logo

পুরাণকল্প, বাস্তব ও কল্পরূপ কে জি সুব্রহ্মণ্যনের সাম্প্রতিক প্রদর্শনী

মৃ ণা ল  ঘো ষ

কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ এখন ভারতবর্ষের সৃজনশীল প্রবীণতম শিল্পীদের অন্যতম। তাঁর বয়স প্রায় নববই ছুঁয়েছে। এখনো তিনি যেন অনেকটা যৌবনের দীপ্তি নিয়েই সমানভাবে সক্রিয়। ছবি অনেক সহজ, সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত, ঐতিহ্যদীপ্ত হয়েছে। আঙ্গিকের মেধাপ্রসূত সমস্ত জটিলতাকে তিনি কাটিয়ে উঠেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৬০ ও ’৭০-এর দশকেপাশ্চাত্য-আধুনিকতা আত্তীকরণের পর্যায়ে একধরনের  মস্তিষ্কনির্ভর আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রবণতা তাঁর ছবিতে দেখা যেত। সেই পাশ্চাত্য-আঙ্গিকবাদের ওপর সর্বতোভাবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তিনি যখন তাকে নিজস্ব ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের সঙ্গে সমন্বিত করে নিতে পেরেছেন, তখন থেকেই তাঁর প্রকাশ সহজ ও সাবলীল হতে থেকেছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, প্রজ্ঞার উন্মীলনের সঙ্গে সঙ্গে, তা আরো স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে। নির্ভার, রসদীপ্ত হয়েছে। নিজস্ব প্রবহমান ঐতিহ্যের সঙ্গে আবিশ্ব উত্তরাধিকারের সমন্বয় ঘটেছে।

এরই পরিচয় পাওয়া গেল কলকাতার গ্যালারি ৮৮-তে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর একটি প্রদর্শনীতে। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মিথোলজিজ’। এক বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি তুলট কাগজের ওপর গোয়াশ বা অস্বচ্ছ জলরঙে তিনি এঁকেছেন চবিবশটি ছবি। সবগুলিই অতি সাম্প্রতিক কাজ। প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হলো গ্যালারি ৮৮-র প্রতিষ্ঠার পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে। ১৯৮৮-তে শুরু হয়েছিল এই গ্যালারি। বহু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ও প্রদর্শনী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এই গ্যালারি শিল্পচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সুব্রহ্মণ্যনের মতো একজন প্রবীণ ও বহুমুখী শিল্পীর কাজের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে এই গ্যালারির রজতজয়ন্তী যে উদ্যাপিত হতে পারল এটা খুবই গৌরবের।

কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। চিত্রকলা, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, ভিত্তিচিত্র সব ক্ষেত্রেই তিনি সমানভাবে পারদর্শী। সারাজীবন সবগুলি মাধ্যমেই নিরন্তর কাজ করে গেছেন। গ্রন্থচিত্রণের ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন, বিশেষত শিশুসাহিত্যে। এছাড়া বিশিষ্ট কবি, লেখক, শিল্পতাত্ত্বিক ও চিন্তক হিসেবেও অসামান্য বিস্তার ঘটেছে তাঁর প্রতিভার। শিক্ষক হিসেবে তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয়। শান্তিনিকেতন ও বরোদার শিল্পশিক্ষার পরিকাঠামো নির্মাণে তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সমস্ত গুণাবলির মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ভালোবাসাকে পরিব্যাপ্ত করেছেন। কাছের, দূরের পরিচিত সমস্ত শিল্পী ও শিল্পানুরাগী মানুষের কাছে তিনি প্রীতিভাজন ‘মানিদা’ নামে সুপরিচিত। এমন শ্রদ্ধেয় ও প্রীতিপূর্ণ শিল্পীব্যক্তিত্ব এখন এদেশে আর খুব বেশি নেই। শিল্পের সঙ্গে শিল্পতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রেও তিনি অনন্য। এই দুটি ক্ষেত্রকে মিলিয়ে নিতে পারার যে বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী সুব্রহ্মণ্যন্ সেই উত্তরাধিকারকে অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রবাহিত করে আসছেন।

