logo

প রি ক্র মা

মোরশেদুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া ও আমার কথা

মোরশেদুল ইসলামের আমার বন্ধু রাশেদ নিয়ে আমি একটি চলচ্চিত্র-সমালোচনা লিখেছিলাম শিল্প ও শিল্পী পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় (ফে ব্রুয়ারি, ২০১২)। আমার সমালোচনা নিয়ে দুটি প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটির পরের সংখ্যায় (মে, ২০১২)। একটি লিখেছেন কলকাতার হৃদয়পুর থেকে সুশীল সাহা এবং আরেকটি চলচ্চিত্রটির পরিচালক স্বয়ং। আমার মনে হয়েছে, প্রতিক্রিয়াগুলোর পরে আমারও কিছু বলা উচিত। আমি বলব মূলত পরিচালকের প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে। কারণ কোনো চলচ্চিত্র সমালোচনার পর পরিচালকের লিখিত প্রতিক্রিয়া সাধারণত দেখা যায় না। ব্যাপারটা গুরুতর।

পরিচালক দাবি করেছেন, আমি চলচ্চিত্রটি ভালোমতো না দেখেই সমালোচনা লিখেছি এবং ব্যাপারটিকে তিনি ‘অপরাধ’ বলে রায় দিয়েছেন। আমি চলচ্চিত্রটি প্রথম দেখি পরিচালকেরই আয়োজিত আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে। এরপর শিল্প ও শিল্পী পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদ পরিচালকের কাছ থেকে ডিভিডি সংগ্রহ করে আমার হাতে দিয়ে দায়িত্ব দেন চলচ্চিত্রটি নিয়ে লেখার জন্য। ডিভিডি হাতে পাওয়ায় সুবিধা হয়েছে চলচ্চিত্রটি বারবার দেখার। আমি বলছি, আমি ভালো করেই চলচ্চিত্রটি দেখেছি। ছবিটির বহুল প্রশংসা করার পর (আমি লিখেছিলাম – ‘শিশু-কিশোরদের উপযোগী নির্মিত মোরশেদুল ইসলামের চারটি চলচ্চিত্রের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সুনির্মিত। চাকা ছাড়া মোরশেদুল ইসলামের অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যেও আমার বন্ধু রাশেদের অবস্থান থাকবে ওপরের দিকেই’) লিখেছিলাম, কিছু কিছু জায়গায় পরিচালকের ‘অমনোযোগ আমাদের হতাশও করে’। বিপত্তি বেধেছে এই ‘অমনোযোগ’গুলো ধরিয়ে দিতে গিয়েই। ছোটখাটো ভুলত্র“টি মহৎ শিল্পকর্মকে বামনকর্ম বানিয়ে দিতে পারে, চলচ্চিত্রকার পরের প্রকল্পে সতর্ক থাকবেন – সমালোচনা লেখার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র সমালোচকের প্রত্যাশা এই-ই থাকে। আমরা জানি, গ্রেট মেকারদের কাজে এরকম ছোটখাটো ভুলত্র“টি থাকে না বললেই চলে। শিল্পপ্রয়াসী মহৎকর্ম তো বটেই, এমনকি হলিউড-বলিউডের অনেক জনপ্রিয় ছবিতেই এসব বিষয়ে কোনো আপস করা হয় না।

