রবিউল হুসাইন
নদীমাতৃক বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। প্রাগৈতিহাসিককালে এখানে ছিল তেথিস নামক সমুদ্রের অবস্থান। হিমালয় অববাহিকার পাহাড় গলা বরফের পানি এবং মৌসুমি অঞ্চলীয় প্রবল বৃষ্টি দ্বারা বিভিন্ন ও অসংখ্য নদীনালা-বিধৌত হয়ে তার সঙ্গে পলিমাটি বয়ে নিয়ে সেই সমুদ্র ভরাট করে এই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক সৃষ্টি।
মাটি বাংলাদেশের প্রাণ। এককালে ভারতসহ সারা পৃথিবীর, এই ভূখণ্ডের উর্বরতার জন্য শস্যভাণ্ডার ছিল সবুজ-শ্যামল দেশটি; যদিও এখন সেই দেশ বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ বলে পরিচিত। ইতিহাস পর্যালোচনে দেখা গেছে, প্রাচীন সেই সভ্যতাসব গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ ছিল কোনো সুপেয় জল-প্রবাহিত নদী ও জলাধার। এসব কেন্দ্র করে সরস মৃত্তিকা-ফসলের ভূমিভাণ্ডার, মিষ্টি পানীয় জল-মানব বসতির এবং জলের প্রবহমান স্রোত-বাণিজ্য ও যোগাযোগে সহজলভ্যতার – এই তিনটি মৌলিক চাহিদার বহমান নিশ্চয়তায় সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। ইউরোপেশিয়ার তাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস, আফ্রিকার দশটি দেশের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত নীল আর এশিয়ার সিন্ধু ও গঙ্গা-পদ্মা-যমুনা-মেঘনা ঘিরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাই দেখা যায় প্রাচীন মানবসভ্যতার উদ্ভব। এসব সভ্যতাকে এককথায় বলা যায় মৃত্তিকাসংলগ্ন ও কৃষিপ্রধান।
আমাদের সভ্যতার মৌলিক ও প্রধান উৎস মৃত্তিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আদিযুগে গুহাবাসী মানুষ যখন পশুপাখি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত তখন সে ছিল ভাগ্যের হাতে ক্রীড়নক। তারপর সে শিখল চাষাবাদ, কৃষিকাজ ও ফসল উৎপাদনের কার্যকুশলতা। এলো হাতের মুঠোতে ভাগ্য। এক জায়গায় থাকতে থাকতে সে আবহাওয়া চিনল, মাটি কর্ষণ করে সে শস্য ফলাতে জানল। এই কৃষিকাজই মানুষের দ্বারা সংঘটিত ও সংগঠিত প্রথম বিপ্লব এবং স্থায়ী কৃষিসভ্যতার মূল কাঠামো। দল বেঁধে গ্রামে তাদের বাস করা, শস্য-ফল-ফুল পরিচর্যা, পশু পালন – এসব ছিল সেই বিপ্লবের প্রধান কর্মকাণ্ড ও আসল পরিচয়। তারপর নগরের প্রবর্তন, লিপি ও চিত্র আবিষ্কার, পৌরনীতি মান্য করা – এগুলো দ্বিতীয় বিপ্লব। এরপরের ধারাবাহিকতায় আসে বর্তমানের শিল্প বা যন্ত্রবিপ্লব। মোট কথা, এই দেশ সভ্যতার আদি রূপ থেকে ক্রমাগত গড়িয়ে গড়িয়ে তবে আজকের এ অবস্থায় উপনীত। জানা গেছে, হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব খ্রি. পূ. ৩৫ হাজার অব্দে পৃথিবীর বয়স যেখানে সাড়ে চার কোটি বছর। আর এ মৃত্তিকাসভ্যতার গ্রামে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস খ্রি. পূ. দশ হাজার থেকে সাত হাজার অব্দের মধ্যে। অতএব দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে হীনমন্যতাসুলভ সন্দিহানে যারা ভয়ার্ত ও ভীত, তাদের সন্দেহ অমূলক এবং ভ্রান্ত। আমাদের এই দেউলেপনা ও নির্ভরপ্রিয়তা এখন একবিংশ খ্রিষ্টাব্দে হাস্যকর ও মর্মান্তিক।
