সৌ মি ত্র ব সু
একশ বছর বয়েস হয়ে এলো শম্ভু মিত্রের? যখন তাঁকে দেখেছি, কথা শুনেছি, থেকেছি ধরাছোঁয়ার মধ্যে, তখন এই বোধটা নিশ্চয় তৈরি হয়েছিল যে ইনি একজন খুব বড়মাপের মানুষ, কিন্তু আজ এতদিন পরে নিজেকে বেশ কিছুটা দূরবর্তী রেখে যেমন করে বিশ্লেষণ করতে পারি তাঁর কাজকে, মতামতের সেই জোর তখন তৈরি হয়নি। তখন তিনি জ্যাঠামশায়, রমাপ্রসাদ বণিকের দেখাদেখি ওই নামেই তাঁকে ডাকতাম আমি, কোনো কোনো সমবয়সীর বিদ্রূপকে অগ্রাহ্য করেই। বাংলা থিয়েটারে সবাইকেই নাম ধরে দাদা ডাকার চালু প্রথাটা রমাই প্রথম ভেঙেছিল কি না বলতে পারব না।
শম্ভু মিত্রকে আমি খুব বেশিদিন পাইনি, হিসাব মতো মোটামুটি পঁচাত্তরের শেষ থেকে বছর দুই-তিনের জন্যে, তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। তার পরে যোগাযোগ হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে, কখনো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে নিয়ে যাবার সূত্রে, কখনো সাহিত্য পরিষৎ-এর কোনো প্রস্তাব পৌঁছে দেবার কাজে। ফলে, তাঁর সম্পর্কে আমার তুলনায় অনেক বেশি স্মৃতি ধারণ করে রেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়, তবু আমার মনে রাখা কথাগুলো তো আমারই। একটি সদ্য যুবা কেমন করে দেখছে মানুষটিকে, কেমন করে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তাঁর বিষয়ে একটা ব্যক্তিগত ধারণা করে নিচ্ছে, তার আখ্যান হিসেবে দু-একটা গল্প বলবার ডাক পেয়েছি। শম্ভু মিত্রকে নিয়ে নানা পন্ডিতি আলোচনার ফাঁকে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাগুলো পাঠকের মনে অন্যরকম একটা জায়গা করে নিতেও পারে। এর মধ্যে কোনো কোনো গল্প আগে লিখেছি, তবু সেসব কথা বারবার করে বলতে ইচ্ছে করে।
যেমন, এক্ষুনি মনে পড়ছে, বহুরূপীতে আসার প্রায় পিঠোপিঠিই রাজা নাটকের বিশ্ববসুর পার্ট জুটেছিল আমার কপালে। গভীর মনোযোগে মহলা দিচ্ছি, শম্ভু মিত্র একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিশ্ববসুর পোশাক কী হবে?’ জানি না তো, কেউ বলে দেয়নি। শম্ভু মিত্রের প্রশ্নটা আজো কানে বাজে – ‘সে কি গো, একটা পার্ট করবে, আর তার পোশাক কী হবে জেনে নেবে না?’ যেটুকু শিখেছি, এই রকম করেই শিখেছি।
মনের মধ্যে রেখে দেওয়া মিষ্টি ছবি একটা বার করি। খুব বড় পুরস্কার পেয়েছিলাম পাখিতে অভিনয় করে। শম্ভু মিত্র দেখতে এসেছিলেন এ নাটক। সেদিন তো সকাল থেকে আমার গলা খারাপ। একটু সহানুভূতির জন্যে রমাকে বললাম সেকথা, রমা মাছি তাড়ানোর মতো করে উড়িয়ে দিলো, ‘জেঠু দেখতে আসছেন বলে এত টেনশন করছিস কেন, যেমন করে করিস তেমনই করবি।’ আরে, আশ্চর্য! শম্ভু মিত্র আসছেন বলে আমার গলা খারাপ এটা ওকে কে বলে দিলো। এইসব মনের কথা পড়া লোকজনকে নিয়ে মুশকিল না, বলুন। অভিনয় হয়ে গেল। সাজঘরে বসে শম্ভু মিত্র চা খাচ্ছেন। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভুলগুলো যদি একটু বলে দেন।’ ঠোঁটের অল্প দূরে চায়ের কাপ, মুখ তুলে উদার গলায় বললেন, ‘না না, ভালো হয়েছে।’ তারপর একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তৃপ্তি মিত্রকে বললেন, ‘মণি, আমাদের সৌমিত্র তো অ্যাকটর হয়ে গেল।’ সবাই অল্পস্বল্প হাসল, তারপর অন্য কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি চুপিসারে বেরিয়ে এলাম সাজঘরের বাইরে, অ্যাকাডেমির বাথরুমের সামনেটায়। দুহাত মুঠো করে একা একাই লাফাতে লাগলাম।