শান্তিনিকেতনের শিল্প-ঐতিহ্যের একজন যোগ্য উত্তরাধিকারী তিনি। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে শিল্পশিক্ষা ও শিল্পচর্চাকেন্দ্র ‘কলাভবন’ তৈরি হয়েছিল ১৯১৯ সালে। ১৯২১-এ ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার পর তা বিশ্বভারতীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুর ওপর অর্পণ করেছিলেন কলাভবন পরিচালনার দায়িত্ব। কবির স্বপ্ন ছিল এখন থেকে বিকশিত হবে এমন এক শিল্পধারা, যা দেশীয় পরম্পরার শিকড় থেকে উন্মীলিত হয়ে আবিশ্ব বিস্তার পাবে এবং স্বদেশের সঙ্গে বিশ্বের সমন্বয় ঘটাবে। এই প্রকল্পকে যাঁরা সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও রামকিঙ্কর। তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার এক বিশেষ ধরন অভিব্যক্ত হয়েছে, যাকে কোনো শিল্পতাত্ত্বিক বলেছেন ‘কনটেক্সচুয়াল মডার্নিজম’ বা ‘প্রাসঙ্গিক আধুনিকতা’। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ছবিও অন্তর্ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত নিজস্ব চিত্রচর্চার মধ্য দিয়ে আমাদের আধুনিকতায় যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন, আমাদের আধুনিকতাবাদী চিত্রের ভেতর তা অত্যন্ত নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে স্বদেশ ও বিশ্বকে সমন্বিত করেছে। প্রবহমান ঐতিহ্য ও জীবনের প্রাসঙ্গিকতাকে সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত করেছে।

শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে নন্দলাল বসু ছিলেন সমস্তরকম ঔপনিবেশিকতাবাদী আধিপত্যের একান্ত বিরোধী।
এই আধিপত্যের প্রতিরোধেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন স্বদেশচেতনা-সম্পৃক্ত এক শিল্প-আঙ্গিক, যার ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়েছে পরম্পরার নানা স্তর। শিল্পকে স্বদেশসঞ্জাত আত্মপরিচয়ের দীপ্তিতে ভাস্বর করেছে। পরম্পরাকে বিস্তৃত করে তিনি সমগ্র প্রাচ্য-উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করেছিলেন। চীন ও জাপানের ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ থেকে, তাকে আরো অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নন্দলাল। শেষ পর্যায়ে এর সঙ্গে তিনি খুব সন্তর্পণে মিলিয়েছিলেন পাশ্চাত্য আধুনিকতার কিছু সারাৎসার।

ঐতিহ্যকে বিস্তৃত ও বিশ্বায়িত করার যে প্রকল্পের ভেতর কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল, দুজনে দুই বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে, যা আধুনিকতার ভেতর ‘কন্টেক্সট’ বা ঐতিহ্যগত আত্মপরিচয়ের প্রসঙ্গকে বিশ্বায়িত করতে চেয়েছিল, তাকেই আরো যুগোপযোগী ও সমকালসম্পৃক্ত প্রাসঙ্গিকতায় বিস্তৃত করেছেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও রামকিঙ্কর। বিনোদবিহারী প্রাচ্য-আঙ্গিকের গন্ডির ভিতরই কাজ করেছেন। অত্যন্ত প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে তাকে সময়ের মূল্যমানে অভিষিক্ত করেছেন। প্রাচ্য-ধ্রুপদীচেতনাকে তিনি বিশ্বগত প্রজ্ঞায় পরিশীলিত করে স্বদেশকে বিশ্বে পরিব্যাপ্ত করেছেন। মূলত নিসর্গ নিয়েই তিনি কাজ করেছেন বেশি। নিসর্গের উদাত্ততার ভিতর শূন্যতাদীর্ণ যে মগ্নতা আছে, তারই স্বরূপ উন্মীলিত করতে চেয়েছেন তিনি। জীবন বা মানুষের জঙ্গমতা বা গতিপ্রবাহও তাঁর ছবিতে এসেছে। তার ভিতর দিয়ে মানবিক চৈতন্যের ধ্রুপদী প্রজ্ঞাকেই তিনি উন্মীলিত করেছেন। ১৯৪৬-৪৭-এ করা শান্তিনিকেতন হিন্দি-ভবনের ম্যুরালে বিধৃত আছে যার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। বিনোদবিহারী ছিলেন সম্পূর্ণভাবেই ধ্রুপদীচেতনায় সংস্থিত।

