির ঘাটে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন জন্ম-মৃত্যু, আনন্দ-বেদনা। দিন-রাত্রি এই ঘাটে শুনেছেন নানা রাগিণীর বৈচিত্র্যময় সুর। এই ঘাট বালক বয়সে তাঁর সত্তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যাকালে এই ঘাটে বৈচিত্র্যময় সুর ভেসে বেড়াত। একেক সময়ের একেক সুর। কখনো খ্যাতনামা কেউ গাইতেন, কখনো কোনো শিক্ষানবিশ। আবার সানাইয়ের সুর ও মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যেত দূর থেকে। কখনো ঈশ্বরে সমর্পিত মন্ত্রোচ্চারণ।
বাবা আলাউদ্দিন খাঁর হাতে ১৯৩০ সালে মা হেমাঙ্গিনী দেবী যখন সঁপে দিলেন রবিশঙ্করকে, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর আরেক জীবন। বোম্বাই বন্দরের এ স্মৃতি তাঁকে কতভাবে যে তাড়া করেছে নানা সাক্ষাৎকার ও লেখায় সে-কথা তিনি বারংবার উল্লেখ করেছেন। তাঁর পঁচাত্তরতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘স্মৃতি, সৃষ্টি আলাপ’ শিরোনামে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, পুনরাবৃত্তি আর রোমন্থনের জন্য পড়ে আছে মৃত্যু, বিচ্ছেদ আর বিরহের স্মৃতি। যে রকম একটা স্মৃতির কথা বারবার ফিরে আসে তাঁর কথায়, লেখায় – সম্ভবত খুব অন্তর্লীন, গুপ্তভাবে তাঁর বাজনাতেও। বোম্বাই বন্দরে দাঁড়িয়ে মা হেমাঙ্গিনী দেবী হাত নাড়ছেন, আর জাহাজ একটু-একটু করে সরে যাচ্ছে ডক ছেড়ে। ১৯৩৫ সালের ঘটনা সেটা, রবিশঙ্করের (তখন রবীন্দ্রশঙ্কর) বয়স তখন পনেরো। দাদা উদয়শঙ্করের নৃত্যের দলের সঙ্গে ইউরোপ যাচ্ছেন নবীন কিশোর। তার একটু আগে দলের সংগীত পরিচালক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর হাতে ছেলেকে সমর্পণ করে মা বলেছেন, ‘কদিন আগে ওর বাবা মারা গেছেন। বড় দুরন্ত ছেলে আমার। একটু দেখবেন বাবা।’ অমনি ডুকরে কেঁদে উঠেছেন খাঁ সাহেব, ‘এ কী বলেন মা জননী। আপনি তো রত্নাগর্ভা। উদয়শঙ্করের মতো পুত্র ধারণ করেছেন গর্ভে। আজ থিকে রবু আমার বড় ছেলে, আলী আকবর আমার ছোট ছেলে।’ কদিন আগেও দিল্লির বাড়ির বাগানে বসে এই কথা বলতে বলতে গলা বুজে আসছিল শিল্পীর। বললেন, ‘ওই শেষ দেখা। কিছুদিন বাদে টেলিগ্রাম এলো, মা নেই। তা শুনে বাবারও জানি কীরকম একটা হয়ে গেল, আমাকে বরাবরের মতো বকাঝকা ছেড়ে দিলেন আর শুধু শেখাতে লাগলেন।’
মধ্যপ্রদেশের মাইহারে গুরুগৃহে যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তা কত গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছিল তাঁর শিল্পিত সত্তায়, সে-কথা তিনি স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। বাবা আলাউদ্দিনের কড়া শাসন, দৈনিক ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টা পরিশ্রম ও শিক্ষাগ্রহণ। এই গ্রহণই তাঁর মধ্যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্তর্লোকটি উপলব্ধির ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।
বাবা আলাউদ্দিন যন্ত্রসংগীতে, বিশেষত সেতার ও সরোদে কুশলী ও দক্ষ ছিলেন। এই দুটি যন্ত্রের বাদনকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠের লাবণ্যও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে বহু মাত্রা দান করেছিল। শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর বহুমুখী অবদানের জন্য সমকালে হয়ে উঠেছিলেন শ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব। মাইহারে একই সঙ্গে তিনি রবিশঙ্কর আর আলী আকবরকে যন্ত্র ও কণ্ঠে সংগীত তালিম দেন। নিয়মানুবর্তিতা ও কঠোর শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে রবিশঙ্কর কয়েক বছরের সাধনায় সেতারবাদনে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন। তারপর দিল্লি বেতারে চাকরি এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবে সেতারবাদন তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সংগীত অনুষ্ঠানে পঞ্চাশের দশকে আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তিনি যুগলবন্দি করেন। গুরুভাই আলী আকবরের সঙ্গে তাঁর সমঝোতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার এক আশ্চর্য নিদর্শন এই যুগলবন্দি। পরে কয়েকটি যুগলবন্দি দীর্ঘ বাদনে প্রকাশিত হয়েছে এবং অগণিত মানুষ এই দীর্ঘ বাদনগুলো থেকে আনন্দ পেয়েছে। এছাড়া আইপিটির সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা এবং খাজা আহমদ আব্বাস পরিচালিত ধরতি কে লাল চলচ্চিত্রে সংগীত রচনায় তিনি যে বুদ্ধি ও শৈলীর ছাপ রেখে যান তাতে রবিশঙ্করের অঙ্গীকারবোধ ও শক্তিমত্তার পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে। ১৯৫৫ সালে তিনি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর সংগীত এবং ১৯৫৭ সালে তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা ছবিতে আবহসংগীত রচনা করেন। এ দুটি সিনেমায় তাঁর সংগীত রচনা তাঁকে চলচ্চিত্রে মহৎ সুরস্রষ্টা বলে চিহ্নিত করেছিল। কাবুলিওয়ালা চলচ্চিত্রের জন্য তিনি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার বিয়ার অর্জন করলেও পথের পাঁচালীর আবহসংগীত রচনা তাঁকে মানবিক গুণাবলির মহৎ স্রষ্টা করে তুলেছিল। তাঁর সুরারোপ, এই কীর্তি রবিশঙ্করের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। সত্যজিতের অনুরোধে রাশ দেখে কত দ্রুত তিনি এ সৃষ্টি করেছিলেন, তা সংগীতরসিকদের বিস্ময়াভিভূত করেছে। এ নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে তাঁর আশ্চর্য প্রতিভা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরো প্রসারিত করে। তিনি বলেন, ‘টালিগঞ্জের ভবানী সিনেমাতে রাশ দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। কী আর বলব। সেই রাশ দেখে আমি তো আবেগে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। আমি ওঁকে মন উজাড় করে অভিনন্দন জানিয়ে বললাম, এ ছবির সুর আমি করছিই। বলতে নেই, রাশ দেখতে দেখতেই ছবির থিম মিউজিকটা যেন গুনগুন করে ভেতরে ভেতরে পাক দিয়ে উঠেছিল। আমি রাজী আছি জেনেই উনি শহরের একটা লজঝড় স্টুডিয়োও বুক করে ফেললেন। এবং মাত্র এক রাত সময়ে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে যেভাবে পথের পাঁচালীর সুর আমি করতে পেরেছিলাম তা তো এক কথায় ইতিহাস।’
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রবিশঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন দেশে ও বিদেশে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের গৌরবোজ্জ্বল এক শিল্পী। সংগীত সম্মেলন, ডিক্সন লেন সংগীত উৎসব, কলকাতার বিভিন্ন মাহফিলে, লক্ষেèৗ, বারানসি দিল্লিতে অনুরাগজনদের সম্মুখে বা সংগীত উৎসবে কিংবা কলকাতায় জ্ঞানঘোষের বাড়িতে নির্বাচিত বোদ্ধা শ্রোতৃমণ্ডলীর সম্মুখে সেতারবাদন তাঁকে করে তুলেছিল কিংবদন্তিতুল্য এক শিল্পী। এসব অনুষ্ঠানের সুবাদে তিনি আলোচিত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। দৈনিক পত্রিকার পাতায় বা দেশ পত্রিকায় তাঁর পরিবেশনার সমীক্ষা পত্রস্থ হয়েছে। সংবাদপত্রের শিরোনামও হয়েছেন কখনো। এমনকি রবিশঙ্করের বাজনার স্বকীয়তা ও শুদ্ধতা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমতো তর্ক উঠেছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের শ্রোতৃমণ্ডলীও তাঁর নিত্য নব সৃষ্ট রাগে ভারতীয় সংগীতের অন্তর্নিহিত শক্তি নতুন করে অনুভব করেছিলেন। সেজন্য ষাটের দশকের বিলোড়ন সৃষ্টিকারী বিটলরা তাঁর সেতারবাদনে আকৃষ্ট হবেন কিংবা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের ধীশক্তি নিয়ে নবীন আলোকে উজ্জীবিত বোধ করবেন এবং রবিশঙ্কর এই উজ্জীবনে প্রধান ভূমিকা পালন করবেন এ যেন খুব স্বাভাবিক ছিল। এই যাত্রাপথে তাঁর নবসৃষ্ট সুর ও রাগ পাশ্চাত্যকে এতটাই উদ্বুদ্ধ করেছিল যে, তিনি পৃথিবীর যেকোনো বড় শহরে যখন অনুষ্ঠান করছেন তা নবীন শ্রোতৃমণ্ডলীর আনুকূল্যে এক সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। এই মেলবন্ধ তাঁকে বিশেষভাবে বিশ্বনাগরিক করে তুলেছিল। বিশেষ করে জর্জ হ্যারিসন তাঁর শিষত্ব গ্রহণ করায় রবিশঙ্কর অভূতপূর্বভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেন। এই সময়ে তিনি ঘরানার শুদ্ধতার সঙ্গে শৈলী ও ছন্দের সঙ্গে আলাপে বিস্তারে ও নিজের স্বকীয়তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের কিছু অনুষঙ্গের মিশ্রণ ঘটালে ভারতবর্ষে সমালোচিত হন। যদিও তাঁর সৃষ্ট সুর ও রাগ শুধু তাঁর শিষ্যদের মধ্যে সীমিত থাকেনি, অন্যরাও কেউ তাঁর দু-চারটি রাগ গ্রহণ করেছিলেন।
বহুবর্ণী এই মানুষের প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা সম্পর্কে তিনি রাগ-অনুরাগে মুক্তমনে খুবই খোলামেলা আলোচনা করেছেন। এতটুকু আবরণ দেননি। নারী নিয়ে, প্রথম স্ত্রী গুরু আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা অসামান্য শিল্পী অন্নপূর্ণার সঙ্গে বিবাহ প্রসঙ্গে, অভিমান ও বিচ্ছেদ নিয়ে, কোনো কোনো নারীর সঙ্গে প্রেম নিয়ে এতটা খোলামেলা কথা বলা ইতোপূর্বে আমরা খুব একটা প্রত্যক্ষ করিনি। ভারতীয় রুচিবোধে লালিত অনেককে এ আহত করলেও তা হয়ে উঠেছিল তাঁর আধুনিক মুক্তমনের আশ্চর্য প্রকাশ।
বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় রবিশঙ্কর উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করবেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এদেশের আপামর জনসাধারণ যখন নানাভাবে বিপর্যস্ত ও নিত্যদিন মৃত্যুর মুখোমুখি, শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন যখন করছেন লাখ লাখ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করছেন, রবিশঙ্কর সেই দুঃসময়ে তাঁর শিষ্য জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ করেন। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে এই কনসার্টটি হয়। এই কনসার্টের জন্য জুলাই মাসে তিনি বেশ পরিশ্রম করেন। প্রথম মহলা অনুষ্ঠিত হয় ২৬ জুলাই নিউইয়র্কের নোলা স্টুডিওতে। কনসার্টে চল্লিশ হাজার দর্শকের সমাগম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ করে তিনি এ অঞ্চলের বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। একাত্তরের ১ আগস্ট এই অনুষ্ঠানের পর পাশ্চাত্যে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়, ২০০৫ সালে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবামের ডিভিডি প্রকাশিত হয়েছিল। সেটির ভূমিকায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলেছিলেন, পঁচাত্তর বছরের সংগীতজীবনে যত কনসার্ট করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই কনসার্টটিই।
বাংলাদেশ কনসার্টে রবিশঙ্কর, বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসনের কণ্ঠ থেকে যে আর্তি ঝরে পড়েছিল, সুরের মূর্ছনায় শ্রোতারা মুগ্ধ বিস্ময়ে তা উপলব্ধি করেছিলেন। কনসার্টটির আবেগস্পর্শী অভিনবত্ব ও বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম তাঁদের সত্তায় কীভাবে যে মিশে গিয়েছিল এ আর্তিতে তা স্পষ্ট। এ শুধু এই অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের দুঃখ-বেদনাকে তুলে ধরেনি, মুক্তিকামী মানুষের গভীর জীবনযুদ্ধের আলেখ্য হয়ে উঠেছিল। এ কনসার্টেও রবিশঙ্করের প্রতিভার এবং সংগঠনশক্তির বিচ্ছুরণ আমাদের আবেগাপ্লুত করে তোলে।
সন্দেহ নেই, রবিশঙ্করের মৃত্যুতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। এই সংগীতসাধক আটটি দশক চর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়ে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন, যা ছিল সংগীতবিশ্বে সত্যিকার অর্থেই মহত্তম এক কীর্তি। কিন্তু দুঃখ হয়, কন্যা আনুশকা ছাড়া তিনি অন্য কাউকে যোগ্যভাবে দীক্ষিত করেননি।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011