অ লো ক ব সু
শেষ ভালো যার সব ভালো তার’ – এই কথাটির আর একবার প্রমাণ মিললো ৩০ মে ২০১১ তারিখে ‘প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব’-এর সফল সমাপ্তির মাধ্যমে। যার শেষটা ভালো বলা হলো তার শুরুটা কেমন ছিল? ‘প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব’ শুরু হয় ২১ মে সন্ধ্যায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসবের উদ্বোধন ঘটে। উৎসবের উদ্বোধন করেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বিশ্ব কেন্দ্রের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। সম্মানিত বিশেষ অতিথি হিসেবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি নাট্যজন আতাউর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের সেক্রেটারি জেনারেল নাসিরউদ্দীন ইউসুফ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। বিকেল থেকে তুমুল ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে হাজির হতে থাকেন শত শত নাট্যকর্মী ও দর্শক। বাইরে যখন ঝড়ের তুমুল দাপাদাপি তখন মিলনায়তনের সামনের কাচঘেরা স্পেসে বেদির ওপর সারেঙ্গি ও স্যাক্সোফোনের সুরের মূর্ছনা। মূল অনুষ্ঠান শুরুতে সামান্য দেরি হলেও দর্শকরা বিন্দুমাত্রও ধৈর্যচ্যুত হওয়ার সুযোগ পাননি। কারণ সারেঙ্গি আর স্যাক্সোফোনের সুরের ঐকতানের সঙ্গে কাচের দেয়ালে চলছিল প্রজেক্টরে দশকভিত্তিক নাট্যচর্চার স্থিরচিত্রের প্রদর্শনী। আর দুপাশের কাচের দেয়ালের কাছ ঘিরে আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
২১ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা দশ দিনে দেশি-বিদেশি ২৫টি নাটক প্রদর্শনীর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১’। আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র এর আগে ঢাকায় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও নাট্যোৎসবের আয়োজন করলেও এবারের আয়োজনে ছিল সত্যিকারের একটি উৎসবের আমেজ। এ উৎসবে শিল্পকলা একাডেমীর তিনটি হলে দশ দিনে পঁচিশটি নাটকের প্রদর্শনী হয়।
ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পাঁচটি বিদেশি নাটক এবারের উৎসবের নামেই স্থান করে নিয়েছিল আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব, তাই দেশের বাইরের নাটকই ছিল উৎসবের মূল আকর্ষণ। আয়োজক সূত্রে জানা যায়, বিদেশি দলের অংশগ্রহণ আশা করা হলেও সময়স্বল্পতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা আশানুরূপ হয়ে ওঠেনি। তার পরও পাঁচটি বিদেশি দলের পাঁচটি বিদেশি নাটক এক উৎসবে দেখতে পাওয়া ঢাকার নাট্যদর্শকদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
উৎসবের প্রথম দিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় সিঙ্গাপুরের বাডস থিয়েটার কোম্পানির নাটক শেডস। আলিয়া বানো রচিত এ নাটকের নির্দেশনায় ছিলেন ক্লেয়ার ডিভাইন। নাটকটির গল্পে রয়েছে প্রেম। কিন্তু প্রেমকে কেন্দ্র করে বর্তমান সিঙ্গাপুরের আর্থসামাজিক, ধর্ম-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটই প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের দ্রুত সম্প্রসারণশীল অর্থনীতির দেশ সিঙ্গাপুর। গ্লোবালাইজেশনের ঘূর্ণিপাকে বহু সংস্কৃতির এই দেশটির পরিবারগুলোতে কী কী প্রভাব পড়ছে, কী কী দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত – এ-নাটকে তাই উপস্থাপন করা হয়েছে। অগ্রসরমাণ, শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, এর একদিকে বৈশ্বায়ন অন্যদিকে চিরাচরিত রীতিনীতি। এই দুইয়ের চাপে সিঙ্গাপুরের মুসলিম সম্প্রদায় চিঁড়াচেপ্টা হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। শেডস নাটকে এ বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে অত্যন্ত পরিশীলিত ও নান্দনিক উপায়ে। অত্যন্ত মুন্শিয়ানার ছোঁয়া এ প্রযোজনায়। রিয়ালিস্টিক ধাঁচে বাঁধা এ প্রযোজনায় যাঁরা অভিনয় করেছেন এবং নেপথ্যে কাজ করেছেন তাঁদের টিমওয়ার্ক ছিল অত্যন্ত নিখুঁত মানের।
