আ না ই স লা ম
বাংলাদেশের সংস্কৃতির গোলার্ধে ভাস্কর নভেরা আহমেদ এক নির্জন ভূখণ্ড। জীবন্ত কিংবদন্তি এই ভাস্করের জীবন ও শিল্প অভিজাত জীবনতৃষ্ণার বয়ান। ৪১ বছরের স্বেচ্ছা-নির্বাসনে, নিভৃতবাসিনী এই ভাস্কর থাকেন প্যারিসে। সম্প্রতি চার দশকেরও (১৯৬৯-২০১৪) বেশি সময়ের অগুনতি সৃষ্টির কিছু নির্বাচিত শিল্পকর্ম নিয়ে রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনী হয়ে গেল প্যারিসে নভেরার। মোট শিল্পকর্মের সংখ্যা ৫১। ৪২টি চিত্রকর্ম এবং ৯টি ভাস্কর্য। স্বামী গ্রেগোয়া ব্র“নসের উদ্যোগে এই প্রদর্শনীর কিউরেটর প্যাট্রিক আমিন। দুই মাসব্যাপী (১৬ জানুয়ারি-১৬ মার্চ) এই রেট্রোসপেকটিভের গুরুত্ব নানা কারণে।
নভেরার আত্মপ্রচারে কুণ্ঠা থাকলেও এই প্রদর্শনী তাঁর আত্ম-উন্মোচনের ইতিহাস। এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো তাঁর সৃষ্টিকর্ম, সৃষ্টি-প্রেরণা, সৃষ্টি-চেতনার সমাপ্তি ঘটেনি। তার উদ্বোধন ঘটল আবার। দীর্ঘদিন দেশছাড়া। দৃশ্যপট থেকে অনুপস্থিত। তাঁর অবর্তমানে বিশেষ মহল এবং ব্যক্তিদের মনগড়া ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত মিথ্যাকে, কপটতাকে ভেঙে দেয় নভেরার সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। তাঁর নিবিড় সৃষ্টিশীলতার ফসল এই প্রদর্শনী। নভেরা দৃপ্ত ছিলেন আর এখন এই বয়সে এসেও মনের দিক থেকে প্রবল যুদ্ধ করা এক নারী। এই প্রদর্শনী ব্যক্তি নভেরার বেড়া পেরিয়ে অবশ্যই বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
নভেরা মূলত ভাস্কর। কিন্তু চিত্রকর হিসেবে তাঁর শক্তি, নিষ্ঠার পরিচয় সাম্প্রতিক চিত্রকর্মসমূহ। আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার তাগিদে শিল্পীকে খুঁজতে হয় শিল্পের নানা অলিন্দ, শিল্পের শরীর। তাঁর সৃষ্টিকর্মকে বিশ্লেষণ করতে গেলে ব্যক্তি নভেরাকে জানাটা খুবই জরুরি। ’৭৪ সালে বড়দিনে প্যারিসে এক সড়ক দুর্ঘটনা নভেরার জীবন-ভাবনার শর্তগুলো পালটে দেয়। তাঁর বিশ্বাস, চেতনা বদলে গিয়েছিল অতি দ্রুত। স্বজন-আত্মীয়দের ব্যবহারে তাদের স্বরূপ উন্মোচনের পাশে জীবনকে চিনেছিলেন নতুনভাবে। হার না নানা মনোবলের বিরলতম নজির নভেরা। ২০১০ সালের নভেম্বরে স্ট্রোকের পর পুরোপুরি হুইলচেয়ারে আবদ্ধ। চেয়ারে বসেই ছোট ছোট কাজ করেন ক্যানভাসে। ’৭৪-এর দুর্ঘটনায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তলপেট। তার চিহ্ন নিয়ে খানিকটা খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। আর গত চার বছর আগের স্ট্রোকে ডান পাটি আক্রান্ত হয়েছে।
বহুদিন ধরেই নভেরা আছেন নিজস্ব আড়ালে। দেশত্যাগের এক অজানা ধোঁয়াটে অধ্যায়, তারপর স্বেচ্ছা-নির্বাসনের দীর্ঘ অন্তরাল। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, মৃদু হাসিতে বুঝিয়েছেন – অন্তরালে থাকাটা তাঁর নিজস্ব জীবনচর্যার ব্যাপার।
মানুষের কোলাহল, স্তুতি, প্রশংসা থেকে আগলে রাখা তাঁর ভুবন। গত চল্লিশ বছর ধরে যে কাজগুলো করেছেন তাতে ক্রমাগত কয়েকটি ইমেজ বা রূপ পুনরাবৃত্ত হতে দেখা যায়। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, তিনি একই বিষয় পুনরাবৃত্তি করেছেন। আর নভেরার চিত্রকর্মের অন্তর্জগৎ দেখে মনে হবে, তিনি সবসময় স্বদেশেই যেন বসবাস করছেন।
তাঁর শিল্পজিজ্ঞাসার প্রথম পাঠ মায়ের কাছে। উদার ও সংস্কৃতিমনা পিতামাতার সান্নিধ্যে লালিত হওয়ায় মনে এক ধরনের দৃঢ়তা ছিল নিজেকে নিজের মতো করে প্রকাশ করার। নভেরার জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ (ক্যাটালগ সূত্রে) সুন্দরবনে। কর্মসূত্রে বাবা সৈয়দ আহমেদ কর্মরত ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলে। চাচা আদর করে নাম রাখেন নভেরা। ফার্সি শব্দ নভেরা অর্থ নবাগত, নতুন জন্ম। পরবর্তী জীবনে, নভেরা শব্দটি যথার্থ অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের ভাস্কর্য আধুনিক ভাষা পেয়েছিল।
