logo

নিউ মিডিয়া আর্ট ও প্রামাণ্যচিত্র

মা হ মু দু ল  হো সে ন

১. ক্লাউড

ক্লাউড – জেমস জর্জ ও জোনাথান মিনার্ডের একটি নিরীক্ষামূলক, ইন্টারঅ্যাকটিভ টেক-আর্ট প্রামাণ্যচিত্র। তিরিশজন নিউ মিডিয়া আর্টিস্ট, কিউরেটর, ডিজাইনার এবং সমালোচককে নিয়ে এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। ছবির বিষয়রা ডিজিটাল, ত্রিমাত্রিক রঙিন সিলিউট হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন। হাততালির ভেতর দিয়ে তাঁরা ডিজিটাল ডাটার মেঘের মধ্যে আবির্ভূত হচ্ছেন, তারপর ছড়িয়ে যাচ্ছেন এবং নতুন বিষয় হিসেবে আবার আবির্ভূত হচ্ছেন। এই অনন্য ইফেক্টটি আনার জন্য তাঁরা ব্যবহার করেছেন আরজিবিডি টুলকিট নামের একটি সফটওয়্যার লাইব্রেরি। হাই ডেফিনিশন ক্যামেরার সঙ্গে কাজ করেছে মাইক্রোসফটের গেম স্টেশন এক্স বক্সের নতুন সংযোজন কাইনেক্ট ডেপথ সেন্সর। এভাবে তাঁরা প্রথাগত চলচ্চিত্র নির্মাণের যে কারিগরি প্যারাডাইম তাকে অতিক্রম করে গেছেন এবং দর্শকের জন্য সৃষ্টি করেছেন সম্পূর্ণ নতুন এক ভিজুয়াল অভিজ্ঞতা। যেমন এটি সম্পূর্ণ অর্থেই একটি সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। এটি দর্শকের নিষ্ক্রিয় দেখার ভূমিকাটিকে নিরাকরণ করে। দর্শক সাক্ষাৎকারের ডাটাবেজ থেকে বেছে নিতে পারেন তাঁর আগ্রহের অংশ, চলে যেতে পারেন এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে, অথবা একই বিষয়ের আরো অধিক গভীরে। ছবির নির্মাতারা বলছেন, দর্শকের এই সক্রিয়তার মধ্যে থাকবে ‘reasonable experience of randomness’। ক্লাউডের নির্মাতারা মনে করেন, পৃথিবী যেমন গোল নয় তেমনি ডিজিটাল বাস্তবতাও একরৈখিক নয়। এই বাস্তবতাকে সনাতন ন্যারেটিভের ভেতর দিয়ে ধরা সম্ভব নয়। তাঁদের অভিজ্ঞতায় ডিজিটাল বাস্তবতা হচ্ছে, ‘a sprouting web of interactive, overlapping and interrupting ideas.’ চলচ্চিত্র নির্মাণের এই প্রক্রিয়া জর্জ ও মিনার্ডের এক কাস্টম মেইড অনন্য প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। এই তাহলে নিউ মিডিয়া আর্ট আর এই কি নতুন প্রামাণ্যচিত্র?

২. নিউ মিডিয়া আর্ট – কোথা থেকে, কখন, কীভাবে

 

কিন্তু নিউ মিডিয়া আর্ট বলতে কী বুঝব সেটা যেন একটুখানি বলবার অপেক্ষায় থাকে। গোড়াতে ‘নিউ’ শব্দটি বোধ হয় ছিল না – কেবল মিডিয়া আর্ট বলেই কিছু প্রযুক্তিনির্ভর অভিব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে চাওয়া হয়েছিল। আর এসব অভিব্যক্তি পারফর্মিং আর্ট, ভিজুয়াল আর্ট এবং কথ্য বা লিখিত ভাষ্যভিত্তিক যে আর্ট তাদের থেকেই শাখা-প্রশাখা ধরে প্রসারিত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমে সকল কিছুর যেমন সুন্দর, গোছানো শ্রেণিকরণ করা হয়েছে – অন্তত যা আধুনিকতার একটি বিশেষ চিহ্ন, তেমনটি যেন ঘটেনি মিডিয়া আর্টের ক্ষেত্রে। আসলে মিডিয়া আর্টের ভেতর যে আধুনিকতাকে পেরিয়ে যাবার এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি করে শৃঙ্খলা ভেঙে দেবার সহজাত প্রবণতা আছে, তা-ই সম্ভবত এর একটি বোধগম্য কারণ। অন্তত আমরা ক্রীড়াচ্ছলেও এরকম ভেবে নিতে পারি; এ লেখা আরো এগিয়ে গেলে আমরা দেখব ক্রীড়াময়তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মিডিয়া আর্টে। শ্রেণিকরণ প্রসঙ্গে ফেরা যাক। দেখতে পাই কখনো ব্যবহৃত প্রযুক্তির ধরন অনুযায়ী, কখনো সৃষ্ট শিল্পের উদ্দেশ্য এবং উপস্থাপনা অনুযায়ী, আবার কখনো কদাচিৎ এর অভিব্যক্তির ধারণাটি এবং নন্দনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিকরণ করা হয়েছে। এসবের ভেতর হারিয়ে যাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু যে জিনিসটি বিভ্রান্তির মধ্যেও চোখে পড়বে তা হলো যে চলমান ছবির সঙ্গে মিডিয়া আর্টের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এডওয়ার্ড ময়ব্রিজ যে সিরিজ ফটোগ্রাফি নিয়ে নিরীক্ষা করেছিলেন; তখনো আসেনি কিন্তু চলচ্চিত্র – সেই নিরীক্ষাকেই মিডিয়া আর্টের সূতিকাগার বলতে চাওয়া হচ্ছে। পরে বিশ শতকে মূল ধারার ন্যারেটিভ চলচ্চিত্রের বিপরীতে যেসব চলচ্চিত্র প্রচেষ্টা হয়েছে তাদের মিডিয়া আর্টের মর্যাদা দিতে চাওয়া হয়েছে। শব্দের আবির্ভাব, সম্পাদনার নানা সৃজনশীল কৌশল সৃষ্টি, নানাধরনের অপটিক্যাল ইফেক্ট মিলে চলচ্চিত্রের মধ্যেই নানা নিরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, যার সুযোগ নিয়েছিলেন স্টুডিও সিস্টেমের বাইরের চলচ্চিত্রকাররা এবং অন্যান্য দৃশ্যশিল্পের শিল্পীরা। ম্যান রে, সালভাদর দালি অথবা ফ্যারনঁ লেগ্যারের মতো শিল্পীরা চলমান ছবিকে নানাভাবে ব্যবহার করছিলেন তাঁদের অভিব্যক্তির জন্য। অন্যদিকে, আইজেনস্টাইন, জিগা ভের্তভ, ফ্রিৎজ ল্যাঙ, লুই বুনুয়েল চলচ্চিত্র শিল্পের ভেতরেই নানা নিরীক্ষার প্রান্তিক শিল্পজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। এভাবে চলচ্চিত্রের সকল ধরনের অফ-বিট ব্যবহারকেই মিডিয়া আর্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সম্ভবত এ এক ফিরে দেখার ব্যাপার। কারণ, পরে যা ঘটেছে তা হলো চলমান ছবির প্রযুক্তির ব্যাপক বদল, অথবা নতুন সকল প্রযুক্তির কেন্দ্রের মধ্যে অবস্থান নিয়েছে চলমান ছবি এবং আধার হয়ে উঠেছে সকল নতুন শিল্প-প্রচেষ্টার।

