রা ফি উ ল ই স লা ম
জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২) দেশ-কাল ও সমাজ-সচেতন একজন গল্পকার-ঔপন্যাসিক, সৃজনশীল লেখক, প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার। তবে একজন প্রাতিস্বিক চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিত। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগ-পরবর্তী ভাষা-আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে পূর্ব বাংলা আন্দোলিত হয়। নতুন আশা-আকাক্সক্ষা, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দোলাচলে এ ভূখণ্ডের মানুষের স্বতন্ত্র চারিত্র্য বিকশিত হয়। জহির রায়হান স্বাধীনতাকামী এই ভূখণ্ডের মানুষের চলচ্চিত্র-আইকন, পথ-প্রদর্শক পথিক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-শিল্পের জন্য তিনি দেখিয়ে গেছেন শিল্পোত্তীর্ণ হবার অনেক পথ। ষাটের দশকে ‘এফডিসি’ প্রতিষ্ঠার সেই প্রথম লগ্নে মেধাবী-কর্ষণে সৃষ্টি করে গেছেন বেশ কয়েকটি সার্থক চলচ্চিত্র।
জহির রায়হানের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ, জন্ম অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট; বর্তমান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে, এক সম্ভ্রান্ত ও রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তাঁর অগ্রজ শহীদ সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১)। পিতা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। ফলে জহির রায়হানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ এবং বেড়ে ওঠা কলকাতায়। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর তিনি ফেনীর গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। এখানে ‘আমিরাবাদ হাই স্কুল’ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকার ‘জগন্নাথ কলেজ’ থেকে আইএসসি পাস করে কিছুদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু মেডিক্যাল অধ্যয়ন বাদ দিয়ে তিনি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অনার্সসহ বিএ ডিগ্রি (১৯৫৮) অর্জন করেন। তরুণ বয়সেই জহির রায়হান বামপন্থী রাজনীতি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তৎকালীন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির গোপন চিঠিপত্র আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি সাংকেতিক ‘রায়হান’ নামে পরিচিত হন। এ থেকেই তাঁর নাম জহিরুল্লাহ থেকে জহির রায়হানে পরিবর্তিত হয়। জহির রায়হান বায়ান্নর
ভাষা-আন্দোলনসহ সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫২-র ২১ ফেব্র“য়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলকারী প্রথম দশজন ছাত্রের একজন ছিলেন তিনি। এজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়। জহির রায়হান ছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, প্রগতিশীল মানবতাবাদী ও সংগ্রামী রাজনৈতিক চৈতন্যের ঝাণ্ডাবাহক। এ সংগ্রামী চৈতন্য ও মানবতাবাদী দর্শন তাঁর সমস্ত শিল্প-সাহিত্য তথা চলচ্চিত্রে অভিব্যক্ত। চলচ্চিত্র-শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ১৯৫২ সালে ফটোগ্রাফি শেখার মানসে কলকাতার ‘প্রমথেশ বড়–য়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফি’ স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৭ সালে লাহোরের পরিচালক এ জে কারদারের উর্দু ছবি জাগো হুয়া সাবেরা (উধু ঝযধষষ উধহি) চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এ ধারাবাহিকতায় তিনি যে নদী মরু পথে (পরিচালক – সালাউদ্দিন) ও এ দেশ তোমার আমার (পরিচালক – এহতেশাম) চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবে কাজ করে চলচ্চিত্র-পরিচালনার পাঠ নেন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে জহির রায়হানের স্বতন্ত্র মেধার পরিচয় পাওয়া তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি কখনো আসেনিতেই (১৯৬১)। এরপর পুরো ষাটের দশক চলচ্চিত্র রচনা-পরিচালনা ও প্রযোজনার মাধ্যমে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকেন এ শিল্পের সঙ্গে। একে একে তৈরি করেন সোনার কাজল (১৯৬২, কলিম শরাফীর সঙ্গে যৌথ পরিচালনা), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪, উর্দু, পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র), বাহানা (১৯৬৫, উর্দু, সিনেমাস্কোপ), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৬), দুই ভাই (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯), লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত, ১৯৭০), স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) প্রভৃতি চলচ্চিত্র। একুশে ফে ব্রুয়ারী নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পদক্ষেপও তিনি নিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল, জীবন থেকে নেয়া ও স্টপ জেনোসাইড ছবির জন্য জহির রায়হান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অমর হয়ে আছেন। সোনার কাজল, সঙ্গম, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা, দুই ভাই প্রভৃতি ছবি মূলত বাণিজ্যিক। চলচ্চিত্রের শিল্পময়তা বা কমিটমেন্ট এ চলচ্চিত্রগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা উদ্দিষ্ট নয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের (১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ নিখোঁজ) খোঁজে মিরপুর যান জহির রায়হান। সেখান থেকে আর ফেরেননি এই মহৎ শিল্পী।
কখনো আসেনি (১৯৬১)
কখনো আসেনি জহির রায়হান রচিত ও পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। মাত্র ছাব্বিশ বছর-বয়সী পরিচালকের সার্থক ও সাহসী নিরীক্ষা। সে সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে কখনো আসেনির কাহিনি-চিত্রনাট্য, বিষয়-বক্তব্য সর্বোপরি চলচ্চিত্র-রূপায়ণ অভিনব। এ চলচ্চিত্রে জহির রায়হান শিল্প ও শিল্পী সম্পর্কিত তাঁর বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজেছেন, উত্তর দিয়েছেন, শিল্প-ভাবনার সমীকরণ টেনেছেন। শিল্প বা সৌন্দর্যের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক, নৈকট্য বা দূরত্ব কতটুকু? মানুষের জীবনের সার্থকতা কোথায় – স্থির নি ষ্প্রাণ শিল্পত্বে?
