logo

ফেস্টিভাল দ্য কান একটি বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র উৎসব

সে লি ম  পা র ভে জ

কান, ভেনিস আর বার্লিন – এই ‘থ্রি বিগ’ বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব। কান চলচ্চিত্র উৎসব – অফিসিয়াল নাম ফেস্টিভাল দ্য কান বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর মধ্যে আরো বেশি মর্যাদাপূর্ণ ও প্রভাবশালী হয়ে উঠছে দিন দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৩৯ সালে সব প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করেও শুরু হতে না পারা কান যাত্রা শুরু করে ১৯৪৬ সালে ফ্রান্সের রিসোর্ট শহর ‘কান’ থেকে। পালে দ্য ফেস্টিভালে দ্য কোঁগ্র (Palais des Festival et des Congres) নামক ভবন থেকে এর মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রতিবছরের মে মাসে। পোলিশ পরিচালক কার্জসটফ কিসোলস্কি (Krzyszt of Kieslowski) তাঁর থ্রি কালারস ট্রিলজির (The Three Colors Trilogy) একটি রেড (Red) বানিয়েছিলেন এই কান উৎসবকে উদ্দেশ্য করে। সারা পৃথিবীর প্রায় হাজারটি ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে কানকে স্বভাবে ও বৈচিত্র্যে সহজেই আলাদা করা যায়।

এবারের কান উৎসব

ফেস্টিভাল দ্য কানের চৌষট্টিতম আসর এবার অনুষ্ঠিত হলো ১১ থেকে ২২ মে। মার্কিন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো (Robert De Niro) প্রথমবারের মতো হয়েছিলেন মূল প্রতিযোগিতার  প্রেসিডেন্ট। আর ফরাসি পরিচালক মাইকেল গনড্রে (Michel Gondry) শ্রেষ্ঠ শর্টফিল্ম প্রতিযোগিতার জুরিপ্রধান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জন হো বং (Joon Ho Bong) নিয়েছিলেন প্রথমবার নির্মিত শ্রেষ্ঠ সিনেমা নির্বাচনের দায়িত্ব।

মার্কিন উডি অ্যালেনের (Woody Allen) মিডনাইট ইন প্যারিস (Midnight in Paris) দিয়ে শুরু হয় কানের উৎসব। ইরানের জেলবন্দি পরিচালক জাফর পানাহি (Jafor Panahi) ও মুহম্মদ রাসউলফকে (Mohammad Rasoulof) জানানো হয় বিশেষ সম্মাননা। পানাহির দিস ইজ নট আ ফিল্ম (This Is Not a Film) এবং রাসউলফের গুডবাই (Goodbye) দেখানো হয়  উৎসবে। পানাহি পান  ‘Carrosse d’Or’ পুরস্কার। ডেনিস পরিচালক লারস ভন ট্রিয়ার (Lars Von Trier)  তাঁর মেলানকোলিয়া (Melancholia) সিনেমার সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে নাৎসি বলে ফেলায় বিতর্ক বেশ জমে উঠেছিল, যদিও কান কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মতো অফিসিয়ালি ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে সব সামলে নেন ভালোভাবে।

উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান ম্যালেন লরেন্ট (Melanie Laurent) পরিচালনা করলেও ইতালীয় পরিচালক
বারনারদো বারতোলুচি (Bernardo Bertolucci) পরিচালনা করেন কানের সবচেয়ে লোভনীয় পুরস্কার পাম ডি’ওর (Palme d’Or) দেওয়ার অনুষ্ঠানটি। মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২০টি চলচ্চিত্র। প্রথমবারের মতো শ্রেষ্ঠ হওয়ার লড়াইয়ে নামে ২১টি চলচ্চিত্র; শ্রেষ্ঠ শর্টফিল্মের গোল্ডেন পাম পুরস্কার জেতার দৌড়ে অংশ নেয় নয়টি চলচ্চিত্র। উৎসব শেষ হয় ফ্রান্সের ক্রিস্টোফি হনারর (Cristophe Honore) দি বিলাভড (The Beloved) সিনেমা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে।

টি ট্রি অফ লাইফ (The Tree of Life) জিতে নিয়েছে  শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পাম ডি’ওর (Palme d’Or)। টেরেন্স মালিক (Terrence Malick) পরিচালিত ছবিটি মাইকেল মুরের ২০০৪ সালে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ফারেনহাইট ৯/১১ (Fahrenheit 9/11)-এর পর প্রথম কোনো আমেরিকান সিনেমা এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি জিতলো। পুরস্কারের ব্যাপারে জুরি বোর্ডের প্রধান রবার্ট ডি নিরো বলেছেন, ‘বিজয়ী খুঁজে নেওয়ার ব্যাপারটি খুব কঠিন ছিল। কিন্তু দি ট্রি অফ লাইফ (The Tree of Life) ছবিটির আকার, গুরুত্ব কিংবা উদ্দেশ্য যাই বলুন না কেন ছবিটিকে পুরস্কারের জন্য সবচেয়ে যোগ্য করে তুলেছে।’ এর আগে ১৯৭৯ সালে ডেজ অফ হেভেন (Days of Heaven) ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন টেরেন্স মালিক।

দি ট্রি অফ লাইফ (The Tree of Life)