মিডিয়া আর্টের ইতিহাস যাঁরা পাঠ করবার চেষ্টা করছেন তাঁরা বলছেন যে, ছয়ের দশকে ভিডিও আবির্ভূত হওয়ার আগে পর্যন্ত যে স্বাধীন চলচ্চিত্র প্রচেষ্টা, যেখানে অভিব্যক্তির নিরীক্ষার প্রচেষ্টা আছে প্রযুক্তির ব্যবহারে এবং বিষয়বস্ত্তর মৌলিকতায়, তার সবই মিডিয়া আর্টের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আমাদের হয়তো মনে পড়বে অ্যান্ডি ওয়ারহলের চলচ্চিত্রগুলোর কথা। কিন্তু ভিডিও প্রযুক্তির আবির্ভাব মিডিয়া আর্টকে নিয়ে গেছে তার সেই চরিত্রের দিকে, যার ভেতর দিয়ে আজ আমরা হয়তো তাঁকে চিনতে পারি। সেসব গেল শতকের ছয়ের দশকের কথা। মূলধারার টেলিভিশনের বিকল্প একটি দেখার জগৎ সৃষ্টি করার কৌশল হিসেবে ভিডিও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছিলেন মিডিয়া আর্টিস্টরা। তাঁরা নানামুখী ধারায় কাজ করেছিলেন। যেমন একটি ধারা ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক ইস্যুতে বিকল্প প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ। ১৯৭২-এর আমেরিকার নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটদের কনভেনশন নিয়ে এরকম একটি ছবি নির্মিত হয়েছিল টপভ্যালু টেলিভিশন (টিভিটিভি) এবং ভিডিওফ্রিএক্স নামের ভিডিও সমবায়ের প্রচেষ্টায়। দেখার এই বিকল্প প্রতিবেশ নির্মাণের চেষ্টা কেবল প্রামাণ্যচিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ন্যারেটিভ ভিডিও, সংগীত ভিডিও – এসব বিষয়কে নিয়েও কাজ করতে চেয়েছে। আর দ্বিতীয় যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছিল অনেক ক্ষেত্রে তা হলো, নতুন এই মাধ্যমটির প্রযুক্তিগত চরিত্রকে ব্যবহার করে নতুন ধরনের ইমেজ সৃষ্টির চেষ্টা। এ সময় থেকেই ‘ভিডিও আর্ট’ পদটি প্রচলিত হয়ে যায়। আর যে ব্যাপারটি ঘটে তা হলো, প্রথাগত চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী নন কিন্তু চলমান ছবিকে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম করে তুলতে চান – এমন মানুষেরা ভিডিও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। যেসব মাল্টি-মিডিয়া স্থাপনাকর্ম তাঁরা সৃষ্টি করতে শুরু করলেন সেগুলি বিভিন্ন গ্যালারিতে, মিউজিয়ামে এবং উন্মুক্ত স্থানে প্রদর্শিত হতে লাগল। এখানে আবার দুটি ধারা দেখা গেল। একদল শিল্পী তাঁদের স্থাপনাকর্মে ভিডিও মাধ্যমে চলমান ছবিকে তার প্রথাগত প্যারাডাইমের ভেতরই উপস্থাপন করতে লাগলেন। অন্য দলটি ভিডিওর চলমান ইমেজের ভেতর থেকে ধারণাভিত্তিক নতুন শিল্পচেতনা অথবা উপস্থাপনা নিয়ে নিরীক্ষা শুরু করলেন। দর্শকের সংবেদন, প্রতিক্রিয়া এবং অংশগ্রহণকে তাঁরা ভিডিওর ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কথা ভাবতে শুরু করলেন। এ সময়ই প্রচলিত হয় কমিউনিটি ভিডিওর ধারণা। যার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠী – হয়তো একটি সড়ক বা একটি মহল্লার মানুষেরা ভিডিওর ভেতর দিয়ে নিজেদের ভেতরে যোগাযোগ, সচেতনতা, প্রচারণা ইত্যাদি গড়ে তুলতে পারেন। এইভাবে চলমান ইমেজের একধরনের গণতন্ত্রায়ন এবং সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়।

এর পরেই ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের বিপ্লব। আটের দশকের শেষ বা নয়ের দশকের শুরু থেকে ডিজিটাল ভিডিও, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারে মিডিয়া আর্টে যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয় তাকে স্বীকৃতি দিয়ে আলোচকরা এ পর্যায় থেকে ‘নিউ মিডিয়া আর্ট’ পদটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। নিউ মিডিয়া এখন ন্যারেটিভ ছবি, প্রামাণ্যচিত্র, নিরীক্ষামূলক শিল্পকর্ম এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা – সকল ক্ষেত্রেই সমানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘One person’s new media art is another person’s social intervention and a third person’s scientific research.’

নিউ মিডিয়া আর্টের আঙ্গিকগত ব্যাপ্তি এত বিশাল যে সে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা! সেখানে চলমান ছবিতে গল্প থাকতে পারে, সে গল্পের অংশবিশেষে কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ থাকতে পারে, কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের ইমেজ বা গ্রাফ বা ডাটার উপস্থাপনা থাকতে পারে, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমের কোনো আউটপুট নিয়ে কাজ থাকতে পারে, প্রথাগত ডকুমেন্টেশন থাকতে পারে, ইন্টারঅ্যাকটিভ ন্যারেটিভ বা ডকুমেন্টেশন থাকতে পারে, তার উৎস হতে পারে ইন্টারনেটের কোনো নির্দিষ্ট অথবা ডাইনামিক লিঙ্ক। এছাড়া শিল্পীরা চলমান ছবি এবং শব্দের প্রজেকশনে নানা কৌশলের ব্যবস্থা করে থাকেন, সঙ্গে যুক্ত হতে পারে পেইন্টিং, ড্রইং, ছাপচিত্র, লাইভ অভিনয় এবং আরো কত কী! নিউ মিডিয়া তাত্ত্বিক লেভ ম্যানোভিচ এই সময়ের মিডিয়া আর্টের জন্য উত্তর-মিডিয়া নন্দনতত্ত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।