নাকি সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নামাখা জীবনের স্পন্দনে? সমাজ-জীবন, স্বজন বা ভালোবাসার প্রতি শিল্পীর দায় কতটুকু? জীবনের খরতাপে, বিরূপ সময়ে শিল্প বা শিল্পীর রূপ কী ও কেমন? ছবির শুরুতে রহস্যময় পরাবাস্তব আবহে একটি বাড়িতে মৃত দুবোন ও তাদের মৃত ভাইকে আমরা দেখি। শিল্পী-ভাইয়ের আঁকা ‘শায়িত দু’বোন’ ও ‘একজন রহস্যময় নারী’র পোর্ট্রটে দেখি। জানতে পারি তাদের মৃত্যুর রহস্য কেউ খুঁজে পায়নি এবং এ ঘটনার কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল নেই। কালের আবর্তনে দোতলা এ বাড়িতে বসত করতে আসে, একই রকম আর একটি পরিবার। দুবোন, শিল্পী ভাই শওকত আর তাদের বাবা। রাতে একটি নারীকণ্ঠের রহস্যময় কান্না শুনতে পায় ওরা। তাদের সামনের বাড়িতে থাকে একজন রহস্যময় মানুষ সুলতান। শিল্পকর্মের সংগ্রাহক। পৃথিবীর বহুদেশে ঘুরে, নৈতিক বা অনৈতিকভাবে তিনি সংগ্রহ করেছেন মূল্যবান অনেক শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য। ‘শিল্পকে জিইয়ে রাখতে’ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন মিউজিয়াম। তার এ মিউজিয়ামের অনবদ্য সংগ্রহ – মাত্র পঞ্চাশ টাকায়, অল্পবয়সে কেনা, বর্তমানে পূর্ণযৌবনা অপূর্ব সুন্দরী এক নারী মরিয়ম বা মেরি। তাকে মিউজিয়ামেরই অপূর্ব সংগ্রহ একটি ভাস্কর্য বিবেচনা করে মানব-বিদ্বেষী সুলতান। মানুষের স্পর্শ-সঙ্গ-সংসর্গ থেকে মেরিকে মুক্ত রাখতে চায় সুলতান। নিজেও থাকে দূরে। কিন্তু রক্তে-মাংসে গড়া মেরির রয়েছে জীবনের প্রতি ভালোবাসা। তার এই সুপ্ত জীবনাকাক্সক্ষা-ভালোবাসা শিল্পী শওকতের সঙ্গে পরিচয় ও নৈক্যটের সঙ্গে নিজ মূর্তিপম আদল ভেঙে স্পন্দমান হয়। তাদের প্রেম গভীরতর হয়। কিন্তু মেরির এই প্রেমে নিমগ্ন হওয়াকে, ‘ব্যর্থ’, ‘কদর্য’, ‘মাটি’ হয়ে যাওয়া মনে করে সুলতান। ‘ফুলের গায়ে হাত দিলে তার পাপড়িগুলো ঝরে যায়’; তাই সে চায় ‘সুন্দর চিরকাল স্থির হয়ে থাকবে, মানুষের হাতে সে ধরা দেবে না, মানুষের ছোঁয়ায় সে নড়বে না, কাঁপবে না’। তাই মেরির প্রেমে সর্বৈব বাধা দেয় সুলতান। পাশাপাশি, বাবার আকস্মিক চাকরিচ্যুতি ও মৃত্যুর পর অর্থকষ্টে রূঢ় জীবন-বাস্তবতার মুখোমুখি হয় শওকত। কোথাও চাকরি খুঁজে পায় না সে। করতে পারে না প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান। একদিকে দুবোনের দায়িত্ব অন্যদিকে মেরির ভালোবাসা। সুলতানের মিউজিয়াম থেকে মুক্ত হয়ে শওকতের সঙ্গে দূরে কোথাও যেতে চায় মেরি। এই দ্বৈরথে দিশেহারা বিভ্রান্ত শওকত একসময় দুবোনকে – ‘তোমরা মরলে আমি বাঁচি’ উক্তি করে, তাদের নিজেদের পথ খুঁজে নিতে বলে। মেরিকে নিয়ে অন্য কোথাও যাবার প্রস্তুতি নেয় শওকত। দুবোন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ খুঁজে নেয়। অর্থ জোগাড় করতে না পেরে শওকত ফিরে আসে। নিজেও বিষপানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মৃত্যুর আগে এঁকে যায় শায়িত দুবোনের ছবি। হঠাৎ দেখতে পায়, অন্য এক শিল্পী, তার আঁকা ছবিতে তুলির প্রলেপ দিচ্ছে, একই ছবি আঁকছে। শওকত মারা যায়। কালের চাকা ঘোরে। আবার সে-বাড়িতে বসত করতে আসে অন্য একটি পরিবার। কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের কাহিনি, বিভিন্ন উপকাহিনি, বিভিন্ন দৃশ্য-ঘটনা, পাত্র-পাত্রী বা চরিত্রের ক্রমবিকাশ ও পরিণতির মধ্যে পরিচালক অনেক প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা বা রহস্য সংস্থাপন করেছেন। দর্শককে বিভিন্ন মীমাংসার অংশীদার করেছেন। একেবারে শুরুতে প্রথম পরিবারের মৃত দুবোন ও ভাইয়ের মৃত্যুরহস্য উন্মোচনের জন্যই কি দ্বিতীয় পরিবারের কাহিনি? নাকি দ্বিতীয় পরিবার স্থিরীকৃত নিয়তি বা ‘নেমেসিসে’র অনুসরণ করেছে। কাহিনির শেষে মানবী-ভাস্কর্য মেরির প্রশ্ন – শওকতকে ভালোবেসে কী পেল? তাহলে মানুষের স্পর্শ-সঙ্গ-সংসর্গ মুক্ত সুলতানের মিউজিয়ামই কি মেরির নিয়তি? এই দ্বিমুখী বাস্তবতার জন্যই কি রহস্যময় কান্না? রূঢ় বাস্তবতার মাঝে শিল্প বা শিল্পীর অস্তিত্বই বা কোথায়?
