সৈ য় দ ম ন জু রু ল ই স লা ম
যে-কোনো দেশের চিত্রকলার ইতিহাসে, বিশেষ করে আধুনিক পর্যায়ে, পশ্চিমের কয়েকজন চিত্রকর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দেখা দেন। এর কারণ তাঁদের ছবিতে যুগ ধারণার প্রকাশ, সৃজনশীল কল্পনার বিকাশ, বিষয়-প্রকরণ-চিত্রকল্প-আকার অথবা পরিসর নিয়ে তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং যুগের চিমত্মা-দর্শন ও মূল ভাবনাগুলোর নানান ব্যাখ্যা। কুড়ি শতকের শুরম্ন থেকে পশ্চিমের শিল্পকলায় আধুনিকতার যে উৎসার আমরা লক্ষ করি, তার বহুমুখী প্রকাশ অত্যমত্ম বলিষ্ঠতা ও কর্তৃত্বের সঙ্গে যাঁরা ঘটিয়েছেন, যেমন পিকাসো, ব্রাক, সেজানে দুশাম্প তাঁদের প্রভাব পড়েছে প্রায় প্রতিটি দেশের আধুনিক শিল্পীদের কাজে। এই প্রভাব অনেকেই নিজস্বভাবে, নিজ সংস্কৃতি ও শিল্পরম্নচির সঙ্গে মিলিয়ে, নিজস্ব সৃজন-প্রতিভার রসায়নে জারিত করে তাঁদের কাজে মূর্ত করেছেন, কেউ কেউ অনুকরণের ফাঁদে পড়ে গেছেন, কেউ কেউ শিল্পীদের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে ভিন্ন একটি পথে গিয়ে একটা নতুন চিত্রভাষা নির্মাণ করেছেন। পশ্চিমা শিল্পীদের যে তালিকা দেওয়া হলো, সেটি সময়ে আরো বিসত্মৃত হলো, অনেক নাম তাতে সংযুক্ত হলো। যেমন ফ্রান্সিস বেকন। বাংলাদেশের অনেক শিল্পী সত্তর-আশির দশকে বেকনকে যেন ‘আবিষ্কার’ করলেন, যদিও ততদিনে তাঁর বয়স হয়ে গেছে সত্তরের বেশি, এবং তাঁর বড় কাজগুলো প্রায় সবই করা হয়ে গেছে। কেন তাহলে কিছু শিল্পীর কাছে বেকন গুরম্নত্বপূর্ণ প্রতীয়মান হলেন, তাঁকে নিয়ে নতুন চিমত্মাভাবনা শুরম্ন হলো? কারণ সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাসত্মবতায় সেই বিচ্ছিন্নতা, সেই উদ্বিগ্নতা, সেই বীভৎসতা, সেই রূঢ় অমত্মরীণতা ছিল বড় একটি বিষয়, যা শিল্পীদের তাড়িত করত। তাঁরা বেকনের শক্তিশালী, অনেক ক্ষেত্রে ‘সহিংস’ ক্যানভাসে নিজেদের সময়ের চিমত্মাকে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন। তাঁরা নিজেদের মতো করে তাঁদের সময়কে প্রকাশ করেছেন, তবে বেকন তাঁদের শক্তিশালী প্রকাশের পেছনে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল ৮২ বছর বয়সে মারা গেলেন ফ্রান্সিস বেকন; হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, স্পেনে। চিত্রকলায় আধুনিক যুগের পথিকৃৎ শিল্পীদের একজন বলে তাঁকে গণ্য করা হতো, বলা হতো – এবং তাঁর মৃত্যুর পর অনেক লেখালেখিতে এই দাবিটি করতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রকাশবাদ বা এক্সপ্রেশনিজমকে একটি দৃশ্যমান রূপ দিয়েছেন বেকন। তাঁর ক্যানভাসে জেগে থাকে দুঃস্বপ্ন এবং তিনি তাঁর বাঁকাচোরা ফিগার, ভয়ানক দৃশ্যপট এবং যন্ত্রণা ও আতঙ্কের বিশ্বসত্ম রূপায়ণে সৃষ্টি করেছেন আমাদের সময়ের