আমাদের মূল আগ্রহের বিষয় নিউ মিডিয়া আর্ট এবং প্রামাণ্যচিত্র। সেদিকে মনোযোগী হবার আগে নিউ মিডিয়া আর্টে চলমান ছবির অন্যতর ব্যবহার নিয়ে সংক্ষেপে কিছু ভাবনার কথা লেখা যেতে পারে। নিউ মিডিয়া আর্টে এখন প্রধানত একটি ধারণার ভিজুয়ালাইজেশন এবং অনেক ক্ষেত্রেই এই ধারণার সঙ্গে দর্শকের সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টি যুক্ত হয়। ভিজুয়ালাইজেশনের বিষয়টি সংঘটিত করার জন্য নানারকম উপাদান ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন বলেছি আগেই। ভিডিও, অডিও, লাইভ পারফরম্যান্স, নানা বাস্তব বা সম্ভাব্য অভিজ্ঞতার প্রযুক্তিগত সিমুলেশন, অাঁকা ছবি, ছাপচিত্র, আলোকচিত্র, সংগীত, লিখিত ভাষ্য – এরকম বিচিত্র উপাদানের সমন্বয়ে ঘটতে পারে এই ভিজুয়ালাইজেশন। যে-কোনো অর্থেই এই সকল উপাদান তখন ধারণাটির বাহন বা কন্টেইনারে পরিণত হয়; বলা যেতে পারে মেটা-শিল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই উপাদানগুলি। আমরা কিন্তু তর্ক করতে পারি যে, যে-কোনো শিল্পেই কি তার আঙ্গিকটি আসলে কন্টেইনার বা মেটা-আর্ট নয়? শিল্প তো আসলে যা উপস্থাপিত হচ্ছে সেই উপস্থাপনার অভিজ্ঞতাটি। এভাবে ভাবলে অবশ্য আলোচনাটির একধরনের লঘুকরণ হয়ে যায়, যা তর্কের দিক থেকে হয়তো নির্ভুল, কিন্তু অভিজ্ঞতায় ততটা কনভিন্সিং নয়। এবং এভাবে দেখলে এটাও বলা যায় যে, ধারণাভিত্তিক শিল্পেরই বা নতুনত্বটা কোথায়? এমন শিল্পের অস্তিত্ব কি কল্পনা করা সম্ভব, যার পেছনে শিল্পীর কোনো ধারণা কাজ করেনি? কিন্তু আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, কনসেপচুয়াল আর্ট অবশ্যই এক ভিন্ন উপস্থাপনা এবং সেখানে আমরা জীবন্ত পারফরম্যান্স থেকে শুরু করে যা কিছু দেখি তাদের সকলের সংশ্লেষণে একটি নতুন শিল্প-উপস্থাপনা আমরা ভোগ করি। আমরা আলাদাভাবে অভিনয়, চলচ্চিত্র, পেইন্টিং বা সংগীতের ভোগকে উপলব্ধি করি না, অথবা আমাদের এমন একটি চেতনার কন্ডিশনিং ঘটে যে, আমরা বিচ্ছিন্নভাবে এসব উপাদানকে অনুভবই করি না। বরং যে কনসেপ্ট পেপারটি আমরা পাই তার সঙ্গে একধরনের সাবজেক্টিভ বোঝাপড়ায় পৌঁছুতে চাই সামগ্রিক উপস্থাপনাটির ভেতর দিয়ে। আর কনসেপচুয়াল আর্ট তো শিল্প-উপস্থাপনার শৈলীর মূল্য বিচারে চূড়ান্তভাবে আস্থাহীন। সেখানে ধারণাটিই প্রধান। আমরা অবভাসিক অধ্যয়ন বা ফেনোমেনোলজিক্যাল স্টাডির জায়গা থেকে বিষয়টিকে দেখতে চাচ্ছি। নিউ মিডিয়া আর্টের যে ফেনোমেনা সেখানে আরো অনেক উপাদানের সঙ্গে চলমান ছবি প্রায়ই এমন এক উপাদান, যাকে আলাদাভাবে অভিজ্ঞান বা উপলব্ধি করার সম্ভাবনা নেই অথবা বলা যেতে পারে, চলমান ছবির অভিজ্ঞতার এক গুণগত পরিবর্তন এখানে ঘটে যেতে পারে। বিশেষ করে এর সঙ্গে যখন ইন্টারঅ্যাকটিভিটির বিষয়টি যুক্ত হয় তখন ব্যাপারটি আরো এক ধাপ বা বহু ধাপ এগিয়ে যায়। যেমন ধরুন, এমন এক কাজ, নিউ মিডিয়া আর্টের, যেখানে চলমান ছবির চরিত্ররা দর্শকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন, যে স্পেসে কাজটি রয়েছে তার ভেতর দিয়ে তাদের সঙ্গে হেঁটে চলার, এমনকি সাইকেল চালিয়ে ভ্রমণ করার আমন্ত্রণ জানান এবং দর্শকেরা সেরকম কিছু করেন। এখানে দর্শক প্রথমে প্রশ্নোত্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক এনগেজমেন্টে এবং পরে চলমান ক্যামেরার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার বা সাইকেল চালানোর পারফরম্যান্সে এমনভাবে যুক্ত হন যে, হয় চলচ্চিত্র-ভোগ এর প্যারাডাইমটি এক ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত হয় বা বাতিল হয়ে যায় উপস্থাপিত শিল্পের ধারণাটির জীবনচক্রটির মধ্যে। এভাবে নিউ মিডিয়া আর্টে চলমান ছবির, হয়তো চলচ্চিত্রের, এক ভিন্ন যাত্রা, ভিন্ন ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমরা বরং ফিরে যাই প্রামাণ্যচিত্রে – এবং নিউ মিডিয়ার সঙ্গে তার যৌক্তিক সম্পৃক্তি প্রসঙ্গে।

৩. নতুন প্রামাণ্যচিত্র

 

ওয়েব ডকুমেন্টারি, ইন্টারঅ্যাকটিভ ডকুমেন্টারি, ডাটাবেজ-ফিল্মমেকিং, নন-লিনিয়ার ডকুমেন্টারি ইত্যাদি ডিজিটাল বিপ্লব-উত্তর প্রামাণ্যচিত্র-সম্ভাবনা।

নতুন প্রামাণ্যচিত্রকার যদি নিউ মিডিয়াকে ব্যবহার করতে চান তাহলে তাঁর চলচ্চিত্র-চিন্তার নবায়নের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ এখানে নিউ মিডিয়ার প্রযুক্তির সঙ্গে প্রথাগত চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্যারাডাইমের এক ধরনের সংশ্লেষণের প্রশ্ন আছে। আছে নিউ মিডিয়ার প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলচ্চিত্রটির সৃজনের প্রশ্ন। এখানে নিউ মিডিয়ার সঙ্গে মাত্রাগত সম্পর্কের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে আমাদের আলোচনাটি অগ্রসর হতে পারে। একটি প্রামাণ্যচিত্র বা তর্কের খাতিরে বলা যায় যে-কোনো চলচ্চিত্রই কেবল ডিজিটাল মাস্টারিংয়ের সময় সফটওয়্যার ব্যবহার করে খানিকটা ইন্টারঅ্যাকটিভ করে ফেলা যায়। দর্শক তার পছন্দমতো দৃশ্য বেছে অগ্রসর হতে পারেন এবং চলচ্চিত্রটিতে কিছু মাত্রায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু প্রযুক্তির হাত ধরে এই সম্ভাবনা এখন আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই যাত্রায় ডাটাবেজের ধারণাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ডাটাবেজ একটি কম্পিউটারবিষয়ক পদ এবং এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, এটি হচ্ছে ‘উপাত্তের সুবিন্যস্ত সংগ্রহ (organized collection of data)’ এবং এর উপযোগিতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ডাটাবেজে যে উপাত্ত সংগৃহীত থাকে তাকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়, যাতে কম্পিউটারের সাহায্যে এই উপাত্ত অতি দ্রুত অনুসন্ধান করা যায় এবং ব্যবহারের জন্য পুনরুদ্ধার করে আনা যায়।’ আমরা প্রায়ই শুনি সার্চ ইঞ্জিনের কথা। সার্চ ইঞ্জিনের কাজ হচ্ছে ডাটাবেজ থেকে উপাত্ত পুনরুদ্ধার করা। বলা বাহুল্য, সার্চ ইঞ্জিনগুলো হচ্ছে অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার এবং আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সফটওয়্যার। ভেবে দেখুন, একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার অল্প কিছু ব্যক্তিগত উপাত্ত প্রবেশ করানো মাত্র সে আপনার সম্ভাব্য বন্ধুদের খুঁজে বের করছে কোটি কোটি আপনার মতো মানুষের উপাত্তের সঙ্গে মিলিয়ে। এবং আমরা সকলেই মানব যে, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। এ কাজটি করছে সার্চ ইঞ্জিন। আজকের নতুন প্রামাণ্যচিত্রের প্রবক্তারা বলছেন, ডাটাবেজের ওপর ভিত্তি করে সত্যিকারের নন-লিনিয়ার এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হতে পারে। তাঁরা সম্ভবত কেবলমাত্র নন-লিনিয়ারিটি বা অ-একরৈখিকতার কথা বলছেন না, অনিশ্চিত এবং ক্রীড়াময় ন্যারেটিভের কথাও বলছেন। কেননা, নিউ মিডিয়ার সঙ্গে ভীষণভাবে যুক্ত হচ্ছে ক্রীড়াময়তার প্রসঙ্গটি। কম্পিউটার গেমসের কথা কেবল তাঁরা বলছেন না, এ ধারার তাত্ত্বিকরা মনে করেন ‘Play is older than culture.’ সুতরাং সংস্কৃতির নতুনতম উপস্থাপনায় তাঁরা ক্রীড়াময়তাকে তার যোগ্য স্থানে ফিরিয়ে আনতে চান। কিন্তু যেসব কথা বলছি এসবই যথেষ্ট মাত্রায় বিমূর্ত হয়ে উঠছে বলে সন্দেহ করি। যেসব কথা পড়ে এবং যা দেখে এসব বলতে অনুপ্রাণিত হচ্ছি, সেসব চিন্তাকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি উদাহরণ, অন্তত ভাবনার পর্যায়ে, তৈরি করে নিলে কেমন হয়? অনেক ভেবেচিন্তে একটি দুঃসাহস দেখাচ্ছি। আমি চলচ্চিত্রকার নই, এমনকি মোটের ওপর সৃজনশীল মানুষও নই। তারপরও একটি চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার কথা বলছি। ধরা যাক, আমরা একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ, নন-লিনিয়ার, ডাটাবেজ-নির্ভর ওয়েব ডকুমেন্টারির কথা বলছি। বিষয় : মেকিং অব স্টপ জেনোসাইড। আমি কল্পনা করছি, এই চলচ্চিত্রের একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ থাকবে। এই ডাটাবেজে আস্ত স্টপ জেনোসাইড চলচ্চিত্রটি থাকবে। থাকবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তোলা আরো কিছু ফুটেজ, যা এই চলচ্চিত্রকারের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। এখানে থাকবে সাক্ষাৎকারগুলি। যাঁরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন এর নির্মাণের সঙ্গে এবং যাঁরা বিভিন্নভাবে এটির নির্মাণকালীন ইতিহাস জানেন প্রত্যক্ষভাবে বা পড়ে এবং শুনে। এখানে থাকবে জহির রায়হানের নির্মিত অন্য চলচ্চিত্র, যেমন – জীবন থেকে নেয়া, কখনও আসেনি, কাঁচের দেয়ালের কিছু অংশ। প্রত্যক্ষ জড়িত মানুষদের কথনের সঙ্গে মিলিয়ে আরো ফুটেজ যুক্ত হতে পারে। যেমন – আমরা আলমগীর কবিরের মুখে শুনেছি যে, স্টপ জেনোসাইড নির্মাণের আগে জহির রায়হান ওয়াইদার অ্যাশেজ অ্যান্ড ডায়মন্ডস এবং কিছু লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী প্রামাণ্যচিত্র দেখেছিলেন। আমরা এসব ছবির কিছু ফুটেজ ডাটাবেজে রাখতে পারি। এই ডাটাবেজে সংযুক্ত হবে জহির রায়হানের বাছাইকৃত কিছু সাহিত্যকর্মের পিডিএফ ফাইল। দর্শকের জন্য, এক্ষেত্রে দুরস্ত হচ্ছে ‘ব্যবহারকারী’ শব্দটি চয়ন করা, এই চলচ্চিত্রটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একটি সার্চ অপশন চলচ্চিত্রটির ওয়েবসাইটে দেওয়া থাকতে পারে। দর্শকদের নানা প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে বের করে উপস্থাপন করবে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব থেকে। যেমন –  ব্যবহারকারী ‘জেনোসাইড’ এবং ‘ষাটের দশক’ এই শব্দগুলি মিলিয়ে নেটে প্রাপ্য ভিডিও উপাত্ত দেখতে চাইতে পারেন। তিনি প্রশ্ন করতে পারেন ‘১৯৭১’ এবং ‘বাংলাদেশ ওয়ার’ শব্দ দুটি নিয়ে এবং খুঁজে পেতে চাইতে পারেন যে-কোনো সাংস্কৃতিক কর্মের ফুটেজ এই প্রসঙ্গে। এখন এই চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণ ব্যবহারকারীর স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে, নাকি এটিতে এক ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হবে সেটি স্থির করার ব্যাপার। যতটুকু বোঝা যায়, প্রায় সকল নির্মাতাই চাইবেন তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের যে উদ্দেশ্য তার সঙ্গে দর্শক একটি পর্যায় পর্যন্ত সম্পর্কিত হোক। অন্তত তাঁর তর্কটি বা তাঁর ইতিহাসের পাঠটির ভেতর দিয়ে দর্শক যাক। সুতরাং এখন চলে আসছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় কিছু লজিক বিল্ড করার ব্যাপার। আমি কাঁচাভাবে কিছু লজিকের কথা ভাবছি। ১. দর্শককে এই ছবির একটি অংশ দেখতেই হবে (না হলে তিনি আর অগ্রসর হতে পারবেন না, যেমনটি ঘটে অনেক কম্পিউটার গেমের ক্ষেত্রে)। সে অংশটি হলো, একজন প্রামাণ্যচিত্রবোদ্ধা স্টপ জেনোসাইডের নির্মিতি নিয়ে কথা বলছেন এবং এর সঙ্গে ক্রস কাটিং করে স্টপ জেনোসাইড ছবির প্রাসঙ্গিক অংশগুলো দেখানো হচ্ছে। ২. প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিটি সাক্ষাৎকারই দেখতে হবে। ৩. পরোক্ষ অভিজ্ঞতার সাক্ষাৎকারগুলো থেকে অন্তত একটিকে দেখতে হবে। ৪. ব্যবহারকারী জহির রায়হানের পূর্বে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র দেখার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, আবার না-ও নিতে পারেন। কিন্তু যদি তিনি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাঁকে জীবন থেকে নেয়ার অংশবিশেষ দেখতেই হবে। ৫. ব্যবহারকারীকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য প্রামাণ্যচিত্র দেখতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সবশেষে ব্যবহারকারী কতক্ষণ চলচ্চিত্রটিতে থাকলেন তা তাঁকে দেখানো হবে এবং তাঁর নিকট থেকে এই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে এবং স্টপ জেনোসাইড সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হবে। এসব উপাত্ত আবার ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা হবে এবং পরবর্তী ব্যবহারকারীরা এগুলি একটি নির্দিষ্ট উপস্থাপনায় দেখতে পাবেন। আমি আশা করি, যাঁরা এ বিষয়ে কোনো ছবি করার কথা ভাবছেন তাঁরা আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সম্ভবত সাধিত হয়েছে। আমি নিউ মিডিয়া আর্টের ব্যাপক প্রযুক্তিগত সম্ভাবনার সঙ্গে প্রামাণ্যচিত্রকে সম্পর্কিত করতে পেরেছি। আসলে এ কথাগুলি আদৌ মৌলিক কিছু নয়। এখন প্রযুক্তির এমত ব্যবহারে নতুন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা ও সংগঠক লোয়া ভোসেন বলছেন, ‘I do think filmmakers are beginning to imagine new ways of telling stories across multiple platforms including online, through games, etc., and so transmedia and more immersive formats will continue to pull documentaries in new directions. Much more relevant to independent filmmakers is the question of how viewing habits have changed and what audiences will ‘sit through’ in terms of television running times. I ask filmmakers how many 90-minute social issue documentaries did they watch on television last week, and maybe we need to consider making multiple versions of some films : a festival version, theatrical version and television version. We still want a great story, well-told, and some of us will sit in a movie theater to watch that, and more of us will sit in our living room or with our laptops to watch it, but the way we watch is definitely changing.’ আমাদের উদাহরণে যে চলচ্চিত্রটির কথা বলা হয়েছে সেটিরও এরকম কয়েকটি সংস্করণের কথা ভাবা যেতে পারে। প্রথাগত সিনেমা হলের জন্য একটি সংস্করণ, যেটি এ মুহূর্তে ইন্টারঅ্যাকটিভ হতে পারবে না। দৈর্ঘ্য বিবেচনায় রেখে এরই আরেকটি সংস্করণ হতে পারে টেলিভিশনের জন্য। অন্যদিকে সম্পূর্ণ ইন্টারঅ্যাকটিভ এবং পুরোপুরি নন-লিনিয়ার সংস্করণটি হতে পারে ওয়েবের জন্য।

