বি ল নি কো ল স
লেখাটি ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) নিয়মিত প্রকাশনায় ২০১৫ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ‘প্রামাণিক’ বৈশিষ্ট্যটির নানা রকম নেতিবাচক ও ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আলাপ করে। সত্যের ভুল উপস্থাপন বিভিন্ন কারণ বা লক্ষ্য হয়ে থাকে, তা গল্পের বয়ানকে সহজ করার জন্যই হোক কিংবা রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্যে হোক, তার বিধান খুঁজেছে এই লেখা। তবে একই সঙ্গে এটাও মেনে নিয়েছে, চলচ্চিত্র মাত্রই একটি শিল্প, নিছক সংবাদ বা গল্প পরিবেশন নয়; তাই নিয়মকানুন দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে একজন নির্মাতাকে বেঁধে ফেলা যাবে না।
বিল নিকোলস ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি প্রণীত ইন্ট্রোডাকশন টু ডকুমেন্টারি শীর্ষক বইটিসহ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ওপর আরো কতক নামি বইয়ের লেখক। বর্তমানে তিনি সান ফ্রান্সিস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির চলচ্চিত্র অধ্যয়নের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন গোপা বিশ্বাস সীজার।
আমরা কি নৈতিক প্রামাণ্যচিত্র চর্চার জন্য একটি মানদ- স্থাপন করতে পারি? মাইটি টাইমস : ভলিউম ২ : দ্য চিলড্রেন’স মার্চ (২০০৪, রবার্ট হাডসন, পরিচালক/প্রযোজক) চলচ্চিত্রটি ২০০৫ সালে অস্কার পাওয়ার যোগ্য কি না এই বিতর্কটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে এই প্রশ্নটি একটি নিখাদ আলংকারিক প্রশ্ন নয়। চলচ্চিত্রটি স্পষ্টতই নতুন অভিনীত দৃশ্য ও ঐতিহাসিক ফুটেজ অবিভেদ্যভাবে জোড়া লাগিয়েছে এবং এক সময় ও স্থানের সংরক্ষিত সহিংসতার দৃশ্যগুলোকে অন্য সময় ও স্থানের সহিংসতাকে তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করেছে। (স্বীকারোক্তি : আমি এখনো চলচ্চিত্রটি দেখিনি।)
এটা কি নৈতিক মানদ- লঙ্ঘন করেছে? এই মানদ- কী রকম হতে পারে এবং কে এই মানদ- জারি করবে? একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের বিকৃতি, অপব্যাখ্যা, বলপ্রয়োগ বা বিশ্বাসঘাতকতা এড়ানোর কোনো দায় থাকে কি? এটা স্থূল বা অত্যমত্ম সূক্ষ্মটাই হোক না কেন, এমনকি যদি এটি একটি উচ্চতর লক্ষ্য যেমন, ‘গল্পটি বলা’ বা ‘অন্যায়কে প্রকাশে’ সহায়কও হয়ে থাকে তাও কি পরিচালকের এ দায়ভার এড়ানো উচিত? প্ররোচনামূলক কৌশল যাতে প্রতিষ্ঠিত সত্য, প্রমাণের নিয়ম এবং পোক্ত বিতর্কের নীতি বিকৃত না করে সেজন্য একজন পরিচালকের কি দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত?