বহু যুগ থেকে মাটিই আমাদের জীয়নকাঠি ও সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। মাটির মানুষের মাটির ঘরবাড়ি, মাটির তৈজসপত্র, মাটির পুতুল এবং শেষমেশ মাটির সমাধি কিংবা মাটির ছাই। প্রখর সূর্যতাপের কারণে এই দেশের পলিমাটি হলো রোদে-শুকোনো ইট, তারপরে আগুনে-পোড়ানো ইট এবং পোড়ামাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোশন, তৈজসসমূহ। মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত মানুষেরা বাঙালি, এরা প্রাকৃতিক কারণে কল্পনাপ্রবণ, স্বাপ্নিক এবং শিল্পমনস্ক হয়ে থাকে। এদেশে মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়, জল হয়, পলিমাটি বিধৌত নদীনালাবেষ্টিত নরম মাটিতে গাছপালা জন্মে বেশুমার, জলে মাছ হয়, স্থলে শস্য ও ফসল হয়, গাছে ফল-মূল, বাগানে ফুল, পাখি, প্রজাপতি, ওপরে নীলাকাশ। এই উতলা পরিবেশে মানুষের মন আনচান করে ওঠে, তার শিল্পীসত্তা জেগে ওঠে, সে কাঁচা মাটিতে আঁকিবুঁকি করে, আঁকে, গড়ে, নকশায় মন দেয়, সৃষ্টি করে মাছ, ফুল, পাতা, পাখি, মানুষ, জীবজন্তু, নৌকো – এইসব। তারপর সেই মাটি পুড়িয়ে পোড়ামাটি হয়ে যায় স্থায়ী এক চক্ষুপ্রিয় রক্তবর্ণের অনুপম সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ নিজস্ব জীবন-সংস্কৃতির শিল্প। এভাবেই সে নান্দনিকতার এক মূল অধ্যায়কে আবিষ্কার ও উদ্ভব করে তোলে, যা অকৃত্রিম, দেশজ এবং জীবনভিত্তিক, শিল্পবিচারে একটি প্রথম শ্রেণির সৃষ্টিকর্ম বলে বিবেচিত।
মাটির একটি বর্গ, আয়ত, বৃত্ত বা ত্রিভুজ আকৃতির প্লেট, থালা, কিংবা ফলক, এক বা দুই ইঞ্চি পুরু, তার ওপর বিভিন্ন সৃষ্টিকর্ম, যাতে সহজে দগ্ধ হতে পারে – এমন এককতা নির্বাচন শিল্পীর প্রধান উপাদান এবং শিল্প প্রকাশের অন্যতম অনন্য মাধ্যম। এই প্রক্রিয়া নানা উপায়ে ব্যবহার ও শৈলীতে উজ্জ্বল এবং এই অব্যাহত ধারাবাহিকতায় এক উচ্চশ্রেণির সৃষ্টিকর্ম, যা দেশজ সংস্কৃতিজাত নিজস্ব শিল্প হিসেবে চিহ্নিত। তাই খ্রি. পূ. তৃতীয় শতাব্দী গুপ্তযুগের মহাস্থানগড়, সপ্তম ও অষ্টম খ্রিষ্টাব্দের পালযুগে পাহাড়পুর-ময়নামতির স্তূপ এবং বৌদ্ধবিহারে এই পোড়ামাটি শিল্পকর্মের অনুপম নিদর্শন দেখা যায়, যা সে-সময়ের উচ্চমান শিল্পশৈলীর স্থায়ী পরিচয় দেয়। জীবজন্তু, ফুল, পাখি, নকশা, দেব-দেবীর অবয়ব এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন নিয়ে নানা অনুষঙ্গ সেইসব পোড়ামাটির শিল্পকর্মে ধরা, যেগুলো বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয়ে বিশিষ্ট হয়ে আছে। সাধারণত কোনো ভবন, বিশেষ করে উপাসনালয়ের ভিত্তি, বহির্দেয়াল, জানালার ওপরে, ছাদ বা কার্নিশের নিচের অংশে এই শিল্পকর্ম সার বেঁধে বিভিন্ন আঙ্গিকে স্থাপন করা হতো। এর