ক্লাউডস ওভার কিউবা ঠিক এমনি এক ওয়েভ ডকুমেন্টারি – ইন্টারঅ্যাকটিভ, নন-লিনিয়ার এবং দর্শকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে এর ব্যাপ্তি, বিস্তার। পনেরোটি ইন্টারঅ্যাকটিভ অপশন ব্যবহার করে দর্শক বা ব্যবহারকারী ১৯৬২ সালের কিউবা সংকটের প্রাগ-ইতিহাস, উদ্ভব, বিস্তার এবং বিমোচন সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রায় দুইশো স্থিরচিত্র, ভিডিওচিত্র, প্রামাণ্য দলিল, অডিও রেকর্ডিং এই ছবির সঙ্গে যুক্ত আছে, যেগুলি আগ্রহীজনেরা আরো বিস্তারিত জানার জন্য পাঠ করতে পারেন। এইচ টি এম এল ফাইভ এবং জাভা স্ক্রিপ্ট এবং ওয়েভ সার্কিট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন এক ছবি তৈরি করা হয়েছে, যা একে দিয়েছে ক্রস প্ল্যাটফর্ম কমপ্যাটিবিলিটি। অর্থাৎ যে-কোনো অপারেটিং সিস্টেমের ল্যাপটপ থেকে শুরু করে যে-কোনো স্মার্টফোনেই আপনি এই ছবিটি দেখতে এবং পাঠ করতে পারবেন। এমনকি দর্শক ওই তেরোদিনের সংকটে সরাসরি অংশগ্রহণও করতে পারবেন; অন্তত অংশগ্রহণের ভারচুয়াল অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন! এ বিষয়টির ওপর জোর দিতে চাই যে, আগামী দিনের একটি বড়সংখ্যক দর্শক প্রামাণ্যচিত্র দেখবেন তাঁদের নিজস্ব, ব্যক্তিগত একটি ডিভাইসে। সেটি হতে পারে স্মার্টফোন, ট্যাব বা আরো নতুন কিছু। এসব ডিভাইস আসবে নানা প্রযুক্তি, অপারেটিং সিস্টেম ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে। সুতরাং যে প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হবে তা যাতে সব ধরনের ডিভাইসে চলতে পারে, অর্থাৎ একটু আগেই যার কথা লিখেছি – ‘ক্রস প্ল্যাটফর্ম কমপ্যাটিবিলিটি’, এই প্রযুক্তিগত সুবিধাটি তার ক্ষেত্রে থাকতে হবে।

ক্লাউডস ওভার কিউবা যতদূর পর্যন্ত প্রযুক্তিকে ধারণ করে নন-লিনিয়ার এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ হতে পেরেছে, এতখানি না হয়েও কিন্তু অনেক ওয়েব ডকুমেন্টারি নতুন চলচ্চিত্র-সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে,   অন্তত তাদের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাচ্ছে। লন্ডন কলেজ অব মিডিয়ার অধ্যাপক সান্ড্রা গাওনডেজি ইন্টারঅ্যাকটিভিটির দিক থেকে প্রামাণ্যচিত্রকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এক ধরনের প্রামাণ্যচিত্র, তাঁর ভাষায়, সেমি-ক্লোজড বা বন্ধ-প্রায়। এ ধরনের ছবিতে দর্শক তাঁর ইচ্ছামতো নেভিগেট করতে পারেন কিন্তু ছবির কনটেন্ট বদলে ফেলতে পারেন না। দ্বিতীয় ধরনের প্রামাণ্যচিত্রকে তিনি বলছেন সেমি-ওপেন বা প্রায়-খোলা। এরকম ছবিতে দর্শক একটা পর্যায় পর্যন্ত অংশগ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু ছবির কাঠামো পরিবর্তন করতে পারেন না। তৃতীয় ধরনের ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রামাণ্যচিত্র হচ্ছে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। এ ধরনের ছবিতে দর্শক চলচ্চিত্রটির সঙ্গে পুরোপুরিভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারেন এবং চলচ্চিত্রটির কাঠামো বা বিষয়বস্ত্ত প্রত্যেক দর্শকের জন্য নতুন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।

প্রায়-বন্ধ ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রামাণ্যচিত্রের একটি উদাহরণ হতে পারে কানাডায় মিডিয়া গ্রুপ The Goggles-এর তৈরি প্রামাণ্যচিত্র ওয়েলকাম টু পাইন পয়েন্ট। পাইন পয়েন্ট কানাডার এক খনি-শহর, যেটি গত শতকের আটের দশকে অস্তিত্ববহীন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে যে বইটি লেখা হয়েছিল সেটির টেক্সট ছবিটিতেও একইভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এই টেক্সটই তার মূল কনটেন্ট। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্মৃতি এবং নানা জিনিসের কোলাজ। আরেকটি প্রায়-বন্ধ ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রামাণ্যচিত্র হচ্ছে ফরাসি চলচ্চিত্রকার অলিভিয়ের ল্যামবার্ত এবং আলোকচিত্রী থমাস সিলভার যৌথ নির্মিতি Bréves de Trottoir। এই ছবিতে চলমান ছবি এবং আলোকচিত্রের একটি সংগ্রহ প্যারিসের ‘ডেইলি সেলিব্রিটি’দের জীবনের গল্প বলে।