পরিত্রাণহীন কিমিতিকে। বেকন সম্পর্কে আরো বলা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পাইকারি ইহুদি নিধনের ঘটনাটি, যা হলোকাস্ট নামে ইতিহাসের এক বীভৎস অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে চিরদিনের জন্য, ফ্রান্সিস বেকনের ছবিতে মূর্ত হয়েছে, তাঁর বাসত্মবধর্মী অথচ ভিন্ন মাত্রার পরিবেশনায়, উজ্জ্বল রং ও বিচিত্রধর্মী আকার-আকৃতিগুলোতে। সভ্যতার রক্তক্ষরণ, নিষ্ঠুরতা, শঙ্কা ও আতঙ্ক বেকনের বিষয়-আশয়; অথচ নিজেকে তিনি বাসত্মববাদী ছাড়া আর কোনোভাবেই দেখতে রাজি ছিলেন না। তাঁর ছবিতে কোনো রাজনৈতিক দর্শন বা তথাকথিত শিক্ষণীয় বিষয় নেই – অত্যমত্ম নিস্পৃহভাবে যেন বেকন এঁকে গেছেন কিছু উদ্ভট চিত্রকল্প, ভয়ার্ত মানুষজন; আবেগের তীব্রতায় ভেসে যাওয়া নগ্নিকা অথবা দুঃস্বপ্নতাড়িত ধর্মযাজক। সচেতনভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত রেখেছেন নিজের তুলিকে ফ্রান্সিস বেকন। এমনকি তাঁর ছবিতে কোনো গল্প যে আছে, তাও তিনি অস্বীকার করেন। কিন্তু শিল্পের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারে এতটুকু চিড় ধরে না তাতে।
বেকনের জন্ম ১৯০৯ সালে, ডাবলিনে। বাবা ছিলেন ঘোড়ার তালিমদার। ঘোড়ার সঙ্গে বেকনের পরিচয় হয় ঘনিষ্ঠভাবে, অল্প বয়সে – তাঁর ছবিতে ঘোড়ারা নেই, কিন্তু তাদের তাড়িত গতি, তাদের সকল শারীরিক জ্যামিতি, তাদের ক্ষুরের অবিরাম ধ্বনি, যেন একটি অদৃশ্য, কিন্তু বাঙ্ময়, প্রেক্ষাপট রচনা করে তাঁর ছবির। ঘোড়াদের আসত্মাবলে সমকামিতায় হাতেখড়ি লাভ করেন বেকন, যে সমকামিতা সারাজীবনে তিনি পরিহার করতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি, যদিও নানা দিক থেকে চাপ ছিল। তাঁর ক্রুদ্ধ পিতা যখন বেকনকে এই স্খলনের জন্য ঘর থেকে বের করে দিলেন, শাপে বর হয়েই দেখা দিলো ঘটনাটি। লন্ডন হয়ে ইউরোপের পথে পাড়ি জমালেন বেকন এবং পৌঁছুলেন বার্লিন ও প্যারিসে, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। প্যারিসে তখন চলছিল পিকাসোর একটি প্রদর্শনী। ওই প্রদর্শনী দেখে বেকনের মনে হলো, নিয়তি তাঁকে নির্দিষ্ট করে রেখেছে একজন শিল্পী হওয়ার জন্য। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা তাঁর ছিল না; কিন্তু বেকন যথার্থই স্বশিক্ষিত হতে পেরেছিলেন। কারণ প্রকাশবাদের সঙ্গে স্বাভাবিক ও প্রবৃত্তিগত মিলটিকে তিনি প্রশসত্ম করেছিলেন কিউববাদের সঙ্গে সংমিশ্রিত করে। ফলে তাঁর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের মধ্যে একটি অদ্ভুত পৃথিবীর সাক্ষাৎ আমরা পাই, যেখানে প্রকাশবাদী বোধ অনুভূতিগুলো – যা ব্যক্তিনির্ভর ও অগোছালো – কিউববাদের জ্যামিতিক শাসনে এক অদ্ভুত অসংগতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। প্রকাশবাদের