তাঁর সতীর্থ রামকিঙ্করের প্রকাশ এ থেকে আলাদা। তাঁকে রোমান্টিক বললে হয়তো ভুল হবে না। চিত্র ও ভাস্কর্য দুটি মাধ্যমেই তিনি সমানভাবে কাজ করে গেছেন। ঐতিহ্যের দিক থেকে পছন্দ করেছেন আদিমতাকে। আদিবাসী পরম্পরার জীবন ও শিল্প থেকে তুলে এনেছেন শিল্পের উপকরণ। তাকে পাশ্চাত্য-আধুনিকতাবাদী আঙ্গিকের সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব রূপকল্প। দৈনন্দিন জীবনে মানুষের বঞ্চনা, অসহায়তা, হিংসা ও শোষণজনিত ক্ষয় এ সমস্ত তাঁকে ব্যথিত করেছে। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদীচেতনা থেকে গড়ে উঠেছে তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর যেমন নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর শিল্পের  বিভিন্ন পর্যায়ে। পাশাপাশি প্রকৃতির রহস্যময় ও উদাত্ত সৌন্দর্যের প্রতিও তাঁর আকর্ষণ ছিল। জলরঙের নিসর্গরচনায় যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী আঙ্গিককে আমাদের আধুনিকতায় সমন্বিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি।

শান্তিনিকেতন-উদ্ভূত প্রাসঙ্গিক-আধুনিকতার এই যে বিস্তার, এই ক্ষেত্রটিকেই সময়ান্বিতভাবে আরো প্রসারিত করেছেন কে জি সুব্রহ্মণ্যন্। নন্দলাল, বিনোদবিহারী এবং রামকিঙ্কর – তিনজনকেই তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। বিনোদবিহারীর প্রজ্ঞা, দর্শন ও কর্মধারা তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর সহকারী হিসেবেও অনেক প্রকল্পে তিনি কাজ করেছেন। সেখান থেকেও অর্জন করেছেন নিজস্ব শিল্পদৃষ্টি।

কে জি সুব্রহ্মণ্যনের জন্ম ১৯২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি উত্তর কেরালার কুথুপারাম্বু (Kuthuparambu) গ্রামে। শৈশবে স্থানীয় মন্দিরের দেয়ালে কাঠের কারুকাজের যে ভাস্কর্য বা গ্রামীণ নানা উৎসবের মধ্যে অতীত-বিধৃত প্রবহমান জীবনের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, তা তাঁকে প্রথম শিল্পচেতনার দিকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বদেশচেতনার প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রাথমিক উৎস ছিল এটা। মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন ১৯৪২-৪৩ সালে। তখন কেসিএস পানিক্কর ও দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সংস্পর্শে আসেন। তাঁরা চেয়েছিলেন তিনি মাদ্রাজ আর্ট কলেজে ভর্তি হোন। কিন্তু তখন তিনি যেতে চাননি শিল্পশিক্ষার দিকে। গিয়েছিলেন পরে, যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করে বেরিয়ে এলেন। তখন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অধিকার হারিয়েছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে। তাই ১৯৪৪ সালে শান্তিনিকেতনে এলেন কলাভবনে ভর্তি হওয়ার জন্য।

