না সি মু ল খ বি র
ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে ‘পরিবার’ শিরোনাম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিমেন্টে তৈরি একটি মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য। বিভিন্ন প্রকাশনায় ‘কাউ উইথ টু ফিগারস’ নামে পরিচিত এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয় আনুমানিক ১৯৫৮ সালে। ঢাকার ফার্মগেট এলাকার এক ধনী ব্যবসায়ীর বাড়ির বাগানে ভাস্কর্যটি প্রথমে স্থাপন করা হয়। মূলত এটিই বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ধারার প্রাঙ্গণ ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যটির স্রষ্টা নভেরা আহমেদ (জন্ম ১৯৩০), একজন বাঙালি মুসলিম নারী।
পরিবার কিংবা কাউ উইথ টু ফিগারস যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই ভাস্কর্যটি নিঃসন্দেহে কৃষিজীবী গ্রামনির্ভর বাংলাদেশের একটি সার্থক শিল্প রূপায়ণ। একই সঙ্গে সমকালীন ইউরোপীয় ভাইটালিস্ট ধারায় গড়নের সরলীকরণ ও অভ্যন্তরে শূন্যস্থান (Hollow) সৃষ্টি করে এবং এদেশের লোকজ পুতুলের সাদৃশ্য আকার নিয়ে রচনা করা এই ভাস্কর্যটি ‘বিশ্বজনীন’ ও ‘স্থানীয়’ শিল্পভাষার স্বাধীন সমন্বয়েরও একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ।
পেছনের কথা
দক্ষিণ এশীয় সভ্যতার অন্যান্য অংশের মতো বাংলাদেশেও প্রাচীন দৃশ্যশিল্পের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্যের প্রাধান্য ছিল। এদেশে প্রাথমিক-মধ্যযুগে (অষ্টম-দ্বাদশ শতাব্দী) বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ভাস্কর্যের বিখ্যাত পূর্ব-ভারতীয় শৈলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি প্রাচীন আদিবাসী ও লোকায়ত ধারার ভাস্কর্যের বহুমুখী সৃজনও অব্যাহত থাকে। তুর্কি সুলতানি শাসনামলে মসজিদ ও স্থাপত্যগাত্রে অলংকৃত পোড়া ইটের সূক্ষ্ম অলংকরণনির্ভর রিলিফ কর্মের দেখা মেলে। মধ্যযুগের শেষ পর্বে, সুলতানি ও মুঘল শাসনকালে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বঙ্গদেশে দরবারি চিত্রকলা পৃষ্ঠপোষকতা পায়। পাশাপাশি হিন্দু দেবমন্দিরসমূহ অসাধারণ সব মৃৎভাস্কর্য ফলক দ্বারা শোভিত হয়। তবে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু হওয়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সমগ্র ভারতবর্ষের মতো বাংলাদেশ অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় গুরুতর ব্যত্যয় সৃষ্টি করে। তারপরও মৃৎভাস্কর্য তার অখণ্ড ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতা অন্তত উনিশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত রাখে।
সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ও পরবর্তীকালে অখণ্ড বাংলা প্রদেশের রাজধানী হিসেবে কলকাতা (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী) নগরী ছিল ঔপনিবেশিক শিল্প, শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা, বিস্তার ও নির্দেশনার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকবৃন্দ প্রাথমিকভাবে এদেশের শিল্পের অন্যান্য শাখার মতো ভাস্কর্যের ঐতিহ্যকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে। ইউরোপ থেকে ভিক্টোরীয় ও নব্য-ধ্র“পদী ভাস্কর্যসমূহ এনে তারা কলকাতাসহ স্থানীয় নগরসমূহকে সজ্জিত করে। ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত স্থানীয় অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ভিক্টোরীয় ভাস্কর্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। স্থানীয় শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ব্রিটিশ ধ্র“পদী ভাস্কর্যের রীতি ও কৌশলের কারিগরি পাঠ যুক্ত হয়। এদেশের পরম্পরার মৃৎশিল্পীদের একাংশকে উৎসাহিত করা হয় ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক আঙ্গিকের ভাস্কর্য নির্মাণে।
পরম্পরার বাইরে বেশ কজন এদেশীয় ভাস্কর দেশে-বিদেশে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন করে গুণী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এঁদের মধ্যে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী রোহিনী কান্ত নাগ (১৮৬৮-১৮৯৫), বরিশালের শীতল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৯-?), ময়মনসিংহের অশ্বিনী বর্মণ রায় (১৮৮২-?) ও ঢাকার বিক্রমপুরের ফণীন্দ্রনাথ বসু (১৮৮৮-১৯২৬) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফণীন্দ্রনাথ বসু কলকাতায় সংক্ষিপ্ত পাঠ শেষে ভাস্কর্যে উচ্চতর শিক্ষার জন্য লন্ডনে যান এবং পরবর্তীকালে এডিনবরা কলেজ অফ আর্ট থেকে স্টুয়ার্ট প্রাইজসহ ডিপ্লোমা সম্পন্ন (১৯১১) করেন। এরপর ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এডিনবরাতে ফিরে স্টুডিও স্থাপন করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ১৯২৫ সালে রয়েল স্কটিশ অ্যাকাডেমির অ্যাসোসিয়েট নির্বাচিত হন। স্কটিশ অ্যাকাডেমির ১৯১৩-১৯২০ সাল পর্যন্ত সময়ের প্রদর্শনীগুলোতে তিনি অংশ নেন। স্কটল্যান্ডের পার্থ শহরের সেন্ট জন’স চার্চে তাঁর নিউ টেস্টামেন্ট অবলম্বনে রচিত একটি গুচ্ছ ভাস্কর্য ও সেন্ট জনের একটি প্রতিকৃতি ভাস্কর্য রক্ষিত আছে। সে-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কোনো ভাস্করের ব্রিটেনে এ-ধরনের প্রতিষ্ঠা একটি বিরল ঘটনা।