জহির রায়হান কখনো আসেনির চলচ্চিত্রায়ণেও অনেক সার্থক। ছবির চিত্রগ্রহণ, বিভিন্ন দৃশ্যের লাইটিং বা আলোক-পরিকল্পনা বিষয়-বক্তব্যের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ। ছবিতে সংগীত অনেক শক্তিশালী। বিভিন্ন দৃশ্য, ঘটনা, বক্তব্য খণ্ড খণ্ড সংলাপের আবেগ ও বক্তব্য প্রকাশে বিভিন্ন যন্ত্রসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে। জীবনের চলমানতা চাকার মোটিফে বেশ কবার ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীমূর্তি নাটকীয়ভাবে দেখিয়ে, মানুষের অন্তঃস্বরূপ প্রকাশিত। এ ছবিতে ছবির কাহিনি-সংলাপ বা বিভিন্ন দৃশ্য ও ঘটনায় ‘আয়রণি’র ব্যবহার জহির রায়হানের প্রিয়। প্রথম পরিচয়ে সুলতান সম্পর্কে শওকতের ধারণা হয়েছিল – ‘এমনও অনেক লোক পৃথিবীতে আছে, যারা শিল্পের মর্যাদা দিতে জানে, সেই সঙ্গে শিল্পীরও’। এ ধারণার বিপরীত সত্য আমরা দেখি চলচ্চিত্রে। শওকতের যে-বোনটি মায়ের অবর্তমানে সংসার চালায়, যে প্রায়শই সন্তানের মুখ কল্পনা করে, তার নিয়তিতে বিয়ে বা সংসার হয় না। যে শওকত ‘সব কিছু ভাই ভুলে গিয়ে একটু হাসো’ গান গায়, সে কিন্তু সবকিছু ভুলে একটু হাসতে পারেনি। তবে এ ছবির কাহিনি, পাত্র-পাত্রী, দৃশ্যায়ন সমকালীন রাজনীতি এবং দেশ-কাল বিচ্ছিন্ন।
কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩)
দুই ভাই, তাদের মা ও সন্তান-সন্ততির এক নিম্নবিত্ত যৌথ পরিবারে আশ্রিত ভাগ্নি হাসিনার সঙ্গে তার এক মামাতো ভাই জামালের প্রেমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কাঁচের দেয়ালের কাহিনি। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর এ মামা বাড়িতেই বড় হয় হাসিনা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর হাসিনার বাবা হামিদ আলী একটু উদ্ভ্রান্ত বৈরাগী স্বভাবের; একাকী অন্যত্র বাস করেন। লটারিতে অনেক টাকা জেতার আশায় একের পর এক টিকিট কেনা তার নেশা। মামাতো ভাই জামালের সঙ্গে হাসিনার প্রেম, প্রেমের লুকোচুরি, চিঠি-বিনিময়, প্রেমের কষ্ট ও আনন্দের অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনি বিকশিত হয়। একসময় এ বিষয়টি জানাজানি ও প্রকাশিত হয়ে যায়। নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হতে হয় হাসিনাকে। ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হয় স্বল্পবাক হাসিনা। কিন্তু এ বিষয়ে প্রেমিক জামালের থেকে কোনো সমর্থন মেলেনি তার। বাবা-মা জামালের অন্যত্র বিয়ের আয়োজন করে। এ বাড়িতে হাসিনার একমাত্র মানসিক-সঙ্গী সিনেমা-পাগল আর এক মামা (মামার শ্যালক) ইউসুফ জামান। একসময় হাসিনার বাবা হামিদ আলীর হঠাৎ মৃত্যু এবং লটারিতে এক লাখ টাকা প্রাপ্তির মিথ্যে সংবাদ আসে। হঠাৎ করে কদর বেড়ে যায় হাসিনার। টাকার লোভে দুই মামা-মামি কলহে লিপ্ত হন – নিজ নিজ পুত্রের সঙ্গে হাসিনার বিয়ের জন্য। বাড়িতে পার্টিশন ওঠে; দুই ভাইয়ের কথা বন্ধ হয়ে যায়। পারিবারিক সংকটে নানিও হাসিনাকে রূঢ় কথা বলেন। বাবার মৃত্যুর খবর জেনে যায় হাসিনা। উদ্ভূত বিরূপ পরিবেশে নীরবে একাকী বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় হাসিনা। শেষ মুহূর্তে সংকীর্ণ গৃহ থেকে উন্মুক্ত পৃথিবীর সীমানায় হাসিনার সহযাত্রী হয় মামা ইউসুফ জামান ।
কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রটির বিষয়-বক্তব্য – মানুষের অহেতুক সংকীর্ণতা-ক্ষুদ্রত্ব-দীনতা। ভঙ্গুর এ কাঁচের দেয়াল খুব সহজেই ভেঙে মানুষ ক্ষুদ্রত্বের আবেষ্টনী থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে। কাঁচের দেয়াল অর্থ স্বচ্ছ দেয়াল; যে দেয়াল ভেদ করে দেখা যায়, অনুভব ও অনুধাবন করা যায়। কিন্তু যে দেয়াল পার হওয়া যায় না বা কোনো কোনো মানুষ পেরোয় না বা পেরোতে গেলে ভাঙতে হয়। হাসিনার প্রেমকে ধারণ করেও জামাল পারেনি কাঁচের দেয়াল ভেঙে অস্তিত্বমান বা মহত্ত্বে উত্তীর্ণ হতে। পারেনি এ পরিবারের কেউ-ই।
১৯৬৫ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, পরিচালনা-সম্পাদনা-সংলাপ ও শব্দগ্রহণের জন্য পুরস্কৃত হয় কাঁচের দেয়াল। নির্মিতির দিক থেকে কাঁচের দেয়াল অত্যন্ত পরিকল্পিত ও পরিপাটি একটি চলচ্চিত্র। সাদামাটা প্রেমের গল্পেও বক্তব্য প্রকাশের জন্য জহির রায়হান বিভিন্ন চলচ্চিত্র-ভাষা ব্যবহার করেছেন। চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায়, উন্মুক্ত ছাদে বিশাল আকাশ ও প্রকৃতির পটভূমিতে বসে পত্র-পাঠরত হাসিনা। প্রেম-সৌন্দর্য ও উদারতার প্রতীক হাসিনা এভাবেই চিত্রায়িত। সংকীর্ণ-ক্ষুদ্রমনা বাড়ির সদস্যগণ গাদাগাদি করে বাস করা সীমিত-গণ্ডির বাড়ির ভেতর চিত্রায়িত ও