logo

প রি ক্র মা ১৯১৩ : কালের অবয়ব

রা জী ব  ভৌ মি ক
আধুনিক ইউরোপীয় চারুকলার ইতিহাসে ১৯১৩ সালটি একটি অসাধারণ মাইলফলক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত আগের বিস্ফোরণোন্মুখ বিশ্বপ্রবাহ, শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে বদলে যাওয়া গ্রামীণ ও শহুরে জীবন, ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে থাকা জীবনযাত্রা – সব মিলিয়ে এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি যার কুটিল, উদ্ভট ও বহুমাত্রিক মিথস্ক্রিয়াগুলো ফুটিয়ে তুলতে স্পর্শকাতর শিল্পী বাধ্য হন নিরীক্ষার চূড়ান্ত করতে। এ বছরই এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যার অনেকগুলোর প্রভাবই এখনো বিদ্যমান। ১৯১৩ সালেই প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার সময় গণনার শুরু। এ বছরই বিশ্ব গোলকটিকে প্রথম ভাগ করা হয় ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোনে। মার্সেল প্র“স্টের রিমেমব্র্যান্স অফ থিংস পাস্ট উপন্যাস প্রকাশিত হতে শুরু হয় এই সালে, রজার ফ্রাই চালু করেন তাঁর ওমেগা ওয়ার্কশপ আর নিউইয়র্কে শুরু হয় বিখ্যাত আর্মারি শো।
১৯১৩ – এ বছরটি জুড়ে পশ্চিমা চারুকলার অঙ্গনে বয়েছে যুগপত্তা বা সাইমালটেনিটির হাওয়া। আরো বেশি বিমূর্ততা, একাধিক দৃষ্টিকোণ বা স্মৃতিগোত্রের যুগপৎ চাঞ্চল্য কিংবা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর অভিজ্ঞতার মেলবন্ধ।  ইংল্যান্ডের লিডসের হেনরি ম্যুর ইনস্টিটিউটে চলছে ‘নাইনটিন থার্টিন : দ্য শেইপ অফ টাইম’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। এখানে তুলে ধরা হয়েছে এমন কিছু ভাস্কর্য, যা এসব নিরীক্ষাধর্মী ধারণাকে অবয়ব দিয়েছে নিজের বস্তুবাদিতা, স্থানবাদিতা এবং প্রাচীন আলংকারিক ঐতিহ্যগুলোর মধ্য দিয়ে। প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে ২২ নভেম্বর, চলবে ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অবধি।
সময়ের যে গতিময়তা ও পরিবর্তনশীলতা, তা নিয়ে ভাস্কররা কী ভাবেন তার একটা ধারণা মিলবে এ প্রদর্শনীর নিদর্শনগুলো দেখলে। আবার সময়ের এই যে গুণাবলি, তা কীভাবে ভাস্কর্যকে প্রভাবিত করে, মিলবে তারও বেশ একটা ধারণা। এ প্রদর্শনীতে যেসব নিদর্শন তোলা হয়েছে তার সবই ১৯১৩ সালে তৈরি; যদিও এদের মধ্যে বেশ কটিকে পরে আবার নতুন করে নকল বা সংস্কার করা হয়েছে।
আর্চিপেঙ্কো, গটফ্রেড, গডিয়ের-বেসকা প্রভৃতির কিউবিজম-প্রীতি কিংবা বোচ্চিওনির ফিউচারিজম অথবা বারানভ-রোসাঁইয়ের ডায়নামিজম আর দুশঁর দোমড়ানো-মোচড়ানো মাপজোখ – একশ বছর আগে ভাস্কররা কীভাবে বস্তু ও অবয়ব দিয়ে স্থানকে চ্যালেঞ্জ জানাতেন তাঁর একটা বোঝাপড়া হয়ে যাবে দর্শনার্থীর।
ভাস্করদের এসব আচরণ ও নিরীক্ষা প্রভাবিত করেছিল সে-সময়ের অনেক আঁকিয়েকেও। তেমনি একজন সোফিচি। ধরা যাক তাঁর অদ্ভুতুড়ে আর বাঁকাচোরা প্রদীপের কথা। অনেকটা ভাস্কর্যের মতোই এই ছবিতে আলো ও স্থানের খোলামেলা সহাবস্থান চোখে পড়বে। সে-সময়ের ভাস্কররা সময়কে যেমন দেখেছেন দ্রুতগতির প্রপঞ্চ হিসেবে, তেমনি আবার দেখেছেন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক ধীরস্থির অববাহিকার নজরে। ভ­াদিমির বারানভ রোসাঁইয়ের ‘রিদমে’ যেমন আভাস মিলবে শিল্পায়নের কারণে অতিদ্রুত পরিবর্তনশীল ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থার। মোডিগলিয়ানির ড্রয়িং ‘ক্যারিয়াটিড’ এবং ডি চিরিকোর ছবি ‘দ্য টাওয়ারে’ শিল্পীর কল্পনার চরিত্রটা অনেকটা ভাস্করের চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
চারুকলা বা সাহিত্যে আধুনিকতা বা মডার্নিজমের আবির্ভাব সাল হিসেবে কেউ কেউ বলেন ১৯০৫ সালের কথা, কারণ সে বছরই অঁরি মাতিস ও দেরাঁ সূচনা করেছিলেন ফভিস্ট ছবির। কেউ কেউ আবার বলেন ১৯২২ সালের কথা, কারণ সে বছরই প্রকাশিত হয়েছিল টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড এবং জেমস জয়েসের ইউলিসিস। ২০১৩ সালটি এই দুইয়ের ঠিক মাঝ বরাবর অবস্থিত। তাই অবস্থানগত কারণেই দুটি বৈপ্লবিক ধারার বাহক এই বিশেষ বছরটি। আর এ কারণেই নির্দিষ্ট কোনো একটি ধারা বা প্রকাশভঙ্গি অনুপস্থিত ১৯১৩ সালের ভাস্কর্য বা ছবিতে। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে ভাবলে, যেসব জটিল আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাচনের উপস্থিতি ও ক্রিয়ার কারণে বিবর্তন হয়েছিল আধুনিকতার, তার প্রায় সবই নিহিত রয়েছে ১৯১৩ সালের এই শিল্পকর্মগুলোতে। এই একটিই তো বছর। কারণ তারপরই তো শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামের মহাপ্রলয় – আর তাতেই প্রাণ দিতে হয় বোচ্চিওনি এবং গডিয়ের ব্রেসকার মতো প্রতিভাবান শিল্পীদের।
২৮-১১-২০১২

Leave a Reply