logo

বহতা বাংলার সৃজন পশরা

সি ল ভি য়া  না জ নী ন
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ রবে না আর, রবে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখন;
(স্বপ্ন, মহাপৃথিবী, জীবনানন্দ দাশ)

স্বপ্নমালায় গাঁথা থোকা থোকা রহস্যের মতো মানুষের মনে জেগে ওঠে শিল্পানুভূতির অনামা কুসুম। কেউ কেউ এদের নামাঙ্কিত করে দর্শকের দৃষ্টিচালিত করেন বিশেষ কোনো পরিপ্রেক্ষিতে, কেউবা শিরোনামহীন রেখে আরো অনির্দিষ্টতায় অবগাহনের সুযোগ করে দেন দর্শকদের। বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নের দিকেই শিল্পের ঝোঁক অধিকতর। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার আলো-আঁধারিমাখা সিঁড়ির মতো শিল্প আমাদের ডাকে, ডেকে ডেকে কখনো ক্লান্ত হয়, কখনো ডেকেই চলে অবিরাম। শিল্পের এমন ডাকের মুখোমুখি হওয়া গেল আমাদের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত ‘১৯তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০১১’। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় কিছুটা যেন সুস্থির নান্দনিকতার পরশ।
মানুষের সৌন্দর্যবোধ জৈবিক প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে। শিল্পের স্বরূপ অন্বেষণের চেষ্টার পাশাপাশি নানা বিশ্লেষণ-প্রেক্ষাপট বিবেচনাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কালপরিক্রমায়। শিল্প কতখানি বাক্সময় বা ভাবপ্রধান বা রূপময় তা-ও আলোচনায় এসেছে। শিল্পের নান্দনিক বিচারে ইন্দ্র্রিয়গ্রাহ্য-উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট বা তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্ব – এই বিচারের পরিবর্তে শিল্পী কাক্সিক্ষত বিষয়কে তার সৃজনে-উপলব্ধিতে কতখানি সার্থক তাও হতে পারে উপজীব্য। অভিজ্ঞতা-অভিব্যক্তির সম্মিলিত উপস্থাপন প্রতিভাত হয়ে শিল্প পরিগণিত হয় যাপিত জীবনে।
১৯তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী সম্প্রতি শেষ হলো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিবছর এদেশের শিল্পচর্চার গতি-প্রকৃতি, সমসাময়িককালে শিল্পীদের ভাবনা-করণকৌশল – সবকিছুর সঙ্গে দর্শক, শিল্পবোদ্ধা-শিল্প-সমালোচকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এবারের প্রদর্শনীতে ২১১ জন শিল্পীর ২৬৫টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। জলরং, তেলরং, মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিক, টেম্পেরা, গ্রাফিক্স, স্থাপনা শিল্প এবং ভাস্কর্যের নান্দনিক উপস্থাপনা রয়েছে।
২১১ জন শিল্পীর অংশগ্রহণে ২৬৫টি শিল্পকর্মের এই বিরাট আয়োজন নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার, যদিও শিল্পকলা একাডেমীর দায়িত্বই এ-ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করা। রুচি, সৌন্দর্য ও সৃষ্টিশীলতার সাধনায় আত্মনিয়োগের জন্য আমাদের গরিব দেশের সরকার তার নাগরিকদের এতটুকু সুবিধা দেবে এটাই বাঞ্ছনীয়। তবু জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পুরনো অমীমাংসিত প্রশ্ন নতুন করে সামনে চলে আসে। শিল্পকলা কী? শিল্পের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? শিল্পের উদ্দেশ্য কী থাকা উচিত? আমাদের শিল্পকর্মের ধরন কী হতে পারে? ইত্যাদি। এসব প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়, উড়িয়ে দেওয়া যায়, অবজ্ঞা করা যায়; তাতে শিল্পের তথা শিল্পীর ব্যক্তিগত সুবিধা তৈরি হতে পারে, কিন্তু যে জাতির জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী তাদের কী হবে? প্রদর্শনীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পকর্মগুলোর শিরোনাম দেখা যায় : ‘বৃক্ষ-মানব, খবরের কাগজ এবং ইট, রূপান্তর ও শারীরিক অস্তিত্ব-২, নরকের ফুলবাগান, অভিব্যক্তির সঙ্গে বসবাস, সাইলেন্ট ডিসকোর্স-১, সমাজের ব্যথা, পোড়া আত্মার আনন্দ-ভ্রমণ, তল ও তলের ভেতর-৫, চারণভূমি-১’ প্রভৃতি। এইসব শিরোনামের সঙ্গে এই জাতির সম্পর্ক নিরূপণ সম্ভবত একটি কঠিন