যে শিল্প আমার বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে
প্রামাণ্যচিত্র একটি অভিব্যক্তিপূর্ণ শিল্প। পুরনো দিনের বাগিশদের মত, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দর্শকের অনুমোদন লাভ করা, শুধু ‘তথ্য পারাপার’ করা বা বিনোদিত করা নয়। তাই অলংকারে আশ্রয়গ্রহণটা আশ্চর্যজনক নয়, কিন্তুনৈতিকতাকে ছাপিয়ে যাওয়া যে-কোনো অজুহাতকে হার মানায়। যে বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা বিধান প্রচলিত বিজ্ঞান ও মতবাদ দিতে পারে না, অলংকার তা প্রকাশের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হাতিয়ার। আমরা কিসের মূল্য দেব এবং কীভাবে ও কেন দেব? প্রত্যেক সমাজ ও প্রত্যেক ব্যক্তি বিভিন্নভাবে এর উত্তর দেন। প্রত্যেক বক্তা এই প্রশ্ন বিশেস্নষণ করেন এবং বিভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উত্তর উত্থাপন করেন।
ব্যবহারে ও চর্চায় এটি কীভাবে আছে? প্রামাণ্যচিত্রের নৈতিক নিয়মাবলি অবশ্যই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্ত্ত এবং আসল দর্শক – এ দুইয়ের জন্য কল্যাণকর হওয়ার ব্যাপারে লক্ষ করা উচিত। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্রের বিষয় ও দর্শকের মর্যাদাকে প্রাধান্য দিতে একটি নৈতিক নিয়মাবলি দরকার, যেখানে দর্শক সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং যেখানে তার সঙ্গে নির্মাতার সম্পর্ক সীমিত নয় বা সম্পূর্ণভাবে বিধিবদ্ধ চুক্তিমূলক সম্পর্ক দ্বারা চালিতও নয়।
চলচ্চিত্রের বিষয়ের ওপর লক্ষ রেখে বলা যায়, নৈতিকতা ও ক্ষমতার মধ্যকার সংযোগ এতে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার পেশায় সফলতা তৈরি হয়েছে অন্যদের দুর্ভাগ্যের ওপর। ব্রায়ান উইনস্টন ক্রুদ্ধভাবেই লিখে গেছেন যে, প্রামাণ্যচিত্রে ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির একটি প্রথা’ রয়েছে, বিশেষ করে সাংবাদিক প্রতিবেদনে (সূত্র : দ্য ট্র্যাডিশন অব দ্য ভিক্টিম ইন গ্রিয়ারসনিয়ান ডকুমেন্টারি, নিউ চ্যালেঞ্জেস ফর ডকুমেন্টারি, অ্যালান রসেন্থাল সম্পাদিত)। একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং তাঁর বিষয়বস্ত্তর মধ্যকার সম্পর্ক, একজন কল্যাণকর অথবা সম্ভাব্য অকল্যাণকর স্বৈরশাসকের শাসিত বস্ত্তর মধ্যকার সম্পর্কের সাদৃশ্য। বিষয়বস্ত্তর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার্থে কী কী সীমারেখা স্বেচ্ছায় ধার্য করা যেতে পারে?
দর্শকের ওপর আলোকপাত করে, নৈতিকতা ও উপস্থাপনের মধ্যকার সংযোগ একটি তুলনামূলক গুরুত্ব নির্ধারণ করে। আমরা যা বলি তার সত্যতার জন্য আমরা কতটুকু দায়ী? একটি ই-মেইলে চিত্রনির্মাতা ও শিক্ষাবিদ জন এলস বলেছেন যে, দর্শক নিতামত্মই অনেক কিছুকে সত্য বলে মনে করবেন এবং এর জন্য চলচ্চিত্রনির্মাতার সে সকল বিশ্বাসকে প্রচারের সম্পূর্ণ দায়ভার নিতে হবে। চলচ্চিত্রনির্মাতা যদি হৃদয় থেকে না বলেন, অন্য স্বার্থের জন্য ভাড়া করা কণ্ঠ হয়ে থাকেন তবে চলচ্চিত্রে প্রতারণাটা কতটুকু সমর্থনীয়?
