ঋতুপর্ণ ঘোষ ও তাঁর চলচ্চিত্র বিষয়ে ড. কাবেরী গায়েনের নিবন্ধ ‘উস্কে দিয়েছেন, তবে কাঠামোর মধ্যেই’ পড়লাম। ঋতুপর্ণকে তাঁর চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি পাঠ হয়ে থাকবে লেখাটি। এবং যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখার মতোই এই নিবন্ধও একইসঙ্গে অপরাপর পাঠ, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিক্রিয়াকে উস্কে দেওয়ার কাজটি বেশ ভালোভাবে করার ক্ষমতা রাখে।
সেই সূত্রেই ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রে বিশেষত যৌনতার নির্মাণ, শৈলী নিয়ে নিরীক্ষা এবং তারকা অভিনেতা নির্বাচনের প্রবণতা নিয়ে আলোচনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে মূলত এ-লেখার অবতারণা। সূত্র ধরে আসবে ঋতুপর্ণের সত্যজিৎ-উত্তরাধিকারের দায় ও দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক প্রসঙ্গটিও।
‘শৈল্পিক, রুচিসম্মত এবং বাস্তবসম্মত’ হওয়ার পরও ঋতুপর্ণের যৌনতা নির্মাণ ‘নেহাতই বাণিজ্যিক’ হওয়াটা জরুরি কি না – এই জিজ্ঞাসা দিয়ে শুরু করা যাক।
এক্ষেত্রে শুরুতেই চলচ্চিত্রে যৌনতার নির্মাণে বাণিজ্য আর শিল্পের ভেদরেখাটি ঠিক কোন জায়গায় টানা যায়, বা সেটি নির্ধারণ কে করবেন – সেই পুরনো প্রশ্ন।
ঋতুপর্ণের ফিল্মোগ্রাফিতে যৌনতা নেহাতই একটি উপাদান (বাণিজ্যিক অথবা অবাণিজ্যিক) হয়ে আসেনি সবসময়। বরং ঋতুপর্ণের বলা গল্পের কেন্দ্রীয় ঝোঁক হিসেবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে যৌনতাকে চিহ্নিত করা যায় প্রায়ই। প্রথম দিককার ছবি বাড়িওয়ালি থেকে মৃত্যুর আগে মুক্তি পাওয়া শেষ ছবি চিত্রাঙ্গদা পর্যন্ত এই ঝোঁকের বেশ কৌতূহল জাগানো একটি বিশিষ্ট চেহারাও গড়ে উঠতে দেখতে পাই আমরা।
বাড়িওয়ালির কেন্দ্রীয় চরিত্র মধ্যবয়সী বনলতা, বিয়ের ঠিক আগের রাতে সাপের কামড়ে স্বামী মারা যাওয়ার পর যার আর বিয়ে হয়নি। এই একাকী নারীর যৌনতার সূক্ষ্ম, সংবেদনশীল যে নির্মাণ ঋতুপর্ণ বাড়িওয়ালিতে করলেন, বলার স্পর্ধা করি, ভারতীয় চলচ্চিত্রে তো বটেই, বিশ্ব চলচ্চিত্রেও এত নান্দনিক উপস্থাপনা খুব সুলভ নয়। অবদমিত যৌনতার যে সংকেতগুলো তিনি বিশেষত বনলতার স্বপ্নদৃশ্যে তৈরি করেন, বাণিজ্যের ঊর্ধ্বে একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল শিল্পীর পক্ষেই তা সম্ভব। বিপরীতে কাজের মেয়েটির অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলোর অভিঘাত বনলতার বিপন্নতাকে সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে দেয়।
দহনের যৌনতাও কি নেহাত বাণিজ্য? ছবিটিতে যৌনতা আর কর্তৃত্বের রাজনীতির যে মনোযোগভূমি তার সঙ্গে এই নির্মাণ শুধু যৌক্তিক নয়, প্রয়োজনীয় হয়ে আসে।
অন্তরমহল (যা নাকি কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে বাড়াবাড়ি লেগেছে, ঋতুপর্ণের এ নিয়ে অ্যাপলজিও ছিল) একই প্রাসঙ্গিকতায় আলোচিত হতে পারে। এক্ষেত্রে খামতি যা ছিল, বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠার জায়গাটায়।
