হা সা ন ফে র দৌ স
কাকতালীয় বলে বাংলায় একটা চমৎকার শব্দ আছে। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ কো-ইনসিডেনস – মোটেই তেমন সুন্দর কিছু নয়। ভাবুন দেখি, কাক এসে বসল তালগাছে, আর সে তাল টুপ করে পড়ল আপনার মাথায়। প্রায় আধা ডজন কো-ইনসিডেনস ঘটলে তবেই না এমন একটা কাণ্ড হবে। লাখে একটা হয় কি না কে জানে।
পিকাসো, মাতিস ও গার্ট্রুড স্টাইনকে নিয়ে তেমন একটা কাকতালীয় ঘটনার আমি সাক্ষী। প্রথম ঘটনা, গত বছর মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের নিজস্ব সংগ্রহ নিয়ে পিকাসো প্রদর্শনী, যার কেন্দ্রে ছিল পিকাসোর আঁকা গার্ট্রুডের অসাধারণ পোর্ট্রেট। ১৯৪৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে গার্ট্রুড নিজে ছবিটি মিউজিয়ামকে দান করে যান। মেটে সে ছবি দেখে আমি একটি চটজলদি লেখাও ছেপেছিলাম।
দ্বিতীয় ঘটনা, এর এক মাসের মাথায় আকাশপথে আটলান্টিক পাড়ি দেবার সময় প্লেনে বসে দেখা উডি অ্যালেনের রোমান্টিক কমেডি ফিল্ম মিডনাইট ইন প্যারিস। গল্পের বিষয়, ১৯২০-এর দিকে প্যারিসে লেখক-শিল্পীদের আড্ডা, যার অন্যতম কুশীলব পিকাসো, গার্ট্রুড ও মাতিস। পিকাসোর আঁকা গার্ট্রুডের সেই ছবি একদম মধ্যমঞ্চে।
তৃতীয় ঘটনা, এ-বছরের গোড়ার দিকে উডি অ্যালেনের ছোটগল্পের সংকলন গেটিং ইভেন হাতে আসা। গড়িমসি করে অবশেষে যখন পড়া শুরু করি, আমি একদম হতবাক। বইয়ের একটি গল্পের নাম ‘এ টোয়েন্টিস মেমোরি’, যার বিষয় ১৯২০-এর দিকে পিকাসো, গার্ট্রুড ও মাতিসসহ অন্য মহারথীদের কেচ্ছা। সে গল্প পড়ে শেষ করতে না করতে খবর এলো মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে গার্ট্রুড ও তাঁর দুই ভাই ও এক ভ্রাতৃবধূ প্যারিসে থাকতে মাতিস ও পিকাসোর যেসব শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছিলেন, তার এক প্রদর্শনী।
বলুন, কাকতালীয় নয় তো আর কী?
বস্তুত ১৯৭১-এ প্যারিসের যে গল্প উডি অ্যালেন লিখেছিলেন, চল্লিশ বছর পর তাই সেলুলয়েডের পর্দায় দেখার সুযোগ পেলাম। ফিল্মে আমাদের দেখা মেলে প্যারিসে ভ্রমণরত এক তরুণ হবু লেখক স্বপ্নের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁর কল্পনার প্যারিসে, ঠিক প্রথম মহাযুদ্ধের পর, যখন সে শহর গম গম করছে আধুনিক লেখক-গায়ক-শিল্পীদের পদচারণায়। এ টোয়েন্টিস মেমোরি অবশ্য টাইম-ট্রাভেলের বিবরণ নয়, বিশের দশকে প্যারিসে এক মার্কিন যুবকের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার বিবরণ। শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে
অল্প-বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে এমন যে কেউ প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক পরের এই প্যারিস নিয়ে উৎসাহিত না হয়ে পারেই না। চিত্রকলায়, সংগীতে, সাহিত্যে ও দর্শনে যা কিছু নতুন, যা কিছু চোখ ধাঁধানো, তার সবকিছুই তখন ঘটছে এই প্যারিসে। এক মহাসমরে অংশগ্রহণ শেষে এসে পৌঁছেছেন হেমিংওয়ে। ফিটজিরালড তাঁর নববিবাহিত স্ত্রী জেলডাসহ আস্তানা নিয়েছেন এই শহরে। পিকাসো এই শহরে এসেছেন শতাব্দীর গোড়ার দিকে, ক্রমশ তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন প্যারিসের শিল্পবোদ্ধারা। সেতুবন্ধের কাজটি করছেন গার্ট্রুড ও তাঁর ভাই লিও। দালিও তখন প্যারিসে। এছাড়া রয়েছেন বুনুয়েল, আপোলিনিওর ও মার্কিন জাজ শিল্পী কোল পোর্টার। উডির গল্পে ও ফিল্মে এঁদের অনেকেই কুশীলব।
উডি অ্যালেনের ফিল্মে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও হাজির হন গার্ট্রুড স্টাইন ও তাঁর ভাই লিও স্টাইন। গার্ট্রুডের ২৭ রু দ্য ফ্লরুসের সালোনটি এই ফিল্মের জন্য গভীর যতেœর সঙ্গে পুনর্নির্মাণ করেছেন উডি। ঘরজুড়ে ছবি, যেন কিঞ্চিৎ অগোছালো কোনো এক মিউজিয়াম। এক ঝলক দেখি গার্ট্রুডকে তাঁর বিখ্যাত আরাম কেদারায় বসে, পেছনের দেয়ালে পিকাসোর আঁকা তাঁর সেই বিখ্যাত পোর্ট্রেট। মাতিসের বিখ্যাত ছবি, ওম্যান উইথ এ হ্যাট, যা ১৯০৫ সালে গার্ট্রুড পাঁচশো ফ্রাঁ দিয়ে কিনেছিলেন, সেদিনের হিসাবে একদম কম নয় যদিও আজকের মূল্যে তা প্রায় হাস্যকর, তাও বুঝি উঁকি দেয়। পিকাসো, প্রায় বাক্যহীন, নিঃশব্দে পায়চারী করছেন। সম্ভবত তাঁর সে-সময়ের প্রেমিকা ফেরনান্ডে অলিভিয়েও তাঁর সঙ্গে ছিলেন, কিন্তু আমার পক্ষে তাঁকে চিনে ওঠা সম্ভব হয়নি। গার্ট্রুড নিজেকে ‘জিনিয়াস’ ভাবতেন। মাত্র এক ঝলকের দেখা, কিন্তু তারই মধ্যে উডি অ্যালেন কিঞ্চিৎ কৃত্রিম, কিঞ্চিৎ ফাঁপানো এই মানুষটির পোর্ট্রেট সেলুলয়েডের পর্দায় ঠিকই এঁকে ফেলেন।
মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের সৌজন্যে সেই প্যারিসে আবার ফেরা হলো। আবার দেখা হলো গার্ট্রুড, পিকাসো ও মাতিসের সঙ্গে। এটি শুধু চোখ ধাঁধানো এক চিত্র-প্রদর্শনী নয়, আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসের এক নাটকীয়, ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সচিত্র বিবরণ। এই নাটকের প্রধান চরিত্র অবশ্যই গার্ট্রুড। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সহোদর লিও ও গার্ট্রুডের দীর্ঘদিনের সমকামী বন্ধু এলিস বি টোকলাস। এছাড়া মাতিস ও পিকাসো তো থাকছেনই। বক্ষ্যমাণ রচনায় সে নাটকের পুনর্নির্মাণে নিবিষ্ট হব আমরা, আমাদের গাইড হিসেবে থাকবে গার্ট্রুডের লেখা দি অটোবায়োগ্রাফি অব এলিস বি টোকলাস। এলিসের আত্মজীবনী হিসেবে নামকরণ হলেও এটি যে এলিসের জবানিতে গার্ট্রুডেরই আত্মকথন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে বই ছাপা হয়ে বেরোতে না বেরোতেই ইউরোপের নামজাদা বিভিন্ন শিল্পী-লেখক, তাঁদের মধ্যে মাতিসও ছিলেন, তীব্র ভাষায় গার্ট্রুডকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে আক্রমণ করবেন। এই আলোচনায় তাঁদের সে প্যাম্ফলেট থেকেও রসদ নেব। সবচেয়ে বেশি যে পাথেয় আমাদের থাকবে তা হলো পিকাসো ও মাতিসের আঁকা ছবি এবং ছবির পেছনের গল্প।
নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামটি এমনিতেই বিশাল। তার নিয়মিত সংগ্রহ তো আছেই, তার ওপর রয়েছে নিত্যনতুন প্রদর্শনী। ‘স্টাইনস কালেক্ট’ যাতে স্টাইন পরিবারের চার সদস্যের সারা জীবনের চিত্রকলা ও শিল্পসামগ্রী সংগ্রহের প্রায় প্রতিটি জিনিস এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে, তা সুপরিকল্পিতভাবে বিতরণ করে সাজানো হয়েছে ছোট-বড় মোট নয়টি গ্যালারিতে। স্টাইন ভাই ও বোনের প্যারিসের বাসগৃহের উন্মুক্ত গ্যালারির অনুকরণে, প্রায় একই আকারের একটি ঘর সাজানো হয়েছে। শুধু ছবি ও ভাস্কর্য নয়, স্টাইন পরিবারের প্রায় একশ বছরের ইতিহাসও এখানে বিবৃত হয়েছে – তাঁদের সংগ্রহ থেকে পাওয়া অসংখ্য ছবি, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দ্রব্য, চিঠি। গার্ট্রুডের লেখা একটি অপেরার অংশবিশেষের ভিডিও-ও এখানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। শুধু চিত্রকর্মই আছে শচারেক – কেবল পিকাসো ও মাতিসের নয়, বিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেক প্রধান চিত্রকর ও ভাস্করের কাজ। সেজানের ভক্ত ছিলেন তাঁরা দুজনই, বিশেষত লিও, ফলে একাধিক সেজান রয়েছে। আছে রেনোয়া, মানে, এমনকি গগাঁ-ও। এসব ছবির অধিকাংশই ১৯২০-এর আগে কেনা, যখন নতুন ধারার শিল্পীরা অধিকাংশই প্রায়-অপরিচিত, অখ্যাত। সে সময় ছবির দাম ছিল সামান্য, পিকাসোর অনেক ছবি গার্ট্রুড কিনেছেন মাত্র দুই ডলারে। ভাইবোনের সম্পর্কে ফাটল ধরায় তাঁদের সংগৃহীত ছবি ভাগাভাগি হয়ে যায়। পরে, অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেক ছবি তাঁরা বিক্রি করতেও বাধ্য হন। ফলে এই প্রদর্শনীর অনেক ছবি সংগ্রহ করতে হয়েছে আটলান্টিকের উভয় পারের বিভিন্ন মিউজিয়াম ও ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। বিলিবণ্টন না হলে তাঁদের সংগ্রহ নিয়েই যে একটা আস্ত মিউজিয়াম গড়ে তোলা যেত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্যারিসে গার্ট্রুডের বাসগৃহের দ্বার অবারিত ছিল নতুন ধারার লেখক-শিল্পীদের। প্রতি শনিবার বসত সালোন। মাতিস ও পিকাসো তাদের অন্যতম অতিথি। পিকাসোর অনেক ছবি প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয় গার্ট্রুডের বাসায়। পিকাসো বা মাতিসের সেসব ছবি দেখতে হলে ছুটে আসতে হতো ২৭ রু দ্য ফ্লরুসে। নবশিল্পধারার সমর্থনে গার্ট্রুডের এই ভূমিকার জন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘প্রপাগান্ডিস্ট’ নামে অভিহিত করেছেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে নবধারার এই শিল্পকলা খুব যে সমাদৃত হয়েছিল, তা নয়। স্টাইন পরিবারই তাকে জনসমক্ষে আনতে সাহায্য করে। মাতিস ও পিকাসোকেও একে অপরের সঙ্গে পরিচিত করান গার্ট্রুড। এই দুজনের মধ্যে যে ঈর্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাজ করত, গার্ট্রুডের সালোন তার সাক্ষী।
২৭ রু দ্য ফ্লরুস
শিল্পেরও সম্ভবত একজন দেবতা আছেন। অন্যথায় গার্ট্রুড ও তাঁর ভাই লিও-র প্যারিসে আধা স্থায়ীভাবে বাস করার কথা নয়। জন্মেছিলেন পেনসিলভানিয়ায়, ধনী জার্মান ইহুদি ব্যবসায়ী পিতার ঘরে। ড্যানিয়েল স্টাইন, তাঁর পিতা, আরো লাভ হবে ভেবে প্রথমে ভিয়েনা, পরে প্যারিসে আস্তানা গাড়েন। কিন্তু তেমন সুবিধা না হওয়ায় ফিরে আসেন আমেরিকায়, এবার ডেরা বাঁধেন ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে। সেখানেই গার্ট্রুডের শিক্ষাজীবন শুরু। পরে অবশ্য বালটিমোর ও ম্যাসাচুসেটসে। প্রথমে ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়ার, পরে ঠিক করলেন ডাক্তার হবেন। কোনোটাই হওয়া হলো না। পিঠাপিঠি ভাই লিওর শখ ছিল
দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। গার্ট্রুড তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরেন্স, লন্ডন হয়ে শেষ পর্যন্ত এসে হাজির হন প্যারিসে ১৯০৩ সালে। ফ্লোরেন্সে থাকতেই লিও ছবি আঁকার ব্যাপারে উৎসাহী হন। জাপান সফরে এসে সেখানকার শিল্পীদের ছাপচিত্র দেখে তা সংগ্রহে উৎসাহী হন, ছবি সংগ্রহের বাতিক সেই থেকে শুরু।
লিও প্যারিসের বনেদি পাড়ায়, ২৭ রু দ্য ফ্লরুসে, খোলামেলা একটি বাড়ি ভাড়া নেন। তিনি গুছিয়ে উঠতে না উঠতেই পিছু পিছু এলেন গার্ট্রুড। বড় ভাই মাইকেল, পিতার মৃত্যুর পর স্টাইন পরিবারের ব্যবসা দেখাশোনার ভার যার ওপর পড়েছিল, ও তাঁর স্ত্রী সারাহ-ও প্যারিসে
আস্তানা গাড়লেন পরের বছর, লিও-গার্ট্রুডের বাড়ির কাছেই। লিও বা গার্ট্রুড কারোরই কোনো পেশা ছিল না, কোনো নির্দিষ্ট চাকরিও কেউ করেননি কখনো। খুব যে বড়লোক ছিলেন, তাও নয়, যদিও তাঁদের ছবি কেনার অভ্যাস থেকে মনে হতে পারে বেহিসাবি আমেরিকান। তাঁদের দুজনের নামে ব্যাংকে আলাদা আলাদা ট্রাস্ট ফান্ড রাখা ছিল, সেখান থেকেই মাসোহারা তুলে ব্যয় নির্বাহ হতো। যদি কখনো টাকায় টান পড়ত, বড় ভাই মাইকেল তো ছিলেনই। প্যারিসে আসতে না আসতেই ব্যবসা থেকে হঠাৎ বড় ধরনের লাভ হয় স্টাইন পরিবারের। যেন হাতে চাঁদ পেলেন লিও গার্ট্রুড।
গার্ট্রুড ও লিও যে বাড়িতে ওঠেন সেটি ছিল আকারে মাঝারি। দুটি শোবার ঘর, তার বাইরে একটা বড় অংশজুড়ে বসার ঘর। ১৯০৭ সালে এলিস এসে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত সে বাড়িতে কাজের লোক বাদ দিলে থাকার লোক ছিল মোটে দুজন, ফলে ছবি ঝোলাবার জায়গা বিস্তর। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের সে বাড়ি হয়ে উঠল প্যারিসের আভঁ-গার্দ
শিল্পী-লেখক-সমঝদারদের নিত্য আড্ডার এক প্রধান আস্তানা। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনেরা তো বটেই, চেনা-অচেনা যে কেউই তাঁদের ‘সালোনে’র দরজায় টোকা দিতে পারতেন। তাঁদের পরিচিত কোনো একজনের নাম নিয়ে বললেই হতো, তিনি আমাকে আপনার বাসায় আসার ঠিকানা দিয়েছেন। সে বাসায় প্রতি সপ্তাহে বসত ‘শনিবারের সালোন’। নামজাদা সব লেখক-চিত্রকরদের নিয়ে হতো জম্পেশ আড্ডা ও ভোজ। মধ্যরাত পর্যন্ত চলত সে আড্ডা, কখনো কখনো ভোররাত অবধি চলত পানাহার। সব অতিথি বিদায় হলে তারপরে লিখতে বসতেন গার্ট্রুড। তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী দ্য মেকিং অব আমেরিকানস এভাবেই শুরু। ১৯১৩ পর্যন্ত এ বাড়িতেই ছিলেন গার্ট্রুড, লিও এবং এলিস বি টোকলাস। বোনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সে বাড়ি ছেড়ে চলে যান লিও। বাকি জীবনে বেশির ভাগ সময়ই তিনি কাটান দেশ-বিদেশে ঘুরে। গার্ট্রুড ও এলিস ২৭ রু দ্য ফ্লরুসের এই বাড়িতেই কাটান পরবর্তী দুই দশক।
ছবি সংগ্রহের কাজটি শুরু করেছিলেন লিও। খুব ভেবেচিন্তে নয়, কিছু জাপানি প্রিন্ট দেখার পর খুব ভালো লেগে গেলে কিনে ফেলেন। সেই থেকে শুরু। এক বন্ধুর কাছে সেজানের ছবি দেখার পর তাঁর সংগ্রহ শুরু করেন। সে-সময়ে প্যারিসে সবচেয়ে বড় গ্যালারির মালিক ছিলেন ভোলার। তাঁর কাছ থেকেই তাঁদের সংগ্রহের প্রথম সেজানটি তাঁরা কেনেন, ল্যান্ডস্কেপ ‘উইথ দ্য ¯িপ্রং হাউস’। ভোলারের চোখে সে-সময় বিশ্বের সেরা শিল্পী সেজান। তাঁর ছবির প্রতি এই দুই আমেরিকান ভাইবোনের আগ্রহ দেখে ভোলার যেমন বিস্মিত, তেমনি আনন্দিত হয়েছিলেন। তাঁদের বন্ধুত্বের সেই শুরু।
ওম্যান উইথ এ হ্যাট
১৯০৫ সালের কথা। সে বছর প্যারিসে বার্ষিক হেমন্তকালীন
চিত্র-প্রদর্শনীতে গার্ট্রুড প্রথমবারের মতো পরিচিত হন মাতিসের ছবির সঙ্গে। গার্ট্রুডের বয়স তখন একত্রিশ, মাতিসের ছত্রিশ। প্রদর্শনীতে ভিন্ন স্বাদের অনেক ছবিই ছিল, কিন্তু অধিকাংশের সমালোচনার শিকার হয় যে ছবিটি তা হলো মাতিসের ‘ওম্যান উইথ এ হ্যাট’। সে ছবি দেখে লোকজন কেবল যে ছি ছি করে তা-ই নয়, কেউ কেউ নখের আঁচড় দিয়ে তার কিঞ্চিৎ ক্ষতিও করে। ছবিটি দেখে লিওর মন্তব্য ছিল, একি বিচ্ছিরি ছবি (পরে তাঁর স্মৃতিকথা অ্যাপ্রিসিয়েশনে লিও অবশ্য গার্ট্রুডের স্মৃতি সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। ছবিটি দেখে তাঁর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এ-কথা হয়তো ঠিক, কিন্তু ‘মনে মনে আমার অজান্তে এমন ছবিরই প্রতীক্ষায় আমি ছিলাম’)। তাঁর পছন্দ হয় মাতিসের আরেকটি ছবি। কিন্তু গার্ট্রুড চাইছিলেন পাখা হাতে লম্বা মুখো মহিলার ছবিটিই। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো তাঁরা দুটো ছবিই কিনবেন।
