অ নি র্বা ণ রা য়
যারা ভালো চিঠি লেখে তারা মনের জানালার
ধারে বসে লেখে, আলাপ করে যায় – তার কোনো
ভার নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। এই সব
চলতি ঘটনার ’পরে লেখকের বিশেষ অনুরাগ
থাকা চাই, তা হলেই তার কথাগুলি পতঙ্গের মতো
হালকা পাখা মেলে হাওয়ার উপর দিয়ে নেচে যায়।
– রবীন্দ্রনাথ
চিঠি না লিখে থাকতে পারতেন না ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। চিঠি লেখা ছিল তাঁর রক্তে। আসলে উনিশ শতকে চিঠি লেখাটা উল্লেখযোগ্য সামাজিক দক্ষতা হিসেবে গণ্য হতো। ভ্যান গঘ পরিবারেও এই চিঠি লেখার চল ছিল মূলত একটি কারণে। অল্প বয়সে ভ্যান গঘ পরিবারের ছেলেমেয়েরা নানা কাজে বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকত। চিঠি লিখে তারা নিজেদের খবরাখবর দিত, বাড়ির খবর নিত, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ দৃঢ় করত। বাড়ির লোকেরা তাঁদের দূরে-থাকা ছেলেমেয়েদের খবর জেনে নিশ্চিন্ত বোধ করতেন। সপ্তাহান্তিক চিঠি লেখা দুপক্ষের অবশ্য-কৃত্যের অন্তর্গত ছিল। এই পরিবারের সদস্য হয়ে ভিনসেন্ট চিঠি না লিখে থাকবেন কী করে। সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন ভাই থিওকে : ছয়শো একান্নটা, ভাইয়ের বউকে একটা, ভাই আর তার বউকে সাতটা। ডাচ শিল্পী আন্তন ভ্যান র্যাপার্ডকে লিখেছিলেন আটান্নটা। ফরাসি শিল্পী এমিল বার্নার্ডকে লিখেছিলেন বাইশটা। বোন ভিলেমিয়েন আর মা আন্নাকে লিখেছিলেন যথাক্রমে একুশ আর বারোটা চিঠি। বাবা-মাকে একসঙ্গে লিখেছিলেন মাত্র পাঁচটি চিঠি। ভ্যান গঘের সঙ্গে সঙ্গে যে ফরাসি শিল্পীর নাম উঠে আসে সেই পল গগ্যাঁকে লিখেছিলেন মাত্র চারখানা চিঠি। এছাড়া বিভিন্ন পরিচিতজন, শখের শিল্পী এবং তাঁর স্বল্পকালের ছাত্র আন্তন কোর্সমেকার্সকে, সমালোচক আলবার্ত অরিয়েরদের সব মিলিয়ে লিখেছিলেন একশ ষাটটা চিঠি। অন্যদিকে ভিনসেন্ট পেয়েছিলেন মাত্র তিরাশিটি চিঠি। সবচেয়ে বেশি থিও আর তাঁর বউয়ের কাছ থেকে : ছেচল্লিশটা। পল গগ্যাঁ তাঁকে লিখেছিলেন ষোলোটা চিঠি। অন্যরা দুটো-একটা করে। ডাকঘরকর্মী যোসেফ রুলাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলেন চারটা চিঠি। এই সংখ্যায়ন থেকে সিদ্ধান্ত করাই যেতে পারে, উত্তরের প্রত্যাশায় নয়, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ চিঠি লিখতেন প্রাণের তাগিদে। নিজস্ব ভাবনাচিন্তা উপলব্ধি, কাজের বিবরণ, দেশ দেখার অভিজ্ঞতা ধরে রাখার জন্য। এদিক দিয়ে তাঁর চিঠিকে কি দিনপঞ্জির সঙ্গে তুলনা করা যাবে? তাঁর চিঠির ঈষৎ গভীরে যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলা যাক। দেখি এক অন্যরকম ভিনসেন্টকে।
একবার পকেটে দশ ফ্রাঁ নিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ট্রেনে যেতে যেতে ফুরোলো রেস্ত। অতঃপর হন্টন। পা ক্ষতবিক্ষত। কুছ পরোয়া নেহি। সঙ্গে ছিল নিজের আঁকা স্কেচ। তার বিনিময়ে রুটি সংগ্রহ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি। এরপর ভিনসেন্ট লিখেছেন :
But when my ten francs were gone, I had to bivouac out in the open for the last 3 nights, once in an abandoned carriage, all white with frost in the morning, a rather poor shelter, once in a wood-pile and once, and it was a little better, in a haystack that had been broached, where I managed to make a slightly more comfortable rest, only a fine rain didn’t exactly add to my well-being.