নভেরার বিস্তারিত জীবনী রচনার ক্ষমতা ও পর্যাপ্ত তথ্য সম্ভবত কারো হাতেই নেই। কিন্তু তাঁর কাছে শোনা তথ্য দিয়ে এই লেখা নভেরার জীবনের রূপরেখা। উদার, øেহশীল বাবা হয়েও অল্প বয়সে নভেরাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর বাবার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে কিশোরী নভেরা ভাস্কর হবার বাসনা ব্যক্ত করেন। যদিও বাবা মেয়েকে আইনশাস্ত্র পড়তে পাঠিয়ে দেন লন্ডনে ১৯৫১ সালে। কিন্তু ভাস্কর হবার অদম্য স্পৃহায় স্বাধীনচেতা নভেরা যোগ দেন লন্ডনের সিটি অ্যান্ড গিল্ড (City & Guild) স্টোন কাভিং ক্লাসে। ১৩ বছরের নভেরা থাকতেন লন্ডনে বড় বোনের বাড়িতে। পরে ক্যাম্বারওয়েল স্কুলে পাঁচ বছর অধ্যয়ন শেষে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা প্রাপ্তির পর দুবছরের জন্য যান ফ্লোরেন্সে। এ সময়টাতে বিভিন্ন গুণী চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, লেখকদের সান্নিধ্য তাঁর সৃজনসত্তাকে সমৃদ্ধ করে।
দেশে ফিরে ১৯৫৭ সালে শুরু করেন শহীদ মিনারের কাজ। সহযোগী ছিলেন শিল্পী হামিদুর রাহমান। পরের বছরই ১৯৫৮-তে আইয়ুব খান সরকার নভেরাদের স্টুডিও ধ্বংস করে দেয়। একই বছরে ঢাকাতে প্রথম মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য প্রদর্শনী করেন। ’৫৯ সালে ছয় মাসের জন্য বার্মাতে যান ভগবান বুদ্ধের দর্শনে বিশ্বাসী ভাস্কর। দেশে ফিরে সুলভ উপকরণ দিয়েই তাঁর ভাস্কর্যচর্চা শুরু করেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা-জারিত নভেরা ১৯৬০ সালে ঢাকায় একক প্রদর্শনী করেন। বড়মাপের সে প্রদর্শনী প্রকৃত অর্থেই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিজগতের জন্য ছোটখাটো বিপ্লব। প্রদর্শনীর অধিকাংশ শিল্পকর্মই ছিল বিশাল আকৃতির। বিষয়বৈচিত্র্য, উপকরণ ও মাধ্যম গুণে প্রতিটি ভাস্কর্য ছিল তাঁর সৃজনতৃষ্ণা এবং সাবলীল নির্মিতির স্বাক্ষর। আধুনিক ভাস্কর্যের এই প্রদর্শনীটি ছিল জাতিসংঘ ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। ‘ইনার গেজ’ (Inner Gaze) শিরোনামের প্রদর্শনী ছিল নভেরার শিল্পভাবনার ধ্র“পদ অভিজ্ঞান, যার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন ভাস্কর হিসেবে বিরল সমীহ।
প্যারিসে নভেরার সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর ৫১টি শিল্পকর্মের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য স্বল্প পরিসরে লেখা অসম্ভব। কারণ নভেরার সৃষ্টি মানেই ব্যক্তি নভেরাকেও আমূল অন্বেষণ। সে কারণেই ফিরে যেতে হয় ভাস্কর নভেরার যাত্রাপথের প্রথম পর্বে। ইউরোপ পর্বের কাজগুলো মাটি দিয়ে করে কাস্ট করতেন ধাতুতে। কিন্তু দেশে কাস্টিংয়ের সমস্যার জন্য তিনি সিমেন্টে কাজ শুরু করেন। আর এ পর্বে উপকরণের জন্যই ভাস্কর্যের ফর্ম ও আঙ্গিক নিয়েও তিনি মগ্ন হন নিরীক্ষার নতুন জগতে। সৃষ্টির অসীম পিপাসায় নিজের ভাবনাগুলো ফুর্তি পায় বিমূর্ত ধারায়। ঢাকার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দেয়ালের রিলিফটিতে চিত্রিত হয়েছে গ্রামীণ জীবন। দেয়ালচিত্রের দ্বিমাত্রিক জগতে তাঁর অনুপ্রেরণা লোকশৈলীর পুতুল। কাঠ খোদাইয়ের কাজে নভেরা খুব কঠিন জটিল কোনো নকশা করেননি। বরং তিনি সচেষ্ট ছিলেন কাঠের ভাস্কর্যগুণ বজায় রেখে তারই অনুষঙ্গে মাধ্যমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রাখতে। ভাস্কর্যের মতো শ্রমসাধ্য মাধ্যমে নভেরা কাজ করেছেন নিজস্ব দর্শন ও সৃষ্টির তাগিদে। রেঙ্গুনে বুদ্ধমূর্তি দর্শনে মোহিত নভেরা করেছিলেন বিশাল আয়তনের সিটেড বুদ্ধা (Seated Buddha)| মাধ্যমের গণ্ডিতে থেকেই তিনি ফর্ম ও স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছুঁতে চেয়েছেন সৃষ্টির আকাশকে। ‘ফ্যামিলি’ (Family) কিংবা ‘গিভ আস দিজ ডে’ (Give us this day) জাতীয় কাজে রয়েছে সেই গুণ, যাকে ‘অর্গানিক ক্যারেক্টার’ বলা হয়। এ পর্বের অনেক কাজে দেখা যায় এই সচেতনতার অনুষঙ্গ। তাঁর আশপাশের জৈবজীবন (Organic life) কখনো বা যাপিত জীবনের নিসর্গ থেকেও অনুপ্রাণিত হয়ে ড্রইং করেছেন মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্যের। ‘ষাঁড়’ ভাস্কর্যটি বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের সামনে উন্মুক্ত সবুজ চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে বা দুটো ফিগার জাতীয় কাজগুলো এমনভাবে রূপায়িত – যা প্রকৃতিলগ্ন, প্রকৃতির অংশ বলেই মনে হয়।