এরপরে ২৩ তারিখে একই মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় হংকংয়ের এশিয়ান পিপলস থিয়েটার ফেস্টিভাল সোসাইটি এবং এফএম থিয়েটার পাওয়ারের যৌথ প্রযোজনা এইট টাইম এইট। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেন যৌথভাবে ব্যাঙ্কে ইউং এবং পিং কেই।
এইট টাইম এইট নাটকের শুরুতে হংকংয়ের ঐতিহ্যবাহী চা পান করানো হয় দর্শকদের এবং সকলকে সূর্যমুখী ফুলের বীজ দেওয়া হয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
নাটকটি শুরু হয় হংকংবাসী পরিবারের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। সন্তান তার ইচ্ছে মতো বড় হতে চায়। পড়াশুনা করতে চায় তার পছন্দের বিষয়ে কিন্তু পরিবার তাকে শেখায় অন্য জিনিস। তাকে বিজনেস, ইকোনমিকস পড়তে হবে। তাকে গ্লোবালাইজেশনের চাকার সঙ্গে সমান গতিতে ছুটতে হবে। ফলে নিজের সত্তার সঙ্গে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে একীভূত হয় হংকংবাসীদের জাতি-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সংকটটি। এসব সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয় পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের সঙ্গে কমিউনিজমের দ্বন্দ্ব। চে গুয়েভারার প্রতি, তাঁর দর্শনের দিকে উঁকি মারে ক্রমাগত পুঁজির শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হংকংয়ের হৃদয়তন্ত্রী। নাটকটি দেখে মনে হয়েছে, এটি যেন একটি কর্মশালা প্রযোজনা। নাটকের অবয়ব ও উপস্থাপনায় নিরাভরণতার ছোঁয়া।
২৬ মে জাতীয় নাট্যশালায় পরিবেশিত হয় আগরতলার নাট্যভূমি প্রযোজনা স্ত্রীর পত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প থেকে এ নাটকটি নির্মাণ করেছেন সঞ্চয় কর। নাটকের উপস্থাপনা রীতিতে অভিনবত্ব না থাকলেও এর বিষয়বস্তুর রয়েছে চিরকালীন আবেদন। অনেকটা টেলিভিশন নাটকের ঢংয়ে দৃশ্যবিন্যাস করা হয়েছে এ নাটকে। তবে অভিনয়শিল্পীরা ভালো অভিনয় করে উতরে নিয়েছেন এ প্রযোজনাটি।
২৭ মে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় নেপালের থিয়েটার মানডালার প্রযোজনা মাইলা ডট কম। দায়াহাং রাই রচিত ও নির্দেশিত এ নাটকটি দর্শকদের তৃপ্ত করতে সক্ষম হয়। খুব সাদামাটা বিষয় নিয়ে এ নাটকের গল্প। ২৫ বছরের তরুণী সাহুনী একটা কফিশপ চালায়। আর সে কফিশপে কাজ করে ১৩ বছরের বালক মাইলা। মাইলা বেশ চটপটে এবং খুব কাজের। তাই মাইলাকে বেশ পছন্দ ও খাতির করে কফিশপের মালিক সাহুনী। প্রতিদিনের কাজের মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে এক মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়। একদিন এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মাইলা সাহুনীকে চুমু খেতে চায়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। সাহুনী খেপে যায় এবং মাইলার চাকরি চলে যায়। এই সাদামাটা গল্পের নাটকটিতে নির্দেশক দায়াহাং রাই ব্যবহার করেছেন শরীরের ভাষা। নাটকে সংলাপের ব্যবহার হয়েছে খুবই কম। যাও হয়েছে তা দু-তিনটি শব্দেই হয়েছে। মাত্র দুজন অভিনয়শিল্পী তাঁদের আঙ্গিক অভিনয়কুশলতায় মুগ্ধ করে রেখেছেন দর্শকদের। আঙ্গিক অভিনয়েও তাঁরা জটিল কোনো পন্থা অবলম্বন করেননি। শুধু সাদামাটা মুহূর্তগুলোকে প্রকাশ করার জন্য সাদামাটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চালিয়ে গেছেন। মাইলার ভূমিকায় রাজন খাটিওয়াদার অভিনয় ছিল এক কথায় অসামান্য। সাহুনীর চরিত্রে সৃজনা সুব্বার অভিনয়ও ছিল মানানসই।