যৌনতা নির্মাণে সম্ভবত ঋতুপর্ণের সবচেয়ে আলোচিত ছবি চোখের বালি।
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, চোখের বালির যৌনতা
ঋতুপর্ণ-ব্যাখ্যায় সবচেয়ে প্রবলভাবে কি-রোল প্লে করেছে। ওই সামাজিক প্রেক্ষাপটে শরীরকে বিনোদিনীর ক্ষেত্রে এমপাওয়ারমেন্টের একটা টুল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন তিনি। মহেন্দ্রর মায়ের চা খাওয়া থেকে শুরু করে বিনোদিনীর শরীরী সম্ভোগ পর্যন্ত যৌনতার একটা যে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ চোখের বালিতে পাওয়া যায়, সেটা বিনোদিনীসহ প্রধান নারী চরিত্রগুলোর দ্বান্দ্বিক অবস্থান এবং পাশাপাশি পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার মেটাফর হয়ে দাঁড়ায়।
যেখানে এর চড়া প্রকাশের অভিযোগটা ওঠে সেইখানটাতেই বিধবা বিনোদিনীর বিপন্নতাটুকু সবচেয়ে বেশি করে বাজে। সামাজিক, সাংসারিক বঞ্চনা থেকেও, তার সামর্থ্য অনুযায়ী, নিজেরটুকু আদায় করে নেওয়ার জন্য ওই টুলটিকেই ব্যবহার করে বিনোদিনী। এর বেশি তার আয়ত্তে নেই বলেও। আর তা করতে গিয়ে যে কূটভূমিকায় তাকে অবতীর্ণ হতে দেখি, ঋতুপর্ণের বিনোদিনী ঠিক ওইখানেই বিশিষ্ট হয়ে ওঠে।
একটা নির্দিষ্ট সময়কালের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির বিনোদিনী যে তাৎপর্য নিয়ে সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সম্ভাবনাটি তৈরি করতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত পারে না, ঋতুপর্ণের বিনোদিনী সেটা এইখানেই প্রবলভাবে করে। বাঙালি নায়িকাকে তাও আবার রবীন্দ্রনাথের, খল হতে দেখতে কারোরই বোধহয় ভালো লাগেনি। অথচ ঋতুপর্ণের বিনোদিনী রক্তমাংস নিয়ে উঠে আসে মানবচরিত্রের ওই গ্রে এরিয়াতেই।
ঋতুপর্ণের অন্যান্য ছবিতেও যৌনতা এসেছে। তিনি ছবি করেছেন মূলত নারী-পুরুষের ব্যক্তিসম্পর্ক, দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে। অন্তরঙ্গ দৃশ্য এই পরিসরের একটা জরুরি অনুষঙ্গ। সবটা বলা যাবে, শুধু যৌনতা এড়িয়ে – এটা নিশ্চয়ই আমরা ভাবছি না। তাই যদি হয়, তবে যৌনতা দেখলেই আমাদের মনে যে সন্দেহ জাগে – বাণিজ্য করা হলো না তো! এর কারণটা সম্ভবত বাজে দৃষ্টান্তের প্রাচুর্য।
পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে এই অভিযোগ ওঠে না, সিনেমাতে আমরা বিভ্রান্ত হই ওই কূট-দৃষ্টান্তের কারণে। গণমাধ্যম আর শিল্পের পার্থক্য জেনেই এটা মনে হয় আমার। কারণ পেইন্টিং বা মিউজিকের মতো সিনেমাও চূড়ান্ত বিচারে আমার কাছে ব্যক্তিগত উপভোগই। কার সঙ্গে দেখব, অথবা আদৌ দেখব কি না – এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সেখানে থাকে। টেলিভিশন সম্প্রচারের ক্ষেত্রে থাকে সিলেকশন ফিল্টারিং।