তাঁর সৃষ্টিচেতনায় একই সঙ্গে বিরাজ করেছে প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রান্তর, ঋজু, খাড়া নুয়ে পড়া গাছ, অরণ্যরাজির ছায়া, এর পত্রপল্লবের সবুজ ভেদ করা সূর্যের আলো। প্রকৃতির চিত্রকলাকে তিনি মূর্ত করেছেন ভাস্কর্যের শরীরে। নানা আকৃতির গহ্বর, ছোট-বড় ফাঁকফোকর – আলোছায়ার কারিকুরি। প্রকৃতিলগ্ন ভাস্কর্যসমূহের মধ্যে আছে ‘সিটেড উওম্যান’, ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ (১৯৬৯), ‘মেডিটেশন’ (১৯৬৮)।
‘ইনার গেজ’ প্রদর্শনীতে নভেরা বলেছিলেন – তাঁর ভাস্কর্য প্রকৃতির অংশ। … আমরা ভাস্কররা নগর পরিকল্পনা, হাসপাতাল, বাড়িঘর, কারখানা নির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারি। … We must ignite among our people the spark of curiosity, about the inner visions, meanings & truth of life (which can only be by bringing art within the horizon of our city life)| নভেরার শিল্পভাবনায় ভাস্কর্য ও স্থাপত্য বরাবরই হাত ধরে এগিয়েছে। আর সে সূত্রেই এর প্রথম পর্বের বেশিরভাগ কাজকে বলা হয় মনুমেন্টাল – larger than life. স্থাপত্যের বিশালতা আর ভাস্কর্যের গঠন-সুষমার স্রষ্টা নভেরাকে বলা হতো আর্কিটেকচারাল স্কাল্পট্রেস (architectural sculptress)| ১৯৬১ সালে তিনি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের আমন্ত্রণে লাহোরে যান সেখানে অনুষ্ঠিত ‘অল পাকিস্তান পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচার’ প্রদর্শনীতে অংশ নিতে। প্রদর্শনীতে ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ নামে ভাস্কর্যে তিনি পান রাষ্ট্রপতির প্রথম পুরস্কার।
ভাস্কর রঁদ্যা যেমন শিবের প্রলয়নৃত্যে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তেমনি শিবের ভাস্কর্য গড়ার স্বপ্নে নভেরা শিখেছিলেন ভরতনাট্যম। ১৯৬১ সালে যান বম্বেতে। বম্বের কলামন্দিরে গিয়েছিলেন নৃত্যের যথার্থ পূর্ণাঙ্গ অনুশীলনে। প্রায় দেড় বছর নৃত্য শিক্ষাকালে মঞ্চেও নেচেছেন।
ছক ভেঙে বেরোতে চাওয়া নভেরা সীমাবদ্ধ বৃত্তের মাঝে ধরে রাখেননি নিজেকে। দেখা ও জানার নেশায় ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশে। দৃষ্টির ফ্রেমে শুধু নিসর্গসৌন্দর্য নয়, দেখেছেন ভৌগোলিক পরিবেশে বদলে যাওয়া নানা সংস্কৃতি আর কীর্তির শাশ্বত, সংবেদনশীল আন্দামান নির্মাণ। ১৯৬৮-তে গিয়েছিলেন লাওসে। তার আগে অবশ্য দীর্ঘ ভ্রমণে যান থাইল্যান্ডে আর ১৯৬৩ সালে প্যারিসে। পরিচিত হয়েছিলেন সমকালীন শিল্পের দুই নৃপতি ভাস্কর সেজার এবং ভাস্কর জিয়াকোমেত্তির সঙ্গে। ১৯৬৬ সালে প্যারিসে ফিরে ছিলেন দীর্ঘদিন। প্রচুর কাজও করেছিলেন। তারই মাঝে বিরতি। শিল্পচর্চার এক পর্বে দেখার নেশায় ছুটে গেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ইউরোপের বিভিন্ন শিল্পনগরীতে। গেছেন ভারত, বার্মা, নেপালের বিভিন্ন মন্দির দর্শনে। কম্বোডিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া ভ্রমণ শেষে গিয়েছিলেন লাওসে। আমেরিকার যুদ্ধবিমানের ভগ্নাংশ, ভগ্নাবশেষের সরলীকৃত ব্যবহারে মূর্ত করেছিলেন যুদ্ধের আগ্রাসী রূপকে। পড়ে থাকা, পাওয়া যন্ত্রাংশের জোড়াতালি দিয়ে জন্ম দিয়েছেন নিজের নিভৃত আবেগকে। পাথরের স্তব্ধতা, ধাতুর কাঠিন্য নভেরার পেলব, কর্মিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়ায় পেয়েছে ফর্মের লাবণ্য স্ট্রাকচারাল ফিলিংস। এই ভাস্কর্যগুলো নিয়ে প্রথম আউটডোর স্কাল্পচার প্রদর্শনী করেন ১৯৭০ সালে। ব্যাংককের এই প্রদর্শনীতে ৩৩টি মনুমেন্টাল ভাস্কর্য ছিল; এর মধ্যে ১১টি ছিল ইন্দোচীনের যুদ্ধে মার্কিন বিমানের ভগ্নাংশ দিয়ে তৈরি। ব্যাংককের দোইয়ান দ্য লা ফ্যাকাল্টি দ্যে আর্টস ডেকোরেটিভ দ্য লা ইউনিভারসিতে দ্য শিল্পাকর্ন (Doyen de la faculté des Arts Décoratifs de l’université de Silpakorn) ছিল প্রদর্শনীর আয়োজক। দশ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর কাজগুলো ছিল বিমূর্ত-আধাবিমূর্ত ধাঁচের। ধাতুর পাত বাঁকিয়ে পিটিয়ে ঢালাই করে নির্মাণ করেছেন ভাস্কর্যের শরীর। আর ধাতুর জমাট স্তব্ধতাকে ভেঙে যে বিনির্মাণ তাতে স্পষ্ট স্রষ্টার মননের তাপ ও সৌন্দর্য। দম্পতি (১৯৬৯), লুনাটিক টোটেম (১৯৬৯), পরিবার (১৯৬৯), জেব্রা ক্রসিং (১৯৬৮), শুটিং স্টার (১৯৬৮), ইকারুস (১৯৬৯) ইত্যাদি ভাস্কর্য তাঁর বিরামহীন রূপতৃষ্ণার স্বাক্ষর।