আমি লিখেছিলাম, ‘যুদ্ধ-দৃশ্যগুলো একেবারে সাদামাটা মনে হয়েছে। অন্যান্য দৃশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা গেলেও, স্কুলে ক্যাম্প-করা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মূলযুদ্ধে শফিক, রাশেদ ও ইবু ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি। এই বক্তব্যের পর পরিচালক বলছেন ‘কী ভয়াবহ পর্যবেক্ষণ!’ তিনি আরো বলছেন, ‘পর্দায় শুধু তিনজনকে দেখা গেলেও ফ্রেমের বাইরে যে আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তাঁরা গুলি করছেন, গ্রেনেড নিক্ষেপ করছেন, জয় বাংলা ধ্বনি দিচ্ছেন, তা কি একজন সাধারণ দর্শকেরও বুঝতে অসুবিধা হয়?’ শফিকের কণ্ঠেও সংলাপ ছিল, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কভার দেওয়া’। এটা ঠিক, গুলি, গ্রেনেড নিক্ষেপ, জয় বাংলা ধ্বনি ফ্রেমের বাইরে ছিল; কিন্তু ফ্রেমের ভেতরে, হাই অ্যাঙ্গেল ও লং শটে ধারণ করা, পাকিস্তানি সৈন্যদের পাল্টা গুলিবর্ষণ ও ট্রাকে করে পলায়নদৃশ্য ছিল; এর পরপরই অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা ফ্রেমে ঢুকতে পারত, জয়ী হয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে পারত। তাহলে যুদ্ধটির ব্যাপকতা বোঝানো যেত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধতাও প্রতিষ্ঠিত হতো। পর্দায় মাত্র তিনজন মুক্তিযোদ্ধার ভিস্যুয়াল উপস্থিতি তাই যুদ্ধ-দৃশ্যটিকে ‘সাদামাটা’ করেই রেখেছে।

আরেক জায়গায় লিখেছিলাম, ‘ক্লাস শেষে রাশেদ ও কাদেরের মধ্যে একবার ধাক্কাধাক্কি হয়। রাশেদ কাদেরকে ধাক্কা দিলে পড়ে যায়। কাদের যখন ভূপাতিত হয়, তখন কোনো বেঞ্চকে পড়ে যেতে দেখা যায় না। কিন্তু কাটের পর যখন কাদের উঠে দাঁড়ায় তখন দেখা যায় একটা বেঞ্চ কাত হয়ে পড়ে আছে। যুদ্ধজাহাজে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা শহরে আসার পরে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসে খান বাহাদুর ও তার দুই চেলা। চেলা দুইজনকে পাকিস্তানি সৈন্য যখন গুলি করে হত্যা করে, তখন সৈন্যের বন্দুকের অ্যাঙ্গেল ভিন্ন দিকে থাকে, তারপরও চেলা গুলিবিদ্ধ হয়’। এই দুই পর্যবেক্ষণের বিপরীতে পরিচালক ক্লাসরুমের দৃশ্যের ক্ষেত্রে লিখলেন, ‘দুটি শট দুই অ্যাঙ্গেল থেকে নেওয়া হয়েছে বলেই তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন’। আমি মোটেও বিভ্রান্ত হইনি। মোদ্দা কথা হলো, রাশেদ কাদেরকে ধাক্কা দিল, কাদের মাটিতে পড়ে গেল, পড়ার সময় কোনো বড় বেঞ্চ পড়েনি বা কাত হয়নি। এরপর কাদেরের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে একটা লো অ্যাঙ্গেল শট ছিল, যেখানে দেখা যায় রাশেদ ও অন্যান্য ক্লাসমেট দাঁড়িয়ে কাদেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই শটেও দণ্ডায়মান বেঞ্চের এক কোনা দেখা যায়। এই দুই শটের একটাতেও কোনো বেঞ্চকে কাত হতে দেখা যায়নি। কেবল কাদের যখন উঠে দাঁড়াতে থাকে তখন বড় বেঞ্চ কাত হয়ে আছে দেখা যায়, যেন আগেই এগুলো পড়েছে, যার অর্থ ধাক্কাধাক্কি বা কাদেরের পতনের সময় এটা ঘটেছে। অ্যাঙ্গেল যতই পরিবর্তিত হোক, বেঞ্চটি পড়ার কোনো তথ্যই ফ্রেমে বা ফ্রেমের বাইরে দেওয়া হয়নি। খান বাহাদুর ও তার চেলার হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণের বিপরীতে মোরশেদুল ইসলাম লিখলেন, ‘ফ্রেমের বাইরেও যে আরো সৈন্য ছিল এবং তারাও যে গুলি করছিল তা ফাহমিদুলের চোখ এড়িয়ে গেছে’। এখানেও ফ্রেমের বাইরের গুলিতে চেলা বিদ্ধ হয়েছে। ভালো কথা! কিন্তু ফ্রেমের ভেতরে সৈন্যটা আকাশমুখে বন্দুক ধরে ছিল কেন? সব সৈন্যের ওই মুহূর্তে অ্যাকশন ছিল তিনজনকে গুলি করা, আকাশমুখো বন্দুক তখন কী শিকারে ব্যাপৃত ছিল? সঠিক কাজটি ফ্রেমের বাইরে থেকে ঘটেছে, ফ্রেমের ভেতরে কাণ্ডটিকে তাহলে কী বিবেচনা করবে দর্শক?