কাজ। অথচ এটা জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী। অবশ্য শিল্পী-বোদ্ধাগণ খুব সহজেই হয়তো বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। কিন্তু সাধারণ দর্শকের জন্য একটি সেমিনার কি জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না? যেখানে শিল্পী ও দর্শকের পারস্পরিক মতবিনিময়ের পরিবেশ থাকবে। শিল্পকর্ম ও শিল্পীগণ ভিনগ্রহের কেউ নন। এই সমাজের অন্য দশজন সাধারণ মানুষেরই অংশ। প্রাত্যহিক ঘটনা-দুর্ঘটনার কোনো ছাপ শিল্পে থাকবে না – এটা কী করে সম্ভব? জীবনের অনুভূতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘটনাবলিও শিল্পীর চেতনাকে ফাঁকি দিতে পারার কথা নয়, অথচ অনেক মোটাদাগের বিষয়ও অবলীলায় এড়িয়ে যান শিল্পীবৃন্দ। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবতার প্রতিফলন যদি নাই থাকবে, তাহলে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর প্রয়োজনীয়তা  কতটুকু?  কেউ  হয়তো বলতে পারেন এসব দায় শিল্পের নয়, তাহলে কার? শিল্পীরা প্রাপ্য সুবিধা ভোগ করবেন আর দায়িত্ব তুলে দেবেন অন্যদের ঘাড়ে, এটাকে সম্ভবত সুবিধাবাদ বলা যায়। আমাদের আর্টের চরিত্র এমন সুবিধাবাদী রূপে আবির্ভূত হোক – এটা কারো কাম্য হতে পারে না। শিল্পের প্রথম বিনিময় বাস্তবের সঙ্গে, এরপর পরাবাস্তব, অধিবাস্তব ও অবাস্তবের প্রতি। মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়ার পরেই আসবে অন্যান্য প্রসঙ্গ। আমাদের শিল্প ভাতের আগেই ফুল কেনার স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়ে আছে এবং ভান করছে; অনবরত অভিনয় করে করে স্বকীয়তাবিষয়ক ধারণাই লোপ পাওয়ার পথে। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী – এটা বাংলাদেশেরও হতে পারে, আবার নেপাল-ভুটান-আফ্রিকারও হতে পারে। এই প্রদর্শনীতে এমন কিছু কি ছিল যাতে নির্দ্বিধায় বলা যাবে এটা বাংলাদেশের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী? বোদ্ধাগণ হয়তো বলবেন শিল্পের আন্তর্জাতিক গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। এটা পণ্যের গ্লোবালাইজেশনের জন্য সঠিক। শিল্প অবশ্যই প্রথমত পণ্য নয়। আর অন্দর-বাহিরে কে প্রাধান্য পাবে তার জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। কাজেই আমাদের অন্দরে-অন্তরে নজর ফেরাতে হবে। অন্তঃসারশূন্য আন্তর্জাতিকতা নতুবা ফাঁকা বুলি হিসেবে কালের গহ্বরে মিলিয়ে যাবে।
জাতীয় শিল্পকলার কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকবে কী থাকবে না সেটা ব্যাপক আলোচনার বিষয়। কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, এস এম সুলতানের প্রদর্শিত মত, পথ ও আদর্শ থেকে যে আমাদের শিল্পীগণ নিজেদের বিয়োজিত করে নিয়েছেন তা বেশ বোঝা যায়। শিল্পের প্রতি সেই নিবেদন সচরাচর চোখে পড়ে না। এটা কী আমাদের গুরুস্থানীয় শিল্পীদের ব্যর্থতা না সমকালীন শিল্পীদের? শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এক জীবনে যতটা সম্ভব তার পুরোটা করে গেছেন আমাদের শিল্পের জন্য। শিল্পী কামরুল হাসান, এস এম সুলতান দেশীয় শিল্পকলার চরিত্র চিত্রণে দিয়েছেন কর্মক্ষম জীবনের সবটুকু। তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের শিল্পীদের আত্মজিজ্ঞাসার স্বরূপ অজ্ঞাতই রয়ে গেল। আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, স্টাইল কিংবা নিজস্বতার ধুয়া তুলে শিল্পকর্মের নামে আসলে কী তৈরি হচ্ছে তা গুরুত্বের সঙ্গে তলিয়ে দেখা দরকার, অন্যথায় আমাদের অন্য জাতীয় বিষয়গুলোর মতো শিল্পকলার পরিণতিও একই হতে বাধ্য; ইতোমধ্যে শিল্পকলাও ব্যাপক আকারে দুর্নীতিগ্রস্ত কি না এ-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যদিও আমাদের ধারণা শিল্পক্ষেত্রে হয়তো দুর্নীতি হয় না অথবা সম্ভব নয়। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ নয়। শিল্পের দুর্নীতি অন্য সাধারণ দশটা দুর্নীতি থেকে আলাদা এবং একে চিহ্নিত করাও সহজ নয়। সুতরাং শিল্পেই দুর্নীতির সুযোগ বেশি এবং সম্ভবত ঘটছেও তাই। নতুবা আমাদের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী  ২০১১  সালে  এসে  এমন উদ্ভ্রান্ত চেহারায় হওয়ার কথা নয়। তেজহীন-ঝাঁজহীন-শক্তিহীন অবয়বে ধুঁকছে আমাদের শিল্পকলা। অথচ জয়নুল-কামরুল-সুলতানের উত্তরসূরিদের হওয়ার কথা ছিল বুদ্ধির দীপ্তিতে ঝকমকে, আবেগ-অনুভূতির তীব্রতা, দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং মানবিকতার মহত্বে উদ্ভাসিত। শিল্প বিষয়ে আমাদের আগাগোড়া নতুনভাবে ভাবা উচিত। দেশ-মাটি-মানুষ থেকে বিয়োজিত হয়ে পৃথিবীতে কোনো মহৎ শিল্প নির্মিত হওয়ার নজির নেই এবং ভবিষ্যতেও বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে মহৎ মানবতা অথবা শিল্পকলার জন্ম হবে না।
মানবসভ্যতার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্প এগিয়ে গিয়েছে। অনুভূতির শিল্পিত উপলব্ধি মূর্ত-বিমূর্ত রূপে শিল্পে প্রতিভাত হয়। শিল্পে পরিবর্তনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। নতুন উপাদানের সমন্বয়, বিষয়বস্তু আর ভাবনার প্রকাশ, নিরীক্ষা-সৌন্দর্যের তাগিদ শিল্পকর্মকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করে।  মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্রিম্যান বলেন, ‘ÔCreative work is based on fantasy which demands for eight. No work of art can be created without visualizing the effect before it is undertaken.’ শিল্পকর্মের কৌশলগতভাবে উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি শিল্পীর সমাজ, অভিজ্ঞতা, পরিবেশ সচেতনতা, দূরদর্শী হতে হবে।
এছাড়া আধুনিক সময়ে শিল্পের ক্ষেত্রে দুটি দার্শনিক মতবাদ নিয়ে বহুল আলোচনা হচ্ছে -Art for Art’s sake and Art for Life’s sake- কেউ বলছেন শিল্পীর ব্যক্তিগত আনন্দই প্রধান শিল্পকর্ম সৃজনে, এখানে সাধারণ মানুষের অনুভূতি অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য। অপরদিকে শিল্পীর ব্যক্তিচিন্তার বাইরে এসে সমাজ-শোষণ বা কোনো আদর্শ নিয়ে সোচ্চার হয়ে বক্তব্যধর্মী শিল্পকর্ম অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এমনই নানা মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-বিশ্লেষণ চলছে যুগে যুগে। শিল্প মূলত শিল্পীর অনুভূতি, চেতনা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতার সমন্বয়ে রূপায়িত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের বিমূর্ত চর্চার আবশ্যকতা নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন তৈরি হয়। বিমূর্ত শিল্প প্রতীচ্য থেকে উদ্ভাবিত শিল্প-আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। তাদের মতবাদ, ধারা, শতাব্দীর মধ্যে ক্রমবিবর্তনের পথে শূন্যতা তৈরি হয়নি। অন্যদিকে এদেশে বিভিন্ন জাতির আবির্ভাবে সেই সংস্কৃতি-কৃষ্টির বিস্তার হয়েছে, আবার নতুন জাতি সভ্যতা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়েছে মানুষের মৌলিকতা-ভাবনা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ। তাই এদেশে চিত্রকলার বিবর্তন বা রূপান্তরের ইতিহাস শিল্পান্দোলনের চর্চাকে উৎসাহিত করেনি। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা-রাজনীতি-দর্শন পাশ্চাত্যের অবস্থা থেকে ভিন্নতর। বিমূর্ত শিল্পে এদেশের মানুষ-জীবনবোধ-মূল্যবোধ-সংস্কৃতির প্রতিফলন নেই। তাহলে       এ-সময়ের শিল্পীরা কেন এই চর্চা ব্যাপকভাবে করছে এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা জরুরি। মনোবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস রাইটম্যান প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে বলেছেন – ‘ঃÔthe main  western cultural tendencies that is an objective interest in life has remained the same. This common factor in
western art seems the more important when it is
contrasted with Eastern art… it appears that modern artists display an analytical interest in life.’
জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখিত আকারে জানানো হচ্ছে, ‘বর্তমান জাতীয় প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের জন্য একটি ব্যাপক প্রচার। প্রদর্শনীটির বৈশিষ্ট্য হলো প্রবল সৃজনশীলতা, বৈচিত্র্য ও জীবনীশক্তি। অন্য একটি কারণে প্রদর্শনীটি গুরুত্ববহ, এখানে সমকালীন চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে আইডিয়োলজি ভাবনায় ক্রমশ পরিবর্তনের কথা ব্যক্ত হয়েছে।’
বলা হচ্ছে, প্রদর্শনীটি বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের ব্যাপক প্রচার। এরপর অবধারিতভাবেই চলে আসা প্রশ্ন হলো – কেমন প্রচার অথবা কীভাবে প্রচার? প্রদর্শনীটি ঢাকাস্থ শিল্পকলা একাডেমীর নিজস্ব ভবনেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এর কোনো প্রদর্শনী নেই। প্রদর্শনীটি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশেও স্থানান্তরিত হবে না বা ইন্টারনেটেও এই প্রদর্শনী দেখার সুযোগ নেই। ব্যাপক বিদেশি শিল্পী, কিউরেটর, অতিথিদেরও কোনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তাহলে ব্যাপক প্রচারের বিষয়টি ঘটল কী করে? তাছাড়া শিল্পগুণকে ছাপিয়ে প্রচারটাই মুখ্য হয়ে যাচ্ছে কি না সেটাও সম্ভবত লক্ষ করার বিষয়। ক্যাটালগে আরো বলা হচ্ছে প্রদর্শনীটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে – প্রবলভাবে সৃজনশীল, বৈচিত্র্যময় ও জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ; কিছু কিছু শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে ওই বিশেষণগুলো প্রযোজ্য, তবে সব শিল্পকর্মকে এমন সাধারণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে করার কিছু নেই। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী হিসেবে শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এই প্রদর্শনী খুব বেশি আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলবে বলে মনে হয় না। কারণ বিগত সময়, সমকাল এবং ভবিষ্যৎকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কালোত্তীর্ণ কোনো শিল্পকর্ম বা এর সম্ভাবনার ইঙ্গিত এই প্রদর্শনীতে দৃশ্যমান নয়। বিভিন্ন বিষয়বস্তুর নানাবিধ ফর্মের  রিঅ্যারেঞ্জ করে নতুন নতুন বিষয়ভঙ্গির অবতারণা রয়েছে এখানে। গ্লোবাল হিউম্যানিটি, পোস্টকলোনিয়াল ডিসকোর্স কিংবা থলথলে ভাবালুতায় তাত্ত্বিক অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক বিপর্যয়ের টানাপড়েন আমাদের উপরিতলে ভাসিয়ে রাখে। অতি সাধারণ ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব অনায়াসে ঢুকে পড়ে আমাদের শিল্পকলার সৃষ্টিশীল কারখানায়। তত্ত্ব ও তথ্যজাল আমাদের জাতীয় চারুকলাকে কোনো অবয়ব নিতে দেয় না। শিল্পকলা একাডেমীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এবং আমাদের প্রথিতযশা শিল্পীদের এই বিষয়ে আরো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা এখন সময়ের দাবি। বছর বছর জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী অন্যথায় রাষ্ট্রীয় অর্থের নিরেট অপচয়ে পরিণত হবে।
শিল্প ধ্যানের মাধ্যমে অনুভব করা যায়; সময়ের পরিবর্তনে কখনো শিল্প বিষয়নির্ভর, কখনো ভাবনির্ভর, কখনোবা প্রকাশনির্ভর। তবে জীবিকার তাগিদে শিল্প সৃজন হয় না, সত্যের উপলব্ধি আর নান্দনিক পরিতৃপ্তির সার্থকরূপ শিল্পে পরিস্ফুটিত হয়। তাই শিল্পীর দায়ভার থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র অবলম্বন শিল্পকর্ম। শিল্পের নৈতিক মূল্যকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। শুদ্ধরূপের অন্বেষণ একজন শিল্পীর ব্রত; তাই এ-ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজনে শিল্পী তাঁর শিল্পকর্মকে দর্শক-বোদ্ধা-সমালোচকের দৃষ্টিগোচর করে ভাবনার নতুন পথ উন্মোচন করতে সমর্থ হয়ে থাকেন। একসঙ্গে এত বেশিসংখ্যক শিল্পীর শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ আমাদের খুব বেশি হয় না। এমন আয়োজনের সফলতা-ব্যর্থতা দর্শক নির্ধারণ করবে। অভিনন্দন অংশগ্রহণকারী শিল্পী এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীকে।

Leave a Reply