এই প্রশ্নগুলো কতিপয় বিশ্বাসসংক্রামত্ম প্রশ্নের জন্ম দেয় – এমন একটি ব্যাপার যা আইনীকরণ করা সম্ভব নয়; যা বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে প্রসত্মাবিত ও প্রতিশ্রম্নত, যা মঞ্জুর হয় বা যার অর্জন সম্ভব হয় অনিশ্চিত দরকষাকষির মধ্য দিয়ে এবং এদের মধ্যকার দৃঢ় সম্পর্কের মধ্যস্থতায়। একটি নৈতিক নিয়ম, চুক্তির শর্তাবলি, নির্মাণের নীতির প্রয়োজনীয়তা, গুণগতমান নির্ধারণের পদ্ধতিকে অতিক্রম করতে পারে। কীভাবে আমরা নিজেদের সঙ্গে, নিজেদের উপস্থাপনার (চলচ্চিত্র) সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রমাণ করে বেকসুর খালাস হব? নৈতিক মানদ- এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের পথপ্রদর্শক।
একটি নৈতিক নিয়ম
প্রামাণ্যচিত্র অনুশীলনের একটি নীতিগত দিক হলো তা চিত্রনির্মাতা ও তাঁর বিষয়বস্ত্ত এবং তাঁর দর্শকের মধ্যকার যে ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা উদ্ভূত হয় তা নির্দেশ করা। আরো বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে এটি বিষয়বস্ত্তর ব্যাপারে একমত হওয়ার নীতির সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে, যা স্বীকার করে নেয় যে, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ যতটা না বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা তার চেয়ে বেশি শিল্পের অনুশীলন।
সংক্ষেপে, হিপক্রেইটের শপথের মতো, একটি নির্দেশক বিবরণ দেওয়া যায় ‘এমন কিছু করো না যা তোমার বিষয়বস্ত্তর মানবিকতাকে আঘাত ও তোমার দর্শকের বিশ্বাসকে সমঝোতায় আনার চেষ্টা করবে।’
এরকম একটি মমত্মব্য নিতামত্মই অস্বচ্ছ বলে মনে হতে পারে। কী বিশ্বাসকে আপস করবে? আর কী-ইবা অন্যের মানবিকতাকে আঘাত করে? এই অস্পষ্টতাটি অনিচ্ছাকৃত নয়। এটি এমনকি স্বয়ং প্রামাণ্যচিত্রের যে-কোনো সংজ্ঞার মতো। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নীতিশাস্ত্রকে পরীক্ষা করা হতো এবং এটিও সেরকমই বলে।
যা কিছু দর্শকদের ধোঁকা দেয় এবং বিষয়বস্ত্তর মানদ- লঙ্ঘন করে তা নিয়ে যে দীর্ঘ বিতর্ক আছে তারই অবশেষ বা উচ্ছিষ্ট এসে দূষিত করে তুলছে প্রামাণ্যচিত্রের ইতিহাসকে। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির প্রবক্তারা যেভাবে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির অনুসারীদের আক্রমণ করেন তাতে আবার ধোঁয়াশা বলে কোনো ব্যাপার থাকে না – অংশগ্রহণকারী হিসেবে জাঁ রুশ এবং পর্যবেক্ষক হিসেবে রিকি লিকক উদাহরণই সেটা বলে দেয়। একইভাবে এটি নিয়েও বিতর্ক আছে যে, অপরাপর সংস্কৃতিতে একজন নির্মাতা যখন চলচ্চিত্র ধারণ করেন, তখন তিনি জাতিগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে যখন তাঁর বিষয়বস্ত্তকে একটি বাঁধাধরা গ–তে করেন তখন তা অস্পষ্টতর হয়ে ওঠে, যেমনটি দেখা যায় রবার্ট গার্ডনারের ডেড বার্ডস অথবা রবার্ট ফ্লাহারটির নানুক অব দ্য নর্থ চলচ্চিত্রে।
প্রামাণ্যচিত্রের নীতিগুলো পরিবর্তিত হয়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে, দর্শকের বিশ্বাসকে যা পরিবর্তন করে ও অপরের মানবিকতাকে লঙ্ঘিত করে তার সিদ্ধামত্মও পরিবর্তিত হয়। সমসাময়িক প্রামাণ্যচিত্রের ওপর ভিত্তি করে আরো বিশদভাবে কিছু নৈতিক বিষয়ের নকশা করা সম্ভব।
চলচ্চিত্রনির্মাতা ও তাঁর বিষয়