সঙ্গে কিউববাদের এই ভয়ানক সংমিশ্রণ আমাদের সময়ে বেকন ছাড়া কেউ করতে সাহস করেছেন কি না, আমার জানা নেই, থাকলেও অমত্মত তাঁর মতো এতটা তীব্রতা ও তীক্ষনতা নিয়ে আর কেউ হয়তো তা করতে পারেননি। বেকনের পক্ষক্ষ বিষয়টি সহজ ছিল, কারণ জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রথা ভাঙতে এবং একই সঙ্গে অত্যমত্ম নির্মোহভাবে ওই ধ্বংসকার্য দেখতে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এইখানে আমরা একটি মিল পাই বেকনের সঙ্গে তাঁর পূর্বসূরি, প্রথাবিরোধী এবং প্রতিবাদী আরেক বেকনের। উভয়ের নাম হুবহু এক, যদিও প্রথম ফ্রান্সিস বেকনের জন্ম ১৫৬১ সালে, মৃত্যু ১৬২৬-এ। তিনি ছিলেন দার্শনিক, প্রবন্ধকার, রাষ্ট্রনেতা। চিত্রকর্ম চর্চায় কোনোদিন তিনি যাননি। কিন্তু আমাদের সময়ের বেকনের সঙ্গে তাঁর মিলটি ছিল এই জায়গায় যে, তিনি কর্তৃপক্ষীয় যে-কোনো যুক্তিতর্কের বিরোধী ছিলেন – অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান যখন সুবিধাবাদী যুক্তিতে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে ব্যক্তিমানুষকে, তখন বেকন রম্নখে দাঁড়িয়েছেন। জেকবীয় ইংল্যান্ডে স্কলাসটিক দর্শনের যে করম্নণ হাল হয়েছিল নিষ্প্রাণ তর্ক-বিতর্কের বাহুল্যে, তিনি তা থেকে দর্শনকে উদ্ধার করতে ব্রতী হয়েছিলেন। বেকন বিশ্বাস করতেন, দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও বিচারবাদী চিমত্মার প্রসার না থাকলে দর্শন শুধু প্রথাবদ্ধ একটি চর্চা হয়ে থাকবে, মানুষের উপকারে আসবে না। চিত্রকর বেকনের ফ্রান্সিস নামটি যিনি দিয়েছিলেন, তিনি ওই বেকনের চিমত্মাচেতনার এই দিকটি কতটা আন্দাজ করেছিলেন, কে জানে; কিন্তু এই বেকনও তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে একটি প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন সারাজীবন – প্রথার বিরম্নদ্ধে, আবেগধর্মিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিরম্নদ্ধে। আমাদের সময়েই বিখ্যাত কত চিত্র আন্দোলনই কিছু শীর্ষ প্রবক্তার প্রস্থানের পর দ্রম্নত প্রাতিষ্ঠানিকতার সীমাবদ্ধতা অর্জন করে ফেলল সে তো আমরা দেখেছি। বেকন এই মিইয়ে যাওয়া, নুয়ে পড়া, ক্রমবিলীয়মান শক্তিগুলোকে সদা জাগ্রত রাখার চেষ্টায় নিবেদিত ছিলেন।
জোসেফ কনরাডের একটি উপন্যাসিকা আছে, হার্ট অফ ডার্কনেস নামে, যেখানে আলোকিত পশ্চিমা একটি শহর থেকে গল্পের যাত্রা শুরম্ন হয়ে শেষ হয় আফ্রিকার গভীর অভ্যমত্মরে কঙ্গোর এক গহিন জঙ্গলে, একটি ছোট্ট, অন্ধকার ট্রেডিং আউটপোস্টে। উপন্যাসিকার বর্ণনাকারীর সঙ্গে সেখানে দেখা হয় হাতির দাঁতের ব্যবসায়ী, ওই আউটপোস্টের নির্বাহী, মি. কুর্জের সঙ্গে। মি. কুর্জ, যিনি বাণিজ্যকে একটি ধর্মে পরিণত করা পশ্চিমের প্রতিনিধি, একসময় মৃত্যুপথযাত্রী