উৎসবের শেষদিন জাতীয় নাট্যশালায় প্রদর্শিত হয় ভারতের মণিপুরের কলাক্ষেত্র নাট্যদলের নাটক ডাকঘর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ নাকটির নির্দেশনায় ছিলেন ভারতের স্বনামধন্য নির্দেশক, পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত নাট্যজন শ্রী এইচ কানহাইলাল। বাংলা, মণিপুরি, অহমিয়াসহ পাঁচ-ছয়টি ভাষায় এই নাটকটি উপস্থাপন করা হয়েছে। সংলাপ এখানে গৌণ ভূমিকা পালন করেছে। রূপকধর্মী এ প্রযোজনায় সর্বত্র কুশলতার স্বাক্ষর রাখতে পারঙ্গম হয়েছেন নির্দেশক। নির্দেশক এ নাটকে অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে ক্যাথারসিস প্রক্রিয়ায় কাজ করেছেন। ফলে চরিত্রের বয়স, মুখের ভাষা, স্থানকাল বিবৃত হয়েছে ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়। অত্যন্ত উঁচুমানের এ প্রযোজনাটির কথা দর্শকদের মনে থাকবে অনেকদিন। কিশোর অমলের চরিত্রে ৬০ বছর বয়সী নারী অভিনয়শিল্পী হেইচনাম সাবিত্রীর অনন্য অভিনয় ছিল দর্শকদের বিশেষ প্রাপ্তি।
দশ দিনে দেশের বিশ
উৎসবে বিদেশি পাঁচটি নাটক দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকলেও দেশের বিশটি নাটকের প্রদর্শনীও কম কিছু নয়। উৎসবে দেশের নাটক নির্বাচনে এবার প্রাধান্য পেয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের প্রযোজনাগুলো। উৎসবে প্রদর্শিত হয় মণিপুরি থিয়েটারের কহে বীরাঙ্গনা, থিয়েটারের মুক্তধারা, থিয়েটার আর্ট ইউনিটের মগজ সমাচার, পালাকারের বাংলার মাটি বাংলার জল, থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির শাইলক অ্যান্ড সিকোফ্যান্টস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের ডাম্ব ওয়াটার, পদাতিক নাট্য সংসদের (টিএসসি) জনমাঙ্ক, ঢাকা ড্রামার ছায়াবৃক্ষ, ইসলাম উদ্দিন পালাকারের পালাগান কমলা রানীর সাগরদীঘি, সুবচন নাট্য সংসদের মহাজনের নাও, প্রাঙ্গণেমোর-এর দ্রোহ প্রেম নারী, থিয়েটারের (আরামবাগ) জন্মসূত্র, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ঘাসিরাম কোতয়াল, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের পুসি বিড়াল ও একজন প্রকৃত মানুষ, অরিন্দমের জলকন্যা, দেশ নাটকের মঙ্গলমুখ, অনুশীলন নাট্যদলের রথের রশি, শব্দাবলীর ফণা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের তোতাকাহিনী। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের পরিবেশনার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশালের নাটকের প্রদর্শনী হওয়ায় ঢাকার দর্শকরা এই উৎসবে ঢাকার বাইরের নাট্যচর্চা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যচর্চা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।
সবার ওপরে রবীন্দ্রনাথ