অন্যদিকে জার্নি টু দ্য এন্ড অব কোল একটি প্রায়-খোলা প্রামাণ্যচিত্র। ফরাসি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান হঙ্কিটঙ্কের হয়ে এই ছবিটির কাঠামোটি নির্মাণ করেছেন স্যামুয়েল বোলেনড্রফ ও আবেল সেগ্রেতাঁ। এতে আছে প্রায় তিনশো আলোকচিত্র, তিন ঘণ্টার ভিডিও আর দশ ঘণ্টার শব্দসংগ্রহ। এসব উপকরণ দর্শককে আমন্ত্রণ জানায় চীনের অভিবাসী খনি-শ্রমিকদের সঙ্গে খনির গভীরে প্রবেশের এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের। দর্শকরা চলচ্চিত্রটির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন এবং টেক্সটের আকারে নতুন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। ফরাসি সাংবাদিক ডেভিড দুফ্রেসনে এবং আলোকচিত্র-সাংবাদিক ফিলিপ ব্রল্ত প্রিজন ভ্যালি নামের যে ছবিটি তৈরি করেছেন সেটি একই সঙ্গে একটি টেলিভিশন ডকুমেন্টারি, একটি ওয়েব ডকুমেন্টারি, একটি মুদ্রিত বই, একটি আইফোন অ্যাপ এবং প্যারিসে একটি প্রদর্শনী হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকার কলোরাডো রাজ্যের ফ্রিমন্ট কাউন্টিকে নিয়ে এই ছবি। কাউন্টিটির বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে অবস্থিত তেরোটি কারাগার হচ্ছে এর অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ছবির দর্শককে ফেসবুক বা টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এর মধ্যে প্রবেশ করতে হয়, অথবা, ছবিটির ওয়েবসাইটে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ছবিটি একটি সড়ক-পরিভ্রমণের মতো করে দর্শককে এগিয়ে নিয়ে চলে এবং নানারকম ঘোরা পথে যাবার জন্য দর্শককে উৎসাহিত করে। সেইসঙ্গে নানা সম্পূরক তথ্য জানতে দর্শককে সাহায্য করে।

খোঁজ করে দেখা গেল, ঢাকা শহরের বাজারগুলোর ওপর একটি ওয়েব ডকুমেন্টারি আছে। ছবিটির নির্মাতা শাহজাহান সিরাজ। ধারণাটি ছিল এরকম যে, আশি + একদিনে (জুল ভার্নের বিখ্যাত উপন্যাসের অনুপ্রেরণায়) ঢাকার বিভিন্ন বাজার, শপিং মল ইত্যাদি থেকে লাইভ ভিডিও ও অডিও স্ট্রিমিং করা। প্রতিদিন একটি করে বাজার থেকে এই কাজটি করার মাধ্যমে দর্শককে ঢাকার
বাজার-জীবনের জীবন্ত অভিজ্ঞতা প্রদান করা এবং হয়তো এভাবে এ শহরের একটা পরিচিতি এবং ঘনিষ্ঠতা প্রদান করা। পরে সকল ভিডিও এবং অডিওকে নেটে উপাত্ত হিসেবে রাখা হয়েছে এবং দর্শক নিজের পছন্দমতো ক্রমে এই বাজার ভ্রমণে অংশ নিতে পারেন।

সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রামাণ্যচিত্রের ধারণা নিয়ে খুব বেশি কাজ এখনো হয়নি। তবে এ বিষয়ে নানারকম নিরীক্ষা চলেছে। ক্লাউডস ওভার কিউবা প্রযুক্তির দিক থেকে খুবই অগ্রসর এবং ব্যাপকভাবে ইন্টারঅ্যাকটিভ। কিন্তু একে পুরোপুরি উন্মুক্ত ছবি হয়তো এ-কারণেই বলা যাবে না যে, এখানে দর্শক খুব মৌলিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন না, নিজের সৃজনশীলতা দিয়ে ছবিটিকে বদলে দিতে পারেন না!

যে প্রশ্নটি করাই যেতে পারে তা হলো, কেন এরকম ভীষণরকম প্রযুক্তিপরায়ণ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রামাণ্যচিত্রকে নিয়ে ফেলতে হবে? আসলে ফেলতে না চাইলে কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ প্রশ্নটি খানিকটা চলচ্চিত্র আবিষ্কারের পরে উত্থিত কিছু সংশয়বাদী প্রশ্নের মতোই শোনাচ্ছে না কি? কেন আমরা নাটক ছেড়ে এরকম জটিল আড়ম্বরপূর্ণ একটি মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হব, লিখিত ভাষ্য বা সাহিত্যের ন্যারেটিভ ছেড়ে চলমান ছবির ফ্যাশনকে কেন আমরা গ্রহণ করব? অথবা প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয়তাবিষয়ক তর্ক উঠতে পারে, আমরা ভাবিত হতে পারি প্রযুক্তির নতুন সৃজনশীল সম্ভাবনা বনাম পণ্যের অভাব সৃষ্টি করার ক্ষমতা প্রসঙ্গে। কিন্তু এসব আলোচনা, এই লেখাকে কোনো গ্রহণযোগ্য দৈর্ঘ্যের বাইরে নিয়ে যাবে। আমরা সেই বিস্তৃতির দিকে না গিয়ে কয়েকটি মামুলি পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করতে পারি। চলচ্চিত্রনির্মাতা লোয়া ভোসেন দর্শকের দেখার অভ্যাস পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা সক্রিয় চলচ্চিত্র-দর্শক নিয়ে ভাবছি অনেক দিন থেকেই। অন্যদিকে কম্পিউটার প্রযুক্তি মানুষকে নতুন এক সক্রিয়তা দিয়েছে। এই ডিজিটাল সক্রিয়তায় মানুষ তার কর্মের জগৎকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারছে। সেটা গেম খেলার ক্ষেত্রে হতে পারে, যোগাযোগের ক্ষেত্রে হতে পারে, মতামত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হতে পারে, দেখার এবং দেখানোর ক্ষেত্রে হতে পারে। চলচ্চিত্র ইন্টারঅ্যাকটিভ হয়ে উঠে এই সক্রিয়তাকে ধারণ করতে পারে। একজন চলচ্চিত্র দর্শক, চলচ্চিত্রের ব্যবহারকারী হয়ে একজন অ্যাকটিভিস্ট, একজন ভলান্টিয়ার, একজন সৃজনশীল মানুষ হয়ে উঠতে পারেন। আমরা চলচ্চিত্রের দর্শকের এই র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তন চাই তো, তাই না? দ্বিতীয়ত, একটি চলচ্চিত্র ইন্টারঅ্যাকটিভ মোডে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার যদি একটি ডাটাবেজ তৈরি করা যায় তাহলে সেটি নির্মাতার জন্য হয়ে উঠতে পারে ভীষণরকম উদ্দীপনাময়। একটি চলচ্চিত্র জন্ম দিতে পারে একাধিক চলচ্চিত্রের কনটেন্ট, এমনকি ফর্মের। তৃতীয়ত, ক্রীড়াময় এই কাঠামোটি সহজে প্রবেশ করবে এমন মানুষের মধ্যে, যাঁরা এই চলচ্চিত্রের সম্ভাব্য দর্শকের তালিকায় হয়তো ছিলেন না। কেননা তথাকথিত স্বাধীন নেভিগেশন এবং কুইজভিত্তিক নেভিগেশন এখন কম্পিউটার গেমসের ফরম্যাট। এই ফরম্যাটটি স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল সৃষ্টি করবে, আগ্রহী করবে অনেক অপ্রস্ত্তত অথবা তৈরি নন এমন ব্যবহারকারীকে। কিন্তু নেভিগেশনের প্রক্রিয়ায় তাঁরা অভিজ্ঞ প্রামাণ্যচিত্র-দর্শক হয়ে উঠবেন, আশা করা যেতেই পারে। চলচ্চিত্রের নতুন যে দর্শক, তাঁরা নানা ব্যক্তিগত ডিভাইসে আগামী দিনে ছবি দেখবেন – লিখেছি আগেই। যোগ করি, এই দর্শকেরা বয়সে তরুণ এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির দক্ষ ধারক, ব্যবহারকারী। তাঁরা চলমান ছবিকে নানাদিক থেকে তাঁদের জীবনের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন; সিনেমাকে তাঁরা এসব ব্যবহারেরই আরেকটি অধ্যায় হিসেবে পেতে চাইবেন।