মাতিস সে-সময় প্রবল অর্থকষ্টে ভুগছেন, ছেলেমেয়েদের খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়ায় তাদের বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়তি আয় হবে ভেবে তাঁর স্ত্রী – ‘ওম্যান উইথ এ হ্যাটে’র মডেল – এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে এক দোকান খুলে বসেন। মাতিস চাইছিলেন ‘ওম্যান উইথ এ হ্যাট’ ছবিটির জন্য পাঁচশো ফ্রাঁ, তখনকার হিসেবে একশ ডলার। ভোলারের পরামর্শ শুনে গার্ট্রুড ও লিও প্রস্তাব করলেন, ছবিটির জন্য চারশো ফ্রাঁ দেবেন তাঁরা। প্রদর্শনীর প্রথম দিন মাতিস এসেছিলেন, কিন্তু দর্শকদের কটু মন্তব্য শুনে তিনি এতটা ব্যথিত হয়ে পড়েন যে আর একবারও সে-প্রদর্শনীমুখো হননি। ছবিটি বিক্রি হবে এমন আশাও তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঠিক তখনই চারশো ফ্রাঁর প্রস্তাবটি নিয়ে ভোলারের এক সহকারী দেখা করতে এলেন। প্রস্তাব শুনে মাতিস তো এক কথায় রাজি, কিন্তু মাদাম মাতিস বললেন, না, পুরো পাঁচশো ফ্রাঁ-ই দিতে হবে। তাঁর পীড়াপীড়িতে অনেকটা নিমরাজি হয়েই মাতিস চিরকুটে লিখে পাঠালেন, তাঁকে পুরো দাম দিলে তবেই তিনি ছবি বিক্রি করবেন। এরপর বেশ কয়েকদিন চলে যায়, কোনো খোঁজখবর নেই। ক্রেতা বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল ভেবে মাতিস তাঁর স্ত্রীর ওপর মহাখাপ্পা। স্ত্রীও এই নিয়ে ভীষণ মনস্তাপে ভুগছিলেন। এমন সময় নীল খামে বার্তা এসে হাজির, তার চাওয়া দামেই ছবিটি কিনতে রাজি হয়েছে স্টাইন পরিবার। সে বার্তা পড়ে খুশি হওয়ার বদলে মাতিসের মুখ কালো হলো। তা দেখে মাদাম মাতিসের বুক ধক করে উঠল। তাহলে বোধহয় ছবিটা আর বিক্রি হলো না। কিঞ্চিৎ বিলম্ব করে মাতিস জানালেন, না, ছবিটা বিক্রি হয়েছে, তাঁদের চাওয়া দামেই। সে কথা শুনে মহা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন তাঁর স্ত্রী। ‘তাহলে অমন মুখ করে বসে রইলে কেন?’ মাতিসের জবাব, ‘কই, আমি তো তোমার দিকে চোখ পিট পিট করছিলাম, কারণ খবরটা পেয়ে আমি এত অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম যে কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম।’ গার্ট্রুড লিখেছেন, মাদাম মাতিস ও মাতিস উভয়েই হাসিঠাট্টা মিশিয়ে এ গল্পটা করে খুব মজা পেতেন।
মেটের প্রদর্শনীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে মাতিসের সেই ছবি।
ক্যানভাসের ওপর অয়েল, বেশ বড়সড় ছবি। ছবিতে যে মহিলার ছবি আমরা দেখি Ñ অতি বৃহৎ ও কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত হ্যাট মাথায়, তাঁর চেহারায় প্রশান্তির বদলে গভীর দুশ্চিন্তার কালো ছাপ। ছবিতে নীল, সবুজ ও লাল – এই তিন রঙের প্রাধান্য চোখে পড়ে। মোটা ব্রাশের দাগে আঁকা হওয়ায় ছবিটির মেজাজে কিছুটা অসম্পূর্ণতার আভাস রয়েছে। খুব পরিপাটি বা সুন্দর নয় ছবিটি, কিন্তু সুন্দর ও সাজানো ছবির কথা ভেবে মাতিস এই ছবিটি এঁকেছিলেন বলে মনে হয় না। আমরা জানি, তথাকথিত ফভ (ফভিজম) বা বন্য পশু নামে বিশ শতকের গোড়ায় যে-চিত্রকলা আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির শুরু ১৯০৫-এর এই হৈমন্তিক প্রদর্শনী ও মাতিসের ছবি দিয়েই। ফভ শিল্পীদের একটি বৈশিষ্ট্য, ছবিতে উজ্জ্বল কিন্তু সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন রঙের বিশৃঙ্খল ব্যবহার, এই ছবিতে তা খুবই স্পষ্ট। রঙের এই ব্যবহারকে বলা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত, আকস্মিক ও নাটকীয়। মাতিসই সম্ভবত প্রথম ফভ শিল্পী, যিনি ব্রাশের বদলে সরাসরি রঙের টিউব থেকে ক্যানভাসে রং ছড়ানোর কায়দা চালু করেন। এর ফলে চিত্রিত বিষয়ের আরোপিত বৈসাদৃশ্য অর্জিত হয়, যে বৈসাদৃশ্য দেখে দর্শকেরা দুয়ো দুয়ো করেছিল। অথচ কয়েক বছরের মধ্যে, শিল্পী হিসেবে নাম-যশ হবার সঙ্গে সঙ্গে, মাতিস তাঁর এই অসমান্তরাল রঙের ব্যবহার ও তার ঔজ্জ্বল্যের জন্য অভিষিক্ত হবেন।
ছবিতে মাদাম মাতিসের মাথার ওই বেঢপ হ্যাটটির এক বিশেষত্ব খুঁজে পেয়েছেন খ্যাতনামা চারুকলা বিশেষজ্ঞ টি জে ক্লার্ক। বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় টুপিটি। মাতিস বাস্তবতা খুঁজছিলেন না – তাঁর লক্ষ্যই ছিল অতিরঞ্জন। ক্লার্ক জানাচ্ছেন, মাদাম পিকাসো নিজে উল বুননের কাজ জানতেন ও হ্যাট তৈরিতে অভিজ্ঞ ছিলেন। এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে একটি হ্যাটের দোকানও তিনি দিয়েছিলেন তাঁর চিত্রকর স্বামীর সামান্য আয়ে সমর্থন জোগাতে। ছবিটিতে যে হ্যাটটির অতিরঞ্জিত প্রকাশ, তা সম্ভবত এই কারণে যে মাতিস তাঁদের পারিবারিক জীবনে এই হ্যাটের গুরুত্ব বোঝাতে চাইছিলেন। ‘ওপরে হ্যাট, নিচে ছবি।’
মানুষের শরীর নিয়ে ফর্ম ভাঙার যে খেলার জন্য মাতিস পরিচিত, এ ছবিতে তা লক্ষণীয়। এই অঙ্গবিকৃতির একটি ব্যাখ্যা গার্ট্রুড দিয়েছেন অটোবায়োগ্রাফিতে। মাতিস তাঁর ড্রইংয়ে অমিল ও বিকৃতির ব্যবহার করতেন মূলত সাদার বিপরীতে অন্যান্য রঙের সামঞ্জস্য অর্জনে। ঠিক যেমন গানের বেলায় ‘ডিজোনেনসে’র ব্যবহার ঘটে, অথবা রান্নায় সির্কা বা লেবুর রস ব্যবহৃত হয়। সেজানের ছবিতেও এক ধরনের অসম্পূর্ণতা রয়েছে, সেটা প্রয়োজন থেকে। কিন্তু মাতিসের বেলায় এই অসম্পূর্ণতা পরিকল্পিত।
এই ছবি নিয়ে আরেক বিতর্ক, আসলে কে ছবিটি প্রথমে কিনেছিল। এলিস বি টোকলাসের মাধ্যমে গার্ট্রুড স্পষ্ট বলেছেন, ছবিটি লিওর আপত্তি সত্ত্বেও তিনিই কিনেছিলেন পাঁচশো ফ্রাঁ দিয়ে। কিন্তু আরো কারো ভাষ্য অনুসারে তাঁদের দুজনের একজনও নয়, ছবিটি কেনা হয়েছিল মাইকেল স্টাইনের স্ত্রী সারাহর কথায়, তিনিই সে ছবির আসল মালিক। লিও তাঁর কাছ থেকে ছবিটি চেয়ে নেন বটে, তাঁদের ২৭ রু দ্য ফ্লরুসে সে ছবি ঝোলানোও ছিল। কিন্তু পরে ভাইবোন ঝগড়া হওয়ার পর সে ছবি চলে যায় তার প্রকৃত মালিক সারাহ স্টাইনের কাছে। মোটা দামে বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত সানফ্রানসিস্কোতে তাঁর বাড়িতে সে ছবি ঝোলানো ছিল।
অটোবায়োগ্রাফি অব এলিস বি টোকলাস প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পর, ১৯৩৫ সালে, টেস্টিমনি অ্যাগেইনস্ট গার্ট্রুড স্টাইন এই নামে প্রাগ থেকে একটি ছোট প্যাম্ফলেট প্রকাশিত হয়। তাতে মাতিসসহ বিভিন্ন শিল্পী গার্ট্রুডের বিভিন্ন ‘মিথ্যাচারে’র প্রতিবাদ করেন। সেখানে মাতিস বলেছেন, ছবিটি কেনা হয়ে গেলে লিও সারাহ স্টাইনের কাছ থেকে ছবিটি চেয়ে নেন। এই ছবির বিভিন্ন দিক আমাকে ভালো করে দেখতে হবে – এই ছিল লিওর মন্তব্য।