আমি লিখেছিলাম, ‘রাশেদের চরিত্রে চৌধুরী জাওয়াতা আফনান এবং ইবুর চরিত্রে রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী মোটামুটি মানিয়ে গেলেও অন্যান্য কিশোর চরিত্রের অভিনেতার অভিনয়ে জড়তা লক্ষ করা গেছে’। পরিচালক লিখলেন, ‘কিশোর অভিনেতাদের অভিনয়ে জড়তা ছিল বলে ফাহমিদুল যে মূল্যায়ন করেছেন তা তাঁর স্বাভাবিক ও সাবলীল অভিনয় হৃদয়ঙ্গম করার ব্যর্থতা বলেই আমি মনে করি’। পরে তিনি বলেছেন যে, রাশেদ চরিত্রের অভিনেতা পরিণত অভিনয় করেছেন। আমি বলেছিলাম, তিনি মোটামুটি মানিয়ে গেছেন। আমি জড়তার প্রসঙ্গটি এনেছিলাম রাশেদ ও ইবু বাদে অন্যান্য চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে।

আমি লিখেছিলাম, ‘টাইটেল কার্ড ও এন্ড টাইটেলের নেপথ্য সংগীত মনে ধরার মতো হলেও বাকি সময় জুড়ে ইমন সাহার সংগীত তেমন কিছু যোগ করে না’। কিন্তু এই কথাটিও পরিচালকের পছন্দ হয়নি। টাইটেল ও এন্ড টাইটেলের সংগীতের প্রশংসা করলেও ভেতরের কোথায় কোথায় আমার পছন্দ হয়নি তার ব্যাখ্যা আমি দিইনি। অথচ একে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘ভালো কিছুকে প্রশংসা করতে না পারার ব্যর্থতা’ হিসেবে।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাসে কিশোররা ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মার্চের প্রথম দিককার আলোচনাকে মূল্যায়ন করেছিল ‘দুঃসংবাদ’ হিসেবে। কারণ ওরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিয়ে দিলে স্বাধীন বাংলা হবে না। রাশেদের মত ছিল, ভাসানী ঠিকই বলেছেন, তাঁর এক দফা, এই দেশ স্বাধীন বাংলা হবে। এই প্রসঙ্গ এক জটিল স্পর্শকাতর ইস্যুতে আলো ফেলে – যে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেশুনে পদ্ধতিগতভাবে ধীরে এগোচ্ছিলেন স্বাধীনতার দিকে, কিন্তু ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন এবং জনগণের একাংশের চাপ ছিল আরো দ্রুত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার। হয়তো এই গোষ্ঠীর মত (এখানে রাশেদ ও তার বন্ধুরা) এবং রাজনীতিবিদ ভাসানীর মত প্রায় একই ছিল। উপন্যাসে এই বিষয়টিতে চকিতে ঢোকা হয়েছে এবং সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে আসা হয়েছে। স্বাধীনতার মত-পথ নিয়ে আন্দোলনকারীদের মতবিরোধ থাকতেই পারে, থাকেই – উপন্যাসে ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করা হয়নি। কিন্তু চলচ্চিত্রে এটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালকও যদি বিষয়টাকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে বেরিয়ে আসতে পারতেন, তবে কত ভালোই না হতো! তাই আমি লিখেছিলাম, ‘ঐতিহাসিক তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে মূল উপন্যাস থেকে পরিচালক কিছুটা সরে এসেছেন। উপন্যাসে দেখা গেছে, রাশেদরা চিন্তিত ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা পাবার জন্য দরকষাকষি করছেন; যদি তাঁকে ক্ষমতা দেওয়া হয় তবে স্বাধীনতা আসবে না, পাকিস্তানই টিকে যাবে। তারা বরং স্বাধীনতার জন্য মওলানা ভাসানীর যে এক দফা, তাতে আস্থাশীল ছিল। রাশেদদের এই ভাবনা ধরে নিতে হবে