ফর্ম নিয়ে ঋতুপর্ণ সচেতন ছিলেন। সহজ ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ওঁর সচেতন নির্বাচন বলেই মনে হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার ন্যারেটিভ ফর্ম উনি কিছুটা ব্যবহার করেছেন উৎসবে। পাহাড়ের মেঘ, ছায়া, কুয়াশা, রোদের লুকোচুরি নিয়ে কাজ করলেন তিতলিতে। এটা নিখাদ অনুসরণই।
কিন্তু ওঁর প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি উনিশে এপ্রিলেই একটা বদ্ধ স্পেসে থেকে গল্প বলার এবং দর্শককে পুরো সময়জুড়ে ধরে রাখার ঝুঁকি তিনিই নিয়েছেন। বাণিজ্যিক সফলতা তো এইখানে একটা বড় বিবেচনায় থাকবার কথা ছিল; যেখানে তাঁর প্রথম ছবি হীরের আঙটি মুক্তিও দিতে পারেননি। তবু ঋতুপর্ণ এই এক্সপেরিমেন্টটাই করলেন। বাজেট বাস্তবতার কথাটা মেনে নিলেও এটা বড় ঝুঁকি ছিল তো বটেই। যেখানে সিনেমা মানেই আমাদের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, বিস্তৃত স্পেস আর ভলিউমের গড়পড়তা স্মৃতি।
উনি ফর্ম নিয়ে কাজ আরো করছিলেন। ন্যারেটিভ ভাঙাচোরায় ওঁর লক্ষণগুলো কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করার মতো। হঠাৎ করে নয়, সইয়ে নিয়েই; শেষ পর্যায়ের ছবিগুলোতে তাঁর গল্প বলার সহজবোধ্য রৈখিক কাঠামোটিকে ভাঙবার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। এবং তা শুধু ফ্ল্যাশব্যাকের ব্যবহারে সীমিত থাকে না। এখানে সব চরিত্র কাল্পনিক একটি ভালো দৃষ্টান্ত। আবহমানে সমান্তরালে দুই সময়কালের দুটি গল্প বলে যাওয়া এবং তাদের একটি আবহমান চেতনার অভিন্ন বিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়ার কাঠামো নির্মাণও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
চিত্রাঙ্গদাতেও ন্যারেটিভ নিয়ে নিরীক্ষার কাজটি করেছেন ঋতুপর্ণ। দর্শক সেটি নিয়েছেও। কারণ ঋতুপর্ণ তাঁর দর্শককে চিনতেন। যেমন চিনতেন সত্যজিৎ। ‘সত্যজিতের কাহিনি ও ফর্ম নিয়ে নিরীক্ষা ছিল বরাবর আসক্তিহীন’, ‘তিনি থোড়াই কেয়ার করেন দর্শক কীভাবে নেবে’ এই বিষয়টিও পুরোপুরি সত্য নয়। সত্যজিৎ রায় তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে তাঁর দর্শকের কথা মাথায় রাখার কথা বলেছেন।১ এমনকি প্রযোজকের লগ্নিকৃত টাকার ব্যাপারেও তাঁর দায় স্বীকার করেছেন তিনি।
স্টার কাস্টিং ওঁর ছবির দুর্বলতা হিসেবে যদি আসে, তবেই কেবল আমি সেটাতে খাপ খুলতে চাইব। মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত বিচারে সেটা একবারই আমার মনে হয়েছে – চোখের বালিতে ঐশ্বর্য রাই। এছাড়া এই বাণিজ্যিক ছবির তারকা নেওয়াটি ওঁর ছবির ক্ষতি করার জায়গায় দেখতে পাই না। অ্যামেচার কাউকে নিয়ে গড়েপিটে নেওয়ার চেয়ে মেইনস্ট্রিমের চড়া অভিনয়ে অভ্যস্ত তারকাদের ভেঙেচুরে রীতিমতো সংবেদনশীল অভিনয় বের করে আনা কোনো অংশে সহজ তো নয়ই, বরং যে বেশ কঠিনই – তা চলচ্চিত্রকারমাত্রই জানেন। এটাও এক অর্থে বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে তাঁর সফলতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি।