কিন্তু জেমস মেলো গার্ট্রুড ও স্টাইন পরিবারের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও পারিবারিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখেছেন, ছবিটি প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর মুখে মাইকেল ও সারাহ গার্ট্রুডের কাছ থেকেই চার হাজার ডলারে কিনে নিয়েছিলেন, যার অর্ধেক ছিল নগদ অর্থে। যুদ্ধ শুরু হলে এলিসসহ স্পেন চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন গার্ট্রুড। কিন্তু পকেটে বাড়তি টাকাকড়ি না থাকায় তাঁর সংগ্রহের সব মাতিস বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ‘হ্যাট মাথায় রমণী’ তারই একটি।
গার্ট্রুড নিজেকে মাতিস ও পিকাসো উভয়ের ‘গার্ডিয়ান এঞ্জেল’ হিসেবে প্রমাণে কোনো চেষ্টা করা বাদ দেননি। কিন্তু দূর থেকে যাঁরা এই নাটকের প্রত্যক্ষদর্শী এবং যাঁরা এই বিষয়ে পরে গবেষণা করেছেন, তাঁদের প্রায় সবার ধারণা, প্রায় গোড়া থেকেই গার্ট্রুড পিকাসোর প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পিকাসোর স্বনামধন্য জীবনীকার রিচার্ডসন জানিয়েছেন, গার্ট্রুডের তুলনায় তাঁর ভাই লিও ছবি বুঝতেন অনেক বেশি, ‘শনিবারের সালোনে’ তিনিই ছিলেন আধুনিক চিত্রকলার সবচেয়ে পরিশীলিত ভাষ্যকার। ঠিক সে কারণে মাতিসের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সহজেই। তাঁদের ভ্রাতৃবধূ সারাহও ছিলেন মাতিসের একনিষ্ঠ ‘প্রমোটার’। গার্ট্রুড বা লিওর চেয়ে মাতিসের অনেক বেশি ছবি সংগ্রহ করেছিলেন সারাহ। এই প্রদর্শনীতেই আছে সারাহর সংগ্রহের শখানেক ছবি ও প্রিন্ট, তার বেশিরভাগই মাতিসের। সারাহ নিজে ছবি আঁকতেন, তাঁরই উদ্যোগে ‘মাতিস আকাদেমি’ নামে একটি ছবি আঁকার স্কুলও খোলা হয়েছিল, যেখানে মাতিস নিয়মিত ক্লাস নিতেন। মাতিস সপরিবারে একাধিকবার মাইকেল ও সারাহর সঙ্গে গ্রীষ্মের ছুটিতে অবকাশযাপনে গেছেন। সম্ভবত স্টাইন দম্পতির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ছিল সারাহর একটি পোর্ট্রটে। সারাহ ও মাইকেলের একটি যৌথ পোর্ট্রটেও করেছিলেন – মাতিসের একমাত্র ‘ডাবল পোর্ট্রেট’।
মেটের প্রদর্শনীতে পিকাসোর আঁকা গার্ট্রুডের পোর্ট্রেেটর মতো সমান গুরুত্বে স্থান পেয়েছে সারাহর পোর্ট্রটেটি।
মাতিসের আঁকা আরো একটি ছবি, ব্লু ন্যুড, এই প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা দর্শকের নজরে না এসে পারেই না। তাঁর দীর্ঘ শিল্পীজীবনে মাতিস এই একই শিরোনামে আরো ছবি এঁকেছেন, কিন্তু কেন যেন ১৯০৭-এর আঁকা এই ছবিটি অন্য সবার তুলনায় স্বতন্ত্র। ‘ওম্যান উইথ এ হ্যাটে’র মতো এটিও ফভিজম ধারার ছবি। উনিশ শতকের জনপ্রিয় ইম্প্রেশনিস্টিক ধারা থেকে ইচ্ছাকৃত, এমনকি পরিকল্পিত পথ পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলে এই ফভিস্ট ধারা থেকে। রং ও রেখার ব্যবহারে অতিরঞ্জন, ফর্মের বিকৃতি, নারীদেহের সৌন্দর্যের বদলে তার কদর্যতা – সব মিলিয়ে এই ছবিটি ভালো লাগার কথা নয়। গত শতকের দর্শকদের কাছে তা ভালোও লাগেনি। অথচ যত দিন গেছে, উদ্ভিন্ন যৌবনা যে রমণী ক্যানভাসে প্রকাশিত হয় – মাতিস যাকে সম্পূর্ণ কল্পনা থেকে এঁকেছিলেন – তার বন্য যৌনতা দর্শককে আকৃষ্ট করে প্রবল ও প্রবলতরভাবে। এই আকর্ষণ স্বতঃস্ফূর্ত, মনের গোপন বাসনাকে সে উস্কে দেয়। পিকাসো ছবিটি দেখে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, একে না ছবি-না ডিজাইন, এই দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা বলে তাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অথচ এই ছবি দেখার কয়েক মাসের মধ্যেই তারই অনুকরণে পিকাসো আঁকেন তাঁর জগদ্বিখ্যাত তৈলচিত্র ‘লে দেমোয়াজেল দ্যাভিন’। বিশ শতকের এই দুই প্রধান শিল্পীর মধ্যে প্রতিযোগিতা, যা বস্তুত গত একশ বছর আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসকে পুরোপুরি ওলটপালট করে দেয়, তার শুরু এই ছবি দুটো থেকে। মঞ্চের পেছনে থেকে ‘পাপেট মাস্টার’ হিসেবে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগুনে ঘি ঢালছিলেন গার্ট্রুড।
পিকাসো
কবে, কখন ও কীভাবে পিকাসোর সঙ্গে গার্ট্রুডের পরিচয় ও বন্ধুত্ব, সে ব্যাপারটা এখনো কিছুটা ধোঁয়াটে রয়ে গেছে। অটোবায়োগ্রাফিতেও স্পষ্ট কোনো আভাস নেই। শুধু এটুকু জানা যায়, প্যারিসের এক ছবির গ্যালারিতে লিও প্রথম পিকাসোর ছবির সঙ্গে পরিচিত হন। সে গ্যালারির মালিক সাগোতের কাছ থেকে লিও দুটি ছবি কিনেছিলেন, দুই অজ্ঞাতনামা স্প্যানিশ শিল্পীর কাজ। তাঁদের একজনের নাম গার্ট্রুড মনে রাখেননি, তবে অন্যজন যে পিকাসো সে-কথা নিশ্চিত করেছেন। সাগোত-ই লিওকে পাশের এক আসবাবের দোকানে পাঠান, সেখানে পিকাসোর এক প্রদর্শনী চলছিল। সেখানে তাঁর যে ছবিটি দেখে ভালো লাগে তার দাম হাঁকা হয় বিস্তর, প্রায় সেজানের ছবির কাছাকাছি। এ নিয়ে অভিযোগ করলে সাগোত তাঁকে দিনকয়েক পরে ফিরে আসতে পরামর্শ দেন, প্রতিশ্র“তি দেন পিকাসোর বড়সড় একটা ছবির ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। ঠিকই, দিনকয়েক পরে তিনি মাত্র দেড়শো ফ্রাঁ দিয়ে কিনে নিলেন পিকাসোর ‘অ্যাক্রোব্যাট’স ফ্যামিলি উইথ মাংকি’। গার্ট্রুড অবশ্য দাবি করেছেন লিও সেদিন কিনেছিলেন ‘গার্ল উইথ এ বাস্কেট অব ফ্লাওয়ার’। দুটো ছবিই একসময় স্টাইন পরিবারের সংগ্রহে জমা পড়ে।
আমরা বলছি ১৯০৫ সালের কথা। পিকাসোর বয়স মাত্র চব্বিশ। ততদিনে প্রতিষ্ঠিত না হলেও প্যারিসে নিজের জন্য পা ফেলার মতো জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘ব্লু পিরিয়ডে’র বিষণœ ও একাকী ছবিগুলোর স্থানে তিনি আঁকছেন ‘রোজ পিরিয়ডে’র প্রথম ছবিগুলো। সার্কাসের ক্লাউন ও অ্যাক্রোব্যাট, তাঁর প্রিয় বিষয়, এই সময়ের অনেক ছবিতেই রয়েছে। ছবি দেখে মনে হবে প্রীত, সন্তুষ্ট মানুষের ছবি, কিন্তু যাদের ছবি তিনি আঁকছেন, তারা সমাজের বহির্গত, ব্রাত্য। পিকাসো সম্ভবত নিজের কথাই প্রকারান্তরে এই ছবিগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ করছিলেন। ইতোমধ্যে শিল্পী হিসেবে তিনি স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, কিন্তু অর্থের মুখ খুব একটা দেখেছেন বলে মনে হয় না। ঠিক সেই সময় গার্ট্রুড ও লিও প্রায় দেবদূতের মতো উপস্থিত হলেন তাঁর জীবনে। একদম
নামমাত্র হলেও বিস্তর ছবি তাঁরা কিনেছিলেন এই নবীন শিল্পীর। একবার ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাত বোঝাই করে ছবি কিনে আনেন গার্ট্রুড, যার মোট দাম পড়েছিল আটশো ফ্রাঁ, অর্থাৎ দেড়শো ডলার! পিকাসোর সে সময়ের বান্ধবী অলিভিয়ে পরে লিখেছেন, খুব কষ্টেসৃষ্টে তাঁদের দিন গুজরান হচ্ছিল সে সময়, গার্ট্রুডের কাছ থেকে অতগুলো টাকা হাতে পেয়ে তাঁরা দুজনই যেন বর্তে গেলেন।