আজকের বাংলাদেশের আধুনিকতাবাদী মূলধারার দৃশ্যশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা প্রকৃত অর্থে সূচিত হয় বিশ শতকের চল্লিশের দশকের শেষ পর্বে। ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে উপনিবেশ তুলে নিয়ে চলে গেলে দক্ষিণ এশিয়ার এই উপমহাদেশটি মূলত তিন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত দুই দেশের মতো বাংলা অঞ্চলও বিভক্ত হয়।
দেশবিভাগের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতা থেকে বাঙালি মুসলমান শিল্পীদের একটি দল ঢাকায় চলে আসে এবং কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের আদলে একটি শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। ঢাকায় এই চারুকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রে রেখে এদেশের আধুনিক ধারার শিল্প-আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। উল্লেখ্য, এই শিল্পী দলের সকলে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে আরো লক্ষণীয়, এই শিল্পী দলে কোনো ভাস্কর ছিলেন না। অর্থাৎ বিভাগ-পূর্ব সময়কালে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে চিত্রচর্চার আগ্রহ তৈরি হলেও ভাস্কর্যচর্চার আগ্রহ তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। কলকাতা থেকে আসা শিল্পীদের মধ্যে কোনো ভাস্কর না থাকায় ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার একমাত্র চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ভাস্কর্যের অ্যাকাডেমিক পাঠেরও কোনো সুযোগ শুরুতে সৃষ্টি হয়নি।
১৯৪৭-১৯৭১, আত্মপরিচয় নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার যুগপৎ সংগ্রামে মুখর সামাজিক পটভূমিতে এদেশে আধুনিক ধারার দৃশ্যশিল্প তার প্রাথমিক রূপ পায়। ঢাকা হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র।
ক্ষণিকের ধ্র“বতারা
ঢাকার শিল্পজগতের সঙ্গে কোনো প্রকার সংস্রব ছাড়াই, একান্ত নিজ উদ্যোগে ও উৎসাহে চট্টগ্রামের মেয়ে নভেরা আহমেদ ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে লন্ডনের কেম্বারওয়েল স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস থেকে ভাস্কর্য গড়ার শিক্ষা নেন। প্রায় ছয় বছরে কেম্বারওয়েলের ডিপ্লোমা অর্জন ছাড়াও তিনি প্যারিস, ভিয়েনা ও ফ্লোরেন্সে যেয়ে ইউরোপীয় সমকালীন ভাস্কর্যপ্রবণতাসমূহের সঙ্গে পরিচয় ও ভাস্করবৃন্দের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য অর্জন করে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন।
নভেরা এমন সময় দেশে ফিরলেন যখন এদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা অর্থাৎ জয়নুল, কামরুল, সফীউদ্দিন প্রমুখ প্রকৃতি, লোকজীবন ও লোকশিল্পকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করে চিত্রকলায় ‘আধুনিক ধারা’ প্রবর্তনের দুরূহ সংগ্রামে রত। অপরদিকে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপে উচ্চতর শিল্পশিক্ষা শেষে এ-সময় দেশে ফিরেছেন বা ফিরছেন। এঁরা সকলেই তাঁদের শিক্ষার্থী জীবনে প্রবহমান মুুক্ত ও প্রগতিবাদী চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হন। আবার পাশ্চাত্যের চলমান শিল্পপ্রবণতার গতিময়তাও তাঁদের আকৃষ্ট করে। পশ্চিমের চিত্রকলার বির্মূত আঙ্গিক, বিশেষত বির্মূত প্রকাশবাদ তাঁদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে ও পরবর্তীকালে তাঁদের শিল্পচর্চায়ও বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। নভেরা বাংলাদেশের আধুনিক ধারার শিল্পের এই পরবর্তী বা দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী হয়েও নানাভাবেই ছিলেন স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রম।
ইউরোপের বাস্তবানুগ অ্যাকাডেমিক ধারায় অনুশীলন করলেও দেশে ফিরে নভেরা নতুন শিল্পভাষা নির্মাণে ব্রতী হন। সেই সময়ের সামাজিক বাস্তবতায় একজন নারীর শিল্পী হিসেবে, বিশেষত ভাস্কর হিসেবে আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং ছিল। নভেরা শুধু সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণই করলেন না বরং শুরুতেই স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ও মোড় পরিবর্তনকারী শিল্পভাষাযুক্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভাস্কর্য রচনা করলেন। নভেরা ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ঢাকায় প্রায় একশটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ঢাকার কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার) দেয়ালে করা তাঁর রিলিফ ভাস্কর্যটিও এদেশের কোনো জনপ্রতিষ্ঠানে করা আধুনিক ধারার প্রথম রিলিফ ভাস্কর্য। এছাড়া ঢাকায় ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত সৌধটির নকশা ও পরিকল্পনায় শিল্পী হামিদুর রাহমানের (১৯২৮-১৯৮৮) প্রত্যক্ষ সঙ্গী ছিলেন তিনি।