আর একটা গল্প মনে পড়ে গেল, এই সুযোগে বলে ফেলি। প্রথমদিকেই, অয়দিপাউস নাটকে ভগ্নদূতের পার্টটা নিয়ে একটা টক্কর হয়েছিল। চরিত্রটার দু-একটা অভিনয় করেছিল সমীরণ বলে একটি ছেলে, তার আগে করতেন মুকুন্দ দাস। নাটকের যাকে বলে চূড়ান্ত মুহূর্তে আসে এই দূত, গ্রিক নাটকের নিয়মমতো আড়ালে ঘটা ভয়ংকর সব ঘটনার তীব্র বিবরণ দিয়ে যায়। রানী য়োকাস্তে যাকে বিয়ে করেছেন, দুটি কন্যার জন্ম দিয়েছেন সে আসলে তাঁর নিজের ছেলে, সেই ছেলে, অয়দিপাউস আবার খুন করেছে তাঁর স্বামী, মানে নিজের বাবাকে। এই সত্য জানার পর রানী ছুটতে ছুটতে অন্দরমহলে চলে গেছেন, দু-এক লহমা পরে ভেতরে চলে গেছেন রাজা অয়দিপাউস নিজেও। দূত এসে খবর দেবে, রানী আত্মহত্যা করেছেন, আর রানীর পোশাকের কাঁটা নিজের দুই চোখে বিঁধিয়ে দিয়ে অন্ধ হয়ে গেছেন রাজা। সংলাপে আছে, ‘অন্ধ হও, তুমি অন্ধ হও’ – এই কথা বলতে বলতে বারবার, বারবার সেই কাঁটা নিজের দুই চোখের মধ্যে …। প্রথমে বলল সমীরণ, তারপরে আমার পালা। আমি, যেমনটা মঞ্চে হতো, মাটিতে বসে দুই হাত আকাশের দিকে তুলে বললাম, ‘অন্ধ
হ-ও, তুমি অন্ধ হও – এই কথা বলতে বলতে বারবার, বারবার সেই কাঁটা নিজের দুই চোখের মধ্যে – মানে টেনে টেনে, হাহাকারের মতো করে বলেছিলাম। তারপরেই এলো সেই দুঃখ পাবার মুহূর্ত। শম্ভু মিত্র আমাকে বললেন, ‘ওই যে বাবা তুমি বললে, অন্ধ হও, ওইটে খুব কায়দা করে বলেছ।’ যাঁরা শম্ভু মিত্রের কথা বলার ধরনের সঙ্গে পরিচিত নন তাঁরা বুঝতে পারবেন কি না জানি না, কায়দা করে কথাটা আসলে প্রশংসা করে বলা, মানে ওই বলাটা তুমি খুব বুদ্ধি করে বার করেছ – এই রকম মানেতে বলা। এই প্রশংসাবাক্যটির পরে বললেন, ‘তবে সমীরণ তো করছে ওই পার্টটা, ওই করুক।’
আমি যখন বহুরূপীতে গেছি তখন শম্ভু মিত্র খুব নিয়মিত অভিনয় করেন না, মাঝেমধ্যে হয়তো উৎসব উপলক্ষে প্রযোজনা করা হয় পুরনো নাটকগুলো। তেমনি করেই চার অধ্যায় হবে। আমি নতমুখে কালীপ্রসাদ ঘোষকে বললাম, যদি দেখবার অনুমতি পাওয়া যায়। দাবি করে বলার উপায় ছিল না, বহুরূপীতে ঘুরত একটা গল্প, সত্যি কি না জানি না। অসীমদা বলে একজন টেপরেকর্ডার বাজাত। সে একদিন শম্ভু মিত্রকে বলেছিল, বাইরে থেকে কোন্ একটা নাটক দেখতে চায়, খুব ভালো হয়েছে নাকি নাটকটা। টেপ বাজানোটা অন্য কাউকে ভালো করে শিখিয়ে দেবে, কোনো অসুবিধে হবে না। শম্ভু মিত্র নাকি সরল মুখে বলেছিলেন, ‘অসীম, আমি শুনেছি শম্ভু মিত্তির নাকি অয়দিপাউসে খুব ভালো অভিনয় করে, কী করে দেখা যায় বলো তো?’ আমি অবশ্য তেমন কোনো জবাব পেলাম না, বহুরূপীতে যারা আছে তাদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে ছোট বলে ভেতরে ভেতরে একটু আদরই হয়তো দিত সবাই। নাটক দেখার অনুমতি দেওয়া হলো। নাটক শেষে ভেতরে গেলাম। শম্ভু মিত্র মেকআপ তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগল?’ – খুব ভালো। এর পরেই শম্ভু মিত্রোচিত অবধারিত প্রশ্ন, ‘কেন ভালো লাগল?’ আমি ঝড়াক করে বললাম, ‘উপন্যাসটা পড়ে যেগুলো বুঝতে পারিনি সেগুলো বুঝতে পারলাম।’ ঠান্ডা চোখে একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন শম্ভু মিত্র, তারপর বললেন, তাহলে অভিনয়টা হচ্ছে নোট বইয়ের মতো, পড়ে যেটা বোঝা যায় না সেটা বুঝিয়ে দেবার জন্যেই অভিনয় করা?’ ক্লিন বোল্ড। সত্যিই তো, অভিনয়ের কাজটা কী তাহলে? সে কি সাহিত্যের ব্যাখ্যাকার তল্পিবাহক শুধু? এখন রবীন্দ্রভারতীতে ছাত্রদের থিয়েটার পড়াই, লিখিত নাটকের সঙ্গে মঞ্চ প্রযোজনা কোথায় আলাদা হয়ে যায়, মঞ্চ প্রযোজনা কেমন করে তৈরি করে তার নিজস্ব ভাষ্য তাই নিয়েও কথা বলতে হয়, তখন মনে পড়ে যায় চার অধ্যায়ের সেই সাজঘর, মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগিয়ে দেওয়া শম্ভু মিত্রের মুখ।