হন। কিন্তু মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি হাতির দাঁতের শ্বেতচ্ছটা অথবা পশ্চিমের আলোকিত কোনো নিসর্গ দেখেন না, বরং দেখেন সভ্যতার গভীর কেন্দ্রে ঘনীভূত অন্ধকারকে এবং আতঙ্ককে। তাঁর সেই বিখ্যাত শেষ উক্তি – The horror, the horror! অনেকেই উচ্চারিত হতে শুনেছেন। ফ্রান্সিস বেকন দেখেছিলেন এই horror-কে, তবে মৃত্যুর বহু আগেই, দেখেছিলেন মানুষের জীবনে, তার প্রতিষ্ঠানে, পারিপার্শ্বিকতায়, তার পরিবেশে। বেকনের বহু ছবিতে এই আতঙ্ক এক ক্ষমাহীন মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে থাকে দর্শকের দিকে। তাঁর বিখ্যাত ‘পোপ’ সিরিজ, অথবা চিৎকাররত নগ্নিকার ছবি, অথবা দরোজা-জানালাহীন ঘরে অথবা কাচের গরাদ বা খাঁচায় ভয়ার্ত মানুষজনের নিষ্পেষণের ছবি – সর্বত্র ওই ভয় ও চিৎকার, এবং বিশেষ করে শেষোক্ত ছবিগুলোতে, যেন আমাদের সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও দেখতে বাধ্য হই – আবছা কাচের মধ্য দিয়ে এক নিদানিক অত্যাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃশ্য। বেকনের ছবি দেখলে প্রথমেই আমাদের উৎপন্ন হয় কিমিতিবোধ, আতঙ্ক, শঙ্কা, বিবমিষা। কিন্তু এই যদি হয় একজন চিত্রকরের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের সূত্রপাত তাহলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় কীভাবে?
উত্তরে বলা যায় – এবং এইখানে কাফকার সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্যটি স্বীকৃত – ওই কিমিতিবোধ, শঙ্কা বা বিবমিষাই সবটুকু নয় ফ্রান্সিস বেকনের। কাফকার পৃথিবীটিও প্রথম দর্শনে বা আপাতদৃষ্টিতে এক উত্থানহীন, ভয়ংকর প্রাত্যহিকতার, এক গুরম্নতর আত্মিক-নান্দনিক অসুখের। কিন্তু কাফকার একটি উপন্যাস শেষ হলে আমরা অনুভব করি একটি বিপরীত সম্ভাবনার দিকেও যেন এগোচ্ছি আমরা, আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি একটি ব্যক্তিগত নির্বাণ। এমনকি যে প্রায়-নিয়তিবাদী মেটামরফোসিস গল্পটি আমাদের সীমাবদ্ধ পৃথিবীর বাইরের দরোজাগুলোতে অন্ধকার পর্দা টেনে দেয়, সেখানেও সম্ভাবনা থাকে, এক ক্ষীণ, দূরবর্তী পুনরম্নত্থানের। সব শেষ হয়েও শেষ হয়ে যায় না – অমত্মত কাফকার ভাষা তাই বলে, তাঁর চিত্রকল্প তাই বলে, তাঁর চরিত্রের ভেতরের সত্তাটি তাই বলে। সেই তুলনায় ফ্রান্সিস বেকন অনেক বেশি শনাক্তযোগ্য উত্থানবাদী। তিনি কখনো পরিষ্কারভাবে কোনো সম্ভাবনাকে মূর্ত করেন না, কিন্তু আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি অসুন্দরের, বীভৎসতার ও কুৎসিতের আড়ালে তাঁর চিত্রকলায় সুন্দরের প্রতি একটি প্রবল আগ্রহ আছে। বেকন সম্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি কুৎসিতকে রূপামত্মরিত করেন সুন্দরে, সুন্দরকে