স্বাধীনতার প্রশ্নে ঔপন্যাসিকের ভাবনা। কিন্তু পরিচালক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ রাখতে চাননি। ফলে ভাসানীর প্রসঙ্গ একেবারেই উল্লেখ না করে মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান এই চলচ্চিত্রে হাজির করা হয়েছে, তা প্রাধান্যশীল একরৈখিক বয়ান, যা এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারের সেন্সর বোর্ড বা অপরাপর ক্ষমতাকেন্দ্রকে তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট হয়েছে’। যাই হোক, এই বিশ্লেষণটি পরিচালকের একেবারেই পছন্দ হয়নি। তাই তিনি লিখলেন, ‘ফাহমিদুলরা যতই ‘প্রাধান্যশীল একরৈখিক বয়ান’ বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার বা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খাটো করার অপচেষ্টা করুন, ঐতিহাসিক সত্য তাতে বিন্দুমাত্র ম্লান হয় না’। অবশ্যই ঐতিহাসিক সত্য ম্লান হবে না, অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে পুরো দেশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, সবাই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল, পুরো জাতিকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে দেখেছিলাম। কিন্তু তার মধ্যেও নানান রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয়, জাতিগত, লৈঙ্গিক পার্থক্য-বৈচিত্র্য ছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল আওয়ামী-মুসলমান-বাঙালি-পুরুষের হবে না। অন্যান্য অভিজ্ঞতাকেও আমলে আনতে হবে। তাই এটা মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃতি-অসম্মান-খর্ব করার মামলা না। এই মামলা বৈচিত্র্যের – অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য মুক্তিযুদ্ধের সম্পদ। আর ‘ফাহমিদুলরা’ মানে কী? বহুবচন কেন? আমাকে কাদের গোত্রভুক্ত করার চেষ্টা করছেন পরিচালক? তিনি কি খেয়াল করেছেন যে, ওই দলে মুহম্মদ জাফর ইকবালও পড়ছেন? এটা খুব দুঃখজনক যে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আলোচনায় প্রাধান্যশীল মতের বাইরে কোনো কিছু দেখলে তাকে দ্রুত স্বাধীনতাবিরোধীদের শিবিরে পাঠিয়ে দেবার একটা প্রবণতা গড়ে উঠেছে। এই প্রবণতা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসপাঠকেই বরং ক্ষতিগ্রস্ত করে।

 

ফাহমিদুল হক

১৫ জুলাই, ২০১২

গের্নিকা প্রসঙ্গে

মে ২০১২-র শিল্প ও শিল্পী সংখ্যাটি দেখে ও পড়ে ভালো লাগল। শিল্প বিষয়ে এমন ত্রৈমাসিক বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, তা আনন্দ ও গর্বের কথা এবং এ অঞ্চলের শিল্পরসিক ও ছাত্রদের এই ত্রৈমাসিকের সংখ্যাগুলো পড়তেই হবে, শিল্পকলা সম্পর্কে গভীরভাবে জানার জন্য। যে-কোনো শিল্পবস্তু স্বয়ং প্রকাশিত নয় বা স্বয়ং তার উদ্দেশ্য, গতিপথ নির্ধারণ করে না। তার জন্য প্রয়োজন পড়ে ইতিহাসের, নানা আলোচনা ও তর্কের। এসবের একজন হয়েই শিল্পকর্মকে বুঝতে ও জানতে হয়। আবার এভাবে মান নির্ধারিত না হলে শিল্পের বাজারও তৈরি হবে না বা তৈরি হলেও তা টিকবে না। কেবলই অতিরঞ্জনে বা তোষামোদে শিল্পের গুরুত্ব তৈরি হয় না। শিল্প অন্যান্য কমোডিটির মতো নয়।