পঞ্চাশের দশকের এক মিড ওয়েস্টার্ন পরিবারের বড় ছেলে জ্যাক। বাবার সঙ্গে এক জটিল মানসিক সম্পর্ক স্থাপন ও পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে শৈশব আর কৈশোরে বেড়ে ওঠে জ্যাক। সে দেখতে পায় আধুনিক জীবনে পৃথিবীর মানুষের মন কীভাবে মরে যাচ্ছে। মানুষের বিশ্বাসগুলো কোথায় যেন চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে, বসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। মানুষের এই বিশ্বাসহীন জীবনের মানেই বা কী? পরিচালক টেরেন্স মালিক নিজের চিত্রনাট্যে ১৩৮ মিনিটের চলচ্চিত্রে অনবদ্য কিছু দৃশ্যের মধ্য দিয়ে দর্শকের চোখ আটকে দিয়েছেন। ইমানুয়েল লুবেজকির (Emanuel Lubezki) অসাধারণ ক্যামেরার কাজে মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্কগুলো ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। জ্যাকের বাবার চরিত্রে ব্র্যাড পিট (Brad Pitt), ছোট জ্যাক হান্টার ম্যাকক্রেকেন (Hunter Maccracken) ও জ্যাক চরিত্রে শন পেনের (Sean Penn) বেশকিছু অভিব্যক্তি ছবির প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হয়তো দি ট্রি অফ লাইফ জিতে নিয়েছে এবারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পাম ডি’ওর।

পুরস্কারমালা

তুর্কি নুরি বিলজি সেলানের (Nuri Bilge Ceylan) ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আনাতোলিয়া (Once Upon A Time In Anatolia) এবং বেলজিয়ামের ডারডেন ভ্রাতৃদ্বয়ের (Jean-Pierre এবং Luc Dardenne) ছবি দি কিড উইথ আ বাইক  (The Kid With A Bike) জিতে নিয়েছে গ্র্যান্ড প্রাইজ।

আমেরিকান নিকোলাস উইনডিং রেফিন (Nicolas Winding Refn) তাঁর ড্রাইভ (Drive) ছবি দিয়ে জিতে নিয়েছেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কারটি।

ইসরায়েলের ছবি ফুটনোট (Footnote)-এর জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছেন জোসেফ সেদার (Joseph Cedar)।

ডেনমার্কের লারস ভন ট্রিয়ারের (Lars Von Trier) মেলানকোলিয়া-র (Melancholia) জন্য শ্রেষ্ঠ  অভিনেত্রী হয়েছেন ক্রিস্টেন ডানস্ট (Kirsten Dunst) আর জেন ডুজারডিন (Jean Dujardin) হয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ফ্রান্সের মাইকেল হাজানাভিসিয়াসের (Michel Hazanavicius)  ছবি দি আর্টিস্ট (The Artist)-এ অসাধারণ অভিনয়ের জন্য।

ফ্রান্সের মাইউইন লি বেস্কোর (Maiwenn Le Besko) পোলিশ (Poliss) পেয়েছে শ্রেষ্ঠ জুরি প্রাইজ।

শর্টফিল্ম ক্যাটাগরিতে পাম ডি’ওর জিতেছেন ফ্রান্স ও ইউক্রেনের যৌথ প্রযোজনার মেরিনা ভোরদা (Maryna Vorda) ছবি ক্রস কান্ট্রি (Cross Country) আর শর্টফিল্মের জুরি প্রাইজ জিতেছে বেলজিয়ামের ছবি ওয়ানজ ডেসটুপের (Wannes Destoop) সুইমসুট ৪৬ (Swimsuit 46)।

প্রতিযোগিতার বাইরে তরুণ মেধাবীর সৃষ্টিশীল কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম কি ডুক (Kim Ki Duk) তাঁর আরিরাং (Arirang) চলচ্চিত্রের জন্য এবং জার্মানির আন্ড্রেস ড্রেসেন (Andreas Dresen) তাঁর স্টড অন ট্রাক (Stopped On Track) চলচ্চিত্রের জন্য।

শ্রেষ্ঠ স্টুডেন্ট ফিল্মের প্রথম পুরস্কারটি পেয়েছে জামার্নির ডিএফএফবির ছাত্র ডুরোটিয়া ড্রাউমেভা (Doroteya Droumeva)-র দি লেটার (The Letter)। ফ্রান্সের ডিরারি (Drari) হয়েছে দ্বিতীয় আর দক্ষিণ কোরিয়ার ফ্লাই বাই নাইট (Fly By Night) পেয়েছে তৃতীয় পুরস্কার।

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম ক্রিটিকস পুরস্কার পেয়েছে ফিনল্যান্ডের আকি কাউরিয়াসমাকির (Aki Kauriasmaki) সিনেমা লি হাভরে (Le Havre)।

আর শ্রেষ্ঠ প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য ক্যামেরা ডি’ওর (Camera d’Or) জিতে নিয়েছে লাস অ্যাকাসিয়াস (Las Acacias)-এর  জন্য পাবলো জিওরগেলি (Pablo Giorgelli)।

ছোট দীর্ঘশ্বাস

ফেস্টিভাল দ্য কানের লাল কার্পেট যখন ক্যামেরার মুহুর্মুহু সাদা আলোয় ভাসতে থাকে তারকা আর কলাকুশলীর তখন মনে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস জায়গা খোঁজে – কবে, কখন আবারো একজন দাঁড়িয়ে এই আলোয় আমাদেরও আলোকিত করবে। সেই দীর্ঘশ্বাসকে ছাপিয়ে ফেস্টিভাল দ্য কানে গ্ল্যামার ছড়ানোর প্রতিযোগিতা মনকে আরো একটু ভারি করে তোলে।

হোক, ফেস্টিভাল দ্য কান তো শুধু ভালো চলচ্চিত্র প্রদর্শনের উৎসব নয় – ভালো চলচ্চিত্র বিক্রিরও উৎসব। বিক্রির জন্য এ বিজ্ঞাপনের হয়তো প্রয়োজন আছে।

Leave a Reply