পিকাসোর ব্লু ও রোজ পিরিয়ডের কিছু সেরা ছবি সে সময় তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন। পরে নানা কারণে সেসব স্টাইন পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়। এই প্রদর্শনীর জন্য বিশ্বের নানা জায়গা থেকে ছবিগুলো পুনরুদ্ধার করে আনা হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘টু উইমেন অ্যাট এ বার,’ ‘বয় লিডিং এ হর্স’ এবং ‘ইয়াং অ্যাক্রোব্যাট উইথ এ বল’। ‘ন্যুড’ সিরিজের একাধিক ছবিও তাঁরা কিনেছিলেন, এর মধ্যে মনে রাখার মতো ‘সিটেড ন্যুড’।
প্যারিসের বোদ্ধা সমাজে যে পিকাসো স্বীকৃত ও সম্মানিত হন, এর পেছনে গার্ট্রুড ও তাঁর ভাইয়ের অবদান ছিল, তা অনস্বীকার্য। গোড়ার দিকে গার্ট্রুড পিকাসোর ছবি পছন্দ না করলেও মানুষ পিকাসোকে তাঁর পছন্দ হয়েছিল, অটোবায়োগ্রাফি পড়ে সে কথাই মনে হয়। ‘পিকাসো দেখতে ছিলেন রুগ্ন, শ্যামবর্ণের, চঞ্চল আয়ত চোখের, কিছুটা বন্য, অবশ্য খারাপ অর্থে নয়।’ একদিন নৈশভোজের টেবিলে পিকাসো ও গার্ট্রুড পাশাপাশি চেয়ারে বসে। গার্ট্রুড প্রথম হাত বাড়িয়ে এক টুকরো রুটি তুলে নিলেন। ‘এটা আমার’ বলে পিকাসো প্রায় জোর করে সে রুটি খণ্ড ছিনিয়ে নিলেন। কাণ্ড দেখে স্মিত হাসলেন গার্ট্রুড, আর পিকাসো লাজুক চোখে তাঁর দিকে তাকালেন। তাঁদের দুজনের বন্ধুত্বের সেই শুরু।
১৯০৫-০৬-এর দিকে পিকাসো তাঁর বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে গার্ট্রুডের একটি বড় সাইজের তৈলচিত্র এঁকেছিলেন। কিন্তু শুধু কৃতজ্ঞতা নয়, গার্ট্রুডের দেয়ালে মাতিসের তৈলচিত্র ‘টুপি মাথায় রমণী’ পিকাসোর নজরে পড়েছিল। সম্ভবত ঈর্ষা বোধ করেছিলেন মাতিসের প্রতি এই সম্মানে। তারই জবাব হিসেবে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে ছবি আঁকার
প্রস্তাব রাখেন পিকাসো। গার্ট্রুডের বসার ঘরের দেয়ালে আর সবকিছু ছাপিয়ে যা চোখে পড়ত তা হলো এই ছবিটি। পিকাসোকে নিয়ে গার্ট্রুড যে চটি বই লিখেছিলেন, তার প্রচ্ছদেও এই ছবি। উডি অ্যালেনের ফিল্ম মিডনাইট ইন প্যারিসে গার্ট্রুডের যে কক্ষ দেখি, তা দেখে চেনার এক উপায় এই ছবি।
গার্ট্রুড স্টাইনের এই বিখ্যাত পোর্ট্রেটটি পিকাসো যখন এঁকেছিলেন, তখন তাঁর বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ। কাছ থেকে ছবিটা দেখার চেষ্টা করি আমি। সদ্য যৌবনে পা দিয়েছেন পিকাসো, শিল্পী হিসেবে নিজস্ব ভাষা খুঁজে চলেছেন, তখনো স্পষ্ট নয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে এই অন্বেষা। অথচ এই শিল্পী কেন বিশ শতকের একজন সেরা আঁকিয়ে, তার সকল নিদর্শনই এখানে বর্তমান। পোর্ট্রেেট অবিকল অনুকরণ আমরা খুঁজি না, খুঁজি যাকে আঁকা হলো তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রকাশকে। পিকাসো যে গার্ট্রুডকে এঁকেছেন তাতে রমণীয় অভিব্যক্তি খুঁজতে গেলে ঠকতে হবে। বাহ্যিক চেহারার বাইরে যা লক্ষণীয় এবং যা পিকাসোকে সম্ভবত আকর্ষণ করেছিল সবচেয়ে বেশি – তা গার্ট্রুডের পাণ্ডিত্য, তাঁর মেধা এবং বোধকরি মেধার ঔদ্ধত্য। যে নির্জন, আত্মমগ্ন ও বিচ্ছিন্ন মহিলার ছবির প্রতিরূপ এখানে দেখি, বস্তুত তিনি গার্ট্রুড স্টাইন ছাড়া অন্য কেউ হতে পারেন না, এ বিশ্বাস আমাদের অনায়াসেই জন্মে, এমনকি তাঁর ফটোগ্রাফের সঙ্গে স্পষ্ট অমিল সত্ত্বেও। গার্ট্রুড নিজেও বলেছিলেন, ‘দিস ইজ আই’। এই আমি, এটাই আমার প্রকাশ। ১৯৪৬ সালে, মৃত্যুর আগে এই ছবিটি মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামকে দান করার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘জাদুঘরের সংরক্ষণালয়েই এর স্থান হওয়া উচিত।’
গার্ট্রুড দাবি করেছিলেন, কম করে হলেও আশি-নব্বই বার এই ছবির জন্য মডেল হিসেবে পিকাসোর প্যারিসের ভাঙাচোড়া স্টুডিওতে আসন দিতে হয়েছে তাঁকে। ১৯০৫ সালের পড়ন্ত হেমন্তে ও কঠিন শীতে ঘোড়ার গাড়ি চেপে দিনের পর দিন এসেছেন, সিঁড়ি ভেঙে বাতু লাভোয়াতে পিকাসোর স্টুডিওতে উঠেছেন, লম্বা ‘আসনে’র পর কখনো কখনো গভীর রাতে একা হেঁটে বাসায় ফিরেছেন। ‘এই মুখ আমি আর দেখতে পারছি না,’ কপট ক্ষোভে গার্ট্রুডকে বলেছিলেন পিকাসো। আমরা জানি, প্যারিসে শুরু করলেও এই ছবি আঁকা শেষ হয় বছরখানেক পর স্পেনের গসোলে অবকাশযাপনের সময়, মডেলকে সামনে বসিয়ে রেখে নয়, মনের মধ্যে যে চেহারা পিকাসো গেঁথে নিয়েছিলেন, তারই ভিত্তিতে। ছবি শেষ হবার পর কেউ একজন মন্তব্য করেছিলেন, ধুর, এ তো গার্ট্রুডের ছবি নয়, অন্য কারো।’উত্তরে হেসে পিকাসো বলেছিলেন, ‘এখন নয়, কিন্তু একদিন হবে।’ অন্য কথায়, একসময় আমার আঁকা গার্ট্রুডকেই সবাই মনে রাখবে, আসল গার্ট্রুডকে নয়।
পাশাপাশি লাগোয়া ঘরজুড়ে প্রদর্শনী। সব ছবি একঝলক দেখে নিয়ে আমি ফিরে আসি প্রথম কক্ষে গার্ট্রুডের ছবির সামনে। এবার নতুন একটা অর্থ আমি আবিষ্কার করি ছবিটি দেখে। কামশূন্য একটি ছবি। এমনকি হতে পারে এ ছিল গার্ট্রুডের প্রতি পিকাসোর আগাম প্রতিশোধ? আজীবন নারী ও তার দেহ ভিক্ষুকের ক্ষুধা, প্রেমিকের বশ্যতা ও দুর্বৃত্তের আগ্রাসন নিয়ে অনুসরণ করেছেন পিকাসো। তিন মাস সামনে বসিয়ে রেখে এই ছবিটি এঁকেছেন তিনি, অথচ সমকামী গার্ট্রুডের সেই ছবি সম্পূর্ণ ‘এসেক্সুয়াল’। আমরা জানি, তিরিশ শতকের মাঝামাঝি তাঁদের দুজনের বন্ধুত্ব কার্যত শেষ হয়ে যায়, এলিস বি টোকলাস গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশের পর পর, প্রধানত পিকাসোর অনাগ্রহের কারণেই। সে বইতে গার্ট্রুড নিজেকে পিকাসোর মিউজ – তাঁর প্রেরণাদাত্রী আরাধ্য হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সে কথা শুনে পিকাসো হেসেছিলেন, আর তাঁর ভাই পল বলেছিলেন, ‘ও একটা আস্ত মিথ্যুক।’ চিত্রকলায় তাঁর জ্ঞান নিয়েও পিকাসো সন্দিহান ছিলেন। চিত্রকলার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গার্ট্রুড একসময় বলেছিলেন, ‘ছবি ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে, মাঝারি মানের হতে পারে। তা সে যাই হোক, আমি (সব) ছবি দেখতে চাই।’খুব একজন শিল্পকলা বোদ্ধার কথা এ নয়, তা বোঝা মুশকিল নয়। তাঁর গদ্য রচনায় ‘কিউবিস্ট’ ধারার এক বিচিত্র রচনাপদ্ধতি অনুসরণ করতেন গার্ট্রুড, যা খুব একটা বোধগম্য কোনো ব্যাপার ছিল না। এ নিয়ে বিরক্ত ছিলেন পিকাসো। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘কালি ও রেখায় তো নকশা করা যায়, কিন্তু কথা যদি অর্থপূর্ণ না হয়, তার কী মূল্য আছে?’ তিরিশের দশকে এসে গার্ট্রুড পিকাসোকে নিয়ে যে বই লেখেন, তাতে এমন এক অদ্ভুত
মন্তব্য সংযুক্ত করেন, ‘পিকাসো বরাবরই নিজেকে শূন্য করবার – নিজেকে পুরোপুরি শূন্য করবার – সম্পূর্ণ, সব সময় শূন্য করার প্রয়োজন বোধ করতেন। সারা জীবন তাঁর কাজের মধ্যে নিজেকে শূন্য করার এই প্রবণতা বার বার ফিরে এসেছে।’ সে কথা তাঁকে কেউ পড়ে শোনালে পিকাসোর
মন্তব্য ছিল, ও (আমার ছবির) কিছুই বোঝেনি, পুরোপুরি ধাঁধায় পড়ে গেছে।’
পোর্ট্রটেটার দিকে আমি আবার ফিরে তাকাই। একজন শীতল, নির্জন ও যৌবনোত্তর কামহীন না নারী-না পুরুষের তৈলচিত্র। এ কি হতে পারে যে এই ছবি এক অহংকারী শিল্পীর উদ্ধত বুদ্ধিজীবীর প্রতি এক ধরনের প্রতিশোধ?