আর এই অবস্থায় তিনি বিশ্বাস করছেন (সাতাশ বছর বয়স তখন তাঁর) উঠে দাঁড়াবেন একদিন, হাতে তুলে নেবেন পেনসিল, ফিরে যাবেন আবার ড্রয়িংয়ের জগতে। দীর্ঘদিন সাংঘাতিক দারিদ্র্য তাঁকে কিছু করতে দেয়নি। এবার তিনি ঠিক পারবেন।
এমন অনেক ভিনসেন্ট ছড়িয়ে আছেন তাঁর চিঠিতে। পারলে দেখে নেব মাঝে মাঝেই।
দুই
ভাই থিওকে লেখা চিঠিগুলো সযত্নে রক্ষা করতেন জো ভ্যান গঘ-বঙ্গার, থিওর বউ। ১৯১৪-তে ভ্যান গঘের চিঠি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় মুখবন্ধে লিখেছিলেন তিনি :
১৮৮৯-এর এপ্রিলে, প্যারিসের সিটি পিগেলের ফ্ল্যাটে এসে ঢুকলাম থিওর বউ হয়ে। একদিন চোখে পড়ল ছোট্ট ডেস্কের নিচে ড্রয়ারভর্তি চিঠি, ভিনসেন্টের লেখা, সপ্তাহের পর সপ্তাহ দেখতে দেখতে পরিচিত হয়ে উঠল সেই হাতের লেখা আর বাড়তে লাগল সংখ্যা …
অধিকাংশ চিঠির সঙ্গে খাম পাওয়া যায়নি। বহু চিঠিতে থাকত না তারিখ। জো চিঠির ঘটনাবলি বা কোনো কোনো সূত্র ধরে চিঠিগুলোকে কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে নিয়েছিলেন।
চিঠি লেখার জন্য ভিনসেন্ট নানারকম কাগজ ব্যবহার করতেন। প্রথমদিকে কাগজের মান ছিল বেশ উচ্চস্তরের, কখনো তাতে থাকত জলছাপ বা মোহর। ছবির দোকান গুপিল অ্যান্ড সিতে কাজ করার সময় কোম্পানির নোটপ্যাড ব্যবহার করেছেন। ১৮৮০-র পরবর্তীকালে চিঠি লিখেছেন সাধারণ কাগজে, কখনো কখনো অতি সস্তা কাগজে। কাগজের মাপ ছিল ৮x৪ মিমি বা ৪x৪ মিমি। কাগজটা চার ভাঁজ করে নিয়ে চিঠি লিখতেন। এক পাতার চিঠি লিখেছেন হাতে গোনা। সাধারণত চার পাতার কমে ভিনসেন্টের চিঠি লেখা শেষ হতো না। তাঁর লেখা সবচেয়ে বড় চিঠির পাতার সংখ্যা ১৬। ডাক খরচের কথাটা মাথায় রেখে চিঠির কাগজ নির্বাচন করা হতো খুব পাতলা। সময়ের হাতে পড়ে চিঠির কালির রং বদলে গিয়েছে বলে মূল কালির রং অনুমান করা শক্ত।
ভ্যান গঘের সময়ে চিঠির হাতের লেখা, তাঁর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিশেষ গুণ বলে ধরা হতো। প্রথমদিকে তাঁর হাতের লেখা বেশ পরিষ্কার পাঠ্য ছিল। বানান, যতিচিহ্নের ব্যাপারে যত্ন নিতেন। চিঠি যত বড় হতে লাগল চিঠির অক্ষর তত ছোট হতে শুরু করল। প্রথমদিকে চিঠিতে কাটাকুটি হতো না। পরে হতে লাগল। জায়গা কম পড়ায় মার্জিনেও লিখতে দ্বিধা করেননি। হাতের লেখা আগাগোড়া একই রকম ছিল বলা যাবে না এই কথাটা। লিখতেন নিবের কলমে। একবার হয়েছিল কি, থিওকে চিঠি লিখছিলেন। একটা কথা বোঝাতে গিয়ে, বিশেষ জোর দেওয়ার জন্য, in damned earnest শব্দ তিনটি একটু বড় করে রঙের ব্রাশ কালিতে ডুবিয়ে লিখে দিলেন। এ থেকে মনে হতেই পারে চিঠি লেখাটা তাঁর চলতেই থাকত কাজের ফাঁকে ফাঁকে। একবারে হয়তো লেখা হতো না গোটা চিঠিটা।
তিন