প্রতীকায়িত। এ চলচ্চিত্রে জহির রায়হান ব্যতিক্রমী ও বিচিত্র (un-usual view-point) বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে ছোট বাড়ি এবং এর পাত্র-পাত্রীদের দৃশ্যধারণ করেছেন। সে-অনুসারে দৃশ্যমালা বিন্যস্ত ও সম্পাদনা করেছেন। কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রে জহির রায়হান বিভিন্ন দৃশ্যের আলো-ছায়া বিষয়ে অনেক সৃষ্টিশীল নিরীক্ষা করেছেন। আলোক-পরিমিতির বিভিন্ন ‘গ্রেডেশন’, ছায়ার বর্ণবৈষম্যর (Tone) মাধ্যমে তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয় ও চরিত্রকে প্রোজ্জল করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধকার বা আলোহীনতার বিপরীতে কাক্সিক্ষত দৃশ্য বা দৃশ্যের অংশকে আলোকিত করেছেন। তাঁর সৃজনশীল আলোক-পরিকল্পনায় পাত্র-পাত্রীর মনস্তত্ত্ব, আবেগ-অনুভূতি, না-বলা কথা অভিব্যক্ত হয়েছে। কাহিনির নাটকীয়তাও এতে করে ক্রমবিকশিত হয়েছে। সর্বোপরি আমরা একটি চলচ্চিত্রপম নান্দনিক ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ পর্যবেক্ষণ করেছি।
একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদের রক্তস্নাত বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিক জহির রায়হানের কাছে ছিল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস ও আদর্শ। ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘একুশের গল্প’সহ তাঁর বিভিন্ন লেখায় একুশের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ দেখি। একুশে ফেবব্রুয়ারির ঘটনা তথা মহান ভাষা-আন্দোলনের কাহিনি ও চৈতন্য চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন জহির রায়হান। ১৯৬৫ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীরকে তিনি এর চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বও দিয়েছিলেন। শাহরিয়ার কবিরের লেখা জহির রায়হানের ‘২১ ফেবব্রুয়ারী’ রচনার ভূমিকা থেকে জানা যায় – ‘মুর্তজা বশীর জহির রায়হানের মুখে বলা গল্পটির ওপর ভিত্তি করে একুশে ফেব্রুয়ারীর চিত্রনাট্য লেখেন। জহির রায়হান এটি এফডিসি স্টুডিওতে জমা দেন। কিন্তু এ ছবি নির্মাণের অনুমতি তাঁকে দেওয়া হয়নি। কিছুকাল পর এ চিত্রনাট্যটি হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে জহির রায়হানের কাছ থেকে শ্রুতলিখনের মাধ্যমে, শাহরিয়ার কবির একুশে ফেব্রুয়ারীর চিত্রকাহিনি গ্রন্থনা করেন। একুশে ফেব্রুয়ারীর এই চিত্রকাহিনি প্রথম প্রকাশিত হয় সমীপেষু পত্রিকায়। এ চিত্রকাহিনিতে দেখা যায়, কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ও আবেগ-মিশ্রিত হয়ে ছাত্রদের ভাষা-আন্দোলন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। ভাষা-সংগ্রামে উজ্জ্বল এদেশবাসীর দুর্ভাগ্য জহির রায়হানের মতো দেশপ্রেমিক মেধাবী চলচ্চিত্রকারের পরিচালনায় একুশে ফেব্রুয়ারী চলচ্চিত্র দেখতে না পারা।
জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯)
দেশ-মাটি ও মানুষের প্রতি শিল্পীসুলভ কমিটমেন্ট থেকে সৃজিত হয়েছে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া। এখানেই প্রথম জহির রায়হানের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও অভিপ্রায়ের চলচ্চিত্র রূপায়ণ দেখি। স্বৈরাচারী অপশাসন, সর্বপ্রকার শোষণ-বঞ্চনা তথা পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার প্রতীকী গল্প জীবন থেকে নেয়া। জীবন থেকে নেয়া একেবারে সমকালীন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের একটি চলচ্চিত্র। দেশজুড়ে তখন ইয়াহিয়া খানের সামরিক স্বৈরশাসন। ১৯৬৮-৬৯-এর গণ-আন্দোলনে পূর্ব বাংলা প্রকম্পিত। দেশের সংগ্রামী মানুষ শোষণ-বঞ্চনামুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিষয়টি চলচ্চিত্রের রুপালি ফিতেয়-সেলুলয়েডে অভিব্যক্ত করতে চাইলেন জহির রায়হান। কিন্তু সেই প্রতিকূল সময়ে স্বাধীন ইচ্ছেমতো এ চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ ছিল না। তাই, এমনকি, কাহিনিতেও রূপকের আশ্রয় নিতে হয়েছে জহির রায়হানকে। বড় বোন ও ভগ্নিপতিসমেত দুভাই আনিস ও ফারুকের সংসার। পেশায় উকিল আনিসের রোজগারে এ সংসার চলে। কিন্তু এ পরিবারে দুই ভাই, স্বামী ও চাকর-বাকরদের ওপর একক কর্তৃত্ব-শাসন-শোষণ ওই বড় বোনের। যে-বোন, যে-স্ত্রী ‘একুশে ফেব্রুয়ারি কী জানে না’ এবং যে কি না ‘মিলিটারি মেয়ে’, ‘ডিকটেটরি শাসন চালায় পুরো পরিবারের প্রতি’, যে বলে ‘এ সংসারে গান গাওয়া চলবে না’, যাকে ‘গায়ে মানে না’ কিন্তু যে ‘আপনি মোড়ল’, যে কি না ক্ষমতার ‘চাবিকাঠি হাতে রাখার জন্য যা কিছু করার দরকার’, তাই করতে দ্বিধা করে না, সে তো পাকিস্তানি স্বৈরচারী শাসক আর তার আচরণ পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনা আর নির্যাতনের রূপক। তাই তো তার বিরুদ্ধে ঘরের দেয়ালে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড লাগাতে হয় – ‘একজনের শাসন চলবে না’, ‘গান গাইতে দিতে হবে’। তাই তো চলচ্চিত্রের শেষে তার কারাবাস।