নির্মাতাদের চলচ্চিত্রের বিষয় ও নির্মাতাদের ক্ষমতায় যে পার্থক্য/বিভেদ তা তাঁদের উপস্থাপনের মাধ্যমের ওপর দখল দেখেই অনুমান করা যায়। যার বা যে বিষয়ের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে তা/তারা কতটা নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে, তারা কি আদৌ মাধ্যমগুলোর ধারেকাছে জেতে পারে? তারা কি নির্মাতার অাঁকা ছকের বাইরে যেয়ে নিজের গল্পটা বলতে পারে? যদি উত্তরগুলো অনেকাংশে নেতিবাচক হয়, তবে মিথ্যা বর্ণনা, শোষণ ও নির্যাতন এড়vতে চলচ্চিত্র পরিচালকের নৈতিক বাধ্যবাধকতা সংগতিপূর্ণভাবেই প্রশ্নের জন্ম দেয়।
যার বা যে বিষয়ের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে, তা/তারা যদি তাদের গল্প অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্মাতার ওপর নির্ভর করে – তারা, যারা সামাজিকভাবে নীচু শ্রেণিতে থাকে তারাই প্রধানত নানান অবিচার ও অন্যায়ের সহজ শিকার – আর এরাই অপউপস্থাপনা ও অপচারের সম্মুখীন হয়।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নিয়ে একটি পূর্ববর্তী নিবন্ধে দেখা যায় যে, (‘হাউ ক্লোজ ইজ টু ক্লোজ? আ কনসিডারেশন অব দ্য ফিল্মমেকার-সাবজেক্ট রিলেশনশিপ’, লিসা লিম্যান, ২০০৩ জুন) অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতাই কোনো বিষয় উপস্থাপনের ব্যাপারে নৈতিকভাবে অত্যমত্ম সংবেদনশীল হওয়া সত্ত্বেও সঠিকভাবে বিষয়কে উপস্থাপনে সমর্থ হন না। তাঁরা বিষয়কে নানান বস্ত্তগত সাহায্য করে থাকেন। কেননা তা না করলে পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। রেনে তাজিমা-পি যেমন, ২০০৪-এ একটি পরিবারের অভিবাসনের চেষ্টা নিয়ে পিবিএসের ধারাবাহিক দ্য নিউ আমেরিকানস তৈরি করেন। তিনি শুধুমাত্র একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে ওই পরিবারটির তেরো বছর পর এক হওয়ার জন্য ভিসা অফিসে দৌড়ানোর গল্প চিত্রায়ণের চেষ্টা না করে নিজে গাড়ি চালিয়ে তাদের ভিসা অফিসে পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবেন। তাঁর এই কাজটা গল্পের গতিপথ বদলে দেয় যদিও তাঁর নৈতিকবোধ বা দায়িত্ব এখানে নিখাদ এবং তিনি নিজে তখন ওই গল্পের একটা অংশ হয়ে যান কারণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা এখানে ব্যক্তিমানুষের আড়ালে চলে যান।
এমন আরেকটি উদাহরণ হলো বর্ন ইনটু ব্রথেলস (জানা ব্রিস্কি, রস কফম্যান, ২০০৪)। একজন চলচ্চিত্রকারের নৈতিক দায়িত্ব কীভাবে একটি চলচ্চিত্রের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এটি হতে পারে তার একটি অসাধারণ উদাহরণ। আবার যৌনকর্মীর সমত্মানদের ফটোগ্রাফি শেখাতে শেখাতে, পরবর্তী সময়ে তাদেরকে নিজস্ব উপস্থাপনের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন – ব্রিস্কির মতে এটাই আসলে চলচ্চিত্রকার এবং বিষয়ের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য এনে দেয়। এই বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ অতি অবশ্যই এমন থাকবে না যেমনটি তার কারণে এখন আছে – এভাবে একটি অপ্রভাবিত দৃষ্টিকোণ বজায় রাখার নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কর্মনীতির সঙ্গে যায় না কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে এ কারণেই চলচ্চিত্রনির্মাণ একটি শিল্প, গৎবাঁধা সংবাদ পরিবেশন নয়।
