logo

বব ডিলান

শ ঙ্ক র লা ল  ভ ট্টা চা র্য

বব ডিলানের গানের সুবর্ণজয়ন্তী!

কথাটা শুনলে দুই রকমের প্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব। এক. সে কী, ওঁর গান কবে ছিল না জগতে! দুই. এরই মধ্যে ডিলানের গানের পঞ্চাশ!

ডিলানের ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ডে’র  পঞ্চাশ  হলো। যে-গানকে মানবজাতির জাতীয় সংগীত বললে বাড়িয়ে বলা হয় না, কমিয়েও বলা হয় না। গানটা যাদের জন্য লেখা এবং গাওয়া তারা কিন্তু এই পঞ্চাশ বছর ধরে সেটা গাইছে, শুনছে ও ভালোবাসছে – তাদের সংখ্যা, ভাষা, দেশসীমানা দিন দিন ছড়িয়ে যাচ্ছে, আমাদের ভাষার কবীর সুমনের মতো নানা ভূগোলের নানা গায়ক-গীতিকার তা নিজেদের যুগ ও মানুষের মতো করে নিচ্ছেন। এবং ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড’ মানুষের হয়ে কথা বলা গানের শুধুই একটা শুরু ডিলানের। হাওয়ায় বেদনা বইছে বলে যে-ধুন জাগল তা পরের বছরেই, ১৯৬৩-তে, এক আশ্চর্য সতর্কবার্তা ও জগদ্দর্শন হয়ে দেখা দিলো আরেক অমর গানে – ‘দ্য টাইমস দে আর আ’ চেঞ্জিং’।

ডিলানের গানের সুবর্ণজয়ন্তীতে যে দুটো প্রতিক্রিয়া দিয়ে শুরু করেছিলাম তার প্রথমটি যাঁদের, তাঁরা ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ডে’র কান্না এবং চিরায়ত বেদনার দ্বারা আক্রান্ত। তাঁরা জানেন যে কবি ডিলানের আক্ষেপ মানুষের নিয়তি নিয়েই, সেই আক্ষেপের মধ্যে এক তীব্র আর্তনাদও তাঁরা শুনতে পান –

‘হাউ মেনি ইয়ার্স ক্যান আ মাউন্টেন এগজিস্ট

বিফোর ইট’স ওয়াশড টু দ্য সি?

ইয়েস, এন’ হাউ মেনি ইয়ার্স ক্যান সাম পিপল এগজিস্ট

বিফোর দে আর অ্যালাউড টু বি ফ্রি?

ইয়েস, এন’ হাউ মেনি টাইমস ক্যান আ ম্যান টার্ন হিজ হেড,

প্রিটেন্ডিং হি জাস্ট ডাজন’ট সি?

দ্য আনসর, মাই ফ্রেন্ড, ইজ ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড,

দ্য আনসর ইজ ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড।’

 

দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া যাঁদের, মানে যাঁরা চমকে ওঠেন ডিলানের গান পঞ্চাশ ছুঁল শুনে, তাঁরা বশ কবির ভর্ৎসনা ও প্রতিবাদের স্বরক্ষেপে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, গোটা পাশ্চাত্যের নবীন প্রজন্মের রাগ, ক্ষোভ, জ্বালার ভাষা জুগিয়েছে অনেকের কাছে ডিলানের সেরা বলে স্বীকৃত এই গানের এই সব কথা …

‘কাম মাদারস অ্যান্ড ফাদারস

থ্রুআউট দ্য ল্যান্ড

অ্যান্ড ডোন্ট ক্রিটিসাইজ

হোয়াট ইউ কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড

ইয়োর সানস অ্যান্ড ইয়োর ডটারস

আর বিয়ন্ড ইয়োর কমান্ড

ইয়োর ওল্ড রোড ইজ

র‌্যাপিডলি এজিং

প্লিজ গেট আউট অব দ্য নিউ ওয়ান

ইফ ইউ কান্ট লেন্ড ইয়োর হ্যান্ড

ফর দ্য টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং।’

 