তখন মহলাঘরে খুব ঢোকেন না শম্ভু মিত্র, কিন্তু আসেন তো রোজই, এসে বাইরের চত্বরে বসে থাকেন। তাঁর সামনে গিয়ে বসে পড়লেই হলো, কথা শুরু করে দিলেই হলো, অনর্গল কথা বলে যাবেন, যে-কোনো বিষয় নিয়ে, খুব সহজ ধরনে। সেসব কথা কখনই উঁচু আসন থেকে জ্ঞান দেওয়ার মতো করে নয়, বরং জিজ্ঞাসুকে অগাধ জলে ফেলে দিতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন। একবার যেমন জিজ্ঞেস করেছিলাম স্তানিস্লাভস্কি আর ব্রেখটের তফাৎ নিয়ে। উনি বললেন, ‘পড়ো, পড়ে দেখো, তারপরে এসো। আমি তো ডিকশনারি নই।’ আর একবার প্রশ্ন করেছিলাম, যেসব হলে সাধারণভাবে কথা শোনানো যায় না সেখানে কী করে কথা শোনাব? উত্তর এলো, ‘যেসব হলে কথা শোনানো যায় সেখানে তুমি কী করবে তা নিয়ে আমি বলতে পারি, কথা শোনানো যায় না এমন হলের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।’ একটা মন্তব্যের জেরে হাসি দেখেছিলাম তাঁর মুখে। পুতুল খেলা নিয়ে কথা হচ্ছিল। শম্ভু মিত্রের লেখাতেই আছে, তিনি একটু বড়মাপের চরিত্রে অভিনয় করা পছন্দ করেন, ইংরেজিতে যাকে বলে larger than life, দশচক্র, অয়দিপাউস বা চার অধ্যায়ের মতো নাটকে যেসব অভিনয় আমরা দেখেছি। পুতুল খেলার তপন তো তেমন চরিত্র নয়। শম্ভু মিত্র বলছিলেন, পুতুল খেলায় তপন হলো ফুয়েল (ঠিক এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিলেন), তার কাজ শুধু বুলুর চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তোলা। সেই কথোপকথনেই আমি বলেছিলাম, আমার কেমন মনে হয়, আমিও বড় হলে তপনের মতোই হয়ে যাব। উনি একটু হেসেছিলেন। মুখে যে যাই বলুক, পুরুষতন্ত্রের বীজ যে আমাদের প্রবৃত্তির মধ্যেই থাকে, তার থেকে বেরোনো যে প্রকৃতিগতভাবেই খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব, সেটা বুঝতে পেরেছে এই ছেলে, একথা ভেবেই কি তাঁর এই হাসি? হবে হয়তো। আর শুনেছি শিশিরকুমারকে নিয়ে (উনি বলতেন ভাদুড়ি মশাই) নানা গল্প। তার মধ্যে মঞ্চের ওপর এক-আধটা দুষ্টুমির কাহিনিও শুনেছি।
তার মধ্যেই আমার কপালে জুটে গেল অভিনয় নিয়ে, প্রযোজনা নিয়ে সবচেয়ে বড় শিক্ষার পরিসর, কুমার রায়ের নির্দেশনায় নিধুবাবুকে নিয়ে একটি নাটকের মহলা শুরু হলো বহুরূপীতে। তখন নিয়মিতই দলে আসতেন শম্ভু মিত্র, কিন্তু নিজের অভিনীত নাটক ছাড়া তাঁকে মহলাঘরে ঢুকতে দেখা যেত না। কে জানে কেন সেই মহলায় ঢুকে পড়লেন শম্ভু মিত্র, কুমার রায় সসম্মানে জায়গা ছেড়ে দিলেন তাঁকে। যাই হোক, আমার স্থান হলো তাঁর ঠিক ডান পাশে, প্রায় ডান হাত বলা যেতে পারে। নাটকটাকে নিয়ে অনবরত কাটাছেঁড়া করা হতো, আর আমি পান্ডুলিপিতে সেইসব লিখে রাখতাম। দু-তিনটে ঘটনার কথা মনে আছে। সুনীল সরকার মুখুজ্জে নামের চরিত্রে অভিনয় করতেন, তাঁর মুখে একটি পদ্য ছিল। সে পদ্যের একটি লাইনে ছিল – ‘তব পদাম্বুজে ভবানী।’ হঠাৎ শম্ভু মিত্র সুনীলদাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পদাম্বুজ মানে কী?’ নিজের সংলাপের মধ্যে যে এমন একটা মারাত্মক ফাঁদ লুকিয়ে আছে সুনীলদা তা কল্পনাও করেননি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোতলাতে লাগলেন। অনেক কষ্টে বোধহয় তাঁর মুখ দিয়েই শব্দটাকে ভাঙা গেল – ‘পদ মানে পা, আর -’
‘ – আর অম্বুজ মানে?’