নতুন, অভিনেতা নন – এমনদের নিয়েও তো কাজ করেছেন তিনি, রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ রোলে। বেশকিছু উদাহরণ চট করেই মনে আসে। দহনে ঝিনুকের ঠাম্মীর চরিত্রে ঋতুপর্ণ নিলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রকে। অনেকের স্মৃতিতেই তাঁর করা রোলটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। শুভ মহরতে চন্দ্রবিন্দুর গায়ক অনিন্দ্য চ্যাটার্জি কাজ করলেন একটা প্রধান চরিত্রে। ভালোই তো করলেন! খেলার বাচ্চা ছেলেটি, আকাশনীল! বিশ্বের তাবৎ চলচ্চিত্রকার স্বীকার করেন শিশুশিল্পীদের নিয়ে কাজ করাটা পরিচালনার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোর একটি। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে আকাশনীলকে নিয়ে ঋতুপর্ণ যে সফল, ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কেউই বোধহয় অস্বীকার করবেন না। ঋতুপর্ণর মৃত্যুর পর মুক্তি পাওয়া ছবি সত্যান্বেষীতেও অন্যতম প্রধান চরিত্র কালীগাতি করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক (এখন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেসে পড়ান) শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়। ওঁর কাছে মহাভারতসহ বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ নিতে যেতেন ঋতুপর্ণ। কালীগাতির অবয়বটা মিলে যাওয়ায় জোর করে ধরে অভিনেতা বানিয়ে দেওয়া। অন্যান্য ছবিতেও এধরনের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। সুতরাং আনকোরা নতুনদের নিয়েও যে সমানভাবে সফল ছিলেন ঋতুপর্ণ, সন্দেহ থাকে না।
স্টার কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। যে ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি কাজ করছেন তার প্রেক্ষাপট আর বাস্তবতাও এক্ষেত্রে বিবেচ্য। ফাসবাইন্ডার যত সহজে একটি পার্সোনাল ফিল্ম বানিয়ে বসতে পারেন, সেটা তাঁর ইন্ডাস্ট্রি এবং কনটেক্সট সমর্থন করেন বলেই পারেন। এই বিচারে এমনকি সত্যজিৎ আর ঋতুপর্ণের কনটেক্সটও পুরোপুরি এক থাকার কথা নয়।
টালিগঞ্জের অল্প বাজেটের ছবিতে শিল্পনির্দেশনা, সাজসজ্জা আর সেটে পরিপাটি রুচির ছাপ ঋতুপর্ণের অর্জনই বলব। যে ধরনের ছবি তিনি করেন, তার সঙ্গে এর বিরোধ ঘটলেই সেটি নিয়ে কথা হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেটি ‘শৈল্পিক’ এবং ‘বাস্তবসম্মত’ ততক্ষণ এর কৃতিত্বটাই ঋতুপর্ণের প্রাপ্য। কস্টিউম, বিশেষ করে শিল্প নির্দেশনায় ঋতুপর্ণের মুনশিয়ানা চোখে পড়ার মতো। শত কোটি টাকার বাজেটে বলিউডে যেখানে দেবদাসের মতো ছবিতে সাজসজ্জা আর সেট চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, ঋতুপর্ণ তাঁর শতাংশ বাজেটের ছবিতে সেটার উৎকর্ষের নমুনা দেখিয়ে দেন। বিশেষ করে পিরিয়ড ফিল্মে তিনি অনবদ্য। এমনকি ঘরে-বাইরের অন্দরসজ্জাতেও খামতি পাই, চোখের বালি সেখানে বাস্তবসম্মতভাবে নান্দনিক। অন্তরমহল, নৌকাডুবি অনন্য দৃষ্টান্ত।