কলকাতার আধুনিক বাঙালি কিন্তু ১৯৬২-তেই ডিলানকে আবিষ্কার করে ফেলেননি, বরং ওই বছরে তাঁরা ভীষণই মর্মাহত ছিলেন তাঁদের প্রিয় ম্যারিলিন মনরোর আত্মহত্যায়। পরের বছর তাঁদের কাছে খবর পৌঁছেছে এক বিস্ময়কর ব্রিটিশ ব্যান্ডের আবির্ভাবের। সেই ব্যান্ড, বিটলসদের প্রথম এলপি ‘প্লিজ প্লিজ মি’ হস্তগত করার জন্য ভালোই তৎপরতা অনেকের মধ্যে। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি এক ভিন্ন স্বর, ভিন্ন সুর, ভিন্ন জগৎ হিসেবে ধরা দিতে শুরু করলেন বব ডিলান। এবং কলেজে-ক্যাম্পাসে ঝড়টা  বইতে  শুরু  করল ’৬৮-র  ছাত্র  বিপ্লবের তাণ্ডবলগ্নে। ততদিন যে-ডিলান আমাদের মতো ছাত্রদের কাছে গানই ছিলেন, কখন একসময় কবিতার ভাষা হয়ে গেছেন। আবার কখন একসময় চে গুয়েভারার মতো বুকে নিয়ে ঘোরার মতো আইকন।

এও কি সমাপতন যে, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমার শতবর্ষে ডিলানের গানের সুবর্ণজয়ন্তী এলো? ঠিক একশ বছর আগে এই জুলাই মাসের ৭ তারিখে উইলিয়ম রটেনস্টাইনের বাড়িতে এক সান্ধ্য আসরে কবির সেই তর্জমার খাতা থেকে কিছু কবিতা পড়ে শোনান কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস। কিছুকাল পরে সেই মুগ্ধতায় গীতাঞ্জলির যে অপূর্ব ভূমিকা লেখেন তিনি, তারই একটা অনুচ্ছেদ আজ একটা নিপুণ ব্যাখ্যার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে, গোলার্ধ ও সভ্যতা অতিক্রম করে বব ডিলান কেন বাঙালির এত অন্তরঙ্গ হলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইয়েটসের বলা কথাগুলো সমান সত্যতায় একজন বাঙালিও বলতে পারতেন ডিলানকে নিয়ে। ইয়েটস যখন বলছেন ….

‘‘A whole people, a whole civili“ation immeasurably strange to us, seems to have been taken up into this imagination; and yet we are not moved because of its strangeness, but because we have met our own image…’’

ডিলানের জগতে বাঙালি তার কী প্রতিরূপ দেখেছিল বুঝতে হলে ওঁর সেই জগৎটাকেও একটু দেখতে হয়…

শুরু করা যায় ডিলানের নিজের চেহারা-চরিত্র দিয়ে। যেমনটি ধরা পড়েছিলেন পরবর্তীকালে ওঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ও জীবনীকার গ্রাইল মার্কাসের কাছে। মার্কাস লিখেছেন, ১৯৬৩-র গ্রীষ্মে নিউ জার্সির এক ময়দানে শুনতে গেছেন জোন বায়েজকে। তার কদিন আগেই টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে মুখ এসেছে বায়েজের। গানের ফাঁকে শিল্পী বললেন, ‘এবার আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’ বলতে বলতেই এক ঝড়ো চেহারার ছোকরা বেরিয়ে এলো, গাময় ধুলো। কয়েকটা গান গেয়ে বেরিয়েও গেল। কিন্তু ওরই মধ্যে এক গুচ্ছ প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল ছোকরা।

তদ্গত হয়ে শোনার পর শ্রোতার প্রশ্ন : কী গাইল ও? অন্যের মঞ্চে এসে কী কাণ্ড বাধাল? কোত্থেকে এলো? কোথায় যাবে? ও কে? বয়সই বা কত? এসবেরই উত্তর সেদিন ছোকরা দেয়নি যখন গাইল Ñ ‘মাই নেম ইট ইজ নাথিং, মাই এজ ইট মিনিজ লেস?’ ছোকরাকে দেখে বোঝা গেল না, ওর বয়স সতেরো না সাতাশ। কোত্থেকে এসেছে সে প্রশ্নও অবান্তর হয়ে গেল। কারণ সেদিনের একটি গান ‘দ্য টাইমস দে আর আ চেঞ্জিং’য়ে গোটা মার্কিন ইতিহাসই তো বলা। তবে একেবারে অন্য স্বাদে, অন্য সুরে, অন্য সত্যতায়।