ভিনসেন্ট বেশিরভাগ চিঠি লিখেছিলেন ভাই থিওকে। তাঁকে প্রথম চিঠি লেখেন ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭২। শেষ চিঠি ২৯ জুলাই ১৮৯০-তে মৃত্যুর দিনকয়েক আগে। চিঠির তারিখ জানা যায় না।
৩০ জুলাই ১৮৬৯। ভিনসেন্টের বয়স তখন মাত্র ষোলো। বাড়ি ছেড়ে কাজে যোগ দিলেন আন্তর্জাতিক ছবি কেনাবেচার কোম্পানি গুপিল অ্যান্ড কোম্পানিতে। সেখানে তাঁর এক কাকা ছিলেন কোম্পানির অন্যতম অংশীদার। দ্য হেগ থেকে থিওকে তাঁর প্রথম চিঠিতে ভিনসেন্ট লিখছেন :
প্রিয় থিও,
তোর চিঠির জন্য ধন্যবাদ। নির্বিঘ্নে ফিরে গেছিস শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। প্রথম কটা দিন তোর কথা মনে হচ্ছিল। সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে তোকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলাম।
কটা দিন আমরা একসঙ্গে আনন্দে কাটালাম। আসলে আমরা একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম। সুযোগ ছিল বলে দুটো-একটা জিনিস দেখতে গিয়েছিলাম।
কী মারাত্মক আবহাওয়া। আয়স্টারউইকে যাবার সময় তুই নিশ্চয় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলি। গতকাল প্রদর্শনী উপলক্ষে দৌড় ছিল তবে খারাপ আবহাওয়ার দরুন আলোকসজ্জা আর আতশবাজি মুলতবি রাখা হয়। তুইও নিশ্চয় দেখার জন্য থেকে যাসনি। হানেবিক আর রুজদের ভালোবাসা নিস।
চিরদিনের
তোর প্রিয়
ভিনসেন্ট
ছোট্ট চিঠি। নেই তেমন উচ্ছ্বাস। আবেগ। কী সংযত। দু-একটা খবর। চিঠি পেয়ে উত্তর দিস, নেই সে কথাও। যেন কোনো কর্তব্যবোধ থেকে লেখা হয়েছে এই চিঠি। একটু কি দিনপঞ্জিধর্মী! পরে দেখা যায়, থিওকে লেখা চিঠিতে ভিড় করে আসছে নানা বিষয়। বিভিন্ন শিল্পীর কথা, ছবির প্রসঙ্গ, বই পড়া, কেনার কথা, প্রকৃতি বর্ণনা, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেমের কথা, বন্ধুতার কথা ইত্যাদি অজস্র বিষয়। বাইবেল থেকে আছে অসংখ্য উদ্ধৃতি। প্রথমদিককার চিঠিতে আছে বিভিন্ন কবিতা থেকে উৎকলন। একবার র্যামসগেট থেকে লন্ডনে হাঁটা দিয়েছিলেন। অনেকটা পথ। যেতে যেতে এক জায়গায় পুকুরের কাছে বিচ আর এলম গাছে ঘেরা একটা জায়গায় একটু বিশ্রাম করে নিলেন। সাড়ে তিনটার সময় ভোর হয়ে গিয়েছে ভেবে পাখিদের কলকাকলিতে ঘুম ভেঙে যেতে আবার হাঁটা শুরু করে দিলেন। সেই সময় লেখা একটা চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন এই বলে : Enclosed, a feather from one of the rooks there … ভাবা যায়। ভাইকে চিঠি লিখছেন, সঙ্গে পাঠাচ্ছেন পাখির পালক। পরে দেখা যায়, পাখির পালক রূপান্তরিত হয়েছে স্কেচে, ড্রয়িংয়ে। কখনো চিঠির সঙ্গে অাঁকা। কখনো আলাদা এঁকে পাঠানো। ৬ অক্টোবর ১৮৭৫ প্যারিস থেকে থিওকে লেখা চিঠিতে পাঠানো ‘Some beautiful English hymns’-এর কয়েক ছত্র :
Thy way not mine, O lord
However dark it be,
lead me by their own hand
choose out the path for me.