যখন ক্ষমতার প্রবাহ বিপরীতে, যখন চলচ্চিত্রের বিষয় নির্মাতার ওপর নির্ভর করে না, তখন দায়িত্ববোধ ও সকল নীতিমালার প্রথম লক্ষ্য হতে হবে গল্পটির বয়ান। ধোঁকার প্রয়োজন হবে তাদের জন্য যারা কিছুটা হলেও অন্যের ওপর নির্ভর করে। এবং একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের কারণে (যা প্রায়শই নিজস্ব ক্ষমতার প্রয়োগঘটিত) বিরোধিতা করে কারণ তারা সঙ্গোপনে ওই দুটিকে একটা আকার দিতে চায়।
এন্রন : দ্য স্মারটেস্ট গাই ইন দ্য রুম (এলেক্স গিবনি, ২০০৫) একেবারে নথি-তালিকা করে আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, কী কী ভাবে ক্ষমতাধরেরা গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে নিয়মতান্ত্রিক একধরনের প্রতারণা চালাচ্ছে এবং অন্যের টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজেরা ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে চলচ্চিত্রের নির্মাতারা, উপস্থাপনের মাধ্যম বা তরিকাগুলো নিজেদের মতো করে নেওয়ার জন্য ক্রমাগত যে শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে যাচ্ছেন আদতে অত্যমত্ম ক্ষমতাধর একটি গোষ্ঠী। এসব ক্ষেত্রে, সত্যের অপলাপ/বিকৃতি আর ভুল/অসম্পূর্ণ উপস্থাপন সর্বদাই একটি আলোচনার দাবিদার, কিন্তু আগে বলা হয়ে গেছে এমন গল্পে বা চলচ্চিত্রের বিষয়ের সঙ্গে যায় না বা খাপ খায় না এমন গল্পে প্রায়ই আরোপিত উপস্থাপন দেখা গেলেও গল্প বলার আকুতি/দৃঢ়তা যে চলচ্চিত্রে থাকে তাতে অপ্রয়োজনীয় উপস্থাপন তুলনামূলক কম থাকে এবং পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে সত্যকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন না করে এরা বরং এমন কিছু বলে যা আগে বলা হয়নি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাদের দর্শক
নৈতিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের চর্চা যুক্তিকে যতদূর সম্ভব সম্মান করেই এগোয়। তারা সুনির্দিষ্ট তথ্য উপস্থাপন করে এবং সত্যটা জেনেই করে। কখনো কখনো অবশ্য সত্য যুক্তির সীমাকে অতিক্রম করে যায়। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র সবসময়ই অনুভূতি জাগাতে চায়, প্রতিশ্রম্নতিকে শক্তিশালী করতে চায় কোনো একটা ধারণকৃত বিশ্বাসকে ঊর্ধ্বমুখী করতে।
এই যদি হয় সম্যক চিত্র, তবে নির্মাতারা কী করে ক্ষতিকর, ধোঁকাবাজির চর্চাকে প্রশ্ন করবেন/চ্যালেঞ্জ ছুড়বেন? – এই অসৎ চর্চার ব্যাপ্তি অর্থহীন লোক-ভজানো বিষয় থেকে ভুল উপস্থাপন ও নিরেট ধোঁকাবাজি পর্যমত্ম। কী করবেন নির্মাতারা – এই জনগণকে ভুল পথে চালানোর, দোষ ঢাকার নিয়মতান্ত্রিক এই চেষ্টাকে কীভাবে রুখবেন নির্মাতারা?
অপউপস্থাপন অনেক সময় বেশ বিশ্বাসযোগ্য হয়। দেখে মনে হয় যেন ইতিহাসের দালিলিক ফুটেজ অথচ আসলে হয়তো পরে অভিনয় করিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিখুঁত ও জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থাপনে সাদা চোখে ধরা দিতে দিতে দেয় না – এটাই আসলে ‘মাইটি টাইম’ নৈতিক না অনৈতিক উপস্থাপন, সে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আর্কাইভাল ফুটেজের যথাযথ ব্যবহার করা না করা এখনো একটি বিতর্কিত বিষয় এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিতর্ক থামানোর জন্য কোনো নীতিমালা এখন পর্যমত্ম আমাদের নেই। পুনরাভিনয়ের মতো, এই জায়গাটি নিয়ে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি; কোনটা কাজে দেবে, নতুন কাজের কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে মতদ্বৈধতা চলছেই।