ভাস্কর্য রচনার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই নভেরা স্থানীয় সহজলভ্য উপকরণের ওপর নির্ভর করেন। তাঁর এ-সময়ের ভাস্কর্যসমূহ মূলত গৃহনির্মাণের কাঁচামাল অর্থাৎ লোহার রড, সিমেন্ট ও মার্বেলের গুঁড়ো। লোহার রডের কাঠামোয় সরাসরি সিমেন্টে মডেলিং করে তিনি তাঁর প্রায় সকল ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। কৌশলের কারণে তাঁর ভাস্কর্যগুলো অনেকটাই অভিনব সরল ও সংক্ষিপ্ত রূপ লাভ করে। তাঁর ভাস্কর্যের প্রিয় বিষয় ছিল মানুষ। পরিবার রূপে মানুষ, বিশেষত কৃষিনির্ভর গ্রামীণ মানুষ। নারী, বিশেষত মা ও শিশু তাঁর অনেকগুলো ভাস্কর্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
তাঁর এ পর্যায়ের নির্মাণে, ‘দ্য লং ওয়েট’সহ বেশ কিছু ভাস্কর্যে লোকজ পুতুল ও আদিম ভাস্কর্যের গুণাগুণ যুক্ত হতে দেখা যায়। দেশে ফেরার পর নভেরা কিছুদিনের জন্য মিয়ানমারে যান। সেখানে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ভাস্কর্যের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ঘটে। সম্ভবত এই ভ্রমণ তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করে থাকবে। ফিরে এসে তিনি ‘শান্তি’ শিরোনামে বেশ কিছু ভাস্কর্য রচনা করেন। ঢাকার প্রদর্শনীতে ধ্যানী বুদ্ধের অবয়ব অবলম্বনে এই সিরিজের কয়েকটি চমৎকার বিমূর্ত ভাস্কর্য উপস্থাপিত হতে দেখা যায়।
নভেরার কাজে সে-সময়ের বৈশ্বিক আধুনিকতাবাদী ধারার সঙ্গে দেশীয় এবং আদিম ভাস্কর্য-প্রকরণের সাবলীল সমন্ব^য় ঘটে, যা শুরুতেই বাংলাদেশের সমকালীন ভাস্কর্যের ধারাকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে পারত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নভেরার ভাস্কর্য অর্জন পরবর্তীকালে এদেশে কোনো ধারাবাহিকতা পায়নি। ১৯৬০ সালের প্রদর্শনীর পর নভেরা ঢাকা ছেড়ে চলে যান। আর দেশে ফেরেননি।
প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা
নভেরা এদেশ ছেড়ে চলে যাবার কিছুদিন পর একটি বিশেষ ঘটনা ঘটে। ঢাকার একমাত্র সরকারি চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি, যার প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্ট (১৯৪৮-১৯৬৩), সেটি কলেজে রূপান্তরিত হয় (১৯৬৩)। এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত ছিল (১৯৮৩-২০০০), যা বর্তমানে চারুকলা অনুষদ নামে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। ষাটের দশকে কলেজে রূপায়ণের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একাধিক নতুন বিভাগ খোলার প্রয়োজন পড়ে। তারই ফলে তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে নতুন একটি বিভাগ হিসেবে ১৯৬৩ সালে ভাস্কর্য বিভাগের সূচনা হয়। নভেরার স্বপ্রজন্মের শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের (১৯৩২-২০০৫) নেতৃত্বে ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়। ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী শিল্পী রাজ্জাক ঢাকা চারুকলা থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হয়ে ১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে স্নাতকোত্তর পাঠের জন্য যান। সেখানে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপচিত্রের ওপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। পাশাপাশি অঙ্কন ও ভাস্কর্য বিষয়েও বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন।
নতুন শুরু হওয়া ভাস্কর্য বিভাগ গড়ে তোলার পাশাপাশি বহুমাত্রিক শিল্পী রাজ্জাক ভাস্কর্য গড়াতেও মনোযোগী হন। বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষার্ধে তাঁর রচিত মডেলিং-নির্ভর ভাস্কর্যগুলোতে মূলত অ্যাকাডেমিক প্রবণতাই মুখ্য ছিল। মডেল সামনে রেখে, ড্রইং-নির্ভর এই বাস্তবানুগ নির্মাণের মধ্যে ‘রমণীর মুখ’ (১৯৬৪, প্রথমে সিমেন্ট ঢালাই, পরবর্তীকালে ব্রোঞ্জে রূপান্তরিত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর
এ-সময়ের কাজে বাস্তবের সরলীকরণের প্রচেষ্টা আদালাভাবে লক্ষণীয়। রাজ্জাকের সাহচর্যে ভাস্কর্যের প্রতি নিজস্ব আগ্রহ থেকে চারুকলার বিভিন্ন শাখার কজন শিক্ষার্থী শিল্পী ভাস্কর্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শিল্পী আনোয়ার জাহান (১৯৪০-১৯৯৩)। নারায়ণগঞ্জে বেড়ে ওঠা চিত্রকলায় স্নাতক আনোয়ার জাহান ১৯৬৫-৬৬ সালে এক বছর শিক্ষক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। মূলত কাঠ খোদাই মাধ্যমে তিনি ভাস্কর্য নির্মাণে উদ্যোগী হন। অনেকটা নাইভ ধাঁচে খোদাইকৃত তাঁর এ-সময়কার অবয়বধর্মী ভাস্কর্যগুলোতে আদিম ভাস্কর্যের গুণাগুণ লক্ষ করা যায়। ১৯৭০-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই তিনি ‘জলোচ্ছ্বাস’ শিরোনামে দুর্যোগে ভেসে যাওয়া মা ও শিশুর আবেগঘন রিলিফ ভাস্কর্যটি রচনা করেন। তিনি কাঠ ছাড়া ধাতু ও সিমেন্টেও বেশ কিছু ভাস্কর্য রচনা করেন। ‘জীবাশ্ম’ নামে কাঠ ও লোহার সমন্বয়ে রচিত মৎস্য-ভাস্কর্যটি তাঁর সবচেয়ে পরিণত রচনা হিসেবে বিবেচিত।
মুুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের ভাস্কর্য
স্বাধিকার আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের ওপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে ভয়াবহ গণহত্যার সূচনা করে তার বিপরীতে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সকল ক্ষেত্রের মতো ভাস্কর্যেও বিপুল ও গভীর প্রভাব ফেলে। উনিশ শতক থেকেই সারা বিশ্বে প্রজাতান্ত্রিক কিংবা জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানের ফলস্বরূপ দেশে দেশে জাতীয় বীরত্ব ও বিজয়ের সৌধরূপে গণপ্রাঙ্গণ ভাস্কর্যের বিশেষ চাহিদা তৈরি হয়। বিশ শতকে, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাপর সময়ে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহে গণবিপ্লব ও তার বিজয়ের গাথামূলক বৃহদায়তন বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য নির্মাণের ব্যাপক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিশ শতকের সত্তরের দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও জনমনেও একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে বহিরাঙ্গনে বৃহদায়তন সৌধ ভাস্কর্যের চাহিদা তৈরি হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ঢাকার প্রবেশমুখ গাজীপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে (স্থানটি ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামেও পরিচিত) স্থাপিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য ‘মুক্তিযোদ্ধা’ (১৯৭২-৭৩)। রি-ইনফোর্সড সিমেন্ট ঢালাইয়ে নির্মিত আঠারো ফুট উঁচু একটি বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দৃঢ়ভাবে ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ দুই পায়ে স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধার এই অবয়বধর্মী ভাস্কর্যটির এক হাতে রাইফেল অন্য হাতে উদ্যত গ্রেনেড। যে-কোনো আক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুত এমন বোধের জন্ম দেওয়াই বোধহয় ভাস্করের উদ্দেশ্য ছিল। ভাস্কর্যটির প্রণেতা বাংলাদেশের ভাস্কর্যের আধুনিকতার সূচনার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী আবদুর রাজ্জাক। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এই ভাস্কর্যটিই সম্ভবত তাঁর নব্য-ধ্র“পদী ঢঙের শেষ রচনা।
স্বাধীনতার পর রাজ্জাক সম্পূর্ণভাবে অবয়ব-নিরপেক্ষ বিমূর্ত ভাস্কর্যের নিরীক্ষায় নিয়োজিত হন। এ-সময়ে রচিত তাঁর ভাস্কর্যসমূহকে স্পষ্টত দুটি প্রবণতায় ভাগ করা যায়। কাঠ খোদাইনির্ভর ভাস্কর্যগুলোতে জৈবিক (organic) গুণাবলির প্রাধান্য দেখা যায়। ‘নির্মাণ-২’ (১৯৯৫) এর একটি উদাহরণ। অপরদিকে খুঁজে পাওয়া বস্তু (found object)- নির্ভর লোহা ও ইস্পাতের ঝালাই ভাস্কর্যগুলোতে তিনি মূলত জ্যামিতিক বিন্যাস এবং শূন্য পরিসরে গড়নের ভূমিকাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘খাড়াগড়ন’ (১৯৮৩) এই প্রবণতার ভাস্কর্যের একটি উদাহরণ।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখার আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনেও একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ভাস্কর্যটি রচনা করতে এগিয়ে আসেন শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ (জন্ম ১৯৪৫)। অপরাজেয় বাংলা (১৯৭৯) শিরোনামের আঠারো ফুট উচ্চতার তিনটি বাস্তবধর্মী অবয়বের সমন্বয়ে রচিত এই ভাস্কর্যগুচ্ছও রি-ইনফোর্সড সিমেন্টে ঢালাই করা। সশস্ত্র কৃষক, ছাত্র ও সেবিকার অবয়বের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এই ভাস্কর্যের নির্মাণে সমকালীন পূর্ব ইউরোপীয় সমাজবাদী ভাস্কর্যের অনুপ্রেরণা স্পষ্টত লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, নির্মাণের পর থেকেই এই ভাস্কর্যটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ক্রমাগতভাবে জাতীয় ঐক্য ও প্রণোদনার প্রতীকে পরিণত হয়।
অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে আরো কয়েকটি ভাস্কর্য রচনা করেন। স্বাধীনতার পর অপরাজেয় বাংলা নির্মাণের মাধ্যমে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পেলেও ভাস্কর্যের চর্চা তিনি স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই শুরু করেন। সিলেটে জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ আবদুল্লাহ্ খালিদ ঢাকার চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন মৃৎশিল্প বিভাগে গিয়ে নিজ উদ্যোগে ভাস্কর্য অনুশীলন করতেন। এ-সময়ের তাঁর বেশিরভাগ নির্মাণই বাস্তবানুগ প্রতিকৃতি ভাস্কর্য। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তিনি পোড়ামাটি ও সিমেন্ট ঢালাই প্রক্রিয়ায় ‘আত্মবিশ্লেষণ’ শিরোনামে বেশ কিছু নিরীক্ষাধর্মী ও আত্মপ্রতিকৃতিমূলক ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য নির্মাণ পরবর্তীকালে একটি জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনানিবাসসমূহে এবং জেলা পর্যায়ে ব্যাপক নির্মাণ তৎপরতা লক্ষ করা যায়। তবে দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ নির্মাণেই মৌলিকতা ও শিল্পমানের চাইতে স্থানীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক গণ-আবেগই প্রাধান্য পেয়েছে। তবে সত্তরের দশকেই আবির্ভাব ঘটে বেশ কয়েকজন ভাস্করের, যাঁরা ভাস্কর্যকে শিল্প মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা করতে আগ্রহী। নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এরাই বাংলাদেশের সমকালীন আধুনিক ধারার ভাস্কর্যের ভিত্তিভূমি তৈরি করেন।