দুটো কারণ – একটি ব্যবহারিক ও আরেকটি নান্দনিক। দেয়ালের বহির্ভাগে পোড়া ইটের ব্যবহারে বৃষ্টির জল কখনো ভেতরে প্রবেশ করতে পারত না এবং যতদূর সম্ভব দেয়াল জলমগ্নতা থেকে রক্ষা পেত। এইভাবে একটি ভবনকে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন নকশা করা পোড়ামাটির প্লেট ফলক কিংবা চাক্তি ব্যবহার করে আকর্ষণীয় করে তোলাও ছিল অন্যতম কারণ। এই ব্যবহারিক ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী নির্মাণ-পদ্ধতি সেকালে প্রায় সব ধরনের ভবন তৈরির সঙ্গে অনুসৃত হতো। দুঃখজনকভাবে সেই প্রথাটি একালে আর ব্যবহৃত হয় না; যদিও তা আমাদের বাঙালি স্থাপত্য-সংস্কৃতির অপরূপ ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত। সেকালে সময়, পৃষ্ঠপোষকতা আর দক্ষ শিল্পী-কারিগরের লোকশক্তির আনুকূল্য প্রাপ্তি এর প্রসার ও ব্যবহারের অন্যতম কারণ। এছাড়া মাধ্যমের স্থায়ী, কার্যকর ও যথার্থ প্রকৃষ্ট উপায়ে মৌলিক পোড়ামাটির কাজ ছাড়া মনে হয় সেই আমলে এই দেশে অন্যকিছু এত সহজ ও সুন্দর হয়ে দেখা দিত না।
বাংলাদেশ পাথরবিহীন মাটিসর্বস্ব। নদী প্রবাহিত মাটির ভাঙা-গড়া মনুষ্যজীবনের জন্ম ও মৃত্যুর মতো – সবই অস্থায়ী, কিন্তু মানুষ স্থায়িত্ব চায় এবং মাটি ছাড়া তার আর কোনো মাধ্যম কিংবা সাহায্যকারী উপায় নেই। সে তাই এর বিপরীতে সংগ্রাম করে, বেঁচে থাকার জন্যে স্বপ্ন দেখে – সেই আধিবিদ্যক ইতিবাচক অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনদর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ে প্রাকৃতিকভাবে। এই আনুকূল্যতার সুযোগে তার মেধা, মনন, প্রজ্ঞা ও শিল্পীসত্তা দিয়ে ভবনের গায়ে সৃষ্টি করে পোড়ামাটির আলেখ্য নিয়ে মহাকাব্য। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনশ একত্রিশ বছরের পুরনো দীর্ঘ চল্লিশ বছরব্যাপী সৃষ্টি করা দিনাজপুরের কান্তজির নবরতœ মন্দির। একটি মহাকাব্যিক পৌরাণিক রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনির বর্ণনা, এমনকি মোগল সম্রাট শাহজাহানের সময়ে করা হয়েছিল বলে তাঁর উদ্দেশে নিবেদিত হাতি-ঘোড়া-পদাতিক বাহিনীর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এক সারি শোভাযাত্রার দৃশ্যও সন্নিবেশিত। পোড়ামাটির কাজে সমৃদ্ধ উচ্চমান সৌন্দর্য ও বিমুগ্ধতা ভবনের কাঠামোগত স্থাপত্যগুণকে আরো ঐশ্বর্যময় এবং আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এছাড়া বাগেরহাটে খানজাহান আমলের একগুম্বুজ ও সাতাত্তর বা ষাটগুম্বুজ মসজিদে, যেহেতু ইসলাম ধর্মে মানুষ ও জীবজন্তুর অবয়ব ব্যবহার নিষিদ্ধ তাই সেখানে ইসলামীয় ক্যালিগ্রাফি, ফুল-লতা-পাতার জ্যামিতিক নকশা এবং আকারসমৃদ্ধ শিল্প সৃষ্টির প্রচলন দেখা দেয়, যা খুবই উল্লেখযোগ্য। আটশ তেয়াত্তর বছর আগে বারো বছরব্যাপী নির্মিত এই মসজিদ প্রাচীন আমলের সর্ববৃহৎ ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া পাঁচশ বছর আগের