কুৎসিতে। সুন্দর-অসুন্দরের মেলবন্ধন অথবা তাদের পরস্পর সংযুক্ততা আমাদের সময়ে নতুন করে উপলব্ধি করার বিষয় নয়। অনেক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর চিত্রকলায় সেটি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ছবিতেও ছিল ফিগারের বাঁকা ফর্ম, ছিল এক রহস্যময় অসুন্দরের উপস্থিতি এবং তাঁর ছবিতে সঞ্চারিত হতো এক অস্বসিত্মর অনুভূতি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভুতুড়ে ফিগারদের কখনো চিৎকাররত অথবা দুঃস্বপ্নতাড়িত দেখাননি, বরং তাদের অমত্মর্গত রহস্যময়তা ওই সম্ভাবনাকে তিরোহিত করে। বেকন নিজেই বলেছেন, তাঁর ফিগাররা যখন ক্যানভাসে থাকে তাদের সঙ্গে প্রকৃত মানুষজনের সম্পর্কটি হয়ে দাঁড়ায় কাদায় একটি সাপের ফেলে যাওয়া পিচ্ছিল চলনের ছাপের মতো। তিনি সচেতনভাবেই একটি repulsion-এর জন্ম দিতে চেয়েছেন দর্শকদের মনে, যে repulsion থেকে শেষ পর্যমত্ম অনেক ঘোরপ্যাঁচ পথে, হয়তো আকর্ষণ আসবে জীবনের প্রতি।
বেকনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি বহু বিখ্যাত চিত্রকরের ছবি দেখে দেখে অাঁকতেন তাঁর ক্যানভাসে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় জুড়ে দিতেন নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা ও অনুকরণের একটি যৌক্তিকতা। সপ্তদশ শতাব্দীর স্পেনীয় চিত্রকর ভেলাজকুয়েজ অত্যমত্ম প্রিয় ছিলেন ফ্রান্সিস বেকনের। ভেলাজকুয়েজ বিখ্যাত ছিলেন তাঁর বস্ত্তনিষ্ঠতার জন্য, বাসত্মববাদী ধ্যান-ধারণা ও প্রকাশ বৈশিষ্ট্যের জন্য; তাঁর রং ছিল পাকা, তাঁর স্কেচ ছিল অব্যর্থ। বেকন তাঁর বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছেন ভেলাজকুয়েজের অনুকরণে – ‘স্ক্রিমিং পোপ’ – তাঁর বিখ্যাত ছবি, ১৯৫৩ সালে অাঁকা, ধরে রেখেছে ওই প্রাচীন শিল্পীর প্রতিকৃতি অঙ্কনের পারঙ্গমতা এবং তাঁর রঙের সৌষ্ঠব; কিন্তু বেকন দিয়েছেন তাঁর ছবিতে এক দুঃস্বপ্নের মাত্রা, চিৎকাররত পোপ অস্পষ্ট হয়ে আছেন পর্দার ভাঁজগুলোর মধ্য দিয়ে, কিন্তু তাঁর সমসত্ম ভয়ার্ত সত্তা যেন এই অস্পষ্টতার চাদর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। ‘হেড সারাউন্ডেড বাই সাইডস অফ বিফ’ (১৯৫৪) ভেলাজকুয়েজের অনুকরণে অাঁকা আরেকটি ছবি, কিন্তু এখানে বেকনের বৃদ্ধ বসে আছেন এক হিমাগারে, তাঁর মুখম-ল যেন বোনা-মুখোশে ঢাকা, কিন্তু তাঁর মুখ হাঁ করা। আর সেই মুখ থেকে নিঃসৃত, রক্ত চলাচল সত্মব্ধ করা, চিৎকারটি চরাচরব্যাপী ধ্বনিত হতে থাকে।