হামিদুজ্জামান খান (জন্ম ১৯৪৬, কিশোরগঞ্জ) স্বাধীনতার আগেই ভাস্কর্যের অনুশীলনে নিযুক্ত হন। চিত্রকলার ছাত্র হামিদুজ্জামান ১৯৭৬ সালে ভারতের এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করে দেশে ফেরেন এবং ধাতব ঢালাই ও সংযোজনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা প্রভৃতিকে বিষয় করে ‘স্মৃতি ৭১’ শিরোনামে সিরিজ ভাস্কর্য রচনা করেন। মাধ্যম ও বিষয়ের অনবদ্য সমন্বয়ে তাঁর এই ভাস্কর্যগুলোর প্রকাশবাদী চরিত্র এদেশের সমকালীন ভাস্কর্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ভবন, বঙ্গভবনে ধাতব পাত, নল ও দণ্ড ব্যবহার করে ‘পাখী পরিবার’ (১৯৮০) শিরোনামে তিনি একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ছন্দোময়, ভারসাম্যপূর্ণ জ্যামিতিক এই রচনাটি বাংলাদেশের ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সংযোজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের সামনে ধাতু মাধ্যমে ‘সংশপ্তক’ (১৯৯০) শিরোনামে তিনি আরেকটি বিমূর্ত কিন্তু প্রকাশধর্মী অবয়বনির্ভর ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গতানুগতিক নির্মাণের বিপরীতে নিঃসন্দেহে এই রচনাটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আরো অনেক পরে সংশপ্তক অনুসরণে ঢাকার পান্থপথে ইউটিসি সেন্টারে একটি ঝুলন্ত-ভাস্কর্য তৈরি করেন। স্টেনলেস ইস্পাতের সরু নলকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে নির্মিত এই ভাস্কর্যটিও অনবদ্য।
তবে ১৯৮২ থেকে ’৮৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে স্কাল্পচার ইন্টার্নশিপ শেষে দেশে ফিরে এলে তাঁর ভাস্কর্য রচনায় গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের বদলে তিনি মৌলিক আকার ও গড়নের জ্যামিতিক বিন্যাসনির্ভর আঙ্গিকবাদী ভাস্কর্য রচনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। উত্তর আমেরিকার প্রচলিত ও জনপ্রিয় বিমূর্ত প্রবণতাগুলো হয়তো এক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে। যাই হোক মূলত বিশ শতকের আশির দশক থেকে হামিদুজ্জামান খান এদেশে প্রাথমিক কড়া উজ্জ্বল রংনির্ভর জ্যামিতিক ক্রীড়াময় অবয়ব-নিরপেক্ষ বিমূর্ত ভাস্কর্যের ব্যাপক প্রচলন ঘটান। দ্রুত বাণিজ্যিক নগরায়ণের নিয়ামক স্থাপত্যকলাও তাঁর এই সময়ের ভাস্কর্যের পরিপূরক সহযাত্রী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিমূর্তায়ন তাঁর সমকালীন এবং পরবর্তী ভাস্করদেরও কমবেশি প্রভাবিত করে। হামিদুজ্জমান খান জাতীয় ক্ষেত্রেই কেবল নন, ইতোমধ্যে সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিসরেও একজন পরিচিত ভাস্করে পরিণত হন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন ভাস্কর্য উদ্যানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমকালীন ভাস্করের ভাস্কর্যের পাশাপাশি তাঁরও বেশ কিছু ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।
অলোক রায় (জন্ম ২৯৫০, ময়মনসিংহ) ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হন ১৯৭৩ সালে। অতঃপর তিনি ভারতের এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যুরাল বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন ১৯৭৮ সালে। ভারতে অধ্যয়ন তাঁর শিল্পের মাধ্যম ও ধরন বদলে দেয়। অতঃপর ‘মাটির কান্না’ (১৯৮১), ‘আবদ্ধ’ (১৯৮৩) এবং ‘শহীদ’ (১৯৮৫) শিরোনামে তিনটি প্রদর্শনীতে তিনি লাল ও কালো পোড়ামাটিতে রিলিফধর্মী ও মুক্ত ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য উপস্থাপন করেন। নরম কাদা মাটিকে রুটির মতো ছেনে ও বেলে নানাভাবে দুমড়ে-মুচড়ে মূলত সিলিন্ডার আকারে তিনি তাঁর ভাস্কর্যগুলোর কাঠামো রচনা করেন। এই সময়ের রচনাগুলোর মধ্যে তাঁর গুচ্ছ ভাস্কর্যসমূহ বিশিষ্ট। বিচিত্র ও অনেকটাই আদিম প্রকাশধর্মিতাসহ প্রতিকৃতিই তাঁর এই ভাস্কর্যগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে। সামাজিক অনিয়ম, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ভাষা, জাতীয়তা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন তাঁর এ-সময়কার ভাস্কর্যসমূহের মূল প্রেরণা। পরবর্তীকালে তাঁর ভাস্কর্য ক্রমান্বয়ে বদলে যেতে থাকে। সরলীকরণের পরবর্তী পর্যায়ে প্রতিকৃতিই প্রাধান্য পায়। রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ার বদলে তাঁর ভাস্কর্যে প্রকৃতি ও মনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কসহ অন্তর্গত বিভিন্ন দার্শনিকবোধের অভিপ্রকাশের আগ্রহ লক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালে বিন্যাসের ক্ষেত্রে এসেছে আরো অভিনবত্ব ও বৈচিত্র্য। গ্লেজ ও নানান নকশাধর্মী ডিটেল যুুক্ত হয়েছে তাঁর নির্মাণে। হামিদুজ্জামানের মতো তিনিও জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত একজন ভাস্কর। দেশের বাইরে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিশেষত চীনের বিভিন্ন ভাস্কর্য উদ্যানে তাঁর বেশ কিছু ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।