১৯৭০ সালের অক্টোবরে ব্যাংককের প্রদর্শনী শেষে প্যারিসে ফিরে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে। তিন বছর পর প্যারিসে করা কাজগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করেন গ্যালারি রিভ গোসে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে। ১২টি ভাস্কর্য এবং ২৪টি চিত্রকর্ম ছিল প্রদর্শনীতে। অধিকাংশ কাজ ১৯৭১ থেকে ’৭৩ সালের মধ্যে করা। দুটো ভাস্কর্য ছিল ১৯৬৬ সালের। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে দেখা যায় সাপের ভাস্কর্য নিয়ে নভেরার একটি ছবি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাপ, পাখি, পেঁচা বিষয় হিসেবে ছিল তাঁর প্রিয়। ব্যাংকক থেকে তিনি একটি পেঁচাও নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে পোষার জন্য। এই পেঁচাটি তিনি ‘পাখী’ শিরোনামে করেন ১৯৭৩ সালে। মূল কাজটি ধাতুকরণে করা হয়েছিল। নভেরা বিশ্বাস করেন প্রত্যেকটা আকৃতির নিজস্ব একটা স্পিরিট আছে, শক্তি আছে। সেই অনুভূতিটাকেই তিনি গড়নে ও গঠনে মূর্ত করেছেন ভাস্কর্যের শরীরে।
আদিম সরীসৃপ সাপ হলো মানবসভ্যতার একটি প্রাচীনতম মোটিভ এবং টোটেম। এবং কতগুলো আছে যার আবেদনে তা আতঙ্কের অভিজ্ঞান। ‘লো নাগা’ (১৯৭১), ‘কোবরা’ (১৯৭১) নামে সাপের বিশাল আয়তনের ভাস্কর্যকে গড়েছেন এক নতুন আঙ্গিকে।
অনেক অভিজ্ঞতার জারণে সমৃদ্ধ ভাস্কর নভেরা। তাঁর শিল্পকর্মের মূল উপজীব্য মানুষ, জীব বা শুধু কাঠামো। ফিজিক্যাল রিয়েলিটি। বস্তুর কাঠামো বা মানুষের গড়ন যাই হোক না কেন, তাতে আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ধরা-ছোঁয়া-স্পর্শের অতীত সে অনুভূতির স্তর।
১৯৭৪ সালে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন দুমাস। পরের ছয় মাস কাটাতে হয়েছে পুনর্বাসন সেন্টারে। আত্মীয়স্বজনহীন প্রহরগুলোতে অনিবার্যভাবে মনে হয়েছে আলোহীন অন্ধকারে তিনি। কিন্তু বন্ধু গ্রেগোয়া, পেশায় স্থপতি, নেশায় আলোকচিত্রী নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই প্রেম পরিণয়ে রূপ নেয়।
একাকিত্ব বা অস্থির যন্ত্রণাটা নভেরা ভালোভাবে জেনেছেন হাসপাতালের দিনগুলোতে। যাপিত জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত শারীরিক কষ্ট, সংকটের জমা চাপ নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। উঠে দাঁড়িয়েছেন শিল্পে ভর করে, শিল্পকে মুঠোয় করে।
নভেরার চিত্রকর্মে বিষয়, রচনাশৈলীতে কোনো অভিনবত্বের ঘোষণা নেই, প্রয়াস নেই। অথচ সামগ্রিক শিল্পকর্ম অসাধারণ ব্যতিক্রমী। এক অনায়াস দর্শন তাকে দর্শকের সমীপবর্তী করে। গত কয়েক বছরে করা কাজগুলো বেশির ভাগই আয়তনে ছোট। দেখে মনে হতে পারে অসমাপ্ত। কিন্তু সেই মিনিমালিজম বা বলা যায় অসমাপ্তিরও যেন একটা পরিপূর্ণতা আছে। ক্যানভাসের জমি বহুভারে আকীর্ণ নয়। আধুনিকতাবাদীদের মতো অতি জটিল বা কাল্পনিক চিত্রকল্প রূপায়িত করার প্রবণতা নেই। তাই তাঁর ক্যানভাসে দৃশ্যের ব্যঞ্জনা, পরিচ্ছন্নতা থাকে। জনশূন্য দৃশ্যপটে আকাশ, মাটি, গাছ, মেঘের বিচিত্র বিস্তার ও খেলা থাকে। নভেরা আত্মমগ্ন কিন্তু চিত্রজগৎ আত্মবদ্ধ নয়। এ সমস্ত চিত্রকর্ম তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত এক রিলিজ বা অবমুক্তি।
পটে নিসর্গের গাছের পাতা স্থির কিন্তু স্তব্ধ নয়। ফলে স্পন্দন অনুভব করা যায়। তাঁর স্মৃতির আয়নায় ধরা স্বভূমি বাংলাদেশ। চেনা শেকড় থেকেই সৃজন রচনা। ‘নিঃসঙ্গ’, ‘সূর্যাস্ত’, ‘আলোর পথ’, ‘অপুর ভুবন’, ‘মানবতা’, ‘বর্ষাকাল’, ‘কক্সবাজার’, ‘পাখীর কলতান’ চিত্রকর্মগুলো দেখে বোঝা যায় হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও হৃদয়ে সজীব স্বদেশ নামের ভূখণ্ডটি।