ম্যানোভিচ নিউ মিডিয়ায় দুটি স্তরের কথা বলেছেন। একটি সাংস্কৃতিক স্তর এবং অপরটি কম্পিউটারের স্তর। তাঁর মতে, নিউ মিডিয়া ডকুমেন্টারি হচ্ছে সাংস্কৃতিক স্তর এবং কম্পিউটারের স্তরের মধ্যে এক ধরনের ট্রান্সকোডিং। নির্মাতা ও দর্শক ইন্টারঅ্যাকটিভ মোডে প্রতিটি সক্রিয়তার ভেতর দিয়ে এই ট্রান্সকোডিংকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। কিন্তু আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে কম্পিউটার স্তরের সঙ্গে একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ইন্টিগ্রেশনের। চলচ্চিত্রনির্মাতার যে মননশীলতা এবং বিষয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা তার সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির সংবেদন এবং সীমাবদ্ধতার সঠিক সংশ্লেষণের এবং এই প্রযুক্তির যথাযথ বি-রহস্যীকরণের এই চ্যালেঞ্জের দুরূহতম অধ্যায়।

একজন লেখক দেখাচ্ছেন যে, আমরা নিউ মিডিয়ার কথা বলে যে নন-লিনিয়ার, ডাটাবেজ ডকুমেন্টারির কথা বলছি তা আসলে পৃথিবীর প্রথম সফল প্রামাণ্যচিত্রেই সম্পন্ন করা গিয়েছিল। তিনি বলছেন জিগা ভের্তভের ম্যান উইথ আ মুভি ক্যামেরার কথা। তিনটি পৃথক দৃশ্য-মন্তাজ : ১. একজন ক্যামেরাম্যান ছবিটির জন্য ম্যাটেরিয়াল শুট করছেন এবং একজন সম্পাদক ছবিটির দৃশ্যাবলির মন্তাজ তৈরি করছেন, ২. দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে বসে ছবিটি দেখছেন এবং ৩. মস্কো, রিগা ও কিয়েভে একটি দিনের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দৃশ্যাবলি। লেখকের মতে, এভাবে চলচ্চিত্রটিতে একটি অ-একরৈখিক, বহুস্তরবিশিষ্ট, ওপেন-এন্ডেড ন্যারেটিভ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই ম্যান উইথ আ মুভি ক্যামেরা হতে পারে ডাটাবেজ ডকুমেন্টারির এক সেরা উদাহরণ। আমরা এই লেখায় প্রথম থেকেই দেখিয়ে আসার চেষ্টা করছি যে চলমান ছবি, বিশেষত প্রামাণ্য ছবি মিডিয়া আর্টের একটি কেন্দ্রীয় উপাত্ত, প্রেরণা। সুতরাং আজকের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সম্ভবত এই জায়গাটি ছেড়ে দিতে চাইবেন না। আর এ তো কেবল জায়গা ছাড়ার বিষয় নয়, নিজের অভিব্যক্তির নতুন সম্ভাবনাকে ধারণ করারও বিষয় – যা সৃজনশীল মেধাকে উদ্দীপ্ত করতে বাধ্য। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রামাণ্যচিত্রের যে নিরীক্ষার কথা লিখেছি আগেই সেরকম একটি নিরীক্ষা এখন চলছে ম্যান উইথ আ মুভি ক্যামেরা ছবিটিকে নিয়েই। একটি ওয়েবসাইটে দর্শককে এই ছবিটির বিভিন্ন দৃশ্য নিজের মতো ব্যাখ্যা করে তার সঙ্গে নিজের তৈরি করা অংশ যোগ করতে বলা হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন এই ছবিটির নতুন এক বা একাধিক সংস্করণ তৈরি হচ্ছে।

৪. কিছু পুরনো ও আপাতত শেষ কথা

সবশেষে কিছু রক্ষণশীল প্রসঙ্গ। শুরু করি আবারো নিউ মিডিয়া তাত্ত্বিক লেভ ম্যানোভিচের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে। ‘A hundred years after cinema’s birth, cinematic ways of seeing the world, of structuring time, of narrating a story, of linking one experience to the next, have become the basic means by which computer users access and interact with all cultural data. In this respect, the computer fulfills the promise of cinema as a visual Esperanto — a goal that preoccupied many film artists and critics in the 1920s, from Griffith to Vertov. Indeed, today millions of computer users communicate with each other through the same computer interface. And in contrast to cinema, where most ‘users’ are able to ‘understand’ cinematic language but not ‘speak’ it (i.e., make films), all computer users can ‘speak’ the language of the interface. They are active users of the interface, employing it to perform many tasks : send e-mails, organize files, run various applications, and so on.’

ম্যানোভিচ বলতে চাইছেন চলচ্চিত্রের আদিলগ্নে সবচেয়ে সৃজনশীল কর্মীরা তাঁর যে ভূমিকার কথা কল্পনা করেছিলেন আজকের কম্পিউটার প্রযুক্তি সেই ভূমিকাটিকেই গ্রহণ করেছে। সুতরাং তর্ক করা যেতেই পারে যে, চলচ্চিত্র এই প্রযুক্তিকে ধরে যদি এগিয়ে যায়, তাহলে তার অভীষ্ট লক্ষ্যেই পৌঁছুবে মাত্র। ম্যানোভিচ বলেছেন, চলচ্চিত্রের ভাষা মোটামুটি সকলে বোঝে কিন্তু সকলে বলতে পারে না; অর্থাৎ সকলে চলচ্চিত্রনির্মাতা নয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি সকলকে চলচ্চিত্রনির্মাতা হবার একটি কাঠামোগত সুযোগ অন্তত করে দিচ্ছে। ব্যক্তিগত চলচ্চিত্র তো এখন দারুণ আলোচিত, উত্তেজনাকর বিষয়। অপরদিকে ম্যানোভিচ দেখাচ্ছেন যে, কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা   অন্তত যে ইন্টারফেসের ভেতর দিয়ে কম্পিউটার কথা বলে তাকে ব্যবহার করতে পারেন। কথাটি সত্য। কিন্তু এই ইন্টারফেসটির ব্যবহারযোগ্যতা ভীষণভাবে নির্ভর করে এর নির্মাতার ওপর। কম্পিউটারের মাধ্যমে কথা বলার যে বিশ্বজনীনতার কথা ম্যানোভিচ বলছেন, সেখানে ভাষার ব্যবহার, ভোকাবুলারি, নেভিগেশনের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান, মানুষ। অনেক সময় সৃজনশীল মানুষের জন্য সেটা এক বড় বাধা বটে। আমরা বরং কাজ করতে চাই এমন মেটা ল্যাঙ্গুয়েজ নির্মাণের ওপর, যেটার মাধ্যমে একজন সৃজনশীল ব্যবহারকারী – হয়তো একজন চলচ্চিত্রকার, অনেক বেশি স্বাধীনতা নিয়ে কম্পিউটারের শক্তিকে ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি তাঁর নিজস্ব ফাংশন, রুটিন লিখে নিতে পারবেন সহজ ভাষায়, তিনি নিজের ডাটাবেজ কোয়েরি বা প্রশ্ন লেখার জন্য সহজ একটি কোয়েরি ল্যাঙ্গুয়েজ আশা করবেন। আজকের বিশ্বের অনেক ভিজুয়াল আর্টিস্ট কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে থাকেন তাঁর অভিব্যক্তি নির্মাণের জন্য। তাঁদের যোগ্যতাকে সাধুবাদ জানাই এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করি। কিন্তু মনে করি, ক্রিয়েটিভ এনার্জির বেশির ভাগটা শিল্পের আবহ নির্মাণে নিয়োজিত হয়ে যাচ্ছে না তো? বরং প্রোগ্রামিংয়ের বি-রহস্যীকরণ প্রয়োজন এখন; ইন্টারফেসের গণতন্ত্রায়ন তো বটেই, ইন্টারফেস নির্মাণেরও গণতন্ত্রায়ন প্রয়োজন। আমি এ কথাগুলি নিউ মিডিয়া আর্টের আঙ্গিকগত প্যারাডাইমের ভেতর চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে বলছি।