এরল মরিসের বিখ্যাত ‘ফ্লাইং মিল্কশেকসে’র ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল দ্য থিন বস্নু লাইন (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে যখন তিনি একজন নিরপেক্ষ লোকের ফাঁসির সাজা হওয়ার ঘটনাটিকে অভিনেতাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি আসল ঘটনাটা না দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো ঘটনাটা তুলে ধরেন, আবার এটাও বলে দেন এদের সকলের কথা সঠিক নাও হতে পারে। ফগ অব ওয়ার (২০০৩) চলচ্চিত্রটিও একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ঠাসা, আমরা এমন একটা কোণ থেকে ঘটনাটা দেখি যা একজনের স্মৃতি থেকে বলা, সেটা নিজের দোষ খ-ানোর ইচ্ছা আছে আবার একই সঙ্গে ফিরে দেখতে চায়; আউড়ে নেয় পূর্ব-প্রতিশ্রম্নতিগুলো। প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণা মরিসের এই ছবিতে একটি বিষয়ভিত্তিক মোটিফ হয়ে ওঠে, যা বারবার ফিরে আসে।
অপউপস্থাপন নানাভাবে হয়, অনেক সময় কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার ‘আসল গল্প পাওয়ার জন্য’ এর অবতারণা ঘটে, যেখানে হয়তো ওই ঘটনা পুরোটাই আরোপিত, যেমনটা হয়েছিল ট্রাইয়াম্ফ অব দ্য উইলের (লেনি রেইফেনস্টল, ১৯৩৫) ক্ষেত্রে। অনেক শট যে অভিনেতাদের নিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়েছে শুধু তা নয় বরং বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নেওয়া ফুটেজ একসঙ্গে জোড়া দিয়ে হিটলারের আগমনের একটি বিরতিহীন শট নিয়ে এক নকল সত্যি তুলে ধরে, যা কি না আবার তৎকালীন সময়ের সমাদৃত একটি ব্যাপার ছিল অথচ এই ন্যুরেমবার্গ র্যালি-র পুরোটার পুনরাভিনয় চলচ্চিত্রের জন্য অপরিহার্য ছিল না।
একটি বিষয় যে কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে, ভুল ব্যাখ্যার কারণে তা অন্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে বলে মনে হতে পারে। যেমন, ওবিডিয়েনসে (স্ট্যানলি মিলগ্রাম, ১৯৬৫) দেখা যায় যে, সেখানের স্বেচ্ছাসেবীরা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণে অংশ নেয়, যেখানে তারা অপরের ওপর প্রবল বৈদ্যুতিক শক দ্বারা মানুষের শেখার দক্ষতা পরীক্ষা করে বলে মনে করলেও, তারা নিজেরাই পরীক্ষিত হচ্ছিল তারা কীভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ বহন করে এই বৈদ্যুতিক শক পরিচালনা করছিল তার ওপর, যদিও ‘শিক্ষানবিশ’রা ব্যথা অনুভব করছিল, এমনকি মৃত্যুও বরণ করছিল। এটি এমন একটি পরীক্ষা ছিল যেটি সম্মতি নিয়ে করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু এই বৃহৎ ভুল চিত্রটি সাধারণ মানুষের শাসককে মেনে চলার আকাঙক্ষাকে সমর্থন করছে।
এসব ভুল উপস্থাপন কোনোকালেই খোলাখুলিভাবে প্রকাশিত হয় না। ‘বিলম্বিত উদ্ঘাটন’ বলতে আমরা যা বুঝি তা থেকে এটি ভিন্ন কিছু বোঝায়, যেখানে চিত্রনির্মাতা চূড়ামত্মভাবে পূর্ববর্তী বিবরণ প্রকাশ করে। ভ্রামত্ম ও ব্যঙ্গাত্মক প্রামাণ্যচিত্রে এ ধরনের চর্চা আমরা দেখতে পাই, যেমন নো লাইস (মিচেল বস্নক, ১৯৭৩), ডেভিড হোল্জম্যান্স ডাইরি (জিম ম্যাকব্রাইড এবং এল এম কিট কার্সন, ১৯৬৮) এবং ফরগটেন সিলভার (কোস্টা বোটস ও পিটার জ্যাকসন, ১৯৯৬)। এই চলচ্চিত্রগুলো শেষে হলেও তাদের ধূর্ততা স্বীকার করে নেয়, যাতে দর্শকের সত্য উদ্ঘাটন চরমভাবে প্রতারিত হওয়ার প্রশ্ন না তোলে। এ ধরনের কোনোকিছু প্রকাশ একটি নির্মিত চলচ্চিত্রের ব্যর্থতা, যা কি না মাইটি টাইমস : ভলিউম ২ শীর্ষক চলচ্চিত্রটিকে একটি নৈতিক বিতর্কে পরিণত করেছে।