আমি বিশেষ করে এই চিঠিটি লিখছি হায়দার আলী খানের খুবই সুন্দর ‘পিকাসোর গের্নিকা : যুদ্ধ, শান্তি ও শিল্প নন্দনতত্ত্ব ও ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন’ প্রবন্ধটি পড়ে উৎসাহিত হয়ে, তাঁকে আমার অন্তর থেকে অভিনন্দন জানাই এত ভালো ও প্রাসঙ্গিক একটি লেখা ‘গের্নিকা’ নিয়ে লেখার জন্য।

পিকাসোর ‘গের্নিকা’য় আগাগোড়া সাদা-কালো নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন যেমন, ‘সাদা-কালোর ভেতর মানবতার যে আর্তনাদ তীব্রভাবে আমাদের দিকে ছুটে আসে, কোনো রঙিন ছবি তা পারত বলে পিকাসো ভাবেননি। আমরাও ভাবতে পারি না।’ পিকাসোর সারা জীবনের শিল্পকর্মে দেখা যায়, তিনি কোনো কোনো সময় কেবল নির্বাচিত রঙে ছবি আঁকেন। যেমন কেবল নীল রঙে, তারপর গোলাপি রঙে, সাদা-কালোয় ইত্যাদি। analytical cubist mg‡q AvuKv ‡hgb The guitar player, 1910, Woman with guitar, 1911, still life on a Piano (CORT), 1912 – এই ছবিগুলোতে কেবলই ধূসর রং দেখতে পাই। আবার চারটি বড় সাইজের পিকাসোর ছবির নাম করা যায়, যা একই রকম রং দেওয়ার কায়দায় করা। প্রথম হলো The MillinerÕs workshop, 1926 (১৭২ x ২৫৬ সেমি), দ্বিতীয়টি হলো গের্নিকা (১৯৩৭,  ৩৪৯.৩ x ৭৭৬.৬ সেমি), The Charnel House (১৯৪৪-৪৫, ১৯৯.৮ x ২৫০.১ সেমি), চতুর্থটি Las Meninas -র (ভেলাজকুয়েজের ছবির আদলে, ১৯৫৭, ১৯৪ x ২৬০ সেমি) প্রথম ক্যানভাসটি। এ ক্ষেত্রে গের্নিকা ও দ্য কারনেল হাউস বলা যেতে পারে আর্তনাদের ছবি কিন্তু অন্য দুটি আদৌ তা নয়। এবং এদের পরস্পরের সঙ্গে মিল যদি কোথাও থাকে তা হলো এগুলোর প্রতিটিই খুব বড় ছবি এবং অসংখ্য চরিত্রও রয়েছে ছবিতে। ফলে রং আঁকার চাইতে নির্বাচিত সাদা-কালোয় এত বড় composition -কে নিয়ন্ত্রণে রাখার সুবিধা পাওয়া যায়।

পিকাসো ‘গের্নিকা’ ছবিটি শেষ করেছিলেন জুনের চার তারিখ কিন্তু ছাব্বিশে অক্টোবর সেই একই বছরে তিনি খুবই সফল ক্রন্দনরত এক মহিলার ছবি এঁকেছিলেন এবং তা যে গের্নিকার মর্মান্তিক ঘটনার আবেগের সঙ্গে যুক্ত, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ‘বিবঢ়রহম ড়িসধহ’-এ তিনি রং দিয়েছেন হাত খুলে। হলুদ, লাল, সবুজ ইত্যাদি রঙের সমাবেশে ছবিটি গড়ে উঠেছে। ভ্যান গঘের কায়দায় উঁচু পর্দার রং দিয়েও দুঃখিত আবেগের তীব্রতা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন পিকাসো এবং ‘গের্নিকা’র জন্য করা কয়েকটা খসড়া ড্রইং ও রঙিন যেমন দশই মে, ১৯৩৭-এ করা ‘মা ও শিশু’। শুধুই সাদা-কালোয়, তা বলে কয়েকটি খসড়া ড্রইং নিশ্চয়ই রঙিন হতো না।