চলচ্চিত্রের ভাষা বলে কিছু একটার অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করি এবং অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অনুভব করি। চলমান ছবিকে উপাত্ত হিসেবে নিয়ে গ্রিফিথ, আইজেনস্টাইন, ভের্তভ, স্ট্রহাইম, রেনোয়া, ত্রুফোর মতো নির্মাতারা অথবা আন্দ্রে বাঁজা, ক্রিশ্চিয়ান মেটজ, ডেভিড বোর্ডওয়েল বা জোসেফ অ্যান্ডারসনের মতো তাত্ত্বিকেরা মিলে চলচ্চিত্রের ভাষার বিভিন্ন রূপের একটি প্যারাডাইম সৃষ্টি করেছেন। কখনো এটি কাজ করেছে নির্মাতার দৃষ্টিকোণ থেকে, কখনো চলচ্চিত্রের পাঠের দৃষ্টিকোণ থেকে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে সক্রিয় চলচ্চিত্র-দর্শক বা ব্যবহারকারীকে মাথায় রেখে নতুন চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্বের কথা বলছেন নতুন চলচ্চিত্রচিন্তকরা। একথা এখন বলা হচ্ছে যে, ‘Distinctions between passive and active viewing in contemporary, or more specifically, postmodern cinema, are incompatible with ways of seeing, or spectating, that contemporary culture employs.’ নিউ মিডিয়া আর্ট যে নতুন প্রামাণ্যচিত্রের সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে তাকে কিন্তু এসব বিবেচনা থেকে রেহাই দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এসব তত্ত্বের পেছনে আছে সোয়াশো বছরের চলচ্চিত্র সৃষ্টির এবং দর্শনের অভিজ্ঞতা। আমরা মনে করতে পারি ২০০৮ সালের ইসরাইলি প্রামাণ্যচিত্র অলট্জ উইথ বাশিরের কথা। পরিচালক আরি ফোলম্যান। ১৯৮২ সালের লেবাননের যুদ্ধ এর বিষয়। আরি ফোলম্যানের বয়স তখন উনিশ। তিনি ছিলেন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এক পদাতিক সৈনিক। এই যুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ, প্যালেস্টাইনি রিফিউজি ক্যাম্পে ক্রিশ্চিয়ান মিলিশিয়াদের গণহত্যা এবং তাতে ইসরাইলি বাহিনীর সহায়তা – এসব বিষয়ে এই ছবি তাঁর এক আত্মানুসন্ধান। যে সত্যকে তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন সে সত্যকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা। এটি একটি ফিচার লেন্থ ডকুমেন্টারি, যেটি পুরোটাই, সামান্য কিছু ফুটেজ ছাড়া, অ্যানিমেশন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এতে
বাস্তবধর্মী গ্রাফিক্স, পরাবাস্তব দৃশ্যাবলি, ধ্রুপদী সংগীত, আশির দশকের জনপ্রিয় সংগীত সবই ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছবি বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ মিডিয়া আর্টের বহু উপাদানকে ব্যবহার করেও চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞ রুচির চাহিদা মেটাতে পেরেছে ছবিটি। এসব কথন নিশ্চয়ই খানিকটা মৌলবাদী শোনাচ্ছে তখন, যখন বলা হচ্ছে, নিউ মিডিয়া আর্ট শিল্প-মাধ্যমের ধারণারই কবর রচনা করেছে। আমরা এই বক্তব্যকে তাত্ত্বিকভাবে খন্ডন করতে চাই না। মানুষের শিল্প-অভিজ্ঞতা এবং সংবেদন সফল শিল্পের সংজ্ঞা নির্মাণ করবে, সময়ের মাত্রাকে ধারণ করেই – আর এতেই আমাদের আস্থা।

সবশেষে প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে আমার প্রিয় একটি প্রসঙ্গ। ভাবতে ভালোবাসি, প্রামাণ্যচিত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক বা ব্যক্তিগত যা-ই হোক না কেন, সে সত্যে পৌঁছুতে চায়। আর এই যাত্রায় বাস্তবতা হচ্ছে তার বাহক। অথচ বাস্তবতা একটি আপেক্ষিক বিষয়, ব্যক্তি এবং সময় যার প্যারামিটার। কিন্তু তবুও এই যাত্রাতেই, সত্য অনুসন্ধানেই প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতার মুক্তি। এই বিবেচনা ভ্রান্ত নয়, এমনকি এইসব ভীষণ বদলে যাওয়া বাস্তবতার ধারণার মধ্যেও। প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতা আমান্দা লিন কস্তা লিখছেন, ‘Today’s documentary filmmakers, exhibiting a strong postmodernist self-awareness of the blurred and murky lines crisscrossing vérité and agenda filmmaking, are more inclined to believe that, like beauty, truth is in the eye of the beholder.’

তাঁর, প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতার, দৃষ্টিক্ষেপের মধ্যেই তাহলে সত্যের আবাস। নিউ মিডিয়া আর্ট প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতাদের এই অশেষ সত্য-যাত্রায় অনুপ্রাণিত করবে – এই আশা করা যাক।

নভেম্বর ২০১৩, মে ২০১৪

 সহায়ক সূত্র

From Celluloid to Cyberspace : The Media Arts and the Changing Arts World : Kevin F McCarthy, Elizabeth Heneghan Ondaatje

New Media Documentary : Playing with documentary film within the database logic and culture : Ersan Ocak

6 Filmmakers Talk About Documentary Films in the Digital Age : Amanda Lin Costa

Database Documentary : From Authorship to Authoring in Remediated/Remixed Documentary : Hart Cohen

http://thecreatorsproject.vice.com/blog/the-6-most-innovative-interactive-web-documentaries

[এই লেখাটি ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ আয়োজিত প্রামাণ্যচিত্র উৎসবের সেমিনারে উপস্থাপিত নিবন্ধটির পরিবর্ধিত রূপ]

 

Leave a Reply