পি য়া স ম জি দ
বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজ কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৭৫ সালে রচনা করেন ‘খোঁয়ারি’ শীর্ষক গল্প। নামগল্প ‘খোঁয়ারি’ ও আরো কয়েকটি গল্প-সমবায়ে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গল্পগ্রন্থ খোঁয়ারি। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ইলিয়াসের কবিবন্ধু রণজিৎ পাল চৌধুরীকে। উৎসর্গের এই তথ্য এখানে উল্লেখ প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, আমাদের আলোচ্য শিবু কুমার শীল-গ্রন্থিত ও পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র ইলিয়াসের খোঁয়ারির কেন্দ্রীয় চরিত্রও কিন্তু এই রণজিৎ পাল চৌধুরী, পুরো নাম রণজিৎ কুমার পাল চৌধুরী। ইলিয়াসের গল্পে সমরজিৎ নামে তিনি আত্মগোপন করে আছেন আর বছর কয়েক হলো এই পৃথিবী থেকে চিরগোপনে চলে গেলেন তিনি।
এই আলোচনায় ইলিয়াসের গল্প ও শিবু কুমার শীলের সমান্তরাল পাঠ অত্যাবশ্যক। দুই অংশে বিভাজিত এই প্রামাণ্যচিত্র – ‘গল্পের আত্মা, কলকব্জা’ এবং ‘অন্যান্য অনুষঙ্গ’। ইলিয়াসের সংক্ষেপিত পরিচিতি দিয়ে এই প্রামাণ্যচিত্রের প্রারম্ভ আর তার পরেই কাহিনির অকুস্থল সমরজিৎ বা রণজিৎ পাল চৌধুরীর বাড়ির দিকে দর্শকের ভ্রমণ শুরুর প্রস্তাবনা হিসেবে আসে পুরনো ঢাকার চকিতচেহারা দর্শন। গণ-নলকূপ থেকে পানি পড়ছে কলসে, দোকানে বিক্রি হচ্ছে মধুর শাহী পান-মাঠা, মানবশিশু ও খরগোশ শাবকের হল্লা, খোলা নর্দমা আর শেফালি ফুলের মালা গাঁথা চলে সমতালে এবং অতঃপর অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর ওপরতলা থেকে জবাব আসে ‘আসি’।
গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর জাতিগত ক্ষয়ের পরিস্থিতি ত্রিকালদর্শী টেরেসিয়াসের মতো আমাদের সামনে জাজ্জ্বল্য করেন – রণজিৎ পাল চৌধুরী কিংবা সমরজিৎ। শ্রোতা-দর্শকের কানে ‘রণপা’র (রণজিৎ পালকে বন্ধুরা ‘রণপা’ নামেই সম্বোধন করতে ভালোবাসতেন) কথা যেমন অব্যর্থ তীরের মতো বিঁধতে থাকে তেমনি নেপথ্যে প্রায় পরিত্যক্ত কুয়া, ইতস্তত বিড়ালের পায়চারি আর এলোমেলো একরাশ বইপত্রের উপস্থিতি এ প্রামাণ্যচিত্রের শরীরকে মুহুর্মুহু জীবন্ত রাখে।
রণজিৎ পাল যখন বলেন, ‘ইতিহাসকে আমরা স্বীকার করি না কিন্তু ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাত মানুষের জীবনে যে কতটা প্রভাব ফেলে, তার একটা প্রমাণ হয়তো আমি’ তখন ১৯৭১-এ জীবন নিয়ে বহিঃশত্র“র আগ্রাসী থাবায় নিজ বাড়ি থেকে পলায়ন আর ১৯৭১-এর পর স্বাধীন স্বদেশে তাকে নিজ বাসভূমে পরবাসী করার যে পাঁয়তারা তার সূত্রও কিছুটা হলে ঠাহর করা যায়।
রণজিৎ পাল নিজে যেমন সে ইতিকথা বিধৃত করেন তেমনি এ-বিষয়ে নানান ব্যাখ্যা-বয়ান নিয়ে এখানে আমরা হাজির হতে দেখি ইলিয়াসের অনুজ অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানকে। খালিকুজ্জামান ইলিয়াস গল্পের রচনাবলি ও পটভূমি বর্ণনার পাশাপাশি মাইনরিটি সমস্যার দিকেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; ঢাকা শহরের উর্দু স্পিকিং ও বাঙালি হিন্দু মাইনরিটির