পোশাকসজ্জার ব্যাপারে ওঁর অবসেশনটা চরিত্রের মধ্যেও চারিয়ে দেন তিনি, সত্যি। যে পরিসরের গল্প তিনি বলেন, সেখানে সেটা অস্বাভাবিক লাগেও না। ওঁর নায়িকারা যখন খুব বাছাকোছা দারুণ সব শাড়ি পরেন, ওঁর গল্পের নারীপরিসরের নিজস্ব গন্ডিতে ওই বাস্তবতা বেখাপ্পা খুব কমই লেগেছে আমার।
সত্যজিৎ ঘরানার উত্তরাধিকার হিসেবে ঋতুপর্ণকে অবশ্যই চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ‘সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর নির্মাণকে অনেকেই একাকার করে দেখেন’ – এই দেখার সুযোগ আসলে ওই ‘রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় ঘরানার’ ‘শিল্পরুচি’ এবং ‘গল্প বলার ধরন কিংবা সংগীতের ব্যবহার থেকে শুরু করে যে অভিজাত পরিপাটি রুচির নির্মাণ’ পর্যন্তই। সত্যজিৎও গল্প বলার এই শৈলীর অনেকটাই তো নিয়েছেন পশ্চিম থেকে।
কিন্তু বিষয় অথবা বক্তব্য নির্বাচনের জায়গাটিতেই স্বতন্ত্র হয়ে যান সত্যজিৎ-ঋতুপর্ণ। সত্যজিতের মানব ও সমাজদর্শনের তুলনামূলক বিস্তৃত ক্যানভাস আর বিশ্লেষণ থেকে ঋতুপর্ণ সরে আসেন নারী-পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের মনোভূমিতে। এখানেও অ্যান্ড্রোজিনির নিজস্ব চলনে বিশেষত নারী মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উদঘাটন ঋতুপর্ণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে শুরু থেকেই প্রকাশিত হতে দেখি। সত্যজিৎ এখানে দূরের মানুষ। সুতরাং কন্টেন্টের বিচারে অভিঘাত বা ধাক্কার বোঝাপড়ার চরিত্রটাই আলাদা হয়ে পড়ে। ছবিতে বক্তব্যের অনুসিদ্ধান্তগুলোও।
ব্যক্তিসম্পর্কের যে জায়গাগুলোতে এই দুজন চলচ্চিত্রকারকে একই সাধারণ তলে কখনো কখনো পাওয়া যায়, সেখানে সত্যজিতেও অনেকবারই কাঠামো দায়বদ্ধতার কথা মনে হয়েছে আমার। তিনকন্যার সমাপ্তি (রবীন্দ্রনাথের গল্প) থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাতেও (সত্যজিতের নিজের লেখা)।
ড. গায়েন কিছু প্রসঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কাঠামো-দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে এই ছবিটিও আলোচিত হতে পারে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় মনীষার বড় বোনকে আমরা শেষ পর্যন্ত তার বাবার ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধেই সমর্পিত হতে দেখি। শুরু থেকেই এই চরিত্রটির মধ্যে অভিসারিণীসুলভ একটা পাপবোধ মিশিয়ে দেন সত্যজিৎ। বিপরীতে তার স্বামী মদ্যপ, জুয়ায় অভ্যস্ত হলেও তার প্রতি তৈরি করা হয় দর্শকের সহানুভূতি। সন্তানের দোহাই দিয়ে সত্যজিৎ শেষ পর্যন্ত এই নারীর ঘরে ফিরে আসাটাকে জাস্টিফাই করেন।
পিকুতেও প্রায় একই নৈতিকতার দায়বদ্ধতায় মূল চরিত্রের টানাপোড়েনের নিষ্পত্তি হতে দেখি।
কাঞ্চনজঙ্ঘার মনীষাও কি আসলে চূড়ান্তভাবে কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসে? তার পাণিপ্রার্থীর চরিত্রটি তৈরিই করা হয়েছে অপছন্দনীয়ভাবে। মনীষার সঙ্গে সফিস্টিকেশনের বৈপরীত্যটাই ওদের সম্ভাব্য সম্পর্কের মূল ট্র্যাজেডি হতে থাকে। তাই শেষ পর্যন্ত তাকে মনীষার প্রত্যাখ্যান আসলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচি আর অহংবোধকেই স্বস্তি দেয়।