বিশ শতকের সত্তরের দশকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নতুন প্রেরণা ও উদ্যম নিয়ে বেশ কিছু তরুণ ভাস্কর্যচর্চায় এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য, যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে ভাস্কর্র্য রচনা ও চর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত আছেন বা থেকেছেন। এঁরা হলেন – শামিম শিকদার (জন্ম ১৯৫৩, ফরিদপুর), যিনি ঢাকা চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভাস্কর্য বিভাগ থেকে ভাস্কর্যে স্নাতক হন এবং পরবর্তীকালে লন্ডনের জন ক্যাশ স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। তিনি মূলত প্রতিমূর্তি নির্মাণে বিশেষ মনোযোগ নিবদ্ধ করেন এবং এক্ষেত্রে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর রচিত ‘লা গুয়ের্নিকা’ শীর্ষক সিমেন্ট ভাস্কর্যটি ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাঙ্গণে স্থাপিত রয়েছে।
এনামুল হক এনাম (জন্ম ১৯৫৪, ঢাকা) ঢাকা চারুকলা থেকে ১৯৮০ সালে ভাস্কর্যে স্নাতক এবং ভারতের এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮৫ সালে। তাঁর কাজ মূলত বিমূর্ত অবয়বধর্মী। দলবদ্ধ মানুষ বা প্রতিবেশ, বিশেষত স্থাপত্যাংশের সঙ্গে মানুষের সমন্বয়ে তাঁর রচনাগুলো রূপ পায়। তিনি ধাতব ঢালাই মাধ্যমে কাজ করতে বিশেষ পারদর্শী।
রাসা সিদ্দিকী (জন্ম ১৯৫৭, কুমিল্লা) ঢাকার বুলবুল ললিতকলা কেন্দ্রের (বাফা) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ ও নিপীড়িত মানুষের জীবন আলেখ্য অবয়বী ঢঙে উপস্থাপনের জন্য পরিচিত। মণ্ডন ও খোদাই উভয় ধারায়ই ভাস্কর্য রচনা করেন। তবে কাঠ খোদাই দক্ষতার জন্য বিশেষভাবে সুপরিচিত। তাঁর ‘জীবন-১’, ‘জীবন-২’ এবং ‘বিংশতির ক্রীতদাস’ বিশেষ আলোচিত ভাস্কর্য।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (জন্ম ১৯৪৮, যশোর) একজন ব্যতিক্রমী স্বশিক্ষিত ভাস্কর। প্রকৃতিতে খুঁজে পাওয়া বিভিন্ন উপাদান, বিশেষত শুকনো ডাল, শেকড় প্রভৃতি থেকে গড়নের বিভিন্ন সাদৃশ্য রূপ আবিষ্কার ও ন্যূনতম সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে সংস্থাপন করে অর্থময় করে তোলা তাঁর শিল্পের প্রক্রিয়া। সত্তরের দশকের শুরুতে পারিবারিক পরিবেশে তাঁর শিল্পকর্মের অনুশীলন-প্রক্রিয়া শুরু হলেও সম্পূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটে নব্বইয়ের দশকে।
আখতার জাহান আইভি (জন্ম ১৯৫৮, বগুড়া) ঢাকা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগ থেকে ১৯৮০ সালে স্নাতক হন এবং ১৯৮৮-৮৯ সালে বিশ্বভারতীর শান্তিনিকেতনে ভাস্কর্য অনুশীলন করেন। তাঁর ভাস্কর্যের প্রাথমিক প্রেরণা প্রকৃতি ও পরিচিত জগতের চেনা গড়নের সরলীকরণ ও বিমূর্তায়ন। গ্রামীণ গৃহ-স্থাপত্য, বীজ, পাখি, মুখ Ñ এরকম নানা বিচিত্র বিষয় তাঁর ভাস্কর্যের বিষয় হয়ে আসে। ধাতব ঢালাই ও ঝালাই উভয় মাধ্যমেই তিনি সক্রিয়।
দুই দশকের দশ ভাস্কর
বিশ শতকের শেষ দুই দশক অর্থাৎ আশি ও নব্বইয়ের দশককে বাংলাদেশের সমকালীন ভাস্কর্যের নানামুখী প্রবণতা ও প্রচেষ্টার বিস্তৃতির কাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক ভাস্কর্যচর্চা ইতোমধ্যে প্রায় দেড় দশক সময় অতিক্রম করে। পূর্ব প্রজন্মের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের অপেক্ষাকৃত নবীন ভাস্করদের সম্মিলনে একটি বিস্তৃত সৃজন পরিসর তৈরি হওয়ার বাস্তবতা দেখা দেয়। ইতোমধ্যে পূর্বের তুলনায় বিশ্ব পরিসরে চলমান ভাস্কর্যচর্চার সঙ্গে স্থানীয় শিল্পীদের পরিচয় ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। উচ্চশিক্ষা, প্রদর্শনী, কর্মশালার জন্য বিদেশ গমন, এশীয় দ্বিবার্ষিক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে সমকালীন এশীয় ও অন্যান্য দেশের ভাস্কর্য, ধারণা-প্রধান স্থাপনা ও অভিনয়ধর্মী প্রবণতাসমূহ প্রত্যক্ষকরণ স্থানীয় ভাস্করদের ওপর কমবেশি প্রভাব ফেলে।
সুলতানুল ইসলাম (জন্ম ১৯৫৮, ঢাকা) বাস্তবানুগ ও বাস্তব অনুপাতে অবয়বী ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। আশির দশকজুড়ে শিশুদের বিষয় করে তার সৃষ্ট ভাস্কর্যগুলো বিশেষভাবে আলোচিত হয়। ঢাকার শিশু একাডেমী প্রাঙ্গণের দুরন্ত এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত জীবনবৃন্তান্ত ভাস্কর্য দুটি তাঁর উল্লেখযোগ্য নির্মাণ।
