সম্পাদক, শিল্প ও শিল্পী
ঢাকা
প্রসঙ্গ : মকবুল ফিদা হুসেন
আপনাদের অভিনন্দন জানাই এমন একটি উঁচুমানের শিল্প-সম্পর্কিত পত্রিকা প্রকাশ করার জন্য। এ-কাজের মান বজায় রাখা সহজ নয়; কিন্তু এটা যে অত্যন্ত দরকারি কাজ তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য আমার এই চিঠিতে আলোচনার বিষয় হলো শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনকে নিয়ে শিকোয়া নাজনীনের প্রবন্ধটি। নাজনীনের লেখাটি সুলিখিত এবং সাধারণভাবে শিল্পী সম্পর্কে জানাও যায়, তবু তাঁর কিছু মন্তব্য তর্কসাপেক্ষ।
যেমন মকবুল ফিদা হুসেন ছিলেন মনেপ্রাণে একজন সামাজিক মানুষ। যদিও তাঁর যাযাবর, জিপসির মতো জীবনযাত্রা খুবই আকর্ষণীয় এবং অত্যন্ত আলোচিত; কিন্তু বন্ধুত্ব, সামাজিকতা, নানান যোগাযোগ তিনি মেনে চলতেন। অন্তত তাঁর জীবনকে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস One Hundred Years of Solitude থেকে চিহ্নিত করে নিঃসঙ্গতার একশ বছর বোধহয় বলা যায় না। যেমন নাজনীন প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন, হুসেন ছিলেন আপাদমস্তক একজন ধ্যানী শিল্পী। এক্ষেত্রে ধ্যানী কী অর্থে বলা যায়! নিজের কাজ মনোযোগ দিয়ে যে-কোনো শিল্পীকেই করতে হয়; কিন্তু ধ্যানী শব্দটা আমরা যে-অর্থে ব্যবহার করি, তিনি তেমন ছিলেন না নিশ্চয়ই। প্রবন্ধের প্রায় শুরুতেই যেমন নাজনীন লিখেছেন, ‘তিনি বিশ্বাস করতেন রামমোহন, বিবেকানন্দ, তিলক, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর দর্শন।’ হুসেনের ছবিতে গান্ধীজি অনেকবারই এসেছেন এবং তাঁর ছবিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ও কংগ্রেসের যে সামাজিক ভাবনা তা যুক্ত হয়ে আছে শুরু থেকেই; কিন্তু রামমোহন, বিবেকানন্দ, তিলক প্রমুখ বোধহয় একেবারেই নেই। এ কথাগুলোরই বা কী অর্থ – ‘যাদের জীবনে ভারত-অভারত দুই-ই রয়েছে। ভারতীয়ত্বের ছাপ ত্যাগ করার ফলেই যাঁদের ভারতীয় শেকড় শক্ত হয়েছিল। মকবুল ফিদা হুসেন সেই অর্থে ভারতীয় ছিলেন।’ বরং প্রগ্রেসিভ অন্য শিল্পীদের তুলনায় হুসেন ভারতীয় যে সামাজিক-আর্থিক জীবন, তার যে নানান লৌকিক আচার ও সংস্কৃতি, তা নিয়ে উৎসাহী ছিলেন বলেই তিনি চিহ্নিত হতে পারেন ভারতীয়তায়। তিনি যেমন আগাগোড়া figurative শিল্পী ছিলেন এবং তাঁর ছবিতে ফিগারগুলো ভারতীয় বা এই উপমহাদেশীয় বলে ভাবতে কখনো অসুবিধে হয় না। আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি আঁকতে পারতেন চলমান এই জীবন ও সংস্কৃতিকে এবং তা শুধু পরম্পরাগত হয়ে থাকত না, তাতে যোগ হতো নানান নতুন অর্থও। ফ্রান্সিস নিউটন সুজা, সৈয়দ হায়দার রজা, আকবর পদমশী, বাসুদেব গাইটোন্ডে, রামকুমার প্রমুখ সম্পর্কে যা বলা যায় না তা হলো এই যে, হুসেন যেন শৈলজা মুখোপাধ্যায়, যামিনী রায় ও অমৃতা শেরগিলের উত্তরসূরি হিসেবে এসেছেন। হুসেনের প্রথম দিকের অনেক কাজই গ্রামীণ জীবনকে নানা বঢ়রংড়ফব-এ রূপান্তরিত করে উপস্থিত হয়েছে এবং তাতে গ্রামীণ জীবনকে একটা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আঁকা হতো। তাঁর ব্যক্তিত্বও এমন ছিল যা মিডিয়া ও দেশের মানুষকে বেশি রকম আকর্ষণ করেছে, যা আর কোনো ভারতীয় শিল্পীকে নিয়ে ঘটেনি। হুসেন স্বতোৎসারিতভাবে এবং দ্রুত আঁকতেন এবং তা তাঁর একটা বিশেষ নজরকাড়া মুদ্রা হয়ে দাঁড়ায়। এমনই এপিসোডকে পরিবর্তিত করে তাঁর বিখ্যাত চিত্রগুলোর একটি ছিল ‘জমিন’, আরেকটি যেমন আত্মজীবনী, ১৯৬৫ ইত্যাদি।