ঘরে বাইরে (কেন সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথকে এইখানে বেছে নেন, সেটিও বিবেচ্য। ব্রাহ্ম নৈতিকতার রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকার তিনিও যে চলচ্চিত্রে বহন করেন) আরেকটি দৃষ্টান্ত।
সত্যজিৎও শেষ বিচারে উস্কে দেন, ঝুঁকি নেন না।
একমাত্র চারুলতাই ব্যতিক্রম হয়ে থাকে।
গল্পটাই দেখা আমাদের মূল প্রবণতা হলেও চলচ্চিত্রকে শুধুমাত্র একটা অ্যাকাডেমিক টেক্সট হিসেবে পাঠ করতে পারি না আসলে। শিল্পের রসাস্বাদনটাও প্রয়োজনীয়। সেজন্য সবকিছুর পরও চলচ্চিত্রকে শিল্পও হয়ে উঠতে হয় আদর্শ বিচারে। তাই আলো, শব্দ, ছবি, রং, অভিনয় – কোনোটাই আসলে মাছ ঢাকতেই শুধু আসে না, ওসব মিলেই সিনেমা হয়ে ওঠে। তাই আমি ‘একে’ এবং ‘তাকে’ও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাই। সংগতির অভাবটা না যতক্ষণ বলে ওঠে – বরং আমাকে দেখো। একটা পেইন্টিংয়ের যেমন আধেয় বিশ্লেষণই শেষ কথা হতে পারে না – এই জায়গায় আমার বোঝাপড়াটা সেইভাবে কাজ করে।
নির্বিচারে ঋতুপর্ণের সব ছবিই আবার শিল্পের মানদন্ডে টিকে থাকবে এমনটা ভাবারও বিশেষ কারণ নেই। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন, প্রতিবছর বিরতিহীনভাবে (কোনো কোনো বছর দুটি ছবিও বানিয়েছেন) ছবি বানানোর বেলায় তাঁর ক্রুদের কাজ ছাড়া বেকার বসিয়ে না রাখার দায় কাজ করত তাঁর মধ্যে। তাই তিতলি, খেলার মতো হালকা চালের রিফ্রেশিং ছবিও তিনি বানাতেন। কিন্তু বাড়িওয়ালি, সব চরিত্র কাল্পনিকের মতো কিছু ছবি অবশ্যই শিল্পের ছাঁকুনি পার করবে বলে আমার বিশ্বাস।
আবার ‘ব্যক্তিক মানুষের রক্তাক্ত হৃদয় যা নগরায়ণের কারণে একদিন শুরু হয়েছিল সোয়া তিনশো বছর আগে সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলিকাতা জুড়ে, নাম হয়েছিল কলিকাতা, শতকে শতকে ফুলেফেঁপে উঠেছে যে শহর সেই শহরের মানুষদের হাসি-কান্না, জটিলতা-রক্তক্ষরণের কবিতা লেখা হয়েছে সেলুলয়েডে। এ এক নিরন্তর চেষ্টা। সেই চেষ্টার সবচেয়ে কাব্যিক প্রকাশ বুঝি ঋতুপর্ণের চিত্রাঙ্গদার শেষ দৃশ্যের শেষ সংলাপ, ‘কোনো রূপান্তরই সম্পূর্ণ নয়, পদ্ধতিটা চলতেই থাকে।’ সেলুলয়েডের এই কবিতা আসলে শুধুই ‘কৌশলী নির্মাণে’ সম্ভব নয়, শুধু ফর্মের কারসাজিতে তৈরি হয়ে ওঠে না এই কাব্যিক ইন্দ্রজাল। যেমন শুধু ছন্দের কঠিন বাঁধুনিতেই কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে না, ছুঁতে পারে না পাঠকের হৃদয় আর বোধকে। কবিতার মতোই ‘সিনেম্যাটিক মোমেন্ট’ তৈরির ওই ম্যাজিকটুকু নিবিড়ভাবে চলচ্চিত্রকারের মেধা আর তাঁর সৃষ্টিশীল প্রকাশের ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। ঋতুপর্ণ এত অনায়াসেই তা করে ফেলতেন বলেই হয়তো ধন্দ লাগে।