মাতিস ও পিকাসো
গার্ট্রুড ও লিওর মাধ্যমেই পিকাসো ও মাতিসের পরিচয় হয়েছিল, একথায় কোনো সন্দেহ নেই। গার্ট্রুড স্টাইনের জীবনীকার জেমস মেলো তাঁর চার্মড সার্কল গ্রন্থে স্মরণ করেছেন, লিওর স্টুডিওতে প্রথমবারের মতো এই দুই শিল্পীর সাক্ষাৎ হয়। মাতিস ছিলেন বয়সে পরিণত,
পোশাক-আশাকে রক্ষণশীল, জীবনচারিতায় বুর্জোয়া। পিকাসো সেই তুলনায় একদম উলটো। সে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে মাতিস মন্তব্য করেছিলেন, ‘উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু’। সে কথার অর্থ অবশ্য এই নয় শিল্পী হিসেবে তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষ হিসেবে তাঁদের একজন উত্তর মেরু অর্থাৎ শীতল ফ্রান্সের। অন্যজন দক্ষিণ মেরু অর্থাৎ উষ্ণ স্পেনের। পিকাসোর খ্যাতনামা জীবনীকার জন রিচার্ডসন সে কথা উল্লেখ করে
মন্তব্য করেছেন, এই দুই শিল্পীর মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ কথাতেও কোনো ভুল নেই তাঁরা একে অপরকে শ্রদ্ধা করতেন। একে অপরের কাছ থেকে শিখেছেন, নিজেকে বদলেছেন। কখনো একজন হয়েছেন শিক্ষক, অন্যজন ছাত্র। কখনো বা ঠিক বিপরীত।
গার্ট্রুডের লেখা থেকে অবশ্য এই স্ববিরোধী সম্পর্কের সমীকরণটি নজরে আসে না। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর গার্ট্রুড মাতিসকে ‘জিনিয়াস’ বলতে দ্বিধা করেননি, কিন্তু পরে পিকাসোকে নিয়ে বই লেখার সময় জিনিয়াস হিসেবে নাম করেছেন মাত্র দুজনের – পিকাসো ও তিনি নিজে। গোড়া থেকেই গার্টুডকে যা আকর্ষণ করে তা পিকাসোর ব্যক্তিত্ব। এই বোহেমিয়ান মানুষটির প্রতি গার্ট্রুডের কিছুটা বাড়তি ভালোবাসা আছে, যা সবারই নজরে এসেছিল, তা সম্ভবত মাতিসের মনে কিছুটা দ্বন্দ্ব, কিছুটা ঈর্ষা ও গোপন প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে। আগেই বলেছি, পিকাসো গার্ট্রুডের পোর্টেটটি করতে আগ্রহী হয়েছিলেন সম্ভবত ২৭ রু দ্য ফ্লরুসে মাতিসের ‘টুপি মাথায় রমণী’ ছবিটি দেখার পর। ১৯০৫-এর হেমন্ত ও শীতে এঁরা দুজন ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠছেন, আমরা তাও প্রত্যক্ষ করেছি। পিকাসো সময়ে-অসময়ে গার্ট্রুডের ঘরে আসতেন, কখনো একা, কখনো বা তাঁর নারী বন্ধুদের নিয়ে। শনিবারের সালোনে নৈশভোজ হলে গার্ট্রুড ও পিকাসো অনেক সময় বসতেন পাশাপাশি। এটিও মাতিসের দৃষ্টি এড়ায়নি।
১৯০৬-এর হেমন্তে গার্ট্রুড তাঁর বাসায় পিকাসো ও মাতিসসহ তাঁদের পরিচিত অধিকাংশ শিল্পী ও লেখকদের ডেকে সাড়ম্বর এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। সে ভোজের সরস বর্ণনা দিয়েছেন গার্ট্রুড নিজে। বসার ঘরেই তাঁর সব ছবি ঝোলানো ছিল। লম্বা এক টেবিল পেতে খাবার দেওয়া হয়। সব শিল্পীকে এভাবে বসানো হয়, যাতে তাঁদের নিজেদের ছবি ঠিক সামনে থাকে। ‘চিত্রকরেরা কেমন হয়, তা তো আপনারা জানেনই। আমি চেয়েছিলাম তাদের খুশি করতে। সবাই খুশিও হয়েছিল। এত খুশি যে আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো রুটির জন্য লোক পাঠাতে হয়েছিল।’ মাতিস প্রথমে গার্ট্রুডের খেলাটি ধরতে পারেননি। ভোজ শেষে বেরোবার সময় পেছন ফিরে ব্যাপারটি ধরতে পেরে মন্তব্য করেন, ‘পাজি, ভীষণ পাজি।’
মেটের প্রদর্শনীতে স্টাইন সংগ্রহ থেকে চোখ ধাঁধানো পিকাসো ও মাতিসের ছবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কখনো কখনো পাশাপাশি, কখনো বা ভিন্ন কক্ষে। যেহেতু মাতিসের অধিকাংশ কাজের মালিকানা ছিল মাইকেল ও সারাহ স্টাইনের, ফলে এই দুজনের গল্পের অঙ্গসজ্জা হিসেবে মাতিসকে একটু ভিন্ন সাজে উপস্থিত করা হয়েছে। কিন্তু ছবির বণ্টন যেমনই হোক, এই দুই শিল্পীর ভিন্ন কারিগরি ও কলাকৌশল এবং সেই সূত্রে তাদের
অন্তর্গত প্রতিযোগিতা চোখ এড়িয়ে যায় না।
এই দুই শিল্পীর মধ্যে গোপন ঈর্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাজ করছে, তার প্রথম ইঙ্গিত মেলে গার্ট্রুডের লেখায়। অটোবায়োগ্রাফিতে গার্ট্রুড লিখেছেন, মাতিস ও পিকাসো একে অপরকে যার যার পছন্দের ছবি উপহার দিয়েছিলেন। দুজনেই নিজের জন্য বাছাই করেন প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পীর দুর্বলতর একটি কাজ। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে তাদের যার যার সেরা কাজই বাছাই করার কথা। গার্ট্রুডের কথায়, এই দুই শিল্পী একে অপরের দুর্বলতা চিহ্নিত করতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন, সে কারণেই বেছে নিয়েছিলেন একে অপরের দুর্বলতর কাজ। গার্ট্রুড লিখেছেন, ‘এই দুই শিল্পী একে অপরের বন্ধু ছিলেন, শত্র“ও।’ রিচার্ডসন অবশ্য গার্ট্রুডের কথা সবটাই উড়িয়ে দিয়েছেন। গার্ট্রুড হয়তো তাঁদের মুখোমুখি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু তার আগে থেকেই মাতিস ও পিকাসো উভয়েই একে অপরের কাজ সম্বন্ধে জানতেন, কে কী কাজ করছে, তা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। মাতিস বেছে নিয়েছিলেন পিকাসোর একটি স্থিরচিত্র। অন্যদিকে পিকাসো বেছেছিলেন মাতিসের আঁকা তাঁর কন্যা মার্গারিতার পোর্ট্রটে। রিচার্ডসন লিখেছেন, অনেক পরে তিনি এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে পিকাসোর স্পষ্ট জবাব ছিল, গার্ট্রুড আসলে ব্যাপারটা বুঝতেই পারেনি। সে সময় মাতিস তাঁর শিশুপুত্র ও কন্যার করা কাজ দেখে তার প্রভাবে একধরনের সরল ও সুন্দর চিত্রকর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন, যা পিকাসোকে আকর্ষণ করেছিল। মাতিসের কাছ থেকে সে কাজের ধরনটা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। রিচার্ডসন অবশ্য এ-কথাও জানিয়েছেন, মাতিসের কাছ থেকে পাওয়া ছবিটি নিয়ে পিকাসোর স্তাবক বলে পরিচিত একদল চিত্রকর নানারকম হাসিঠাট্টায় মত্ত হতো। সে-কথা মাতিসের কাছে পৌঁছেছিল, তাতে এই দুই শিল্পীর মধ্যে এক কপট যুদ্ধের পরিবেশ আরো জেঁকে বসে।
গার্ট্রুডের শিল্পজ্ঞান খুব উঁচুমাত্রার ছিল, এ-কথা কেউ বলবে না। পিকাসো ও মাতিসকে নিয়ে তাঁর দুটি ভিন্ন ভিন্ন ‘পোর্ট্রেটে’ এই দুই শিল্পী বিষয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা থেকেও তাঁর শিল্প-বিবেচনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেমন, ‘ডেকোরেটিভ আর্ট’ হিসেবে পিকাসোর কাজকে গার্ট্রুড অনেক উঁচু মনে করতেন, অথচ মাতিস তাঁর চোখে ছিল ব্যর্থ। ‘মাতিসের ছবিতে আশ্চর্য সুন্দর রঙের ব্যবহার আছে, তার ড্রয়িং চমৎকার, কিন্তু তাদের সত্যিকার অর্থে কোনো জীবন নেই।’ ছবিতে সমভূত নির্মাণে মাতিস পিকাসোর তুলনায় ব্যর্থ। নিজের ব্যর্থতা অনুধাবনে ব্যর্থ মাতিস পিকাসোর সাফল্য অনুধাবনেও অক্ষম ছিলেন বলে গার্ট্রুড মন্তব্য করেছেন। অথচ শিল্পের ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, মাতিস বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ ‘ডেকোরেটিভ’ শিল্পী হিসেবে নন্দিত। আসলে সে সত্য অনুধাবনের ক্ষমতা গার্ট্রুডেরই ছিল না।
মেটের প্রদর্শনীতে পিকাসো-মাতিসের প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপকরণের অভাব ছিল না। কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্য যে একে অপরকে ছোট করা নয়, একে অপরের কাছ থেকে শেখা, সে-কথাই স্পষ্ট হয়। উদাহরণ হিসেবে মাতিসের ‘ব্লু ন্যুডে’র কথা ধরা যাক। এই ছবিটি গার্ট্রুড-লিও যৌথভাবে সংগ্রহ করেছিলেন, প্রদর্শনীতে তার স্থান হয়েছে ক্রমানুক্রমিক বর্ণনায় ১৯০৭-এর প্যানেলে। সে বছর প্যারিসে স্বতন্ত্র শিল্পীদের বার্ষিক প্রদর্শনী থেকে তাঁরা এই ছবিটি সংগ্রহ করেন। প্যারিসের বোদ্ধা মহলে ছবিটি নিয়ে প্রবল সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। একজন তো বলেই বসেন, এই নগ্ন মহিলার ভেতর কোনো সৌন্দর্য আছে সে কথা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমি মাতিসের দক্ষতায় বিশ্বাস স্থাপনে সম্মত হব (কথাটি শিল্পবিষয়ক লেখক বার্নার্ড বেরেনসন সারাহ স্টাইনকে বলেছিলেন, সম্ভবত মাতিসের প্রতি সারাহর আনুগত্যে বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট হয়ে।)। কিন্তু পিকাসো ছবিটির ভেতর দেখেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন সম্ভাবনার ইঙ্গিত। শোনা গেছে, পিকাসো ছবিটি দেখে কিছুটা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিলেন, কারণ, তার মতে, এই ছবিটি না কোনো নারীর চিত্র, না কোনো নকশা। দুইয়ের মাঝামাঝি একটা কিছু। কিন্তু আমরা জানি, মুখে যাই বলুন, ভেতরে ভেতরে প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন পিকাসো। কয়েক সপ্তাহ তাঁকে কেউ কোথাও দেখেনি, তিনি নিজের স্টুডিওতে ছবি আঁকায় ব্যস্ত ছিলেন। আর সে ছবিই হলো ‘লে দেমোয়াজেল দ’আভিনঁ।