১৯৪৪ থেকে ’৪৮ তিনি কলাভবনে শিল্পশিক্ষা নেন। ঐতিহ্যগত আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যগুলিকে আত্মস্থ করেন সেখান থেকে। তাঁর প্রথম দিকের কাজে, ১৯৪৮, ’৪৯, ’৫০ সালের ছবিতে রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি লন্ডনের ‘স্লেড স্কুল অব আর্টে’ শিক্ষা গ্রহণ করেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতা ও অ্যাকাডেমিক রীতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটে সেখানে। দীর্ঘ সময় ধরে পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদী আঙ্গিক অনুধাবনের চেষ্টা করেন। সাময়িকভাবে পরম্পরাগত আঙ্গিক থেকে দূরেও সরে যান। ১৯৫৯ থেকে ’৬১ পর্যন্ত তিনি অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। দেশীয় লৌকিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটে এই সময়। এই আত্তীকরণের ফলে তাঁর শিল্প নতুন মোড় নেয়।

তাঁর প্রথম দিকের বিশেষত ১৯৬০-এর দশকের ছবিতে আমরা দেখেছি কেমন করে তিনি ইউরোপীয় আধুনিকতাকে আত্তীকৃত করেছেন। বিশেষত সিনথেটিক কিউবিজমের মধ্য দিয়ে রচনা করতে চাইছেন এক চিত্রভাষা, যেখানে বর্ণনাত্মক কোনো অনুষঙ্গের ভিতর না গিয়ে বিশুদ্ধভাবে দৃশ্যতাকেই শুধু পরিস্ফুট করা যায়। এর মধ্যে তাঁর টেরাকোটা রিলিফগুলিতে দেখা যায় কৌতুকপূর্ণ এক সারল্যের উপস্থাপনা। ১৯৬৩-তে লক্ষ্ণৌয়ের রবীন্দ্রালয়ের জন্য ‘কিং অব দ্য ডার্ক চেম্বার’ নামে যে টেরাকোটা ম্যুরাল করেন, সেখান থেকে এর সূচনা। আবার আর একটু পরবর্তী সময়ের কাচচিত্রগুলির মধ্যে দেখা যায় সারল্যময় রৈখিক উপস্থাপনা ও সমতল বর্ণপ্রয়োগে দেশজ নিম্নবর্গীয় চিত্রধারার নান্দনিকতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন আধুনিকতাকে আরো সমৃদ্ধ করতে।

তাঁর পরিণত পর্বের ছবিতে তিনি ক্রমান্বয়ে বাস্তবতার ওপরের স্তরকে অতিক্রম করে মগ্নচেতনায় প্রবাহিত ঐতিহ্যের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করতে চেষ্টা করেছেন। বাস্তবতার মধ্যে তিনি দেখেছেন দুটি স্তর। বাইরের দৃশ্যবাস্তবতা চেতনার মধ্যে কল্পরূপে রূপান্তরিত হয়। সেই কল্পরূপে থাকে ঐতিহ্যগত অতীতের  সারাৎসার। কাজেই প্রতিটি দৃশ্যের মধ্যে থাকে অন্য এক বিকল্প উপস্থিতি (alternative presences)। এই দুইয়ের মধ্যে সমীকরণ চলে। এই সমীকরণের মধ্য দিয়ে ভাবনার জগৎ হয়ে ওঠে এক রূপকথার জগৎ। এইখানেই অনুপ্রবেশ ঘটে ‘মিথ’ বা পুরাণকল্প। আলোচ্য প্রদর্শনীতে আমরা যে ছবি দেখি, তার ভিত্তিতে রয়েছে পুরাণকল্প। তাই এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মিথোলজি’।