ছবির পর ছবিতে নভেরা নিজ স্বপ্ন, স্মৃতি, কল্পনা, কাক্সক্ষাকে তাঁর দেখার চোখ দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন। তেমনি এ সমস্ত সৃষ্টিতে তাঁকেও আমরা কিছুটা হলেও দেখতে পেরেছি। সত্যকে সৌন্দর্যে অঙ্কিত করতে শিল্পীকে অনেক সময়ই আপাত স্বাভাবিকতা ভাঙতে হয়। ভেঙে এগোতে হয়। নভেরার ক্যানভাসে প্রকৃতি ও মানুষ মিলে সে রহস্যময়তার সৃষ্টি করে। তাঁর চিত্রকর্ম বিমূর্ত নয়। ক্যানভাসে নিজস্ব শৈল্পিক শাসন থাকলেও তার দৃশ্যবাস্তবতার কোনো লজিক নেই। ফলে এই রহস্যময়তা এক একজনের কাছে এক একভাবে প্রতিভাত হবে। তাঁর মানব-মানবী উপস্থাপনে আছে কল্পরূপের মাত্রার আধিক্য। মনে হবে ফেলে আসা অতীত বা কোনো দূর ভবিষ্যৎ তাতে উঠে এসেছে। সমুদ্রতটে নারী, পুরুষ, প্রকৃতি, মৃত পাখি – আপন তন্ময়তায় মগ্ন। ‘লাস্ট প্যারাডাইস’ বিস্তীর্ণ সমুদ্রতটের চিত্ররচনায় রূপকের শরীর ছুঁয়ে গেছে। আধুনিক চিত্রকলায় গঠন-শৃঙ্খলার নিগড় আর নেই। তাই প্রকৃতিতে যা আছে বা যা দেখা যায় না তাকে নিজের মতো করে প্রকাশ করে। কোনো কোনো চিত্রে স্বপ্ন-বাস্তবের দ্বৈরথ তাঁর চিত্রের অন্তস্তলে বসে থাকে। ছবির শরীর স্বপ্ন দিয়ে গড়া। স্বপ্নের ভেতরে নম্র শৈল্পিক উচ্চারণ; চিত্রকল্প ও প্রতীকের সহজ-সরল আটপৌরে বিন্যাস। নভেরার বেশকিছু নিসর্গচিত্রে দেখা যাবে বিশুদ্ধ রূপের আবর্তনে সেজানের আদর্শে গঠিত দৃশ্যবিষয়।
‘পাখী’ সিরিজের কাজগুলোতে আছে লোকশিল্পের সারল্য ও বর্ণাঢ্যতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নভেরার কাজে বিশেষত ভাস্কর্যে লোকজ পুতুলের যে গড়ন সে সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – পুতুল গড়নের এই সরলতা বা নাঈভ দিকটি পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। ছোটবেলায় দেখেছেন মা শখে মাটি দিয়ে পুতুল গড়তেন।
‘মানবতা’, ‘কক্সবাজার’, ‘ইডেন উদ্যানে ইভ’, ‘নিঃসঙ্গতা’, ‘আলোর পথে’ বা ‘শ্বেত নারী’ চিত্রকর্মগুলোতে প্রথা আর ব্যাকরণের গণ্ডিতে থেকেও তিনি ব্যাকরণ ভেঙেছেন। ফলে রিয়েলিটি থেকে উপস্থাপন হয়েছে ভিন্ন। নভেরার অনেক চিত্র, অনেক নির্মাণই রিয়েলিটির উপস্থাপন নয়; কিন্তু রূপকে, ভাষায় সত্যেরই বিনির্মাণ।
সমকালীন চিত্রকলায় শিল্পে মূর্ত-বিমূর্ত যে-কোনো শৈলীর প্রধান অভিঘাত মনন ও আবেগকে জাগিয়ে তোলা। তাঁর সৃষ্টি সেই বিন্যস্ত ভাবনার ফসল। নভেরা চিত্রে প্রকৃতি দর্শনে, চিত্রণে আপাত সরলতার গভীরে গূঢ় আছে এক দর্শন। সে দর্শন স্বোপার্জিত; নিজের গড়া জীবন থেকে। এই দার্শনিক সত্তাবলে জীবনে কত ঘটনা-দুর্ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন সবকিছুর অনিত্যতা সত্ত্বেও সবকিছুই রয়ে যায় রূপান্তরের ছায়ায়। মানুষের অস্তিত্বের বিনাশ হলেও তা শূন্যে মিলায় না। রূপান্তরিত হয় অন্য শক্তিতে। গাছ, পাখি, ফুল, পশু – প্রকৃতিরই নানা অনুষঙ্গে। বিজ্ঞানের এই ‘এনট্রপি’ তত্ত্বে নভেরার গভীর বিশ্বাস। দুর্ঘটনার পর তাঁর বর্তমানের জীবনকে মনে হয় ভাস্কর নভেরার রূপান্তরিত সত্তা, যে সত্তা প্রকৃতিতেই লীন হয়ে যাবে। কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা নেই। মানুষ হিসেবে বড় প্রাপ্তি নিজেকে নির্লোভ রাখতে পারাটা। বুদ্ধের দর্শনে পরম আস্থা – ‘যার কিছুই নেই, সেই সবচাইতে ধনী।’ বলেন, এই তাঁর সারাজীবনের সারাংশ। প্রকৃতির সম্পর্ক থেকে লব্ধ নভেরার প্রেরণা। ক্যানভাসে তাঁর প্রকৃতি অনাহত, অকৃত্রিম। তিনি নিঃসঙ্গতা আর সময়ের বিশাল ব্যাপ্তির সঙ্গে অনুভব করেছেন প্রকৃতির মধ্যে এক নিগূঢ় প্রাণের ঐক্যকে। বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের কুলীন ভাস্কর নভেরা। চিত্রকলায়ও তাঁর দক্ষতা ব্যাপক। চিত্রকর্মে সেজান, শাগাল প্রমুখের প্রভাব বা অনেক দেখা ছবির প্রতিধ্বনি মনে হতে পারে। কিন্তু তার পটের চিত্রময়তা ও লালিত্য রচনা (নির্মাণের) আলোছায়া, বর্ণলেপন – মনে হবে না অন্যের চোখ দিয়ে দেখেছেন।