বেশ কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর আমতা আমতা করে সুনীলদা বললেন, ‘চূড়া’। ঠিক চূড়া শব্দটাই কেন তাঁর মাথায় এসেছিল আমি জানি না, এমনটা হতে পারে দেবী ভবানীর মহিমার কথা বলা হচ্ছে যখন মন্দিরের চূড়াটুড়া কিছু একটার কথা থাকবে, এই বিশ্বাসে বলেছিলেন নিশ্চয়। আমার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল, ‘ধ্যাৎ, সে তো গম্বুজ।’ দমবন্ধ করা ঘর সহসা ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। পরে এটা বহুরূপীতে প্রায় গল্পকথা হয়ে যায়, নানা প্রসঙ্গেই শাঁওলীদি ঘটনাটা বলে আমার কথাটা বলত, ‘ধ্যাৎ, সে তো গম্বুজ।’
এর ভেতর থেকে একটা শিক্ষাও কিন্তু নেওয়ার আছে। সংলাপে যা বলছি, তার প্রত্যেকটি শব্দের মানে আমার কাছে স্পষ্ট হওয়া চাই, তা না হলে ফাঁকিবাজি হয়ে যাবে। একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এটা বহুরূপী ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরের ঘটনা, তবু নিজগুণেই এই লেখার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে। বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় আমরা একবার শম্ভু মিত্র রূপান্তরিত পুতুল খেলা নাটক করেছিলাম। আমরা মানে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, লাবণি সরকার, কৌশিক সেন, আমি ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটক নেমে যাবার পর অভিনেতারা দল বেঁধে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। সেখানে দ্বিজেনদা একটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ধরুন, কোনো একটা সংলাপ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, সেটা কেমন করে বলব?’ শম্ভু মিত্রের দ্বিধাহীন উত্তর এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ‘হয় সংলাপটা বোঝবার চেষ্টা করতে হবে, নয় বাদ দিতে হবে।’
কিন্তু এই হালকা গল্পটাই নয়, গীতরত্নের মহলা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। একটা-দুটো ঘটনার কথা বলি। নিধুবাবুর চরিত্রে শান্তি দাস শ্রীমতীকে বলছেন, ‘অভিমান করেছ, শ্রীমতী?’ শম্ভু মিত্র মহলায় বসতেন বাবু হয়ে, হাঁটু দুটোর মধ্যে দূরত্ব যথাসম্ভব কম রেখে। সেখান থেকে সমস্ত ঊর্ধ্বাঙ্গ নাড়িয়ে তিনি বললেন, ‘না না, অভিমান নয়। কী গো, কী বলো তোমরা বউকে?’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘রাগ। রাগ করেছ শ্রীমতী?’ পাঠক বুঝতে পারছেন, একটু সাজানো শব্দ অভিমানের তুলনায় সহজ চালের রাগ শব্দ ব্যবহার করছেন শম্ভু মিত্র, আর তার সমর্থন তিনি খুঁজে নিতে চাইছেন আটপৌরে জীবন থেকেই।
শম্ভু মিত্রের লেখায় দিগ্বিজয়ীতে শিশিরকুমারের নাট্য সম্পাদনা নিয়ে কথা বলা আছে। কেমন করে লিখিত পাঠকে ভেঙে তিনি তৈরি করতেন মঞ্চের উপযোগী বয়ান, তার কিছু চমৎকার উদাহরণ থিয়েটারের ছাত্ররা নিশ্চয় পড়েছেন। সৌভাগ্য বলে মানি, গীতরত্নের মহলায় এমন সব ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি। দৃশ্যটা মনে নেই, সেখানে আছেন শ্রীমতীর সংগীতশিক্ষক নিধুবাবু, শ্রীমতী, আর শ্রীমতীকে যিনি রক্ষিতা হিসেবে কিনে নিয়েছেন সেই মহানন্দ। নিধুবাবুর কোনো একটি কথার উত্তরে শ্রীমতী বেশ লম্বা একটি সংলাপ বলে। শম্ভু মিত্র কেটে দিলেন সেইসব সংলাপ। নাটকের যে একটি মাত্র রুদ্ধদ্বার অভিনয় হয়েছিল তাতে দৃশ্যটি সাজানো হয়েছিল এই রকম করে – শ্রীমতী পরে থাকত একটা লাল পাড় গরদের শাড়ি, নিধুবাবু যখন তাঁর সংলাপ শেষ করেন তখন তাঁকে দেখা যায় পেছনের মঞ্চে ছোট গোল বেদির ওপর দাঁড়িয়ে, সেই বেদির ওপর শুইয়ে রাখা তানপুরাটি উঠে এসেছে তাঁর হাতে। নিধুবাবুর কথা শেষ হলে শ্রীমতীর আঙুল তানপুরার তারগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায়, শুধু সেই ঝংকারটুকুই করে সে, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে। মনে হতো যেন স্বয়ং সরস্বতী দাঁড়িয়ে রয়েছেন, বাক্যে প্রকাশের অতীত এক দ্বিধা নিয়ে। সেই বয়েসেই খানিকটা অস্পষ্টভাবে আমি বুঝতে পারছিলাম থিয়েটারের ভাষা কী রকম হতে পারে, সংলাপকে ছাপিয়ে যা অন্যরকম ব্যঞ্জনা তৈরি করতে চায়।
গীতরত্ন নিয়ে এত কথা বলতে গিয়ে একটা ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ে গেল। আচ্ছা, শম্ভু মিত্রকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেছেন? বিনয় ঘোষ একটা লেখা লিখেছিলেন বহুরূপীতে, তাতে এই রকম কথা ছিল, শম্ভু মিত্রের কাছে সবটাই নাকি ফ্যাক্ট। হাসিটাও ফ্যাক্ট, কান্নাটাও ফ্যাক্ট। মানুষটিকে আমি যতটুকু চিনি, বিশ্লেষণটা একেবারে ঠিকঠাক বলে মনে হয় আমার। সেই শম্ভু মিত্রকে আমি চোখের জল মুছতে দেখেছি, প্রকাশ্যে, মহলার মধ্যে।
গীতরত্নে একটা জায়গা ছিল, শ্রীমতীকে তার মা কুঞ্জদাসী নিয়ে যাচ্ছে রাজা মহানন্দের কাছে, নিধুবাবুর আশ্রয় এবার ঘুচল শ্রীমতীর। কুঞ্জদাসী তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে, আর শ্রীমতীরূপী শাঁওলীদি কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘আমি যাব না মাগো। মাগো, আমি যাব না, মাগো।’ মহলায় এই দৃশ্যটা হবার পর দেখলাম শম্ভু মিত্র ধুতির খুঁটে চোখের জল মুছলেন। কোথাও কি তাঁর ব্যক্তিজীবনের স্মৃতিতে আঘাত করেছিল এই অভিনয়? বলতে পারব না। এই অংশটা দেখে বহুরূপীর একজন, আজ নামটা বলেই ফেলি, অজয়দা, বলেছিলেন, ‘শাঁওলী ওখানটায় যাত্রা করল।’ সেদিনের অপরিণত বুদ্ধিতেও তা মনে হয়নি, আজকের তুলনায় পাকা মাথাতেও তা মনে হয় না। কখনো কখনো, তীব্র কোনো মুহূর্তে মানুষের আচরণ তো সমাজ বা বাস্তবতা-নির্দিষ্ট সীমারেখা পার হয়ে যাবেই। সেই পার হয়ে যাওয়াকে বিদ্রূপ করাটা শহুরে মানুষের একরকমের ফ্যাশন। একে কী বলব, উৎপল দত্ত যেমন বলতেন, মাপাজোকা বেনেবুদ্ধির প্রকাশ?
গীতরত্ন মানুষজন দেখতে পারেননি শেষ পর্যন্ত, যতদূর জানি রুদ্ধদ্বার অভিনয়টি দেখে নাটককার চিত্তরঞ্জন ঘোষ খুশি হননি, শম্ভু মিত্র তাঁর নাটককে যেভাবে কাটাছেঁড়া করে প্রায় নতুন পাঠ তৈরি করেছিলেন তার জন্যেই কি না বলতে পারব না। চিত্তবাবু নাটকটিকে কোনো এক যাত্রাদলের হাতে দিয়ে দিলেন, বহুরূপীর প্রযোজনা বন্ধ হয়ে গেল। বহু পরে কুমার রায় করবেন সেই নাটক, নাম দেওয়া হবে পিরিতি পরম নিধি, তাঁর কথা এই আলোচনায় আসবে না।
ছিয়াত্তর সালে গীতরত্নের প্রথম অভিনয়, ওই ছিয়াত্তর সালেই শম্ভু মিত্র পেলেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার। এ দুয়ের মাঝখানে একটা ভূরিভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল বহুরূপীর সকলের জন্যে, আমার জন্যে তো বটেই। না, ডান হাতের ভূরিভোজ নয়, বলা যেতে পারে মানসিক ভূরিভোজ। শম্ভু মিত্র তাঁর চাঁদ বণিকের পালা নাটকের মহলা শুরু করলেন, আমাকে দেওয়া হলো লখীন্দরের পার্ট। সে মহলা নিয়ে যা মনে পড়ে বলব, তার আগে কিছু জরুরি তথ্য দিয়ে রাখি। চাঁদ করছিলেন শম্ভু মিত্র নিজে, বসে বসে পড়েছেন কখনো, উঠে দাঁড়িয়ে মহলা দেননি। তৃপ্তি মিত্রের সনকাও তাই। বল্লভাচার্য কুমার