‘মিথ’ বা পুরাণকল্প মানবিক অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। এর উৎস প্রাগৈতিহাসিক অতীতে, যখন মানুষ তার   অস্তিত্বের প্রয়োজনে প্রকৃতির প্রতিকূল শক্তিগুলিকে নিজের অনুকূলে আনার জন্য নানাবিধ জাদু-আচারের চর্চা করত। প্রকৃতির বিপুল শক্তিকে এক একটি প্রতীকে রূপান্তরিত করে অনুধাবন করতে চাইত। একে সে নিজস্ব বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত মনে করত। প্রকৃতি ও জীবনে যেমন কোনো বিচ্ছিন্নতা ছিল না, তেমনি বিভেদ ছিল না পুরাণকল্পের বিভিন্ন প্রতীক ও তার প্রাত্যহিক জীবনচর্চার মধ্যেও। পুরাণকল্পের মধ্য দিয়েই মানুষ বৃহত্তর মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে একাত্ম করে নিত। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুক্তিবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে মানুষ পুরাণকল্পের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। তাই পুরাণকল্পের প্রাক্তনসত্যের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছিন্নতা ঘটেছে। পুরাণকল্পকে সে অতিকথা মনে করেছে। দৈনন্দিন বাস্তব জীবনযাপনে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছে।

কিন্তু সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে যখনই মানুষ শিল্পসৃজনের ক্ষেত্রে এসেছে তখন সত্যের চাক্ষুষ বা বুদ্ধিগ্রাহ্য রূপকেই সে একমাত্র সত্য বলে তৃপ্ত থাকতে পারেনি। আপাতসত্যের ভেতর সে অনেক অসংজ্ঞায়িত আলো-অাঁধারি-স্তর শনাক্ত করেছে। তাকে অনুধাবন করতে নানা উপকরণের মধ্যে পুরাণকল্পও হয়ে উঠেছে বিশেষ এক অনুধ্যানের বিষয়। তাই আবহমানকালের শিল্পের ভেতর আমরা পুরাণকল্পের নানা প্রকাশ দেখতে পাই। নানা প্রতীক দেখতে পাই। এক এক যুগের শিল্প পুরাণকল্পকে এক একভাবে ব্যবহার করেছে। পাশ্চাত্যের বাইজান্টাইন শিল্প একভাবে। রেনেসাঁস-শিল্প আর একভাবে। আধুনিক মস্তিষ্কনির্ভর শিল্পে ‘মিথ’-এর ব্যবহার কমেছে। ‘কিউবিজম’, ‘ফিউচারিজম’ বা ‘ডাডাইজমে’ মিথের প্রয়োগ খুবই সীমিত। আবার সুররিয়ালিজমে তা বেড়েছে। কেননা সুররিয়ালিজম স্বপ্ন বা মগ্নচেতনার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।

আমাদের দেশে আদিম ও লৌকিক শিল্পে পুরাণকল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। আধুনিকতার নানা পর্যায়ে বিভিন্নভাবে এর প্রকাশ ঘটেছে। রবি বর্মা বা বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার আঙ্গিকের ছবিতে তা ছিল। সেখানে ছিল পুরাণকল্পের আখ্যানের বহির্মুখী প্রতিফলন। অবনীন্দ্রনাথ যখন ঐতিহ্যগত দেশীয় চৈতন্যের ভেতর প্রবেশ করতে চাইলেন, তখন তিনি পুরাণকল্পকে গ্রহণ করলেন অন্তর্মুখী দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রবহমান জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। ১৯৩৮-এর ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ বা ‘কবিকঙ্কণ দন্ডী’ চিত্রমালায় আমরা এর সার্থক দৃষ্টান্ত দেখি। যামিনী রায় পুরাণকল্পকে ব্যবহার করেছেন লৌকিক প্রজ্ঞাদীপ্ত সারল্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় যেহেতু নিসর্গেই স্থিত থেকেছেন বেশি, তাই তাঁর ছবিতে পুরাণকল্পের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। রামকিঙ্কর ছিলেন প্রত্যক্ষ প্রবহমান জীবনের ভাষ্যকার। তাই তাঁর ছবিতে পুরাণকল্প এসেছে অপরিসীম গুরুত্বে ও বৈভবে। তাঁর ‘কৃষ্ণের জন্ম’ ছবি পুরাণকল্পকে সমকালীন বা চিরন্তন বাস্তবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার অনবদ্য দৃষ্টান্ত।