জহির রায়হান ছিলেন বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তাই ভাষা-আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রভাতফেরি, শহীদ মিনার ছিল তাঁর কাছে অফুরন্ত শক্তি ও প্রেরণার উৎস। জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের শুরুতেই তাই দেখি রাজনৈতিক-কর্মী ও নেতা আনোয়ার ‘অমর একুশে’ প্ল্যাকার্ড লিখছেন, দুই বোন সাথী-বীথিসহ একুশের প্রভাতফেরিতে গান গাইছেন। ছবির শেষ দৃশ্যেও দেখি শহীদ মিনারে সমবেত সাথী-বীথি, আনিস-ফারুক-মেহরাব ও আনোয়ার ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়। ভবিষ্যৎ শোষণমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণে তাঁদের দোয়া কামনা করেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানসহ প্রভাতফেরির অনন্য দৃশ্যায়ন দেখি আমরা এ চলচ্চিত্রে। কুশীলবদের ঋজু অভিব্যক্তিতে জেলের ভেতরে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির দৃশ্যায়নও অনুপম। জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রীর ক্ষেত্রে আমরা বেশকিছু উত্তরণ-রূপান্তর বা অগ্রসরতা পর্যবেক্ষণ করি। আনোয়ারের সহচর যে ‘মধু’ দেশ ও মাটির প্রতি অধিক ভালোবাসার কারণে আনোয়ারকে ভর্ৎসনা করে, সে মধুই ’৬৯-এর উত্তাল গণ-আন্দোলনে দেশের জন্য প্রাণ দেন। কাঁচের দেয়ালের হাসিনাকে আমরা গৃহ-অভ্যন্তরেই সীমায়িত দেখেছি। কখনো আসেনির দুবোনও তাই। কিন্তু জীবন থেকে নেয়ার দুই বোন সাথী-বীথি একুশের প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সাথী-বীথি ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামে, প্রকৃতির কাছে, মাটির কাছে গিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান গায়। লক্ষণীয় স্বাধীনতার পূর্বে, ১৯৬৯ সালে এ চলচ্চিত্রে গানটি জাতীয় সংগীতের মতো ভক্তিভরে গীত ও ব্যবহৃত হয়। অধুনা এ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র (National Cinema) হিসেবে অভিহিত ও আলোচিত হচ্ছে। এদেশের মানুষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি, এদেশের প্রকৃতি-মাটি, এদেশের রাজনীতি, মানুষের দেশপ্রেম, আন্দোলন-সংগ্রাম-সংরাগ এ চলচ্চিত্রের ক্যানভাসে অঙ্গীকৃত।
লেট দেয়ার বি লাইট (LET THERE BE LIGHT)
লেট দেয়ার বি লাইট জহির রায়হানের অসমাপ্ত একটি চলচ্চিত্র।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সস্কৃতির ভেদাভেদহীন সর্বজনীন মানবতাবাদে উত্তরণ এ চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে যুগে-যুগে, দেশে-দেশে বিভিন্ন স্থানে মানুষ মানুষকে নিগৃহীত করছে, মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, রক্তপাত ঘটাচ্ছে। মানুষের প্রতি মানুষের এই হিংসা-বিদ্বেষ-বর্বরতা-ক্রুরতার অন্ধকার থেকে আলোকিত হবার আকাক্সক্ষা : লেট দেয়ার বি লাইট।
১৯৬৫ সালে জহির রায়হান প্রথম লেট দেয়ার বি লাইট চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। ছবিটি প্রথম ইংরেজিতে এবং পরবর্তীকালে বাংলা, উর্দু, রুশ, জার্মান, স্প্যানিশ ও ফরাসিতে ভাষান্তরের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৭০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। শুটিং এগিয়ে যায় অনেক দূর। কিন্তু ১৯৭১-এর মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় এর কাজ। অসমাপ্ত রয়ে যায় জহির রায়হানের শিল্প-মানসের ‘সারা জীবনের স্বপ্ন’ – লেট দেয়ার বি লাইট। ‘আর কত দিন’ নামে প্রকাশিত এর চিত্রকাহিনিতে আমরা দেখি – বিভিন্ন নগরীতে, নামহীন বিভিন্ন প্রান্তরে ‘নানা বর্ণের নানা বয়সের’ মানুষের দল মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছে। পালাচ্ছে আরেক দল মানুষেরই
বন্য-বর্বরতা, হিংসা-বিদ্বেষের ভয়ে। এই ‘অফুরন্ত মিছিলে’র একজনের মুখে শুনি – ‘ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে হিরোশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বোনটা এক সাদা কুত্তার বাড়িতে বাঁদি ছিল। ওর প্রভু ওকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে হত্যা করেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই, তাকে ফাঁসে ঝুলিয়ে মেরেছে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।’