সুলতানি আমলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ, চারশ নব্বই বছর আগে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পোড়ামাটি শিল্পকর্মসমৃদ্ধ বাঘা মসজিদ ও চারশ বছর আগে নির্মিত বাংলা চালাঘরের মতো উত্তর-দক্ষিণে ছাদ বাঁকানো নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ স্থাপত্য ও শিল্পকর্মের জন্য সুবিখ্যাত। এই বাংলায় পনেরোশ শতাব্দীর শেষভাগে সেই সময়ে বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দির, একরতœ নির্মাণরীতি-বর্গাকৃতির সমান্তরাল ছাদ, বাঁকানো কার্নিশযুক্ত ও পোড়ামাটির শিল্পকর্ম দ্বারা অপূর্বভাবে অলংকৃত, যা অতুলনীয় এবং অনুপম। সঙ্গে শ্যামারায়ের পঞ্চরতœ ও কেষ্টরায়ের জোড়বাংলা মন্দিরে উৎকৃষ্ট মানের পোড়ামাটির কাজ দেখা যায়। বলা হয়, পাঁচটি মৌলিক উপাদানে সমৃদ্ধ এই শিল্প। এগুলো হচ্ছে – মাটি, জল, বাতাস, আগুন ও স্থান-জায়গা বা পরিসর, যা দিয়ে মৃৎশিল্পের সৃষ্টি হয় এবং এর মূলে থাকে আত্মগত মানবিক অনুভূতি ও অনুভব। প্রকাশের অভিব্যক্তিটি মাটিসংলগ্ন, লোকজ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাকৃতিক ও মৌলিক। এর কার্যকারণ রীতি-কৌশল লৌকিক ও সাধারণ জনগণের জীবনযাপননির্ভর এবং বাস্তবানুরাগী হয়ে থাকে। আমাদের এই পোড়া দেশে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম সোনালি ঐতিহ্যের স্বাক্ষর দেয়। এখানে উল্লেখ্য, শিল্প বিকাশে, তা যে-কোনো শিল্পই হোক, স্বাধীনকালে স্বাধীনচর্চার মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশের আনুকূল্য লাভ করে থাকে। এই দেশ যখন বহুকাল অবধি স্বাধীন ছিল তখনই কেবল দেশ ও মাটিভিত্তিক শিল্পকর্মের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। গুপ্তযুগে ও পাল আমলে ধীমান ও বীতপালের সময়ে এবং সুলতানি আমলে বা সেন আমলের স্বাধীন সময়ে এই শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। পরবর্তী সময়ে মোগল আমলে এই চর্চায় ছেদ পড়ে। তারা পোড়ামাটি ব্যবহার না করে বালি-সুরকির আস্তরণ দেওয়া শুরু করল। ভবনের দেয়ালে বাইরে এবং ভেতরে আস্তরণের ওপর বিভিন্ন ধরনের নকশাসহ রং ব্যবহার করে কারুকর্ম ইংরেজ আমলেও প্রচলিত ছিল; যদিও এই আস্তরণের ব্যবহার দ্বারা দেয়ালগুলো জলনিরোধক হতো তথাপি এভাবেই স্থাপত্যকলা থেকে পোড়ামাটি শিল্পের নান্দনিকতা-উৎস বিচ্ছিন্ন ও বিদূরিত হয়ে পড়ল। এখন আমরা স্বাধীন। বহুদিন যাবৎ ঔপনিবেশিক ও পরাধীন সময়ে দমবদ্ধ অবস্থায় সূর্যকিরণহীন সাদা ঘাস হয়ে আমরা দিনাতিপাত করেছি। সে সময় আর নেই। এখনই প্রকৃত সময় ও সুযোগ নিজের প্রতিকৃতি, স্বকীয়তা ও স্বরূপ সন্ধান এবং পুনরাবিষ্কারের, যেগুলো আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখনই খুঁজে নেওয়ার প্রকৃষ্ট মুহূর্ত ও পক্ষ। প্রায় সব বিষয়ে আমরা দৈশিক ও বৈদেশিক মূল্যবোধের টানাপড়েনে ব্যতিব্যস্ত, ক্ষতবিক্ষত ও বিভ্রান্ত। তাই জর্জরিত