তৌফিকুর রহমান (জন্ম ১৯৫৯, শরিয়তপুর) ১৯৮১ সালে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ভাস্কর্যে স্নাতক এবং ১৯৮৫ সালে বেইজিং সেন্ট্রাল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন। আশির দশকে তাঁর কাঠ ও অন্যান্য মাধ্যমের ভাস্কর্যে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও সামাজিক বৈষম্যের প্রতি শ্লেষ প্রাধান্য পায়। পরবর্তীকালে নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি ধাতব ঝালাইকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। ধাতব ঝালাই মাধ্যমের প্রাথমিক পর্যায়ের ভাস্কর্যগুলোতে ভূমিদৃশ্যের সঙ্গে যুক্ত করে মানুষ ও প্রাণীর অবয়বকে উপস্থাপন করেন। পরবর্তীকালে একই উপকরণে নিষ্ঠ থেকে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণী অবয়বকে কেন্দ্রীয় বিষয় করে তোলেন। ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি মাধ্যমের গুণাবলি রক্ষা করে প্রকাশধর্মী রচনাকে গুরুত্ব দেন।
মুকুল মুকসুদ্দিন (জন্ম ১৯৫৯, ঢাকা) ঝালাই প্রক্রিয়ায় তামার পাতসহ বিভিন্ন ধাতু মাধ্যমে আলংকারিক ধাঁচে প্রধানত বিভিন্ন যানবাহন ও প্রাণীর অবয়বী ভাস্কর্য রচনা করেন। তাঁর নির্মিত মাঝারি ও ক্ষুদ্রাকৃতি রিকশা, পেঁচা প্রভৃতিকে বিষয় করে নির্মিত ভাস্কর্যগুলো একসময় লক্ষণীয়ভাবে সংগ্রাহকদের আকর্ষণ করে।
মৃণাল হক (জন্ম ১৯৬০, রাজশাহী) বিভিন্ন খুঁজে পাওয়া ধাতব যন্ত্রাংশ ঝালাই করে জুড়ে দিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য পরিচিত। একই সঙ্গে তিনি আলোচিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সৌন্দর্যবর্ধক ফরমায়েশি ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য।
মাহবুব জামাল (জন্ম ১৯৬০, যশোর) নব্বইয়ের দশকে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পাঠকালীন মডেলিং ও সিমেন্ট ঢালাই প্রক্রিয়ায় মানব অবয়বনির্ভর বেশ কিছু ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। পিরামিডের আকৃতিতে দেহকে বিন্যস্ত করে বিশালত্ব প্রদান তাঁর এই সময়ের ভাস্কর্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তাঁর ওই সকল অবয়বে এস এম সুলতানের চিত্রের মানব অবয়ব রচনার রীতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকলেও থাকতে পারে। উল্লেখ্য, যশোরে মাহবুব জামালের কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে সুলতানের সান্নিধ্যে।
শ্যামল চৌধুরী (জন্ম ১৯৬২, নেত্রকোনা) স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবিরোধী মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য বিশেষ পরিচিত। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে রাজু স্মৃতি চত্বরের সন্ত্রাসবিরোধী সিমেন্ট ভাস্কর্য ‘মানববন্ধন’। শ্যামল বর্তমানে মিথ ও ঐতিহ্যের প্রেরণায় অবয়বনির্ভর ভাস্কর্য রচনার নিরীক্ষায় লিপ্ত।
লালা রুখ সেলিম (জন্ম ১৯৬৩, ঢাকা) ভারতের শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন। তিনি নারী ও পুরুষ অবয়ব নিয়ে রচনা করেন মৃৎভাস্কর্য। মৃৎপাত্র নির্মাণের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে ধাপে ধাপে সিলিন্ডার প্রক্রিয়ায় নির্মিত তাঁর ভাস্কর্যে বিশালতা একটি বিশেষ প্রকাশ হিসেবে প্রতিফলিত হয়। ঐতিহ্যসচেতন এই ভাস্কর পরবর্তীকালে অবয়ব নির্মাণে কাগজ মাধ্যমের আগ্রহ উদ্দীপক ব্যবহার করেন।
শেখ সাদী ভূঁঞা (জন্ম ১৯৬৪, কিশোরগঞ্জ) মূলত মডেলিং পদ্ধতিতে অবয়বের সরল বিমূর্তকরণ করে থাকেন। ক্রীড়ারত মা ও শিশু, মানব ও পশুর মিশ্র অবয়ব এরকম লৌকিক ও পৌরাণিক বিষয়কে তাঁর ভাস্কর্যে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়।
মোস্তফা শরীফ আনোয়ার (জন্ম ১৯৬৫, জামালপুর) স্থানীয়ভাবে অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত মাধ্যম পাথরে খোদাই করে ভাস্কর্য গড়েন। তাঁর ভাস্কর্যে প্রতিকৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ বিন্যাস লক্ষ করা যায়।
নব্বইয়ের দশকের সূচনা থেকে মাহবুবুর রহমান (জন্ম ১৯৬৯, ঢাকা) ভাস্কর্য রচনায় নিযুক্ত হন। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র থাকাকালীন মাহবুবুরের শুরুর দিকের ভাস্কর্যে পূর্বসূরি মাহবুব জামালের মতোই অতিকায় অবয়বের প্রাধান্য দেখা যায়। তবে মাহবুবুর রহমানের ভাস্কর্যগুলো শুরু থেকেই আখ্যানধর্মী। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা-আন্দোলনের মতো বিষয় নিয়ে শুরু করে ক্রমেই তাঁর ভাস্কর্য পরিবেশ বিপর্যয়, সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়াবলির দিকে ধাবিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে শ্লেষ, কটাক্ষনির্ভর স্থাপনা ও অভিনয়ধর্মী অনুশীলনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাহবুবুরের শিল্পকর্মে বিষয় ও উপস্থাপনার মতো উপকরণের ব্যবহারেও ব্যাপক বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একজন সুপরিচিত ও ব্যস্ত শিল্পী।