কে জি সুব্রহ্মণ্যনের প্রথম পর্বের ছবিতে পুরাণকল্পের ব্যবহার বিশেষ ছিল না। তখন তিনি অাঁকছেন দৈনন্দিনতার নানা বিষয় নিয়ে। ১৯৪৯-এর ‘স্নেক চার্মার’ ছবিতে লক্ষ করা যায় রামকিঙ্করের প্রভাব। ১৯৫২-র ‘গার্লস ইন ইনটেরিয়র’, ‘সিটেড ফিগার’ বা ‘গার্ল উইথ সানফ্লাওয়ার’ ছবিতে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছন্দিত অলংকরণময়তার সুস্মিত প্রকাশ আমরা দেখি। লন্ডনের স্লেড স্কুলে শিক্ষানবিশি-পর্বে ও পাশ্চাত্য আধুনিকতা আত্তীকরণের পর্যায়ে তাঁর ছবি হয়ে ওঠে সম্যকভাবে গাঠনিক। চিত্রক্ষেত্রের পরিসর-বিন্যাস নিয়ে নানা রকম গবেষণা করেছেন সেই পর্যায়ে। বিশ্লেষণাত্মক ও সমন্বিত ঘনকবাদ বা কিউবিজমকে নানাভাবে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। ১৯৬১-র স্টিল লাইফ উইথ ম্যাঙ্গোজ, ১৯৬৩-র স্টিল লাইফ উইথ বটলস, স্টিল লাইফ উইথ সিরামিক জারস, ১৯৬৪-র আর্টিস্ট অ্যান্ড মডেল ইত্যাদি ছবিতে এর দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায়। এই সময়ই অবশ্য প্রতিমাকল্পের জ্যামিতিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে লৌকিক-বিধৃত পুরাণকল্পও আত্তীকৃত হতে থাকে। ১৯৬৩-র লক্ষ্ণৌ রবীন্দ্রালয়ের টেরাকোটার ভিত্তিচিত্র তাঁর পুরাণকল্পমগ্নতার প্রথম পর্বের দৃষ্টান্ত।

পুরাণকল্পের অনুধ্যান ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে তাঁর ছবিতে ১৯৮০-র দশকের পর থেকে। লৌকিক জীবনের কৌতুকদীপ্ত বৈচিত্র্যকে বর্ণিল বিন্যাসে নানাভাবে এনেছেন। দেশীয় পরম্পরার নানা সুর ও ঐকতানকে, আনন্দ ও সংঘাতকে নানাভাবে খেলিয়েছেন। ‘বহুরূপী’ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে বাস্তব ও বাস্তবাতীতকে একসঙ্গে মিলিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে ‘বহুরূপী’ শীর্ষক এক প্রদর্শনীর ভূমিকায় লিখেছিলেন : যে জগৎ তিনি দেখেন স্বাভাবিকভাবেই তা রূপকথার জগৎ। এই রূপকথার জগতেরই নানা প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ছবিতে পরবর্তীকালে। পুরাণকল্প সম্পৃক্ত হয়েছে সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে। এরই নানা প্রকাশ দেখি আমরা আলোচ্য প্রদর্শনীতে।