‘গের্নিকা’র নির্মাণের প্রস্তুতির অঙ্গ হিসেবে করা পিকাসোর ড্রইংগুলোতেও কত সম্ভাবনা, রূপকল্প, মিথ-নির্মিত হচ্ছিল তা নিয়ে বিস্তৃত লিখেছেন হায়দার আলী খান। সঙ্গে সঙ্গে এও দেখা যায় যে, ‘গের্নিকা’ মূল ছবিটিই Painting I drawing -এর এক বিচিত্র ব্যালান্স হিসেবেই নির্মিত। পিকাসো পুরো ছবিটি জুড়েই লাইন ও টোনের মিলিত ছন্দ তৈরি করেন। ছবিটির বহু জায়গাতেই লাইনের স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। অসাধারণ গ্রাফিক অনুভব থাকার কারণেই পিকাসো এমন করতে পেরেছিলেন।

বিখ্যাত ব্রিটিশ-আমেরিকান শিল্পী রন কিতাজ্ (জ ই করঃধল) গের্নিকা নিয়ে লিখেছিলেন, ‘Guernica is cubist, surrealist, spanish, Anti Fascist, Picassoist, modernist, symbolist etc … its cosmopoliton attentions seem to me those of a diasporist predicamentÕ (R. B. kitaj ÔA Guest in the House of Art’). এই কথাগুলোতে একজন শিল্পীর দেখার স্বচ্ছতা ও গভীরতা রয়েছে। এই পত্র লেখকের আরেকটি প্রিয় মন্তব্য ‘গের্নিকা’কে নিয়ে রয়েছে, যা লিখেছিলেন বিখ্যাত শিল্প-সমালোচক ডেনিড সিলভিয়েস্টার।

‘The freûied, helpless, agoni“ed gestures of the figures, cutting through space in every direction, are locked together – like the pieces of a jigswa – so that they are held in a terrible stillness which the explosive force in every inch of the design is endlessly trying to break through. It is only in responding to this tension between irresistible force and immovable structure that I have started to perceive the scale of the imaginative genius that underlines the iconography, its choice and placing of actors and props, each functioning both as phenomenon and as symbol – the bull, the dying horse, the bird, the flower, the light bull, the fallen warrior with a broken sword, the woman mourning a dead child, the woman falling from a burning house, the woman rushing across the scene holding a lamp – were worked out within a fwe weeks of the air raid with a conviction that gives it the air of inevitability of a classic religious iconography (About modern Art : David Sylvester critical essays 1948-97), Henry wolf and compaû, nwe York)এত বড় একটা উদ্ধৃতি আমি কিছুতেই লিখতাম না, যদি না তা অসাধারণভাবে ‘গের্নিকা’কে এত মূর্ত করে তুলত। আবার হায়দার আলী খান লেখক ফ্রাঙ্ক রাসেলের ছবিটি সম্পর্কে ধর্মীয় প্রভাবের প্রতি পক্ষপাত নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা কিন্তু ডেভিড সিলভিয়েস্টারও বলছেন, ‘inevitability of a classic religious iconography’. কিন্তু মনে হয়, এঁরা কেউই নির্বাচিত কোনো ধর্মের কথা বলছেন না ছবিটির বিষয়ে, বরং আবহমান মানবতাকে রক্ষা করার যে কল্যাণ বোধ তার কথা বলছেন। অর্থাৎ ঈগলটনীয় সংঘাতের ভেতর যে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া, তাও বাতিল কিছুতেই হচ্ছে না ছবিটি প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক ভাবনাতেও এমন ধর্মবোধ ও দ্বান্দ্বিকতার সাক্ষাৎ কত যে রয়েছে। খান সাহেব লিখেছেন, ‘আমাদের কালের প্রতিভাবান মহৎ শিল্পীরাও তাই নতুন প্রেরণা খুঁজে পান গের্নিকার দিকে তাকিয়ে।’ ইচ্ছে হয়, এই প্রেরণা সম্পর্কে আরেকটা বিস্তৃত প্রবন্ধ যদি লেখেন তিনি, তখন না হয় আবার আরেকটা চিঠি লেখা যাবে সেই প্রবন্ধ পড়ার পর।