সময়ের প্রেক্ষাপটে সুযোগের সদ্ব্যবহার সচেতনভাবে সমাধা করা দরকার। ঐতিহ্যবাহী যে-কোনো শিল্পমাধ্যমের ব্যবহার এখন অতীব প্রয়োজন। কালের নিরিখে মূল্যবান সেই শিল্পচর্চা ও প্রয়োগের পৌনঃপুনিকতায়, বিশেষ করে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম এইভাবে তার স্বকীয় মর্যাদায় সর্বতোভাবে হারানো গৌরবটি ফিরে পাবে এবং স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্রে একটি আবশ্যকীয় দেশীয় শিল্পপ্রথা হিসেবে সহজেই প্রতিষ্ঠা পাবে।
এই প্রসঙ্গে পঞ্চাশের দশকে মেক্সিকো ও ব্রাজিলের কথা উল্লেখ করা যায়। সে-সময়ে সেখানে দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে গণশিল্প বলে এক শিল্প আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যার মূলে ছিল সেদেশের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক সচেতন শিল্পী ও স্থপতি। তাঁদের বক্তব্য ছিল – শিল্পকে জাদুঘর আর শিল্পশালার পর্দা থেকে সরিয়ে আরো বৃহৎ পরিসরে জনগণের চোখের সামনে নিয়ে আসতে হবে। বড় বড় ভবনের বিশাল বহির্দেয়াল সব স্থায়ী দেয়ালচিত্রে শোভিত করার চেষ্টা নিয়ে সেগুলো জনগণের শিল্প হিসেবে বিবেচিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এইভাবে দেয়ালচিত্র শিল্প ল্যাটিন আমেরিকায় একটি উচ্চমানের শিল্পমাধ্যম বলে পৃথক পরিচয়ে স্বীকৃত, বিম্বিত ও পরিগণিত হয়েছে। এই দেয়ালচিত্র শিল্পীদের গণশিল্পী বা জনগণের শিল্পী হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এঁদের মধ্যে গুরু শিল্পী দিয়েগো রিভেরা, পরতিনারি, পাউলো ওয়েরনেক, ফ্রিদা কাহ্লো, এদুয়ার কোবরা, জুয়ান ওগোরমান, মাত্তিও মানাউর, এন্তইন পেভ্স্নার প্রমুখ খুব উল্লেখযোগ্য। এঁদের দ্বারা এই শিল্প আন্দোলন স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্র শিল্প মাধ্যমকে একীভূত করে তোলে। এই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় ‘বাইম্যুরাল্স’ পদ্ধতির দেয়ালচিত্র, যেখানে একটি খাড়া দেয়ালে দুই দিকে সৃষ্ট শিল্পকর্ম শোভিত ও প্রদর্শিত হয়। আমাদের দেশে এইরূপ দেয়ালচিত্র খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয় ভাস্কর ও শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মে এমনটি সম্পন্ন করতে এগিয়ে আসবেন অনুকূল সুযোগ-সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে।
এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লোকজ শিল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। সেটা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন পরিত্যক্ত বা ফেলে দেওয়া বাতিল বা অপ্রয়োজনীয় সাধারণ বস্তু ও দ্রব্যসামগ্রী যেমন কাঠ, প্লাস্টিক, ধাতু, কাচ ও মাটির নানা ধরনের নির্মিতি, সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন প্রকারের শিল্পকর্ম সৃষ্টির পুনঃপ্রক্রিয়া। দেশে দেশে এই ধরনের শিল্প দেখতে