এবারের নাট্যোৎসব অর্থাৎ প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১ যে-সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, সে-সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষা, সাহিত্যের প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ১৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এ বছর। বাংলাদেশে বেশ সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। হয়তো সে কারণেই রবীন্দ্রনাটকের চর্চা এ-সময়ে বেশি বেশি হচ্ছে। সংখ্যার হিসাবে এ উৎসবে রবীন্দ্রনাথের নাটকই সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত হয়েছে। ভারতের দুটি নাটকই ছিল রবীন্দ্রনাথের। স্ত্রীর পত্র এবং ডাকঘর। বাংলাদেশের নাট্যদলগুলো রবীন্দ্রনাথের যে-সংখ্যক নাটক এ উৎসবে প্রদর্শন করেছে, তাও সংখ্যার হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ। থিয়েটার প্রযোজনা করেছে মুক্তধারা। নায়লা আজাদ ছিলেন এ নাটকের নির্দেশক। থিয়েটার আর্ট ইউনিট করেছে মগজ সমাচার। রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতা থেকে এ নাটকটি নির্মাণ করেছেন সাইফ সুমন।
রাজশাহীর অনুশীলন নাট্যদল মলয় ভৌমিকের নির্দেশনায় উপস্থাপন করে রবীন্দ্রনাথের রথের রশি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ ড. ইউসুফ হাসান অর্কের নির্দেশনায় পরিবেশন করে রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনী। উপরোল্লিখিত সাতটি নাটক সরাসরি রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে নির্মিত হয়েছে। এছাড়া পালাকারের নাটক বাংলার মাটি বাংলার জল সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র ও রবীন্দ্রনাথের জীবনী অবলম্বনে। সে হিসেবে এ নাটকটিতেও রবীন্দ্রনাথ বর্তমান।
আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, নাট্যকলায় রবীন্দ্রনাথ যে আজো প্রাসঙ্গিক এবং আজো সবচেয়ে বেশি সরব তারই প্রমাণ মিললো প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১-এ।
প্রতিদিন বুলেটিন
প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১ উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে উৎসবের ১০ দিন প্রতিদিন চার পৃষ্ঠার চার রঙের সুদৃশ্য নিউজ বুলেটিন প্রকাশিত হয়। ‘থিয়েটার ফেস্ট নিউজ’ শিরোনামের এই বুলেটিনের সম্পাদনা পরিষদে মূল দায়িত্ব পালন করেন সেলিম শামসুল হুদা চৌধুরী। এই বুলেটিনে প্রতিদিনের নাটকের আগাম সচিত্র প্রতিবেদন যেমন ছাপা হয়েছে, তেমনি দেশি-বিদেশি নাট্যবোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার, মন্তব্যও ছাপা হয়েছে। ফলে দর্শক তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্যটি যেমন জানতে পেরেছেন এই বুলেটিন থেকে, তেমনি উৎসবের গতি-প্রকৃতি, গুরুত্ব সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রচুর নাটকের ছবি, নাটক ও উৎসব সম্পর্কিত এ সুদৃশ্য দৃষ্টিনন্দন বুলেটিনটির দাম রাখা হয়েছিল মাত্র পাঁচ টাকা। বুলেটিনটি উৎসবে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
স্থিরচিত্র প্রদর্শনী
উৎসব উপলক্ষে আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে দশকভিত্তিক নাট্যচর্চার স্থিরচিত্রের একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রদর্শনীতে বিংশ শতকের সত্তর, আশি, নব্বই এবং একবিংশ শতকের শূন্য দশকের নাটকের স্থিরচিত্র প্রদর্শিত হয়। এক্ষেত্রে নাটক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষত্ব প্রকাশ পায়নি। স্থিরচিত্রগুলো প্রামাণিক বটে, তবে পক্ষপাতমুক্তও নয়, নান্দনিকও নয়। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ নাটকের ছবি বাদ পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে আমাদের নাটককে কেন্দ্র করে পোস্টার এবং স্থিরচিত্রের প্রদর্শনী হয়ে থাকে এবং সেসব প্রদর্শনীতে বেশির ভাগ সময়ই যা হয় তাকে শিয়ালের কুমিরের বাচ্চা প্রদর্শন করার মতো অবস্থা। বিগত বেশ কিছু বছর যাবৎ আমাদের থিয়েটারের কিছু মেধাবী কর্মী নিজ উদ্যোগে