সমস্যার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার চেয়ে তার বর্ণনায় সরস হয়ে ওঠে ষাটের দশকের আড্ডা, যে আড্ডার কথা ‘খোঁয়ারি’ গল্পে খুঁজে পাওয়া যায়। ইলিয়াস-রণজিৎ পাল যে জম্পেশ আড্ডা রেক্সে, বিউটি বোর্ডিংয়ে দিতেন আর নেশারু কণ্ঠে কখনো আবৃত্তি করে উঠতেন উর্দু গান বা কবিতার কলি। আবদুল মান্নান সৈয়দ যোগ করেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ব্যাখ্যা – ‘সব দেশেই সংখ্যালঘু সমস্যা আছে। আমি নিজেও সে সমস্যার জাতক। আমি সংখ্যালঘু হিসেবে একটি দেশ থেকে বিতাড়িত। যে এখনো এ সমস্যার জের ধরে যাতনা সহ্য করছে সে হচ্ছে রণজিৎ পাল চৌধুরী।’ আর রণজিৎ পালের চেয়ে ‘খোঁয়ারি’ গল্পের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মনোযোগ দেন শাহাদুজ্জামান – ‘মাইনরিটি এক্সপ্লয়টেশনের
সোশিও-পলিটিক্যাল অ্যানালাইসিস হতে পারে। তবে শিল্পীর কাজ একটু ভিন্ন। ‘খোঁয়ারি’ গল্পে ইলিয়াস যে শিল্পদক্ষতায় সংখ্যালঘু সংকটের রূপায়ণ করেছেন তা সমাজতাত্ত্বিকের কাজ নয়, সাহিত্যের কাজ।’
এই সব অতিথি-কথকের ফাঁকে ফাঁকে মন্দিরার মৃদু তালে একজন রণজিৎ পাল চৌধুরীর সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখে উঠি বিউটি বোর্ডিং। রণপার স্মৃতিচর্যায় আর বিউটি বোর্ডিংয়ের দৃশ্যায়নে আমাদের মানসপটে একে একে স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় শহীদ কাদরী-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-বিপ্লব দাশ-মুশররফ রসুল বুড়ো ভাই-নবাবপুর রোড এবং পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ষাটের দশক।
হারমোনিয়ামের ধ্বনিরণনে রণজিৎ পাল চৌধুরী আয়েশ করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ১৯৭১-এ পাকবাহিনী দ্বারা তাঁর বাড়ি লুটপাটের বর্ণনা দেন নির্বিকার-নিরাসক্ত ভঙ্গিতে। বলেন তাঁর বৃদ্ধ ঠাকুমা, বাবা অমৃতলাল আর ছোট বোনের কথা। এই সব একান্ত স্বজনের চেয়েও তাঁর কথ্যচালে বড় হয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশের রিক্ত দশা। ’৭১-এ ও ’৭১-এর পর তো রণজিৎ পালদের মতো কারো কারো বাড়ি লুট কিংবা দখল হয়েছে, কিন্তু রণজিৎ পালের ভাষ্যেই আমরা পাই সে রূঢ় সত্য যে এতবড় একটা মুক্তিযুদ্ধও গণমানুষকে কোনো স্বস্তি দিতে পারল না। আর তিনি আদর্শবাদী সমাজের ক্ষয়িষ্ণু প্রতিনিধিদের একজন, অর্থকড়ির ব্যাপারে যিনি এই দেশে ‘কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেননি’। তাই জীবনে তাঁর সাফল্যের মধুর হাসি নেই। আছে শুধু ব্যর্থতার অবসাদ। আর থাকার মধ্যে শুধু আছে এক মাধবীলতার ঝাড়।
ইলিয়াসের গল্পে পাই – ‘…এই মেঘ ছিঁড়ে উড়ে চলে যায় এবং সমরজিৎ দ্যাখে, গেটের মাধবীলতার ঝাড় ও বারান্দায় হৃষ্টপুষ্ট থাম পর্যন্ত স্থলকেলি করে বেড়াচ্ছে অমৃতলাল।’ শিবু কুমার শীলের বর্ণনায় এই দৃশ্য আরো গভীর অর্থদ্যোতক ব্যঞ্জনা পায়। এভাবে ‘মাধবীলতার ফিকে সুবাসের সঙ্গে কাঁঠালিচাপা ফুলের ঘন গন্ধ জীবজন্তুর করোটিতে হঠাৎ ঢুকে মগজের সাজগোজ এলোমেলো করে দেয়’ আর অমৃতলাল-পুত্র সমরজিৎ ওরফে রণজিৎ পাল চৌধুরী বলেন – ‘এই মাধবীলতা থাইক্যা যা একটু সুবাস-উবাস আসে আর কি!’ আর আমরা বলি মাধবীলতার এই ঘ্রাণ আসলে বিলীয়মান সময়ের অস্তমিত শোভারই শেষ স্মারকচিহ্ন।