একুশ শতক ও সমকালীন ভাস্কর্য
বিশ শতকের শেষ দুই দশকে বাংলাদেশের সমকালীন ভাস্কর্যের নানামুখী চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে একুশ শতকের ভাস্কর্য কী রূপে আবির্ভূত হবে তার একটি চিত্র যাওয়া যায়। একুশ শতকের সূচনাপর্বে ক্রিয়াশীল কয়েকজন ভাস্করকে নিয়ে লালা রুখ সেলিমের মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ করা হলো। সেলিমের চোখে ‘ময়নুল ইসলাম পল (জন্ম ১৯৬৬) ২০০০ সাল থেকে নির্মিত ভাস্কর্যে কাঠ, সিমেন্ট ও পরবর্তীকালে কাগজে সরলীকৃত জৈবিক ও মানব নির্মিত গড়নের উপস্থাপনা করেন। নাসিমা হক মিতু (জন্ম ১৯৬৭) প্রধানত কাঠ তক্ষণ মাধ্যমে সরলীকৃত গড়ন উপস্থাপন করেন। ২০০০ সাল-পরবর্তী মিতুর কাজে যেমন মাধ্যমের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়, তেমনি তাঁর কাজে এসেছে ঐতিহ্যসচেতনতা ও প্রতীকী উপস্থাপনা। মিতুর কাজে গড়নের বিশুদ্ধতা ও উপাদানকে চূড়ান্ত নিখুঁত সম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। সুদীপ্ত মল্লিক সুইডেন (জন্ম ১৯৬৯) চিত্রকলায় এমএফএএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে। কাজে বিচিত্র উপাদান সমন্বয় করে থাকেন তিনি, যেমন Ñ বাঁশের গুঁড়ি, কাগজ, কাঠ। তাঁর কাজে মানব মস্তক সর্বাধিক ব্যবহৃত গড়ন। মাধ্যমগত বৈচিত্র্য এবং নতুন প্রবণতা দেখা যায় ইমরান হোসেন (জন্ম ১৯৭২), কবীর আহমেদ মাসুম চিশতী (জন্ম ১৯৭৬), মুকুল কুমার বাড়ৈ (জন্ম ১৯৭২), হাসানুর রহমান রিয়াজ (জন্ম ১৯৭৫) প্রমুখের কাজে। সহজলভ্য ও নশ্বর উপাদান অবলীলায় ব্যবহার করেন তাঁরা। নানা সময়ে তাঁরা স্থাপনাও করেছেন। নাসিমুল খবির (জন্ম ১৯৭২) তক্ষণ ও মণ্ডন উভয় প্রক্রিয়ায় প্রথাগত মাধ্যমের মধ্যে থেকে ঐতিহ্যসচেতন ও ইঙ্গিতবহ কাজ করেছেন। ফারজানা ইসলাম মিল্কি (জন্ম ১৯৭৪) ধাতব ঢালাই মাধ্যমে সরলীকৃত অবয়বী ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন।’ এঁরা ছাড়াও সম্প্র্রতি এ এ এম কাওসার হাসান (জন্ম ১৯৬৭), মো. আতিকুল ইসলাম (জন্ম ১৯৭৪) প্রমুখের নির্মাণ ঢাকার শিল্পজগতে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। সিরামিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে ভাস্কর্যধর্মী নির্মাণে নিয়োজিত কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শিল্পী হলেন মো. রবিউল ইসলাম (জন্ম ১৯৭৪), দেবাশীষ পাল (জন্ম ১৯৭১), মো. আজহারুল ইসলাম শেখ (জন্ম ১৯৭০), মোহাম্মদ সাব্বির-আল রাজী (জন্ম ১৯৮১) ও চিন্ময়ী সিকদার (জন্ম ১৯৭৮)।
বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষে অনেকটা হঠাৎ হাজির হওয়া নভেরার ভাস্কর্য আলোড়নের পরবর্তীকালে অর্থাৎ ষাটের দশকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে প্রাতিষ্ঠানিক ভাস্কর্যের চর্চা শুরু হয়। মূলত স্বাধীনতার পরই বাংলাদেশে আধুনিক ধারার ভাস্কর্য রচনার সূচনা হয়। প্রথম প্রজন্মের প্রধান শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে অবয়বনির্ভর ভাস্কর্য দিয়ে শুরু করলেও অচিরেই এদেশের সমকালীন ভাস্কর্যে অবয়ব-নিরপেক্ষ, জ্যামিতিক বিমূর্ততাই প্রাধান্য পায়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে পূর্ব প্রজন্মের ভাস্করদের পাশাপাশি ক্রিয়াশীল নবীন ভাস্করদের একাংশ যেমন অ্যাকাডেমিক নব্য-ধ্র“পদী ধারার দিকে ঝুঁকে পড়ে আবার অন্যদিকে আরেকাংশ বিশ্বপ্রবণতা হিসেবে চলমান জনপ্রিয় স্থাপনা ও অভিনয়ধর্মী আঙ্গিকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। মধ্যবর্তী আরেকটি অংশ গড়ন ও কাঠামোর সতর্ক নিরীক্ষায় নিয়োজিত হয়। তারা ঐতিহ্য ও বিশ্বজনীনতাকে একই সঙ্গে সমন্বয়ের সংগ্রামটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছে। একবিংশ শতাব্দীতে ক্রিয়াশীল নতুনতর প্রজন্মের চর্চায় উল্লিখিত সকল প্রবণতাই কমবেশি লক্ষণীয়।
তথ্যসূত্র
১। কমল সরকার, ভারতের ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী, কলকাতা, ১৯৮৪
২। অরুণ ঘোষ, আর্ট অফ বেঙ্গল ১৮৫০-১৯৫০, কলকাতা, ১৯৯৫
৩। লালা রুখ সেলিম (সম্পাদিত), চারু ও কারুকলা, ঢাকা, ২০০৭
৪। মৃণাল ঘোষ, সমকালীন ভাস্কর্য, কলকাতা, ২০০১
৫। প্রদর্শনী ক্যাটালগ, ইনার গেজ, স্কাল্পচারস অফ নভেরা আহমেদ, ঢাকা, ১৯৬০
৬। নজরুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, আর্ট অফ বাংলাদেশ সিরিজ-৭, ঢাকা, ২০০৩
৭। আবু তাহের, আনোয়ার জাহান, বাংলাদেশের সমকালীন চারুকলা সিরিজ-৪৯, ঢাকা, ১৯৯৪
৮। এনামুল হক, দ্বিতীয় জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনী, বাংলাদেশের সমকালীন চারুকলা সিরিজ-২৫, ঢাকা, ১৯৮৩
৯। নাসিমুল খবির, বাংলাদেশের সমকালীন ভাস্কর্য (১৯৫৫-২০০৫), গড়ন ও উপকরণ, ঐক্য ও বৈচিত্র্য, ঢাকা, ২০০৬
১০। মিজারুল কায়েস, শামীম সিকদার, বাংলাদেশের সমকালীন চারুকলা সিরিজ-২১, ঢাকা, ১৯৮২
১১। নজরুল ইসলাম, হামিদুজ্জামান খান এ মডার্ন স্কাল্পটর, ঢাকা, ২০০৫
১২। মেহবুব আহমেদ, ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ’, দৈনিক সংবাদ, ঢাকা, ১০ নভেম্বর, ১৯৯৪