‘লে দেমোয়াজেলে’ পিকাসো আফ্রিকান মুখোশ ও নিগ্রো ভাস্কর্য রীতির প্রথম প্রয়োগ করেন, একথায় শিল্পী ইতিহাসের বিশেষজ্ঞরা একমত। কিউবিজমের শুরু এই ছবি থেকেই। গার্ট্রুডের কথা বিশ্বাস করা গেলে, নিগ্রো শিল্পধারার সঙ্গে পিকাসোকে পরিচয় করিয়ে দেন মাতিস। একদিন দুপুরে হঠাৎ মাতিস তাঁর বাসায় এসে হাজির। পথে র্যু দে রেনের এক দোকান থেকে তিনি কিনে আনেন একটি কাঠের নিগ্রো স্টাচুয়েট। খানিক পরে এসে হাজির পিকাসো। সে ভাস্কর্য চোখে পড়লে অসম্ভব আগ্রহী হয়ে পড়েন পিকাসো। গার্ট্রুড লিখেছেন, আফ্রিকান বা নিগ্রো শিল্পকলা মাতিসের জন্য বড়জোর কৌতূহলের বিষয় ছিল, কিন্তু পিকাসোর জন্য তা আবিষ্কারের নতুন প্রদেশ উন্মোচন করে দেয়। এই সব ভাস্কর্যে অবয়বের যে ইচ্ছাকৃত বিকৃতি রয়েছে, তা শিল্প হিসেবে তাদের অধিক আকর্ষণীয় ও বাক্সময় করে তোলে। স্পেনের পিকাসোর কাছে এই অতিরঞ্জন ‘স্বাভাবিক, প্রত্যক্ষ ও সভ্য’ মনে হয়েছিল। ‘লে দেমোয়াজেল দ’আভিনঁ’ তার প্রমাণ। তাঁর এই ছবির সরাসরি অনুপ্রেরণা এসেছিল মাতিসের দুটি ছবি থেকে – জয় অব লাইফ এবং ব্লু ন্যুড – যা পিকাসো গার্ট্রুডের বসার ঘরে প্রথমবারের মতো দেখেন।
‘লে দেমোয়াজেল’ নিউইয়র্কের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামের নিজস্ব সংগ্রহে আছে, যতবার সেখানে গেছি, একবার সে ছবির সামনে ঘুরে এসেছি। ‘স্টাইনস কালেক্টে’র সুবাদে মাতিসের ‘জয় অব লাইফ’ দেখার সুযোগ হলো। ভাবা হয়, মাতিসের কল্পনায় বনকন্যাদের আনন্দ উৎসবের চিত্রণ এই ছবিটি। শুধু নারী নয়, এতে পুরুষদেহও রয়েছে, তবে তার ব্যবহার নারীর দেহের প্রতি আমাদের দৃষ্টি প্রখরতর করতে। ফভ ধারার এই ছবিটিতেও রঙের বাহুল্য ও দেহরেখার অতিরঞ্জন ও বিকৃতি, ছবি দেখে এমন বোধ হয় এখনো বোধহয় শিল্পী তার কাজ শেষ করেনি। যে সমভূম রেখার ব্যবহার এতে হয়েছে তাতে বলা হয়েছে সাহসী, এমনকি অভিনব। নগ্ন নারী মূর্তি অঙ্কিত হয়েছে, কিন্তু ‘ব্লু ন্যুডে’র মতো তা আগ্রাসী ও ক্ষুধার্ত নয়। উন্মুক্ত প্রকৃতিতে নৃত্যরত, অলস শয়ানে বিশ্রামরত এইসব মানবদেহের চারদিকে একটি আবরণ জড়ানো হয়েছে বৃক্ষ ও তরুলতায়। আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না যে মানবদেহের তুলনায় বৃক্ষে ব্যবহৃত রং অনেক উজ্জ্বল ও স্পষ্ট।
‘জয় অব লাইফ’ দেখে আমরা হয়তো হোঁচট খাই, কিন্তু বিবমিষা বোধ করি না। অথচ একশ বছর আগে, প্রথম যারা ‘আভিনঁ’ দেখেছিল, তারা রীতিমতো ক্ষুব্ধ, এমনকি সহিংস প্রতিবাদে লাফিয়ে উঠেছিল। পাঁচটি নগ্ন নারী দেহের ছবি, মোটা রেখায় ও রঙে, কামজ আগ্রাসনের রিরিৎসায় পূর্ণ। পিকাসো প্রথমে ছবিটির নাম দিয়েছিলেন ‘আভিনঁর বেশ্যালয়ে’। প্রতিবাদের মুখে সে নাম বদলির রাখেন ‘আভিনঁর মেয়েরা’। ‘ব্লু ন্যুডে’ মাতিসের অনুসরণে ফভ ধারার রং ও অতিরঞ্জিত নকশার ব্যবহার লক্ষণীয়। আফ্রিকান ও আইবেরীয় ধারার মুখোশ-কলার ব্যবহারও এতে অনিবার্যভাবে উপস্থিত। পিকাসো এই ছবিতে যৌনতার প্রকাশকে তার অন্তর্গত কামবোধ-উদ্ভূত বলেছেন। মনের ভেতরে যে ভয়ানক দানবটি বাস করছে, তাকে বধ করাই আমার লক্ষ্য, বলেছেন পিকাসো। লিও ছবিটি দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। এমনকি গার্ট্রুডও প্রথমে ছবিটি মেনে নিতে পারেননি, যদিও পঁচিশ বছর পর পিকাসো নিয়ে গ্রন্থ রচনার সময় একে চিত্রকলার বিশ শতকে প্রবেশ বলে তাকে সাধুবাদ দিয়েছেন। এই ছবি দিয়েই কিউবিজমের শুরু। গার্ট্রুড নিজে সে ধারায় এতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন যে শুধু শব্দে-রেখায় নয় – কিউবিস্ট ধারার পোর্ট্রেট আঁকার এক বিচিত্র পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেন।
অন্যদিকে মাতিসের ওপর পিকাসোর প্রভাবের প্রমাণ মেলে মেটের প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া অন্য একটি ছবি Ñ জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ী আউগুস্তো পেলেরিনের একটি পোর্ট্রটে থেকে। পিকাসোর আঁকা গার্ট্রুডের পোর্ট্রটের জবাবে মাতিস আঁকেন এই ছবিটি বলে ভাবা হয়। সাদা-কালো রঙের জোরালো ব্যবহারের জন্য ছবিটি লক্ষণীয়। ১৯১৬-১৭ সালে আঁকা সে ছবিতে মাতিস গার্ট্রুডের পোর্ট্রেেটর মতো আত্মমগ্ন, কঠোর ও নিবিড় বাহ্যদৃষ্টি অর্জন ছাড়াও একধরনের কৌতুক সংযোজন করেছেন। তীব্র, তীক্ষè চোখ জোড়া ছাড়াও উভয় ছবিতে লক্ষণীয় ক্যানভাসের মাঝ বরাবর দুটি হাত-গার্ট্রুডের বেলায় হাটুর ওপর, তা কিছুটা আগ্রাসী। পেলেরিনের বেলায় মুষ্টিবদ্ধ সে হাতে আগ্রাসন নেই, কিন্তু তাতে দৃঢ় সংকল্পের যে প্রতিভাস তা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।
শুধু মাতিস ও পিকাসো নয়, এই দুই শিল্পী নিয়ে ভাইবোন লিও ও গার্ট্রুডের মধ্যেও যে এক নীরব প্রতিযোগিতা চলছে, প্রদর্শনীটি দেখে সে মনোভাবটি ঠাহর করা যায়। কোন ছবি কে নির্বাচন করেছিলেন, সে ইতিহাসটি কোনো কোনো সময় ধোঁয়াটে লাগলেও এ-কথা ঠিক, পিকাসোর অধিকাংশ ছবির সংগ্রহ গার্ট্রুডের, মাতিসের অধিকাংশ লিও এবং সারাহ-মাইকেলের। ১৯১৩ সালের দিকে লিও যখন প্যারিসে তাঁদের ২৭ রু দ্য ফ্লরুসের বাড়ি ছেড়ে আমেরিকায় ফিরে আসেন, তখন তাঁরা যাঁর যাঁর পছন্দের ছবি ভাগ করে নেন। অধিকাংশ পিকাসো ও মাতিস জোটে গার্ট্রুডের ভাগে। লিও পান রেনোয়া ও সেজান। বলাই বাহুল্য, এসব ছবির অধিকাংশই পরে তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়। নতুন কোনো কাজ সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন পড়লে গার্ট্রুড অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁর সংগ্রহের পিকাসো বিক্রি করে দিতেন। ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে ফ্রান্স জড়িয়ে পড়লে গার্ট্রুড ও এলিস প্যারিসে তাঁদের ভাড়া বাড়ি ত্যাগ করে স্পেনে চলে আসেন। যাবার আগে বাড়তি অর্থ সংস্থানের জন্য তাঁর সংগ্রহের অধিকাংশ মাতিস তিনি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
শেষ পর্যন্ত গার্ট্রুড
মেটের প্রদর্শনীটি বিশ শতকের সেরা দুই চিত্রকরের প্রতি নিবেদিত, অথচ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে মানুষটির ছায়া প্রদর্শনীর প্রতিটি কক্ষ-প্রতিটি গ্যালারি জুড়ে এক দীর্ঘ ছায়া হয়ে অনুসরণ করেন, তিনি গার্ট্রুড। নিজে চিত্রকর নন, লেখক হিসেবেও খুব যে উল্লেখযোগ্য বা পঠনীয়, তাও নন। তবু শেষ পর্যন্ত এই গার্ট্রুড কেন এইভাবে নিজেকে বিশ শতকের আধুনিক শিল্পধারার সঙ্গে অন্বিত করে নেন, সেটি কম চমকপ্রদ নয়। মেটের প্রদর্শনীতে যে শচারেক ছবি বা ছাপচিত্র রয়েছে তাতে তো বটেই, আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য প্রকরণ-উপকরণে সে গল্পটি বলা হয়েছে যতেœ ও ভালোবাসায়।