I dare not choose my lot;
I would not if I might;
choose thou for me, my God,
So shall I walk aright.
কবির নাম ক্রিশ্চিনা জর্জিনা রসেটি। কবির নাম যখন এসেই পড়ল তখন দেখে নেওয়া যাক ভিনসেন্টের চিঠিতে উল্লিখিত অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকের নামের আংশিক তালিকা।
বালজাক, বোদল্যের, বুলয়ার লিটন, কার্লাইল, কপ্পে, দদে, ডিকেনস, ফ্লবেয়ার, গোতিয়ে, এদমন্দ দ্য গঁকুর, লা ফঁতেইন, মলিয়ের, লংফেলো, মপাসাঁ, শেক্সপিয়ার, সুইফট, জোলা, ওয়াল্ট হুইটম্যান, বিচার স্টো, ভলত্যের।
শেক্সপিয়ারের যেসব রচনার কথা ভিনসেন্ট উল্লেখ করেছিলেন :
অ্যাজ ইউ লাইক ইট, হ্যামলেট, হেনরি চতুর্থ, হেনরি পঞ্চম, হেনরি ষষ্ঠ, হেনরি সপ্তম, কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, মেজার ফর মেজার, দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিস, ওথেলো, রিচার্ড দ্বিতীয়, দ্য টেমিং অফ দ্য শ্রু।
২২ আর ২৪ জুন ১৮৮০, দুদিন ধরে লম্বা একটা চিঠি লিখেছিলেন থিওকে। সেখানে শেক্সপিয়ারের কথা এসেছে। গত শীতে একটু ভিক্টর য়ুগো এবং ডিকেন্স, বিচার স্টোর সঙ্গে পড়েছেন শেকশপিয়ার। ভাইকে জানাচ্ছেন :
… I love Dickens’s ‘Richard Cartone’ in his Paris et Londres en 1793 just as much, and I could show you other strangely vivid figures in yet other books, with more or less striking resemblance. And I think that Kent, a man in Shakespeare’s king lear, is just as noble and distinguished a character as any figure of T de kisser, although Kent and king lear are supposed to have lived a long time earlier.
শেক্সপিয়ারের নাটক পাঠ করে তার কোনো একটি চরিত্রকে অন্য একটি চরিত্রের সঙ্গে তুলনা টানা খুব সহজ নয়। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, ভিনসেন্টের স্মৃতিশক্তি রীতিমতো জোরালো ছিল। মৃত্যুর বছরখানেক আগে সহোদরা ভিলেমিইনকে লেখা চিঠিতে (২ জুলাই, ১৮৮৯) ফিরে এসেছেন উইলিয়ম শেক্সপিয়ার :
I’m quite absorbed in reading the Shakespeare that Theo sent me here, where at last I’ll have the calan necessary to do a little more difficult reading. I’ve first taken the kings series, of which I’ve already read Richard II, Henry IV, Henry V and a part of Henry VI as these dramas were the most unfamiliar to me. Have you ever read king lear? But anyway, I think I shar’t urge you too much to read such dramatic books when I myself, returning from this reading, am always obliged to go and gaze at a blade of grass, a pine-tree branch, an ear of wheat, to calm myself.