তপন ভট্টাচার্য

এই-৮১২, সেক্টর-১

সল্ট লেক, কলকাতা-৭০০০৬৪

শিল্প ও শিল্পী প্রসঙ্গে

এক বছরের শিল্প ও শিল্পীর চারটি সংখ্যা একসঙ্গে হাতে পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি তা বলার নয়। সঙ্গে সঙ্গেই জানাতে চেয়েছি, কিন্তু বেশ কদিন এখানে বিএসএনএলএ ই-মেইলের যোগাযোগ ছিল না, তাই নিরস্ত থাকতে হয়েছে। অনেকের মুখেই শুনেছিলাম এর কথা, কিন্তু চোখে দেখে বিস্ময়ের অবধি রইল না।

আমাদের ছাত্রজীবনে সুভো ঠাকুরের সুন্দরম্ নিয়ে মাতামাতি ছিল। সেটাও ছিল আর্ট পেপারে শৌখিনভাবে ছাপা চিত্রকলা বিষয়ক পত্রিকা। কিন্তু তারপরে, অন্তত বাংলা ভাষায়, এরকম লক্ষ্যের ও মানের কাগজ আর চোখে পড়েনি এতকালের মধ্যে, যদি বেরিয়েও থাকে কখনো, নিঃসন্দেহে বলা যায়,  শিল্প ও শিল্পী তাকেও ছাপিয়ে গেছে।

যেমন আকারে তেমনি প্রকারে। বিরাট আয়তনের এই পত্রিকার বৈচিত্র্য ও বিস্তার শুধু পাতা উলটে গেলেই টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশ তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত এবং তাকে ছাড়িয়ে প্রতীচ্য – গোটা বিশ্বের শিল্পজগৎ যেন এখানে হাজির। আরম্ভই হয়েছে আমিনুল ইসলামকে দিযে। তারপর বিভিন্ন সংখ্যায় জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন, কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মনিরুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী যাঁদের কথা অল্পস্বল্প জানি, জানতে চাই আরো। পঞ্চম ও ষাটের দশকের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কীভাবে চিত্র-ভাস্কর্যে ছাপ ফেলছে তারও বিবরণ। সেই একই মেজাজে যামিনী রায়, অমৃতা শেরগিল, চিত্রত্প্রসাদ, সোমনাথ হোর, মকবুল ফিদা হুসেন, মীরা মুখোপাধ্যায়, কে জি সুব্রহ্মণ্যন, গনেশ হালুই, শর্বরী রায় চৌধুরী, শক্তি বর্মণ প্রমুখ।