পঞ্চাশের দশকের শুরম্নতেই বেকন তাঁর কাজে অর্জন করেন একটি দিকনির্দেশনা, তাঁর ঈপ্সিত মুন্শিয়ানাটি। দীর্ঘদিন তিনি ফর্মকে ভেঙে, ফিগারকে ভেঙে, কৌণিকতা, ভঙ্গুরতা দিয়ে, ক্যানভাসে অশুভ ও অসুন্দরের মিছিল এনে, রঙের ব্যতিক্রমী ব্যবহার করে একটি নিজস্ব ইডিয়ম অর্জন করতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু ব্যর্থও হয়েছেন অনেক সময়। এজন্য বেকন নিজে তাঁর বহু ছবি নষ্ট করে ফেলেছেন। তাঁর অগ্রযাত্রার ইতিহাসটি এ কারণে ক্রমিক নয় – পঞ্চাশের দশক থেকে আমরা যেন হঠাৎ করে শুরম্ন করি, যদিও আগের কিছু কিছু নমুনা এখানে-সেখানে পাওয়া যায়। নিউইয়র্কের আধুনিক শিল্পকলার জাদুঘরে বেকনের ‘পেইন্টিং’ নামে একটি ছবি সংরক্ষিত আছে, যা ১৯৪৩ সালে বেকন এঁকেছিলেন। এক কসাইখানায় বক্তৃতারত হাঙরমুখো এক নেতা। স্পষ্ট ও ঋজু উপস্থাপনা; কিন্তু সর্বত্র আছে এক নিষ্ঠুরতার প্রলেপ, আতঙ্কের বিদ্যুৎ ও বিবমিষার স্পর্শ। একই ধরনের অভিব্যক্তি উৎপাদন করে ‘দ্য স্টাডি অফ এ হেড’ (১৯৫৫), যেখানে পটভূমি পরিবর্তিত হয়েছে, বিষয়ও ভিন্ন; কিন্তু এই শতাব্দীর অসুখ ও দুঃস্বপ্ন যেখানে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। ১৯৬২ সালে তিনি ‘থ্রি স্টাডিজ ফর এ ক্রুসিফিকশন’ সমাপ্ত করেন, যেগুলো ১৯৪৪ সালে করা ‘থ্রি স্টাডিজ ফর ফিগারস অ্যাট দি বেইস অফ এ ক্রুসিফিকশনে’র পুনঃ অঙ্কন। বেকন এসব স্টাডিতে মানুষের সমগ্র আধ্যাত্মিক ইতিহাসকেই যেন ব্যঙ্গ করেছেন, তাকে উপস্থিত করেছেন অবলোকনের স্বচ্ছ আলোর নিচে। বীভৎসতার যে নন্দনতত্ত্ব তিনি উপহার দেন এসব ছবিতে, তাতে যেন বাতিল হয়ে যায় দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক বকধার্মিকতার আত্মপ্রসাদ, এমনকি মানুষের স্বসিত্মকর আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। বেকনের মাধ্যম ছিল প্রকট রং আর বুকে কামড় বসিয়ে দেয় এমন সব রেখা।
অথচ মজার ব্যাপার হলো, এসব উপাদান, উপকরণ অথবা মাধ্যম ব্যবহার করে বেকন কোনো বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। বেকন যে আইরিশ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন, তাতে প্রচ- শ্রদ্ধার চোখে ধর্মীয় বিষয়গুলো দেখা হতো, এমনকি ধর্মের নামে বাজারে চালানো ইহজাগতিক বিষয়গুলোকেও। সেখানে বেকন যখন তাঁর এসব ‘আপত্তিকর’ চিত্র নিয়ে উপস্থিত হলেন, প্রতিষ্ঠানের ধিক্কার তাঁকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করার সংঘবদ্ধ কোনো উপায় বা হাতিয়ার হিসেবে বেকন তাঁর ছবিকে ব্যবহার করেননি।
বেকনের যাঁরা গুণগ্রাহী বা অনুসারী ছিলেন, অনেকেই অত্যাচারী যে-কোনো ব্যবস্থা যেমন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রতীকায়িত করার জন্য বেকনের রীতি ও পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছেন। বেকন নিজে ছিলেন একধরনের শুদ্ধবাদিতার চর্চাকারী। তিনি বিশ্বাস করতেন চিত্রকলার জগৎ হবে চিত্রকলাকে ঘিরেই – সেখানে বিষয়-আশয় যা আসে, তা মানুষের অবস্থাকে রূপায়িত করে, কিন্তু কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে না।