প্রদর্শনীতে ৪২টি চিত্রকর্মের মধ্যে আঠারোটি চিত্রে বিষয় পাখি। গভীর সংবেদনায় পাখি এঁকেছেন। তাঁর ক্যানভাসে পাখি চিত্রকল্প। দেশ ছাড়া শাগালের শৈশববিষয়ক ছবিতে পাখি ও পশুর চিত্রকল্প এসেছে। নভেরার পাখি – তাঁর স্মৃতি দেশ, দেশত্যাগের। পরিযায়ী পাখির মতো তাঁর অস্তিত্ব। একটি ছবিতে পাখির পাশেই এঁকেছেন স্বর্ণপিণ্ডের মতো চাঁদ। ইউরোপের আকাশে চাঁদ দেখা গেলেও এমন ফুটফুটে চাঁদ নভেরার স্বপ্নের আশ্লেষে প্রশান্ত, প্রগাঢ়। নানাভাবে নানা শৈলীতে পাখি এঁকেছেন। তবু তা একঘেয়ে, ক্লান্তিকর নয়।
নভেরা আপন ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতার মন্ত্র পেয়েছেন। তাঁর চিত্রকর্ম হাড়-মজ্জায় বাংলার ছবি। স্বদেশের পাখি, চাঁদ, আকাশ, নিসর্গের নির্জনতা বা নির্জনতার নিসর্গ – বহুরূপী ইমেজকে প্যারিসে বসে এঁকেছেন। তাঁর মানসিক জগতের উষ্ণতা, স্মৃতিকাতরতা কিংবা পরবাসী জীবনের ফ্যান্টাসি। তাঁর ভিত্তিও জীবনের অতীতের অভিজ্ঞতা। সে অর্থে কল্পনার ভিত্তিও অতীত। স্মৃতির কোলাজ-ডিকোলাজ – সময়ের হাত ধরে নানা মেটাফোর হিসেবে সেইসব স্মৃতি ছবিতে দেখা যায়।
প্রদর্শিত চিত্রকর্মগুলো (অজস্র কাজের মধ্যে কয়েকটি) ভাস্কর নভেরার শব্দহীন পায়ে চলার পথ আর অন্য যাপনের ছবি। নাজুক শরীর-স্বাস্থ্য, অসাড় অঙ্গ কিন্তু যা হারাননি তা হলো মায়াবী মন, সৃষ্টির অদম্য স্পৃহা। টিকে থাকতে হলে আমিত্বকে প্রকাশ করতে গেলে কোনো প্রত্যাশা রাখলে চলবে না – এই তাঁর ব্যক্তিদর্শনের অবিচ্ছেদ্য ভাবনা। তাই জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসেও তিনি অনন্যই থেকে গেলেন। ৭৫টি বছর জীবন থেকে চলে গেছে। সবার থেকে আলাদা, সবার থেকে দূরে নিভৃতে।
নভেরার আধুনিক মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশে একটি বাক্য প্রবাদের পর্যায়ে চলে এসেছে। সেটি হলো – সময়ের অনেক আগেই তিনি জন্মেছিলেন। তাই তৎকালীন পরিবেশ তাঁকে বাধ্য করেছে দেশ ছাড়তে। কেন, কীভাবে সে অধ্যায়ও ধূসর পর্দায় ঢাকা। কিন্তু নভেরার এ প্রসঙ্গে ভাষ্য – পারিবারিক এবং সামাজিক কারণেই মা গুলশান আগা নিজামীর সম্মতিতে দেশ ছাড়েন।
রবীন্দ্রনাথ এবং বৌদ্ধদর্শন – নভেরার ভাস্কর্য ও চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তনের অনুপুঙ্খ আলোচনায় এ দুটো বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। জীবনের সত্যরূপ উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের ঋষির মন্ত্রকে। ‘আনন্দ থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি। সৃষ্টির উৎস আনন্দ।’ রবীন্দ্ররচনার পরম অনুরাগী নভেরা। রবীন্দ্রপাঠে, শ্রবণে তাঁর শরণ সুখ, আনন্দ। আবার বৌদ্ধদর্শনে গভীরভাবে আলোড়িত। বৌদ্ধধর্মে শিল্প এক মুক্তি বা নির্বাণের পথ বলে স্বীকৃত। শিল্পকে এরা একদা মুক্তির, বুদ্ধত্ব অর্জনের পথে সাধনার এক মাধ্যম করেছিল।
ভাস্কর্যে আধুনিকতার ক্ষেত্রে এপস্টাইনের অবদান নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নভেরা ছিলেন খ্যাতিমান এই ভাস্করের ছাত্রী। একলব্য-একাগ্রতায় জ্যাকব এপস্টাইনের কাছে কাজ শিখেছিলেন। উনিশ শতকের ভাবনায় আকৃষ্ট হয়েও মৌলিক অনুভূতি ও শিল্পভিত্তিক অভিব্যক্তির দিকে তিনি ঝুঁকেছিলেন। অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যেমন রঁদ্যার দ্বারা তেমনি এপস্টাইনের ভাস্কর্যের স্বতঃস্ফূর্ত গতিময়তা ও সহজ চাঞ্চল্যের আভাসও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।
ভাস্কর্যে আয়তনের (ভল্যুম) ভেতর বহু পুঞ্জের (মাস) তাৎপর্য সংস্থান তাঁর অধিগত। আকারকে রূপবন্ধে রূপান্তর করেন ছন্দের বাঁধনে। ব্রোঞ্জে করা আবক্ষ ‘ব্যারনের’ মতো বস্তুর গঠন নির্মাণের স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে ধাতুর অন্তরস্থ অস্থিময় রূপকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করেছেন বিভিন্ন ভাস্কর্যে। অসুন্দর, ভীতিকর বস্তুতেও সৌন্দর্য অন্বেষণ ক্ষমতায় নভেরার দক্ষতা।
ভাস্কর্যচর্চার শুরু থেকেই নভেরা সিমেন্ট-মাটির প্রতিমা নির্মাণের প্রভাবমুক্ত হয়ে চেষ্টা করেছিলেন ভাস্কর্যের শরীর নির্মিতিতে নিজের ধ্যান-ধারণাকে মূর্ত করতে। প্রথানির্ভর ধ্র“পদী ভাস্কর্যের জগৎকে অতিক্রম করে আধুনিকতার পথে হেঁটেছেন পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় তাঁর প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে। লন্ডনে শিল্পগুরু এপস্টাইনের সান্নিধ্যে যে পশ্চিমি আধুনিকতাবাদী ভাষা রপ্ত করেছিলেন, তার সঙ্গে দেশীয় জীবনের বহিরঙ্গক রূপের সহজ সখ্য হয়েছিল তাঁর কাজের।