রায়, বেণীনন্দন দেবতোষ ঘোষ, ন্যাড়া তারাপদ মুখোপাধ্যায়, বেহুলা শাঁওলী মিত্র, লহনা গীতা চক্রবর্তী। নাটকের শুরুতে যারা চাঁদের সঙ্গে পাড়ি দেবে তাদের মধ্যে ছিল রমাপ্রসাদ বণিক, ‘কুঁচবরণ কন্যা তোর মেঘবরণ চুল’ গানটা সে নেচে নেচে গাইত। যে লোকটা অভিযানে বউয়ের বদলে বালিশ নিয়ে যাবার আবদার ধরেছিল, সেই চরিত্রটা করতেন মহম্মদ আস্ফিয়া, আমাদের আস্ফিয়াদা। টাকমাথা গোলগাল হাসিখুশি মানুষটি, চোখে খুব সমস্যা ছিল, নাকি রোজ খানিকক্ষণ ধরে সবুজ পাতার দিকে চেয়ে থাকতে হতো। আস্ফিয়াদাকে নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ে গেল, ভুলে যাবার আগে সেটা শুনিয়ে দিই। কী একটা প্রসঙ্গে শম্ভু মিত্র তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আস্ফিয়া, তুমি কখনো একা একা লুকিয়ে কেঁদেছ?’ আস্ফিয়াদা একই রকম হাসিমুখে ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। শম্ভু মিত্র বাকিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘আর তোমরা?’ সবাই নানাভাবে হ্যাঁ বলল। শম্ভু মিত্র বললেন, ‘কী আশ্চর্য দেখো, এত মানুষ কখনো না কখনো একা একা কেঁদেছে, অথচ বাইরে থেকে কাউকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যায় না।’ ঘটনাটা এমন কিছু নয়, মানুষের সামাজিক রূপ আর নিভৃত মুখের মধ্যে নানা রকম তফাৎ তো থাকেই। বিস্ময় এই, এটা নিয়ে অবাকও হন শম্ভু মিত্রের মতো মানুষ। কোথায় একটা পড়েছিলাম, শিল্পীর সবচেয়ে বড় সহায় তাঁর বিস্ময়বোধ। বিস্ময়বোধ যদি সরে যায়, তবে আর সে শিল্পী থাকতে পারে না। যে কথা বলছিলাম, চাঁদ বণিকের মহলায় করালী করতেন উৎপলদা, উৎপল ভট্টাচার্য। চাঁদ বণিকের ইতিহাস লেখবার জন্যে যে চাঁদের খোঁজে আসে সেই পার্টটার মহলা বোধহয় একদিন-দুদিনের জন্যে দিয়েছিল সুব্রত মজুমদার।
মহলা নিয়ে টুকরো-টাকরা কিছু কথা মনে আছে। যেমন, প্রথমদিকে শম্ভু মিত্র লম্বা একটা ক্লাস করলেন চাঁদের সময়কার বাংলাদেশ নিয়ে, সমাজের সংস্কৃতির নানা খুঁটিনাটি। নাটকের সঙ্গে পড়াশোনার একটা যোগ আছে সেটা বোঝাবার জন্যে হতে পারে, আবার নাট্যঘটনাটাকে শরীর দেওয়ার চেষ্টা বলেও ব্যাপারটাকে ধরা যায়। বল্লভাচার্যের চরিত্রে কুমার রায়কে বলেছিলেন, ‘এই পার্টটা মহর্ষি (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) কেমন করে করতেন সেটা ভেবে অভিনয়টা করো তো!’ এটা খুব স্বাভাবিক, যিনি অভিনয় কাজের সঙ্গে যুক্ত, কোনো কোনো চরিত্র নির্মাণ করতে গেলে তাঁর চোখের সামনে চেনা অভিনেতাদের কারুর কারুর ছাঁদ চলে আসতেই পারে। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য শম্ভু মিত্রের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন, তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে লিখেওছেন তিনি। বল্লভাচার্যের মধ্যে সেই ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ দেখতে চাইছিলেন এই তথ্যটা মাথায় রাখলে নাটকটা বুঝতে কিছুটা সুবিধে হতে পারে। আরো মনে পড়ে, চাঁদের বাণিজ্যতরী ডুবে যায় যে ঝড়ে, সেটা করবার জন্যে বাস্তববাদী ঝড় তৈরি না করে তাঁর পরিকল্পনা ছিল বিদ্যুৎ আঁকা একটা কালো পর্দা প্রবল বেগে নাড়া হবে। বাসরের দৃশ্যে লখীন্দর আর বেহুলা সাঁতালি পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে পেছন দিক থেকে, অর্থাৎ আগে দেখা যাবে তাদের মাথা, তারপর ধীরে ধীরে গোটা শরীর।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে রগড়েছিলেন আমাকে। তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রভারতী থেকে চলে আসতেন বহুরূপীতে, আমি যাদবপুর থেকে বেগবাগানে নেমে এঁদো দোকানে চল্লিশ পয়সা দিয়ে একটা বিফ চপ খেয়ে এক গ্লাস জল খেতাম, রাত নটা পর্যন্ত পেট ভর্তি। কাজটা ভালো করিনি, দিনের পর দিন ওইসব অখাদ্য খাওয়ার ফল পরে ভুগতে হয়েছিল।