গ্রন্থপাঠ, তজ্জনিত প্রতিক্রিয়া এবং তাকে শান্ত/প্রশমিত করতে প্রকৃতির আশ্রয়গ্রহণ – শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে কি আমাদের প্রাণিত করে না?
তাঁর চিঠিতে যে-পরিমাণে বাইবেলের উল্লেখ আছে সে নিয়ে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থ রচনা সম্ভব। পিতার মৃত্যুর পর খোলা বাইবেল, মোমবাতি এঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন ভিনসেন্ট।
বই ছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার কথাও ভিনসেন্ট তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। প্রচুর পত্র-পত্রিকা তিনি সংগ্রহ করতেন। গ্রাফিক পত্রিকার অলংকরণ শিল্পী হওয়ার সাধ ছিল তাঁর মনে। ভিনসেন্টের চিঠিতে উল্লিখিত কয়েকটি পত্রিকার নাম প্রসঙ্গত করা যাক।
Album des Vosges; L’Art Revue Hebdomadaire Illustree; Art et Critique, Revue Literaire, Dramatique, Musicale; The Art Journal; The British Workman and the Friends of Toil; The Century Illustrated Monthly Magazine; Daily News; Le Figaro; Galerie Contemporaire, Litterare, Artistique; The Graphic-An Illustrated weekly Newspaper; The Illustrated London News, Le Temps; Punch, or The London Charivari.
এদের ভেতর গ্রাফিকের নাম সবচেয়ে বেশিবার উল্লিখিত হয়েছে। দু-একটা নমুনা দেওয়া যাক গ্রাফিক সূত্রে।
… I’ve also acquired another ornament for my studio, I got a great bargain on some splendid woodcuts from the graphic, some of them prints not of the cliches but of the blocks themselves. (L 199/9 January 1882)
… The Graphic began on the narrow way and has now moved to the broad one.
I saw the latest issue this morning. There was almost nothing good in it. I took an old, torn, dirty issue of 1873 from a pile of acrap paper at a Jewish bookseller’s this morning and am keeping almost everything in it. (L293/11 December 1882)
কবি-ঔপন্যাসিক-নাট্যকারদের মতো ভিনসেন্টের চিঠিতে ছড়িয়ে আছে অজস্র শিল্পীর নাম। তাঁদের কারো নাম শ্রুত, পরিচিত; বহুজন আবার অশ্রুত, অপরিচিত। এডউইন অস্টিন অ্যাবে, অগস্ট অ্যালিবে বা পিয়ের মারি বেয়লের নাম শিল্পী হিসেবে কতজনের পরিচিত! কিন্তু গুস্তাভ কুর্বে, অনরে দ্যমিয়ের, দেলাক্রোয়া, আলব্রেখট ড্যুরার, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জোলো, ক্লদ মোনে, এডওয়ার্ড মানে, রেনোয়া, রেমব্রান্ট সে তুলনায় বহুদ্রুত। এঁদের নামোল্লেখ একাধিকবার হয়েছে ভিনসেন্টের চিঠিতে। সবচেয়ে বেশিবার হয়েছেন রেমব্রান্ট। অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন এই শিল্পীকে। অসম্ভব। নিজের গ্রন্থপ্রীতিকে ভিনসেন্ট এই বলে :
If now you can forgive a man for going more deeply into paintings, admit also that the love of books is as holy as that of Rembrandt, and I even think that the two complement each other.
আর এক জায়গায় লিখেছেন :
Someone, to give an example, will love Rembrandt, but seriously, that man will know there is a God, he’ll believe firmly in him.