১৯০৫-১৯১৩ – এই সময়েই গার্ট্রুড ও লিও সেরা কাজগুলো সংগ্রহ করেন। লিও প্যারিস ছেড়ে চলে যাবার পর গার্ট্রুডের সংগ্রহে ভাটা পড়েনি, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পীর কাজ তিনি সংগ্রহ করেছেন বলে মনে হয় না। সে-সময়ে নতুন ধারার বলে পরিচিত দু-চারজন রুশ শিল্পীর কাজ তিনি সংগ্রহ করেন, যার অধিকাংশ এই প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে – তাঁদের নাম অথবা কাজ মোটেই স্মরণীয় হয়নি। গার্ট্রুডের শিল্পবোধের পরিচয় সেখান থেকেই ঠাহর করা যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অল্প কয়েক মাস স্পেনে কাটানোর পর গার্ট্রুড ও এলিস প্যারিসে ফিরে আসেন এবং যুদ্ধে ফরাসিদের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। প্যারিস হয়ে ওঠে যুদ্ধফেরত মার্কিনি লেখক-শিল্পীদের মস্ত আখড়া। হেমিংওয়ে-ফিটজিরালড-কোল পোর্টার সেই আখড়ারই অংশ, যাঁদের কথা উডি অ্যালেনের ফিল্মে জীবন্ত হয়ে ফিরে আসে আমাদের কাছে। পিকাসো-মাতিসের সঙ্গে ততদিনে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের ‘পেট্রন’ হিসেবে গার্ট্রুড তখনো কিংবদন্তি। ফরাসি কবি অ্যাপোলিনীয়রের সঙ্গে গার্ট্রুডের বন্ধুত্বের যে গল্পগাথা চালু আছে, তা আরো পত্রপল্লব বিস্তার করে।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বন্ধু প্রকাশকদের সহায়তায় বেশ কিছু গদ্য রচনা গার্ট্রুড ছেপে বের করেছিলেন, কিন্তু খুব বেশি লোক সেসব পড়েছে বলে মনে হয় না। অবস্থা বদলে যায় অটোবায়োগ্রাফি প্রকাশের পর। পাঠক মহলে, বিশেষ করে আমেরিকায়, গ্রন্থটি গার্ট্রুডকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়, কিন্তু সমালোচনার বেত্রাঘাত থেকেও তিনি রেহাই পাননি। লিও স্টাইন এ গ্রন্থে গার্ট্রুডের অনেক স্মৃতিচারণকে সরাসরি ‘মিথ্যা’ বলে অভিযোগ করেন। তাঁর স্মৃতিচারণকে ‘ডাহা মিথ্যা কথা’ – ‘আমাকে যতটা সম্ভব উপেক্ষা করার চেষ্টা’ অভিহিত করে একটি ভিন্ন স্মৃতিকথা লেখেন লিও। এই তর্ক-বিতর্ক ও ‘গসিপ’ গার্ট্রুডের ‘মিথ’কে আরো পোক্ত করে, যদিও লেখক হিসেবে আলাদা কোনো সম্মান তাঁর জন্য বয়ে আনেনি।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর পিকাসো ও মাতিসের সঙ্গে গার্ট্রুডের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অটোবায়োগ্রাফিতে কিছুটা মনস্তাপের সঙ্গেই গার্ট্রুড লিখেছেন, যুদ্ধের পর মাতিসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে যায়। প্যারিস ছেড়ে নিস শহরে স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে আসেন মাতিস, ফলে তাঁদের দেখাশোনার সুযোগও শেষ হয়ে যায়। পিকাসো, যাঁকে একদিন তিনি অনুজপ্রতিম বন্ধুর মতো আগলে রেখেছিলেন, তাঁর সঙ্গেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রুশ ব্যালেরিনা ওলগার সঙ্গে পিকাসোর বিয়ে হয়তো একটা কারণ। পরে, ওলগাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের মিলমিশ হয় বটে, কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব আর জমে ওঠেনি। তাছাড়া গার্ট্রুডের সমর্থনের কোনো আপাত প্রয়োজনও পিকাসোর ছিল না। ততদিনে তিনি রীতিমতো ধনমান, প্যারিসের বুর্জোয়া মহলের খ্যাতিমান সদস্য। ১৯৩৩ সালে অটোবায়োগ্রাফি প্রকাশের পর তাঁদের দুজনের মধ্যে নতুন মতভেদ ঘটে। প্রায় একই সময়ে হঠাৎ কবিতা লেখায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন পিকাসো। তাঁকে এ কাজে উৎসাহ দিয়েছিলেন সুররিয়াল ধারার লেখক আঁন্দ্রে ব্রেতো। পিকাসো আশা করেছিলেন গার্ট্রুড তাঁর কবিতা পড়ে সাধুবাদ দেবেন, উৎসাহ জোগাবেন, কিন্তু গার্ট্রুড এ-ব্যাপারে মিথ্যাচারে আগ্রহী ছিলেন না। চিত্রকরদের ছবি আঁকাতে ব্যস্ত থাকা উচিত, কবিতা লেখায় নয়, তাঁর এমন একটি মন্তব্য পিকাসোকে আঘাত করেছিল। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় পিকাসো নামে গার্ট্রুডের চটি বই, যা না পিকাসোর জীবনী না গার্ট্রুডের স্মৃতিকথা। সেখানে নিজেকে পিকাসোর ‘মিউজ’ হিসেবে চালানোর যে চেষ্টা গার্ট্রুড করেন, তা পড়ে পিকাসো মুচকি হেসেছিলেন, অন্যেরা উচ্চৈঃস্বরে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারপন্থী ভিশি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য অভিযুক্ত হয়েছিলেন গার্ট্রুড। পিকাসোর সঙ্গে তাঁর দূরত্বের সেটিও একটি কারণ। মেটের প্রদর্শনীটিতে এ-ব্যাপারে খুব সামান্য হলেও আলোকপাত করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, নিজে ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও গার্ট্রুড হিটলারের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। নাৎসি বাহিনীর হাতে প্যারিসের পতন হলে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন বলেও শোনা গেছে। নাৎসি অবরোধের পুরো সময়টা তিনি ফ্রান্সেই কাটান, কোনো ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই। কীভাবে তা সম্ভব হলো সে ব্যাপারটি কিছুটা ধোঁয়াটে এবং বিতর্কিত। সত্যি সত্যি গার্ট্রুড হিটলারের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, না তাঁর প্যারিসের বাসগৃহে রক্ষিত শিল্প সংগ্রহ যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে হিটলারের পক্ষাবলম্বনের ভান করেছিলেন, সে-কথা এখনো অমীমাংসিত। এ-কথা অবশ্য প্রমাণিত যে হিটলারপন্থী বলে পরিচিত ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধান বার্নার্ড লেভি তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেন। হিটলারের সেনা সদস্যরা গার্ট্রুডের প্যারিসের বাসভবনে তালা ভাঙার জন্য গিয়েছিল, কিন্তু লেভির হস্তক্ষেপে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তাঁর কোনো ছবিও খোয়া যায়নি। প্রতিদান হিসেবে, লেভির অনুরোধে, গার্ট্রুড মার্শাল ফিলিপ পেতেঁর অতি উগ্র
নাৎসিপন্থী রচনাবলির ইংরেজি অনুবাদে সাহায্য করেন। মেটের প্রদর্শনীটিতে প্রথমে এ-বিষয়ে কোনো আলোকপাত করা হয়নি। পরে, নানা মহল থেকে প্রতিবাদ উঠলে একটি নতুন প্যানেলে এ ব্যাপারে অতিরিক্ত তথ্য সংযোজন করা হয়।
হিটলারপন্থী ভিশি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য গার্ট্রুড তাঁর জীবদ্দশায় কোনো বিচার বা তদন্তের সম্মুখীন হননি। কিন্তু প্যারিসের শিল্পী মহলে তিনি কার্যত একঘরে হয়ে পড়েন। সবচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন পিকাসো, জেমস মেলোর বর্ণিত একটি স্বল্প পরিচিত ঘটনা থেকে সে কথার প্রমাণ মেলে। ১৯৪৬ সালে প্যারিসে গার্ট্রুডের সঙ্গে দেখা করতে আসেন একজন তরুণ মার্কিন লেখক জেমস লর্ড। পিকাসোর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রেই তিনি গার্ট্রুডের কাছে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁদের কথোপকথন খুব একটি সুখকর ছিল না। একে অপরকে মূর্খ বলে তাঁরা বিদায় নেন। গার্ট্রুডের সঙ্গে উত্তপ্ত আলাপ সেরে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে আসেন লর্ড। মেলো লর্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, পিকাসো নির্মম ভাষায় আক্রমণ করেন গার্ট্রুডকে – ‘ও একটা আস্ত ফ্যাসিস্ট।’ তিনি অভিযোগ করেন, গার্ট্রুড পেতেঁর হয়ে তাঁর ভাষণ লিখে দিতেন, এমনকি ফ্রাঙ্কোর (স্পেনের নাৎসিপন্থী একনায়ক) ব্যাপারে তাঁর সহানুভূতি ছিল।
‘ভাবতে পারো, একজন আমেরিকান, তার ওপর ইহুদি, তার এমন ব্যবহার?’ – এই ছিল পিকাসোর মন্তব্য।
১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে, প্যারিসের বাইরে বার্নার্ড লেভির অবকাশকালীন গৃহে অবসরযাপনের সময় মারা যান গার্ট্রুড। তখন তাঁর বয়স বাহাত্তর। আট বছর পর, ১৯৫৪ সালে মারা যান মাতিস। অন্যদিকে দীর্ঘজীবনের অধিকারী পিকাসো গার্ট্রুডের মৃত্যুর পর আরো সাতাশ বছর বেঁচে থাকেন। শুধু বেঁচেই থাকেন না, শিল্পী হিসেবে বিশ্বের সেরা সম্মানের আসনটিও তাঁর জন্য নির্ধারিত থাকে, তাঁর খ্যাতি ও বিত্ত প্রায় আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। এই দীর্ঘ সময়ে মাঝেমধ্যে পুরনো বন্ধু গার্ট্রুডের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে যে ওঠেনি তা নয়, কিন্তু খুব ভালো কিছু তিনি বলে গেছেন বলে শোনা যায় না। পরবর্তীকালে, যাঁরা পিকাসোর জীবন নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ উলটো এই বলে অভিযোগ করবেন, খ্যাতিমান ও প্রতিভাধর পিকাসোর কাঁধে বন্দুক রেখে নিজের ঢোল নিজেই পিটিয়েছেন গার্ট্রুড।
এখন, তাঁদের প্রথম বন্ধুত্বের একশ বছর পরে, গার্ট্রুড স্টাইন কার্যত অপঠিত একজন লেখক। আর পিকাসো ও মাতিস বিশ্বের দুই সেরা শিল্পী হিসেবে বন্দিত। মেটের এই প্রদর্শনীটি দেখতে গিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, গত শতাব্দীর এক শুভ সকালে প্যারিসে এই দুই শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় না হলে গার্ট্রুড স্টাইনকে কেউ কি আদৌ মনে রাখত?
১ জুলাই ২০১২
নিউইয়র্ক