চলচ্চিত্রের দায় নিয়েও অনেক কথা হয়ে গেছে এতদিনে। কবিতার যেমন দায় নেই সমাজ বদলে দেওয়ার, মিউজিকের দায় নেই শুধু যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার, সিনেমার কাঁধেই বা কেন চাপবে অচলায়তন ভাঙার, কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার দায়? প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারও? স্রেফ বিশিষ্ট একটি মুড তৈরিও কখনো শিল্পের সার্থকতা হতে পারে। চিত্রকলা, মিউজিক অথবা কবিতার মতো সিনেমার ক্ষেত্রেও তা সত্যি।
‘রবীন্দ্রনাথের গানের আশ্চর্য, অন্তর্লীন বেদনা’ অথবা ‘সত্যজিতের অন্তর্নিহিত অনুসন্ধান’ যদি কেউ ঋতুপর্ণের নির্মাণে না পান, তবে শিল্পী হিসেবে ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিতের মহিমার দাবিদার হন না বড়জোর, কিন্তু তাকে আপসকামী বা বাণিজ্যিকতার কাছে সমর্পিত হতে হবে – জরুরি নয়।
মুশকিল হলো আদর্শ-বিচারে কবিতা, চিত্রকলা বা সংগীতের মতো স্বাধীন শিল্প মাধ্যম চলচ্চিত্র নয়। পুঁজির সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই তাকে হয়ে উঠতে হয়, এবং তা নির্দিষ্ট সময়কাল আর ভূগোলের ভিন্ন ভিন্ন
বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ভিন্ন চেহারাও পায়। সুতরাং সিনেমার বাণিজ্যিকতার ঝুঁকি এবং ঝোঁক দুটোই আরেক বাস্তবতা বটে। সেই বাস্তবতার জাল কেটেই কেউ যখন সেলুলয়েডে একটা কবিতা লিখে ফেলেন, তার কৃতিত্ব যদি বেশি নাও হয়, কম নয় কোনো মতেই।
এই বিবিধ বিচারেই এস্টাবলিশমেন্টকে আহত না করে ভাবনা উস্কে দেওয়ার কৌশলটাতেই থাকতে চেয়েছেন ঋতুপর্ণ; ওঁর আগেই পরমার মতো ছবির দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও। হয়তো সে কারণেই ঋতুপর্ণ ছবি করিয়ে হিসেবে কাঠামোর স্বীকৃতিতেই সমসাময়িক বাংলার সফলতম পরিচালক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এই গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়েই ওঁর এক অর্থে কিছুটা পার্সোনাল ফিল্ম করে ওঠার দিকে যাত্রার লক্ষণ তাই খুবই কৌতূহলকর ছিল। আশা করতে ইচ্ছা হতো ওইখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রযোজক, দর্শকও ঋতুপর্ণকে ওইভাবে মেনে নিতে শিখে যাবে। সেটা এ অঞ্চলে বোধহয় কেবল ঋতুপর্ণই পারতেন।
সবশেষে কোনো মহৎ চলচ্চিত্রকারই আসলে ‘অনুসন্ধান নিষ্পত্তির’ দায় বোধ হয় নেন না। বরং দর্শককে উস্কে দিয়ে একেকটা ভাবনার জানালা উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে সম্ভাবনার পরিসরকে ছড়িয়ে দিতে প্রয়াস পান। বিশ্বচলচ্চিত্রের কালোত্তীর্ণ ছবিগুলো সে সাক্ষ্যই দেয়।
n সারওয়ার রেজা জিমি, চলচ্চিত্রকর্মী
১. Usually he strongly engages them [the audience] in the best tradition of popular art. As he once said, ‘Popular taste has produced Greek Drama, Shakespeare, The Magic Flute, Chaplin and the Western…. I do not know a single film-maker who has been dismayed by a wide acceptance of his work.
Satyajit Ray : The Inner Eye, by Andrew Robinson, page-55