ভিনসেন্টের চিঠি থেকে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তেমন একটা-দুটো তথ্য এখানে পেশ করা যেতে পারে।
পাইপ টানতে পছন্দ করতেন ভিনসেন্ট।
অল্প বয়সে ভোর ভোর উঠে নিজের কাজকর্ম শুরু করে দিতেন। হাঁটা, পড়া, চিঠি লেখা।
জন কিটসের কবিতার ভক্ত ছিলেন। হল্যান্ডে তাঁকে কেউ জানত না বলে ভিনসেন্টের বিশ্বাস ছিল।
হোটেল দ্রুয়োতে শিল্পী মিইয়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনী ও বিক্রি চলছিল। সেখানে যেতে গিয়ে ভিনসেন্টের মন বলল, ‘জুতো খুলে ফেল কারণ যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেটা পবিত্র ভূমি।’ যে ঘরে থাকতেন তার দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন ছবির প্রিন্ট। আইলওয়ার্থে স্কুলে কাজ করার সময় ভিনসেন্ট রাতে ছেলেদের ঘুমের সময় গল্প শোনাতেন। প্রতিদিন তাদের সঙ্গে বাইবেল পাঠ করতেন।
একজন ইহুদি বইবিক্রেতার কাছ থেকে ভিনসেন্ট ল্যাটিন আর গ্রিক বই কিনতেন। একবার তাঁর কাছ থেকে সত্তর সেন্টে তেরোটা প্রিন্ট কিনেছিলেন ভিনসেন্ট।
তাঁর পিতৃদেব একবার তাঁকে রেভারেন্ড মি. এবং মিসেস মেয়েসের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন। ভিনসেন্ট দেখা করতে গেলেন। রেভারেন্ড সে সময় নিদ্রা দিচ্ছিলেন। ভিনসেন্ট কী আর করেন। ঘণ্টা দেড়েক পরে আসতে বলা হয়েছে। কোটের পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলেন লামেনেইসের একখানা বই। খালের ধার বরাবর গাছের নিচে হাঁটতে হাঁটতে সেই বইটা পড়তে লাগলেন।
ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট বইটার লেখক টমাস আ কেম্পিস। বইটার ফরাসি অনুবাদের গোটাটা একবার তিনি কপি করতে শুরু করেছিলেন। এ বইটার সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল যে আবেগ ছাড়া এ বই পড়া সম্ভব নয়।
ব্রাসেলসে থাকার সময় ঘণ্টাখানেক ধরে একটা বুড়ো গাছের গুঁড়ি আঁকতেন ভিনসেন্ট। তাই দেখে একজন চাষি তাঁকে পাগল ঠাউরেছিল।
কুসমেসে থাকার সময় বাবার পাঠানো অর্থে প্রচুর বই কিনতেন ভিনসেন্ট। বাবা একবার এসে বই কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একবার তিনি ঠিক করেছিলেন জনগণের সুবিধের জন্য লিথোপ্রিন্ট করবেন। কয়েকজন শিল্পীবন্ধুকে ডেকে নেবেন এই কাজে।
ভিনসেন্ট সুভাষিত : চিঠির সৌজন্যে
কোনো কোনো সময় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে ধীরে ধীরে আমি হয়ে উঠছি একজন বিশ্বনাগরিক; অর্থাৎ আমি আর ওলন্দাজ বা ইংরেজ বা ফরাসি নই, কেবল একজন মানুষ।
ছবি-আঁকাটা আমার কাছে কী যে আনন্দের।
অনুশীলনীকে আমার মনে হয় বীজ বপন, ছবি আঁকাটাকে বীজ রোপণ।
আমার কাজের মধ্যে যদি প্রাণের উষ্ণতা আর ভালোবাসা ভরে দেওয়ায় সফল হই, তবে সে তার বন্ধুদের খুঁজে পাবে।
বিশ্বাস করি একটা সময় আসবে যখন আমিও বিক্রি হব …