যুগে-যুগে কালে-কালে বিশ্বব্যাপী এই নিপীড়িত মানুষদেরই অংশ, প্রেমিক যুগল তপু আর ইভা। ‘চতুষ্পদ মানুষগুলো’ ইভার মা-বাবা-ছোটভাইকে হত্যা করেছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, ওরা দুজনেই ছুটছে প্রাণপণে। তপু-ইভা কালের সীমা-পরিসীমা পার হয়ে এক ‘অনন্ত সময়ের সমুদ্রে হারিয়ে’ যায়। সেখানে তারা দেখতে পায় আগের দিন নিহত যিশুখ্রিষ্টের মৃতদেহ। এমনকি ‘চারপাশে অসংখ্য মৃতদেহের মাঝে’ নিজেদের মৃতদেহও খুঁজে পায় তপু-ইভা। বুখেনওয়াল্ডে, অসউইজে, স্টালিনগ্রাডে, ভিয়েতনামে। ‘নিজের মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে’ ইভা-তপু। এই পরাসত্যের জগৎ থেকে আবার প্রাণপণে ছোটে তপু আর ইভা। অসংখ্য নিপীড়িত মানুষের মতো ‘অন্ধকার থেকে আলোতে যেতে চায়’ ওরাও। তাই ‘অনেক অনেক অন্ধকার শেষে’ সহসা নিজেদের সেই অফুরন্ত মিছিলের মাঝখানে আবিষ্কার করল তপু আর ইভা। ‘একটা সীমাহীন সমুদ্রের পাড় ধরে মানুষগুলো এগিয়ে চলেছে সামনে’।
লেট দেয়ার বি লাইটের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়নি। চলচ্চিত্রাকারে মুক্তি পায়নি লেট দেয়ার বি লাইট। কিন্তু এর চিত্রকাহিনিতে কিছু দৃশ্যের বর্ণনা পাই আমরা, যা জহির রায়হানের শৈল্পিক চলচ্চিত্র-প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। তাঁর এই চলচ্চিত্র-ভাষা বিশ্বজনীন – ‘সামনে সীমাহীন সমুদ্র। আর সেই সমুদ্রের সৈকতে, অফুরন্ত ঢেউয়ের পটভূমিকায় একটি ক্রুশ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। ক্রুশের পেছনে লাল টকটকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে’।
‘মৃতদেহগুলোর মাঝখান দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল ইভা আর তপু। কিছুদূর এসে দেখল। একটি মৃত মা মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে। তান স্তন থেকে চুইয়ে পড়া দুধে আর রক্তে মাটি ভিজে গেছে’।
STOP GENOCIDE (১৯৭১)
স্টপ জেনোসাইড জহির রায়হানের সর্বাধিক পরিচিত ও বিখ্যাত চলচ্চিত্রকর্ম। এটি তাঁর প্রথম ডকুমেন্টারি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে গণহত্যা,
লুটপাট-অগ্নিসংযোগ-ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ, গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ, সর্বোপরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্ব-বিবেককে জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে জহির রায়হানের অসাধারণ নির্মাণ এ চলচ্চিত্রটি। বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বিষয়ে এ চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক অভিঘাত সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র-ফ্রন্টেও এটি প্রথম ও সার্থক পদক্ষেপ। স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের কাহিনি-ঘটনাবলি হয়েও, চলচ্চিত্র হিসেবে স্টপ জেনোসাইড নির্দিষ্ট দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন মানবতাবাদ এবং গণহত্যাবিরোধী প্রতিবাদী চলচ্চিত্র হিসেবে ভাস্বর। ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক প্রচারের জন্য ছবিটি ইংরেজি ভাষায় নির্মিত হয়। পরে ১৯৮৮ সালে আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) এর বাংলা ভাষান্তর করেন।
স্টপ জেনোসাইড চলচ্চিত্রটি শুরু হয়েছে ‘স্বাধিকার’ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ভ. ই. লেনিনের একটি বাক্য উদ্ধৃত করে। ‘স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আলাদা হবার অধিকার দাবি’ আর ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ এক নয়। লেনিনের এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শিক ভিত্তির বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। এরপর ‘জাতিসংঘ ঘোষণায়’ সর্বজনীন মানবাধিকার সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আশাবাদের বিপরীতে, ভিয়েতনামের গ্রামে মার্কিনিদের বোমা-নিক্ষেপে নির্বিচারে