আমার পেছনে যে পরিশ্রম দিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র, একথা স্বীকার করতেই হবে আমি তার যোগ্য প্রতিদান দিতে পারিনি। অভিনয় সম্পর্কে আগে থেকে ঠিক করা নানা রকম ধারণা ছিল আমার, সেসব ছেড়ে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না। হয়তো সেই বয়েসে এবং অত কম অভিজ্ঞতার পুঁজি নিয়ে সেটা সম্ভবও ছিল না। কম বয়েসে অভিনেতাদের অনেকের একটু দেখানেপনার প্রবণতা থাকে, সেটাও কোথাও চরিত্রায়ণে বাধা দিচ্ছিল নিশ্চয়। শম্ভু মিত্র একবার বললেন, রুদ্র বলছিল (আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম রুদ্র কে? উনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, রুদ্রপ্রসাদ!) এই পার্টটা পেলে একবার লড়ে নিতাম। কিন্তু এখন তো আর সেই বয়েস নেই। হয়তো তাই। যে মানসিক পরিপক্বতা থাকলে লখীন্দরের সংকটটাকে ঠিক ঠিক ধরতে পারা যায় সেই পরিপক্বতা আমার আসেনি তখনো। যা যা বলতেন তার অনেকটাই ভুলে গেছি, যা কিছু মনে পড়ে তাই লিখতে পারি কি না দেখি।
যেমন মনে পড়ে, লখীন্দরের সেই অসামান্য দৃশ্যটি, যেখানে তাকে জারজ বলা হয়েছে বলে লখীন্দর রাস্তার অন্য ছেলেদের সঙ্গে মারপিট করে, ন্যাড়া তাকে জোর করে ঘরে নিয়ে আসে। আমার তো মনে হয় দেশে-বিদেশে এক একটা চরিত্রের অভিনয় যেমন বড়মাপের অভিনেতাদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে আসে, লখীন্দরের এই দৃশ্যটাও যে-কোনো বড় অভিনেতার কাছে একটা কঠিন পরীক্ষার মতো। বয়েসের ধর্ম, আমি শুরু থেকেই একটু বেশি রকম আবেগ দিয়ে লখীন্দরের কষ্টটা ধরবার চেষ্টা করছিলাম, তাতে একদিকে যেমন চরিত্রটা সম্ভাব্যতার স্তর থেকে সরে যাচ্ছিল, অন্যদিকে আর একটা সমস্যা তৈরি হলো, তার কথা শম্ভু মিত্রের চোখ দিয়েই বলা যাক।
সম্ভবত এই প্রসঙ্গেই শম্ভু মিত্র বলেছিলেন, আমাদের প্রত্যেকের গলার একটা মাপ আছে (তিনি ব্যবহার করেছিলেন রেঞ্জ শব্দটি)। তার পরে আর গলা ওঠে না। সেই মাপটা জেনে রাখা চাই। অভিনয়ের সময় এক-আধবারের বেশি সেই সীমানা পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে, তার বেশি নয়। তাহলে দর্শক বা শ্রোতার মনে হবে, এই মানুষটি গলা আরো তুলতে পারত, কিন্তু তুলল না। আর বারবার যদি পাখির মতো ওই রেঞ্জে গিয়ে গলা ঝাপটাও, তাহলে লোকে বুঝে ফেলবে তোমার ক্ষমতা এইটুকুই, তার বেশি আর গলা ওঠে না। একেবারেই প্রায়োগিক দিকের কথা, কিন্তু খুব দামি কথা বলে আমার এখনো পর্যন্ত মনে হয়।
আরো এই রকম কত কিছু শিখেছি তাঁর কাছে। কোনো চরিত্র যদি আমার পেছনে থাকে, তাহলে ঠিক কতটা ঘাড় ঘোরালে দর্শকের মনে হবে আমি তার দিকে তাকিয়েই কথা বলছি অথচ দর্শককে মুখ দেখানো থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হবে না, মঞ্চের মাপে তার একটা আন্দাজ তৈরি করে দিতে চেয়েছিলেন। পরে, টেলিভিশন বা ফিল্মে অভিনয় করতে গিয়ে ক্যামেরার মাপে এই চুরি (শুটিংয়ের ভাষায় বলে চিট করা) শিখেছি, কিন্তু মঞ্চের অভিনয়ে এই চুরি কেমন করে করতে হয় তা প্রথম শম্ভু মিত্রের কাছে শেখা।