গ্রামের ভেতর অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলব বলে।
প্রকৃতি বিষয়ে অনেক কিছু শেখার আছে।
অনেক সময় ভাবি দিনের তুলনায় রাত্রি অনেক বেশি প্রাণবন্ত আর অনেক বেশি বর্ণময়।
কেউ যদি সক্রিয় হতে চায়, ব্যর্থতাকে ভয় পেলে চলবে না তার, কিছু ভুল করাকে ভয় করলে চলবে না তার।
অনুভূতি একটা মস্ত ব্যাপার। একে বাদ দিয়ে কারো পক্ষে কোনো কিছু করাই অসম্ভব।
কাজই একমাত্র প্রতিকার
আমাদের চারপাশে সর্বত্র কবিতা ঘিরে রয়েছে। তাকে কাগজে-কলমে ধরা, ওফ্, দেখে যেমন মনে হয় তত সহজ নয়।
সত্যিকার ভালোবাসা যেমন করে জীবনের সত্যকে জাগিয়ে দেয় এমন আর কিছুতে পারে না।
জীবন যে কী এক রহস্য, আর রহস্যের রহস্য হলো ভালোবাসা।
কোনো একটা অনন্ত গভীর সত্য ছাড়া জীবন আমার কাছে অর্থহীন।
চার
থিওকে লেখা ভিনসেন্টের চিঠিগুলো সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন থিওর স্ত্রী জো ভ্যান গঘ-বঙ্গার। এই চিঠি থেকে সামান্য কিছু অংশ উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ১৮৯২-তে আমস্টার্ডামে আয়োজিত ভ্যান গঘ প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত ক্যাটালগে। উদ্ধৃতিগুলি নির্বাচন করেছিলেন ডাচ শিল্পী-সমালোচক রিচার্ড রোলান্ড হোলস্ট।
১৮৯৩-এর আগস্টে নয়টি ডাচ এবং চারটি ফরাসিতে লেখা চিঠি প্রকাশিত হয় ভ্যান নু য়েন স্ট্রাকস নামে একটি পত্রিকায়। এগুলি নির্বাচন করেছিলেন ডাচ শিল্পী হেনরি ভান দ্য ভেলচে।
এমিল বার্নার্ডকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন ভিনসেন্ট। সেই সব চিঠির অংশবিশেষ বার্নার্ড ধারাবাহিকভাবে ছাপতে থাকেন মার্কার দ্য ফ্রান্স নামের পত্রিকায়। সময় এপ্রিল ১৮৯৩।
উল্লিখিত এই পত্রিকা দুটিতে প্রকাশিত ভিনসেন্টের চিঠির জর্মান অনুবাদ প্রকাশিত হয় ব্রুনো কাসিরের পত্রিকা কুনস্ট উড কুয়েনস্টলারে ১৯০৪ আর ১৯০৫-এ। পরে এগুলি তিনি একটি গ্রন্থে – ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, ব্রিফ – সংকলন করেন ১৯০৬-এ।
আন্তন ভ্যান রাপার্ডকে লেখা ভিনসেন্টের চিঠি প্রকাশিত হয় ১৯০৫-এ নেদারল্যান্ডসে। আমব্রোয়াজ ভোলার্ড ১৯১১-তে প্রকাশ করেন এমিল বার্নার্ডকে লেখা ভিনসেন্টের চিঠি।
জো ভ্যান গঘ-বঙ্গারের সম্পাদনায় ১৯১৪-তে তিন খন্ডে প্রকাশিত হয় ব্রিভেন আন জিন ব্রোয়েডের (ভাইকে লেখা চিঠি)। এখানে অবশ্য পরিবারের অন্য দু-একজনকে লেখা কয়েকটি চিঠি ছিল।
জোর সম্পাদিত চিঠি থেকে নিয়ে ১৯১৪-তে প্রকাশিত হয় দুখন্ডের জর্মান সংস্করণ। প্রকাশক চিত্র ব্যবসায়ী পল কাসিরের।
১৯২০ থেকে প্রচুর পরিমাণে প্রকাশিত হতে থাকে ভিনসেন্টের চিঠি জর্মান, ইংরেজি, জাপানি অনুবাদে। ১৯৩৮-এ প্রকাশিত হয় এমিল বার্নার্ডকে লেখা চিঠি। সম্পাদনা করেন শিল্পসমালোচক ডগলাস কুপার ডগলাস লর্ড আড়াল নামে। চিঠিগুলো তিনি সাজিয়েছিলেন কালানুক্রম অনুসারে। যুক্ত করেছিলেন টীকা।