নভেরার নিয়ত আবর্ত শিল্পজিজ্ঞাসা এবং শিল্পচর্চায় জড়িয়ে আছে দেশের লোকায়ত শিল্প। ছাগল, পেঁচা, সাপ, ভাস্কর্য সৃষ্টিতে ভর, ভাস্কর্যসুলভ ভিগর যেমন মূর্ত, আবার আধুনিক জ্যামিতিক ছক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে লোকায়ত রক্তমাংসের নির্যাস। সাপ ভাস্কর্যটি ’৭৩ সালে প্যারিসের গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনীতেও আছে। খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতিতে সাপ অশুভ প্রবৃত্তির প্রতীক। ভয়, সন্ত্রাস, আতঙ্ক, সংঘাত – সব উপস্থাপনায় প্রতীকী। অশুভের সঙ্গে শুভর প্রতীকী ব্যঞ্জনা। যে সাপ আতঙ্কের অভিজ্ঞান, ভয়ের উৎস, নির্ভার, অপ্রতিরোধ্য প্রকাশের স্পৃহা। তবে প্রতিকৃতি নির্মাণে লোকচিত্রকলার লক্ষণ যেমন আছে, প্রিমিটিভ শক্তি নভেরার ভাস্কর্যে উপলব্ধি করা যায়। অসাধারণ মৌলিক নির্মাণ এসব কাজ।
তিনি প্যারিসে যখন শিল্পচর্চা শুরু করেন, তার আগেই ইউরোপে সমকালীন শিল্পীরা ফোকের চাইতে প্রিমিটিভ শিল্পের অনুরাগী ছিলেন।
ভাস্কর্যচর্চার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি এপস্টাইন, হেনরি মুর প্রমুখের হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে পূর্বানুসৃত শিল্পশৈলীতে আস্থা রেখে, তার ভাষা থেকে রসদ নিয়েই নিজস্ব ভাস্কর্যশৈলী গড়ে নেন। একদিকে ইউরোপীয় পূর্বসূরিদের এক্সপ্রেশনিস্ট ভাস্কর্যের উপাদান আহরণের পাশে দেশীয় লোকজ শিল্পের উপাদান আত্মস্থ করলেন। তাই নভেরার ভাস্কর্য এপস্টাইন, মুর বা জ্যাকোমিতি, সেজারের সান্নিধ্যে তাঁদের শিল্পভাষায় অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হয়েও আধুনিক ভাস্কর্যের পাইরেটেড এডিশন হয়নি। কারণ তিনি উপাদান নিয়েছেন রসদ হিসেবে, অনুসরণ করেননি। পশ্চিমের সংকেত মুদ্রা, জ্যামিতিক বিন্যাস তাঁর নির্মাণের আত্মীয় হয়ে ওঠে মাত্র।
নভেরা তাঁর সামাজিক চিন্তাকে ব্যক্তিগত চিত্রকল্পের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সামাজিক পরিবেশেই সুপ্ত থাকে শিল্পের সাংকেতিক ভাষার উৎস। ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক, নোবেল প্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে ভেবেছেন গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কথা।
ভূমিহীন-বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর সম্বল বলতে থাকে কখনো বা হাঁস-মুরগি বা ছাগল। এই ভাবনায় ত্রিমাত্রিক বলিষ্ঠতায় নির্মাণ করেছেন ‘ছাগল’ ভাস্কর্যটি।
মিতব্যয়ী, বৈষয়িক বিষয়ে উদাসীন অথচ জীবন ও শিল্পের প্রেমে আবিষ্ট। শারীরিক অক্ষমতা, বার্ধক্যের নানাবিধ জটিলতা অতিক্রম করে তিনি এখনো সৃজনশীল। বজায় রেখেছেন কৌতূহলের ব্যাপ্তি। তিনি নির্জনতাকে মান্য করেন প্রায় ধর্মীয় অনুশাসনের মতো। অনেক আগে থেকেই পছন্দ ছিল প্যারিসের বাইরে ছোট্ট গ্রাম আমুর দ্য শঁতমলে। মাত্র ৩১৯ জন অধিবাসীর এই গ্রামে তিনি সপ্তাহ শেষে সময় কাটাতে যেতেন ’৮৪ সাল থেকে। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ক্লদ মনের বাড়ির পাশেই ভিতই গ্রামে। নিঃসঙ্গ তিনি নন, স্বামী গ্রেগোয়ার মনোযোগ, সযতœ শুশ্রƒষা বার্ধক্যে পৌঁছেও সমানভাবে সক্রিয়।
নানা স্মৃতি তাঁকে জড়িয়ে ধরে, যদিও বলেন তিনি নস্টালজিক নন। এক অদ্ভুত পরিমিতি বোধ অন্তর্লীন আছে তাঁর মধ্যে। হয়তো বলতে চান জীবন এর চাইতে বেশি কিছু নয়।
নভেরা তাঁর জীবনে দুজন ব্যক্তির সহমর্মিতা এবং প্রেরণার কথা বলেন অকুণ্ঠ চিত্তে। একজন পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে হয়ে উঠেছিলেন একজন খাঁটি কমিউনিস্ট। অন্যজন সাংবাদিক এস এম আলী। নভেরা এবং তাঁর স্বামী গ্রেগোয়া নানা প্রসঙ্গে তাঁদের কথা স্মরণ করেন। সাংবাদিক এস এম আলী কর্মসূত্রে ব্যাংকক থাকতেন। দীর্ঘদিন তিনি নভেরাকে অর্থসাহায্য করেছেন নিয়মিত। প্যারিসে নভেরার স্টুডিও, ভাস্কর্য নির্মাণের উপকরণ কিনবার জন্যও অর্থ পাঠাতেন। তবে ’৭১ সালের পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আর যোগাযোগ হয়নি। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনকালে ’৬০-৬১ সালের দিকে নভেরাকে অসুস্থতার জন্য লন্ডনে যেতে হয়েছিল। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন সুহৃদ কবি ফয়েজ আহমেদ। নভেরার ক্যান্সারে আক্রান্ত ইউটেরাস অপারেশন করা হয় লন্ডনে।