এই প্রদর্শনীর একটি ছবি যদি আমরা নিবিষ্টভাবে দেখি, তাহলে বুঝতে পারি, পুরাণকল্পের সঙ্গে তিনি কীভাবে শৈশবসারল্যকে মিলিয়েছেন। রূপকথার গল্প বলতে বলতেই তার সঙ্গে চিরন্তন শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বকে সম্পৃক্ত করেছেন। ছবিটি রাম-রাবণের যুদ্ধবিষয়ক। সমতল বর্ণিল প্রেক্ষাপটে সারল্যময় দ্বিমাত্রিকভাবে সংস্থাপিত হয়েছে প্রতিমাকল্প। চিত্রক্ষেত্রের বাঁ পাশে রাবণের উপস্থাপনা। তার দশমুন্ড ত্রিভুজের মতো গলার ওপর থেকে ঊর্ধ্বমুখে উঠে একটি বিন্দুতে মিলেছে। এক একটি মুখের মধ্যে এক এক রকম অভিব্যক্তি – মৌলবাদ থেকে ফ্যাসিজম পর্যন্ত নানা ধরনের। রাবণের দুই হাতে রক্তবর্ণ তরবারি ও ছুরিকা। সে রামচন্দ্রকে আক্রমণোদ্যত। সম্মুখে তার তুলনায় ক্ষুদ্রকায় শ্রীরামচন্দ্র ধনুকে তীর সংযোগ করে টানতে উদ্যত। তার পিছনে বৃহদাকৃতি হনুমান দুহাত ছড়িয়ে ধাবমান। পিছনে লক্ষ্মণ। মধ্যভাগে একটি গাছের তলায় এক মানবীমূর্তি। খুব সহজ ছন্দে বলা এই গল্পের ভিতর দিয়ে শিল্পী রামায়ণের পুরাণকল্পকে যেমন এনেছেন, তেমনি চিরন্তন শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বকেও প্রতীকায়িত করেছেন।

একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে চিত্রক্ষেত্র চারটি আয়তাকার পরিসরে বিভাজিত। প্রতিটি ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে নর-সিংহের সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন ভঙ্গির সহাবস্থান ও কথোপকথন। ভারতীয় লৌকিকের সঙ্গেই প্রাচীন মিশরীয় শৈলীর সমন্বয় লক্ষ করা যায় এখানে।

একটি ছবিতে বিশালকায় গণপতিকে এঁকেছেন। শুভ্র শুঁড় প্রলম্বিত করে বসে আছেন গণপতি। তাঁর দুই জানুর ওপরে বসে আছে দুটি বালক। দুটি গাছ রয়েছে দুপাশে। দুটি ইঁদুর গাছ বেয়ে ওপরে উঠে গণেশের দিকে তাকিয়ে আছে। দেবতা, মানুষ ও প্রাণিজগতের এক সম্মিলিত আখ্যান, যে জীবন আজকের বাস্তবে নেই, কিন্তু রয়ে গেছে প্রবহমান কৌমচেতনায়। সাদা মুখোশ পরা চৌকির ওপর অর্ধশায়িতা নারী। সামনে ঘরের বাইরে একই রকম মুখোশ পরা দন্ডায়মান এক পুরুষ। অন্যদিকে এক ডানাওয়ালা উড়ন্ত বালিকা। মাঝখানে নেমে আসছে একটি পাখি। চৌকির পাশে মেঝের ওপর সাজানো রয়েছে ফুলদানি। গৃহাভ্যন্তরে সাধারণ জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটছে পুরাণকল্পের।

পুরাণকল্পের সঙ্গে জীবনের পরতে পরতে বিভিন্ন ধরনের সম্মিলন ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে শিল্পী এই প্রযুক্তি-অধ্যুষিত সন্ত্রাসদীর্ণ বিশ্বায়িত আজকের জীবনের পরিমন্ডলেও মিথ ও ম্যাজিক, পুরাণকল্প ও জাদুর সহাবস্থানের ভিতর দিয়ে জীবনপ্রবাহের নিভৃত সৌন্দর্যের নানা আলেখ্য উপস্থাপিত করেছেন এই চিত্রমালায়। পুরাণকল্প ও জীবনের সম্পৃক্ততার এক নতুন ভাষ্য রচনা করেছেন। প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে ধরেছেন এই দুইয়ের মেলবন্ধনকে। পরিস্ফুট হয়েছে এক আলোকিত ঐকতান।

Leave a Reply