হুসেনের ছবির একটা প্রধান বিষয়ই হয়ে দাঁড়ায় ভারতবর্ষকে আঁকা; ফিগারগুলোর যামিনী রায়ের মতোই একটা পুতুলের মতো উপস্থিতি থাকত; কিন্তু তা হতো আরো সজীব, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রবহমান, লৌকিক, এমনকি এপিকধর্মী। হুসেন যেন ভারতীয় মানুষের কথাই ছবিতে বলেন এবং সেই অর্থে স্বাধীনতা-উত্তর যদি ভারতীয় জাতীয় শিল্পী কাউকে বলা যায় তিনি মকবুল ফিদা হুসেন। ভারতীয় পুরাণ বা পৌরাণিক কাহিনি থেকে পার্থিব, লোকায়ত বিষয়ে তাঁর একটা স্বাভাবিক যাতায়াত রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও মনে রাখা দরকার, সৃষ্টিশীলতায় হুসেন সাহেবের যে মান ও ক্ষমতা রয়েছে তার থেকে কোনোভাবেই কম নয় ফ্রান্সিস নিউটন সুজা, তৈয়ব মেহেতা, রামকুমার বা কে বি সুব্রাহ্মণ্যনের মতো শিল্পীদের কাজ। কেবল জনপ্রিয়তা বা মিডিয়ায় আলোচনাই শিল্পবস্তুর মান নির্ধারণ করে না, যদিও তাদের কল্যাণে মকবুল ফিদা হুসেন ও আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলা, কথা দুটো সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলা বলতে অনেকেই রয়েছেন যাঁরা হুসেনের ছবির কথাই ভাবেন। আবার এই যে তিনি অতি বেশি রকম পরিচিত, মিডিয়ায় আলোচিত এবং তিনি একজন মুসলমান ভারতীয় শিল্পী এবং তিনি ভারতের ইতিহাস ও পুরাণকে ছবির বিষয় করেন, তাই দেশের হিন্দু উগ্রপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান। হুসেনের ছবি নিয়ে অসভ্যতা করলে বা সেই ছবি নষ্ট হলে তা সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ার খবর ও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন হিন্দু উগ্রপন্থী তাঁর সুযোগ নিতে থাকেন। এর আগেও ছবি তর্ক, আলোচনা, বিতর্কের বিষয় হয়েছে। যেমন ধরা যাক বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী হেনরি মাতিসের নগ্ন নারীগুলোর উপস্থাপনা, যা নিয়ে নারীবাদীরা আন্দোলন করেছেন এবং তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে; কিন্তু যে অভব্যতা, অসহনশীলতার নজির হিন্দু উগ্রবাদীরা রেখেছেন, তেমন আর কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পীকে নিয়ে হয়েছে বলে জানা নেই। হুসেনের বিদেশে মৃত্যু এ-কথাই মনে করিয়ে দেয়, এই অসহনশীলতাই ভারতীয় গণতন্ত্রের ও সামাজিক একতার বিপদ সংকেত। এ-ধরনের নিজের ইচ্ছে ও প্রয়োজনমতো সেন্সর কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না এবং তা ক্রমাগত ভর্ৎসনার যোগ্য। অর্থাৎ হুসেনের ছবিই আমাদের দেখাল, ভারতীয় জীবনের বিপদ কত দিক থেকে প্রকাশিত হতে পারে এবং তার আপাত নিরীহ ছবিগুলো ভারতীয় জীবনে বিভেদের সংস্কৃতি কত বিস্তারিত, তাকেও চিহ্নিত করতে পারল। ভারত থেকে শিল্পী হুসেনের যে নির্বাসন তা জাতীয় ও সাংস্কৃতিক লজ্জার নিদর্শন হয়ে রইল।