হে আমার দুঃখ তুমি প্রাজ্ঞ হও,
স্থৈর্য নাও শিখে :
(বোদল্যার)
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, প্রাজ্ঞ এবং স্থৈর্যময়ী নভেরাকে প্রথম দেখার পর তাই মনে হতো। তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে অনাকাক্সিক্ষত, অযৌক্তিক কথা, অমীমাংসিত আলোচনা, যার কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না।
কালো শাড়িতে পরিপাটি নভেরা, প্রথম দেখেছিলাম ’৯৭ সালের অক্টোবরের শেষ বিকেলে। জীবন ও সময়ের পরিসংখ্যানহীন অভিজ্ঞতা তাঁর অন্তর্লীন চাপ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছানো (বয়স তখন ষাটের কাছে) ভাস্করের মনে আঁচড় কাটতে পারেনি। মুখশ্রী প্রসাধনের আদরে øিগ্ধ, মুখে হাসি, ছোটখাটো গড়নের এই মানুষটিই ছেনি, হাতুড়ি বা রংতুলি হাতে সৃষ্টিযজ্ঞে মেতে ওঠেন।
বর্তমান রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনীর আগে নভেরার প্যারিসে শেষ প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তবে ’৭০ সালে ব্যাংককের প্রদর্শনীর অনেক ভাস্কর্য আর নভেরার কাছে নেই। কিছু কাজ হারিয়ে গেছে। কিছু হয়তো এখনো ব্যাংককে আছে। তিনি নিশ্চিত নন। তবে ব্যাংকক থেকে জাহাজে একটি বাক্সে ভাস্কর্য পাঠানো হয়েছিল ফ্রান্সের সমুদ্রবন্দর লো হাভ্র। ১৯৭২ সালের ২৯ মে পি.আই.ই ট্রান্সপোর্ট থেকে পাঠানো বিলে এক বাক্স ভাস্কর্যের (৮০৫ কেজি) জন্য দশ হাজার দুইশ সাতাশি ফ্রাঁ পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অর্থাভাবে নভেরার কাজগুলো উদ্ধার করা হয়নি। এ বিষয়ে নভেরাকে পর পর দুটো চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। যাতে লেখা হয়েছিল, নভেরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগাযোগ না করলে আইনত ভাস্কর্যগুলো নিলামে দেওয়া হবে। নভেরা তখন থাকতেন প্যারিসের বেলভিল এলাকায়।
শহীদ মিনার প্রসঙ্গে অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিও অসার যুক্তি দেন – এতদিন কেন বলেননি। তিনি শহীদ মিনারের প্রকৃত নকশাবিদ। পরবাসী ভাস্কর, কী উদ্ধারহীন বেদনা কিংবা আশাহত হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। দেশবিচ্ছিন্ন, তাই জানতেই পারেননি তাঁর অবর্তমানে শহীদ মিনারের প্রকৃত রূপকার সম্পর্কে অসংলগ্ন ও প্রগলভ মিথ্যাচারে নেমেছেন কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে আমার প্রশ্ন শুনে প্রথমে আলোড়নহীন, পরে বিরক্ত, রুষ্ট – হামিদ তো ভাস্কর নয়। সে কী করে ডিজাইন করে। আমি মিনারের একটি ছোট্ট মডেল করে দিয়েছিলাম। হামিদের কাছেই আমার করা ড্রইংসহ সমস্ত কাগজপত্র ছিল।
শহীদ মিনারের বর্তমান রূপ দেখে আহত বিস্ময়ে অবাক হয়েছেন তিনি। মিনারের মূল নকশা যেভাবে করেছিলেন তা পরিপূর্ণতা পায়নি। মূল পরিকল্পনায় ছিল মিনারে মাঝের সর্বোচ্চ স্তম্ভে স্টেইন গ্লাসের কাজ থাকবে। সঙ্গে একই স্তম্ভের পাশে থাকবে হামিদুর রাহমানের ফ্রেসকো। আর দুপাশের ছোট স্তম্ভে থাকবে নভেরার করা ছোট ভাস্কর্য। ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম এবং স্থাপত্যের সমন্বয়ে চেয়েছিলেন ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট বা নৈসর্গিক স্থাপত্যের ধারণা দিতে, আবেদন রাখতে।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনারের নকশা করা থেকে ভাস্কর্য নির্মাণের প্রেক্ষিত ব্যাখ্যায় নভেরার উপলব্ধি, আশ্রয় বুদ্ধের নীরব বোধিতে সমর্পিত। শহীদ মিনারের পাঁচটি বিম্বকে এযাবৎকাল মা ও সন্তান বলে ভাবা হয়েছে। শুনে বিস্মিত তিনি। পাঁচটি স্তম্ভের মাঝে সর্বোচ্চটির নমনীয় আনত ভাব, প্রেরণা উপবিষ্ট বুদ্ধের একটি হাতের ঈষৎ নোয়ানো ভঙ্গি। যাতে মূর্ত একটি মাত্র অনাবিল মন্ত্র – ‘শান্তি’। এই দর্শনেই অনুপ্রাণিত হয়ে নভেরা নকশাটি করেন।