পাওয়া যায়। এই মাধ্যমে শিল্পীরা সাধারণত স্বশিক্ষিত হন, তাঁরা কোনো প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত নন। তবে প্রাকৃতিক এক প্রবল শিল্পসৃষ্টির তাগিদে চারদিকের জগৎ, পরিবেশ ও পরিসর থেকে অনুপ্রেরণার বোধে মনেপ্রাণে নিমগ্ন হয়ে পড়ে কাজ শুরু করেন। এই প্রয়াসকে আমরা বর্জ্যশিল্প বা অনাবিষ্কৃত শিল্পকলা হিসেবে অভিহিত করতে পারি। গৃহস্থালি কাজকর্মে ব্যবহৃত, পরে অপ্রয়োজনীয় যে-কোনো সামগ্রী নিয়ে শিল্প নির্দিষ্ট শিল্পীর মনোযোগ, মেধা, শৈলী, বিষয়, উপাদান-নির্বাচন এবং তার শিল্পসৃষ্টির প্রতিভায় প্রতিভাত হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে ময়মনসিংহ-ঢাকার শিল্পী তাপসী দে এমন একজন বলে জানা যায়।
ভাস্কর্যশিল্পেও এমন বর্জ্যশিল্পের উল্লেখ করা যায়। এই শিল্প ইংরেজির স্কাল্পচার শব্দের অনুকরণে স্ক্র্যাপচার বা ভাস্কর্য বর্র্জ্যশিল্প বলে পরিচিত। আমাদের দেশে তেমন একটা দেখা যায় না, তবে দেশের ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ ভাস্কর নভেরা আহমেদ এই শিল্পে এক অনন্যা হয়ে পরিচিত। তিনি, জানা যায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন যুদ্ধবিমানের দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া লোহার পাত বা খণ্ড সন্ধান ও সংগ্রহ করে সেসব নিয়ে নিজের শিল্পসৃষ্টির চাহিদামতো নির্মাণ করে প্যারিসে প্রদর্শন করেছিলেন। যে-কোনো শিল্পমনস্ক ব্যক্তি বিভিন্ন পরিত্যক্ত ধাতুর খণ্ড বা অংশ জোগাড় করে মনোমত জোড়া লাগিয়ে ভাস্কর্য বর্জ্যশিল্প সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসতে পারেন। আমাদের এখন পর্যন্ত এমন কাউকে দেখা না গেলেও পাশের দেশে অনেকে বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট শিল্পমনা স্থপতিগণ বেশ সৃষ্টিশীল এই বর্জ্যশিল্পকর্মে। এটিকে রূপান্তর শিল্প বলা যেতে পারে। অতীতের স্থাপত্যশিল্পকর্মের নির্মাণে তা মিশরের পিরামিড, ল্যাটিন আমেরিকার আজটেক, মাচুপিচু, মধ্যপ্রাচ্যের সুমেরীয়, অটোমন, এশিয়ার ভারত, চীন বা যেখানেই হোক না কেন সবসময় দেখা গিয়েছে যে, স্থাপত্যের সঙ্গে চিত্র, ভাস্কর্য ও দেয়ালচিত্র শিল্প – সব একীভূত থাকত। সে কারণে প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের সৃষ্টি, বিস্তার, নির্মাণ ও গ্রহণযোগ্যতাসহ সর্বপ্রকার উন্নতি একই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল। কালে কালে সেই শিল্প-ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও সর্বোপরি ভৌগোলিক কারণে এবং তাই একটি শিল্পমাধ্যম আরেকটি শিল্পমাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন ও পৃথক অস্তিত্বে পর্যবসিত এবং পরিগণিত হয়ে উঠেছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে সময় এসেছে, সব শিল্পমাধ্যমের একসঙ্গে একীভূত ও সর্বজনীন উন্নতি এবং অগ্রসরের উদ্দেশ্যে একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রয়াস নেওয়ার। পাশের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই প্রক্রিয়া বহুদিন যাবৎ প্রচলিত আছে, আমাদের দেশেও এই পন্থা আবশ্যকীয়ভাবে অচিরেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রচলিত হওয়া দরকার। সেটি হচ্ছে, যে-কোনো নতুন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যে প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, সেই সর্বমোটের কিছু অংশ যেমন পাঁচ থেকে দশ শতাংশ অর্থ শুধুমাত্র ভবনের ভেতরে, বাইরে ও প্রাঙ্গণ বা চত্বরের বিভিন্ন মনোনীত এবং আকর্ষণীয় জায়গায় চিত্রকলা, ভাস্কর্য, দেয়ালচিত্র, নিসর্গ রচনাসহ ফোয়ারা বা জল-ভাস্কর্য, সংগীত বা শব্দ-শিল্পের সংযোজনা ও আলো-প্রক্ষেপণের সচল ও স্থায়ী ব্যবহার এবং স্থাপনের জন্য নির্ধারিত থাকতে হবে। সেগুলোর মধ্য দিয়ে অবশ্যই দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম – লাল পোড়ামাটি বা ইট ব্যবহারসহ নানা বিষয়কে ঘিরে স্বরূপ-সন্ধানী সৃষ্টিকর্মে নিয়োজিত হতে হবে। সেইসঙ্গে স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে যে-কোনো প্রকল্পের শ্রেষ্ঠ নকশা নির্বাচনে অবশ্যই তা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থাপত্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাছাই করতে হবে। আমাদের দেশে পাথর নেই বা সাধারণত সহজলভ্য নয় বলে পাথরের বদলে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম প্রাচীনকালের বিভিন্ন ভবন, মন্দির, প্রাসাদ, মসজিদ ও সমাধিস্থাপনায় প্রভূতভাবে ব্যবহৃত হতো এবং সেসব দেশের গৌরবময় শিল্প-ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত। প্রাগুক্ত পদক্ষেপে আমরা আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করে সেটিকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারি। ল্যাটিন আমেরিকার শিল্পমনস্ক দেশীয় কৃষ্টিপ্রেমিক রাজনীতিক, নীতিনির্ধারক, জনগণ, শিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি, নিসর্গ-স্রষ্টাদের মতো আমরাও শিল্পকে শিল্পশালার দেয়াল থেকে জনগণের সামনে বিভিন্ন ভবনের প্রধান রাস্তাসংলগ্ন ফাঁকা বিশাল দেয়ালে পোড়ামাটি ও ইট ব্যবহার করে দেয়ালচিত্র সৃষ্টিতে একটি বিশেষ গণশিল্প আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে পারি। বিদেশের বহু শহরে এমন দেখা যায়। বিজ্ঞাপনের বিশাল বিশাল পর্দা স্থাপনের বদলে সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেয়ালচিত্র অঙ্কন বা স্থাপন করে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ও ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন। আমাদেরও সেরকম করে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে এবং এটিকে আবশ্যকীয় একটি শিল্প আইন তৈরি করে বাস্তবায়ন করা দরকার। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান ভবনের বহির্দেয়াল, যেমন স্থপতি কর্তৃক নকশা-নির্ধারিত তেমন করে সম্পূর্ণত পোড়ামাটির শিল্পকর্মে অলংকৃত ও শোভিত করা যায়। এরকম করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কালের নিয়মে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা যায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ভবনের সুউচ্চ ও বিশাল ফাঁকা দেয়াল, যেগুলো প্রধান সড়কের সামনে – পুব, দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে সবসময় দেখা যায়। এই দেয়ালগুলোতে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবহনকারী পোড়ামাটি ও ইট-নির্মিত বা অন্যকোনো মাধ্যম – সিমেন্ট, চীনামাটির ভাঙা তৈজসপত্রের টুকরো বা মোজাইক ব্যবহার করে বিভিন্ন শিল্পকর্ম স্থাপন করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আন্দোলন, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, সফলতা ও সার্থকতা তার সঙ্গে ভাষা, শিল্প আত্মপরিচয়ের নানা উজ্জ্বল অধ্যায় নিয়ে বিষয়ভিত্তিক শিল্প সৃষ্টি করা যেতে পারে এবং তা জাদুঘর ভবনের দৃশ্যমান চারদিকের দেয়ালে সন্নিবেশিত করতে হবে।
এভাবে আপাত অনাকর্ষণীয় ও অব্যবহৃত দেয়ালগুলোতে দৃষ্টিনন্দিত একটি যথার্থ অনুকরণীয় উল্লেখযোগ্য দেশজ পরিচয়ে পরিচিত অনুপম ও মনোময় শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে। আশা করি জাদুঘর ও সেইসঙ্গে বাংলা একাডেমী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ভবনের কর্তৃপক্ষ এই প্রকারের জনগণাদৃত গণদেয়াল চিত্রশিল্প সৃষ্টির বাস্তবায়নে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে এক ঐতিহাসিক শিল্প-দায়িত্ব পালনে আন্তরিক ও একান্তভাবে সচেষ্ট হবেন। প্রকৃতপক্ষে শিল্পকর্ম সব দেশ, মাটি ও জনগণ-সম্পৃক্ত হয়ে গড়ে ওঠে, সেটাই রহস্যময় প্রাকৃতিক বিধি ও নিয়ম। শিল্পের অন্তর্নিহিত অর্থ পরিস্ফুট ও প্রসারিত হয় মানুষ এবং প্রকৃতির সংমিশ্রণে। শিল্প সবসময় প্রয়োজনীয় ও প্রায়োগিক। পঞ্চ ইন্দ্রিয় – দৃষ্টি, শ্র“তি, স্পর্শ, ঘ্রাণ, স্বাদ – এইসব প্রাকৃতিক গুণাবলির চাহিদা মেটাতে শিল্পের সৃষ্টি এবং সব শিল্পই প্রাগুক্ত ইন্দ্রিয়নির্ভর। মানুষের প্রকৃত পরিচয় এইসব শিল্পের মাধ্যমে জায়মান হয়ে ওঠে। মাটি ও জীবনসংলগ্ন শিল্পই প্রকৃত শিল্প, যেমন আমাদের বা সব দেশের আদিশিল্প লোকজ শিল্প। বলা হয়, লোকজ শিল্প কখনো বিলুপ্ত হয় না, সবসময় যদি মানুষ ও মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। পিঁপড়ের ঢিবি যেমন মাটির নিচে অনায়াসে বসবাস করে এবং ওপরের বনভূমি যদি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে তবু তা টিকে থাকে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। এরকম লোকজ শিল্প পিঁপড়ের ঢিবির মতো আমাদের মাঝে সর্বদা স্থায়ী হয়ে বিরাজ করবে এবং ভবিষ্যতে সেইভাবে বহমান ও প্রবাহিত হয়ে অনিঃশেষিতভাবে কালে কালে চলতে থাকবে।