এ ধরনের বিলম্বিত প্রকাশ ওবিডিয়েনসেও অমত্মর্ভুক্ত, কিন্তু অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হয়। পরীক্ষার বস্ত্তকে বৈদ্যুতিক শক দিতে থাকার পর যে অভিনেতারা গবেষক হিসেবে অভিনয় করেছেন তারা বললেন, ‘এই পরীক্ষণটি চায় যে তুমি তা চালিয়ে যাও’, এবং তা শেষ করে যখন পরীক্ষাধীন বিষয়গুলো তা চালিয়ে যেতে প্রত্যাখ্যান করল অথবা শকটি তার সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। এরপর পরীক্ষাধীনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। সমসাময়িক মানদ– এই উপস্থাপন পরিষ্কারভাবে অনৈতিক।
চলচ্চিত্রের বিষয়কে এখন একটি সম্ভাব্য বেদনার দায়/ভয় ও মোটা দাগের ধান্দাবাজি অভিজ্ঞতার সঙ্গে একটি পাবলিক রেকর্ড সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে – চলচ্চিত্রের ঘটনাবলি, তা সে ভালোই বয়ে আনুক কী খারাপ। দর্শক এই বিলম্বিত উদ্ঘাটনের একটি সুবিধা পেলেও পেতে পারে কিন্তু বিষয়বস্ত্তর জন্য এই ভ্রামিত্মর বিলম্বিত প্রকাশ তার নৈতিকতার দিকটি এত সহজে মিটে যায় না। ফিল্মের আওতাধীন ও তার দর্শক উভয়েই অনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে নাকি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
উপসংহার
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরির নীতিমালা একটি দৃঢ় থাই/ভিত পায় যখন এটি চলচ্চিত্রের বিষয় ও দর্শক – উভয়েরই মর্যাদা ও মৌলিকত্বে একইভাবে গুরুত্ব দেওয়ার দিকে আলোকপাত করে এবং সেই সঙ্গে শক্তির জন্য সংগ্রাম এবং সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা নিয়ে যারা কাজ করে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করাও একটি আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই ভিত কোনো ‘এটা করো/ওটা করো’ জাতীয় মতবাদ প্রস্ত্তত করে না বরং এটা মেনে নেয় যে, নীতিমালাকে নানান প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজেই, প্রণীত ইতিহাসের সূত্র ধরেই একটা পোক্ত অবস্থানে যেতে হবে। কখন কী করতে হবে – এই প্রশ্নের উত্তর একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একটি বিশেষ মুহূর্তে তৈরি হবে, আর তা তৈরিতে কিছু সাধারণ নির্দেশাবলি থাকবে মাত্র, কোনো চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম নয়। শিল্প মাত্রই নিয়ম ভেঙে চলার স্বপ্ন দেখায়, নিয়মের বাঁধনে তাই উষ্মা বাড়ে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের নীতিমালাও সে পথেই হাঁটবে।
উদার ও খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপযোগী একটি নীতিমালা – যা সময় ও জায়গা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে, তা প্রদত্ত চলচ্চিত্রের নৈতিক মান বিচারের সম্পূর্ণ ভার নির্মাতা-পরিবেশক-প্রদর্শক-সমালোচক-গবেষক-দর্শক – যাঁরা প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের গঠন ও বিসত্মার নিয়ে ভাবেন তাঁদের ওপর অর্পণ করে; স্টুডিও ব্যপস্থাপক বা মোশন পিকচার অ্যাকাডেমি নয়। বরং ওই গোষ্ঠীর মাঝেই আসলে এই ক্রমবর্ধমান ধারালো বিতর্কের পরে একটা নৈতিক মানদ–র প্রণয়ন সম্ভব। এখান থেকে প্রসত্মাবিত নীতিমালাই আমাদের একটা সরু বাঁক পেরিয়ে গমত্মব্যে পৌঁছে দেবে।