হুসেনের যে দীর্ঘ শিল্পীজীবন তার ক্রমবিবর্তনও শিল্প-ইতিহাসের দিক থেকে আলোচনা ও সমালোচনার বিষয় হয়ে রইল। শিল্প-নির্মাণের শুরুর দিকে তিনি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতীয় গ্রামীণ জীবন আঁকতেন। পঞ্চাশের দশক থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠিত একজন শিল্পী। স্টাইল বা গঠনের দিক থেকে গভীর বদল না হলেও ষাটের দশকে দেখা যায়, শহুরে নাগরিক জীবনও তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে। ১৯৫৬ সালে তিনি আঁকেন তাঁর বিখ্যাত একটি ছবি – ‘Between spider and the lamp’|যে-ছবিতে কতগুলো ভিন্ন বয়সের গ্রামীণ মহিলা কথা বলছেন। যেন এদের রাস্তায় কোথাও দেখা হয়েছে। কিন্তু যে-আখ্যানটি তাদের পারস্পরিকতায় রচিত হচ্ছে তাতে এমন গভীরতা তৈরি হচ্ছে, যা দর্শককে আকর্ষণ করেই চলে। ষাটের দশকে আঁকা আরেকটি বিখ্যাত ছবি হলো ‘কৃষকের পরিবার’। যেন পথের ওপরেই কোথাও এই কৃষক পরিবার অপেক্ষারত, যাতে তাদের জীবনে সদর্থক কিছু ঘটে। দেশবিভাগ তাঁর ছবিতে সরাসরি আসেনি, কিন্তু ওই সময়ে আঁকা ‘man’-এ রয়েছে অস্তিত্ববাদী সংকট যেমন, তেমন স্বাধীনতা-উত্তর মানুষের অসহায় অবস্থান, দেশবিভাগের ফলে আক্রান্ত মানুষের আখ্যানও তাতে পড়া যায়। জটিল কিন্তু সম্ভাবনাময় নির্মাণও ওই ছবিটির একটা বৈশিষ্ট্য। হুসেন বাস্তববাদী নিয়মে ছবি আঁকেন না; কিন্তু তা সত্ত্বেও খুবই সুন্দর যথাযথ প্রতিকৃতি আঁকতে পারতেন। যেমন জওয়াহেরলাল নেহরু, মৌলানা আজাদের আশ্চর্য প্রতিকৃতি ইত্যাদি। আঁকার কায়দায়, নির্মাণে ব্যাপক বদল না করেও তিনি যে এত ভিন্ন ভিন্ন বিষয় আত্মস্থ করতে পারতেন, এও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। রামায়ণ, মহাভারত তো আছেই, এমনকি ইসলাম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্ম থেকেও নানান চিত্র-ধারণা তিনি সহজেই তৈরি করতেন এবং তিনি তা এঁকে ফেলতেন। অন্তত এ-কারণে তাঁকে আন্তর্জাতিক একজন শিল্পী বলা যায়। এই পৃথিবীর নানান রকম সংস্কৃতিই যে তাঁর ছবিতে আবার মূর্ত হয়ে উঠত। সাধারণভাবে বলা যায়, হুসেনের রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল জওয়াহেরলাল নেহরুর কংগ্রেসি আদর্শের মতো। তবু তাঁর একটা বড় বিচ্যুতি ঘটে, যখন সত্তরের দশকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আনা ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থার প্রতি এক ধরনের সহমর্মিতা প্রদর্শন করে কিছু ছবি আঁকেন তিনি। যদিও মেক্সিকান আধুনিক শিল্পীদের মতো সরাসরি রাজনৈতিক শিল্পী হুসেনকে বলা যায় না। হুসেন বরং এমন একটা শিল্পভাষায় ছবিগুলো আঁকতেন যে, নান্দনিক হয়েও তার একটা সামাজিক মাত্রা তৈরি হতো। আধুনিক হয়েও ইতিহাসবোধ তাতে মিশে থাকত। অন্তত তাঁর সার্থক ছবিগুলো সম্পর্কে এমন কথা বলাই যায়।
বলা বাহুল্য, শিকোয়া নাজনীনের প্রবন্ধটিই আমাকে উসকে দিলো হুসেনকে নিয়ে এত কথা লিখতে। তাঁকে আমার ধন্যবাদ জানাই।
তপন ভট্টাচার্য
এ.ই-৮১২, সেক্টর-১
সল্ট লেক, কলকাতা-৭০০০৬৪