বিভিন্ন দলের প্রদর্শনীর স্থিরচিত্র ধারণ করছেন। ভবিষ্যতে তাঁদের কাজে লাগানো গেলে নান্দনিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা সম্ভবপর হবে।
নানা কথা উৎসবকে ঘিরে
ঢাকায় এত বড় একটি সফল উৎসব উদ্যাপনের মাধ্যমে আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র যে তার নিজের দায়িত্বের পরিধি বড় করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন একটি সফল উৎসবের ফলে দর্শক ও নাট্যকর্মীদের আকাক্সক্ষা যে আরো বেড়ে গেল সেটিই এখন আয়োজকদের মনে রাখার বিষয়। যদিও আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের সেক্রেটারি জেনারেল নাসিরউদ্দীন ইউসুফ উৎসবের সমাপ্তির দিনে ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের উৎসবের থেকেও বড় পরিসরের উৎসব আয়োজন করা হবে দুবছর পর ২০১৩ সালে। একটি আন্তর্জাতিক মানের নাট্যোৎসব সফল করার জন্য যে প্রস্তুতি গ্রহণ প্রয়োজন হয় তা নিশ্চিত করা না গেলে সংশ্লিষ্ট মহলে কথা উঠতেই পারে। এবারের সময়স্বল্পতা, শেষ মুহূর্তে অনুদানের টাকার ছাড়প্রাপ্তি ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কথা দর্শক-নাট্যকর্মীরা সহজভাবে মেনে নিলেও ভবিষ্যতের জন্য আয়োজকদের এখন থেকেই সতর্ক ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এবারের উৎসব সম্পর্কে সাধারণ দর্শক ও নাট্যকর্মীদের মূল্যায়ন কী জানার চেষ্টা করেছি। মো. সালেক নামের একজন আইনজীবী এবারের উৎসবে বেশ কিছু নাটক দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এবারের উৎসব সফল হয়েছে। এ ধরনের উৎসব দুই বছরে একটি নয়, বরং এক বছরে দুটি হলে ভালো হয় বলে জানালেন তিনি। তাঁর মতে, সাধারণ দর্শকদের কথা বিবেচনায় রেখে নাটক নির্বাচন করা গেলে উৎসবে ভবিষ্যতে আরো সাড়া মিলবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নাট্যকর্মী হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, এটি আন্তর্জাতিক নামের উৎসব হলেও এটি আসলে একটি আঞ্চলিক উৎসব হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আনা একটি নাটক (ডাকঘর) ছাড়া বাকি কোনো নাটকই সত্যিকারের একটি আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে প্রদর্শনের মতো নয়।
অন্য একজন দর্শক সেলিম আহমেদ, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তিনি ক্ষোভের সুরে বললেন – ঢাকায় এত বড় একটি উৎসব হচ্ছে, তার প্রচারণা খুব কম। যাঁরা শিল্পকলার পাশ দিয়ে চলাচল করেন, তাঁরাও সবাই ঠিক সময়ে ঠিক খবরটি জানতে পারেন না।
শেষ কথা
যে যাই বলুন না কেন ‘প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১’ কোনো রকম বিপত্তি ছাড়াই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এই সফলতার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম ও মেধা ব্যয় করেছেন তিনি হলেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি আইটিআই বিশ্ব কেন্দ্রের যেমন সভাপতি, তেমনি তিনি বাংলাদেশের নাটকের সকল রকম কর্মকাণ্ডের প্রধান পুরুষ। তাঁর প্রচেষ্টাই যে অগ্রগণ্য ছিল এ উৎসবের সাফল্যের পেছনে, তা অস্বীকার করার উপায় কারো নেই। তিনি তাঁর মহতী উদ্যোগ দিয়ে বিশ্বের থিয়েটারের কাছে আমাদের থিয়েটারের মান ঊর্ধ্বে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১-এর সফল আয়োজন ও সমাপ্তি তার সর্বশেষ নিদর্শন।
ভবিষ্যতে আরো সুন্দর ও সফল নাট্যোৎসব এবং বাংলাদেশের নাটক আরো প্রসার লাভ করবে – এই আশাবাদ রইলো এই লেখার শেষ কথায়।