আসরের পরে মার্কাস গিয়েছিলেন মাঠের এক কোণে বসে থাকা শিল্পীকে বলতে, ‘ফাটিয়ে দিয়েছ!’ ছোকরা তা শুনে মুখ তুলে তাকানওনি। শুধু বলেছেন, ‘যাচ্ছেতাই!’ তারপর একটু থেমে ‘একেবারে যাচ্ছেতাই!’ আরেকটু পর জোন বায়েজের সঙ্গে একটা স্টাইলিশ জাগুয়ারে চড়ে তিনি হাওয়া হয়ে গেছেন। মার্কাস লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, নিজের সম্বন্ধে অতসব কটু কথা বলা ছেলেটির নাম বব ডিলান। ততক্ষণে গানের ব্রহ্মাণ্ডে তাঁর ঈশ্বর-কণাটিকে খুঁজে পেয়ে গেছেন মার্কাস। যে-কণা আর তাবৎ কণাকে ভর জোগাবেন, এক নতুন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আণবিক শক্তি হবেন।

আসলে বব ডিলান এরকমই, বরাবরই এরকম। মাসখানেক আগে প্রেসিডেন্ট ওবামা, ডিলানের আকৈশোর ভক্ত, যখন ওঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা সম্মান ফ্রিডম মেডেল পরালেন – শিল্পী হাসলেনও না, একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। জীবনের প্রথম থেকে দারিদ্র্য, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে করে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা ও নৈঃশব্দ্য অর্জন করেছেন ডিলান। ১৯৬৬ সাল থেকে নিয়মিত সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের জন্য নাম ওঠে ওঁর, অথচ তা নিয়ে সামান্যতম হেলদোল নেই। প্রচুর সম্পর্কে জড়িয়েও শেষ অব্দি সংসারে এক সন্ন্যাসীর মতোই। নিজের কবিতায়, নিজের কণ্ঠে নিজের জীবন ও জগৎ নিয়ে যা-যা বলে গেলেন তার বাইরে অন্য কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেবেন না। ছয়ের দশকের শেষে একটা অ্যালবাম করেছিলেন ‘সেল্ফ পোর্ট্রটে’ (আত্মপ্রতিকৃতি) বলে। তবে বাঙালি ডিলানভক্তদের কাছে অনেক কাছের ডিলান ছিলেন ‘হাইওয়ে সিক্সটি ওয়ান রিভিজিটেড’ অ্যালবামের ‘লাইফ আ রোলিং স্টোনে’র গায়ক। যখন তিনি গাইতেন…

‘হাউ ডাজ ইট ফিল

হাউ ডাজ ইট ফিল

টু বি উইদাউট আ হোম

লাইক আ কমপ্লিট আননোন

লাইক আ রোলিং স্টোন?’

বাঙালি আমরা চিরকাল বোধ করেছি যে, বুক হু হু করে ডিলান শুনলে। গানের টোনই মাতাল করে দেয়। এছাড়া যখনই মুখ খোলেন গায়ক, সব সময়ই নিজস্ব কোনো সত্য উচ্চারণের জন্য। গ্রামের কথা, পথহারা পথিকের কথা, রাস্তার ধ্বনি, শহরের ইতিকথা, প্রত্যয় ও প্রতিবাদ, জয়-পরাজয় ও জীবনের অনন্ত বিস্ময়ের কথা তিনি

ফকির-মুর্শিদ, নগর বাউলদের মতো করে গেয়ে গেছেন। আর সমস্তটাই একটা আত্মজীবনী গায়নের ধারায়। তাতে কখনো মনে হয় ডিলান একজন ব্যক্তিমানুষ, কখনো সবমানুষ। ওঁর শুরু লোকগায়ক হয়ে, একসময় অপূর্ব রক ধরে নিলেন, ষাটের দশকের মাঝখানে দেখা গেল এলভিসের রকধারায় হই চই করা স্টেজ শো করে শেষ করলেন ‘লাইক আ রোলিং স্টোন’ গেয়ে। তারপরই ব্যাকস্টেজে গিয়ে পিয়ানোয় বসে গেলেন মার্কিন লৌকিক ভাষায় গলার সুর মেলাতে। আসলে ওঁর ওই লৌকিক ধ্বনিতে যে-কান্না ছড়িয়ে পড়ে শেষ অব্দি সেটাই থেকে যায় ওঁর সেরা আত্মপরিচয়। কীভাবে দিনের পর দিন পথ খুঁড়ে নতুন রাস্তা বার করেছেন, পপ গানের মহল থেকে সরে গিয়ে নিজের মৌলিক স্বরকে পুনরাবিষ্কার করেছেন তার এক স্বর্ণিল স্বাক্ষর রেখে গেলেন ১৯৭৫-এ করা অ্যালবাম ‘ব্লাড অন দ্য ট্রাকে’। আধুনিক গানের কপালে এক রক্ততিলকের মতো এই সংকলন।

Leave a Reply