পরিচালক-নির্মাতা বলেন – ‘দোতলা, ছাদ, ছাদের এক পাশে চিলেকোঠা নড়বড় করতে করতে শখানেক বছর দিব্যি চালিয়ে দিলো’ কিন্তু ধারাবর্ণনায় অধিক মূর্ত হয় ক্রমশ ভেঙে পড়া রণজিৎ পালের বাড়ি। শ্যাওলা জমে ওঠে এর সমুদয় প্রাচীরের গায়ে। এ তো পুরনো আমলের একটি স্থাপত্য বা ব্যক্তির বাসগৃহের ভাঙনদশা নয়, এটা এই নষ্ট-পতিত সময়েরই প্রকৃত মুখচ্ছদ, যেখানে সৃষ্টি নেই, শুধু ভাঙনের শব্দ শোনা যায় অবিরত।
এই প্রামাণ্যচিত্রে রণপার ভ্রাতুষ্পুত্র সুব্রত পাল চৌধুরী প্রজন্মের উত্তরাধিকার হিসেবে বলেন, ‘ইলিয়াসের গল্পের মধ্য দিয়ে এই বাড়ি বেঁচে রইবে আর তাই বাড়ির একজন বাসিন্দা হিসেবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’
কিন্তু ভাগ্য যার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে নির্বিশেষে প্রতারণা করে তিনি কিন্তু তাঁর মৃত্যুকেও ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে ছিলেন নারাজ। নিজ দেহ মেডিক্যালে দিয়ে যেতে চেয়েছেন যেন তাঁর মরদেহ নিয়ে কাউকে ভোগান্তি পোহাতে না হয়। ‘একদিন চইলা যাইব আর কি’ – এমন সরলোক্তির সমান্তরাল যখন তাঁর কণ্ঠে ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যামসম’র পাঠ শুনি তখন ইলিয়াসের গল্পে চোখ ফেরাতে বাধ্য হই এবং বুঝি সমরজিতের জবানিতে যেন তিনি বলেন – ‘খোঁয়ারির মধ্যে রাত কাটে, সারা সকাল জুইড়া খালি খোঁয়ারি’। এই খোঁয়ারি শুধু কি রণজিৎ পাল বা সমরজিতের? না, এ তো সমসময়, সমাজ ও পরিপার্শ্বের গায়ে লেপ্টে থাকা খোঁয়ারি ‘সমরজিতের শরীরের রক্ত উজানে উঠে বসে তার করোটির ছাদে, ছাদের বিমে এবং মেঘ হয়ে কিছুক্ষণ থমকে থেকে অবশেষে বৃষ্টিপাত শুরু করে। এই বৃষ্টির উৎস করোটির মেঘ, করোটির মেঘের উৎস তার শরীরের রক্ত। সুতরাং বর্ষণের রংও লাল, অবিরাম লাল বৃষ্টিপাত চোখের সামনে একটি সীমাহীন জলপর্দা টাঙিয়ে দেয়। পর্দায় দ্যাখা যায়, হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে সমরজিৎও পালিয়ে যাচ্ছে।’ যে লাল বৃষ্টিপাতের তোড়ে সমরজিতের এই পলায়ন, যে পলায়ন জন্ম দেয় অন্তহীন হ্যাংওভার কিংবা খোঁয়ারির সে বিমানবিক বৃষ্টিপাতের উৎস এখনো বন্ধ হয়নি। ‘খোঁয়ারি’র প্রাসঙ্গিকতা তাই ফুরোয় না।
ইলিয়াসের খোঁয়ারির গ্রন্থনা, পরিচালনা ও নেপথ্যকণ্ঠ শিবু কুমার শীলের। চিত্রগ্রহণ – আশরাফুল রানার। সংগীত – আহমেদ শাকিল হাশমী (এস্রাজ, হারমোনিয়াম), সৌরভ সরকার (বাঁশি), শিবু কুমার শীল (মন্দিরা), সম্পাদনা – সৈকত খন্দকার। এটি ক্যালাইডোস্কপের প্রথম প্রযোজনা।
রণজিৎ পালের কণ্ঠে ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ বা ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকের…’র শান্তসৌম্য-প্রেমবিরহদীপ্ত গানের ঝংকার বুঝিবা বলে জীবনকে সুরময় করতে খোঁয়ারিটা এবার না ভাঙলেই নয়।
জয়তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। অমর হোক রণজিৎ পাল চৌধুরীর স্মৃতি। ধন্যবাদ শিবু কুমার শীল।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011