তাঁদের ওপর যে আলোচনা তাতে তর-তম আছে ঠিকই, কিন্তু ওখানকার আবুল মানসুর বা সৈয়দ মনজরুল ইসলামের লেখায় যেমন স্বাদ পেিেছ যথেষ্ট, তেমনি এপার বাংলা থেকে আমন্ত্রিত লেখকেরাও কম নন – যেমন প্রণবরঞ্জন রায়, সুশোভন অধিকারী, মৃণাল ঘোষ প্রমুখ।  সুখের কথা, যান্ত্রিকভাবে দেশ ও কাল অনুসারে সাজানো নয়, এলোমেলোভাবে এসে গেছে একেকটা প্রসঙ্গ এবং সেটাই ভালো লেগেছে, পত্রিকাসুলভ একটা খোলামেলা হাওয়াও তৈরি হয়েছে এর ফলে। আর তা অনেকটাই ছড়ানো। তাই তো মাঝে-মাঝেই পাই ফ্রান্সিস বেকনের জীবন ও শিল্প কিংবা পিকাসো-র গের্নিকা নিয়ে সচিত্র প্রবন্ধ। লেখাগুলোর অভিপ্রায়েও তারপম্য – সবটাই যে বিশদ তা নয়, কখনো নিছক টিপ্পনী।

মূলত ছবি ও ভাস্কর্যের পত্রিকা হলেও খুব সংগতভাবেই সংস্কৃতির অন্য শাখাগুলোর কথাও এসেছে এখানে, শুধু চিত্তবিনোদনের জন্য নয়, পরিপূরক শিল্পকর্ম ও ভাবনার অনুষঙ্গে মৌল বিষয়টির পরিধিকেও চেনা যাবে বলে। মনের মধ্যেই যেন একটা বিনিময়ও চলতে থাকবে। স্থাপত্য, সংগীত, নাট্য, চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ কখনো তত্ত্বে, কখনো বিশেষ কোনো দৃষ্টান্তে। আর সেই সুবাদেই বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতিম স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, নাট্যে সাম্প্রতিক প্রয়োজনাসমূহ, বাংলাদেশের তারেক মাসুদ বা নাসিরউদ্দীন ইউসুফের কাহিনীচিত্র থেকে শুরু করে রাশিয়ার তারাকোভস্কি। পরন্তু, একেবারে ব্যতিক্রমী বিষয়ও – যেমন চার্লস ডয়লির কলকাতা প্রদর্শনী, কমলা ঝরিয়ার ীবন ও গান, আবদুশ শাকুরের লেখা অতিদীর্ঘ বাংলা গানের ইতিহাস, ২০০১-এর প্রথম আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব, কান-এর চলচ্চিতত্রোৎসব, এমনকি চলচ্চিত্র আন্দোলরে অগ্রণী চিদানন্দ দাশগুপ্তের বিস্মৃতিপ্রায় কৃতি।

তবু ‘চিত্রকলা ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা’ এই ঘোষণা সত্ত্বেও চিত্রকলারই যে প্রাধান্য তা মুহূর্তেই স্পষ্ট হয় পাতা খুলে যখন এর ছোট-বড় নানা আয়তনের সাদাকালো ও রঙিন ছবিগুলোতে চোখ পড়ে। দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় নন্দনাল বসুর বর্ণময় ড্রইং, সোমনাথ হোরের ছবিতে সাদার ওপর সাদার আঘাত, কিংবা মীরা মুখোপাধ্যায়ের পোড়ামাটির সজীবন ভাস্কর্যের আলোকচিত্রগুলো। এরকম আরো অনেক। পত্রিকার সামগ্রিক, কিংবা বলা যায়, প্রতিটি পাতার বিন্যাস সজ্জা ও মুদ্রণের নান্দনিক দিকটিতে চোখ জুড়োয়। বাংলা ভাষায় এরকম উপস্থাপনার প্রায় তুলনা মেলে না। বলতে ইচ্ছে করে, বিদেশি উদ্যোগের সমপর্যায়ে এর সাফল্য। সত্যিই গর্ব হয়, বাংলা ভাষায় এই উঁচুমানের অভূতপূর্ব পত্রিকাটির সম্পাদক আমাদের বন্ধু।

হয়তো ভাষার দিক থেকে আমার এই উচ্ছ্বাস একটু পোশাকি হয়ে গেল, কিন্তু কী করব, মনে-মনে তো এই আছে! উদ্গ্রীব হয়ে থাকব পরের সংখ্যাগুলোর জন্যও।

 

অরুণ সেন

কালিন্দী

কলকাতা

Leave a Reply