নারী-পুরুষ-শিশু হত্যার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। ভিয়েতনামে এই গণহত্যার চেয়ে ভয়াবহ ও ব্যাপকহারে প্রতিদিন বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা করছে ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাই নিজ ঘর-বাড়ি, গৃহ-ভিটা ছেড়ে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় শরণার্থী শিবিরের উদ্দেশে অগণিত মানুষের পথচলা – ‘দিগন্ত বিস্তৃত আধমরা মানুষের চলমান মিছিল’। ‘দেহের শক্তি নিঃশেষ তবু ওদের চলতে হয়’। ‘নৃশংস গণহত্যার ভীতি ছড়িয়ে আছে ওদের চোখে মুখে সারা দেহে’। এই অন্তহীন মিছিলে নব্বই বছরের এক বৃদ্ধাকে দেখি, দু-হাত ও দু-পায়ে ভর করে প্রায় একশ মাইল পথচলা এক বৃদ্ধাকে দেখি, শত-সহস্র-লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশুকে দেখি। ‘যাদের প্রত্যেকেরই পাকিস্তানি বর্বরদের লোমহর্ষক অত্যাচারের কোনো না কোনো কাহিনি বলবার আছে’। ‘এদের এক একটি মুখ যেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আঁকা নির্যাতনের এক একটি ভাস্কর্যকর্ম’। এদের একজন খুলনা থেকে আসা ব্যবসায়ী বাবার মেয়ে, ‘বড় জোর ষোল বছর বয়সের’ এক কিশোরী। ‘কারফিউর সময় হানাদার সৈন্যরা ওদের ঘরে প্রবেশ করে, তারপর এই কিশোরীকে নিচে ফেলে ছয়-ছয় জন হানাদার পশু পালাক্রমে ধর্ষণ করে’। আর ‘চলে যাবার আগে ওর বাবা দুই ভাই আর কাকাকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে’। আমরা দেখি এগারো বছরের আরেক নির্বাক কিশোরীকে। রাজশাহী থেকে আগত আশি বছরের বৃদ্ধ, ফরিদপুরের বিনোদবিহারীর মুখে শুনি ‘লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে’ অসংখ্য মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনি। বাংলাদেশে গণহত্যায় ইয়াহিয়া খান ইতিহাস-কুখ্যাত নাদের শাহ, তৈমুর লং, সুলতান মাহমুদ, মুসোলিনি, হিটলারকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিবেক নীরব কেন? ভিয়েতনাম যুদ্ধে মিলায় গ্রামে গণহত্যার জন্য আদালত আমেরিকান সৈন্য লে. উইলিয়াম কেলিকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছিল। কিন্তু মিলায় গ্রামের মতো এরকম শত শত গ্রামে নির্বিচারে প্রকাশ্যে গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। অথচ মানবাধিকার সংরক্ষণে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ, বিশ্ববিবেক নীরব। তাই এ প্রেক্ষাপটে বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধ। চলচ্চিত্রে আমরা দেখি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। তাদের ঋজু কুচকাওয়াজ। গেরিলা যোদ্ধাদের ক্যাম্প। ক্যাম্প-কমান্ডারের দৃঢ় প্রত্যয় – ‘আমরা তো এই যুদ্ধ চাইনি। আমাদের ওপর এ যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা কেবল চেয়েছিলাম, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও তার সৈন্যরা আমাদের সঙ্গে কুকুর-বেড়ালের মতো ব্যবহার করছে। তাই আমাদের যুদ্ধ করতেই হবে। যুদ্ধ আমরা করবই। বিজয় নিশ্চয়ই ছিনিয়ে আনব।’ যুগে যুগে পৃথিবীব্যাপী অন্যায়-অত্যাচার-গণহত্যার বিরুদ্ধে উজ্জ্বল সংগ্রাম হয়েছে – ফরাসি বিপ্লবে, ফ্রাঙ্কোর স্পেনে, আলজেরিয়া-প্যালেস্টাইনে-দক্ষিণ আফিকা-কঙ্গো-লিবিয়ায়-ভিয়েতনামে। তাই ‘বাঙালি জাতির এই বীর্যবান প্রতিরোধ, কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’। ‘বিশ্বজুড়ে মেহনতি নারী-পুরুষ নিজ ভবিষ্যৎ গড়ার গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত করতে যে-সংগ্রাম নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছে, বাঙালির এ মুক্তিযুদ্ধ তারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। তাই চলচ্চিত্রের দাবি, ‘আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব ও সংহতির স্বার্থে পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে, বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো’।
স্টপ জেনোসাইড প্রামাণ্যচিত্রের চলচ্চিত্র-অভিব্যক্তি গতানুগতিকতা থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে চিত্রধারণসহ সীমিত অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মাঝেও জহির রায়হানের সৃষ্টিশীল মেধায় চলচ্চিত্রটির নির্মাণশৈলী ও আঙ্গিক অভিনব। এ চলচ্চিত্রে তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয়-বক্তব্যকে গতিময় ও তীক্ষè করতে দৃশ্য ও শব্দের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন অনেক মেধাবী প্রকৌশল। তাঁর ধারণ করা বিভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে সম্পাদনা-টেবিলে অনেক স্থিরচিত্র, ফুটেজ ব্যবহার এবং এগুলোতে প্রতীক-মোটিফ-রূপকের কার্যকারণসম্মত প্রয়োগ করে বিশ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এক চলচ্চিত্র-কোলাজ তৈরি করেছেন। তাঁর এ প্রয়াস অনেক আধুনিক এবং নান্দনিক শিল্পমিতির স্বাক্ষর। মুক্তিযুদ্ধের এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার প্রায় প্রতিটি বিষয়ই এ চলচ্চিত্রে এসেছে। এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও বিশ্বজনীন বক্তব্য। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্য ও কাহিনিগুলো, গল্প-কথনরূপ বর্ণনার মাধ্যমে একক-গল্পে জুড়েছেন। তাঁর আত্ম-অংশগ্রহণমূলক বর্ণনার ভাষা যথার্থ সংবেদনশীল শিল্পীসত্তার পরিচয়বাহী। চলচ্চিত্রের শুরুতেই শস্য-শ্যামলা চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য বোঝাতে গ্রামের দুই নারীর ঢেঁকিতে ধান-ভানার দৃশ্য আমরা দেখি। পরে একই দৃশ্যের এলোমেলো তছনছ অবস্থা বুঝিয়ে দেয়, সেখানে – গ্রামবাংলায়, সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কীর্তি। চলমান-টাইপরাইটারে জাতিসংঘ ঘোষণার অনুচ্ছেদ, ভিয়েতনাম যুদ্ধে গণহত্যার বিষয়-লিখন; নাটকীয় ও সংবাদগন্ধী। পরিচালক শরণার্থী শিবিরে ধর্ষিত-কিশোরীর নির্মম কাহিনি-কথনের পর, বেশ কিছু সময় স্ক্রিন সাদা-ফাঁকা রেখেছেন। দর্শকের মনে ঘটনার ইমেজ ও অভিঘাত সৃষ্টি করতে। চলচ্চিত্রে এক বৃদ্ধা, এক বৃদ্ধ, ধর্ষিত কিশোরী, নির্বাক-শিশুসহ বেশকিছু ক্লোজ ও বিগ-ক্লোজ শট আমরা দেখি : ভাস্কর্যপম অভিব্যক্তির এসব শট থেকে তাদের নির্মম জীবনাভিজ্ঞতা আমরা পড়ে নিতে পারি। জহির রায়হান যুদ্ধ-গণহত্যা-অত্যাচার-নির্মমতা ও দানবীয়তা বোঝাতে মোটিফ হিসেবে ট্যাঙ্ক, রাইফেল, কাঁটাতার প্রভৃতি চিত্র বারবার ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে সংঘটিত নির্বিচার গণহত্যার বিপরীতে জাতিসংঘ সনদের ‘গালভরা বুলি’, আর মানবাধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তাকে ব্যঙ্গ করতে পরের দৃশ্যেই একটি শিশুর মূত্রত্যাগের দৃশ্য সংযোজন করেছেন। ছবির শুরুতেই ভ. ই. লেনিনের প্রতিকৃতির সঙ্গে সূচনাসংগীত হিসেবে ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক’ ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া পুরো চলচ্চিত্রে রাইফেল-মেশিনগান-মর্টার, বোমা-বিস্ফোরণের শব্দ, শেয়াল-কুকুর-শকুনের ডাক ‘সাউন্ড এফেক্ট’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের দৃশ্যের সঙ্গে পাখির কলতানের শব্দ শুনি আমরা। পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যার বিপরীতে মুক্তিবাহিনীর সর্বৈব প্রতিরোধ ও সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রতীকায়িত করতে লো-অ্যাঙ্গেলে আকাশের বিপরীতে বন্দুক-রাইফেলের শট নিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্রীয় শক্তি বোঝাতে তাদের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে শট নিয়েছেন। ক্যাম্পে স্বাধীনতা-উন্মুখ গেরিলা-যোদ্ধাদের প্রসারিত হাতে কুচকাওয়াজ দেশ স্বাধীন করতে তাদের দৃঢ় প্রত্যয়কে বাক্সময় করেছে। এভাবে জহির রায়হানের পরিচর্যায় স্টপ জেনোসাইড প্রথাগত তথ্যচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, প্রচারণা বা প্রণোদনামূলক চিত্রের বৃত্ত ভেঙে স্বাধীনতাকামী একটি ভূখণ্ডের গল্পময় আধুনিক ডকুমেন্টারি হয়ে উঠেছে।
৩০ জানুয়ারি ১৯৭২, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে, জহির রাযহানের অন্তর্ধান নিখোঁজ বা প্রয়াণ। ১৯৩৫ থেকে ১৯৭২, মাত্র ছত্রিশ বছর জীবনকাল, একজন শিল্পীর সৃষ্টি ও পরিণতির জন্য অপ্রতুল সময়। কিন্তু এই স্বল্পায়ু জীবনকালেই তাঁর বহুমুখী সৃষ্টিমালা আমরা দেখেছি, সৃষ্টির বিকাশ দেখেছি। চলচ্চিত্রে তাঁর শিল্পীসত্তার একটি আদর্শিক বিবর্তন আমরা পর্যবেক্ষণ করি। কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল প্রভৃতি প্রথম পর্যায়ের চলচ্চিত্রে শিল্প ও জীবনভাবনার বিভিন্ন নিরীক্ষা দেখি। জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্রে দেশ-মাটি ও মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট থেকে রাজনীতি-সংযুক্ত হয়েছেন। দেশ-মাটি ও মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অভিব্যক্ত করেছেন। স্টপ জেনোসাইড স্বদেশ আর মানবতার মুক্তির জন্য তাঁর আত্ম-সংগ্রাম। স্টপ জেনোসাইডে যে বিশ্বজনীন মানবতাবাদ তার প্রকাশ আমরা আগেই দেখেছি লেট দেয়ার বি লাইটে। চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের যে সৃষ্টিশীলতা, সেই দ্যুতির স্বাক্ষর আমরা পাই তাঁর লেখনীতেও। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছয়টি – গল্প সংকলন একটি : সূর্যগ্রহণ এবং পাঁচটি উপন্যাস : শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী ও আর কত দিন। তাঁর হাজার বছর ধরে উপন্যাস ১৯৬৪ সালে আদমজী পুরস্কার পায়। উপন্যাসে অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে তিনি মরণোত্তর ‘বাংলা একাডেমী’ পুরস্কার পান। বাংলাদেশের সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে জহির রায়হান যে সৃষ্টিশীল অবদান রেখে গেছেন তা সতত উজ্জ্বল, ভাস্বর। বাতিঘরের মতো তিনি আমাদের চিরদিন দেখিয়ে যাবেন তাঁর প্রাতিস্বিক আলো।