১৯২৫-এ থিওর স্ত্রী জো-বঙ্গারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ভিনসেন্ট ভিলেম ভ্যান গঘ প্রকাশ করেন ১৮৮৮-১৮৯০ কালপর্বে ভিনসেন্টকে লেখা থিওর চিঠি। ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয় আন্তন ভ্যান র্যাপার্ডকে লেখা ভিনসেন্টের চিঠি, পরের বছর তার ডাচ সংস্করণ। ভিলেম ভ্যান গঘের উদযোগে ১৯৫২-৫৪ কালপর্বে চার খন্ডে প্রকাশিত হয় ভিনসেন্টের চিঠি। ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ১৯৫৮-তে। ইতালিয়ান, ফারসি এবং জর্মান অনুবাদে যথাক্রমে ১৯৫৯, ১৯৬০ এবং ১৯৬৫-তে।
১৯৯০-তে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের মৃত্যু শতবর্ষ উপলক্ষে ভ্যান গঘ মিউজিয়ম থেকে প্রকাশিত হয় ভিনসেন্টের চিঠির একটি নতুন সংস্করণ। এখানে যুক্ত হয় ইতিপূর্বে অপ্রকাশিত একুশটি চিঠি।
১৯৯৪-এ ভ্যান গঘ মিউজিয়ম শুরু করেন ভ্যান গঘ পত্র প্রকল্প। তাঁদের সহযোগী ছিল হুজেনস ইনস্টিটিউট। পনেরো বছর গভীর পরিশ্রমের পর প্রকাশিত হয় ছয় খন্ডের ‘দ্য লেটার্স/দ্য কমপ্লিট ইলাসট্রেটেড অ্যান্ড অ্যানোটেটেড এডিশন’। সম্পাদনা করেন লিও জ্যানসেন, হানস লুইজতয়েন, নিয়েনক বাককার।
এই স্টিক সংস্করণে ভিনসেন্টের চিঠি মুদ্রিত হয়েছে কালানুক্রমিকভাবে। ভিনসেন্টের চিঠিতে উল্লিখিত শিল্পীদের অাঁকা ছবির ডাকটিকিট মাপের প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে। লেখা বাহুল্য, ভিনসেন্টের চিঠির সঙ্গে পাঠানো তাঁর আঁকা স্কেচগুলো আছে অবশ্যই। এই ছয় খন্ডের শেষ খন্ডটি নির্দেশিকা। এখানে ভিনসেন্টের জীবনী, পারিবারিক বৃত্ত; তাঁর নিজের ছবির, অন্যের ছবির তালিকাসহ আছে আরো অনেক তালিকা। সর্বার্থে এক মূল্যবান সংস্করণ নিঃসন্দেহে। প্রসঙ্গত, ভিনসেন্টের পত্রধৃত সাহিত্য-উল্লেখ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি উপাধি পেয়েছেন উটের ভ্যান ডের ভিন ২০০৭ সালে। গবেষণাপত্রটি গ্রন্থাকারে ভ্যান গঘ : আ লিটারেরি মাইন্ড শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলায় ভিনসেন্টের চিঠির কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে। ছবি বসু অনূদিত ছয়টি চিঠি প্রকাশিত হয় বারোমাস শারদীয় ১৯৭৯-তে। ‘প্রিয়তম থিও, তোমার ভিনসেন্ট’ শিরোনামে দুটি খন্ডে দেবীপ্রসাদ বসু অনুবাদ করেন সব মিলিয়ে বত্রিশটি চিঠি। ভিনসেন্টের জীবনের শেষ সাত মাসের সাতটি চিঠি অনুবাদ করেন সন্দীপন ভট্টাচার্য। গ্রন্থাকারে সেই অনুবাদ প্রকাশিত ‘এ ভাবেই চলে যেতে চাই’ শিরোনামে। ‘দাহপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ভিনসেন্টের কয়েকটি চিঠি।
আশা করি অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশিত হবে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সমস্ত চিঠি। সমৃদ্ধ হবে বাংলায় ভ্যান গঘ চর্চা।