আমাদের দেশে ফ্রান্সিস বেকন প্রাসঙ্গিক হতে শুরম্ন করেন সত্তরের দশকের শেষ দিকে। এর আগে তাঁর কোনো প্রভাব কোনো শিল্পীর কাজে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। তাছাড়া বেকন কোনো সময়েই আধুনিক চিত্রকলার প্রধান স্রোতটির মাঝখানে ছিলেন না; তাঁর অবস্থান ছিল অনেকটা প্রামিত্মক। তাঁকে এক ডাকে সবাই চিনবেন, এমন বিখ্যাত তিনি কখনো হতে পারেননি। তবে তাঁর মৃত্যুর পর, গত কুড়ি-চবিবশ বছরে, তাঁকে অনেক উঁচু আসনে বসানো হচ্ছে, তাঁর কাজ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। বেকনের অাঁকা ছবির প্রিন্ট আমাদের শিল্পীদের কাছে দুষ্প্রাপ্য ছিল না। তবে যে কারণে ফ্রান্সিস বেকন সত্তরের শেষ থেকে একটি স্থান করে নিতে শুরম্ন করলেন আমাদের চিত্রাঙ্গনে, অমত্মত তাঁর সম্বন্ধে আগ্রহ বাড়ল আমাদের দেশে, তা হলো স্বৈরাচার ও পুলিশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। সারা আশির দশকজুড়েই এইখানে যে ভয়ানক একনায়কতন্ত্র চলল, যা বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের একটা স্থান জুড়ে আছে, তার আঘাতে একে একে ধসে পড়ল যুগের বহু নির্মাণ, মূল্যবোধ, মানুষের বিশ্বাস। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই শুরম্ন হয়েছে নিঃশ্বাস বন্ধ করা গুমোট এই সময়টি, শুধু তার নিয়মত্মারা পালটেছে। আমাদের তরম্নণেরা, বিশেষ করে প্রচলবিরোধী, প্রথাবিরোধী প্রতিবাদী শিল্পীরা, বেকনের কাজে একটি চমৎকার সম্ভাবনা আবিষ্কার করলেন, যা পুলিশ রাষ্ট্রের নানা স্ববিরোধ, ভ-ামি এবং একটি সাধারণ উদ্ভট চিমত্মাকে প্রকাশ করতে পারে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের কশাঘাতে, শাণিতভাবে। বেকনের প্রভাব যেসব শিল্পীরা নিয়েছেন, তাঁরা সকলেই তাঁদের মৌলিক সৃজনশীলতার সঙ্গে তাঁকে মিশিয়েছেন। একটি প্রকাশ বৈশিষ্ট্য এইভাবে তাঁরা আবিষ্কার করেছেন, যা সমগ্র আশির দশকে এক চমৎকার নতুনত্ব উপহার দিয়েছে বাংলাদেশের চিত্রকলায়। শিশির ভট্টাচার্য, ঢালী আল মামুন, নাসির অথবা জলি, দীপা হক, অথবা বিসত্মৃত অর্থে, ‘সময়’ নামক দলটির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা বেকনকে সঠিকভাবে ধরতে পেরেছেন, তাঁকে মূল্যায়ন করতে পেরেছেন। বেকন এঁদের প্রতিভায় একটি স্ফুলিঙ্গ স্থাপন করেছেন, তাঁরা নিজেদের মতো উদ্ভাসিত হয়েছেন।
ফ্রান্সিস বেকন মারা যাওয়ার পর নিউ ইয়র্কার সাময়িকীর অন্যতম প্রধান কার্টুনিস্ট এডওয়ার্ড মমত্মব্য করেন, ‘তাঁর ছবির দিকে তাকাতে আমার ভয় হতো, পাছে নিজের কাছে নিজে নগ্ন হয়ে যাই – যদিও না তাকিয়ে পারতাম না, এখনো পারি না, ওইসব প্রচ- শক্তিশালী ছবির দিকে।’
বেকন প্রায় খেলাচ্ছলে সভ্যতাকে বাধ্য করেছিলেন এর মেকি বেশভূষা, আর মুখোশটি খুলে ফেলতে। n