এখন মনে হয়, শম্ভু মিত্র কি চাঁদ বণিকে একটু অন্য ধরনের অভিনয়রীতি দাবি করছিলেন তাঁর সহযোগীদের কাছ থেকে? অন্যের কথা বলবার ক্ষমতা আমার নেই, নিজের অভিজ্ঞতা তো সেই রকমই বলতে চাইছে। প্রায়ই বলতেন, মানুষের কথা বলার ধরন নাকি মোটামুটি দশ বছর অন্তর অন্তর পালটে যায়, অভিনেতাকেও নিজেকে পালটাতে হয় তার সঙ্গে তাল রেখে। নিজেও সে চেষ্টা করতেন, দশচক্র নিয়ে কথা হচ্ছিল একবার, তখন বলেছিলেন। শম্ভু মিত্রের রেডিওর অভিনয়গুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো করে লক্ষ করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। যা বলছিলাম, দেবসভায় নাচ দেখিয়ে লখীন্দরের প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার পর বেহুলা আর লখীন্দরের যে দৃশ্যটা, সেখানে শম্ভু মিত্র অভিনয়ের ধাঁচটাকে বেঁধেছিলেন থেমে থেমে, মাঝখানে বেশ অনেকখানি নীরবতা ভরে ভরে। এখন ভাবতে গিয়ে রোমাঞ্চ হয় শরীরে, বেহুলার শান্ত এবং নিরাসক্ত উচ্চারণের বিপরীতে লখীন্দরের সংলাপ বলাতে চাইছিলেন সন্দেহে তীক্ষ্ণ করে, কেমন করে কোন উপায়ে বেহুলা লখীন্দরকে বাঁচিয়েছে তা বুঝতে পারছে না বলেই সে স্থিত হতে পারছে না। বেহুলার মুখে সম্পূর্ণ ঘটনাটা শুনে সে যখন বলে, ‘জানার যে কী প্রচন্ড কষ্ট। অবিরাম, অবিরাম সেই কষ্ট বয়ে বয়ে কেমন মানুষ হয়ে বেঁচে রব আমি।’ মনে পড়লে নিজেকে ছিঁড়েকুটে ফেলতে ইচ্ছে করে, এইখানটা আমি নাটকীয় করে তোলবার চেষ্টা করতাম। যে মুহূর্তের ভেতরেই এত নাটক ভরা, তাকে কেউ নাটকীয় করতে যায়? কম বয়েসের নির্বুদ্ধিতা আর কাকে বলে।
মহলার গল্প নয়, এমনকি সরাসরি চাঁদ বণিকের পালা নাটকের কথাও নয়, একটা ঘটনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তখন বহুরূপীর সেট তৈরি হতো অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস হলের পেছনের চত্বরটায়। সেই রকম কী একটা নাটকের কাজ হচ্ছে, আমি আছি, উৎপল নায়েক আছে, আমাদের সেটের কাজ করত যে বারীনদা সে আছে, সঙ্গে বাইরের মিস্ত্রিও এক-আধজন থাকতে পার। হঠাৎ বারীনদা কী একটা কথায় একজনকে ধমকে উঠল, ‘আবরের মতো কথা বলিস না তো।’ আমি তক্ষুনি চেপে ধরলাম তাকে, ‘ওটা কী বললে? আবর? মানে কি?’ বারীনদা জিভটিভ কেটে বলল, ‘ও আমাদের গাঁয়ের লোকের কথা বাবু, চামড়ার মুখে হড়কে গেছে।’ না না, কিন্তু মানেটা কী? জানা গেল, আবর মানে বোকা।
বারীনদাকে জেরা করার কারণটা বলি। চাঁদ বণিকের পালায় জুড়ির দলের একটা গানে ছিল –
শিব তারে বাঁচাল না সদুদ্দেশ্য বাঁচাল না
আপন কর্মের প্রতি নিষ্ঠা তারে বাঁচাল না
কোথা যে কী ভুল হলো জানে না আবর
এইবার কী বা করে চাঁদ সদাগর।
সদুদ্দেশ্য, কর্ম, নিষ্ঠা – এইসব তৎসম শব্দের পাশাপাশি কী অবলীলায়, কী মোক্ষমভাবে আবরের মতো একটা গেঁয়ো শব্দ লাগিয়ে দিয়েছিলেন ভাবতেই অবাক লাগে।
ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল চাঁদ বণিকের পালার মহলা, সে শুধু আমার জন্যে নিশ্চয় নয়, দলের সঙ্গে সম্পর্কে কোথাও কি সুর কাটছিল? জানি না, বুঝতে পারিনি। ম্যাগসাইসাই পেলেন শম্ভু মিত্র, ঘোর রবে বাঙালি আদর করতে শিখল তাঁর যে-কোনো কাজকে, আর তারপরেই শোনা গেল সেই খবর, শম্ভু মিত্র আর বহুরূপীতে নেই।
কী কারণে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন দল, কত রকম সব খারাপ লোকেদের ষড়যন্ত্রে, তাই নিয়ে চন্ডীমন্ডপ মার্কা কূটকচালিতে আমার আগ্রহ নেই। এমন একজন সহজ অথচ গভীর মানুষ কিছুদিনের জন্যে এসেছিলেন আমার জীবনে, তাঁর বোধ দিয়ে ছুঁয়েছিলেন আমাকে, জীবনের স্মৃতিধার্য একটি সময় সেই প্রভায় ঝলমলে হয়ে আছে।